মানুষের হাহাকার – সতেরো
কী গো, তোমার ঘুম ভাঙবে না?
ভুবনবাবু, স্ত্রীর আলতো গলার স্বর শুনতে পেলেন। তিনি চোখ বুজে পড়ে আছেন। সময় বড় দীর্ঘ, কিছুতেই তার সময় কাটতে চায় না। বিকেলে এ—সময় তিনি এক কাপ চা খান, তবু উঠতে ইচ্ছে করছে না।
নীরজা ফের বলল, ওঠো। কত আর ঘুমোবে। চায়ের জল বসিয়ে দিয়েছি কিন্তু।
ভুবনবাবু উঠে পড়লেন। বাথরুমে ঢুকে চোখ মুখে জলের ঝাপটা দিলেন। ভেজা গামছায় মুখ মুছে বের হয়ে এলেন। তারপর রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বললেন, ভানু ফেরেনি এখনও?
কোথায় আর ফিরল।
ওরা কি কেউ বাড়ির কথা ভাবে না?
যা দিন কাল, ভেবে আর কী হবে?
ভুবনবাবুর মনটা কেমন অস্বস্তিতে ভরে গেল। ছেলের জন্যে তো মায়েরই ভাবনা থাকার কথা। কিন্তু নীরজার অদ্ভুত নিস্পৃহ স্বভাব। জীবনের এই শেষ অঙ্কে যেন আরও বেশি নিস্পৃহ স্বভাব। তিনি হয়তো বলেই ফেলতেন, পেটের দোষ, কিন্তু তিনি জানেন, বললেই পার পেয়ে যাবেন না। এমন সব কুৎসিত কথা নীরজা অনায়াসে বলে যাবে যে তখন আর দাঁড়াবার জায়গা থাকবে না।
ওপাশের রাস্তার তিনতলার কার্নিশের নিচে সূর্য হেলে গেছে। বারান্দায় ছায়া আছে এখন। বোধহয় মানদা এসেছে। বারান্দা মুছে দিচ্ছে। বারান্দায় কিছু বেতের চেয়ার আছে। একটা ইজিচেয়ার আছে। ইজিচেয়ারটা ভেঙে গেছিল, বাবার অসুবিধা হচ্ছে ভেবে রমা সারিয়ে দিয়েছে। শরীর এলিয়ে দিলেন চেয়ারটাতে। মানুষের এ সময়টা বুঝি খুবই অর্থহীন। ছেলের বিয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে পারলে সংসারটাতে বেঁচে থাকার একটা অর্থ খুঁজে পাওয়া যেত। কিছুই হচ্ছে না।
প্রথম যৌবনে মনে হত, ছেলেপিলেরা দাঁড়িয়ে গেলেই এ জীবনের জন্য ছুটি নেওয়া যাবে। এবং প্রথম যখন ভানু অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার হাতে নিয়ে এসেছিল, তিনি যথার্থই কিছুটা হালকা বোধ করছিলেন এবং ক’মাস আগে যখন রমার চাকরি হয়ে গেল; বেশ বড় রকমের একটা দায়িত্ববোধ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছেন ভেবেছিলেন। কেবল মানুটার চাকরি। সেটাও হয়ে যাবে হয়তো। কিন্তু ইদানীং মনে হচ্ছে তার কোনো কাজই শেষ হয়নি। তাঁর মুক্তি মেলেনি। বরং তিনি এখন আরও বেশি টেনসনের মধ্যে আছেন। মুখের ওপর কিছু বলতে সাহস পান না। দশ রকমের অজুহাত দেখিয়ে দেবে। বাড়ি সময়মতো না ফিরলে যে বাবা—মার চিন্তাভাবনা থাকে এটা তারা আজকাল একেবারেই বুঝতে পারে না বুঝি।
নীরজা চা রেখে গেল আর সঙ্গে দুটো বিস্কুট একটা সন্দেশ। ভুবনবাবু প্রথম সন্দেশ ভেঙে খেলেন। তারপর চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেলেন। মেয়েটা এখন কী করছে কে জানে। আজকাল তো হামেশাই দুর্ঘটনা ঘটছে। মানুটা বের হয়ে গেল। একবার বলেও যায় না কোথায় যায় এরা! সবাই ধীরে ধীরে আলাদা সত্তা ধারণ করছে। একই সংসার একই আবাস, একরকম দুঃখ। তিনি এতদিন বাড়ি থেকে যে দুঃখটা দূর করার জন্য আপ্রাণ খেটেছেন সেটা একবিন্দু নড়েচড়ে বসেনি।
বরং মনে হয় সবাই এখন ঠিক ওর মতো নিজেদের জগৎ তৈরি করতে ব্যস্ত। তিনি যেমন নীরজা ভানু রমা মানুকে নিয়ে একটা সত্তা আবিষ্কার করেছিলেন, ওরাও তেমনি, কোনো মন্দাকিনী, কোনো জয়া, কোনো অরুণ ছানাপোনা নির্মাণের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ওরা যে তাঁর কেউ না, এটা উপলব্ধি করে কেমন হতাশ হয়ে পড়লেন। চা কেমন যেন বিস্বাদ লাগছিল। চোখ ঝাপসা হয়ে উঠছে।
মন্দাকিনীর সঙ্গে ভানুর একটা অবৈধ সম্পর্ক ঠিক কীভাবে গড়ে উঠেছে তিনি জানেন না। বিয়ে দিলে হয়তো সব সেরে যাবে। প্রিয়নাথ আছে বাড়িতে। সে তো টের পায়। যদি সত্যি হয়, যদি সম্পর্কটা সুস্থই না থাকে, এই অবেলায় বাড়ি ফিরলে ভানুকে নিজের আত্মজ ভাবতে তার কষ্ট হবে। ভানু আলাদা একটা অস্তিত্ব। সে ক্রমে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। যেন অভ্যাস বসে সংসারের বাজার, বাসা ভাড়া, জামাকাপড় শুধু জুগিয়ে যাচ্ছে। আর কোনো প্রবল টান অথবা আকর্ষণ এ—সংসারের জন্যে তার নেই। তিনি এবারে ডাকলেন, নীরজা।
নীরজা হাত মুছে বারান্দায় এসে দাঁড়াল।
তুমি বলতে পারো তোমার ছেলেমেয়েরা এখন কে কোথায় কী করছে?
লোকটা আজকাল যখন তখন এমন সব অদ্ভুত প্রশ্ন করে ফেলে। নীরজা খুব একটা অবাক হল না। বলল, ওরা কিছু তো একটা করছেই। বাড়ি ফিরলে জিজ্ঞেস কোরো।
তুমি টের পাও না!
না।
আমি কিন্তু টের পাই।
সেই এক কথা বলবে। বলবে ওরা আর আমার কেউ নয়। ওরা আমার জন্যে যতটুকু করছে, সবটাই ওদের মান—সম্মানের জন্যে। আমাদের সময়ে কিন্তু এমনটা ছিল না। বিয়ের পর তোমাকে কলকাতার বাসায় আনব কথাটা কত বছর যে বাবা—মাকে বলতেই পারিনি। থেকে থেকে পেটের ব্যামোটা ধরাতে না পারলে বোধহয় শেষপর্যন্ত সাহসই পেতাম না। বেশ একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে তবে নিয়ে এসেছিলাম।
নীরজা বলল, তুমি বুড়োমানুষ, বাড়ি থেকে বের হতে চাও না। তোমার মতো ওরা যখন হবে, ওদের তাই হবে। বাইরে একটু ঘুরে না বেড়ালে সংসারে ওরা বড় হবে কী করে! বুঝবে কী করে জীবনটা শুধু যোগ বিয়োগ নয়, গুণ ভাগও আছে।
নীরজার সঙ্গে কথায় তিনি কখনও পারেন না। আর তাছাড়া এই বুড়ো মানুষটা হয়তো তাঁর সেই যৌবনেও এমনি তাকে তাড়া করেছে। স্ত্রীর প্রতি যতই সংশয় থাকুক, প্রিয়নাথ এলেই সেটা বোঝা যেত, তিনি তো, আর আহাম্মক নন, যে কিছুতেই বুঝতেন না, তবু ভেবেছিলেন, যৌবন সবাইকে একটু বেয়াড়া স্বভাবের করে দেয়, ছেলেপুলে হলে সব আবার ঠিক হয়ে যাবে। ঠিক হয়েও গিয়েছিল। যদি মাথা গরম করতেন, তবে সংসারে অশান্তি বাড়ত। এবং চরম সহ্য পরীক্ষার দ্বারা নীরজার ভেতর বোধহয় পাপবোধই জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। এক সময় নীরজা সত্যি নিরাময় হয়ে গেল। এই বুড়োটে স্বভাবই তাকে কোনো আত্মহত্যা অথবা খুন থেকে রেহাই দিয়েছে। আজকের ছেলে—ছোকরাদের ভিতর এটা দেখা যায় না। ভয়টা সেইজন্যেই। মানু তো দিন দিন যা উগ্র স্বভাবের হয়ে উঠছে! কাউকে আর গ্রাহ্য করে না। সবাই যেন ওর শত্রু। সহিষ্ণুতা ও আত্মসংযম বলতে এদের আর কিছু নেই।
এবং মানুর জন্যই আজকাল তার বেশি ভয়। তিনি দেখলেন, কথার আর কোনো জবাব দিচ্ছে না বলে নীরজা চলে যাচ্ছে। তিনি ফের ডাকলেন, নীরজা।
নীরজা এবার একটু ক্ষুণ্ণ গলায় বলল, আমার কাজ আছে।
নীরজা সংসারে এত যে কাজ করছ, কী হচ্ছেটা বিনিময়ে।
কী হচ্ছে না। সবই হচ্ছে।
এটাকে হওয়া বলে।
আমি তো সংসারে এটুকুও যে হবে আশা করিনি। তুমি যা মানুষ ছিলে।
ভুবনবাবু জানেন নীরজার খোঁটা দিয়ে কথা বলার স্বভাব। সময় সময় দারিদ্র্যের জ্বালা নীরজাকে সহ্য করতে হয়েছে। অভাবের ভিতর একটা মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। স্বচ্ছলতা মানুষকে বড় দূরে সরিয়ে রাখে। সংসারের জন্যে যদি অভাববোধ না থাকল তবে মানুষ বাঁচবে কী নিয়ে। তার মনে আছে একবার ইলিশের মরশুম চলছে, অর্থাভাবে গোটা ইলিশ একদিনও আনতে পারছেন না। ব্যাগের ভিতর থেকে ইলিশ মাছের রুপোলি লেজটা উঁকি মারবে কতদিন এমন আশা করেছে নীরজা। বাবার কড়া নাড়ার শব্দ পেলেই রমা ছুটে গেছে ব্যাগ খুলে দেখেছে, গোটা ইলিশ নেই। মানু বলেছে, বাবা তুমি আনবে না? তিনি বলেছেন, দেখি মাইনে পাই, একদিন আনব। এবং স্বপ্নে পর্যন্ত ভানু দেখেছে বাবা আস্ত ইলিশ নিয়ে বাজার থেকে ফিরেছে। আর যেদিন এল সত্যি সত্যি সে এক উৎসবের ব্যাপার। গোল হয়ে বসা, সবার খাওয়া একসঙ্গে। আজকাল একসঙ্গে বসে খাওয়া কালেভদ্রে হয়ে থাকে। এত যে করা, শেষে কি সবই এমন একটা বিচ্ছিন্ন খাপছাড়া জীবনের জন্য! ভুবনবাবু ভারি বিচলিত হয়ে পড়লেন।
নীরজা দেখল কেমন ঝুঁকে আছে মানুষটা। চুল সাদা হয়ে যাচ্ছে। কপালের দিকে যৌবনেই সামান্য টাক পড়েছিল, সেটা আর বাড়েনি। চেহারাতে বেশ একটা সৌম্যকান্তি ফুটে উঠেছে। ধুতি কখনও লুঙ্গির মতো পরেন না। বেশ কোঁচা দুলিয়ে ধুতি পরার অভ্যাস। বাড়িতে এখন বাটিকের কাজ করা লুঙ্গি চল হয়েছে। দুই ছেলেতে বাসায় ফিরে কতক্ষণে শরীর হালকা করবে, কতক্ষণে লুঙ্গি মাথায় গলিয়ে দিয়ে বেশ আরাম করবে,—আর মানুষটার তখন গজ গজ বেড়ে যায়। বামুনের বাড়ি, লুঙ্গি, কী যে হচ্ছে আজকাল, এবং এটা নীরজা বুঝতে পারে অনেক কিছু অপছন্দের মতো এটাও একটা অপছন্দ। এবং সব যেমন সরে যাচ্ছে এটাও তার সয়ে গেছে। কেবল নিজে কখনও দলের নাম লেখাবেন না কিছুতে।
নীরজার মনে হল, আসলে মানুষটা সব অনাসৃষ্টি থেকে নিজেকে পৃথক রাখতে ভালোবাসে। অথবা নিজে সাধু থেকে যদি পরিবারের সবার মঙ্গল করা যায়। নিজের এই সাধু স্বভাবের জন্যেই তার বিশ্বাস সংসারে খুব একটা অধর্ম বাসা বাঁধতে পারবে না। নীরজা মনে মনে তখন না হেসে পারে না। সে বলল, কী আর কথা বলছ না কেন?
ভুবনবাবু সহসা জেগে ওঠার মতো তাকালেন। বললেন, তুমি এখনও আছো!
থাকব না কেন। সহজ কথাটা মেনে নিতে এত বাধে কেন!
ওরা বাড়ি না থাকলে তোমার কষ্ট হয় না?
ওরা বড় হয়েছে।
বড় হলেও তুমি মা। তোমাকে তো কেউ বলে না, মা তুমি কেমন আছো?
ওরা ভালো থাকলেই আমি ভালো। সেটা বুঝতে পারে।
ওরা কী সত্য ভালো আছে!
আছে বইকি।
তোমার চোখ নেই নীরজা। তুমি কিছু টের পাও না।
সব টের পাই। মানুষ শিখতে শিখতে বড় হয়। একটু কিছু শিখুক না।
এটা তো শেখা না, শরীরকে পীড়ন করা।
নীরজা বলল, সবই সংসারে দরকার হয়। তোমার মতো ওরা যে ভীত হয়নি, উদাসীন হয়নি, এতে আমার সাহস বাড়ে।
তুমি কী সত্যি সত্যি তবে এটা চাইছ?
আমি কে চাইবার! চাইলেও যা হবে, না চাইলেও তাই হবে। সেজন্যে ভাবি না। সময়মতো সবাই ঠিক ফিরে আসে।
তোমার কথা শুনলে মনে হয় নীরজা, পৃথিবীতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে না। সময়ে সব ঠিকঠাক হয়ে যায়।
নীরজা এবার কী বলবে ভেবে পেল না। ধীরে ধীরে পরাজিত হওয়ার মতো বলল, ওরা তোমার সন্তান, তেমন কিছু করবে না।
ভুবনবাবুর মাথাটা আবার ঝুঁকে গেল। বলল, নীরজা, ওরা তোমারও সন্তান। ভুললে চলবে কেন!