Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

আজও আবার রমাকে নিয়ে অরুণ বের হয়ে গেল। ভুবনবাবু কান পেতে শুনলেন স্কুটারের শব্দ। দূরে আরও মিলিয়ে যাচ্ছে। তাঁর এমন সুন্দর মেয়েটাকে নিয়ে একটা লোক মাঝে মাঝে উধাও হয়ে যায়। বুকের ভেতর কষ্টটা টের পান। অসহায় চোখ মুখ দেখলে মায়া হবার কথা। ভুবনবাবু কত কিছু আশা করেছিলেন। তাঁর সংসার খুব বড় নয়। ভানু যেবারে হল, তিনি চাকরি খোয়ালেন। রমা যেবারে হল, তিনি প্রমোশান পেলেন আর মানু যখন নীরজার পেটে, চাকরিতে জটিল অবস্থা। সংসারে মেয়েটাকেই বার বার মনে হয়েছে পয়া। মেয়েটার কপালে খুব সুখ থাকার কথা। এবং মনে মনে যা কিছু স্বস্তি সবই রমাকে কেন্দ্র করে। সেই মেয়েটা ক’মাসের মধ্যে কেমন হয়ে গেল। একটা লোকের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালে খারাপ দেখায়, এখন আর তেমন বলতেই সাহস পান না।

এবং সারাটা দিন অস্বস্তিতে কাটে। এই যে রমা বের হলে গেল, এবং কোথায় যাবে, যাবার সময় তো বলে গেল কোন এক অমলবাবুর বউভাত। কখন ফিরবে রমা? একবার খুব সংকোচের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যা হোক রমা খুব একটা মুখ করেনি। ভালো মতই বলেছে, ফিরতে সন্ধ্যা হবে।

ফিরতে সন্ধ্যা হওয়ার ব্যাপারটা খুব ভয়ের নয়। কতদিন তো রমার ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়। তিনি বারান্দায় পায়চারি করেন। রাস্তায় স্কুটারের শব্দ পেলেই বুঝতে পারেন, রমা এল। অরুণের স্কুটার অন্য দশটা স্কুটার থেকে যেন আলাদা। শব্দটা তাঁর ভারি চেনা। দশটা স্কুটারের ভেতর কোনটা অরুণের তিনি আজকাল ঠিক টের পান। ঘরের ভেতর বসে বুঝতে পারেন, মানু সদর খুলছে। ওরা এল।

অথবা স্ত্রীকে বলবেন, এত রাত করে যে ফিরছে, কিছু বল না কেন?

তুমিও তো বলতে পারো।

আমার কি শোভা পায়। তুমি মা। স্ত্রীজাতির কলঙ্কটা কী তা বোঝো। তুমি বললেই ভালো হয়। আমার পক্ষে বলা শোভা পায় না।

নীরজা যে কিছু বলেনি এমন নয়। কিন্তু রমা এমন গম্ভীর মুখে তখন চেয়ে থাকে যে তিনি সাহস পান না। রমা মাঝে মাঝে মাকে ভীতু দেখলে হেসে ফেলে।—আচ্ছা মা, আমি তো তোমার মেয়ে, তবে ভয় পাও কেন?

নীরজা ভিতরে আরও গুটিয়ে যায় তখন। রমা তো জানে না, ওর বয়সে তিনি খুব ভালো ছিলেন না। অথচ সব মায়েরাই তো এমন মুখ করে রাখে যে মনেই হয় না, যৌবনে কী একটা যেন হলে ভালো হয়, সব থেকেও কিছু একটা নেই, সব মায়েরাই যে সব বাচ্চাদের অজ্ঞাতে গোপনে কিছু করে ফেলতে পারে, রমা বুঝি তা জানে না। নীরজার চুলে পাক ধরেছে। বয়সানুযায়ী একটু বেশি পেকেছে। কপালে বড় সিঁদুরের ফোটা সতী—সাধ্বী করে রেখেছে। নীরজা বলতে পারত, আমাদের কালটা একটু অন্যরকমের ছিল। অতটা খোলামেলা ছিল না। তোমরা বড় খোলামেলা। ভয়টা সেজন্যই বেশি।

রমা মাকে জড়িয়ে বলত, আমাকে তুমি কী ভাবো মা?

নীরজা কিছু তখন বলতে পারত না। কারণ সংসারটা সত্যি আর আগের মতো নেই। জীবনধারণের জন্য কত কিছু আজকাল দরকার হয়। সাধাসিধে ভাবে বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই আজকালের ছেলেমেয়েদের কাছে। যা আছে চারপাশে দেখে নাও, জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। নীরজা আজকাল নিজের কাঙালপনাও মাঝে মাঝে টের পায়। মেয়েকে খুব বেশি একটা কিছু বলতে পারে না।

ভানু বাজারের থলে রেখেই বলল, মানদাকে বল চা করে দিতে। আমি বের হব।

কোথায় বের হবে সবাই জানে। নীরজা বলল, মানদা বাজারটা সাজিয়ে রাখ। দাদাবাবুকে চা করে দাও। ডিম ভেজে দাও টোস্টের সঙ্গে।

মানু গুনগুন করে তখন গান গাইছিল। মানু উবু হয়ে রেডিয়োর নব ঘোরাচ্ছে। ছুটির দিনে সকালেই বাড়িটা একে একে খালি হয়ে যায়। মানুবাবু এখনও ঘরে আছে দেখে ভানু বিস্মিত হল। গতকাল হেরে এসেছে। হেরে গেলে বাড়িতেই ঘাপটি মেরে বসে থাকে। কেউ ডাকলেও সাড়া দেয় না। মন ভালো নেই মানুর তবু একবার জিজ্ঞেস করল, অরুণ চলে গেছে?

দিদিকে নিয়ে চলে গেছে।

তোর কাজের কথা কিছু বলল?

না।

একবার জিজ্ঞেসা করলে পারতিস।

মানু কিছুতেই সেন্টারটা পাচ্ছে না। দাদার কথা খুব অবহেলা ভরে যেন শুনছে। বাড়ির ভেতর একটা জঘন্য ঘটনা ঘটছে দিনের পর দিন। অথচ সবাই চোখ বুজে আছে। কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না। কেমন ব্যক্তিত্বহীন বাবা। দাদা স্বার্থপর হয়ে উঠছে। মানু একটা চাকরি পেলেই পড়াশোনা ছেড়ে দেবে। দাদাও নিজেরটা বুঝে নেবার জন্য আজকাল বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে—সে কঠিন এবং রুক্ষ গলায় জবাব দেবে ভাবছিল আর তখনই বাবার কাশির শব্দটা বেয়াড়া রকমের। সে আর সাহসই পেল না কিছু বলতে। কেবল দাদার দিকে একবার মুখ তুলে তাকাল।

তখন বোঝাই যায় দিদির এমন অসামাজিক আচরণে সবারই সায় আছে। অরুণ এলে তাদের সবাইকে খুব ভদ্র হয়ে যেতে হয়। যতটা নয় তার চেয়ে বেশি। যেমন বাবা দাদা মা সবাই তখন একটা সুন্দর মুখোশ পরে ফেলে। পবিত্র সব কথাবার্তা। যেন কোনো দেবদূত অরুণদা। দেবদূতরা তো শরীরের কিছু বোঝে না। মানু বন্ধুদের কাছে খুব গর্বের সঙ্গে বুকে টোকা মেরে আর কথা বলতেও পারে না। বিশেষ করে কলেজে নানুর সঙ্গে দেখা হলে মাথাটা তার নুয়ে আসে। নানু গম্ভীর প্রকৃতির ছেলে। খুব সিরিয়াস জীবন সম্পর্কে। রাজনীতি নিয়ে কথা উঠলে নেতাদের সে চোর বাটপাড় ছাড়া ভাবে না। কী হয়ে গেল দিদিটা! আমরা কী হয়ে গেলাম!

