মা
আজ সকাল থেকেই প্রভার মনটা বড়ো খারাপ । বড়ো ছেলে আর বৌমা আলোচনা করছিল মা মরে গেলে এই ঘরটা পেলে ওদের ভারী সুবিধে হবে।এমনটাও কানে এলো-“এখনো কতদিন কে জানে?”
ওফ! আগে যখন সবাই বলতো-“তোমার পাঁচ ছেলে !মেয়ে নেই,কত ভাগ্যবতী তুমি!”শুনে শুনে তিনিও তেমনটাই ভাবতেন বৈকি ! আনন্দের একটা চোরা-স্রোত বইতো বুকের ভেতর।আর এখন সে সৌভাগ্যের বহর তো প্রতিনিয়ত টের পান।
যখন ছেলেরা ছোটো ছিল ,এতটুকু অবসর নেই।তাড়াতাড়ি কাজ,রান্না সেরে বেরোতে হবে!তার মধ্যেই যখন উনি আর প্রভা পাঁচ মিনিট একসাথে বসে চা টুকু খেতেন। তারপর তো আগে পরে খেয়ে নিয়ে বেরোনো।বাচ্চাদের এতটুকুও অযত্ন হতে দিতেন না কখনোই,আর আজ!বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে প্রভা দেবীর।সমস্ত কিছুর বিনিময়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন।এত দুঃখেও হাসি পেয়ে গেল তার, না বড়ো করেছেন,প্রতিষ্ঠিত করেছেন সেকথা ঠিক কিন্তু মানুষ করতে পারেন নি।
এখন তিনি শয্যাশায়ী।সকলের বোঝা! সবাই বলতো প্রভা পরকে আপন করতে পারে।হায়রে! আপনকে আপন করে ধরে রাখতেই পারলো না সে।যখন সুস্থ ছিলেন লোকের বিপদে আপদে পাশে থেকেছেন।তাঁকে দেখতে তাদের কেউ কেউ এলে বৌমারা ভারি বিরক্ত হয়।তার এই আশী বছর বয়সে ডাক্তার দেখাতে চাইলে বলে এ বয়সে অমন হয়।না ঘরটা খালি না হলে তার বড়ো ছেলের ভারী অসুবিধা!কিন্তু মরণও হয়না যে ! উপায় ভাবতে লাগলেন।
বিছানার উপরেই তার খাবার রাখার ছোট টুলটা রয়েছে না!যে করেই হোক বড়ো ছেলের মুখে হাসি ফোটাতেই হবে তাকে।বুকের ভেতর তাকিয়ে দেখলেন দশ বছর আগে উপরে চলে যাওয়া মানুষটির মুখখানি।ঈশ্বরকে স্মরণ করে ক্ষমা চাইলেন। চারদিন আগে শেষ পেনশন পেয়েছেন।বালিশের তলায় রাখলেন সেই টাকা ।আরেকটি স্বীকারোক্তি, অন্যদের দায়মুক্ত করার।বুকের ভেতর একটা মোচড়ানো ব্যথা পাক দিয়ে উঠলো। শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে উঠে দাঁড়ালেন টুলের উপর। পড়ে যাচ্ছিলেন কিন্তু না! মনে জোর আনলেন, পরনের শাড়ীতে ফাঁস লাগিয়ে ছুঁড়ে ফেলেন ফ্যানের দিকে।দুবারের চেষ্টায় আটকে ফেললেন। শাড়ির অন্য প্রান্তে ফাঁস লাগিয়ে দুচোখ বন্ধ করে গলায় পরে নিলেন, পায়ের তলার কাঠের টুলটা পা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিলেন। হ্যাঁচকা টান পড়লো। কি প্রচন্ড কষ্ট!যন্ত্রনায় দমবন্ধ হয়ে আসছে।জিভটা বেরিয়ে পড়েছে। ঠোঁটের পাশ দিয়ে কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো খানিকটা রক্ত । প্রবল যন্ত্রণার চোটে চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়, খানিক ছটফটিয়ে নিস্পন্দ দেহটি ঝুলে পড়লো। ঘর খালি করে দিলেন তিনি বড়ো ছেলের জন্য।