মামন : পর্ব – ৯ (Mamon)
রাতে বাড়ি ফিরল সবাই একসাথে। সবাই থম মেরে আছে। বাড়িতে এসেই মহেশ সব কাজের লোকদের ছুটি দিয়ে দিল, ব্যতিক্রম সুভদ্রা, ও ছাড়া বর্ষাকে দেখার কেউ নেই। পিঙ্কি এসে থেকেই মামনকে তুমুল গালমন্দ করছে। মহেশ অনেকবার থামতে বললেও থামেনি। একসময় কাবার্ড থেকে মদের বোতল আর গ্লাস বের করে খেতে শুরু করে দিল। মামন চুপ করে বসে, বলা ভাল পিঙ্কি ওকে বসে থাকতে বাধ্য করেছে, সব দেখছে আর গালাগাল খাচ্ছে, ভাবছে তার এ জন্মের পাপ না গত জন্মের পাপ, যার জন্য ঈশ্বর তাকে এইসব পরীক্ষাতে বারবার ডেকে নিচ্ছেন। মহেশ আর যাই করুক মদ একদম ছোঁয় না, সিগারেট আর মাঝেমধ্যে খৈনি। মহেশ পুরো নাটকটা দেখতে দেখতে হটাৎই উঠে গেল, ফিরে এল একটু পরে ,কোলে বর্ষা। বর্ষাকে মহেশ খুব ভালোবাসে, এইটা আবার পিঙ্কি সহ্য করতে পারে না। এনেই টেবিলে বর্ষাকে বসিয়ে পিঙ্কির হাত টেনে বলল আগে একে বারান্দা থেকে নিচে ছুঁড়ে ফেলে মেরে দাও তারপর ওর মাকে ঘর থেকে বের করবে। পিঙ্কি এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। থতমত খেয়ে বলল সে কেন শিশুহত্যার পাপ নেবে। মহেশ সুভদ্রাকে ডেকে বর্ষাকে পাঠিয়ে দিয়ে শুরু করল তুমুল গালাগাল। মূল বক্তব্য অসহায় মহিলাকে তার শিশু সন্তান সহ বের করা কি অপরাধ নয়, পিঙ্কি লেখাপড়ার দাম কি বুঝবে, আজ গুলাটি যে সোসাইটির সেখানে তওয়াইফ যদি অশিক্ষিত হয় তার স্থান হয় না। কোঠিবাড়ির মেয়েদের সোসাইটি ওই বাড়িটাই। সঙ্গে চলল বাছা বাছা বিশেষণ। রাণাও খিস্তি দিত কিন্তু মামন এই ধরনের খিস্তির সঙ্গে পরিচিত ছিল না। ওর গা গোলাতে লাগল, মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে ছুটে বাথরুমে চলে গেল। বমি হল না, তবে কান মাথা ঝিমঝিম করছে, ঘুরছে, টলমল পায়ে ঘরে এসে শুয়ে পরল। অনেকক্ষণ বাদে সুভদ্রা এসে বলল সাহেব তাকে ডাকছে। ড্রইংরুমে এসে দেখল পিঙ্কি পুরোদস্তুর মাতাল, বসেই থাকতে পারছে না। মহেশ ফোন করে দুজন কাজের মেয়েকে ডেকে পিঙ্কিকে ঘরে নিয়ে যেতে বলল আরও বলল পিঙ্কির ড্রেস যেন ওরাই বদলে দেয়। ওই বাড়িতেই একতলায় কাজের লোক আর ড্রাইভাররা থাকত। ওরা চলে যেতে মহেশ মামনকে গম্ভীর গলায় নির্দেশ দিল পোষাক বদলে খাবার ঘরে আসতে, পিঙ্কি যা অবস্থা ও আজ খেতে পারবে না। ওরা দুজনেই খাবে। মামনের ওপর আজ সকাল থেকে যে ঝড় বয়ে গেছে তার জন্য তার খাওয়ার ইচ্ছেটা চলে গেছে। সেকথা বলতে মহেশ আরও কঠিন স্বরে নির্দেশটা ফের দিল। আধঘন্টা বাদে কোনও রকমে একটা রুটি সবজি দিয়ে খেয়ে মামন ঘরে চলে এল, দেখল সুভদ্রা বর্ষাকে নিয়ে বসে আছে। মামন ওকে নিলে সুভদ্রা খেয়ে আসবে। মা আর মেয়ের এই একঘন্টা গল্প ,খুনসুটি, মান অভিমান সব চলে। তারপর বর্ষা ঘুমিয়ে গেলে সুভদ্রা বর্ষাকে নিয়ে শুতে চলে যায়। মা মেয়ে রাতে এক খাটে শোয় না, আজও তার ব্যতিক্রম হল না, এটাও পিঙ্কির আদেশ।
রাত গভীর, মামনের চোখে ঘুম থাকলেও অবসন্ন মনে একটানা নিজের ভাগ্যের কথা ভেবে চলেছে। এমন সময় দরজায় হালকা টোকার আওয়াজ, মামন চমকে উঠল, তার চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল, ফের টোকার আওয়াজ, কে হতে পারে ! সুভদ্রা তো এমন ভাবে ডাকে না ! মামন উঠে ঘরের আলো জ্বালিয়ে দরজা খুলতেই মহেশ বলে উঠল হাজার ঝড়ের মধ্যেও যে মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করে সেইই পারফেক্ট মানুষ, মামন দরজা বন্ধ কেন করেছিল,সকালেই তো কথা হয়েছিল সে আসবে রাত একটার পরে ! মামন লজ্জিত হল, আমতা আমতা করে বলল আসলে তার যেভাবে সারাদিন কাটল তার ফসল দরজা বন্ধ রাখা। মহেশ একটু হেসে মামনের হাতটা ধরে ভেতরে নিয়ে এল দরজায় ছিটকে লাগিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে মামনের রূপালীর কথাগুলো মনে এল , মহেশ তাকে কেন এতদিন ভোগ না করে রয়েছে সেটাই অস্বাভাবিক। মামনের বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল, তবে আজকেই কি সেই দিন। দুজনে খাটে বসল। মহেশ পকেট থেকে প্যাকেট বের করে একটা সিগারেট ধরাল। মামন চুপ করে মহেশকে দেখে চলেছে। কি অদ্ভুত নির্লিপ্ত থাকতে পারে লোকটা অথচ যার একমাত্র ধ্যান জ্ঞান অর্থ আর মহিলাদের ভোগ করা। সাতপাঁচ মামন ভাবল না, ভেবেই বা সে কি করবে। তার আর নতুন করে হারাবার কিইই বা আছে। মামন মনে মনে প্রস্তুত হতে থাকল মহেশ আমন্ত্রণের। একে তার মনের জন্য শরীর অবসন্ন তার ওপর যদি বাধা দেয়, এই বাঘের মত লোকটার কাছে সে আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে। অতএব………..।
সিগারেটে তিন চারটে সুখটান দিয়ে মহেশ মামনের দিকে তাকিয়ে বলল , সে কেন ডেকেছিল, এইবার যেন মামন বলে। আলোচনার জন্য যদি সারারাত কাটে তো কাটুক, কাল মামনের ছুটি। শুরু করে দিক মামন। মামন আদ্যোপান্তো বলে দিল, এমনকি গুলাটি ওকে শেষ যে বার্তা দিয়েছে সেইটা বলে বলল তখন সে কি করবে, তার মেয়ে বড় হয়ে উঠছে তারই বা কি হবে ?
মহেশ সব শুনে শুরু করল তার গল্প। ওদের আদি বাড়ি জব্বলপুরের কাছে একটা বর্ধিষ্ণু গ্রামে। ওদের এক পূর্বপুরুষ মোঘলদের কাছ থেকে জায়গীর পেয়েছিল , দেশ স্বাধীন হবার পরে সরকার অনেক কিছুই কেড়ে নিলেও আজও যা সম্পত্তি আছে তা ভাঙিয়ে আগামী দশটা প্রজন্ম কিছু কাজকর্ম না করেই বসে বসে খেতে পারবে। ওদের পরিবারের গুণ দোষ দুটোই আছে। বেশ্যাখানাতে যাওয়া বা বাঈজি বাড়িতে যাওয়া তাদের নিত্যকর্ম। তবে ওদের পরিবারে মদ খাওয়া কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ কূলদেবতা শ্যামের জন্য। মহেশ কোনও রকমে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করলেও ব্যবসার জন্য তাকে ইংরাজি আলাদা করে শিখতে হয়েছে, সেখানে সুমঙ্গলা …..
মামন থামিয়ে বলল সে সব জানে , এইসব শুনে তার কি হবে, তার প্রশ্নের উত্তর তো এগুলো নয় ! মহেশ একটু হেসে মামনের হাতের তালুতে একটা আলতো করে চুমু খেয়ে বলল সব বলবে আগে তো উত্তরের কারণ মজবুত করতে হবে, মামন যেন একটু ধৈর্য্য ধরে। অগত্যা …..। মহেশ ফের শুরু করল , মামন যে পিঙ্কির ব্যাপারে জানে এইটা শুনে সে অবাক হয়নি। সে জানত রূপালী সব বলেছে মামনকে তবে মামন যা জানে না তা হল গুলাটির অতীত। মানে , মামন চমকে উঠল। আগের মতই হেসে আর মামনের তালুতে একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে মহেশ বলল যে গুলাটিকে কেউ বাড়ি থেকে তুলে এনে দিল্লীর এক বেশ্যাখানাতে বিক্রি করে দিয়েছিল। মহেশ দিল্লীতে কাজে গেলেই ওর বাঁধা নিয়ম মেনে রাতে ওই বাড়িতে যেত। মহেশ টাকা দিয়ে গুলাটিকে কিনে এই বাড়িতে আনে, তখন ওর ব্যবসা এত ফুলে ফেঁপে ওঠেনি। সরকারী কাজ করত মহেশের কোম্পানি, তখন জুনিয়র অফিসার ছিল আজকের এই বড়া সাব। মহেশ তাকে ঘুষ দিত, উনি কাজের বরাত দিতেন। একদিন গুলাটি পালিয়ে গেল ওনার সঙ্গে, উনি তখন আরও বড় পদে উঠে গেছেন। মহেশ ওনার সঙ্গে গুলাটিকে নিয়ে ভয় দেখাতে যাওয়া মাত্র উনি ইনকাম ট্যাক্স আর ইডি লেলিয়ে দেন। সন্ধি হয় অনেক টাকা আর গুলাটির দিকে হাত না বাড়ানোর শর্তে। ততদিনে কলকাতার ফ্ল্যাটে রূপালী এসে গেছে। এদিকে এই বাড়িটা ফাঁকা, তখন সে কলকাতা থেকে পিঙ্কিকে কিনে এখানে নিয়ে আসে। ফের সিগারেট ধরায় মহেশ। ঘড়ির ঘন্টা জানান দেয় রাত তিনটে। মহেশ ফের খেই ধরে বলতে শুরু করল , তার বাপ ঠাকুরদা যতই বেশ্যাখানাতে যাক না কেন কোন বাড়ির মহিলাদের প্রতি তাদের নজর ছিল না, তারা ঘোরতর সংসারী ছিল। বাড়ির মহিলা ও নিজের স্ত্রীদের প্রতি তারা তাদের কর্তব্য ঠিক মত পালন করেছিল। তারা বলত অন্যের ঘরের স্ত্রীদের দিকে নজর দিলে তোমার ঘরের স্ত্রীও বারবধূ হবে। মহেশ এই সংস্কার নিয়ে বড় হয়েছে। পরের কথাগুলো মামনকে চুম্বকের মত আকৃষ্ট করল। তবে কি এই সংস্কারের জন্য আজ পর্যন্ত মহেশ তাকে ভোগ করেনি ?
মহেশ বলে উঠল – চলো ঘুম পাচ্ছে, আজ আমি তোমার ঘরেই শোব, তোমার কি আপত্তি আছে ?