Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মান্ধাতার টোপ ও ঘনাদা || Premendra Mitra » Page 3

মান্ধাতার টোপ ও ঘনাদা || Premendra Mitra

পাছে তিনি ধৈর্য হারান সেই ভয়ে তাঁর মেজাজকে তোয়াজ করার সুরেই বললাম, আপনি যা বলেছেন তা যে বুঝতে পারিনি, তা ঠিক। জোচ্চোর বাটপাড় ধাপ্পাবাজ হলে তাদের ব্যবস্থা করবার জন্য তো কোর্ট কাছারি, পুলিশ আর গোয়েন্দাটোয়েন্দা আছে।

তা আছে! ঘনাদা একটু যেন হাসলেন, কিন্তু পুলিশ-গোয়েন্দারা যখন কূল পায় না, খনই তো হয় মুশকিল। ওদের হয়েছিল তাই।

ব্যাপারটা কী হয়েছিল যদি দয়া করে একটু বুঝিয়ে দেন, নবীনবাবুর সঙ্গে আমরাও মিনতি জানালাম, এ তো সাধারণ চুরি-ডাকাতি, তহবিল তছরুপ গোছের কিছু মনে হচ্ছে না, কিন্তু–

হ্যাঁ, ওই কিন্তুটাই বড় ভয়ানক, ঘনাদার গলায় একটু উৎসাহের আভাসই পাওয়া গেল এবার, সাধারণ চুরি-ডাকাতি নয়, কিন্তু আমেরিকা জার্মানি ফ্রান্সের মতো বড় বড় দেশের শেয়ার মার্কেট মানে ব্যবসার বাজারে যেন ভূমিকম্প লেগেছে। একটা ধুরন্ধর ধাপ্পাবাজ সেখানে শেয়ার বেচাকেনার এমন কারসাজি করেছে যে, তার ফাঁপানো সুদিনের খোয়াব দেখানো ফাঁপানো ফানুস হঠাৎ ফেঁসে গিয়ে একদল লোভী ফাটকাবাজারির একেবারে সর্বনাশ হয়েছে। সেই ফেঁসে-যাওয়া ফাটকাবাজারিরাই এখন দুশমনকে খুঁজছে হন্যে হয়ে। কিন্তু খুঁজলে কী হবে? ক-দিনের জন্য দুনিয়ার বাজারে দেখা দিয়ে প্যাঁচালো বুদ্ধির জোরে ছড়ানো ধাপ্পায় লোভীদেরই বেশি করে ফাঁদে ফেলে যে একেবারে খতম করে দিয়ে গেছে, তার পাত্তা আর কে কোথায় পাচ্ছে?

তা হলে? দ্বিধাভরেই জিজ্ঞেস করলাম আমরা, সেই ধুরন্ধর ধড়িবাজকে ধরার দায় শেষ পর্যন্ত আর নিলেন না?

নেবার ইচ্ছেই তো ছিল না, কিন্তুঘনাদা যেন স্বীকার না করে পারলেন না— কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেরই যে লোভ হল দুনিয়ার ধড়িবাজ চূড়ামণিকে স্বচক্ষে একবার দেখে তার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার। তাই কিংকং-এর ছোট ভাইয়ের হাতের মোচড়ে যেন ককিয়ে উঠেই তার হুকুমটা মেনে নিলাম শুধু একটা শর্তে।

শর্ত! তোর আবার শর্ত কী রে উচ্চিংড়ে, দুশমন দানোটা দাঁত খিঁচিয়ে বলল, কাজটা হাসিল করলে তোরই পছন্দ মতো হয় ডান নয় বাঁ কানটা ছিঁড়ব। এই একটা শর্ত তুই অবশ্য করতে পারিস বটে!

না, অমন অবুঝ হবেন না, যেন মিনতি করে বলেছিলাম, আপনাদের কাজ হাসিল করবার জন্যই এ-শর্তটা আমার রাখা দরকার।

বেশি বকবক করিসনি, ধৈর্য হারিয়ে কিংকং-এর ভাই ছোট কং এবার ধমক দিয়ে বলেছে, কী তোর শর্ত বলে ফ্যাল, শুনি।

এমন কিছু নয়, আমি যেন ভয়ে ভয়ে বলেছি, শর্ত শুধু এই যে, আমি আপনাদের মক্কেলকে এক বছরের মধ্যে খুঁজে বার করব ঠিক, কিন্তু আমাকে তারপর আপনাদের খুঁজে বার করতে হবে।

তার মানে? ছোট কং মানে ঘটোৎকচের দাদা রাগে রক্তচক্ষু হয়ে আমার দিকে চেয়ে এবার গর্জে উঠেছে, তুই খুঁজে বার করবি আমাদের ধুরন্ধরকে? আর তার পর তোকে খুঁজতে হবে আমাদের? এ কী উলটো-পালটা রসিকতা হচ্ছে আমাদের সঙ্গে? দেব এবার মুণ্ডুটা সত্যি উলটো দিকে ঘুরিয়ে।

ছোট কং তখনই আমায় ধরবার জন্য হাত বাড়ায় আরকী!

তার নাগালের বাইরে একটু সরে গিয়ে বললাম, মিছিমিছি রাগ করছেন কেন? আপনাদের যা আসল উদ্দেশ্য তার সিদ্ধির জন্যই এ-শর্তটা যে দরকার, তা বুঝতে পারছেন না কেন? আপনাদের মক্কেল তো বলছেন ধড়িবাজ চূড়ামণি। তাকে খুঁজে বার করে সামনাসামনি কোতল করতে গেলে আপনাদের হবে কিছু? যা আপনাদের বিশেষ দরকার, তার সেই গোলমেলে কাজ-কারবার আর লেনদেনের গোপন কাগজপত্র তখন কি আর হাত করতে পারবেন? সে আগেই সব দেবে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করে। তাই বলছি, আমি এক বছরেরই মধ্যে তাকে খুঁজে বার করবার কড়ার করছি। কিন্তু খুঁজে বার করে আমি শুধু তার ওপর নজর রাখার বেশি আর কিছু করব না। করলে সব কাজ যাবে ভেস্তে! আপনাদেরই তাই তখন আমায় খুঁজে বার করার চেষ্টা করে আপনাদের সেই ধড়িবাজের সঠিক সন্ধান পেতে হবে।

ব্যাপারটা ইচ্ছে করেই বেশ একটু জটিল গোলমেলে করে তাদের কাছে সাজিয়ে ধরেছিলাম। ঠিক মতো কিছু না বুঝলেও নিজেদের গরজে শেষ পর্যন্ত আমার শর্ত মানতে তারা আর আপত্তি করেনি।

গল্প যেন এখানেই শেষ, ঘনাদা এমনভাবে থেমে যাওয়ায় নবীনবাবুই প্রথম প্রতিবাদ করলেন, ও কী, থামলেন যে? সেই শুঁটকো চামচিকে আর কিংকং-এর ভাই ছোট কং আপনার শর্ত না হয় মেনে নিল, তাতে হল কী? ধরতে পারলেন সেই ধড়িবাজ চূড়ামণিকে? কোথায় কেমন করে ধরলেন?

ধীরে, বন্ধু ধীরে, আমাদেরই এবার নবীনবাবুকে সামলাতে হল, কোথা দিয়ে কেমন করে কী হল, শুনুনই না একটু ধৈর্য ধরে।

ধৈর্য ধরে লব? আমাদের বকুনিতে একটু যেন অপ্রস্তুত হয়ে নবীনবাবু বললেন, কিন্তু শেষ ফলটা না জানলে স্বস্তি পাচ্ছি না যে!

ও, আপনি তা হলে তাদেরই একজন, গোয়েন্দা-গল্প পড়তে শুরু করে প্রথমেই শেষ পাতাগুলো উলটে যারা অপরাধীটা কে জেনে নিতে চায়। না মশাই, ওই ধৈর্যটুকু না থাকলে বাহাত্তর নম্বরের মজলিশে বসে আপনি সুখ পাবেন না।

কেন? নবীনবাবু এবার একটু যেন গরম, এখানে গল্প তৈরি হতে হতে বুঝি বদলেও যায়? আসামি যায় পালটে?

না, তা যাবে না! নবীনবাবুর কথার প্রতিবাদে আমরা কেউ কিছু বলার আগে ঘনাদারই বাজখাঁই গলা শোনা গেল, বরং শেষ দিক থেকেই শুরু করে উজানে পিছিয়ে যাচ্ছি।

উজানে পিছিয়ে যাচ্ছি মানে? গৌর আমাদের সকলের হয়ে প্রতিবাদ না জানিয়ে পারল না, ঠিক ধারা ধরার বদলে উলটো দিক থেকে শুনে গল্পের সেই আসল মজা আর থাকবে?

থাকবে, থাকবে! আমরা সমস্বরে আশ্বাস দিলাম, এ একরকম বাহবা, বুঝেছ? যেদিক দিয়ে শুরু করো, একই দাঁড়ায়।

আমাদের যুক্তিটা জোরালো না হলেও সমর্থনটায় ঘনাদা অখুশি হলেন না বলেই মনে হল। প্রসন্ন মুখেই বললেন, তারপর ঠিক এক বছর কোনও সাড়াশব্দ আর করিনি। ঠিক বার-তারিখ ধরে একটি বছর শেষ হবার পর ছোট কং আর তার চিমসে সঙ্গী একটা চিঠি পেয়েই নিশ্চয়ই একেবারে হতভম্ব। আমাদের মতো আঠারো মাসে বছরের দেশ নয়, খাস মার্কিন মুলুকের রাজধানী ওয়াশিংটন শহরের লাগাও মেরিল্যান্ড-এ একটা পাঁচতারা হোটেল। ডাকে চিঠি দিলে সেখানে মারা যাবার কি বিলি হতে দেরি হবার কোনও ভয় না থাকলেও নিজের হাতে হোটেলের চিঠির বাক্সে আমার দুই মুরুব্বির নামের চিঠিটা ফেলেছি।

ভোরবেলা জরুরি ছাপ দেওয়া চিঠিটা ফেলেছি, সুতরাং ব্রেকফাস্টের সময়েই সে চিঠি তাদের হাতে পৌঁছেছে নিশ্চয়ই। খাম খুলে সে চিঠি পড়তে পড়তে আর সঙ্গীকে শোনাতে শোনাতে দুজনের মুখের অবস্থা কী হয়েছে দেখতে না পেলেও অনুমান বোধহয় ঠিকই করতে পেরেছি।

চিঠিটার ভাষা ছিল:

মনিব বাহাদুর, ছোট কং ও চিমসে চামচিকে মহোদয়, দেখতে দেখতে এক বছর তো হয়ে গেল। আমার কাজ তো আমি ঠিক মতো শেষ করছি, কিন্তু এখনও আপনাদের দেখা নেই কেন? কথা ছিল আমি এক বছরে আমার কাজ সারব, আর আপনারাও তখন আমায় খুঁজে নেবেন। আপনাদের শ্রীমুখ এখনও পর্যন্ত একবারও না দেখে মনে হচ্ছে, এখনও আমার সঠিক পাত্তা আপনারা পাননি। তা হোক, হতাশ না হয়ে চেষ্টা করে যান। অধ্যবসায়ে সব কিছু সম্ভব।

ইতি বশংবদ ঘনশ্যাম

এ-চিঠির পরে আবার একটু পুঃ দিয়ে লেখা:

আপনাদের ধুরন্ধর ধড়িবাজ মক্কেলকে তাড়াতাড়ি খুঁজে বার করবার একটা হদিস এখানে দিচ্ছি। মনে রাখবেন, আপনারা যাকে খুঁজছেন, সেই মক্কেল এক পাকা জাত-জুয়াড়ি। মাছের আঁশটে গন্ধ যার ধ্যানজ্ঞান, সেই বেড়ালকে যেমন মাছ কোটার হেঁশেলে, তেমনই রক্তে যার জুয়ার নেশা তেমন পাকা জাত-জুয়াড়িকে কোথায় পাওয়া যায়, একটু ভেবে দেখুন না। হ্যাঁ, স্যার, একটা কথা, আপনাদের ধড়িবাজ চুড়ামণি পাকা জাত-জুয়াড়ি, ইতিমধ্যে এই মেরিল্যান্ড-এর এক হাসপাতালে একরাশ ডলার এই কিছুদিন হল দান করেছে। এ খবরটা যাচাই করে নেবেন। ধড়িবাজ চূড়ামণিকে কিন্তু খুঁজে যান।

তা খুঁজতে তারা কি আর কিছু বাকি রেখেছে?

কিন্তু এরপর তাদের অবস্থা যা হল তা আরও করুণ ছাড়া আর কী বলা যায়!

মেরিল্যান্ড-এর হোটেলে যে চিঠি পেয়েছিল তাতে গায়ের জ্বালায় ছটফট করে তারা অ্যাটলান্টিকের এপার-ওপার হয়ে তখন মন্টিকালোয় এসে একটা ভিলাবাড়ি ভাড়া নিয়ে আছে।

মন্টিকালো নামটা উচ্চারণ করবার পর আর বোধহয় কোনও বিবরণ দিতে হয় না। হ্যাঁ, ফ্রান্সের দক্ষিণে ভূমধ্যসাগরের উপকূলে দুনিয়ার সেই জুয়াড়িদের অমরাবতী মন্টিকালো। ভাগ্যের রুলেট চাকা সেখানে এক-এক চক্করে দু-দশ লাখ নয়, অমন কোটি কোটি টাকার বরাত ঘুরিয়ে আনে কি উড়িয়ে দেয়।

ছোট কং আর তার চিমসে দাদা সেখানে ক-দিন হল এসে সমদ্রের তীরে রিভিয়েরায় একটা স্বর্গপুরীর মতো ভিলা ভাড়া করে আছে।

আছে মানে ভিলায় নয়, ঠিকানাটা তাই রেখে সারা দিন-রাত তারা সব জুয়ার ঘাঁটি ক্যাসিনো থেকে ক্যাসিনো ঘুরে তাদের মক্কেলকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এর আগে মেরিল্যান্ড-এ পাওয়া চিঠিটায় উচ্চিংড়ে সেই দাসটা লিখেছিল সারা দুনিয়ার ফাটকা বাজারে যে ধড়িবাজ সব বাঘা বাঘা কারবারি আর দালালদের ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল, সে যে আসলে একজন জুয়াড়ি, সে কথা মনে রাখতে। সে কথা মনে রাখলে সেই ধড়িবাজকে দাতব্য লটারির মজলিশে খোঁজার কোনও মানে হয় না নিশ্চয়।

কথাটা মনে ধরেছিল বলেই কং আর তার শুঁটকো সঙ্গী এদিক-ওদিক একটু ঘুরেফিরে এই মন্টিকার্লোয় এসে উঠেছে। জুয়াড়ির এমন স্বর্গ আর কোথায় আছে দুনিয়ায়।

কিন্তু কই! এখানে আসা অবধি সারা দিনরাত সব কটা ক্যাসিনোতে পালা করে সারাক্ষণ ধরনা দিয়েও সেই ধড়িবাজের টিকিটি পর্যন্ত দেখতে পেল না।

সে ধড়িবাজের দেখা পাওয়ার বদলে পেল সেই গায়ে জ্বালা-ধরানো চিঠিটা। চিঠিটা সেই শুঁটকো উচ্চিংড়ে দাসটার।

দাস লিখেছে:

আরে ছ্যা ছ্যা। তোমরা যে এমন নিরেট আহাম্মক তা ভাবতেই পারিনি। সমস্ত দুনিয়ার কারবারের চাকা স্রেফ বুদ্ধির প্যাঁচে যে উলটে-পালটে যেমন খুশি ঘুরিয়ে দিয়ে সিসের গাদ থেকে সোনার তাল বানিয়ে নিয়ে গেছে, তাকে খুঁজতে এসেছ জুয়োর চাকতিতে, ভাগ্য ফেরাবার ছেলেখেলা যেখানে হয় সেইসব ক্যাসিনোয় রুলেটের টেবিলে গাওস্কর তার হাতের মার ঠিক রাখতে গেছে ডাংগুলি খেলতে? না হে, উজবুকরা, তা নয়। যাকে তোমরা খুঁজছ রুলেটের জুয়ায় হাত নোংরা করবার মানুষ সে নয়। মন্টিকালো কি তোমরা এর আগে যেখানে খোঁজ করে এসেছ, সেই লাসভেগাস-এর দশ-বিশ লাখ ডলার লাভে তার লোভই নেই। সাগর হেন পাঁচ-দশটা দিঘি যে বাগিয়েছে, দুটো পাতকোর জন্য হ্যাংলামি সে করবে কেন? তার আবার দানের কথা শুনেছি, আর কটা নতুন দানের কথা শোনো। ইউরোপে যেমন তেমনই আফ্রিকাতেও দু-দুটো নতুন বিরাট হাসপাতাল বসাবার সমস্ত খরচ সে দেবার ব্যবস্থা করেছে। যা গচ্চা দিয়ে তোমরা হন্যে হয়ে তাকে ধরবার জন্য ছোটাছুটি করছ, তোমাদের সেই লোকসানের টাকা দিয়েই সে এ সব দানধ্যান যে করছে, তা বুঝতে পেরে তোমরা যে দাঁত-কিড়মিড় করছ, তা টের পাচ্ছি। কিন্তু উপায় তো নেই। তোমাদের নাক-কান যে এমন করে মলে দিয়েছে, তার হদিস পেতে হলে বড়ের চালে যেখানে কিস্তিমাতের খেলার কেরামতি দেখা যায়, সেখানে যেতে হবে। তোমাদের ওই ফাটকাবাজারি বুদ্ধি নিয়ে শুধু নিজেদের চেষ্টায় সেখানে পৌঁছবার আশা অবশ্য কম। তবু চেষ্টা করে যাও, করে যাও চেষ্টা।

চিঠিটা পড়তে-পড়তে ছোট কং আর তার শুঁটকো সঙ্গীর চেহারা যা হয়েছিল, তা যে এঁকে রাখবার মতো তা নিশ্চয়ই বলতে হবে না। একজন যেন মাটিতে পোঁতা মাইন, আর অন্যজন, যাকে ক্ষেপণাস্ত্র বলে, সেই মিসাইল।

চিঠিটা যখন তারা পেয়েছে তখন নিজেদের শিকার খুঁজতে একটা ক্যাসিনোর মধ্যে বসে নজর রাখছিল বলেই কোনওরকমে নিজেদের সামলে তারা আগুনের হলকার মতো রুলেট-টেবিল ছেড়ে ক্যাসিনোর বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

এইমাত্র চিঠিটা একজন বেয়ারার হাতে তাদের কাছে পৌঁছেছে। বেয়ারাকে খুঁজে পেতে দেরি হয়নি। কিন্তু খুব ফ্যাশনদুরস্ত পোশাক পরা অজানা এক ভদ্রলোক দূর থেকে তাদের দুজনকে দেখিয়ে দিয়ে জরুরি চিঠিটা তাদের দেবার নির্দেশ দিয়ে চলে গেছে। এর বেশি সে বেয়ারা আর কিছু হদিস দিতে পারেনি।

রীতিমত ফ্যাশনদুরস্ত দামি পোশাকের ভদ্রলোক যে চিঠিটা যথাস্থানে দেবার জন্য মোটা বকশিসও দিয়ে গেছে, বেয়ারা শেষ পর্যন্ত তা স্বীকার না করে পারেনি।

কিন্তু চিঠি দিয়ে লোকটা গেল কোথায়? ক্যাসিনোর মধ্যে সে ঢোকেনি, ক্যাসিনোর বাইরেও তার কোনও চিহ্ন দেখা যায়নি। সেখানকার ক্যাসিনোর বাহারে উর্দিপরা নেহাত শোভা হিসেবে বসিয়ে রাখা এক দ্বারপাল তার নির্দিষ্ট জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই ঘুমোচ্ছে বলা যায়। আর এ সব ক্যাসিনোতে যেমন থাকে, তেমনই দু-একজন হাড়হাভাতে ফতুর-হওয়া জুয়াড়ি, ভাগ্যের কৃপায় মোটা দাঁওটা যারা মেরেছে, এমন কারও কাছে নানা ছুতোয় কিছু ভিক্ষে পাবার আশায় ঘঘারাঘুরি করছে।

ছোট কং আর তার সঙ্গী ক্যাসিনোর বাইরে বেরিয়ে আসতেই তেমনই একজনের পাল্লায় পড়ে।

মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, একটা চোখ কালোঠলিতে ঢাকা, পকেট আর বোতাম-ঘর ভেঁড়া একটা ওভারকোট কাঁধে ঝোলানো লোকটা ছোট কং আর তার সঙ্গীর জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। তারা বাইরে আসতেই তাদের ওপর প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্যাকুলভাবে বলে, শুধু একটা ফ্রাঁ মঁসিয়ে, শুধু একটা ফ্রাঁ ঢাকা দিয়ে বরাতের চাকা একেবারে ঘুরিয়ে দেব দেখুন।

ছোট কং আর তার সঙ্গী রাগে বিরক্তিতে তাকে ঠেলে দিয়ে যত সামনের দিকে এগগাবার চেষ্টা করে, সে নাছোড়বান্দা হয়ে ততই তাদের প্রায় জড়িয়ে ধরে থামাবার চেষ্টা করে বলে, দোহাই আপনাদের, লাখে একজনের ভাগ্যে একবারই যা কখনও আসে, এমন করে সেই আশীর্বাদ পায়ে ঠেলবেন না। শুনুন, শুনুন, আজ এই বিকেল ঠিক চারটের পর তিনের পড়তার দিন। হ্যাঁ, লাল চৌকো আর তিনের নামতার পড়তা চলবে। সারা রাত জেগে দিনক্ষণের জ্যোতিষী হিসেব কষে আমি দেখেছি। একটা ফ্রাঁ দিয়ে শুরু করতে পারল আমি ক্যাসিনোর গোটা জুয়ার ব্যাঙ্ক ফেল করিয়ে দিয়ে যেতে পারতাম। শুধু একটা ফ্রাঁ পেলে—যা আমার নেই–

মন্টিকালোর মতো বড় বড় জুয়াড়িদের সাধের শহরে এরকম পাগল নানা আস্তানায় প্রায়ই দেখা যায়। জুয়ার নেশায় সর্বস্ব খুইয়ে তারা আবার জ্যোতিষ গণনায় নির্ভুল লাভের ছক বার করবার স্বপ্ন দ্যাখে। আইনের শাসন আর পুলিশের চোখ এড়িয়ে ভিক্ষে করে বেড়ায় এমনই করে।

ছোট কং আর তার সঙ্গী নাছোড়বান্দা ভিখিরিটাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলেই শেষ পর্যন্ত ক্যাসিনোর বাইরে এসে দাঁড়িয়ে ছিল, কে তাদের চিঠিটা পাঠিয়েছে তা জানবার আশায়।

কিন্তু শান্ত নির্জন দুনিয়ার কুবের হেন ধনীদের জুয়ার নেশা মেটাবার অমরাবতীর মতো শহরের বাইরে তখন দক্ষিণের উপসাগর থেকে মধুর সমুদ্রের হাওয়া বইছে। দূরে-দূরে ক্যাসিনোগুলোর বাহারি আলোর মালা এক এক করে জ্বলে উঠতে শুরু করেছে।

রাগে দাঁত ঘষতে ঘষতে দুই দুশমন আবার ক্যাসিনোর দিকেই ফিরতে গিয়ে দ্যাখে, সেই গাঁয়ে ছেঁড়াখোঁড়া ওভারকোট ঝোলানো নাছোড়বান্দা ভিখিরিটা একটু যেন খোঁড়াতে খোঁড়াতে তাদের দিকেই আসছে।

ছোট কং তখন রাগে প্রায় বুঝি ফেটেই পড়ে। খবরদার বলছি গিরগিটিটা, একটু থেমে বুনো বরার মতো ঘোঁতঘোতিয়ে সে বললে, আর এক পা যদি এদিকে আসিস তা হলে তোর পলকা শিরদাঁড়াটাই মটকে দেব। সত্যি ভেঙে দেব।

লোকটা ভয় পেয়েই নিশ্চয়ই অতদূর এসেছিল। তারপর আর না এগিয়ে যেন হতাশ হয়ে বললে, আমায় একটা ফ্রাঁ দিয়ে বরাত ফেরাবার মওকা তো দিলে না। তা না দাও, তবু তোমাদেরই বরাত ফিরুক। এই কাগজটায় আজকের জ্যোতিষের গণনায় পড়তার নম্বর কী, তা লিখে কষে দেওয়া আছে। তোমরাই একটু গা ঘামিয়ে ভাগ্যের চাকাটা ঘোরাতে পারো কি না দ্যাখো।

লোকটা দর থেকে একটা কাগজের পাকানো ডেলা তাদের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল। ছোট কং রাগে সেটা পা দিয়ে মাড়িয়ে ছিড়তে যাচ্ছিল, কিন্তু তার সিঁড়িঙ্গে সঙ্গী তার আগেই কাগজের ডেলাটা কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে রাখল।

ওটা তুমি কুড়িয়ে নিলে ডুগানচাচা? তোমার ঘেন্না হল না? ছোট কং প্রায়। দাঁত খিঁচিয়ে বললে।

না, ঘেন্না হবে কেন? হেসে জবাব দিলে ছোট কং-এর সিঁড়িঙ্গে সঙ্গী ডুগান, কাগজের ডেলাটা তো আর পকেটে কামড়াচ্ছে না?

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *