মানুষের হাহাকার – ছাব্বিশ
নানু এখান থেকে চলে যাবার পর দুখানা চিঠি লিখেছে। চিঠি দুটো রাসবিহারী খুব যত্নের সঙ্গে তার নিজস্ব কাঠের বাক্সে রেখেছিলেন। তিনি ভাবলেন, চিঠি দুটো ফের আর একবার পড়ে দেখবেন। আজ দুপুরে রানুরও চিঠি এসেছে। চিঠিতে এবার রানু নানুর সব খবর জানার জন্য খুব উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এতদিন পরে ছেলের জন্য এই উদ্বেগটুকুতে রাসবিহারী বিশেষ প্রসন্ন। নানু মার কথা তার চিঠিতে কোথাও উল্লেখ করেছিল কী না, যদি না করে থাকে—আসলে কী একটা বয়েস হয়ে যায়, যখন ছেলেমেয়েরা নিজস্ব এক জগতের বাসিন্দা হয়ে যায়—তখন সম্পর্কে চিড় ধরে বোধহয়। কিন্তু আশ্চর্য চিঠি দুটো খুঁজে পেলেন না। তিনি তো চিঠি দুটো তার কাঠের বাক্সেই রেখেছিলেন। এখন আর কাউকে ডেকে বলতে পারেন না, তোমরা আমার বাক্স কেউ হাঁটকেছ। শেষ দিকে মিতার এই স্বভাব ছিল। টাকাপয়সার দরকার হলে সে অনেক সময় বাক্স হাঁটকাত। টাকাপয়সা তিনি সবসময় বইয়ের ভাঁজে রাখেন। বাক্সটায় তার কিছু ধর্মগ্রন্থ আছে। পাতার ভাঁজে ভাঁজে টাকা, চিঠি, পুজোর ফুল বেলপাতা, এবং তাবিজ ও একটি রুদ্রাক্ষের মালা সবই ঠিক আছে অথচ চিঠি দুটো নেই।
তিনি অগত্যা মেয়ের চিঠির জবাব লিখতে বসলেন। লিখবেন, নানু ভালো আছে। ওর পর পর দুখানা চিঠি পেয়েছি। ওখানে ও জমিজমা কিনে চাষ—আবাদ করবে বলে জানিয়েছে। শহর তার ভালো লাগছে না। সে লিখেছে, আমি একটা নতুন জগৎ আবিষ্কার করেছি দাদু। ফুল ফল গাছপালার কথাও লিখেছে। রাতের জ্যোৎস্না খুব মায়াবী। সকালের সূর্য আশ্চর্য প্রাণপ্রাচুর্য এনে দেয়। দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ, আর রাতের গভীর নিস্তব্ধতার মধ্যে অজস্র নক্ষত্রমালা দেখতে দেখতে প্রায়ই তার মনে একটা প্রশ্ন জাগে, এবং সে প্রশ্নটা বাকি জীবনের সত্যাসত্য নিয়ে। নানু লিখেছে, দাদু তুমি নিজেও এই পৃথিবীতে এনে এমন একটা প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। শেষে লিখেছে, আমি যে লাল বলটা হারিয়েছিলাম, এখানে এসে সেটা ফিরে পেয়েছি।
পরের প্যারাতে কী লিখবেন ভাবলেন, নানু সম্পর্কে চিঠি থেকে তার এই কথাটুকু মনে হয়েছে। তিনি নানুকে লিখেছিলেন, মাকে চিঠি দিয়ো। রানুকে চিঠি দিলে পত্রে তার উল্লেখ থাকত। পত্রে নানুর চিঠির কোনো উল্লেখ নেই দেখেই বুঝতে পারলেন, নানু তার মাকে কোনো খবরই দেয়নি। এমনকি আর কাউকে সে চিঠি লেখেনি। অবশ্য নানু যে স্বভাবের তাতে আর কাউকে সে চিঠি লিখতেও যাবে না। চিঠি পাবার পর মনে হয়েছে একবার তিনি সত্যি নানুর কাছে চলে যাবেন। কিন্তু স্টেশন থেকে পাঁচ সাত ক্রোশ হেঁটে গেলে নানুর সেই স্বপ্নের দেশ। এ—বয়সে এতটা পথ হাঁটতে পারবেন কিনা সংশয়ে এখনও তাঁর যাওয়া হয়ে উঠল না। সংসারে তিনি এখন মুক্ত। অথচ কথাটা যত সহজে ভাবতে পারলেন জীবনযাপনে যদি তার বিন্দুমাত্র আঁচ পাবার চেষ্টা করতেন। হাজার রকমের গেরো তাঁকে সবসময় বিড়ম্বনার মধ্যে রেখে দিয়েছে। হেমর শরীর দিনকে দিন খারাপের দিকে। ইদানীং শ্বাসকষ্টে ভুগছে। ওষুধপত্রে কাজ দিচ্ছে না। টোটকা করেছে কিছুদিন, তারপর দেবস্থানে গিয়েছে। বর্তমান গুরুর খোঁজে আছে। কোনো এক ব্রহ্মচারীর খবর পেয়ে দুদিন সেখান থেকে ঘুরে এসেছেন। কিন্তু গুরুটিকে পছন্দ হয়নি। তবে বাড়িতে সাঁইবাবার ছবি ঝুলিয়ে কিছুদিন বেশ প্রশান্তিতে ছিল, কিন্তু শ্বাসকষ্ট বাড়তেই সে বলেছে, আমাকে প্রভুর কাছে নিয়ে চলো। মনে মনে তার প্রভু ঠিক হয়েই আছে—অযথা গুরুর খোঁজাখুঁজি করেছে। শীতের শেষে ভেবে রেখেছেন, এবার প্রভুর কাছে হেমকে নিয়ে যেতেই হবে। প্রভুর দর্শনে যদি হেম আরোগ্য লাভ করে। নানুর কাছে কবে যাবেন কিছুতেই স্থির করে উঠতে পারছেন না।
চিঠি লিখতে বসে এই সব হাবিজাবি রাসবিহারীর মনে আসতে থাকে। মানুষের মৃত্যুভয় সব আত্মপ্রত্যয় নষ্ট করে দেয়। অথচ সহজভাবে ভাবলে, এটাই কী নিয়ম, এভাবেই মানুষ সংসার করতে করতে একদিন শেষ হয়ে যায়, এটা বোঝা উচিত। হেমকে এসব বলেও লাভ নেই। বয়স হলে রক্তের জোর কমে আসে, শরীরের ক্ষমতা কমে আসে, মহাপ্রস্থানের পথে তখন রওনা হতে হয়। এবং এসময় কিছু তীর্থস্থান দর্শনে মনে প্রসন্নতা আসে। তিনি লিখলেন, তোমার মার শরীর ভালো না। ভাবছি তোমার মাকে নিয়ে কিছুদিন দক্ষিণভারত ঘুরে আসব। তারপর কী লেখা যায়—মণীষের কথা লিখবেন কিনা ভাবলেন। তাঁর বড় মেয়েটি রুগণ। মণীষের সঙ্গে রানুর অবৈধ সম্পর্কটি তিনি এ—বাড়িতেই টের পেয়েছিলেন। কিন্তু চোখ বুজে থাক ছাড়া উপায় ছিল না। শরীর বলে কথা। তারপর তিনি আরও দু—লাইন লিখলেন, ভানুর চিঠি পেয়েছি, সে ভালো আছে। মিতা গত রবিবারে ভানুকে নিয়ে এসেছিল। ওরা দুপুরে এখানে খেয়েছে।
তারপরের লাইন লিখতে গিয়েই মনে হল, আসলে মানুষের মুক্তি বলে কিছু নেই। তিনি মুক্তি খুঁজছেন, আসলে সেটা সব কিছুর সঙ্গে শুধু কমপ্রমাইজ করে চলা। নানুও কী তাই করছে। না সত্যি সে মানুষের আরও বড় সত্যাসত্য আবিষ্কার করে ফেলেছে। কারণ রাসবিহারীর ধারণা মানু আর দশটা ছেলের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। সে বড় একটা কিছু করে ফেলতে চায়। কিন্তু সেই মুহূর্তেই মনে হল সামান্য একটা ঝি—মেয়ের জন্য যে চলে যায়, তার পক্ষে বড় কিছু করা অসম্ভব। তিনি লিখলেন, নানু চিঠিতে ঝি—মেয়েটির কোনো কথাই লেখেনি। তারপরই মনে হল, এ—বাক্যাংশটি রানুকে পীড়া দেবে। ভেবে কেটে দিলেন। বেশ ভালো করে কেটে দিলেন। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা তিনি চাইলেন না। শেষে লিখলেন নানু ভালো আছে। তুমি এলে আমি মানুর কাছে যাব। বুঝিয়ে বলব, দেখি কী হয়। সে সেই যে চলে গেল আর একবারও এল না। যদিও এসে থাকে কলকাতায়, আমার এখানে এল না। আর একটা কথা লিখছি, মণীশ তো স্বরাষ্ট্র দপ্তরে আছে, তুমি কী ওকে দিয়ে পুলিশের মারফত নানুকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে পারো না। আসলে সে ওখানে পুলিশের ভয়ে আত্মগোপন করে আছে। মণীষের এত প্রভাব শুনছি, আর এতো সামান্য কাজ—একটা ঝি—মেয়ের জন্য ভদ্রসন্তান দেওয়ানা হয়ে যায় কবে কে দেখেছে। তিনি যে বাক্যাংশ কেটে দিয়েছিলেন, শেষ পর্যন্ত ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাই আবার লিখলেন। মনের সেই আদিম সংস্কারের জায়গাটা খুঁচিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে দিয়ে তাই লেখাল। তিনি তারপর কিছুক্ষণ টেবিলে বসে থাকলেন। চিঠি লেখা শেষ হয়েও হচ্ছে না। শরীর থেকে চাদরটা সরে যাওয়ায় শীত শীত অনুভব করলেন। চাদরটি ফের ভালো করে জড়িয়ে নিতেই মনে হল, ও—ঘরে হেম খুব কাশছে। হেমর ঘরে আজকাল তার যেতেও ভয় লাগে। সব সময় একটা না একটা অনুযোগ। যেন হেমর সব কষ্টের হেতু তিনি নিজে।
রাত বাড়ছিল। এত বড় বাড়িটাতে এখন তিনি আর হেম। কেন এই বাড়িটা যে করতে গেলেন! যৌবনে মানুষের কত স্বপ্ন থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সবই কাচের পাত্রের মতো মনে হয়। জীবনের ইচ্ছাগুলো বড়ই ক্ষণভঙ্গুর, তবু সব আগলে একটা প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো এই আবাসে তিনি বেঁচে আছেন। সামনের জানলা খোলা, লনে জ্যোৎস্না। কিছু গাছপালা ডুবে আছে। এই গাছপালাগুলোই মনে হয় তাঁর শেষ বেলার সঙ্গী। এবং বাড়িটিতে যদি তার নিজের রোপণ করা গাছপালাগুলি না থাকত, তবে যে—কোনো পান্থনিবাসের মতো বাড়িটাকে ছেড়ে তিনি অন্যত্র চলে যেতে পারতেন। তার সেজন্য এতটুকু কষ্ট হত না। কিন্তু গাছপালা বোধহয় মানুষের নীরব বন্ধুত্ব কামনা করে। শেষ বয়সে এটা তিনি বেশি টের পান বলে কোথাও গিয়ে দুচার দিনের বেশি থাকতে পারেন না। এ বাড়িটাতে এখন গাছপালাগুলিই তাঁর আকর্ষণ। হেম যে এতদিনের সঙ্গী ছিল, সেও দিনকে দিন অদ্ভুতভাবে জীবন থেকে সরে যাচ্ছে। যদি হেমর মৃত্যু হয় তার কোনো কষ্ট হবে না। বরং কেন জানি কিছুদিন থেকে মনে মনে তিনি হেমর মৃত্যু কামনা করছেন। এই গেরোটা মানুষের খুবই বড় গেরো।
চিঠিটা ভাঁজ করলেন। কাল সকালেই চিঠিটা ডাকে দিতে হবে। রানু বিয়েতে এসেছিল মাত্র দুদিনের ছুটি নিয়ে। তখন ছেলে সম্পর্কে প্রায় নীরব ছিল। অথচ তার এই চিঠিটাতে নানুর জন্য ভারী আবেগের সঞ্চার হয়েছে। এতদিনে কী রানু শরীরের দিক থেকে কোথাও কিছু খামতি টের পেয়েছে। সে বুঝেছে কী শরীরের রক্তমাংসে আর তেমন বান ডাকার ব্যাপারটা নেই। ক্রমশ তা কমে আসছে। অথবা বয়সের রেখা ক্রমে শরীরে দগদগে ঘায়ের মতো ফুটে উঠছে। এখন তার একমাত্র সম্বল বলতে শ্রীমান দুর্গাদাস ওরফে নানু।
তিনি চিঠিটা টেবিলে রেখেই বাইরে বের হয়ে এলেন। শীতের জ্যোৎস্না তাঁর বাড়ির সর্বত্র এখন ছম ছম করছে। রাস্তায় দুটো কুকুর দৌড়ে যাচ্ছিল, আউট হাউসে নিধু ঘুমোচ্ছে বোধ হয়। গোরুর ঘরে খচ খচ শব্দ হচ্ছিল। দূরে শেষ বাস অথবা রিকশার টুংটাং শব্দ তিনি লনে দাঁড়িয়ে শুনতে পেলেন। শুনতে পেলেন, বহু দূর থেকে এক বালক, হাত তুলে তাঁকে যেন ইশারায় ডাকছে। বহুদূর অথবা যেন কোনো গতজন্মের ঘটনা, সেই বালকের হাত ধরে কেউ হাঁটছে। বাবার হাত ধরে সে কোথাও যাচ্ছে। তাঁর মনে হল বাবা এমনি শীতের রাতে তাকে লণ্ঠন নিয়ে আনতে যেতেন মাস্টারমশাইর বাড়ি থেকে। সে বাবার হাত ধরে বাড়ি ফিরত। বাবা বলতেন, সদা সত্য কথা বলিবে। বাবা প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষদের জীবনী বলতেন, রাসু তুমি বড় মানুষ হবে। এইসব ভাবলে তিনি কেমন বিমর্ষ হয়ে যান। তিনি চেয়েছিলেন এক, হলেন অন্য। প্রবঞ্চনা শঠতা বাদে এক সময় জীবনে তাঁর কোনো সম্বল ছিল না। এখন তাঁর মনে হয় কার জন্য তিনি জীবনে এই শঠতা এবং প্রবঞ্চনা সম্বল করে এখানে এসে পৌঁছেছেন। শূন্য এক মাঠ, খাঁ খাঁ মরুভূমির মতো যেন তাঁকে এখন গিলতে আসছে। তিনি একা লনে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় পেলেন।
এবং ঘরে ফিরে মনে হল, এক পরিত্যক্ত আবাসে তিনি এসে ঢুকছেন। শুধু ইঁদুরের কিছু খুট খুট শব্দ শুনতে পেলেন। হেমর কোনো সাড়াশব্দ নেই। শ্বাসকষ্ট, যদি কম দম বন্ধ হয়ে গিয়ে শক্ত হয়ে যায় কেমন ভূতুড়ে একটা অস্তিত্ব অনুভব করে তিনি ভিতরে কেঁপে উঠলেন। এবং খুব সন্তর্পণে হেমর ঘরে ঢুকে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিলেন। হেম ঘুমোচ্ছে। হেমর মৃত্যু হয়নি তো! নিশ্বাস পড়ছে কী না ভেবে তিনি হেমর নাকের ওপর হাত রাখতেন, না, নিশ্বাস পড়ছে। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। এই বাড়িতে একসময় সব ঘরগুলি শোরগোলে ভরে থাকত। ছয় মেয়ে এবং মেয়েরা বড় হতে থাকলে বাড়িতে যুবক আত্মীয়দের ভিড় লেগেই থাকত। সবসময় তখন হেম ছিল ব্যস্ত। একদণ্ড ওর দম ফেলবার সময় ছিল না। এক হাতে সব সে আগলে রেখেছিল। আত্মীয়স্বজনে বাড়িটা ভরে থাকত। কেউ এলে মেয়েরা ছাড়তে চাইত না। এখন মনে হয় সবই অন্য জন্মের ঘটনা। যদি নানুটাও থাকত। নানুর বউ এবং তখনই আবার একটা ঝি—মেয়ে এবং বংশের কৌলীন্য সব কেমন তার ঘিলুর মধ্যে রক্তের প্রবাহ বাড়িয়ে দিচ্ছে। নিমেষে তিনি একজন অবুঝ অভিভাবক হয়ে উঠলেন। তাঁর মনেই থাকল না, তিনি অসহায়, সবাই তাঁকে ছেড়েছুড়ে চলে গেছে। রক্তের মধ্যে কী যে এক নিছক আভিজাত্য মানুষের থেকে যায়। তিনি সব জটিলতা থেকে মুক্তি পাবার জন্য অবশেষে বললেন, ঠাকুর সবই তোমার ইচ্ছা।
আসলে এই ইচ্ছার কথা বলে যতই তিনি রেহাই পেতে চান ততই তাঁকে যেন কেউ দম বন্ধ করে মারতে চায়। কেমন এক জ্বালা মাথার মধ্যে কেবল কুট কুট করে কামড়াচ্ছে। আমরা তোর কাছে এত পর হয়ে গেলাম! একটা ঝি—মেয়ে তোর সর্বস্ব হয়ে গেল : এবং এই করে রাসবিহারীর মনে হল সামান্য একটা মেয়ে তাঁদের সব কৌলীন্য কেড়ে নিচ্ছে। প্রথম দিকে যতটা হালকাভাবে নিয়েছিলেন, দিন যত যেতে থাকল তত কেমন গুরুত্ব বাড়তে থাকল আর তিনি ভাবতে থাকলেন, ক্রমেই হেরে যাচ্ছেন। অথচ এই জ্বালা তার আগে তেমন হয়নি। যেন আমার কী যার ছেলে তার কোনো মাথাব্যথা নেই, আমি কেন চিন্তা করে মারি। এ—সবই তাঁকে দীর্ঘকাল চুপচাপ থাকতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু রানুর উদ্বেগপূর্ণ চিঠি পেয়ে তিনি কিছুটা বিচলিত বোধ করলেন। বিধবা মার তুই একমাত্র ছেলে, কত আশা—ভরসা—আর তুই এখন একটা ঝি—মেয়ের সঙ্গে থেকে সত্য দর্শন করছিস।
আগামীকাল ভুবনবাবুর বাড়িতে তাঁর যাবার কথা। ভুবনবাবুর ছেলেটিরও খোঁজ নেই। নানুর মতো উগ্র রাজনীতির শিকার। ভুবনবাবুর সঙ্গে তাঁর জীবনের কোথায় যেন বড় রকমের একটা মিল আছে। শোবার সময় তিনি জল খেলেন, এবং ঘুমের ওষুধ খেলেন। আজকাল ঘুমের খুব ব্যাঘাত হচ্ছে। সারারাত কোনো কোনো দিন জেগে থাকেন। রাস্তায় গাড়ির শব্দ পান, খুব নিশুতি রাতে পাতা পড়লেও তিনি টের পান, গাছ থেকে পাতা ঝরছে।
পরদিন রাসবিহারীবাবু সকাল সকাল ভুবনবাবুর বাড়িতে চলে গেলেন। দু’জন সমবয়সি মানুষের দেখা হলে কিছুটা হালকা হবেন ভেবেছিলেন তিনি। সেখানে গিয়ে দেখলেন প্রিয়নাথও হাজির। আজকাল কী হয়েছে ভুবনবাবুর, তিনি মাঝে মাঝে কোনো বুড়ো মানুষের সঙ্গে দুদণ্ড কথা বললে সুখ পান। রমা তাঁকে অফিস থেকে ফোনে এমনই বলেছিল। আপনি আসবেন মেসোমশাই। বাবা আজকাল কেমন হয়ে যাচ্ছে। সে প্রিয়নাথকেও অফিস যাবার পথে বলে গেছিল। অন্তত বাবা কিছুটা সমবয়সি মানুষের সঙ্গে থাকলে স্বাভাবিক কথাবার্তায় মশগুল হয়ে থাকতে পারবেন। এবং কিছুদিন থেকেই ভুবনবাবু কতদিন বুড়ো মানুষের সঙ্গে দেখা হয় না বলে বেরই হয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
রাসবিহারী ভুবনবাবুর বাড়ি পৌঁছে দেখলেন, রমা অফিস ছুটি নিয়েছে। ভানুও অফিস যায়নি। মিতা এখনও এ—বাড়িতে রান্নাঘরের ছাড়পত্র পায়নি। প্রিয়নাথবাবু বিধবা বউমাও এসেছেন। অনেক দিন পর তিন সমবয়সি মানুষ বারান্দায় বসে প্রথমে দেশের দ্রব্যমূল্য নিয়ে কথা আরম্ভ করলেন। দ্রব্যমূল্য থেকে, দেশ বাড়ি, শৈশবকাল, বাবা জ্যাঠাদের গল্প, একান্নবর্তী পরিবারের গল্প, এভাবে বর্তমান প্রজন্মের কথাও এসে পড়ল।
রাসবিহারী বললেন, মানুর কোনো আর খবর পেলেন না!
ভুবনবাবু ধুতি কোঁচা দিয়ে পরেন। গায়ে ফতুয়া। চুল খুব ছোট করে ছাঁটা। সাদা চুল এবং মুখ সদ্য কামানো বলে, খুবই শৌখিন মানুষের মতো দেখতে লাগছিল। ভুবনবাবু খুব লম্বা নন, খুব বেঁটে নন, এখনও অসুখ—বিসুখ কম। এদিকে রাতে দুবার উঠতে হচ্ছে, ব্লাডসুগার করাবেন। ভেবেছেন। রাতে আর ভাত খান না। দুধ রুটি এবং কলা এই প্রায় রাতের খাবারে এসে দাঁড়িয়েছে। এখনও চা—টাই বেশি খান। চা খেতে তিনি ভালোবাসেন। ইতিমধ্যে একবার চা হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় রাউন্ডের চা এসেছে। বেতের চেয়ারে গোল হয়ে বসছেন। তাস পাশা খেলার অভ্যাস থাকলে এ সময়ে এটাই জমে ওঠার কথা। কিন্তু ভুবনবাবুর তাস পাশার নেশা নেই, এক সময়ে বই পড়ার নেশা ছিল, এখন পত্রিকা পড়ার নেশা। পত্রিকার খবর থেকে বিজ্ঞাপন, পাত্র—পাত্রীর খবর এবং আজ কোথায় যাবেন এই শিরোনামায় তিনি কিছু কিছু খবর নিয়ে বিকেল হলেই আজ কোথায় যাবেন জায়গাতে নিঃশব্দে কোনো কোনো দিন চলেও যান। রমার কাছে, ভানুর কাছে এটা খুবই অস্বাভাবিক ঠেকছে। বাবাতো এমন ছিলেন না। কিছু বললে, বলেন, মহাবোধি সোসাইটিতে গেছিলাম। বেশ বললেন, দয়ানন্দজী। ধর্ম সম্পর্কে মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে গেল বলে আজ দেশের এই দুরবস্থা। অবশ্য এখন মানু সম্পর্কে রাসবিহারী কিছু জানতে চাইছেন। কী বলবেন ভাবছিলেন। গোটা চারেক উড়ো চিঠি এসেছে, কে বা কারা করিডোরে রাতে ফেলে যায়। —আমি ভালো আছি বাবা। এই চারটি শব্দ লেখা থাকে। হাতের লেখা থেকে তিনি বুঝতে পারেন ওটা মানুরই চিঠি। কাজেই তিনি বললেন, মনে হয় ভালোই আছে। না থাকলে খবর পেতাম।
প্রিয়নাথ এই মানুষটি যে এমনই জবাব দেবে জানতেন।
প্রিয়নাথ বলল, ভুবন চলো আমরা কোথাও কিছুদিন ঘুরে আসি। রাসবিহারীবাবুও চলুন।
রাসবিহারী পরেছেন সিল্কের পাঞ্জাবি এবং ফাইন ধুতি। পায়ে পামসু মোজা। স্নান সেরে আহ্নিক করে তবে এসেছেন। এখনও সকালের শীত বারান্দায় জমা হয়ে আছে। ভুবনবাবু সুতোর চাদর গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন। প্রিয়নাথের পরনে পাজামা পাঞ্জাবি। এটাই তার পোশাক। গায়ে জহরকোট। প্রিয়নাথ একসময় স্বদেশি করত। দেশ স্বাধীন হবার পর তার আত্মত্যাগের দৌলতে সরকারের তথ্য বিভাগে বেশ বড় চাকরি করেছে। এবং এখন রিটায়ার করার পর শৌখিন মানুষের মতোই বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। পুত্রের মৃত্যুর জন্য যতটা কাতর হবার কথা তার বিন্দুমাত্র চোখে লেগে নেই। প্রিয়নাথের প্রস্তাবে সবারই সায় থাকা সত্ত্বেও কেউ কোনো জবাব দিলেন না।
কেবল রাসবিহারী বললেন, কোথায় যাবেন?
যেদিকে চোখ যায়, সেদিকে—এখন তো আমাদের সবারই পিছু টান কমে এসেছে।
ভুবনবাবু সামান্য সময় চুপ করে থাকার পর একটু মুচকি হেসে প্রিয়নাথকে উদ্দেশ্য করে বললেন, কোথায় যাবে? যেখানেই যাও সেই এক দৃশ্য—মনে হবে তুমি বড় পিছিয়ে পড়েছ। সবাই দৌড়াচ্ছে। এটা দেখতে কার ভালো লাগে বলো। তারপরই বললেন, নানু এসেছিল। বলল মেসোমশাই একবার আমাদের দিকটাই ঘুরে আসবেন! মন প্রফুল্ল হবে। বেঁচে থাকার অর্থ খুঁজে পাবেন।
রাসবিহারী এমন একটা খবরে ব্যথিত হলেন। নানু এখানে এসেছে অথচ তাঁর কাছে যায়নি। এমন কী তার রাগ হল ভেবে, মিতা কিংবা ভানু কেউ খবরটা দেয়নি। রাসবিহারী বললেন, কবে নানু, এসেছিল?
সে তো মনে করতে পারছি না। কেউ বাড়ি ছিল না। নীরজা দুপুরে নিদ্রায় মগ্ন ছিল। ও আমার সঙ্গেই দেখা করে গেল। বলল, কীসের একটা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং—এ এসেছিল। মানুর খবর কিছু রাখে কিনা বলতে বলল, ও নিয়ে ভাববেন না। মানু কখনও খারাপ কাজ করতে পারে না। তাছাড়া মানু ভালো আছে। আজ হোক কাল হোক ওর সঙ্গে মানুর দেখা হবেই। কী বিশ্বাস থেকে এমন বলল, তাও বুঝতে পারলাম না। আরও কত কথা। এমন সুন্দর কথা বলতে পারে ছেলেটা—সে বলছে, সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এখন আর কারও ওপর তার কোনো রাগ নেই। জীবনে সৎ এবং পরিশ্রমী হওয়া বাদে মানুষের নাকি আর কিছু করণীয় থাকে না। হালের রাজনীতি নিয়ে কথা হল, উগ্র রাজনীতি নিয়েও সে কথা বলল। আজকের যারাই সৎ দেশে তারা কিছু করতে চায়। কীভাবে করবে ঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তবে একটা কিছু ঠিক হবেই। এভাবে একটা দেশের মানুষ বেশিদিন বাঁচতে পারে না বলেও তার বিশ্বাস। যদি যাই ওর কাছেই যাব।
রাসবিহারী কেমন বিভ্রমের মধ্যে পড়ে যাচ্ছেন। নানুর চিঠির সঙ্গে এসব কথার যেন কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি বললেন আমাকে কেউ খবরটা দিল না!
আপনি জানেন না সে এসেছিল!
না।
ভানু কিছু বলেনি!
না।
তাজ্জব! নানু যে এসেছিল, ওদের আমি বলেছি। গোপনে মানুও আসে। কারও সঙ্গে দেখা করে না। শুধু আমার সঙ্গেই কথা হয় গোপনে। তবে কী জানেন, আজকাল আমার ছেলেমেয়ে বউ কেউ আমার কথা বিশ্বাস করতে চায় না। ভাবে। আমার মাথা খারাপ।
তারপর কেন জানি কেউ আর একটা কথা বলতে পারল না। সবাই দেখল ভুবনবাবু কেমন উদাস মুখ করে বসে আছেন। রাসবিহারী রাস্তা দেখছিলেন। প্রিয়নাথ মাথা নিচু করে বসে আছেন। তিনজন সমবয়সি মানুষ আজ বড় বেশি টের পেলেন কেউ তাঁরা ঠিকঠাক বেঁচে নেই। তাঁদের জীবনের সবকিছু এক অদৃশ্য শক্তি ধীরে ধীরে হরণ করে নিচ্ছে।