Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

ভারি দুরন্ত হয়েছে কাকলি। চুল বব করা। দৌড়াতে গেলে গোটা শরীর যেন নেচে বেড়ায়। শাদা শাটিনের ফ্রক পরতে পছন্দ করে মেয়েটা। কাকাবাবুকে দেখলে ওর দুষ্টুমি আরও বেড়ে যায়। দাদু কাকাবাবু সকাল থেকে সেই যে উবু হয়ে বসেছে ওঠার নাম নেই। কাকলি দৌড়ে এসেছে দরজায়। মুখ বাড়িয়ে বলছে, তোমরা চান করে নাও। মা চান করতে বলছে।

প্রিয়নাথ বললেন, এই হয়ে গেল।

ভানু প্রিয়নাথের মুখ দেখল। সংসারে মন্দাকিনী বউদি, কাকলি এবং বুড়ো মানুষটা। ঠিক বুড়ো নয়, প্রৌঢ় বলা চলে প্রিয়নাথকাকাকে। বয়স বাবার চেয়ে কিছু বেশিই হবে। তবু কী করে যে কাকা হয়ে গেলেন! প্রিয়নাথকাকা, একসময় বাবার খুব বন্ধু ছিলেন। প্রিয়নাথ কাকা একসময় মা’র ভীষণ খোঁজখবর করতেন। এবং এখনও মা, একবার পুরীতে প্রিয়নাথকাকা কত অবহেলা ভরে সমুদ্রের ঢেউ থেকে তাকে তুলে এনেছিল তার গল্প করতে ভালোবাসে। সেবারে প্রিয়নাথকাকা সঙ্গে না থাকলে জলে ডুবেই মরতে হত। মা ঠেস দিয়ে বলত, তোমার বাবা যা একখানা পুরুষ! বয়সকালে প্রিয়নাথকাকা খুবই সুপুরুষ ছিলেন। আধ পাকা চুল। বাবার চেয়ে কম বয়সি মনে হয়। নিজে সুন্দর, বউমাকে বাড়ির মতো মানিয়ে এনেছিলেন। ভয় ছিল বাড়ির নীল রক্ত যেন কলুষিত না হয়। কাকলির উরু দেখা যাচ্ছিল ফ্রকের নীচে। বয়স তো খুব বেশি না। তার চাল ভুল হয়ে যাচ্ছে।

সে হেরে গেলে প্রিয়নাথকাকা খুশি হয় খুব। আর এই নিয়ে মন্দাকিনী বউদি হাসি ঠাট্টা করতে ভালোবাসে। —মন কোথায় থাকে?

প্রিয়নাথ শেষ চালে এসে দেখলেন, কিস্তি দেবার মতো গুটির বল নেই। সারাদিনই ছকের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে হবে। সুতরাং বললেন, তুমি বসো। স্নানটা সেরে নিচ্ছি। এবং কাকলিকে ডেকে বললেন, ভানুকে একটা কাপড় বের করে দে।

প্রিয়নাথ চানের ঘরে চলে গেলেই কাকলি ছুটে ঘরে ঢুকে পড়ল। বলল, তুমি ভারি মিথ্যুক।

ভানু বুঝতে না পেরে বলল, মিছে কথা কখন বললাম?

তোমাকে মারব। বলেই চুল খামচে ওর পিঠে ঝুলে পড়ল।

সান—ফ্লাওয়ার চলে গেছে বললে কেন?

আছে নাকি?

আমার বন্ধুরা তো দেখে এল।

তোকে সাউন্ড অফ মিউজিক দেখাব।

না দেখব না।

ক্রেজি বয়। খুব ভালো বই।

মেয়েটি ওর ঘাড়ে ঝুলে এভাবে অজস্র কথা আর আদর খাবার ছলনাতে বেশ জড়িয়ে যাচ্ছে। ভানুর এত ভালো লাগে কেন এটা। ইচ্ছে হয় কোলে নিয়ে ফাঁপানো চুলে বিলি কেটে দেয়। মেয়েটা বুঝতে পারে মা এখন কোথায়। তার ঘিলুতে সব সময় এই বাড়ির একটা প্রতিবিম্ব ভাসে, প্রৌঢ় মানুষটি সব সময় সতর্ক নজর রাখছেন। অথচ এই প্রৌঢ় মানুষটি না থাকলে সে যখন তখন হুট হাট এ বাড়িতে আসতে পারত না।

যেমন এখন রান্নাঘরে মন্দাকিনী বউদি, এ ঘরে সে আর কাকলি। স্নানের ঘরে প্রিয়নাথ কাকা বেশ সময় নিয়ে চান করতে ভালোবাসেন। মন্দাকিনীর চটির শব্দ পাওয়া যাবে, এ—দিকে এলেই টের পায় কাকলি মা আসছে। তখন সামনে বসে মেয়েটা পা দোলাবে। মন্দাকিনী হলুদ ছোপের হাত আঁচলে সামান্য মুছে বলবে, তোমাকে জ্বালাচ্ছে?

ভানু হেসে বলবে, খুব।

সে বলল, কাকলি রোমান—হলিডে দেখবে নাকি?

মাকে বল না!

মন্দাকিনীকে বললে, সেও বায়না ধরবে, আমাকে নিয়ে চল! এবং প্রিয়নাথকাকা মনে করেন সঙ্গে কাকলি থাকলে যে—কোনো জায়গায় ভানুর সঙ্গে মন্দাকিনী যেতে পারে। আজ রান্নার লোকটা কামাই করেছে। কামাই না করলেও ছুটির দিনে শ্বশুরকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ায় বউদি। এবং ভানু এলে বুঝতে পারে, এত বড় একটা শোক, সহজেই মন্দাকিনী বউদির উবে যায়। কাকলি পর্যন্ত সে—দিনের সেই শোককে আর মনে করতে পারে না। ভানুকে দেখলে ওরা দুজনেই ভারি খুশি হয়ে ওঠে।

ভানু এখন বুঝতে পারে না আকর্ষণটা কার প্রতি তার প্রবল! কাকলি, না মন্দাকিনী। কাকলিকে ফ্রকে আর মানায়ও না। তবু মন্দাকিনী আরও কিছুদিন হয়তো কাকলিকে বালিকা সাজিয়ে রাখবে। এবং সে টের পায়, এই বালিকা সাজিয়ে রাখার ভেতর মন্দাকিনীর যে খুব একটা বয়স না, এখনও দীর্ঘ সময় ধরে সে যুবতীর মতো বেঁচে থাকতে পারে, কারণে অকারণে ইচ্ছেটা প্রবল হয়ে উঠলে, সদ্য পাশ করা যুবতীর চেয়ে কম যাবে না, এ—সব বোধহয় বলতে চায়। এবং বিয়ের সময় কত বয়স, কবে কাকলি হয়েছে, এই হওয়ার ভেতর জন্মের তারিখ বলে—টলে আজকাল মন্দাকিনী খুব একটা সুখ পায়। এবং ওর যে কী হয় তখন! নির্দোষ কথাবার্তা। অথচ ব্যাপারটার ভেতর এমন সব ঘটনা বা দৃশ্য থেকে যায়, যা তাকে ভীষণ প্রলুব্ধ করে। আর এ—সব কথাবার্তা যে খুব গোপনে হয় তাও না। প্রিয়নাথকাকার সামনেই যে—কোনো অছিলায় একবার মনে করিয়ে দেওয়া, বাবা তো আমাকে বালিকা বয়সেই নিয়ে এল। বালিকা বয়েস! বয়েসটা তরুণীর হলে ক্ষতি ছিল কী! এবং গত চোদ্দই জুন সকালবেলায় বউদি বলেছিল, বুঝলে ভানুবাবু, বালিকাবধূতে আলাদা সুখ আছে। আসলে কী বালিকা বয়সে বিয়ে হলে খুব একনিষ্ঠ থাকা যায় এমন কিছু বলতে চায় মন্দাকিনী! না অন্য কিছু? না পবিত্র আধারে প্রবিষ্ট হবার মতো রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা শুধু বালিকাবধূতেই! কোনটা?

প্রিয়নাথকাকা স্নান সেরে যাবার সময় উঁকি মেরে বললেন, যাও ভানু, আমার হয়ে গেছে।

মন্দাকিনী বউদি সকালেই বোধহয় আজ স্নান সেরে নিয়েছে। রবিবার ভানুর ছুটির দিন। এ—দিনটাতে মন্দাকিনীও ছুটি করে নিয়েছে। এবং ভানু আজকাল কখনও কোনো হলের নীচে প্রতীক্ষা করে থাকে। মন্দাকিনী বউদিকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ারও একটা কাজ আছে তার।

প্রিয়নাথ নানাভাবেই ভানুকে এ বাড়ির জন্যে ভারি দরকারি ভেবে থাকেন। সুতরাং প্রিয়নাথ বললেন, বউমা ওকে একটা কাপড় দাও!

মন্দাকিনী বাথরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল। বলল, কী কিছু পরতে হবে না।

ভেতরে জল পড়ার শব্দ হচ্ছে। বোধহয় শুনতে পায়নি। সে বলল, ও ও মশাই কাপড় নেবেন না!

কাকলিও এসে গেছে। কেমন একটা মজা পায় এই মানুষটির কথাবার্তায়। ভেতরে মানুষটা চান করছে। শরীরে কী থাকে, স্নানের সময়ের কিছু কিছু দৃশ্য এ—সময় ওদের দুজনই ভেবে ফেলে। দুজন দু—রকম ভাবে। মন্দাকিনী খুব সরল বালিকার মতো মুখ করে আছে। কাকলি ভারি গম্ভীর। এবং দরজা সামান্য ফাঁক করে কাপড়টা নেবার সময় বোধহয় কেউ খুব একটা ভালো থাকছে না ভেতরে। লম্বা লোমশ ভেজা হাত, মন্দাকিনীর শরীর কেমন কাঁটা দিয়ে ওঠে। এবং কাকলির দৃশ্যটা বেশ মধুর লাগছিল। অথবা বলা যায় মানুষটার গায়ের গন্ধ কেমন স্নানে আর সাবানে মিশে গেছে। পরিচ্ছন্ন সুগন্ধযুক্ত সুশ্রী মানুষ, বয়স তিরিশের কোঠায়, এবং মুখে খুব বিনীত বাধ্যের ছাপ, এ মানুষকে পছন্দ না করে উপায় থাকে না।

কাকলির বায়না কত। আজকাল যে—কোনো বায়না, গোপনে অথবা সবার সমক্ষে এই মানুষটাই তামিল করে থাকে। রোমান—হলিডে দেখে কী হবে! সাউন্ড—অফ মিউজিক, একান্ত না হলে লাভ স্টোরি, সে ভেবেছিল ফিসফিস গলায় বলবে, লাভ স্টোরি বইটা দেখাবে ভানুকাকা? আমাদের ক্লাসের মাধুরী অনীতা দেখেছে। আমাকে দেখাবে? পালিয়ে তোমার সঙ্গে একদিন দেখে আসব। কেউ টের পাবে না? ফন্দি ফিকির ভাবতে সময় লাগে না কাকলির। ভানুকাকার ফোন নাম্বার জানা। বারোটা তিনটে, এবং তিনটের সময় বই দেখে ফিরলে দাদু ঠিক ভাববেন, কাকলি স্কুল থেকে ফিরছে। কোনো কিছুর জন্যে এমনিতেই আর দাদু তাকে তিরস্কার করেন না। কেবল মাঝে মাঝে দাদুর মুখ কেন জানি গম্ভীর হয়ে যায়। তখন সে বুঝতে পারে দাদু ভীষণ রাগ করেছেন। আর সে তখন এমন বিমর্ষ হয়ে যায় যে দাদু কিছুতেই আর গম্ভীর থাকতে পারেন না। —কাকলি কোথায় রে!

এই যে দাদু। সে লাফিয়ে দাদুর কাছে চলে যায়।

লেকের ধারে যাবি নাকি?

আমার ভাল্লাগে না। অতসী আসবে বিকেলে।

আমার সঙ্গে তোর কোথাও যেতে ইচ্ছে হয় না, না রে?

কেন, যাইতো। তোমার সঙ্গে সেদিন রেখা পিসিদের বাড়ি গেলাম তো।

আগে তো পা উঠিয়েই থাকতিস!

কাকলি বলবে, এখনও থাকি।

দাদু আর তারপর কিছু হয়তো বলবেন না। পত্রিকার কিছু কিছু কাটিং রাখার একটা স্বভাব আছে দাদুর। সবদিন রাখেন না। কখনও কোনোদিন রাখলে কাগজটা আলাদাভাবে তুলে নিয়ে বিছানার নিচে রেখে দেবেন। বিকেলে কাকলি এলে তাকে নিয়ে বসবেন। গঁদ এবং শাদা ফুলস্কেপ কাগজে এঁটে দেবেন দাদু কাটা কাগজগুলি। সে তা রোদে বিছিয়ে সামান্য শুকনো করে ফাইলে সাজিয়ে রাখবে। এবং কখনও দাদু ওর বই অথবা চশমা হাতে দিয়ে বলবেন, রেখে দে এবং নানারকমের সব হজমি ওষুধ খাবার পর আদর করে হাতে দেবেন! বলবেন, খা।

সুতরাং এ—বাড়িতে কাকলির বাবা নেই বলে সে হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ার কথা ছিল, দাদু, ভানুকাকা এবং মা মিলে সেটা পুষিয়ে দিচ্ছে। বরং সে এখন তার বান্ধবীদের সঙ্গে একটু রাত করে ফিরলেও দাদু কিছু বলেন না। বাবা থাকতে একটা সুন্দর রেকর্ড প্লেয়ার কিনে দিয়েছিল তাকে। তার প্রিয় গানের রেকর্ড আলমারিতে সাজানো। বাবার মৃত্যুর পর মাস দুই ভীষণভাবে মুহ্যমান ছিল। তখন দাদু যে সব গান সে শুনতে ভালোবাসত, তার কোনো একটা রেকর্ড—প্লেয়ারে বাজাতেন। যেন বাড়িটাকে আবার স্বাভাবিক করে তোলার জন্যে দাদুর শেষ চেষ্টা। শোকে বাড়িঘর অন্ধকার হয়ে থাকবে মনে হতেই বুঝি দাদু ডেকে এনেছিলেন ভানুকাকাকে। এই বাড়ির ব্যালকনিতে একজন মানুষ অফিস থেকে ফিরেই রাতের আকাশ দেখতে ভালোবাসত। এখন আর তা যেন কারও মনেই নেই। সবাই কেমন সহজেই সব কিছু মেনে নিয়েছে।

প্রিয়নাথ আজকাল নিরামিষ খেতে ভালোবাসেন। মাছ—টাছ খেতেই চান না। মন্দাকিনী তবু জোরজার করে খাওয়ায়। বাইরে প্রিয়নাথের আধুনিক মানুষের মতো ব্যবহার। ভেতরে তার এখনও একজন প্রাচীন মানুষ আছে। যে চায়—মন্দাকিনী আচার—বিচার মেনে চলুক। একজন সদ্যবিধবার পক্ষে আচার—বিচার কথাটা খুব জোর গলায় বলা ঠিক না। মাছটা মাংসটা মন্দাকিনী এখনও খাচ্ছে না। খেলে তিনি খুব একটা বাধাও দেবেন না। তবু যতদিন না খায় ততদিনই যেন একটা স্বস্তি আছে। মাছ মাংসের সঙ্গে শরীরের লোভ—লালসা বাড়ে বই কমে না। তিনি সেটা বোঝেন। এবং এ—জন্য নিরামিষ খাওয়ার ঝোঁকটা ইদানীং বেড়েছে। কাকলির অন্য রকমের স্বভাব। নিরামিষ খেতেই পারে না। তাছাড়া প্রোটিন জাতীয় খাবার বালিকা বয়সে খুবই দরকার। কাকলির জন্যে মাছ, কখনও মাংস অথবা ডিম বাড়িতে করতেই হয়। খেতে বসে মন্দাকিনী আজকাল জোরজার করে সামান্য মাছ—মাংস প্রিয়নাথকে খেতে দেয়। প্রিয়নাথও যেন কিছুটা বিরক্ত মুখে কোনোরকমে শুধু গলাধঃকরণ করা আর কিছু না, না হলেই ভালো ছিল, তবু শরীর বলে কথা, মন্দাকিনী সব সময়েই শরীরের কথা মনে করিয়ে দেয় প্রিয়নাথকে। —খান বাবা। না খেলে শরীর টিকবে কী করে। তার যেন বলার ইচ্ছে, শরীর যে সব বাবা। তার যে ইচ্ছের শেষ নেই। প্রিয়নাথের মুখোশ পরে থাকার স্বভাব সব সময়। ভেতরের লোভ তিনি সামলাতে পারেন না। খুব সহজেই খেয়ে নেন। খুব স্বার্থপরতার মতো দেখায়, এ—জন্য একদিন খাবার পর হজমি খাবার সময় ডেকেছিলেন, বউমা।

মন্দাকিনী হাত মুছতে মুছতে প্রিয়নাথের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। বউমার দিকে তিনি চোখ তুলে তাকাতে পারেননি। বড়ই পুষ্ট শরীর এবং নিরামিষ আহারে লাবণ্য বোধহয় শরীরে আরও বেড়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে ভয় পেয়ে যান তিনি। বলেন, বউমা একটা কথা ছিল।

মন্দাকিনী শুধু তাকিয়ে ছিল শ্বশুরের দিকে, কিছু বলেনি। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথায় এলে শ্বশুরমশাই এ—ভাবেই কথা আরম্ভ করেন।

আমি বলছিলাম কি……

আবার প্রিয়নাথ কথা শেষ না করেই অন্যদিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছিলেন। মন্দাকিনী তখনও কিছু বলেনি।

বলছিলাম, আজকাল কেউ আর অত মেনে—টেনে চলে না।

তুমি ইচ্ছে করলে…..’, আবার কথা শেষ না করেই সিগারেটের প্যাকেটটা খুঁজছিলেন।

মন্দাকিনী তখন বলেছিল, আমার বাবা কোনো কিছু অসুবিধা হচ্ছে না। আপনি এ নিয়ে ভাববেন না।

প্রিয়নাথ খুব খুশি হয়েছিলেন। বউমা এমনিতে খুবই বুদ্ধিমতী। কে কী পছন্দ করে বউমা ঠিক বুঝতে পারে। তিনি তখন আরও উদার হয়ে যান। বলেছিলেন, বউমা বাকি জীবনটা তোমার পড়ে থাকল। আমার দুর্ভাগ্য। চোখের ওপর দেখতে হবে সব।

এই চোখের ওপর দেখতে হবে সব, সেটা কী দেখতে হবে। দেখতে হবে, একজন সদ্য বিধবা যুবতী কীভাবে শরীরের সব ইচ্ছে নষ্ট করে দেয়। সব প্রলোভন জয় করে ফেলেছে, আসলে এটাকে কি প্রলোভন বলা চলে! একজন মানুষের স্মৃতি কতদিন বয়ে নিয়ে যাওয়া চলে! একজন মানুষের স্মৃতি তাকে কতদিন সুস্থ রাখতে পারবে—এটা কী তিনি কেবল দেখতে চান, খাদ্যবস্তুতে ভেজাল না থাকুক। এমনভাবে সব চলুক, সংসার ভেঙে না যায়, সব ঠিকঠাক চলছে, আহারে কিছু মাছ মাংস থাকুক, অথচ কেউ টের পাবে না, গোপনে সবাই সব কিছু খেতে পছন্দ করে থাকে।

মন্দাকিনী বলেছিল, বাবা, আজকাল আপনি বড্ড বেশি ভাবেন। আমার কপালে এমনই লেখা ছিল। আর আমার তো কোনো কষ্ট হয় না।

প্রিয়নাথ বউমার দিকে তাকিয়ে মনে মনে হেসেছিলেন। কষ্ট হয় না কথাটাই মিথ্যে। তবু শুনতে ভালো লেগেছিল। শরীরের কষ্ট কেউ লাঘব করতে পারে না। রুচির কথা যদি ধরা যায়, এটাও একজন প্রৌঢ় মানুষের কথা ভেবে, কারণ একমাত্র পুত্রের শোক মানুষের কাছে যে কী ভয়াবহ মন্দাকিনী সেটা বুঝতে পারে। সাধারণ রুচিতে বাধে বলেই কোনো কষ্টই কষ্ট বলে মনে করছে না মন্দাকিনী। এবং প্রিয়নাথ কখনও কখনও নিজেকে একজন সতর্ক প্রহরীর মতো দেখতে পান। যেন বাড়িটার চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। কখন দরজা খোলা পেয়ে চোর—ছ্যাঁচোড় ঢুকে যাবে ঠিক কি!

আর দিন যত যাচ্ছে প্রিয়নাথ বুঝতে পারছিলেন, যতই সতর্ক থাকুন, কিছু না কিছু অভ্যন্তরে ঘটেই যাচ্ছে। এবং যতই তিনি সতর্ক থাকুন না, অভ্যন্তরে যে সংকট, তা থেকে বউমার ত্রাণ নেই। ত্রাণ কথাটাই তাঁর মনে হয়েছিল। এবং নিজেকে এত সতর্ক রাখতে কেমন একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল। যেহেতু খুব বিবেচক মানুষ হিসেবে তাঁর খ্যাতি আছে, এবং বিবেচক হতে গিয়েই টের পেয়েছিলেন, সংসারে তিনি যে গণ্ডী সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন সেটা একজন মানুষের ওপর অবিচারের শামিল! স্ত্রী গত হওয়ার পরে বুঝতে পারতেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে তাঁর ভয়াবহ সব ইচ্ছেরা ইঁদুরের মতো কুরে কুরে খেত। এবং তিনি নীরজা নামক এক যুবতীর দরজায় কতদিন আহম্মকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতেন। দরজা খোলা পেলে নীরজা কখনও কিছু দিয়ে বলত, আর না। ভারি লোভ। এত লোভ ভালো না। তখনই মনে হত সংসারে তিনি একটা গর্হিত কাজ করে বেড়াচ্ছেন। ভুবন সাদাসিধে মানুষ। স্ত্রীর প্রতি তার অন্ধ বিশ্বাস। বিশ্বাসের ঘরে এ—ভাবে সিঁদ কাটা ঠিক হচ্ছে না। মনে মনে অহরহ একটা অনুশোচনা ছিল, অথচ কিছুতেই তিনি অভ্যন্তরে পেরেক পুঁতে দিতে পারেননি। এই অসহায় দৃশ্যাবলি আজকাল তাঁকে খুব কাবু করছে। এবং নীরজার সন্তান ভানুর প্রতি কিঞ্চিৎ টানও অনুভব করছেন। সংসার ঠিকঠাক রাখার জন্যে এটা যে কত বড় দুর্বুদ্ধি ঠিক টের পান। তবু তিনি বুঝতে পারেন, কিছু আর করার নেই। নিয়তি এ বাড়িতে আর একটা পাপ কাজ করিয়ে নেবেই। তিনি শুধু নিমিত্ত মাত্র।

ভানু এসো। ভাত দিয়েছে!

ভানু লুঙ্গির মতো করে পরেছে কাপড়টা। চুল ব্যাকব্রাশ করা। জামাটা গায়ে গলিয়ে নিয়েছে। ভেতরে গেঞ্জি নেই। বুক খোলা। ভেজা লোম বুকে লেপ্টে আছে। এবং বুক খোলা বলে, প্রায় বুকের সবটাই দেখা যাচ্ছে। কী ঘন লোম। কাল কুচকুচে। এবং উষ্ণতা ভারি গভীর। মন্দাকিনী ডালের বাটি আলু পটলের ডিস রাখার সময় গোপনে দেখে ফেলল। এবং এই দেখে ফেলাটাই কাল। দরজায় দাঁড়িয়ে ওদের খাওয়া দেখছিল আর ভেতরে ভীষণ জ্বালা অনুভব করছিল। কিছুতেই যেন প্রলোভনের হাত থেকে সে নিজেকে রক্ষা করতে পারছিল না।

প্রিয়নাথ বললেন, তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না। এ—বয়সে এত কম খেলে চলে!

ভানু বলল, এমনই তো খাই।

মাংসের বাটিটা বেশ ভরে দিয়েছে মন্দাকিনী। ভানু মাংসের বাটির দিকে তাকিয়ে মন্দাকিনীকে বলল, এত দিয়েছ কেন? এত আমি খাই?

কী খায় না খায় মন্দাকিনী তা কি জানে! প্রিয়নাথ সহসা অন্যমনস্কতার দরুণ বিষম খেলেন।

জল খান বাবা।

তাড়াতাড়ি প্রিয়নাথ জল খেলেন। এবং নাকে মুখে ভাতের কণিকা সব সুড়সুড়ি দিচ্ছিল। নিজের ব্রহ্মতালুতে হাত চেপে দিলেন দুবার। তারপর গলা খাকারি দিয়ে যেন অস্বস্তিটা লাঘব করার চেষ্টা করলেন।

এত আয়োজন! বলে ভানু আবার মন্দাকিনী বউদিকে দেখল। কাকলির খাওয়া হয়ে গেছে বলে সে বসে ছিল একটা মোড়ায়। কাকলি মার দিকে তাকিয়ে বলল, কী যে বল না কাকু! আয়োজন কোথায়। এটুকু দই খেতে পার না?

খেতে সবই পারি। তবে একটা তো পেট! কত খাব।

প্রিয়নাথ বললেন, যা—ই বল, বাঙালিদের খাবার খুব স্বাস্থ্যসম্মত। তেতো দিয়ে আরম্ভ। টক দিয়ে শেষ।

সহসা তিনি এমন কথা কেন বললেন ভানু বুঝতে পারল না। সে কথায় সায় দিল শুধু, তা ঠিক।

আমরা জানি না বলে, আমাদের যত হজমের গোলমাল।

ভানুর স্বাস্থ্য প্রবল। উঁচু লম্বা মানুষ। কোনো অসুখ—বিসুখ ইদানীং তার হয়নি। বাড়িতে মা খাবার সবসময় বেশ রিচ করে রাঁধে। বাবার জন্যে আলাদা রান্না হয়। ঝাল—টাল মা বেশি খায়। মশলা তেল বেশি দিতে ভালোবাসে। খুব একটা শরীর খারাপ হয় না তার। কিন্তু এ বাড়ির রান্না কম মশলায়। তেল ঝাল মশলা পরিমাণ মতো। তবু বুঝতে পারে মন্দাকিনীর অসুখটা ভেতরে রয়েই যাচ্ছে। কিছুতেই নিরাময় হচ্ছে না।

আসলে এটা অসুখ না স্বাভাবিক জীবন! যুবতী নারী বলতে যা বোঝায়, তার স্বাধীনতা থাকলে যা যা থাকে হাতের মুঠোয়, সবই করতে ভালোবাসে মন্দাকিনী। কিন্তু কখনও কোনো চপলতা দেখেনি। কাছে কাছে রাখতেই পছন্দ করে। অথচ প্রশ্রয় দেয় না। কেবল একটা আকর্ষণ রেখে দিয়েছে শরীরে। এমন পোশাক পরে থাকে যেন মায়াবী সব কিছুকে দূরে সরিয়ে রাখার ইচ্ছে। সাধাসিধে। এতেই আরও গন্ধটি প্রবল হয়ে যায়। পৃথিবীর যেখানেই সে থাকুক নাকের ডগায় বিধবা যুবতীর গন্ধটা লেগে থাকে।

মন্দাকিনী তখন বলল, কাকলি, তোর কাকার বিছানা করে দে।

একটু একা থাকলেই মন্দাকিনী কাজের ফাঁকে ঘরে ঢুকতে পারে। দুটো একটা কথা। কখনও চিৎ হয়ে শুয়ে থাকলে মন্দাকিনী জানলার কাছে এসে দাঁড়ায়। কপাট ভেজিয়ে দেয়। কাকলি দুষ্টুমি করতে ভালোবাসে। তখন প্রৌঢ় মানুষটা টের পায় একজন যুবক কত সহজে বাড়িটাকে স্বাভাবিক করে রেখেছে। ভানু এলেই যেন বাড়িটা প্রাণ পেয়ে যায়। তিনি তখন চোখ বুজে যৌবন বয়সের কিছু দৃশ্য দেখতে পান। নীরজা ঠিক এভাবে তাকে দেখলে চঞ্চল হয়ে উঠত। পৃথিবীতে এটা যে কী, শরীরে অথবা রক্তে এটা যে মানুষের কী এক আশ্চর্য অনুভূতি—কোনো বাধা নিষেধই কেন যে গ্রাহ্য করে না—এমন এক রহস্যময়তা টের পেয়ে পুত্রের ছবিটা দেখলেন। মুখে ভালোমানুষ, মৃত্যুটার সঙ্গে একটা ছোট কেলেঙ্কারি জড়িত। যদিও টের পায়নি কেউ। মন্দাকিনীর কী ছিল না! তিনি অঙ্ক কষে বের করতে বসে যান। তারপর বুঝতে পারেন, সবারই সব থাকে। ব্যবহারে পুরানো হয়ে গেলে আকর্ষণ কমে যায়। আর সংসারে চুরি করে খাবার স্বভাব, মানুষের বোধহয় সহজাত ব্যাপার। ঠেকানো যায় না। ছেলেটা গোপনে আর একটা প্রেম করছিল, বোধহয়। না হলে রাধা এবং সে একই গাড়িতে থাকবে কেন! রাধা আর সে একই সঙ্গে খাদে পড়ে শেষ হবে কেন!

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *