চার দেওয়ালের মধ্যে
‘চার দেওয়ালের মধ্যে নানান দৃশ্যকে…’ মান্না দে’র গাওয়া গানটাকে আজকাল প্রায়ই গুনগুন করে অর্জুন, বিশেষ করে যখন সে কম্পিউটারের সামনে বসে। নেটে ঢুকে পড়লে এই চার দেওয়ালের মধ্যে গোটা পৃথিবীটা টুক করে চলে আসে। কোথায় সানফ্রান্সিসকো, কোথায় সিঙ্গাপুর, কয়েক সেকেন্ডেই খবরাখবর নিয়ে আসা যায়। গত কাল অর্জুন মেজরকে মেল করেছিল। আজ দেখল, মেলের জবাব আসেনি। সুস্থ থাকলে মেজর প্রতিদিন মেল খোলেন। জবাব দেন। ষাটে পৌঁছোনো মানুষটি এখনও বেশ যুবক আছেন। উত্তর না আসার কারণ দুটো হতে পারে। এক, মেজর তার নিউ ইয়র্কের ফ্ল্যাটে নেই। দুই, উনি খুব অসুস্থ।
ঘড়ি দেখল অর্জুন। এখন দুপুর তিনটে। নিউ ইয়র্কে ভোর হচ্ছে। মেজর নিশ্চয়ই গভীর ঘুমে। ঘুম থেকে উঠে, খেয়াল পড়লে চার ঘণ্টার আগে মেল পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। অথচ শুভেন্দুবাবু তাকে চারটের মধ্যে দেখা করতে বলেছেন। ওই সময় তার সঙ্গে কথা বলে তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। অর্জুন কম্পিউটার বন্ধ করল।
লাল বাইক নিয়ে কদমতলার মোড়ে চলে এল সে। সঙ্গে সঙ্গে ডাকটা ভেসে এল, অর্জুন! অ্যাই অর্জুন।
উলটো দিকের ফুটপাতে যে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে দেখে অবাক হল অর্জুন। নির্মাল্য। ওরা একসঙ্গে জলপাইগুড়ি জিলা স্কুলে পড়ত। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করার পর ও নরেন্দ্রপুরে পড়তে চলে যায়। ওর বাবাও ট্রান্সফার হয়ে এই শহরের পাট চুকিয়ে চলে গিয়েছেন কিছুদিন পরে। মুখের আদল আগের মতো থাকলেও, নির্মাল্যর চেহারা বেশ ভাল দেখাচ্ছে। পরনের জামাপ্যান্টও বেশ দামি। বাইক ঘুরিয়ে ওর সামনে এসে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তুই এখানে?
কাজে এসেছি। উঠেছি ‘তিস্তা ভবনে। শহরটা একদম বদলে গিয়েছে রে। তুই কিন্তু খুব একটা পালটাসনি। নির্মাল্য কাছে এল।
কী কাজে এখানে এসেছিস?
বলা যাবে না। তারপর তুই তো আবার ডিটেকটিভ। আমি সরকারি কাজেই এসেছি। নির্মাল্য হাসল।
অর্জুন বলল, ভুল হল। আমি ডিটেকটিভ নই, সত্যসন্ধানী, ঘড়ি দেখল সে, এখনও চল্লিশ মিনিট বাকি আছে চারটে বাজতে। জিজ্ঞেস করল, চা খাবি?
চা? কোথায়?
আঙুল তুলে কদমতলার মোড়ে সেই প্রাচীন রেস্তরাঁটাকে দেখাল অর্জুন। এখন এই দুপুরে দোকান ফাঁকা। বেঞ্চিগুলো বেশ নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে।
ওখানে? শহরে এখনও ভাল রেস্তরাঁ হয়নি? নির্মাল্য অপছন্দ জানাল।
হয়েছে। তবে এখানেই বেস্ট চা পাওয়া যায়। তুই স্কুলে পড়ার সময় এই দোকানে কখনও চা খাসনি? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
মাথা নাড়ল নির্মাল্য, তখন তো বাড়ির বাইরে গিয়ে খাওয়ার প্রয়োজন হত না।
ওরা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসল। নির্মাল্য বলল, এখন যারা আমাকে চেনে, তাদের কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। আমি যে এমন পোড়ো চায়ের দোকানে বসে আছি, তা ভাবতেও পারবে না। তা তুই জলপাইগুড়িতেই পড়ে থাকলি?
হ্যাঁ। তুই? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
দিল্লিতে।
সরকারি কাজে এসেছিস বললি, কোন ডিপার্টমেন্ট?
নির্মাল্য তাকাল, শুনে কী করবি? ছেড়ে দে।
চা এসে গেল। নির্মাল্য নিজেকে রহস্যের আড়ালে রাখতে চাইছে বুঝতে পেরে অর্জুন আর প্রশ্ন করল না। চায়ে চুমুক দিয়ে নির্মাল্য বলল, বাঃ। গুড। তুই ঠিক বলেছিস।
তুই কদমতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে কী করছিলি?
কিছু না। সকালে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছিলাম। আজকের মতো কাজ শেষ করে গাড়িটা ছেড়ে দিলাম। ভাবলাম, পুরনো শহরটাকে নতুন করে দেখি। তোর রোজগার কেমন হয়?
চলে যায়।
তুই দিল্লিতে চলে আয়। প্রাইভেট ডিটেকটিভদের ওখানে খুব ডিমান্ড।
আবার ভুল করলি। আমি ডিটেকটিভ নই।
আরে ওই হল। সত্যিটা কী, তা জানতে তোকে লাখ লাখ টাকা দেবে।
কদ্দিন আছিস এখানে?
কাল বিকেলের ফ্লাইট ধরব বাগডোগরা থেকে।
চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে অর্জুন বলল, অনেক দিন পরে তোর সঙ্গে দেখা হল। কিছু মনে করিস না, এখন আমাকে একজনের সঙ্গে দেখা করতে যেতে হবে।
সন্ধের পরে চলে আয় না তিস্তা ভবনে। গল্প করা যাবে।
ঠিক আছে। মনে হচ্ছে, যেতে পারব।
নির্মাল্যকে ফুটপাতে ছেড়ে বাইকে ওঠার পর অর্জুনের মনে হল, এটাই তো স্বাভাবিক। স্কুলের ছাত্র থাকাকালীন যা স্বাভাবিক, তা পরবর্তী জীবনে পালটে যাবেই। চাকরির সুবাদে যে-জীবন নির্মাল্য পেয়েছে, তার সঙ্গে ছাত্রজীবনের কোনও মিল নেই। নিশ্চয়ই খুব উঁচু পদে আছে ও। স্টেটাস, টাকাপয়সা ইত্যাদির মাপকাঠিতে জীবনকে মাপা ওর অভ্যেসে এসে গিয়েছে। সকলেই তো আর জগুদা নয়।
শিল্পসমিতি পাড়ার যে-রাস্তায় সে বাইক থেকে নামল, সেটি বেশ ছিমছাম, দু’পাশে গাছগাছালি। বড় বড় বাড়িগুলো আরও চুপচাপ। পাড়াটা যে অভিজাতদের জন্য, তা বলার দরকার হয় না।
গেট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকল অর্জুন। লম্বা-লম্বা ঝাউগাছ সুন্দর করে সাজানো। দু’পা এগোতেই কুকুরের চিৎকার ভেসে এল। একটা নয়, অনেক কুকুর দোতলার গ্রিল দেওয়া বারান্দা থেকে তাকে দেখে চিৎকার করছে। যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে টুকরো না করা পর্যন্ত শান্ত হবে না ওরা। অর্জুন। গুনল। চারটে বিরাট চেহারার অ্যালসেশিয়ান বলে মনে হল। কুকুর চারটে একবার গ্রিলের কাছে ছুটে আসছে, আবার চোখের আড়ালে চলে যাচ্ছে। বোধহয় নামতে চাইছে ওরা। দরজা বন্ধ থাকায় পারছে না।
এই সময় একজন স্বাস্থ্যবান মানুষ বাড়ির একতলা থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার, বলুন!
শুভেন্দুশেখরবাবু তো এ-বাড়িতে থাকেন?
হ্যাঁ।
উনি আমাকে টেলিফোনে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতে বলেছিলেন।
আপনার নাম?
অর্জুন।
নাম শুনেই বোধহয় লোকটা একটু অবাক হয়ে তাকাল। তারপর ইশারায় অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে চলে গেল। কুকুর চারটে তখনও সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। অর্জুন চারপাশে ঘুরে দেখল। পাঁচিল-ঘেরা বাড়ি। পাঁচিলগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি উঁচু। তার উপর কাঁচের টুকরো বসানো। এই ব্যবস্থা শহরের প্রাচীন বাড়িগুলোতে থাকত। এখনও কয়েকটিতে রয়েছে।
লোকটি বেরিয়ে এসে বলল, আসুন।
ভিতরে পা রেখেই অর্জুন বুঝতে পারল, পরিবারটি বনেদি। দেওয়ালে লম্বা লম্বা ছবি ফ্রেমে বাঁধানো। আসবাবও প্রাচীন, একফোঁটা ময়লা কোথাও পড়ে নেই।
উপরে যেতে হবে। লোকটি জানাল।
কুকুরগুলো…!
ওরা বারান্দায়। দরজা আটকানো রয়েছে।
দোতলায় উঠে এল। শ্বেতপাথরের মেঝে, মোটা দেওয়ালের বাড়ি। একটা হলঘরে অর্জুনকে নিয়ে গিয়ে বসতে বলে ভিতরে চলে গেল লোকটা। অর্জুন সোফায় বসল। দেওয়ালে যামিনী রায়, নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি টাঙানো। অর্জুন উলটে খুঁটিয়ে দেখে বুঝতে চাইল, ওগুলো অরিজিনাল না রি-প্রিন্ট।
ছবির ব্যাপারে অভিজ্ঞতা আছে নাকি?
গলাটা ভেসে আসতেই পিছন ফিরে তাকাল অর্জুন। ধবধবে সাদা চুল, সোনার মতো গায়ের রং, ঘি-রঙা সিল্কের পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামা পরা শুভেন্দুশেখর এগিয়ে এলেন হুইলচেয়ার চালিয়ে।
না, তেমন কিছু নয়। নমস্কার।
নমস্কার। এ বাড়িতে যা কিছু আছে, তা অরিজিনাল। তা হলে তুমিই অর্জুন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
বোসো। অর্জুন বসলে ভদ্রলোক কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন, আমাকে বলা হয়েছিল, তোমার বয়স অল্প। তার মানে তুমি যে নিতান্ত তরুণ, তা ভাবিনি।
সম্ভবত, আঠারো বছরের পর আর তরুণ বলা যায় না। সেই অর্থে আমি অনেক দিন যুবক হয়ে গিয়েছি। অর্জুন বলল।
আমার বয়স কত মনে হচ্ছে?
অর্জুন তাকাল। ভদ্রলোকের চুল সাদা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ভুরু কালোই রয়েছে। গলার চামড়ায় ঈষৎ কুঞ্চন। অর্জুন বলল, সত্তরের আশপাশে।
নো। আই অ্যাম এইট্টি ওয়ান। কার অ্যাকসিডেন্টে এই পা দুটো অকেজো হয়ে গিয়েছে আঠারো বছর। আমার তখন তেষট্টি বছর বয়স। কিন্তু ইয়ংম্যান, যে সামনাসামনি দেখে আমার বয়স বলতে পারল না, তার উপর আস্থা রাখব কী করে? শুভেন্দুশেখর চোখ নাচালেন।
অর্জুন হাসল, আপনি যা ভাববেন, তাই করবেন। আমার তরফ থেকে একটা কথা বলতে পারি। আপনি যদি নর্মাল মানুষের মতো হাঁটাচলা করতেন, রোদ-বৃষ্টিতে বাইরে বেরোতেন, তা হলে তার প্রতিক্রিয়া আপনার শরীরে ফুটে উঠত। বয়স বুঝতে অসুবিধে হত না। যেহেতু আপনি দুর্ঘটনার জন্য ওই চেয়ারে বসে এঘর-ওঘর করেন, রোদে-বৃষ্টিতে বেরোবার প্রশ্ন নেই, তাই আপনার মুখে, চামড়ায় তেমন কোনও পরিবর্তন হয়নি। বরং সাধারণের চেয়ে আপনার কাধ অনেক বেশি বড় এবং মজবুত। অর্থাৎ পায়ের বদলে আপনাকে হাত ব্যবহার করতে হয়। নিশ্চয়ই প্রয়োজনে ক্রাচ ব্যবহার করেন। আশি বছরেও একটিও চুল পাকেনি এমন মানুষ আমি দেখেছি। কিন্তু আপনার চুল সাদা অথচ, ভুরু কঁচা। যদি একাশি বছর সত্যি হয়, তা হলে আপনি শুধু ভুরুতে ডাই করেছেন। বুঝতেই পারছেন, আমাকে বিভ্রান্ত কেন হতে হয়েছে!
শুভেন্দুশেখর হাসলেন, এবার বুঝলাম, বিষ্ণুচরণবাবু কেন তোমার নাম রেকমেন্ড করেছেন। প্রথমে একটু পান করা যাক। কফি না চা?
চা। তবে দুধ এবং চিনি বাদ দিয়ে। অর্জুন গম্ভীর গলায় বলল। চায়ের দোকানের চা দুধ-চিনি ছাড়া খাওয়া যায় না। স্বাদ ভাল হলে লিকারের গন্ধ পাওয়া যায় না। কিন্তু শুভেন্দুশেখরবাবুর এই বাড়িতে অবশ্যই দামি চা ব্যবহার করা হয়। অতএব তার সুগন্ধ দুধ-চিনিতে নষ্ট করতে সে ইচ্ছুক নয়। বেল টিপলেন শুভেন্দুশেখর।
আপনি নিউ ইয়র্কে থাকেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
না। নিউ ইয়র্কের বাইরে। অতলান্তিকের গায়ে।
সেই লোকটি এলে শুভেন্দুশেখর চায়ের হুকুম দিলেন। লোকটি চলে গেল।
কতদিন আছেন ওখানে?
একচল্লিশ বছর। অবশ্য শীতের সময় তিন সপ্তাহের জন্য এখানে এসে থাকি। এবার চার সপ্তাহের জন্যে এসেছি জলপাইগুড়িতে। শুভেন্দুশেখর বললেন, গরম একদম সহ্য করতে পারি না আমি।
এখানে কে থাকেন?
কেউ না। আমার স্ত্রী গত হয়েছেন দশ বছর আগে। যে-লোকটি তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছে, সে-ই দেখাশোনা করে বাড়িটা। প্রত্যেক বারই ভাবি, বিক্রি করে পাট চুকিয়ে দিয়ে চলে যাব। কিন্তু… চুপ করে গেলেন শুভেন্দুশেখর।
আপনি আমাকে কী কারণে ডেকেছেন?
ওয়েল অর্জুন, যে-কারণে ডেকেছি, সেটা বলার আগে একটা ভূমিকা করা দরকার। আমার একটিমাত্র ছেলে। তার নাম নভেন্দু। সে যখন আমার সঙ্গে আমেরিকায় যায়, তখন তার বয়স পাঁচ। আমার বিয়ের দশ বছর পরে সে জন্মেছিল। ছাত্রাবস্থায় ওর মতো বুদ্ধিমান ছেলের বাবা বলে স্কুল থেকে আমাকে কনগ্রাচুলেট করত। খুব দ্রুত নভেন্দু মেন স্ট্রিমের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল। আমেরিকান ইংরেজি যেভাবে বলত, তা শুনে সতেরো বছর বয়সেই গাদা গাদা বান্ধবী জুটে গেল তার। উনিশে পা দিতে না-দিতে বিয়ে করে ফেলল সে। মেয়েটি স্প্যানিশ। ভাঙা ইংরেজি বলে। ছেলে ইতিমধ্যে স্প্যানিশ শিখে ফেলেছে। আমার স্ত্রী এই বিয়ে মেনে নিতে পারেননি। আমার আপত্তির কারণ ছিল একটাই, স্বাবলম্বী না হয়ে বিয়ে করা। মেয়েটিকে আমার খারাপ লাগেনি। কিন্তু আমাদের আপত্তি শোনার পাত্র ও ছিল না। বিয়ের পর বউকে নিয়ে চলে এল বাড়িতে। প্রতিদিন আমার কাছে ডলার চাইত। দিতে না চাইলে বউকে পাঠাত। প্রথম প্রথম দিতাম। তারপর শুনলাম, ও পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। বউয়ের সঙ্গে ঝামেলা শুরু করেছে। বললাম, আমার বাড়িতে বসে ওসব করা চলবে না। শুনে বউকে ফেলে রেখে উধাও হয়ে গেল। ওদেশের মেয়েরা একা-একা শ্বশুরবাড়িতে পড়ে থাকে না। মেয়েটিও চলে গেল একদিন। একটানা বলে থামলেন শুভেন্দুশেখর।
তারপর?
পাঁচ বছর ওর খবর পাইনি। এক রাত্রে ফিরে এল অসুস্থ হয়ে। বেশ জ্বর। ওর মা ওকে হাসপাতালে ভরতি করিয়ে এল। দিনদশেক পরে যখন সুস্থ হয়ে বাড়ি এল, তখন জানতে পারলাম, ওদের বিয়ে ভেঙে গিয়েছে। মাসখানেক সে বাড়ির বাইরে বের হয়নি। বাংলায় কথা বলা ভুলে গিয়েছিল। ডাল-ভাত খেতে তীব্র আপত্তি করত। আমেরিকান খাবার করতে হত ওর জন্য। ওর হাত থেকে বাঁচার জন্য ওকে নিয়ে জলপাইগুড়িতে এসেছিলাম বছর এগারো আগে।
তাই?
এখানে আসার পর বাড়ি থেকে বেরোত না। টিভির সামনে চব্বিশ ঘণ্টা বসে থাকত। হঠাৎ একদিন ফোন এল ওর। বলল, কয়েক দিনের জন্য বাংলাদেশ থেকে ঘুরে আসবে। ওর কোনও বন্ধু সেদেশে থাকে। তার নিমন্ত্রণে যাবে। আমি আপত্তি করিনি। এখানে আসার পর সে যে সংযত আচরণ করেছিল, তাতে এটুকু বিলাসভ্ৰমণ তার পাওনা ছিল।
হঠাৎ খেয়াল হতে হুইলচেয়ারে লাগানো বোতাম টিপলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে বেল বাজল। সম্ভবত রিমোটে এই কাণ্ড হল। বেল বাজামাত্র লোকটি ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। তাতে চায়ের পট, কাপ, ডিশ, দুধ-চিনি আর প্লেটে বিস্কুট সাজানো।
হুইলচেয়ারে বসে পরিবেশন করলেন শুভেন্দুশেখর। চায়ে চুমুক দিল অর্জুন। অপূর্ব! স্বাদ এবং গন্ধ বলে দিচ্ছে খুব দামি চা। বলল, আপনি মকাইবাড়ির চা খান?
হ্যাঁ। বহুকালের অভ্যেস। আমেরিকাতেও এই চা ব্যবহার করি।
যে-কথা বলছিলেন…!
আমার সমস্যা হল নভেন্দু। সে এখন আমার সঙ্গে থাকে না। যেহেতু আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ কম নয়, তাই আমার মৃত্যু কবে হবে, সেই অপেক্ষায় সে আছে। মনে হয়, বেশি দিন ধৈর্য সে ধরতে পারবে না। তার অর্থ নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ?
তারপর?
সেই ছেলে এখন এখানে।
এখানে?
না। এই বাড়িতে নয়। উত্তরবঙ্গ আর বাংলাদেশের মধ্যে ওর যাতায়াত। মাঝে মাঝে আমেরিকায় যায়। কিছুদিন আগে একটি মেয়ে আমাকে ফোন করে ওর কথা জিজ্ঞেস করে। তার নাকি খুব দরকার নভেন্দুকে। মেয়েটি নিউ ইয়র্কে থাকে। আমার কৌতূহল হল। তাকে দেখা করতে বললাম। নিজেই গাড়ি চালিয়ে এল মেয়েটি। ইংরেজিতে কথা বলছিল। বেশ সুন্দরী, বছর আঠাশের মধ্যে বয়স। মেয়েটির নাম নিমা। পাকিস্তানি। বলল, নভেন্দুর কাছে ওর এক লক্ষ ডলার আছে, কিন্তু সে গা-ঢাকা দিয়েছে। এত টাকা কেন নভেন্দুর কাছে সে পাবে, এই প্রশ্নের জবাব কিছুতেই দিতে চাইল না। কিছুদিন আগে অতলান্তিক সিটিতে একটি বাংলাদেশি যুবক খুন হয়। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে, ছেলেটির কোনও বৈধ কাগজপত্র ছিল না। ভিসা তো দূরের কথা, পাসপোর্টই ছিল না। একটা বাংলাদেশি রেস্তরাঁয় বেআইনিভাবে কাজ করত। ওর কাগজপত্র নেই বলে, রেস্তরাঁর মালিক নামমাত্র টাকা দিত। নিমা যাওয়ার আগে জানিয়ে গেল, ওই খুনের সঙ্গে নভেন্দু যে জড়িত, তার প্রমাণ সে দিতে পারে। এক মাসের মধ্যে টাকা না পেলে সে পুলিশের কাছে যাবে। আমি যদি ছেলেকে বাঁচাতে চাই, তা হলে যেন তাকে ফোন করি। একটা কার্ডও রেখে গিয়েছে সে। চুপ করলেন শুভেন্দুশেখর। চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলেন কিছু।
আপনি টাকাটা দিয়েছেন?
নো। কেন দেব? কেউ এসে ভয় দেখাল আর অমনি দিয়ে দেব? কোনও ভাল কাজে নয়, আমার বখে যাওয়া ছেলেকে বাঁচাতে আমি টাকা খরচ করব? কিন্তু আমি ভয় পেলাম। আমাকে খুন করলে ও কয়েক লক্ষ ডলারের মালিক হয়ে যাবে। সুযোগটা ও হাতছাড়া যে করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? এই ছেলে সম্পর্কে আমার কোনও আগ্রহ নেই। গতকাল নিমাকে ফোন করে আমার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছি। নিমা অনুরোধ করল, এখানে তাকে কিছুদিন থাকতে দিতে পারি কিনা। কারণ, সে খবর পেয়েছে নভেন্দু এই প্রান্তের বর্ডারে কিছুদিন ধরে আছে।
এই প্রান্তের বর্ডার মানে? ভারত-বাংলাদেশ বর্ডার?
হ্যাঁ। শুভেন্দুশেখর মাথা নাড়লেন, নিমা জিজ্ঞেস করছিল, বেরুবাড়ি নামে কোনও জায়গা এদিকে আছে কিনা। অর্থাৎ শয়তানটাকে বেরুবাড়িতেও দেখা গিয়েছে।
চা শেষ করল অর্জুন, আমাকে আপনি কী করতে বলছেন?
আমি আমার ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে চাই। কিন্তু আমি চাইলেই যে সে তা মেনে নেবে, তার কোনও লক্ষণ দেখছি না। তা হলে নিমা আমার কাছে আসত না। আমি মরে গেলে সে যাতে বিষয়-সম্পত্তি না পায়, তার ব্যবস্থা আমি করেছি। কিন্তু আমি চাই ও এখন কী করছে, তা জানতে। শুভেন্দুশেখর তাকালেন।
যার সম্পর্কে আপনি এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার সম্পর্কে জানতে চাইছেন কেন?
কারণ, আমার সন্দেহ, সে কোনও ভয়ংকর অন্যায় কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমার সন্দেহ যদি সত্যি হয়, তা হলে ওর শাস্তি পাওয়া উচিত। শুভেন্দুশেখর বললেন, তোমাকে সত্যটা সন্ধান করতে হবে। বিষ্ণুচরণবাবু আমার ঘনিষ্ঠ মানুষ, এসব কথা উনি জানেন। আমি এখানে আসছি জেনে বললেন, তোমার সঙ্গে দেখা করতে। এত কম বয়সের সত্যসন্ধানীর উপর ওঁর যখন গভীর আস্থা আছে, তখন আমি আর কোনও প্রশ্ন তুলছি না। এখন বলল, দায়িত্বটা নেবে?
আমাকে একটু ভাবতে দিন।
দ্যাখো, আমি আর বড়জোর কুড়ি দিন এখানে থাকতে পারি। এর মধ্যে যদি কাজটা শেষ করতে পারো, তা হলে খুশি হব। তোমার রেমুনারেশন কত?
অর্জুন হাসল, ওসব নিয়ে পরে কথা হবে।
না হে। আমি প্রোফেশনাল লোকের সঙ্গে কাজ করতে পছন্দ করি।
বেশ। ভেবে দেখি। যদি মনে হয় করব, তা হলে আপনাকে জানাব। আর হ্যাঁ, নভেন্দুবাবুর একটা ফোটো পেতে পারি?
অবশ্যই। একটু বোসো, আমি আসছি। হুইলচেয়ার ঘুরিয়ে ওপাশের ঘরে চলে গেলেন শুভেন্দুশেখর।
লোকটি অর্জুনকে আকর্ষণ করছেন। এই বাড়ি দেখেই বোঝা যায়, ইনি বেশ ধনী। তার উপর আমেরিকায় বাড়ি। প্রতিবন্ধী হওয়া সত্ত্বেও যাওয়া আসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এই বিপুল সম্পত্তির মালিক হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র পুত্রের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখতে চাইছেন না। তাকে তো বঞ্চিত করবেনই, উলটে শাস্তি দিতে চাইছেন। কিন্তু আমেরিকায় বাংলাদেশি খুনের প্রসঙ্গ ছাড়া, ওর করা এমন কোনও অন্যায়ের কথা জানা নেই, যার জন্য ভারতবর্ষে নভেন্দুবাবুর বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া যায়। তা ছাড়া বাংলাদেশের মানুষকে খুনের কথাও তো স্পষ্ট নয়। হ্যাঁ, টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রতারণা করার ব্যাপারটা পুলিশকে বলা যেতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রে নিমা নামের মেয়েটিকে এখানে এসে অভিযোগ জানাতে হবে।
শুভেন্দুশেখর ফিরে এলেন, আই অ্যাম সরি অর্জুন। ওর এখনকার কোনও ফোটো এখানে নেই। ইনফ্যাক্ট এখন ও যা করছে, তাতে ফোটো তুলে বাড়িতে রাখার তো কোনও মানে হয় না। ওর যখন বছর পনেরো বয়স, তখন একটা গ্রুপ ফোটো ভোলা হয়েছিল। দ্যাখো, এটা থেকে যদি ওকে আন্দাজ করতে পারো।
ফোটোটি দেখল অর্জুন। শুভেন্দুশেখর তো সুপুরুষ, ওঁর স্ত্রীও যথেষ্ট সুন্দরী। ওঁদের মাঝখানে যে দাঁড়িয়ে আছে, তার ঠোঁটের পাশে কোয়ার্টার ইঞ্চি কাটা দাগ। সেটা দেখাল অর্জুন, এটা কি এখনও আছে?
ফোটোটা দেখলেন শুভেন্দুশেখর, হ্যাঁ, ও দাগ জন্মেও যাওয়ার নয়। স্কুলে মারপিট করে মুখ ফাটিয়েছিল। সেলাই করতে হয়েছিল। বলেছিল, প্লাস্টিক সার্জারি করলে দাগ মিলিয়ে যেত। কিন্তু আমি ইচ্ছে করেই করাইনি। চিহ্নটা রেখে দিয়েছিলাম।
অর্জুন উঠে দাঁড়াল, ফোটোটা পকেটে রাখল। বলল, সমস্যা হল, নভেন্দুবাবুকে কোথায় পাওয়া যাবে, তার কোনও নির্দিষ্ট জায়গার কথা বলতে পারছেন না!
আমি জানলে তবে তো জানাব।
ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত তো বেশ দীর্ঘ। আচ্ছা, আপনাকে কাল সকালে আমি ফোন করব। নমস্কার জানিয়ে বেরিয়ে এল অর্জুন!
.
সোজা শহরের দিকে না গিয়ে মাষকলাইবাড়ির শ্মশানের পাশ দিয়ে হাইওয়েতেচলে এল অর্জুন। জায়গাটা খুব ফাঁকা, বাইক চালাতে ভাল লাগে। ধরধরা নদী পেরিয়ে একটা সাঁকোর কাছে বাইক থামাতে দেখতে পেল, অগুনতি বক আকাশে উড়ে যাচ্ছে একটা ছবি আঁকতে আঁকতে। দেখলে মনে হয়, বকগুলো খুব ভাল ট্রেনিং নিয়েছে এরকমভাবে ওড়ার জন্য।
সন্ধে নামছে। পৃথিবীটা এখন মায়াবী ছায়ার চাদরে মোড়া। নভেন্দুর ফোটোটা বের করল অর্জুন। এই ফোটো তোলার সময় বাবার সঙ্গে ছেলের যে সম্পর্ক ছিল, এখন সেটা মৃত। বিশ্বাস চলে গেলে সম্পর্ক মরে যায়।
কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নভেন্দু কী করছে? ব্যাবসা? ওর সম্পর্কে যা শোনা গেল, তা সত্যি হলে নভেন্দুর মতো মানুষ পৃথিবীর এত জায়গা ছেড়ে এরকম জায়গায় সুস্থ ব্যাবসা করতে আসবে বলে বিশ্বাস করা যায় না। কী ব্যাবসা করবে সে? আমদানি-রপ্তানি? সে তো নিশ্চয়ই আমেরিকার নাগরিক। এখানে এই ধরনের ব্যাবসা করতে গেলে সরকারের কাছ থেকে লাইসেন্স পাওয়া অত্যাবশ্যক ব্যাপার। সেটা সে পেতে পারে না। নিশ্চয়ই চাকরি বা সমাজসেবার কাজে সে এখানে বসে নেই! তা হলে একটাই পথ তার কাছে ভোলা, সেটা অসৎ ব্যাবসা। কী সেটা? এদিকে নেপাল বা বাংলাদেশ থেকে চোরা পথে বিদেশি জিনিস আনার কারবার অনেকেই করে। সরকারকে শুল্ক না দিয়ে সেগুলো বিক্রি করে মোটা টাকা লাভ করছে বছরের পর বছর। তেমন কিছু?
রাজবাড়ির পাড়ার কানা দুলাল ওই ব্যাবসা করত। প্রথমে সিনেমা হলে টিকিট ব্ল্যাক করা, তারপরে মালগাড়ি থেকে জিনিস হাওয়া করা এবং পরে সেটা করতে গিয়ে ট্রেন থেকে পড়ে পাথর ঢুকে একটা চোখ অন্ধ হয়ে যায়। জেল-হাসপাতাল হয়ে ফিরে আসে মাস ছয়েক পরে। তখন থেকে তার নাম হয়ে যায়, কানা দুলাল। সবসময় গগলস পরে থাকে সে। ওই জেলেই এমন একজনের সঙ্গে তার আলাপ হয়, যে তাকে বিদেশি জিনিস বেআইনি পথে এনে বিক্রির পরামর্শ দেয়। তারপর খুব তাড়াতাড়ি বড়লোক হতে আরম্ভ করে কানা দুলাল। চোরা পথে বাংলাদেশে যাওয়া তার কাছে জল-ভাত ছিল। কিন্তু বিধি বাম হলে সে কী করতে পারে? একই সঙ্গে ব্লাডপ্রেশার, ব্লাডসুগার তাকে এমন কাহিল করে ফেলল যে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক পা হাঁটার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলল। এসব কাহিনির একটু আধটু জলপাইগুড়ির বাতাসে এককালে ভাসত।
বাইক চালিয়ে কানা দুলালের বাড়িতে পৌঁছে গেল অর্জুন। টাকা হলেও লোকের মুখে নামটা বদলায়নি। বারান্দায় বসে ছিল সে। হাড় জিরজিরে শরীর, দাড়ি না কামানো মুখে সাদা ছোপ। বাইক থেকে নামতে দেখেই। চিনতে পেরেছিল কানা দুলাল। এই সন্ধেবেলায় তার চোখে গগলস নেই। ক্রাচ হাতড়ে কোনওরকমে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আপনি?
অর্জুন হাসল, এখন কেমন আছেন?
আর থাকা! চিতার দিকে পা বাড়িয়ে আছি, অথচ ভগবান টানছে না। এ যে কী যন্ত্রণা, তা আমিই জানি। কিন্তু আপনি হঠাৎ আমার এখানে? না-না। ওসব ধান্দা আমি অনেক আগে ছেড়ে দিয়েছি। এখন কয়েক পা হাঁটলেই দম বন্ধ হয়ে যায়। ওসব অতীত। আপনি ভুল খবর পেয়ে এসেছেন!
আমি কোনও খবর পেয়ে আপনার কাছে আসিনি। অর্জুন বলল।
তা হলে? একটু অবাক হল কানা দুলাল।
আপনার কাছে একটু সাহায্য চাইছি।
আমি? সাহায্য করব? হাসল কানা দুলাল, আমার সেই ক্ষমতা কোথায়?
আমি শুনেছি, আপনি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ভাল চেনেন। নিশ্চয়ই চোরা পথে অনেকবার বাংলাদেশে গিয়েছেন। তাই তো?
ওসব কথা এখন বলে কেন লজ্জায় ফেলছেন! ওসব অতীত। আমি আর মনে করতে চাই না। এখন সারাক্ষণ ভগবানকে ডাকি…
নিশ্চয়ই ডাকবেন। আপনার অন্যায় কাজের জন্য ভগবান আপনাকে যথেষ্ট শাস্তি দিয়েছেন। বিচার করে জজসাহেব জেলে পাঠালে এত বড় শাস্তি হত না। কিন্তু এই অসুস্থ শরীরে যদি মানুষের উপকার করেন, তা হলে অনেক বেশি শান্তি পাবেন আপনি। অর্জুন বলল।
দৃষ্টিহীন চোখ নড়ল না। অন্যটি একটু সংকুচিত হল, বুঝলাম না!
আচ্ছা বলুন তো, বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে লাইসেন্স ছাড়াই কী কী ব্যাবসা চলে?
কী না চলে! কাপড়চোপড় থেকে সিগারেট, মদ, যন্ত্রপাতি, টর্চ, ব্যাটারি, সব।
কীরকম লাভ হয়?
আগে ভাল হত। এখন সরকারি নীতি বদলে যাওয়ায়, একমাত্র মোবাইল সেটে ভাল লাভ পাওয়া যায়। অনেক জায়গায় নজরানা দিতে দিতে লাভ কমে যায়। অনেক হাত ঘোরে তো! কানা দুলাল বলল।
অর্জুন ভাবল, নভেন্দু এই ধরনের ব্যাবসা করার জন্য এখানে পড়ে থাকবে কেন? সে জিজ্ঞেস করল, বিদেশিরা এই ব্যাবসা করে?
তারা এসব পুঁটিমাছ ধরবে কেন? মাথা নাড়ল কানা দুলাল, তারা আরও বড় মাছ জালে তোলে!
কীরকম?
পাচার।
পাচার? কী পাচার করে?
মানুষ। পুরুষ মানুষ। দু’চোখ বন্ধ করল কানা দুলাল।
কীরকম? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
ধরুন, আপনি কোনও দেশে যেতে চান। আপনার কাজ চাই। সেই দেশে কাজের লোক কম পাওয়া যায়। গেলেই চাকরি। কিন্তু আপনাকে সেই দেশের সরকার ঢোকার অনুমতি দিচ্ছে না। অতএব বেআইনি পথে আপনি সেই দেশে ঢুকবেন। এই ব্যাপারে আপনাকে সাহায্য করার জন্য রাঘববোয়ালরা বসে আছে। তারা আপনার কাছে মোটা টাকা নিয়ে ঠিক পৌঁছে দেবে। ওসব ক্ষমতা আমাদের ছিল না। কানা দুলাল বলল।
এতক্ষণে ছবিটা পরিষ্কার হল অর্জুনের কাছে। সে শুনেছে, বিদেশে বাংলাদেশের মানুষেরা প্রচুর পরিমাণে যান চাকরি করতে। গিয়ে টাকা পাঠান। নভেন্দু কি মানুষ পাচারের ব্যবসায় নেমেছে?
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, আমাদের এখানে কেউ কি এই ব্যাবসা করেন?
এখন করে কিনা জানি না, তবে শিলিগুড়ির হরিরাম ঝুনঝুনওয়ালার নাম শুনেছি।
শিলিগুড়ির কোথায় থাকেন ভদ্রলোক?
টাউন স্টেশনের সামনে ওর বাড়ি। সবাই চেনে। খুব বড়লোক।
ঠিক আছে। অর্জুন ঘুরে দাঁড়াল।
কানা দুলাল জিজ্ঞেস করল, আপনি কি ওর কাছে যাবেন?
আপনার আপত্তি আছে?
না। কিন্তু দয়া করে আমার নাম করবেন না। দু’হাত জোড় করল কানা দুলাল।
কেন?
আমি অপঘাতে মরতে চাই না। ভগবান অসুখে ভুগিয়ে নিয়ে যাবেন, ঠিক আছে। কিন্তু ঝুনঝুনওয়ালার লোক আমাকে গুলি করে মারুক, তা চাই না। গলার স্বর করুণ হয়ে গেল কানা দুলালের।
ঠিক আছে। আপনার নাম আমি বলব না। অর্জুন প্রতিশ্রুতি দিল।
.
শিলিগুড়ির টাউন স্টেশনের এখন তেমন গুরুত্ব নেই। এককালে যখন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন দূরের কথা, শিলিগুড়ির জংশন স্টেশনই তৈরি হয়নি, তখন এখান থেকেই দূরপাল্লার ট্রেন ছাড়ত। স্বাধীনতার আগে থেকেই এখনকার বাংলাদেশ হয়ে ট্রেন যেত শিয়ালদহে, এই স্টেশন ছেড়ে। এখন প্রায় পোড়ো বাড়ির মতো অবস্থা স্টেশনটার।
পরদিন সকালে হরিরাম ঝুনঝুনওয়ালার বাড়ি যাচ্ছিল অর্জুন। বাইক থেকে নেমে একটা পানের দোকানদারকে জিজ্ঞেস করতেই ঝুনঝুনওয়ালার বাড়িটার হদিশ পেল অর্জুন। তিনতলা বিশাল বাড়ি, কিন্তু কোনও ছিরিছাঁদ নেই। বাড়ির একতলার দরজা খোলা। সেখানে পৌঁছোতেই একটা কাজের লোক এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, কী চাই?
হরিরামবাবু আছেন?
কোত্থেকে আসছেন?
জলপাইগুড়ি থেকে। আমার নাম অর্জুন।
বাবু এখন ঘুমোচ্ছেন।
ঘড়ি দেখল অর্জুন। সকাল নটা দশ। সে ঠিক এক ঘন্টা আগে জলপাইগুড়ি থেকে বেরিয়েছিল। কোনও ব্যাবসাদার এত বেলা পর্যন্ত ঘুমোয়?
আমার যে ওঁর সঙ্গে কথা বলা দরকার।
তা হলে অপেক্ষা করুন। লোকটা ভিতরে চলে গেল।
অর্জুন বুঝল, লোকটা ভদ্রতার ধার ধারে না। সাধারণত এক্ষেত্রে তাকে বাইরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসতে বলাই ভদ্রতা। সে রাস্তার দিকে তাকাল। প্রচুর রিকশা যাচ্ছে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি শহরের ভিতরে যাওয়ার শর্টকাট রাস্তা হল এটা। ধুলো উড়ছে। এই সময় দুটো মোটরবাইক এসে দাঁড়াল বাড়ির সামনে। চারজন ছেলে নেমে এসে বাড়িতে ঢোকার সময় অর্জুনকে দেখল। একজন জিজ্ঞেস করল, কী চাই?
হরিরামবাবুর সঙ্গে দেখা করব। উনি ঘুমোচ্ছেন, তাই দাঁড়িয়ে আছি।
ও। কী দরকার আমাকে বলুন, আমি, ওঁর ছেলে।
নমস্কার। ওঁর সঙ্গেই কথা বলতে চাই।
দেখুন মশাই, চাকরির ধান্দা থাকলে ফুটে যান।
অর্জুন হাসল, না। চাকরি চাই না।
কোত্থেকে আসছেন?
জলপাইগুড়ি থেকে।
ছেলেগুলো ভিতরে চলে গেল। চালচলন এবং মুখের ভাবভঙ্গি বলে দিচ্ছে, আর যাই হোক, নম্রতা বলে কোনও কিছুর সঙ্গে ওদের পরিচয় নেই।
প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে কাজের লোক অর্জুনকে ডেকে নিয়ে গেল যে ঘরে, সেখানে একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক বসে পান চিবোচ্ছেন। বেশ রোগা, মুখে বসন্তের দাগ স্পষ্ট। অর্জুন ঘরে ঢুকে বলল, নমস্কার।
নমস্কার। কী দরকার?
আপনি হরিরামবাবু?
পাবলিক তাই বলে।
আমি আপনার সঙ্গে একটা ব্যাপারে কথা বলতে চাই।
হরিরামবাবু তাকালেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, বসুন। তাড়াতাড়ি বলুন, আমার টাইম খুব কম। আপনার নাম?
অর্জুন।
কী করেন?
সত্যসন্ধান।
তার মানে?
আমি সত্যের সন্ধান করতে চাই। এটা করে আসছি বেশ কয়েক বছর। জলপাইগুড়ির মানুষ আমাকে চেনে।
অর্জুনের কথা শেষ হওয়ামাত্র হরিরামবাবু পকেট থেকে মোবাইল বের করে নম্বর টিপলেন, হিন্দি ভাষায় কথা শুরু করলেন। নিজের নামটা শুনে অর্জুন বুঝল, তাকে নিয়েই কথা বলছেন ভদ্রলোক। যদিও অন্য কিছু শব্দ একেবারে অচেনা মনে হচ্ছিল না। মোবাইল বন্ধ করে হরিরামবাবু বললেন আরে, বসুন, বসুন। আপনি তো বিখ্যাত মানুষ। একবার নাম বলতেই আমার ভাই কিষেনচাঁদ চিনে ফেলল। দিনবাজারে ওর গদি। চেনেন?
মাথা নেড়ে না বলল অর্জুন।
দেখুন, আপনাকে কিন্তু ও চেনে! ভদ্রলোকের কথাবার্তার ধরনই বদলে গেল, বসুন অর্জুনবাবু, রোজ এত ফালতু লোক এসে বিরক্ত করে যে, খারাপ ব্যবহার না করে পারি না। বলুন, কী করতে পারি?
অর্জুন বসল। লোকটি অত্যন্ত ঘাঘু। খুব সাবধানে কথা বলতে হবে এঁর সঙ্গে। টেবিলের উপর একটা লম্বাটে কৌটোর দিকে তার নজর গেল। হরিরামবাবু বললেন, এ জিনিস নিশ্চয়ই দেখেছেন। কৌটো তুলে ঢাকনা খুলতেই মিষ্টি বাজনা বাজতে লাগল। হরিরামবাবু বললেন, খেলনা।
কোথাকার তৈরি?
চায়না। আরে এখন এখানে চিন-ভারত এক হয়ে গিয়েছে। নেপাল ভুটান-বাংলাদেশ হয়ে ঢুকে পড়ছে নর্থ বেঙ্গলে। আপনি নিশ্চয়ই জানেন।
একটু-আধটু। আপনাদের মতো অনেক ব্যবসায়ী টাকা ঢেলেছেন ওই ব্যবসায়। প্রচুর লাভ করেছেন। অর্জুন হাসল।
তা আপনাকে মিথ্যে বলব না, করেছি। অনেক আগে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এত লোক নেমে পড়ল লাইনে যে, টানা মাল বিক্রি করাই সমস্যা হয়ে গেল। তো আমি হাত তুলে নিলাম। একথা লোকাল পুলিশও জানে।
যখন ব্যাবসাটা করতেন, তখন ওরা স্টেপ নেয়নি?
হরিরামবাবু হাসলেন, নিলে কি আপনার সামনে বসে থাকতে পারতাম? এই যে আমি এসব গল্প আপনাকে করছি, কেন করছি জানেন?
অর্জুন মাথা নাড়ল।
আমি একজন দেশপ্রেমিক, তাই। আমি অন্যায় ব্যবসায় টাকা বানিয়েছি ঠিক, কিন্তু দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করিনি। পুলিশ স্বীকার করে, আমি খবরটা না দিলে ওরা জানতেও পারত না। আরে বলুন, কোন ব্যবসায় একটু আধটু অন্যায় মেশানো থাকে না? একদম ন্যায়ের পথে ব্যাবসা করলে আজকের দিনে বউয়ের শাড়িও কিনে দিতে পারবেন না। :
পুলিশের কথা কী বলছিলেন?
মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছিল, আপনি ঠিক মনে রেখে দিয়েছেন। ছাড়ুন ওসব কথা। হরিরামবাবু বলমাত্র সেই ছেলেটি ঘরে ঢুকল, বাবুজি।
হাঁ! হরিরামবাবু তাকালেন।
আজ এক লাখ জমা দিতে হবে।
কত পিস আছে?
দশ হাজারের মতো।
হুঁ। পঞ্চাশ হাজার লস করিয়ে দিলি। শুনলাম, চল্লিশ হায়েস্ট বিড হয়েছিল। তোদের কোনও দরকার ছিল না এক লাফে এক লাখ বলার।
পঞ্চাশ বললে ওরা পঞ্চান্ন বলত। এক লাখ বলায় ওরা চেপে গেল। মনে হচ্ছে, ওরা সন্দেহ করেছিল, কিন্তু সাহস পায়নি। ছেলে বলল।
ঠিক আছে, আধঘণ্টা পরে এসো।
আমাকে যে এখনই বেরোতে হবে।
কোথায়?
ডেভিড একটা ব্যাবসার খবর এনেছে।
কত টাকার?
পঞ্চাশ লাখ।
না। ওই ব্যবসায় আমরা হাত দেব না।
ছেলেটি অখুশি হল। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেল। হরিরামবাবু বিড়বিড় করলেন, লোভ! লোভের চেয়ে বিষাক্ত সাপ দুনিয়ায় নেই। দশ হাজার ছেলেদের জুতো কাস্টমস সিজ করেছে। যারা বর্ডার পেরিয়ে আনছিল, তারা সব পালিয়েছে। তাই কাস্টমস নিলাম করল। এই ছেলে বুদ্বু, এক লাখে নিলাম ডেকে নিল। পার জুতো দশ টাকা। তো ঠিক হ্যায়।
দশ টাকার জুতো? সে কী?
একেবারে চিনে তৈরি। ভাল চামড়া।
অবিশ্বাস্য।
না অর্জুনবাবু। জুতোগুলো সব বাঁ পায়ের। ডান পায়ের একটাও নেই। এক পায়ের জুতোর জন্যে আপনি কি দশ টাকা খরচ করবেন? এক পায়ে জুতো অন্য পা নাঙ্গা! হা হা হা। হাসলেন হরিরামবাবু।
আপনি কিনলেন কেন?
কিনলাম। লাক যদি ভাল থাকে, তা হলে ডান পায়েরটাও পেয়ে যাব। দুটো পাশাপাশি করলে খরচ হবে বিশ টাকা। তখন পাঁচশো টাকা চাইলে, আপনি লুফে নেবেন। নিলামে কেনা মাল মানে সেন্ট পার্সেন্ট লিগাল জিনিস। সৎপথে ব্যাবসা একেই বলে, বুঝলেন। কিন্তু ওই যে পঞ্চাশ লাখের ব্যাবসা। ওর মধ্যে আমি নেই। পঞ্চাশ লাখ ঢাললে কমসে কম দেড় কোটি পাওয়া যাবে তিন দিনে। কিন্তু আমি আমার মাদার ইন্ডিয়ার সঙ্গে বেইমানি করতে পারব না।
কীসের ব্যাবসা?
হরিরামবাবু তাকালেন, যে-ব্যাবসা আমি করি না, তার কথা ভাবতেই চাই না।
তবু…?
আরে মশাই, এই যে আমাদের দেশে এত সন্ত্রাসবাদী, উগ্রপন্থী হাঙ্গামা চালাচ্ছে, মানুষ খুন করছে, এরা অস্ত্র পাচ্ছে কোথায়? সাধারণ পুলিশের হাতে যে অস্ত্র নেই, তা এদের কাছে চলে আসছে। ওসবের মধ্যে আমি নেই। মাথা নাড়লেন তিনি।
কিন্তু আপনার ছেলের কাছে প্রস্তাব এসেছে!
আরে, ওরা ছেলেমানুষ। এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়ায় ধান্দা নিয়ে। কে কোথায় কী বলছে, তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। এই তো, কয়েক দিন ধরে আমার কাছে বায়না করছে, আমেরিকা যাবে বলে। হরিরামবাবু হাসলেন, আমাদের পঁয়তাল্লিশ টাকা নাকি আমেরিকায় এক টাকা। সেখানে গিয়ে ব্যাবসা করলে অনেক তাড়াতাড়ি টাকা কামাতে পারবে। আমি বলি, ধীরে ধীরে এগোও, তাড়াতাড়ি করলেই হোঁচট খাবে।
এই লাইনে বিদেশিরা আসছে?
আমি তো ধান্দা প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, খবর রাখি না। তবে কোনও সাদা চামড়াকে আর এদিকে দেখতে পাওয়া যায় না। খোঁজ নিতে পারি।
প্লিজ, একটু খোঁজ নিন না।
আপনার আমার কাছে আসার উদ্দেশ্য পরিষ্কার করে বলুন তো?
দুই দেশের সীমান্ত ডিঙিয়ে যারা লাইসেন্সবিহীন ব্যাবসা করে, তাদের ব্যাবসার ধরন জানার প্রয়োজন হয়েছিল বলে এসেছি। অর্জুন বলল।
এ-খবর জানানোর জন্য আমিই যে উপযুক্ত ব্যক্তি, সেটা আপনাকে কে বলল?
হাওয়া। শিলিগুড়ির হাওয়ায় খবরটা ভাসছে।
আপনি বুদ্ধিমান। কিন্তু আমি এসব ব্যবসায় আর নেই। যা কারবার করি, কাস্টমস ডিউটি দিয়েই করি। এই অস্ত্র আমদানি আর মানুষ পাচার যারা করছে, তারা করুক।
মানুষ পাচার? অর্জুন সোজা হয়ে বসল।
আপনি বিদেশে যাবেন, পাসপোর্ট নেই, থাকলেও ভিসা পাচ্ছেন না, পাঁচ থেকে দশ লাখ ফেলুন, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
বাব্বা! এত্ত টাকা তো সাধারণ মানুষের পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।
ঘটি-বাটি, জমি বিক্রি করে দিচ্ছে। শুনেছে, ওদেশে গেলে দু-তিন বছরে কোটি টাকা রোজগার করা যায়।
এই জলপাইগুড়ি-কোচবিহারের সাধারণ ঘরের ছেলেরা এভাবে যাচ্ছে?
দুর মশাই। এখানকার ছেলেদের অত হিম্মত কী করে হবে! যাচ্ছে বাংলাদেশের ছেলেরা। আচ্ছা … হঠাৎ ঘড়ি দেখলেন হরিরামবাবু।
নমস্কার এবং ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এল অর্জুন। বারান্দায় দাঁড়াতেই দেখতে পেল ব্যস্ত শিলিগুড়ির রাস্তায় আরও ব্যস্ততা বেড়েছে।
নভেন্দুকে খুঁজে বের করা সহজ কাজ নয়। তা ছাড়া সে পশ্চিমবঙ্গে আছে না বাংলাদেশে, তাও জানা নেই। দুপুরে শিলিগুড়ির হাকিমপাড়ায় এক বন্ধুর বাড়িতে খাওয়া সেরে ফেরার পথে অর্জুন ঠিক করল, শুভেন্দুশেখরকে জানিয়ে দেবে, এই ব্যাপারে তার পক্ষে কিছু করা অসম্ভব। সঙ্গে সঙ্গে অমল সোমের মুখ মনে পড়ল। অমল সোম বলতেন, আমাদের ডাক্তারদের মতো ভাবতে হবে। যতক্ষণ খাস ততক্ষণ আশ। মাঝরাস্তায় থেমে যেয়ো না। একজন সত্যান্বেষীকে ধৈর্যের শেষ পরীক্ষা দিতে হয়।
চুপচাপ বাইক চালিয়ে আসছিল সে। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি রোডে এখন সবসময় ছুটন্ত গাড়ির ভিড়। একটু অসতর্ক হলেই দুর্ঘটনা ঘটে। হাতিমোড়ে এসে দেখল, গাড়ি দাঁড়িয়ে গিয়েছে। দুর্ঘটনার কথা ভাবামাত্রই যেন ওটা হয়ে গেল! বাইক বলেই অর্জুন রাস্তা ছেড়ে ঘাসের উপর দিয়ে সামনে চলে এল। একটা সুমো জলপাইগুড়ি থেকে আসছিল। তার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছে। শিলিগুড়ি থেকে যাওয়া টাটা ভ্যানের। দুটো গাড়ির সামনের দিকে ক্ষতি হয়েছে। সুমো গাড়ির আরোহীর সংখ্যা বেশি বলে, তারাই দাপটে কথা বলছে। ওদের মধ্যে যে সবচেয়ে বেশি চেঁচাচ্ছে, তাকে চিনতে পারল অর্জুন। রায়কত পাড়ার সাধন। কনট্রাক্টরি করে। অর্জুন বাইক রেখে এগিয়ে যেতেই অবাক হল। টাটা ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে হরিরামবাবুর ছেলে এবং তার বন্ধু।
অর্জুনকে দেখে সবাই আরও উত্তেজিত, দ্যাখো, কী অবস্থা করেছে গাড়িটার। আর-একটু হলে আমরা সবাই মারা পড়তাম। ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখাতে পারছে না। আসলে আছে কিনা সন্দেহ। পুলিশ না আসা পর্যন্ত আমি ছাড়ছি না।
অর্জুন বলল, ঠিক বলেছ। তবে গাড়ি দুটো রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে যদি কথা বললো, তা হলে ভাল হয়। বিরাট জ্যাম হয়ে গিয়েছে।
ওকে সরাতে বললে পালিয়ে যাবে অর্জুন। সাধন বলল।
না। পালাবে না। ওকে আমি চিনি। অর্জুন বলল।
কিছুক্ষণ দোনামনার পরে দু’জনেই গাড়ি সরিয়ে নিল রাস্তার পাশে। যানবাহন চলা স্বাভাবিক হল।
হঠাৎ হরিরামবাবুর ছেলে তাকে ইশারায় কাছে ডাকল। অর্জুন যেতেই ছেলেটা বলল, ওকে বলুন, ফালতু ঝামেলা না করতে। এক-দু’ হাজার দিয়ে দিচ্ছি।
দু’হাজারে ওর গাড়ি মেরামত করা যাবে না। অর্জুন হাসল।
আরে, আমার গাড়িও তো মেরামত করতে হবে। ঠিক আছে, পাঁচ নিতে বলুন।
অর্জুন সাধনকে প্রস্তাব জানাতে সে বলল, মাথা খারাপ? এগুলো মেরামত করা যায় না। রিপ্লেস করতে হয়। অন্তত বারো-পনেরোর ধাক্কা।
ইনশিয়োরেন্স আছে তো? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ। কেন?
ক্লেম করলে টাকাটা ইনশিওরেন্স থেকে পেয়ে যাবে। এই টাকা ওর টোকেন শাস্তি হিসেবে নিয়ে নাও। অর্জুন বলল।
ঠিক আছে। তবে পুলিশ এসে নোট করার পর ওকে ছাড়ব।
হরিরামবাবুর ছেলেকে কথাটা বলতে সে কাঁধ নাচাল। তারপর গাড়ির জানলা দিয়ে হাত বাড়িয়ে চিৎকার করল, আরে, আমার মোবাইল। মোবাইল কে নিল এখান থেকে? সে গাড়িতে উঠে তন্নতন্ন করে খুঁজল। তার বন্ধুও সঙ্গী হল। তারপর ছেলেটা গাড়ি থেকে নেমে এসে বলল, আমার মোবাইল কেউ ঝেড়ে দিয়েছে।
সাধন চাপা গলায় বলল, নকশা হচ্ছে?
অবশ্য দুর্ঘটনার পর যে ভিড় জমেছিল, তাতে মোবাইল চুরি যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। অর্জুন তার বাইকের দিকে এগোচ্ছিল, হরিরামবাবুর ছেলে তাকে ডাকল, দাদা, আপনার কি মোবাইল আছে?
মাথা নাড়ল অর্জুন।
ও। আপনি কি জলপাইগুড়িতে ফিরে যাচ্ছেন? ছেলেটি জিজ্ঞেস করল।
হ্যাঁ।
একটা উপকার করবেন? ছেলেটি ইতস্তত করল।
নিশ্চয়ই।
জলপাইগুড়ি বাইপাসে একটা নীল মারুতি ভ্যান দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন। ড্রাইভারকে বলবেন, এই ঝামেলায় আমি আটকে গিয়েছি। মোবাইল চুরি গিয়েছে। আমি পরে যোগাযোগ করে নেব। ও যেন অপেক্ষা না করে।
নিশ্চয়ই বলব। কিন্তু আপনার নাম তো আমি জানি না। অর্জুন বলল।
শিবরাম।
অর্জুন আর দাঁড়াল না।
ব্যাপারটার মধ্যে রহস্যের গন্ধ পেল অর্জুন। শিলিগুড়ি থেকে শিবরাম এবং তার সঙ্গী নিশ্চয়ই একজন ড্রাইভারের সঙ্গে দেখা করতে জলপাইগুড়ি বাইপাসে আসবে না। ওই নীল মারুতি নিশ্চয়ই ওদের কোথাও নিয়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। বাপ-ছেলের সংলাপ মনে পড়ল। পঞ্চাশ লাখের ব্যাবসার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিল শিবরাম, যা ওর বাবা নাকচ করে দিয়েছেন। আর বলেছিল, ডেভিড নামের একটা লোকের কথা। সেই ডেভিডের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছিল নাকি শিবরাম?
অবশ্য এসব নিয়ে ভেবে কোনও লাভ নেই। শুভেন্দুশেখর তাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তার সঙ্গে হরিরামের ছেলের কোনও সম্পর্ক থাকার কথা নয়। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল সেই লাইন, ছাই উড়িয়ে দ্যাখো, অমূল্য রতন পেয়েও যেতে পারো।
জলপাইগুড়ি শহরের শুরুর মুখে বাঁ দিকে জাতীয় সড়ক চলে গিয়েছে অসমের দিকে। অর্জুন শহরে না ঢুকে বাইপাস ধরতেই নীল মারুতিটাকে দেখতে পেল। ড্রাইভার বেশ অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখছে।
অর্জুন বাইক দাঁড় করাল, ডেভিডসাহেবের গাড়ি?
ড্রাইভার মাথা নাড়ল, হাঁ সাব। আপনি অনেক দেরি করে ফেলেছেন। বলে গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন চালু করল। তাকে বাধা দিতে গিয়েও শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিল অর্জুন। তারপর নীল মারুতির পিছন পিছন বাইক নিয়ে চলতে লাগল।
লোকটা নির্ঘাত শিবরামকে দ্যাখেনি। সে খোঁজ করে নাম বলতেই ভেবে নিয়েছে, যার যাওয়ার কথা সে এসে গিয়েছে? মজা লাগল অর্জুনের। দেখাই যাক, গাড়িটা তাকে কার কাছে নিয়ে যায়।
তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে গিয়ে লাটাগুড়ি যাওয়ার শর্টকাট পথে নীল মারুতি হাইওয়ে ছেড়ে নেমে পড়ল। একটু পরে ডান দিকে ভারতবর্ষের বিখ্যাত রেলওয়ে স্টেশন দোমহনি পড়বে। ইংরেজ আমলে দোমহনি ছিল বিরাট জংশন স্টেশন। এখন একটা ট্রেন মালবাজার থেকে এসে ওখানে থামে, জিরোয় এবং ফিরে যায়। ট্রেনটায় থাকে একটি ইঞ্জিন এবং একটি যাত্রীবাহী কামরা। সারাদিনে দু’বার আসা-যাওয়া করে ওই ট্রেন। স্টেশনের একমাত্র কর্মচারী যিনি, তিনিই সব কিছু করেন। বাকি সময়টা গ্রামবাসীদের সঙ্গে প্ল্যাটফর্মে বসে তাস পেটান। ওই স্টেশনের দিকে চলল নীল মারুতি। রেললাইন ডিঙিয়ে একটা বাংলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এই বাংলো ব্রিটিশ আমলে কোনও রেলওয়ের কর্তার জন্য তৈরি হয়েছিল। দেখে বোঝা যায়, একসময় বেশ চাকচিক্য ছিল। এখন অবহেলায় কোনওমতে দাঁড়িয়ে আছে।
অর্জুন বাইক থেকে নেমে আসতেই বারমুডা আর গেঞ্জি পরা একটা গাট্টাগোট্টা লোক সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নীচে। এসে বলল, ইয়েস?
মিস্টার ডেভিড আছেন?
আপনি কোত্থেকে আসছেন?
শিলিগুড়ি থেকে।
নাম প্লিজ।
আমি শিবরামের খবর নিয়ে এসেছি।
বলুন।
উনি আমাকে ডেভিডের সঙ্গে কথা বলতে বলেছেন।
ডেভিড একটু আগে বেরিয়ে গিয়েছে। ওর জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছে।
বেশ। ডেভিডকে বলে দেবেন, শিরবামের গাড়ি শিলিগুড়ি থেকে এখানে আসার পথে অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। ওর মোবাইলও চুরি গিয়েছে।
তাই নাকি? কেমন আছে ও?
ওর কিছু হয়নি। গাড়ির ক্ষতি হয়েছে। তাই নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় আটকে গিয়েছে।
ও কে! লোকটা মাথা নেড়ে যেখান থেকে এসেছিল, সেখানে চলে গেল।