দিদির আগের সুনাম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বোঝাই যাচ্ছিল। সে তো নিজেও কম হাঁটাহাটি করছে না, সে যদি কোথাও চাকরি পেয়ে যেত, তবে, তবেই বা কী, দিদি কী এমন একটা রঙিন জগৎ থেকে নেমে এসে বলবে, খোকা, আমি ফের ভালো হয়ে গেছিরে।

মানু তখন শুনতে পাচ্ছে বড়দা শিস দিচ্ছে ঘরে। বড়দা ফিরবে প্রায় একটায়। বাড়ি থেকে সকালে বের হবার সময় শিস দিয়ে গান গায় দাদা। মানু দাদার এত উচ্ছ্বাস কেন টের পায়! ছুটির দিনে প্রিয়নাথ কাকার বাড়িতে সকালটা কাটিয়ে আসবে। মন্দাকিনী বউদি আজকাল খুব যত্ন করছে। প্রিয়নাথ কাকার বিধবা পুত্রবধূ মন্দাকিনী বউদি। গত অক্টোবরে রাঁচির কাছে কার অ্যাকসিডেন্টে দাদা মারা গেলেন। বাবা কি টের পায় সব। বাবা কি টের পেলেই কাশতে থাকে খক খক করে।

মানু সেন্টারটা কিছুতেই পেল না। জয়ার কাছে একবার যাবে। জয়া তো এখন পার্লারে বসে কবিতা লিখছে। কোথায় একটা কাগজে জয়ার কবিতা বের হয়। আজকাল গিয়ে কাছে বসে থাকলেও জয়া টের পায় না, একজন তরুণ যুবক ওর সামনে বসে আছে। সে কবিতা—টবিতা পড়তে ভালোবাসে না। বোঝেও না। বরং খেলার খবর যত আছে—কে কোন সালে কার কাছে কত পয়েন্ট ছিনিয়ে নিয়েছে গড় গড় করে বলে দিতে পারে। উঠতি খেলোয়াড় টমসনের ফাস্ট বলের গতি কত, অমৃতরাজ ভ্রাতৃদ্বয় শেষ পর্যন্ত ডেভিস কাপের ফাইনালে উঠতে পারবে কী না, না উঠতে পারলে ওর রাতের ঘুমটাই মাটি হবে। বরং তাকে বললে, সে সহজেই খেলা বিষয়ক রচনা লিখে দিতে পারে। কবিতার মাথামুণ্ড সে কিছুই বোঝে না। জয়া তাকে একদিন বলেছিল, মানু তোমার এমন সুন্দর চোখ, তুমি কবিতা লিখতে পারো না কেন? তোমার চোখে যদি চুমো খাই রাগ করবে?

মানু বলেছিল, যাঃ তুমি তো মেয়ে। চোখে চুমো খাবে কী।

চোখে চুমো খেলে আমি সুন্দর কবিতা লিখতে পারব। এসো না খাই।

কী হবে কবিতা লিখে?

তুমি বুঝবে না মানু। মানুষ কী সুন্দর হয়ে যায় কবিতা লিখতে পারলে।

চোখে চুমু না খেলে কষ্ট হবে তোমার?

খুব।

তবে খাও। সে চোখ বুজে দাঁড়িয়েছিল।

জয়া তখন উঠে চারপাশে কী দেখে নিল। বাঘা পায়ের কাছে লেজ নাড়ছে। সে উঠে পড়তেই বাঘা উঠে পড়েছিল। সুন্দর জি আর মিনি স্কার্ট পরা মেয়েটার শরীরে কী যে আশ্চর্য গন্ধ! সে চোখ বুজেছিল—কারণ, বুঝতে পারছিল দুহাত বাড়িয়ে তাকে জড়িয়ে নিয়েছে জয়া। কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে উঠছিল তখন। জয়ার বাবা ওপর থেকে বলেছিল, ‘বাঘা অসময়ে ডাকছে কেন রে!’

জয়া চুমো খেতে খেতে বলেছিল, বাঘা খুব অসভ্য হয়েছে বাবা। সময় অসময় বোঝে না।

মানু একদণ্ড দেরি করেনি। ধাঁই করে লাথি মেরেছিল বাঘার পেটে। বাঘা আর একটুও চিৎকার করেনি। জয়ার ঠোঁটে মিষ্টি গন্ধ। সে বাড়ি ঢুকে বাথরুমে সাবানে ঘষে ঘষে গন্ধটা তুলে ফেলেছিল। পালিয়ে সিগারেট খাওয়ার মতো কোনো গন্ধ যদি দিদি টের পেয়ে যায়—মানুটা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

সংসারে নষ্ট হয়ে গেলে কেউ আর তখন ভালোবাসতে চায় না। সে এ জন্যে সব সময় ভালো থাকতে চেয়েছে। উঠতি বয়সে যা সব ইচ্ছে থাকে, তারও আছে। সে একদিন সিগারেট খেতে পারল না পালিয়ে। কতদিন ভাবত নানুকে নিয়ে সে বাবুঘাটে চলে যাবে, অথবা গড়ের মাঠের ঠিক মাঝখানটায়। দু’জনে দুটো সিগারেট কিনে নেবে মেট্রোর নিচ থেকে। তারপর সন্তর্পণে হাঁটতে হাঁটতে একেবারে যখন বুঝবে কেউ নেই, পরিচিতি কোনো মুখই তাকে আর দেখছে না, তখন সিগারেট জ্বালিয়ে বেশ বড়দের মতো টানবে। ইচ্ছেটা সেই কবে থেকে। পরীক্ষায় সে ভালো করতে পারে না কেন বোঝে না। কেবল খেলা সম্পর্কে ভারি উৎসাহ তার। আসলে সে খেলা পাগল বলে, অন্য দশটা কুকর্ম করার সময় একেবারেই পায়নি। তার বয়সের ছেলেরা কত সব অভিজ্ঞতার কথা বলে। সে একটাও বলতে পারে না। তবু যা হোক জয়াকে মাস দুই আগে ভাগ্যিস হাতের কাছে পেয়ে গেল। জয়া তাকে মাঝে মাঝে আজকাল সাহসী হতে বলছে।

দিদির এই সকালে বের হয়ে যাওয়াটা ভালো লাগছিল না। বাবা কিছু বলে না। দাদাও বের হয়ে যাচ্ছে। কেমন সবাই আলগা হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। ছ’মাস আগেও এটা ছিল না। কেমন সবাই মিলে সুন্দর একটা সংসারের ছবি ছিল বাড়িতে। দিদির চাকরিটা দাদাকেও কেমন স্বার্থপর করে ফেলেছে। সে বুঝি ভাবছে, এবার চলে যাবে। এতদিন তো টানা গেল, এবার ছুটি।

মা তখন ডাকল, মানু খেয়ে যা।

ওর খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। এবং কেমন বিরক্ত গলায় বলল, রেখে দাও।

রেখে দেবটা কোথায় শুনি! তোমাদের সবার খাবার নিয়ে কতক্ষণ বসে থাকব?

কে বলেছে বসে থাকতে?

নীরজা আজকাল দেখেছে মানু প্রায়ই মুখে মুখে উত্তর করে। স্বভাবটা কেমন চোয়াড়ে হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। বড়টাকে কিছু বলতে পারে না। মেজটা তো স্বাধীন হয়ে গেল চাকরি পাবার পর। ছোটটা পর্যন্ত মুখ করছে। নীরজা অগত্যা মানুর সকালের জলখাবার প্লেট দিয়ে তার ঘরে ঢেকে রেখে দিল। যখন খুশি খাবে। মুখে কিছু বলল না।

আজকাল বাড়ির খাবারের মেনু পালটে গেছে। আগে ছিল দুখানা রুটি, সামান্য আলুর তরকারি। দিদির চাকরিটা সংসারে প্রাচুর্য এনে দিয়েছে, ডিমের পোচ, মাখন, স্লাইস পাউরুটি, এক গ্লাস হরলিক্স। এত খাবার দেখে, তার বমি পাচ্ছিল। দিদি রুমাল উড়িয়ে কোথায় যায়, কী করে, সব বুঝতে পারে। একদিন ভেবেছিল বলবে, দিদি তুই আর যাস না। আমি কাঁচামালের ব্যবসা করব। আমাদের ঠিক চলে যাবে। তারপর মনে হয়েছিল ইস, কে শুনবে তার কথা। আর বাবা যদি জানতে পারে বাজারে আনাজপাতি বিক্রি করার কথা ভাবছে সে, তবে আর রক্ষে থাকবে না। মানসম্মান এভাবে খোয়াতে রাজি নই।

সে একটা জামা গায়ে দিল। সকালটাতে কিছু করার থাকে না। অন্যদিন দাদার অফিস, দিদির অফিস থাকে বলে বাজারটা সে করতে যায়। সকালের কাগজটা দেখা হয়ে গেলেই যেন সারাদিনের কাজ তার শেষ। গল্পের বই সে দু—একবার পড়ার চেষ্টা করছে, কোনো মজা নেই কোথাও। বরং এ পাড়ায় সে অনেকের ফুট—ফরমাস খেটে দেয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কেউ মরে গেলে কাঁধ দেওয়া, দত্তবাড়ির বউ যাবে রামগড়ে, কে যাবে সঙ্গে, ভুবনবাবুর ছেলে মানুর কথা তখন সবার মনে পড়ে যায়। মানু পাড়ায় এভাবে বেশ ইজ্জত নিয়ে বেঁচেছিল। দিদিটা রুমাল উড়িয়ে বউভাত খেতে যাচ্ছে। বাবার এত সুখ সয় না বোধহয়। কেমন সব সময় শঙ্কিত মুখ। একটা জ্যান্ত উটের ছবির মতো বাবা গলা বাড়িয়েই আছে।

সেও নেমে গেল সিঁড়ি ধরে। কোথায় যাবে জানে না। বের হতে ইচ্ছে ছিল না। এই সময়টাই বোধহয় সবার ভালো না লাগার সময়। বিকেলে দো—আসমান দেখা যাবে। জয়া তাকে দিয়ে টিকিট কাটিয়ে রেখেছে। সকালটাই বড় বেশি একঘেয়ে। হাবুল পালের রোয়াকটাই সর্বোৎকৃষ্ট জায়গা। ওরা পাঁচ—সাতজন নানা রকম খবরে মেতে থাকতে পারে তখন। কিন্তু হেরে গেছে দল। সে মানত পর্যন্ত করেছিল। কালীবাড়িতে লাল জবা দেবে। গেলেই ছেঁকে ধরবে পিছনে লাগবে। তবু আড্ডা ছাড়া হাতের কাছে এখন তার করার কিছু নেই। এবং যেতেই রুমন বলে ফেলল, কত টেম্পারেচার?

কোনো টেম্পারেচার ওঠেনি।

আয় না দেখি।

মন ভালো নেই রুমন। ঝামেলা করবি না।

কী ঝামেলা করলাম মাইরি। বুককি শালা মাইরি তোকে কী বলবে বলে কখন থেকে বসে আছে।

কিছু বলতে হবে না। কে শুনছে ওর কথা।

বুককি বলল, খাঁ খাঁ করছে গুরু।

সবারই খাঁ খাঁ করছে। কেউ ভালো নেই। চুপচাপ বসে থাক। অথবা গান গাও, শুনি!

বুককি বলল, অসময়ে গান গাইতে বলছ?

গা না। যা মনে আসে।

চাঁদবদনী ধনি নাচ তো দেখি গাইব?

গা না। কে বারণ করেছে। যেটা ভালো লাগে গা।

রুমন বলল, আমি নাচব তবে।

মানু বলল, না তোমায় নাচতে হবে না।

বুককি চোখ বুজে ফেলেছে। ওর গানের গলা ভালো। হুবহু নকল করে ফেলতে পারে একবার শুনে। অথচ কোনো প্রচেষ্টা নেই। কে জানে চেষ্টা থাকলে হয়তো সেও একটা কিশোরকুমার হয়ে যেতে পারত। আসলে বুককি যতটা আড্ডাবাজ হুল্লোড়ে ততটা সিরিয়াস নয় জীবনে। অথচ সব সংগীত সম্মেলনে বুককিকে দেখা যাবে বাইরে গাছের নীচে বসে আছে। নিবিষ্ট মনে গান শুনতে সে ভালোবাসে। মানু বলেছিল, তুই তো গান শিখতে পারিস। চর্চা করিস না কেন?

এই যে করছি। বলেই সে গান জুড়ে দেয়। চর্চা তো তোমরা এলেই শুরু হয়ে যায়। তোমাদের ভালো লাগলে আর কার ভালো লাগল না লাগল গ্রাহ্য করি না। যেন এ কটি বন্ধুর জন্যেই সে অতি যত্নে গলায় গান তুলে ফেলে। এবং ওদের যতক্ষণ না শোনাবে বুককি কেমন অস্বস্তিতে থাকে।

বুককি বেশ মজার গান জুড়ে দিয়েছে। চাঁদবদনী ধনি নাচ তো দেখি। ওরা রেলিঙে ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই একটা পার্ক, সেখানে সকালে টেনিস খেলে কেউ কেউ। হকার্স কর্নারে দোকানপাট খুলছে। পাড়ায় কে কোন বাড়িতে থাকে সবই তারা জানে। তরুণী মেয়েরা অথবা যারা কৈশোর পার হয়ে যাচ্ছে সবার একটা করে তাদের নিজস্ব নাম আছে। ধবলী যাচ্ছে, যদি চাঁদবদনী ধনি নাচ তো দেখি বুককি না গাইত, তবে ঠিক চেঁচিয়ে বলত, ধবলী যায়, কী হবে হায় এই সব পঙ্গপালের।

যেন সত্যি আর একটা গান। অথচ বুককি সত্যি গানটা মন দিয়ে গাইছে। গান শুনে যে নিস্তেজ পর্বটা ছিল মানুর, নিমেষে কেমন উবে গেল। বলল, বুককি তুই কী বলবি বলেছিলি রে?

গুরু দোষ নেবে না বল।

দোষ নেব কেন!

দোষ হলে ক্ষমা করে দেবে বল।

এই হচ্ছে বুককি। আসল কথাটা বলার আগে এত বেশি ভনিতা করবে যে শোনার সব আকর্ষণ নষ্ট হয়ে যায়।

বুককি! কেমন চেঁচিয়ে উঠল মানু!

রুমন বলল, তোর কি মেজাজটা আজ ঠিক নেই রে!

মানু কিছু বলল না।

হার জিত তো খেলায় আছেই।

রুমন! খুব স্থির গলা মানুর।

কেমন হতচকিত রুমন। বুককি বলল, দোস্ত তুমি যা দেখাচ্ছ তারপর আর দেখছি কিছু বলাই যাবে না।

মানু হাতে বালা পরেছে বছর খানেক হয়ে গেল। সে ডান হাতের বালা বেশ টেনে ওপরে তুলছে। মানু ভেতরে ভেতরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লে এমন করে থাকে। ওর কেন যে মনে হয় ঠিক এই সময়ে দিদি কিছু করছে। দিদিকে জোর করে কেউ কিছু করছে। সে রোয়াকে বসে পড়ল। পিন্টিদের বাড়ির তিনতলার জানালার দাঁড়িয়ে পিন্টির কাকা সিগারেট খাচ্ছে। পিন্টি একবার পুজোর মণ্ডপে রাত জেগেছিল। পিন্টির শরীরে এক রকমের সুন্দর গন্ধ আছে। সে মেয়েদের আলাদা গন্ধ টের পায়। জয়া পিন্টি বুলার শরীরে এক এক রকমের গন্ধ।

মানু মনে মনে হেসে ফেলল। যত সব বাজে ভাবনা তাকে সব সময় বিপর্যস্ত করছে। যেমন, দিদি যখন কলেজে পড়ত, একটু দেরি হলেই তার মনে হত, এই বুঝি কেউ এসে খবর দিয়ে যাবে অ্যাকসিডেন্ট। দিদির খাতায় রোল নাম্বার, ইয়ার এবং কলেজের নাম যদি না থাকে, কোনো ঠিকানায় তাকে খুঁজে পাবে না। এবং দিদি ফিরে এলেই বলেছিল, তোর খাতায় রোল নাম্বার, কলেজের নাম লিখে রাখিস তো?

রমা কিছুই বুঝতে পারত না। মানু এ—ধরনের কথা কেন বলছে, রমা একবার দেখেছিল, ওর ব্যাগে একটা চিরকুট। কী খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করেছিল। নাম, ঠিকানা লেখা। এবং ঠিক মানুর হাতের লেখা।

মানুর এই ধরনের অশুভ চিন্তা করার একটা বাতিক আছে। বাবা যখন অফিস থেকে রিটায়ার করে তখন বয়স তার খুব একটা বেশি না। বাবা একটু রাত করে ফেললেই জানালায় দাঁড়িয়ে ছটফট করত মানু। আর মনে হত, কেউ বলছে—এটা কি ২৩/১০ এর বাড়ি? এখানে ভুবনবাবু বলে কেউ থাকেন? আপনি ভুবনবাবুর কে! তিনি হাসপাতালে।

মানু বলল, বুককি নির্ভাবনায় বলতে পারিস।

গুরু তোমার জয়া কিন্তু প্রেম করছে।

কার সঙ্গে?

সে তো গুরু জানি না।

ওর অনেক কবি বন্ধু আছে। জয়া বলেছে, কবি বন্ধুদের নিয়ে জয়া মাঝে মাঝে বেড়ায়।

বুককির মুখটা মানুর কথায় কেমন ফ্যাকাশে দেখাল। সে ভেবেছিল জোর একটা খবর দেবে আজ মানুকে। কিন্তু মানু কোনো উত্তর দিল না। কলেজ স্ট্রিটের পিছনের দিকটার একটা রেস্টুরেন্টে সে জয়াকে দুদিন দেখেছে। পর্দা ঘেরা সব কেবিনে নানা রকমের নষ্টামি করার জায়গা। বদনাম আছে জায়গাটার। উঠতি কলেজ পালানো সব ছেলেমেয়েদের খুব ভিড় হয়। সহজে কেবিন পাওয়া ভার। একবার ঢুকে গেলে কেউই বের হতে চায় না। এমন জায়গায় সে জয়াকে দেখেছিল। সঙ্গে সুন্দর মতো তার বয়সি একটা ছেলে।

বুককি বলল, কবি বন্ধুরা বুঝি খুব ভালো ছেলে হয়?

অন্তত তোমাদের মতো না।

রুমন বলল, মাইরি, আমিও কবিতা লিখতে আরম্ভ করব ভাবছি।

ভেবে দ্যাখ না। চাট্টিখানি কথা না। কবি হতে চাইলেই কবি হওয়া যায় না। জয়ার নাম আছে।

বুককি বলল, ছেলেটার যদি ফ্যাচাং করার ইচ্ছে হয়ে যায়।

মানু বলল, ফ্যাচাং করার ইচ্ছে হবেই না। কবিতা ভারি মধুর ব্যাপার। কবিরা কবিতা ছাড়া কিছু বোঝে না, জানে না।

রুমন বলল, বিকেলে তোর খেলা আছে?

বিকেলে আমি আর জয়া দো—আসমান দেখতে যাচ্ছি।

আর সেই আশায় সেদিন ম্যাটিনিতে সে হলের নীচে দাঁড়িয়েছিল জয়া আসবে—সে আর জয়া হলে ঢুকবে। টিকিট জয়ার কাছে। জয়ার জন্যে চারপাশের ভিড়ের ভেতর যখন উন্মুখ ছিল তখনই মনে হল দূরে জয়া কারও সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। সে কাছে গিয়ে বলল, এসো। শো আরম্ভ হয়ে যাবে।

জয়া বলল, তুমি যাও মানু। বলে একটা টিকিট দিয়ে দিল। আমার যাওয়া হবে না। তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম।

তার মানে?

আমার আজ কবিতা পাঠ আছে। এর নাম কালিদাস! ও আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে বাড়ি গেছিল।

মানুর মাথাটা ঝিম ঝিম লাগছিল। ভেতরে একটা ক্রুদ্ধ বাঘ হাই তুলছিল। সে কিছু বলতে পারল না। কবিরা খুব সুন্দর কথা বলে! জয়া কত সুন্দরভাবে কথাটা বলল। সে কোনো রকমে বলল, আপনিও বুঝি কবিতা লেখেন?

কালিদাস বলল, জয়ার জন্য লিখি। জয়ার খুব ভালো লাগে আমার কবিতা। মানুর ইচ্ছে হয়েছিল জানার, তার জন্যে কেউ কিছু লেখে কিনা। কিন্তু সে দেখল, ওদের যাবার এত তাড়া যে আর একটা কথাও বলার সময় নেই। সে ভ্যাবলাকান্তর মতো দাঁড়িয়ে থাকল। সামনের বাসটায় দৌড়ে উঠে গেল জয়া আর তার কবিবন্ধু। সে দুঃখী মানুষের মতো দাঁড়িয়ে থেকে টিকিটটা মুখে পুরে দিল। তারপর শক্ত দাঁতে কট কট করে কাটতে থাকল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *