মায়ের আর্তনাদ
আকাশে ঘনঘটা —–সুনসান রাস্তা—–সব বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ—-কোনো গাড়ি ও চলাচল করছে না।
বীণাপানি দেবীর ছেলেকে কে বা কারা বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে—কে বা কারা মেরেছে—- সকলের জানা—–সবার প্রাণের ভয় আছে—-আজ পাড়ায় লক ডাউন চলছে—-শুধু এক মায়ের ও এক শিশুর কান্না ভেসে আসছে।
বীনাপানির সংসার
বীনাপানির চার ছেলে—কমল ও বীনাপানির—- সুখের সংসার।
বড় ছেলের বয়স ঊনিশ কি কুড়ি—- এক গরীবের বারো বছরের মেয়ের সাথে বিবাহ দেন—-আগে তো আঠারো ও একুশের ব্যাপার ছিল না—-বৌমা শ্বশুরবাড়ি এসে লেখাপড়া শেখে।
বীনাপানির মেজ ছেলে বুড়ো—-সবে স্কুল গন্ডি পার করেছে—-তখন কিছু পাড়ার বকাটে ছেলের সাথে আলাপ হয়—-এই বয়সে ভাল মন্দের বিচার হয় না—- বুড়োর জানা ছিল না—–এই নবাগত বন্ধুরা কি কি কাজ করতে পারে????
একদিন বীনাপানির বাড়ি পুলিশ আসে— বুড়ো কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ধরে নিয়ে যায়—–সব নবাগত বন্ধুদের গতিবিধি জেনে বুড়োকে ছেড়ে দেয়—-আর পুলিশরা বুড়োকে বলে —-তুমি মাষ্টার মশাইয়ের ছেলে—–ওদের সাথে মিশবে না—–আসলে ওরা ডাকাত—–গতকাল ওরা ব্যাঙ্ক ডাকাতি করেছে——বুড়ো ভয় পেয়ে আবার পড়াশুনায় মন দেয়।
বুড়ো কলেজে ভর্তি হয়—–এক সহপাঠিকে হঠাৎ বিয়ে করে—-বাড়ির কেউ জানে না—–।
বাড়িতে জানাবে কি?
তখনো বুড়ো পড়ছে—চাকরি করে না—-।বীনাপানি জানতে পারে ,——যেদিন বুড়োর মেয়ে জন্মাতে গিয়ে বুড়োর স্ত্রী মৃত্যু শয্যায়—বুড়োর বউ মারা যাওয়াতে পাগল পাগল অবস্থা হয়—-বীনাপানি তখন ঐ সদ্যোজাত মেয়েকে বড় বৌয়ের হাতে তুলে দেয়—-বড় বৌয়ের ও বাচ্চা ছিল না—-
মাতৃস্নেহে মানুষ করে।
বীনাপানির চার ছেলে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়—মেজ ছেলে বিভিন্ন চাকরি ধরে,ছাড়ে— অবশেষে ব্যাঙ্কে চাকরি পায়—-কয়েকদিনের মধ্যে বোম্বাই ,এখনকার মুম্বইয়ে পোস্টিং—–বাড়ির সকলের খুব আনন্দ।
নকশাল পিরিয়ডের সময়—–চারদিকে মারামারি, কাটাকাটি ,গোলাগুলি চলছে—-
মেয়ে জন্মাবার দিন থেকে কোনদিন মেয়েকে কাছে ডাকে নি—অল্প বয়সের প্রেম—ঐ মেয়ে জন্মাতে গিয়ে বৌয়ের মৃত্যু মেনে নিতে পারে নি।
বুড়োর কি হয় যেন —মেয়েকে ডেকে আদর ও করে—বুড়োর নীল ষষ্ঠীতে জন্ম—-ঐ দিন মা পায়েস করেছে—পরদিন বোম্বে চলে যাবে বলে —-কলেজের কটা বন্ধু বুড়োকে বলে আজ পার্টি দে।
এই সকালে কি খাবি তোরা—আরে…চল বলে বুড়োকে টানতে টানতে নিয়ে যায়—-
বন্ধুরা বলে আমরায় খাওয়াব।
বীনাপানি বলে ওরে পায়েসটা খেয়ে যা।তাছাড়া ঝড় বৃষ্টি হবে—ভিজলে শরীর খারাপ করবে।
কিছুক্ষণ পর বীনাপানি পুজা করছে—-তখন শুনতে পাই গুলির শব্দ—-পরপর সাতটা গুলি—-বীনাপানি ভাবে কার তাগরায় ছেলেকে মারল —-যে সাতটা গুলি করল—-ব্যাপারটা খুব কাছেই হচ্ছে।
তাছাড়া বুড়ো যে বার হলো।সাথেই কড়কড় করে বাজ।বাজের শব্দ তার সঙ্গে বন্দুকের গুলির আওয়াজ—-
পূজা শেষ করে জানালা খুলে যা দেখে সে তো কোন মা সহ্য করতে পারবে না।
তারই বুড়োকে বাড়ির লাইট পোস্টে বেঁধে ঐ পাড়ার বকাটে ছেলেরা গুলি করছে—-ওরে ও তো মরে গেছে ওকে আর গুলি করিস না…….।
ও কাকু গো—তোমরা বাবাকে মের না–আজ আমার বাবার জন্মদিন—জান কাকুরা আজ আমার পাঁচ বছরের জীবনে প্রথমবার বাবা আদর করেছে।
এই যে মাসী..মা আপনি কিছু দেখেন নি।আপনার ছেলেকে আগেই খালাস করতাম।আমাদের নামে পুলিশের কাছে নালিশ করা।কাল রাতেই জেল থেকে ফিরেছি।মা আর্তনাদ করে বলে তোদের বিচার ভগবান করবে।
সেই থেকে প্রতি নীলের পূজায় ছেলেকে থালা সাজিয়ে বীনাপানি খেতে দেন।আর কোনদিন পূজা করত না।বীনাপানি ছেলে মারা যাবার আগে ঘন্টার পর ঘন্টা ঠাকুর ঘরে কাটাত।
বীনাপানি র মত কোন মা বাবার যেন চোখের সামনে সন্তানের মৃত্যু যেন দেখতে না হয়।
কোনো সন্তানকে যেন এই নিষ্ঠুরভাবে আপনজনের হত্যা যেন দেখতে না হয়।
আজ এই ছবিটি দেখে সেই মৃত্যুর কথা
মনে পড়ে গেল।সে যে আমার অতি পরিচিত ছিল।
লেখনি… সমর্পিতা দে রাহা