Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মাজোরকা দ্বীপে ফ্রান্সিস || Anil Bhowmick

মাজোরকা দ্বীপে ফ্রান্সিস || Anil Bhowmick

ভূমধ্যসাগরের সবচেয়ে বড়ো দ্বীপ সিসিলি। ফ্রান্সিসরা জাহাজে করে ফিরছে সেই দ্বীপ থেকে।ফ্রান্সিসরা জাতিতে ভাইকিং। এই ভাকিংরা বীরের জাতি। দুঃসাহসী নিভকি। জাহাজ চালাতে সুদক্ষ। সমুদ্রের ধারেই ওদের দেশ বলে সমুদ্রের সঙ্গে ওদের যেন নাড়ির যোগ। ভাইকিংদের রাজার যিনি মন্ত্রী ফ্রান্সিস তারই ছেলে। রাজার মেয়ে রাজকুমারী মারিয়া ফ্রান্সিসের স্ত্রী। হ্যারি ওর প্রাণের বন্ধু। বিস্কো, তিরন্দাজ শাঙ্কো, পেড্রো আর সব ভাইকিং বন্ধুদের নিয়ে ফ্রান্সিস মারিয়া ফিরে আসছিল নিজেদের দেশে।

ফ্রান্সিস আর ওর দুঃসাহসী বন্ধুরা কত দুঃখ কষ্ট সহ্য করে অসীম ধৈর্য, অটল সঙ্কল্পে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিয়ে এসেছে বিরাট সোনার ঘণ্টা, হাঁসের ডিমের মতো বড়ো মুক্তো আরো মূল্যবান কত কিছু। চিন্তা করে বুদ্ধি খাঁটিয়ে নক্শা, ছড়ার সূত্র ধরে উদ্ধার করেছে। গুপ্তধন-ভাণ্ডার। ফ্রান্সিসদের এই বীরত্বের কাহিনী নিয়ে ঐ দেশের চারণকবিরা গান বেঁধেছে। সারা দেশে ওরা সেই গান গেয়ে বেড়ায়।

ফ্রান্সিসদের জাহাজ চলেছে। নির্মেঘ আকাশ বাতাস বেগবান। জাহাজের পালগুলো ফুলে উঠেছে। দাঁড় বাইতে হচ্ছে না ভাইকিংদের। শান্ত সমুদ্রের ওপর দিয়ে ছোটো ছোটো ঢেউ ভেঙে দ্রুত চলেছে ফ্রান্সিসদের জাহাজ। ওদের দেশের দিকে।

দিন তিনেক কাটল। সেদিন বিকেলবেলা। তখনও সূর্য অস্ত যায়নি। মাস্তুলের ওপর নিজের জায়গায় ছিল নজরদার পেড্রো।

হঠাৎ পেড্রো চেঁচিয়ে বলল–ডাঙা–ডাঙা দেখা যাচ্ছে। জাহাজের ডেক-এ যে কয়েকজন ভাইকিং শুয়ে-বসে বিশ্রাম করছিল তাদের একজন ছুটল নীচে নামার সিঁড়ির দিকে। ফ্রান্সিসকে খবরটা দিতে হবে।

খবর পেয়ে ফ্রান্সিস, মারিয়া আর হ্যারি জাহাজের ডেক-এ এসে দাঁড়াল। তাকাল দূর দিগন্তের দিকে। দিগন্তে সূর্যাস্তের লালচে আলো। তার নীচে ছোটো ছোটো টিলার মতো দেখা গেল। সেসবের রং এখন বোঝার উপায় নেই।ফ্রান্সিস হ্যারির দিকে তাকাল। বলল–কী করবে এখনি?হ্যারি বললজায়গাটা কোনো দ্বীপনা দেশ তা তো বুঝতে পারছি না। এক্ষুণি অন্ধকার নামবে। এখান থেকে আর কিছুই দেখা যাবে না।

মারিয়া বলল–কিন্তু আমরা কোথায় এলাম টো জানতে হলে তো নেমে খোঁজ নিতে হবে।

–হুঁ। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। তারপর বলল–রাত হয়ে ভালোই হল। রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে নৌকো নিয়ে ডাঙায় নামবো। মানুষজন কাউকে তো পাওয়া যাবে। তা হলেই জানা যাবে আমরা কোথায় এলাম। আমাদের দেশই বা কতদূরে।

রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর ফ্রান্সিস পোশাক পরে তৈরি হল। ঢোলা হাতা হাঁটুঝুল পোশাক। কোমরে চামড়ার ফেট্টি। তলোয়ার গুজল কোমরের ফেট্টিতে। এবার মারিয়া বলল–আমিও যাবো। ফ্রান্সিস বলে উঠল–পাগল হয়েছে। কীরকম জায়গা কীরকম লোকজন থাকে কিছুই জানি না। এ অবস্থায় তোমাকে নিয়ে যাওয়া যায়? মারিয়া মাথা নেড়ে বলল–দেখো, এটা ভূমধ্যসাগর এলাকা। যতদূর জানি–এই এলাকায় কোনো বন্য জাতি বাস করে না।

ফ্রান্সিস বলল–বন্য জাতির মানুষ অনেক ভালো। তারা সভ্যজাতির মতো হিংস্র হয় না।

–তা হোক। তোমাদের ভাগ্যে যা ঘটবে আমার ভাগ্যেও তাই ঘটবে। মারিয়া বলল। ফ্রান্সিস বুঝল মারিয়াকে না নিয়ে গেলে দুঃখ পাবে। ভাবল–আমরা তো যুদ্ধ। করতে যাচ্ছি না। শুধু জায়গাটার নাম জানতে যাচ্ছি। বলল–বেশ চলো।

মারিয়া খুশিতে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে দাঁড়াল।

জাহাজ থেকে দড়ি বেয়ে বেয়ে ফ্রান্সিসরা একে একে জাহাজের গায়ে বাঁধা একটা নৌকোয় নেমে এলো। মারিয়া আর হ্যারি নৌকোটার মাঝখানে বসল। দাঁড় হাতে একদিকে বসল ফ্রান্সিস অন্যদিকে শাঙ্কো।শাঙ্কো তির-ধনুক খুলে রাখল। দাঁড়টা হালের মতো ধরল। নৌকোর গতি ঠিক রাখতে হবে। জাহাজে বাঁধা দড়ি খুলে দিল ফ্রান্সিস। জাহাজের গায়ে দাঁড় দিয়ে ধাক্কা দিয়ে নৌকোটা সরিয়ে আনল। দাঁড় বাইতে লাগল। নৌকো চলল তীরভূমির দিকে।

নৌকো চলেছে। আকাশে সাদাটে মেঘের মন্থর চলাফেরা। চাঁদের আলো খুব উজ্জ্বল নয়। সেই অল্প আলোয় কিছুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বাতাসে ঠাণ্ডার আমেজ। ছোটো ছোটো ঢেউয়ের দোল খেতে খেতে নৌকো তীরের কাছাকাছি এলো। দেখা গেল তীরের কাছে একটা জাহাজ নোঙর করা। জাহাজটার সিঁড়ির মুখে কাঁচটকা আলো জ্বলছে। তবে ডেক জনশূন। তীরভূমির বালিয়াড়ি টানা গিয়ে উঁচু হয়ে গেছে। কয়েকটা খুঁটিতে জাল টাঙানো। শুকোতে দেওয়া হয়েছে। বেশ কয়েকটা মাছ ধরার নৌকোও আছে। ফ্রান্সিস দাঁড় টানা বন্ধ করল। বলল, হ্যারি, মনে হচ্ছে জাহাজটায় কেউ নেই। তবু এদিক দিয়ে তীরে উঠবো না।

–জাহাজটায় কোনো পতাকা উড়ছেনা। কোন্ দেশের কাদের জাহাজ বোঝা যাচ্ছে না। হ্যারি জাহাজটা দেখতে দেখতে বলল।

–বাঁ দিকে ছোটো টিলাটা ঘেঁষে আমরা তীরে উঠবো। ফ্রান্সিস বলল।

নৌকো বাঁ দিকে ঘোরানোহল। টিলাটার কাছে এসে দেখা গেল এবড়ো-খেবড়ো পাথরের মধ্যে দিয়ে ছোট্ট একটা খাঁড়িমতো। ফান্সিস খাঁড়ির মধ্যে নৌকো ঢোকাল। একটু এগোতেই দেখা গেল সামনে বিস্তৃত বেলাভূমি। বেশ দূরে খুব অস্পষ্ট কিছু বাড়িঘর দেখা গেল। বোঝা গেল ওটা জেলেপাড়া। ফ্রান্সিস বলল, চলো, ঐ জেলেপাড়ায় গিয়ে খোঁজখবর করি। হ্যারি মাথা নেড়ে বলল, না ফ্রান্সিস। খোলা বালিয়াড়ি দিয়ে আমরা যেতে গেলে জাহাজের লোকদের নজরে পড়ে যাবো।

–কিন্তু জাহাজে তো কোনো মানুষজনই দেখা গেল না। মারিয়া বলল।

উঁহু, তবু সাবধান হতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। শাঙ্কো বলল, এক কাজ করি। তির ধনুক নিয়ে আমি একা যাই। বালির ওপর দিয়ে বুক ঘষে ঘষে যাবো। জাহাজে কেউ থাকলেও দেখতে পাবে না।

–ঠিক আছে। শাঙ্কোই যাক। হ্যারি বলল। শাঙ্কো নৌকোয় উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে তির-ধনুক নিচ্ছে তখনই মারিয়া একটু গলা চড়িয়ে উঠলো–দ্যাখো তো, কয়েকজন লোক বালিয়াড়ির ওপর দিয়ে ছুটে এদিকে আসছে। ফ্রান্সিসরা অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখল–একজন লোক বালির ওপর দিয়ে ছুটতে ছুটতে এদিকেই আসছে। ওর পেছনেও ছুটে আসছে কয়েকজন। একটু এগিয়ে আসতেই দেখা গেল সামনের লোকটা প্রাণপণে ছুটে আসছে। ওর হাতে কোনো অস্ত্র নেই। ওর পেছনে তিনজন লোক খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে আসছে। এবার ওদের চিৎকার শোনা গেল। দেখা গেল ওদের গায়ে বর্ম। সৈনিকের পোশাক পরনে। ওরা কৃষ্ণকায়। মাথার চুল কেঁকড়া। বলিষ্ঠদেহী। হ্যারি বলল–ফ্রান্সিস এরা বোধহয় মূর সৈনিক। যে লোকটাকে ওরা আক্রমণ করেছে সে বোধহয় এ দেশীয় নিরীহ জেলে। পরনে এখানকার জেলেদের ঢোলা পোশাক। মূল সৈন্যরা জেলেটাকে হয় মেরে ফেলবে নয়তো মারাত্মকভাবে আহত করবে। জেলেটাকে বাঁচাও। ফ্রান্সিস ডাকলো–শাঙ্কো। শাঙ্কো সঙ্গে সঙ্গে তির ধনুক তুলে নিল। ধনুকেতির পরিয়ে ছিলা টানলো। কিন্তু নৌকোটা বেশ দুলছে। নিশানা ঠিক রাখা মুশকিল। ফ্রান্সিস বলল–মেরো না। আহত করো। শাঙ্কো তির ছুঁড়ল। তিরটা জেলের পেছনেই প্রথম সৈন্যটির ডান কাঁধে বিধে গেল। সৈন্যটি তলোয়ার ফেলে দিল। বাঁ হাতে কঁধ চেপে বালির ওপরে বসে পড়ল। শাঙ্কো আর একটা তির ছুঁড়ল। কিন্তু নিশানা ফসকে গেল। আবার ছুঁড়ল। তির বিধল পরের সৈন্যটির ডান। পায়ের উরুতে। সেও বসে পড়ল। পরের সৈন্যটি দাঁড়িয়ে পড়ল। চারদিকে তাকাতে লাগল। বুঝে উঠতে পারল না, কোন দিক থেকে কে তির ছুঁড়ছে। তবু ভয় পেল। দাঁড়িয়ে রইল। আর এগিয়ে এলো না। দ্বিতীয় সৈন্যটি উরু থেকে তিরটা টেনে খুলে ফেলল। তারপর বালিতে গড়াগড়ি খেতে লাগল। প্রথমটিও তির টেনে খুলে বালিতে শুয়ে পড়ল।

জেলেটি ছুটতে ছুটতে একবার পেছন ফিরে দেখল। তারপর ছুটতে ছুটতে ফ্রান্সিসদের দিকে আসতে লাগল। ফ্রান্সিসরা যে ছোট্ট খাড়িটায় নৌকো ঢুকিয়েছিল–সেই খাঁড়িটায় ঢুকল জেলেটা। ছুটে এসে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাঁতরাতে সাঁতরাতে কিছুটা এসেই ফ্রান্সিসদের নৌকোটা দেখে হাত বাড়িয়ে নৌকোটা ধরতে গেল। ফ্রান্সিস ঝুঁকে পড়ে ওর বাড়ানো হাতটা ধরে ফেলল। লোকটা ভেবেছিল নৌকোটা খালি। ও চমকে উঠে হাত ছাড়াতে গেল। ফ্রান্সিস হাতটা জোরে চেপে ধরে স্পেনীয় ভাষায় বলল–ভয় নেই–আমরা তোমার বন্ধু। লোকটা বুঝল। আর হাত ছাড়াতে চেষ্টা করল না। হ্যারি বলল–তুমি কে? লোকটা তখনও ভীষণ হাঁপাচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে স্পেনীয় ভাষায় বলল–আমি সালভা। আমাকে বাঁচান।

–কোনো ভয় নেই–নৌকোয় উঠে এসো। ফ্রান্সিস বলল।তারপর টেনে সালভাকে নৌকোয় তুলে নিল। অল্প চাঁদের আলোয় দেখা গেল সালভার গায়ে এখানকার জেলেদেরই পোশাক তবে বুকের সামনেটা কাটা। খোলা বুকে তলোয়ারে কাটার দাগ। হাঁপাতে হাঁপাতে সালভা বলে উঠল–শিগগির নৌকো ছেড়ে দিন। ঐ সৈন্যরা এখুনি এসে পড়বে।

–ভয় নেই। দু’জন সৈন্যকে আমরা তির ছুঁড়ে আহত করেছি।

ওরা এক্ষুণি আসতে পারবে না। হ্যারি বলল।

–কিন্তু ওদের দুর্গ কাছেই। ওরা নিশ্চয়ই খবর দেবে। তখন আরো সৈন্য আসবে। সালভা বলল।

–হুঁ, ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। তারপর হাতের দাঁড়ে পাশের এবড়ো-খেবড়ো পাথর ঠেলে নৌকো ছোট্ট খাড়িটা থেকে বের করে আনল।

নৌকো চলল ফ্রান্সিসদের জাহাজের দিকে। হ্যারি বলল–ওরা মূর সৈন্য তাই না?

–হ্যাঁ, সালভা বলল। তারপর বলল–আপনারা আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু আপনাদের পরিচয়

–আমরা ভাইকিং। ফ্রান্সিস নৌকো চালাতে চালাতে বলল।

–ও আপনারা তো বীরের জাতি। এবার জানলাম আপনাদেরমনও উদার। সালভা বলল। তারপর বেশ চিন্তিত স্বরে বলল–আমি তো এখন তীরে যেতে পারবো না।

–একটু দূরেই আমাদের জাহাজে নোঙর করা আছে। তুমি ঐ জাহাজেই থাকবে। ফ্রান্সিস নৌকো চালাতে চালাতে বলল।

হ্যারি বলল–আচ্ছা সালভা–এটা কি একটা দ্বীপ না কোনো দেশ?

–এটা মাজোরকা দ্বীপ–বালেরিক দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপ। এই তীরভূমির নাম পালমা নোভা। এখানে জেলেদের বস্তীতে থাকি। সালভা বলল।

নৌকো চলেছে। রাত শেষ হয়ে আসছে। সমুদ্রের জল ছুঁয়ে জোর ঠাণ্ডা বাতাস বয়ে গেল। ভেজা পোশাকে সালভা দু’হাত বুকে জড়িয়ে ঠাণ্ডায় কেঁপে উঠল। মারিয়া লক্ষ্য করল সেটা।

যে কম্বলমতো মোটা কাপড়টা মারিয়া বসেছিল সেটা তুলে নিয়ে ও সালভার গায়ে জড়িয়ে দিল। সালভা মুখ তুলে মারিয়ার দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসল। তখনই শাঙ্কো বলে উঠল–ফ্রান্সিস আগুন। দুরে তীরভূমি ছাড়িয়ে আগুনের হল্কা উঠছে। দেখা গেল। সালভা ফুঁপিয়ে উঠল, বলল–হ্যাঁ মেরী–মূর সৈন্যরা আমাকে ধরতে না পেরে আমাদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কাঠ আর পাথরে তৈরি আমাদের বস্তিটাই পুড়িয়ে দেবে ওরা। সালভা মাথা নিচু করে ফোঁপাতে লাগল। ওদিকে দ্বীপের ধোঁয়াটে আকাশ আগুনের আভায় লাল হয়ে উঠেছে।

আস্তে আস্তে নৌকো জাহাজের কাছে এলো। রেলিঙ ধরে বিস্কোওরা ফ্রান্সিসদের একে একে জাহাজে তুলে নিল। ফ্রান্সিস বলল–বিস্কো, এরনাম সালভা। একে তোমাদের কেবিন-ঘরে নিয়ে যাও। শুকনো পোশাক দাও। গরম কিছু খেতে দাও।বিস্কো সালভাকে কি ডেকে নিল। চলল ওদের কেবিন-ঘরের দিকে। পুব দিকের আকাশ তখন লাল হয়ে উঠেছে। একটু পরেই সূর্য উঠল।

একটু বেলায় ফ্রান্সিসদের ঘুম ভাঙল। মারিয়ে জেগেই ছিল তখন। খাবার নিয়ে এলো। দু’জনে খাচ্ছে তখন হ্যারি এলো। ফ্রান্সিস বলল–সালভা কেমন আছে?

–ভালো। খেয়েদেয়ে, জাহাজটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। হ্যারি বলল।

–সালভাকে একবার ডাকো তো হ্যারি।মূর সৈন্যরা ওকে আক্রমণ করেছিল কেন সেটা জানতে হয়। ফ্রান্সিস বলল। হ্যারি চলে গেল। একটু পরেই সালভাকে নিয়ে এলো। ফ্রান্সিস হেসে বলল–বসো সালভা। সালভা বিছানাতেই বসল। মারিয়া হেসে বলল–এখন কেমন আছো? সালভাও হাসল। বলল–আপনাদের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ রইলাম। ফ্রান্সিস বলল-ওসব কথা থাক। তোমাকে মূর সৈন্যরা আক্রমণ করেছিল কেন? তোমার বুকই বা তলোয়ারে কাটা কেন? সালভা একটু চুপ করে থেকে বলল–ঐ মূর সৈন্যদের রাজাই বলুন–অথবা দলপতিই বলুন–তার নাম আল আমিরি। সে কিন্তু জাতিতে মূর নয়–আরবী। দিন পনেরো আগে আল আমিরি জাহাজে চড়ে ঐ মূর সৈন্যদের নিয়ে এই পালমা নোভার দুর্গা দখল করে নেয়।

–আগে দুৰ্গটা কার অধিকারে ছিল? হ্যারি বলল।

–মাজোরকার বর্তমান রাজা তৃতীয় জেমসের। আল আমিরি এমনভাবে সৈন্য দিয়ে পালমা নোভা ঘিরে রেখেছে যে রাজা জেমস এখনও জানেন না যে এই দুর্গটা আল আমিরি দখল করে নিয়েছে। একটু থেমে সালভা বলতে লাগল–আমি রামন লালের শিষ্য ছিলাম। রামন লাল আমাদের ঘরে মারা যান। তার মৃতদেহ কবরের ব্যবস্থার জন্যে আমি গাড়িতে নিয়ে রাজধানী পালমায় যাচ্ছিলাম। দুর্গের কাছেই ধরা পড়লাম আল আমিরির সৈন্যদের হাতে। আল আমিরি খবর পেয়ে এলো। মৃত রামন। লালের জোব্বার পকেটে রামন লালের পাণ্ডুলিপির দ্বিতীয় খণ্ডটা পেল। সন্দেহ করল আমি প্রথম খণ্ডটা লুকিয়ে রেখেছি। চাইল প্রথম খণ্ডটা। প্রাণ বাঁচাতে বললাম বাড়িতে আছে। তিনজন সৈন্যের পাহারায় বাড়িতে এলাম। তারপর ওদের চোখে ধুলো দিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে পালালাম। ছুটলাম সমুদ্রের দিকে। ঠিক করেছিলাম নৌকোয় চড়ে পালাবো। এই বেলাভূমিতেই আমরা মানুষ। বালির ওপর দিয়ে আমাদের মতো দ্রুত কেউ ছুটতে পারে না। কিন্তু সৈন্য তিনজনের নজরে পড়ে গেলাম। ওরা তলোয়ার খুলে চিৎকার করতে করতে আমাকে ধাওয়া করলো। তার পরের ঘটনা তো জানেনই। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল-রামন লাল কে? তার পাণ্ডুলিপি–মানে সমস্ত ব্যপারটা বলো তো। সালভা বলল–সে অনেক কথা। প্রথমে বলি আমি কি করে রামন লালের শিষ্য হলাম। একটু থেমে বলতে লাগল–জেলের ছেলে আমি। কিন্তু জেলেবস্তির অন্য ছেলেদের মতো আমি ছিলাম না। ছেলেবেলা থেকেই পড়াশুনোর প্রতি ভীষণ আগ্রহ বোধ করতাম। এখানকার দুর্গ ছাড়িয়ে বেশ দূরে একটা ভাঙাচোরা ঘরে একজন মৌলভী থাকতেন। তাঁর কাছেই আমি আরবী ভাষা শিখতে শুরু করি। একদিন মৌলভী বললেন–আমি যা জানি সবই তোমাকে শিখিয়েছি। যদি সত্যিকারের জ্ঞান লাভ করতে চাও তাহলে রাজধানী পালমা যাও। যদি রামন লালের শিষ্যত্ব লাভ করতে পারো তাহলে গ্রীক, ল্যাটিন, আরবী সমস্ত শাস্ত্রেই তুমি জ্ঞানী হবে। একটু থেমে সালভা বলতে লাগল–রাজধানী পালমা গেলাম। কত দুঃখকষ্টের মধ্য দিয়ে শিক্ষাগুরু রামন লালের নজরে পড়লাম–সে এক কাহিনী। যা হোক–শিক্ষাগুরু রামন লাল আলমুদাইনা রাজপ্রাসাদের একটি অংশে তার শিষ্যদের পড়াতেন। একুট থেমে সালভা বলতে লাগল– এই রামন লালের জীবন বড়ো বিচিত্র। সামান্য ফাইফরমাস খাটার চাকর ছিলেন বালকবয়সে। পরে তিনি নিজের যোগ্যতায় রাজা দ্বিতীয় জেমসের রাজসভার সম্মানিত অমাত্য হয়েছিলেন। গ্রীক শাস্ত্র আরবী ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। মহাপণ্ডিত বলে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজা দ্বিতীয় জেমস আরো জ্ঞানলাভের জন্যে তাকে সিরিয়া মিশর পূর্ব দেশেও পাঠিয়েছিলেন। বেশ কিছুকাল পরে ফিরে এলেন। পালমায় রইলেন বছর কয়েক। তারপর হঠাৎ একদিন দেশত্যাগ করলেন সব সম্মান যশ অর্থ পেছনে ফেলে। সালভা থামলা।

–তারপর? হ্যারি বলল। সালভা বলল–

–রামন লাল নানা শাস্ত্র চর্চার সঙ্গে সঙ্গে অ্যালকেমি অর্থাৎ অপ-রসায়নেরও চর্চা করতেন।

মারিয়া বলল- হ্যাঁ, আমাদের দেশেও কেউ কেউ এই অপ-রসায়নের চর্চা করেন। সীসা, তামা, পারদ সোনায় রূপান্তরিত করা যায় কীভাবে–এই অ্যালকেমির গবেষকরা তারই গবেষণা করেন।

–আপনি ঠিক বলেছেন। সালভা বলল–প্রথমবার রামন লাল অনেক কিছু লিখে আনেন। এটাকেই বলা হয় রামন লালের পাণ্ডুলিপির প্রথম খণ্ড। কিন্তু সেই পাণ্ডুলিপি কোথায় গোপন রেখে তিনি দেশত্যাগ করেন এটা তিনি কাউকে জানিয়ে যাননি। সালভা থামল। ফ্রান্সিস এতক্ষণে বেশ আগ্রহ বোধ করল। বলল–এই প্রথম পাণ্ডুলিপিটা কি অনুসন্ধান করা হয়েছে?

–হ্যাঁ হ্যাঁ–রাজা দ্বিতীয় জেমস তো বটেই এখনকার রাজা তৃতীয় জেমসও পণ্ডিতদের দিয়ে অনুসন্ধান চালাচ্ছেন। কারণ, রামন লাল নাকি পণ্ডিতমহলে বলেছিলেন যে এই প্রথম পাণ্ডুলিপিতে তিনি অ্যালকেমির বেশ কিছু সূত্র লিখে রেখেছেন।

–হুঁ, তাহলে তো ওটা বেশ মূল্যবান। হ্যারি বলল।

–তারপর? ফ্রান্সিস বলল।

–রামন লাল চলে গেলেন। আমি এখানে ফিরে এলাম। নিজে নিজেই পড়াশুনো চালালাম। বাবার বয়েস হয়েছে। আমি মাছ ধরার কাজে বাবাকে সাহায্য করতে লাগলাম। সালভা থামল।

রামন লালের আর কোনো খবর পেলেন না? মারিয়া বলল?

–না। বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। কয়েকদিন আগের কথা। সেদিন বিকেলে নৌকো থেকে মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরবো। হঠাৎ দেখি একটা নৌকো সমুদ্রে দোল খাচ্ছে।

নৌকোটা ঠিক জেলে নৌকো না। কৌতূহল হল। নৌকো চালিয়ে ঐ নৌকোটার, কাছে গেলাম। দেখি একটা কাপড় ঢাকা মাথা অল্প দেখা যাচ্ছে। কাছে গিয়ে দেখি কাদা-ধুলো-বালিতে নোংরা কালো জোব্বা গায়ে একটি লোক শুয়ে আছে। মাথা মুখ কাপড়ে ঢাকা। নৌকোটায় উঠলাম। মুখের কাপড়ের ঢাকনা সরিয়েই ভীষণভাবে চমকে উঠলাম–এ যে আমার শিক্ষাগুরু রামন লাল। মুখের কঁচাপাকা দাঁড়িয়ে মাথার লম্বা লম্বা চুলে রক্তের ছোপ কালো হয়ে গেছে। নাকে কপালে মুখে ক্ষত। জোব্বার হাতার বাইরে হাত দুটোয় কালশিটে দাগ। রক্তের ছোপ। তাড়াতাড়ি বুকের ওপর কান চেপে ধরলাম। নাঃ-বেঁচে আছেন। নাকের নীচে হাত রাখলাম। শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে। একটা কালো রঙের দাঁড় পড়ে আছে নৌকোটায়। নৌকোটা আমার নেকোর সঙ্গে বেঁধে তীরে নিয়ে এলাম। ছুটে এলাম বস্তীতে। কয়েকজন বন্ধ ক ডেকে নিয়ে ছুটলাম সমুদ্রের ধারে। রামন লালকে ধরাধরি করে এনে বিছানায় শুইয়ে দিলাম। মা গরম জলে মুখের গায়ের ক্ষত মুছে দিল। জল খাওয়াল। তখনও উনি চোখ বন্ধ করে আছেন। একটু থামল সালভা। তারপর বলতে লাগল–বৈদ্যির চিকিৎসায় কয়েকদিনের মধ্যে রামন লাল একুট সুস্থ হলেন। আস্তে আস্তে বললেন যে অনেক দেশ ঘুরে তিউনেসিয়ার সমুদ্র উপকূলে এসেছিলেন। ওখানকার আরবীয়রা তাকে পাথর ছুঁড়ে মারছিল। কোনোরকমে একটা নৌকোয় উঠে পালিয়ে আসেন। খাদ্য নেই, জল নেই। একা একা দাঁড় বেয়েছেন। দূরত্ব খুববেশি না হলেও আহত শরীর নিয়ে মাঝে মাঝেই কষ্টে যন্ত্রনায় দাঁড় টানার পরিশ্রমে, ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় অজ্ঞান হয়ে গেছেন। আবার জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন। কথাগুলো বলতে বলতে সালভার গলা ভারী হয়ে এলো। চোখ ছলছল করতে লাগল। একটু থেমে বলতে লাগল কিন্তু উনি আর সুস্থ হলেন না। শরীরের ক্ষতগুলো বিষিয়ে উঠল। ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। এদিকে আল আমিরির সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে রামন লালকে যে রাজধানী পালমায় নিয়ে যাবো তারও উপায় নেই।

একদিন সন্ধে থেকেই শ্বাসকষ্ট শুরু হল। ঐ শ্বাসকষ্টের মধ্যে ইঙ্গিতে কাগজ কলম চাইলেন। আমি তাড়াতাড়ি পার্চমেন্ট কাগজ আর উটপাখির পালকের কলমে কালি লাগিয়ে দিলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে অনেক কষ্টে একটা নক্শামতো কী আঁকলেন। অনেক কষ্টে ফ্যাসফেসে গলায় শুধু বললেন–আল-মুদা-ই-লা-য়। কাঁপা কাঁপা আঙ্গুলে নকশাটা দেখালেন। শ্বাসকষ্টে পাগলের মতো মাথাটা এপাশ ওপাশ করতে করতে স্থির হয়ে গেলেন। বৈদ্যি আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে চলে গেল। আমি শিশুর মতো কাঁদতে লাগলাম। সালভা থামল। ফ্রান্সিসরা কেউ কোনো কথা বলল না। একটু পরে ফ্রান্সিস বলল–আলমুদাইলা কী? সালভা বলল–রাজধানী পালমার রাজপ্রাসাদের নাম।

হ্যারি বলল–ওঁর পোশাকে কিছু পেয়েছিলে?

–হ্যাঁ, জোব্বার পকেটে এক গোছা পাণ্ডুলিপি। গ্রীক ভাষায় লেখা। মন শান্ত হলে পড়লাম পাণ্ডুলিপিটা। লিখেছেন কোথায় কোথায় গেছেন–বন্দি হয়েছেন কয়েদ খেটেছেন–মানে ভ্রমণ কাহিনীর মতো। সবশেষের পাতায় যেটা লিখেছিলেন–সেটা বেশ কৌতূহল জাগায়। লিখেছিলেন–আমার প্রথম পাণ্ডুলিপিতে বেশ কিছু অ্যালকেমির সূত্র আছে। সেই সূত্রগুলো নিয়ে বিভিন্ন দেশের পণ্ডিত অভিজ্ঞ রসায়নবিদদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। বুঝলাম আমার সূত্রগুলো নির্ভুল। ভাবছি ফিরে গিয়ে এসব নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবো। একু থেমে সালভা বলল–সেটা আর পারলেন না।

মাজোরকা দ্বীপে ফ্রান্সিস

-তারপর? ফ্রান্সিস বলল।

–দুর্বল হাতে যে নকশাটা উনি এঁকেছিলেন সেটা ভালো করে দেখে আমি বুঝেছিলাম যে প্রথম পাণ্ডুলিপিটা তিনি কোথায় গোপনে রেখে গেছেন তার নির্দেশ আছেনকশাটায়। কিন্তু সেই নির্দেশ আমি কিছুই বুঝলাম না। ফ্রান্সিস বেশ আগ্রহের সঙ্গে বলে উঠল সেই নকশাটা কোথায়?

–ওটা আমি ঘরে বালির মধ্যে পাথরের পাটাতন দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছি। ঘর তো পুড়ে গেছে। জানি না নকশাটাও পুড়ে গেছে কিনা। সালভা বলল।

না–পোড়ে নি–মারিয়া বলল–আগুনে বালি পোড়ে না বরং বালি আগুন নেভায়। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বিছানা থেকে নামল। ধীর পায়ে মেঝেয় পায়চারি করতে লাগল। ওর মাথায় ঘুরছে–নকশারামন লালের প্রথম পাণ্ডুলিপি। হ্যারি বলল– সালভার পরে কী ঘটলো বলো। সালভা বলতে লাগল–আমি কী করবো বুঝে উঠতে পারলাম না। রামন লালের মতো একজন শ্রদ্ধেয় দেশবরেণ্য মানুষকে সমাধিস্থ করবো এরকম একটা অখ্যাত জায়গায়? কিছুতেই মন মানল না। পরদিন ভোরেই বন্ধুদের সাহায্যে মৃতদেহ দুটো খচ্চরে টানা শস্যবওয়া গাড়িতে তুললাম। নিজেই চালিয়ে নিয়ে চললাম রাজধানী পালমার দিকে। দুর্গের পাশ দিয়ে রাস্তা। যাচ্ছি। কয়েকজন মূর সৈন্য ঘিরে ধরলো। ওরা কাউলে পালমা যেতে দিচ্ছে না। পাছে দুর্গ দখলের খবরটা রাজার কানে ওঠে। ওরা মৃতদেহ দেখল। ওদের মধ্যে একটি সৈন্য রামন লালকে চিনে ফেলল। ওরকম একজন খ্যাতিমান মানুষকে না চেনাই অশ্চর্য। খবর গেল দুর্গে। আল আমিরি ঘোড়ায় চড়ে এলো। মৃতদেহ দেখেই চিনল। সেনাপতিও এসেছে পেছনে পেছনে। সেনাপতিকে বলল মৃতদেহের পোশাক খুঁজে দেখতে। দামি কিছু আছে কিনা। সেনাপতি খুলে নিল গলায় ঝোলানো সোনার কুশটা আঙ্গুলের হীরের আংটি। এক পকেট থেকে পূর্বদেশীয় কিছু মোহর। এবার ঝোলা পকেট থেকে বের করল পাণ্ডুলিপিটা। আল আমিরি পাণ্ডুলিপিটা হাতে নিল। এক পাতা পড়ে আমাকে বলল–এটা পড়েছিস্ তুই? বললাম হ্যাঁ।

–অ্যালকেমির সূত্র আছে এতে? আল আমিরি বলল। বুঝলাম আল আমিরিকে যতটা অশিক্ষিত ভেবেছিলম সে ততটা অশিক্ষিত নয়। রামন লালের পাণ্ডুলিপিতে অ্যালকেমির সূত্র আছে এটা সে জানে। বললাম–

“জানি না। আল আমিরি তলোয়ারের হাতির দাঁতে বাঁধানো হাতলে হাত দিল। চিৎকার করে বলল–

–সত্যি কথা বল্। বললাম–শেষ পাতায় শুধু লেখা আছে যে প্রথম পাণ্ডুলিপিতে সূত্রগুলো লেখা আছে। আল আমিরি দ্রুত হাতে পাতা উলটিয়ে শেষ পাতাটা পড়ে ফেলল। বলল–প্রথম পাণ্ডুলিপি কোথায়?

–সে আমি জানি না। আমি বললাম।

–রামন লাল তোকে কোনো হদিশ দিয়ে যায় নি? আল আমিরি বলল।

–না। আমি বললাম। আল আমিরি বিশ্বাস করল না।

ঝনাৎ করে তলোয়ার কোষমুক্ত করল। আমার মাথার ওপর তলোয়ার উঁচিয়ে ধরে বলল–মিথ্যে কথা। বল্ কোথায় সেই পাণ্ডুলিপি?

–আমি সত্যি জানি না। কথাটা বলতেই তলোয়ারটা রোদে ঝলসে উঠে দ্রুত আমার বুক ছুঁয়ে গেল। পোশাক কেটে গেল। বুক লম্বালম্বি কেটে গেল। রক্ত পড়তে লাগল।

–বল–আবার তলোয়ার তুলল আল আমিরি। বুঝলাম বাঁচতে হলে অন্য পথ নিতে হবে। বললাম হ্যাঁ, মৃত্যুর সময় রামন লাল, আমাকে একটা নক্শামতো এঁকে দিয়ে গেছেন। আল আমিরি বলল–কোথায় সেটা? বললাম–আমার ঘরে রেখে এসেছি। আল আমিরি তলোয়ারের ইঙ্গিতে তিনজন সৈন্যকে বলল–তোরা ওর সঙ্গে যা। ও যা দেবে নিয়ে আসবি। ওকেও সঙ্গে নিয়ে আসবি। খবরদার–পালায় না যেন। সালভা তামল। ফ্রান্সিস পায়চারি থামিয়ে বলল–শোন সালভা–আজ রাতে তোমার পোড়া ঘরে যাবো। নক্শাটা পেলে রামন লালের প্রথম পাণ্ডুলিপিটা উদ্ধার করবো। মারিয়া বলে উঠল–কিন্তু আমরা তো দেশে ফিরবো এখন। ফ্রান্সিস ঘুরে দাঁড়িয়ে মারিয়ার মুখের দিকে তাকাল। আস্তে বলল–ঠিক আছে। তোমরা জাহাজ নিয়ে চলে যাও। আমি, হ্যারি আর শাঙ্কো এই মাজোরকা দ্বীপে থাকবো। পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করবো। মারিয়া বুঝল– ফ্রান্সিস যা করবে স্থির করে তা করবেই। মৃদুস্বরে মারিয়া বলল–আমাকে মাফ করো ফ্রান্সিস। অনেকদিন দেশ ছাড়া তাই আমি তোমার সঙ্গেই থাকবো।

হ্যারি আর সালভা নিজেদের কেবিনে চলে গেল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে কেবিন ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল।

দুপুরের দিকেই হ্যারি বুঝতে পারল–জ্বর আসছে। গতকাল থেকেই শরীরটা ভালো লাগছিল না। অল্পক্ষণের মধ্যেই জ্বর বাড়লো। কপালে দপদপানি শুরু হল। শরীরের গাঁটে গাঁটে মোচড়ানো ব্যথা।বিস্কো বা অন্য ভাইকিং বন্ধুরা তখনও জানেনা-ফ্রান্সিসের নতুন সংকল্পের কথা। বিস্কো হ্যারির কাছে জানতে এলো এবার দেশের দিকে জাহাজ চালাবে কিনা। দেখল হ্যারি চোখ বুজে শুয়ে আছে। ভাবলো–ঘুমুচ্ছে বোধহয়। বিস্কো বিছানায় বসে ডাকলো–হ্যারি? হ্যারির কোনো সাড়া শব্দ নেই। বিস্কো হ্যারির কাঁধে হাত রেখে ডাকতে গেল। চমকে উঠল। হ্যারির গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে যেন। বিস্কো বিছানা থেকে দ্রুত উঠে দাঁড়াল। হ্যারির কপালে গলায় হাত রাখল। ভীষণ জ্বর। একে শরীরের দিক থেকে হ্যারি বরাবরই দুর্বল। রিস্কো বেশ ঘাবড়ে গেল।তাড়াতাড়ি হ্যারিকে আস্তে ধাক্কা দিল। ডাকল–হ্যারি? হ্যারি চোখ মেলে তাকাল। দু’চোখ বেশ লাল। বিস্কো আর দাঁড়াল না। ওদের বৈদ্যি বন্ধুকে ডাকতে ছুটল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই বৈদ্যি ওষুধের পুঁটুলি, একটা বোয়াম নিয়ে এলো। হ্যারিকে পরীক্ষা করল। তারপর পুঁটুলি থেকে এক চিমটে লাল গুঁড়ো বের করে হ্যারিকে খাইয়ে দিল। বোয়াম থেকে কিছু কালো চটচটে ওষুধ বের করে দু’হাতের তালুতে ঘষে বড়ির মতো বানাল। বিস্কোর হাতে দিয়ে বলল–রেখে দাও–সন্ধে রাতে একটা করে খাইয়ে দিও। বৈদ্যি পুঁটুলি বোয়াম নিয়ে চলে গেল।

একটু পরে হ্যারি চোখমুখ কুঁচকে বিস্কোর দিকে পাশ ফিরল। বলল–বিস্কো– ফ্রান্সিস এখন দেশে ফিরতে রাজি নয়। বিস্কো বেশ আশ্চর্য হল। বলল, কেন?

–সে অনেক কথা। ফ্রান্সিস বলবে সব। হ্যারি বলল। হ্যারির অসুখের কথা শুনে কয়েকজন ভাইকিং বন্ধু হ্যারির কেবিনঘরে এলো। একজন ছুটলো ফ্রান্সিসকে খবর দিতে। একটু পরেই ফ্রান্সিস আর মারিয়া এলো। ফ্রান্সিস হ্যারির কপালে হাত দিল। বুঝল বেশ জ্বর। মারিয়াকে বলল সে-কথা। মারিয়া ঘরের চারদিকে তাকাল। ছেঁড়া কাপড়-টাপড় কিছু দেখল না। তখন নিজের পোশাক থেকে কিছুটা ছিঁড়ে নিল। কাঠের গ্লাসে জল ভরে নিয়ে এলো। কাপড়ের টুকরো জলে ভিজিয়ে হ্যারির পাশে বসল। হ্যারির জ্বরতপ্ত কপালে জলপট্টি দিতে লাগল। বিস্কোকে বলল–দরজা সবটা খুলে দাও। আধ ভেজানো দরজা সবটা খুলে দিতেই সমুদ্রের জোর হাওয়া ঢুকল। ঘরের গুমোট ভাবটা কাটল।

দুপুরে স্নান খাওয়া সেরে ফ্রান্সিসরা আবার এলো। মারিয়া জলপট্টি দিতে লাগল।

বিকেল হল। মারিয়া মাঝে মাঝে হ্যারির মাথায় গলায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হ্যারি চোখ খুলে তাকাল। চোখের লালভাব অনেকটা কম। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে হ্যারি শুকনো ঠোঁটে হাসল।

–এখন কেমন বোধ করছো? হ্যারির মুখের কাছে ঝুঁকে ফ্রান্সিস জিজ্ঞেস করল।

-জ্বর কমেছে। ভালো লাগছে–হ্যারি আস্তে আস্তে বলল–তুমি এখন কী করবে বন্ধুদের বলো।

-ও-হ্যাঁ। ফ্রান্সিস সোজা হয়ে বসল। বিস্কোর দিকে তাকিয়ে বলল

সব বন্ধুদের সন্ধেবেলা ডেক্‌-এ আসতে বলো। আমার কিছু বলার আছে।

–বেশ-খবর দিচ্ছি। বিস্কো বলল।

সন্ধে হল। ভাইকিং বন্ধুরা ডেক্‌-এ এসে জমায়েত হল। ফ্রান্সিস এখন কী করবে তাই নিয়ে ওরা পরস্পর কথা বলতে লাগল। একটু পরে ফ্রান্সিস মারিয়াকে নিয়ে ডে এ এলো। বন্ধুদের গুঞ্জন থেমে গেল। আকাশে চাঁদ একটু উজ্জ্বল। জ্যোত্মা পড়েছে শান্ত সমুদ্রের জলে জাহাজে। হাওয়ার তেমন জোর নেই। ফ্রান্সিস একটু গলা চড়িয়ে বলতে লাগল–ভাইসব–সামনে যে ডাঙা দেখা যাচ্ছে–এটা একটা ছোটো বন্দর নাম পালমা নোভা। মাজোরকা দ্বীপের বন্দর। রাজধানীর নাম পালমা। সেটা দূরে। এবার ফ্রান্সিস সালভার কথা, আল আমিরির কথা, রামন লালের পাণ্ডুলিপির কথা, নকশার কথা বলল। তারপর বলল–আমার আপন ভাইয়ের মতো হ্যারি অসুস্থ। আমার মন ভালো নেই। তবু আমাকে যেতেই হবে। তোমরা হ্যারিকে দেখবে। স্থির করেছি আমি, মারিয়া আর শাঙ্কো ঐ দ্বীপে যাবো। রামন লালের প্রথম পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করব। ফ্রান্সিস থামল। সবাই তখন ভাবছে ফ্রান্সিসের কথাগুলো। বিস্কো বলল কী আছে ঐ পাণ্ডুলিপিতে?

-সাধারণ সীসে দস্তা পারদকে সোনায় রূপান্তরিত করার সূত্র লেখা আছে ঐ পাণ্ডুলিপিতে। ফ্রান্সিস বলল। একজন ভাইকিং বন্ধু বলল–

–ফ্রান্সিস এটা কি সম্ভব?

–এই বিষয়টিকে বলে অ্যালকেমি অর্থাৎ অপ-রসায়ন। পাণ্ডুলিপির সূত্রগুলো পেলে প্রক্রিয়া বের করে হয়তো কোনো রসায়নবিদ কিছু করতেও পারেন। আমার লক্ষ্য ঐ প্রথম পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করা। তারপর ঐ দ্বীপের রাজা তৃতীয় জেমসকে দিয়ে দেওয়া। অ্যালকেমি নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই।

–কিন্তু একটা কাগজের পাণ্ডুলিপি তো সোনা মুক্তোর মতো মূল্যবান কিছু নয়। একজন ভাইকিং বন্ধু বলল।

ঠিক। কিন্তু তোমরা তো জানো–গুপ্ত সম্পদ বা গুপ্ত পাণ্ডুলিপির ওপর আমার বিন্দুমাত্র লোভ নেই। আমি ভালোবাসি দুর্জয় সংকল্পকে বীরত্বকে সাহসকে এবং বুদ্ধির খেলাকে। ফ্রান্সিস বলল।

–তোমরা তিনজন কি পারবে? বিস্কো বলল।

–দেখা যাক। আমরা চলে গেলে তোমরা দিনকয়েক অপেক্ষা করো। যদি আমরা না ফিরি তাহলে আমাদের খুঁজতে দ্বীপে নামবে। ফ্রান্সিস বলল।

ভাইকিংদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হল। ফ্রান্সিসরা না ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। দেশের দিকে জাহাজ চালানো যাবে না। আবার এটাও ওরা ভালো করেই জানে ফ্রান্সিসকে কোনোভাবেই সঙ্কল্পচ্যুত করা যাবে না। আস্তে আস্তে গুঞ্জন থামল। বিস্কো। গলা চড়িয়ে বলল- ফ্রান্সিস আমরা তোমাদের ছেড়ে দেশে ফিরবো না। সব ভাইকিংরা সমর্থনের ধ্বনি তুলল–ও-হো-হো। ফ্রান্সিস হাসল। সভা শেষ হল। সবাই চলে যেতে লাগল। ফ্রান্সিসও মারিয়াকে নিয়ে নিজেদের কেবিন-ঘরে ফিরে এলো। ফ্রান্সিসের মনে সংশয় ছিল হয়তো মূল্যহীন একটা পাণ্ডুলিপির জন্যে বন্ধুরা অপেক্ষা করবে কিনা। ওরা তো অনেকদিন দেশ ছাড়া। কিন্তু বন্ধুরা অপেক্ষা করতে রাজি হওয়ায় ফ্রান্সিসদের সংশয় দূর হল। ও খুশি হল।

রাতের খাওয়া শেষ হল। ফ্রান্সিস ওদের কেবিন-ঘরে আস্তে আস্তে পায়চারি করছে। ভাবছে–কেমন সেই রামন লালের নকশা। কে জানে–মুমূর্ষ রামন লাল ঐ নকশায় গুপ্ত পাণ্ডুলিপির হদিশ কিছু দিয়েছে কিনা। তখনি দেখল মারিয়া বিছানায় বসে ওর একটা গাউন কঁচি দিয়ে কাটছে। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। বেশ আশ্চর্য হয়ে বলল পোশাকটা কাটছো কেন? মারিয়া কঁচি চালাতে চালাতে মুখে একটু গম্ভীরভাব এনে বলল–ফ্রান্সিস–আমরা একটা অভিযানে যাচ্ছি, নাচের আসরে যাচ্ছি না। কাজেই গাউনের ঝুলটা কেটে ছোটো করছি যাতে দরকার পড়লে সহজে ছুটোছুটি করতে পারি।

-কিন্তু অমন সুন্দর দামি পোশাকটা

জীবন এই পোশাকের চেয়ে অনেক বেশি দামি আর অনেক সুন্দর বেঁচে থাকা। মারিয়া হেসে বলল। ফ্রান্সিসও হাসল। কিছু বলল না। একটু পরে দু’জনে অসুস্থ হ্যারিকে দেখতে গেল। হ্যারি এখন অনেকটা সুস্থ। জ্বর কমেছে। তবুঅভিযানে যাবার মতো সুস্থ ) হয়নি শরীর।

রাত একটু বাড়তে ফ্রান্সিস তৈরি হল। পোশাক পরে কোমরে চামড়ার ফেট্টিতে তলোয়ার গুজল। মারিয়া কাটা গাউনটা পরল। পোশাকটা না হল গাউন না হল ফ্রক। ধনুক তুনীর ঝুলিয়ে শাঙ্কো এলো। ওর কোমরে একটা ধারালো ছোরা। ছোরাটা ও সবসময়ে কোমরে গুঁজে রাখে। সালভাও এলো। বৈদ্যির ওষুধ লাগিয়ে ওর বুকের ক্ষমতা শুকিয়ে এসেছে।

জাহাজ থেকে ঝোলানো দড়ি ধরে ধরে নৌকোয় নামল ওরা।ফ্রান্সিসদাঁড় বাইতে লাগল। শাঙ্কো একা দাঁড় হালের মতো ধরে বসে রইল। নৌকোর ভেতরে বসল মারিয়া আর সালভা। চাঁদের আলোয় ফ্রান্সিস দেখল জাহাজের রেলি ধরে ওদের দিকে তাকিয়ে আছেবিস্কো আর কয়েকজন বন্ধু। আবার বন্ধুদের সঙ্গে কবে দেখা হবে। ফ্রান্সিসদের মনটা একটু উদাস হল। পরক্ষণেই এসব ভাবনা মন থেকে সরাল। জোরে দাঁড় বাইতে লাগল।

একসময় তীরে পৌঁছল ওরা। আগের সেই ছোট্ট খাঁড়ির মধ্যেই নৌকোটা ঢোকাল ফ্রান্সিস। একটু গিয়ে ওরা একে একে নৌকো থেকে তীরের বালিয়াড়িতে নামল। কালকে দেখা সেই জাহাজটা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্সিস বলল–সালভা ঐ জাহাজটা কাদের?

আল আমিরি এই জাহাজেই সৈন্য আর একদল বন্দি নিয়ে এসেছিল। সালভা। একটু থেমে বলল–গভীর রাত্রে দুর্গের রাজার সৈন্যরা কিছু বোঝবার আগেই প্রচণ্ড আক্রমণ করল। রাজা জেমসের সৈন্যরা বাধা দিল। কিন্তু আল আমিরির মূর সৈন্যদের কাছে ওরা দাঁড়াতেই পারল না। মূরদের কাছে ছিল চামড়ার ফিতের গুলতির মতো স্লিং। ঐ স্লিং দিয়ে পাথরের বক্সে বড় টুকরো ছুঁড়ে ওরা সহজেই দুর্গের সৈন্যদের কাবু করে ফেলল। হেরে গেল রাজা জেমসের সৈন্যরা। সালভা থামল।

জাহাজটা কালকেও দেখেছি জনশূন্য। শাঙ্কো বলল।

–হ্যাঁ, জাহাজটায় কেউ থাকে না। সবাই দুর্গে থাকে। সালভা বলল। জাহাজটা বেশ দূরে। চাঁদের আলোয় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

সামনে সালভা। পেছনে ফ্রান্সিসরা। বালির ওপর দিয়ে হেঁটে চলল। চারপাশ নিস্তব্ধ। শুধু বাতাসের শব্দ আর সমুদ্রের ঢেউ ভেঙে পড়ার মৃদু শব্দ।

ফ্রান্সিসহাঁ টতে হাঁটতে জাহাজটার দিকে ভালো করে নজর বুলোল। বলল–সালভা জাহাজটায় গতরাতে দু-একটা আলো দেখেছিলাম। আজকে দেখছি সব অন্ধকার। মারিয়া বলল–গতরাতে জাহাজটা থেকে কিন্তু কোনো পাটাতন তীরের বালিতে ফেলা ছিল না। আজকে একটা কাঠের পাতাটন ফেলা রয়েছে।

–হুঁ, দেখছি তাই। ফ্রান্সিস একটু চিন্তিতস্বরে বলল। তারপর চারদিক তাকিয়ে দেখতে দেখতে হাঁটতে লাগল। নাঃ, কোথাও কোনো জনপ্রাণীর দেখা নেই।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর দেখা গেল কিছু ছাড়া ছাড়া গাছগাছালি। বাতাসে গাছের পাতায় শব্দ হচ্ছে। তার নীচে পরপর কিছু পাথরের বাড়িঘর। কাছে এসে দেখা গেল সব বাড়িঘর আগুনে পোড়া। পাথন বসানো থামগুলো পুড়ে কালো হয়ে গেছে। ছাত বলে কিছু নেই। সব পুড়ে গেছে। সালভা দাঁড়িয়ে পড়ল। বস্তীর পোড়া ঘরবাড়ি দেখল। তারপর এগিয়ে চলল। পেছনে ফ্রান্সিসরা। কয়েকটা পোড়া বাড়িঘর পার হয়ে একটা পোড়া ঘরে ঢুকল সালভা। ফ্রান্সিসরাও ঘরটায় ঢুকল। এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে দেয়াল পুড়ে কালো হয়ে গেছে। সালভা মেঝে থেকে পোড়া কাঠের ডাল সরিয়ে উবু হয়ে বসল। বালি সরাতে লাগল। একটা পাথরের ছোটো পাটাতন। তুলে ফেলল ওটা। একটু একুট ছাই-রঙা গোটানো কাগজ বের করল। হেসে বলল–যা নকশাটা পুড়ে যায়নি। নকশাটা খুলে দেখে নিঃশব্দে ফ্রান্সিসকে দিল। ফ্রান্সিস হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। মাথার ওপরে ছাত তো নেই। চাঁদের আলো পড়েছে। ফ্রান্সিস কাগজটার সবটা ছড়িয়ে দেখতে লাগল। কালিতে মোটা টানে রামন লালের নিজের হাতে আঁকা নকশা।

ফ্রান্সিস খুব মনোযোগ নিয়ে নকশাটা দেখতে লাগল। মারিয়াও মুখ বাড়িয়ে দেখতে লাগল।শাঙ্কোও একনজর দেখে নিল। সালভা একটু হতাশ স্বরে বলল–মুমূর্ষ অবস্থায় আঁকা এই নকশাটা দেখে রামন লালের প্রথম পাণ্ডুলিপি বের করতে পারবেন? শাঙ্কো বলল–ভাই এর নাম ফ্রান্সিস। কত নকশা, ছড়া ছবির অর্থ বের করেছে ফ্রান্সিস। দেখে–এটারও রহস্য ভেদ করবে। সালভা আর কিছু বলল না।

হঠাৎ রাতের নৈঃশব্দ ভেঙে দিল একটা তীক্ষ্ণ শব্দ। ভীষণ চমকে উঠে সালভা বলল মূর সৈন্যরা আক্রমণ করার আগে মুখে এরকম শব্দ করে। হঠাৎ ধূপ ধাপ শব্দ শোনা গেল। একদল লোকের ছুটে আসার শব্দ। ফ্রান্সিস দ্রুত হাতে নটা ঢোলা জামার মধ্যে গলার কাছ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। শাঙ্কোও কোমর থেকে ছোরাটা বের করে জামার মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল। শাঙ্কো ধনুকে তির পরাল। ফ্রান্সিস এক ঝটকায় তলোয়ার খুলল।

চাঁদের আলোয় দেখা গেল পোড়ো বাড়িটার চারপাশ ঘিরে মূল সৈন্যরা খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে আছে। শাঙ্কো ধনুকে তির পরিয়ে ছিলা টানল। লক্ষ্য সামনের মূল সৈন্যটা। ফ্রান্সিস বলল–ধনুক নামাও। ফ্রান্সিস পোড়া ঘরটা থেকে বাইরে এলো। পেছনে মারিয়া শাঙ্কো আর সালভা। সালভার মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে। ফ্রান্সিস হাতের তলোয়ার বালির ওপর ফেলে দিল। কোন শব্দ হল না। শাঙ্কো ধনুক বালিতে নাময়ে রাখল।

সৈন্যদের দল থেকে একজন লম্বামতো সৈন্য খোলা তলোয়ার হাতে এগিয়ে এলো। ওর চিবুকে কোকড়া দাড়ি। সালভাকে দেখে হলদেটে দাঁত বের করে হাসল। কালো ঘামে ভেজা শরীরে জ্যোৎস্নার আলো পড়েছে। চক চক করছে যেন। বুকে বর্ম। লোকটা আরবী ভাষায় কী বলল। সাভা মাথা নিচু করল। কোনো কথা বলল না। এতক্ষণে মারিয়াকে দেখে লোকটা বেশ আশ্চর্য হল। আরো আশ্চর্য হল মারিয়ার হাঁটুর নীচে পর্যন্ত কাটা গাউন দেখে। সালভাকে কী জিজ্ঞেস করল। সালভা ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বলল–জিজ্ঞেস করছে আপনারা কে? ফ্রান্সিস বলল–বলো যে আমরা ভাইকিং। আমরা লড়াই চাই না। সালভা বলল সেকথা। লোকটা সালভাকে কী বলল। তারপর তলোয়ার ঘুরিয়ে সবাইকে হাঁটবার ইঙ্গিত করল। সালভা ঐ লোকটার দিকে যেতে যেতে বলল–চলুন আমাদের দুর্গে যেতে হবে।

আগে পিছে মুর সৈন্যরা চলল। মাঝখানে ফ্রান্সিসরা। দু’পাশে ছাড়া ছাড়া গাছগাছালি। মাঝখানে ধুলোবালির পথ। হেঁটে চলল সবাই।

যেতে যেতে ফ্রান্সিসরা দেখল এখানে-ওখানে কিছু পাথরের ঘরবাড়ি। মাথায় বড়ো বড়ো বুনো ঘাসের ছাউনি। চাঁদের আলোয় একটু দূরেই দেখা গেল পাথরের দুর্গের কালো মাথা। একটা ছোটো টিলার ওপরে ঐ দুর্গা। দুৰ্গটা ঘিরে পাথর গাঁথা প্রাচীর। বেশ উঁচু।

ডানহাতি একটা পাথর গাঁথা পথ দুর্গের সদর দরজায় গিয়ে শেষ হয়েছে। ফ্রান্সিসরা গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়াল। দুর্গের বিরাট কাঠের দরজায় একটা বড়ো পাল্লা ঘর ঘ শব্দ তুলে খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল সবাই।

একটা চওড়া পাথর বাঁধানো চত্বর পেরিয়ে টানা বারান্দামতো। দুপাশে পাথুরে দেওয়ালের খাঁজে মশাল জ্বলছে। বারান্দা দিয়ে একটু যেতেই ডানদিকে একটা লোহার গরাদ বসানো ছোটো লম্বাটে দরজা। বোঝা গেল কয়েদঘর। কয়েদঘরের পারারাদার এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিস দেখল পাহারাদারটি মূর নয়। গায়ের রং, চেহারা দেখে মনে হল এদেশীয়। একটু বয়েস হয়েছে লোকটার। সেই লম্বাটে লোকটার নির্দেশে পাহারাদার কোমর থেকে লোহার বড়ো গোল রিং-এর চাবির গোছা খুলল। ঘরটার বড়ো তালাটা খুলে লোহার দরজাটা খুলে দিল। লম্বা সৈন্যটি মারিয়ার দিকে তাকিয়ে চড়া গলায় কী বলল। মারিয়া বুঝল না। সালভা বলল–এই কয়েদঘরে আপনাকে থাকতে হবে। মারিয়া একবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। তারপর ঘরটায় ঢুকল। ফ্রান্সিস ভাবল আপত্তি করবে। মারিয়াকে ওদের সঙ্গেই রাখতে বলবে। কিন্তু লম্বা সৈন্যটির কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝল–এ লোকটি কোনো ওজর আপত্তিতে কান দেবে না। তারপরের ঘরাটির তালা খুলল পাহারাদারটি। শাঙ্কোর তির-ধনুক একজন সৈন্য খুলে নিল। ফ্রান্সিসের তলোয়ারটাও সেই রেখেছেহাতে। ওদের ঘরটায় ঢুকিয়ে দেওয়া হল।ফ্রান্সিস সালভাকে বলল–ঐ সৈন্যটিকে বলো আমাদের কয়েক করা হল কেন? সালভা লম্বা সৈন্যটিকে বলল সেকথা। লম্বা সৈন্যটি ফ্রান্সিসের দিকে কড়া চোখে তাকাল। তারপর কী বলে উঠল। সালভা বলল কালকে আল আমিরির দরবারে হাজির করাবে আমাদের। তারপর উনি যা করেন। ফ্রান্সিস আর কোনো কথা বলল না। শুধু মারিয়া যাতে শুনতে পায়। সেভাবে চেঁচিয়ে বলল–মারিয়া কোন ভয় নেই। আমরা পাশের ঘরেই আছি।

এই ঘরটা বেশ বড়ো। মেঝে শুকনো ঘাস পুরু করে বিছানো। দু’পাশের পাথরের দেয়ালে পোঁতা দুটো লোহার আঙুটা থেকে লোহার শেকল ঝুলছে। শেকলের সঙ্গে বাঁধা লম্বা লম্বা দড়ি। আগে ছোটো দড়ি দিয়ে ফ্রান্সিসদের হাত বাঁধা হল। তারপর। শেকলের লম্বা দড়িগুলোর সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হল আলাদা আলাদা ভাবে। ফ্রান্সিস ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। শাঙ্কো সালভা ঘাসের বিছানায় বসে পড়ল। সৈন্যরা চলে গেল।

ফ্রান্সিস একটুক্ষণ চোখ বুজে শুয়ে রইল। তারপর চোখ খুলল। পাথুরে দেয়ালের আংটায় বসানো মশালের আলোয় ওপরের দিকে তাকাল। বেশ উঁচুতে পাথরের ছাত। দু’পাশে দুটো চৌকোণো মতো এবড়ো-খেবড়ো পাথরের ফোকর। অনেক উঁচুতে সেই গরাদহীন ফোকর। ওটার কাছে পৌঁছোনো অসম্ভব। চারপাশে তাকিয়ে দেখল–আরো শেকলবাঁধা আংটা রয়েছে। শাঙ্কো আস্তে ডাকল–ফ্রান্সিস? ফ্রান্সিস ওর দিকে তাকাল। শাঙ্কো বলল–এখান থেকে পালানো যাবে? শুধু তো আমরা নই। রাজকুমারীও রয়েছেন।

–দেখি–আগে। ক’জন পাহারাদার সৈন্য থাকে কতক্ষণ, পরপর পাহারাদার পালটায় কীভাবে খেতে দেয় তারপর ভাববো। সালভাকে বলল–সালভা এখানে অনেক বন্দি রাখা হয় তাই না?

রাজা জেমসের আমলে শত্রুপক্ষের বন্দি সৈন্যদের রাখা হত। এখন তো আল আমিরির দখলে। আল আমিরি অন্তত জনা পঁচিশেক বন্দিকে এখানে এনে রেখেছিল। দিন চার-পাঁচ আগে এক আরবী ব্যবসায়ী জাহাজ নিয়ে এসেছিল। ক্রীতদাস কেনাবেচা ওর ব্যবসা। আল আমিরি সব বন্দিকে বিক্রি করে দিয়েছিল। সালভা বলল।

বন্দিরা কেউ এখান থেকে পালাতে পেরেছিল? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–হ্যাঁ, শুনেছি তিনজন বন্দিনাকি কীভাবে দুর্গের পেছনের মরণজলা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেছিল। শোনা যায় ওরা নাকি মরণজলাতেই মারা গেছে। সালভা বলল।

ফ্রান্সিস দ্রুত উঠে বসল। বলল–মরণজলাটা কী? সালভা বলল–কে জানে কেন এই দুর্গের পেছনেই আছে একটা জলাভূমি।

–খুব বড়ো? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

-না, না, তবে কী করে যে এই জলায় জল আসে–কাদা থাকেনা মেরীই জানেন। বলল সালভা।

–আমি জানি। এটা পাহাড়ি এলাকা। পাথরের কোনো গোপন ফাটল দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল এসে জমা হয়। মাটির ভাগে মিশে কাদা তৈরি করে। ঠিক আছে বলো– ফ্রান্সিস বলল।

জলাভূমিটা লম্বা লম্বা ঘাসে ঢাকা। ঘাসগুলো কোনোদিন সবুজ হয় না। শুকনো হলুদ রঙের। কেউ এই জলার ধারেকাছে আসে না। ঘোড়া খচ্চরও এই ঘাস খেতে আসে না। দিনের আলোতেও জলাটার অন্ধকার ভাবটা কাটতে চায় না। কেমন ধোঁয়াটে সারা জলাভূমিটা। লোকে তাই এটাকে মরণজলা বলে। সালভা বলল।

–হুঁ, মরণজলা। ফ্রান্সিস চিন্তা করতে করতে বলল। তারপর শুয়ে পড়তে পড়তে বলল–রাত শেষ হয়ে এসেছে। ঘুমিয়ে নাও। বিশ্রাম চাই। শরীর ঠিক রাখো। শাঙ্কো আর সালভা শুয়ে পড়ল।

ঠঠাং-ঠং দরজা খোলার শব্দে ফ্রান্সিসের ঘুম ভেঙে গেল। দেখল–পাহারাদার খোলা দরজা দিয়ে ঢুকছে। হাতে একটা কাঠের বড় থালামতো। তাতে গোল কাটা রুটির টুকরো। অন্য ছোটো কানা উঁচু থালাটায় টুকরো আলু-ডুমুরের ঝোলমতো। পাহারাদার দুটো থালা ফ্রান্সিসদের সামনে শুকনো ঘাসের ওপর রাখল। ফ্রান্সিস উঠে বসল। বাঁধা হাত উঁচু করে দেখাল। পাহারাদার মাথা নাড়ল। স্পেনীয় ভাষায় বলল– হাত খোলার হুকুম নেই। বাঁধা হাত দিয়েই খেতে হবে। শাঙ্কো লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। চিৎকার করে বলল–পেয়েছো কী? আমরা কি কুকুর বেড়াল? পাহাদার শাঙ্কোর দিকে তাকাল। কোনো কথা বলল না। শাঙ্কোর চিৎকার করে কথা বলা শুনে দু’জন মূর সৈন্য দরজায় এসে দাঁড়াল। ফ্রান্সিস আস্তে বলল-শাঙ্কো মাথা গরম করো না। খেয়ে নাও। পেটপুরে খাও। শরীর ঠিক রাখো। শাঙ্কো বসল। তিনজনে খেতে লাগল রুটি ভেঙে ভেঙে। ঝোলটা ভালোই লাগল। খেতে খেতে ফ্রান্সিস পাহারাদারটিকে বলল– ভাই, তুমি তো মূরও নও। পাহারাদারটি মাথা নাড়ল।

–নাম কী তোমার? ফ্রান্সিস বলল।

–কালমা। পাহারাদারটি বলল। খাওয়া হয়ে গেছে। ঘরের কোণার রাখা পীপে থেকে কাঠের বাটিতে জল এনে ফ্রান্সিসদের কালমা জল খাওয়াল। কালমা এঁটো থালা নিয়ে চলে গেল। ঠ ঠঙাং দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

একটু বেলা হল। আবার দরজা খুলল কালমা। ঢুকল সেই লম্বামতো লোকটা। সালভাকে কী বলল। সালভা বলল–ফ্রান্সিস, আল আমিরির কাছে আমাদের হাজির করা হবে। সবাই উঠে দাঁড়াল। ফ্রান্সিসের চিন্তা–আল আমিরি কেমন লোক। সালভার ওপর রাগ আছে। কিন্তু আমাদের কী করবে? আটকে রাখবে না ছেড়ে দেবে?

লম্বা দড়িগুলো থেকে খুলে হাত বাঁধা অবস্থাতেই ফ্রান্সিসদের সামনে পেছনে খোলা তলোয়ার হাতে চারজন সৈন্য। একটু এগোতেই মারিয়ার কয়েদঘর। লোহার দরজার ফাঁক দিয়ে ফ্রান্সিস দেখল ঘাসের বিছানায় মারিয়া চুপ করে বসে আছে। ফ্রান্সিসদের পায়ের শব্দে মুখ তুলে তাকাল। ফ্রান্সিস দাঁড়িয়ে পড়ল। সালভাকে বলল-সালভা লোকটিকে বললো–মারিয়াও যাক আমাদের সঙ্গে। সালভা লোকটিকে বলল সেকথা। লোকটি মারিয়ার দিকে তাকাল। কী ভাবল। কালমাকে দরজা খুলে দিতে ইঙ্গিত করল। দরজা খোলা হল। মারিয়া বেরিয়ে এলো। বাইরের আলোয় ফ্রান্সিস দেখল মারিয়ার মুখ শুকিয়ে গেছে। হয়তো রাতে ঘুম হয়নি। ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে এগোল। ভাবল মারিয়াকে না আনলেই ভালো হত। অন্ধকার থেকে হঠাৎ বাইরের উজ্জ্বল রোদে এসে ফ্রান্সিসদের তাকাতে অসুবিধা হচ্ছিল। চোখ কুঁচকে তাকাতে হচ্ছিল।

বাইরের চত্বরে নামল সবাই। চলল সামনের একটা কাঠের দরজার দিকে।

দরজা দিয়ে একটা বিস্তৃত ঘরে ওরা ঢুকল। দিনের বেলায়ও ঘরটা কেমন অন্ধকার। দেয়ালে মশাল জ্বলছে। একটা পাথরের লম্বাটে আসনে রঙচঙে কাপড় পাতা। দু’পা ছড়িয়ে একটু আয়েসী ভঙ্গীতে বসে আছে আল আমিরি। বেশ ফর্সা রঙ। চিবুকে সামান্য দাড়ি। লম্বা শক্তসমর্থ চেহারা। পরনে সাধারণ সাদাকালো রঙের জোব্বামতো। আল আমিরির চোখের দিকে তাকিয়ে ফ্রান্সিস বুঝল লোকটা ধূর্ত আর ক্ষমতালোভী। তার দু’পাশের ছোটো আসনে দু’জন আরবীয় বৃদ্ধ বসে আছে। বোধহয় আল আমিরির পরামর্শদাতা।

ফ্রান্সিসরা দাঁড়িয়ে রইল। লম্বা লোকটি আদাবের ভঙ্গীতে সম্মান জানিয়ে কী বলে গেল। আল আমিরি ভরাট গলায় ডাকল–সালভা? সালভা একটু মাথা নিচু করল। আল আমিরি স্পেনীয় ভাষায় বলল–তুমি খুব বেঁচে গিয়েছিলে। এবার আর তোমার বাঁচার আশা নেই। একটু থেমে বলল

–বল্ কোথায় আছে রামনের পাণ্ডুলিপি?

“আমি সত্যি জানি না সিনির (মহাশয়)। সালভা ভীতকণ্ঠে বলল। আল আমিরি ডান দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল নেড়ে কী ইঙ্গিত করল। একটি খালি গা বলশালী মূর কালো লম্বা চামড়ার চাবুক শপাং-শপাং-প্রচণ্ড জোরে চাবুক চালাতে লাগল সালভার গায়ে। সালভা চিৎকার করে উঠল। চোখে জল এলো ওর। আল আমিরি হাত তুলল। বন্ধ হল। চাবুক মারা।

এবার বলো–নইলে–আল আমিরি গলা চড়াল। সালভা যন্ত্রণায় কেঁদে ফেলল। বলল–সেই পাণ্ডুলিপি কোথায় আমি জানি না। বিশ্বাস করুন–আমি সত্যি কিছু : জানি না।

–তুই রামনের মৃতদেহ নিয়ে গোর দিতে যাচ্ছিলি। তুই সব জানি। বল–। আল আমিরি বলে উঠল।

না-না। সালভা জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল–আমি কিছু জানি না। আবার আঙ্গুলের ইঙ্গিত। আবার চাবুকের মার। সালভার পিঠের দিকে পোশাক ছিঁড়ে গেল। রক্ত ফুটে উঠল পোশাকে। ও যন্ত্রণায় কাঁদতে লাগল। ফ্রান্সিসের আর সহ্য হল না। ও বাঁধা দু’হাত ওপরে তুলল। বলল–আমার অনুরোধ–সালভাকে চাবুক মারা বন্ধ করুন। আল আমিরি একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে ফ্রান্সসের মুখের দিকে তাকাল। বলল তাহলে সালভার হয়ে তুই চাবুকের মার খাবি?

আমার কথাটা আগে শুনুন। তারপর আমাকে চাবুকমারতে চান মারবেন। ফ্রান্সিস বেশ দৃঢ়স্বরে বলল।

আল আমিরি আঙ্গুল তুলল। চাবুক মারা বন্ধ হল। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে রইল। দেখল–সালভা পাথরের মেঝেয় হাঁটু গেড়ে বসে গোঙাচ্ছে। ফ্রাসিস বলল–রামন লাল অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় সালভাদের ঘরে স্থান পেয়েছিলেন। মুমূর্ষ অবস্থায় তিনি সালভাকে একটা নকশা এঁকে দিয়েছিলেন। তারপরই বাকরোধ অবস্থায় তিনি মারা যান। ফ্রান্সিস থামল। শাঙ্কোকে বলল–জামার নিচ থেকে নক্শাটা বের করো। শাঙ্কো বাঁধা হাত ফ্রান্সিসের গলার কাছে জামার ফাঁক দিয়ে ঢুকিয়ে নকশাটা বের করে আনল। ফ্রান্সিস নকশাটা বাঁধা হাতে ধরে বলল–এই সেই নকশা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস রামন লাল এইনশার মধ্যে সালভাকে হদিশ দিয়ে গেছেন–প্রথম পাণ্ডুলিপিটা তিনি কোথায় গোপনে রেখে দেশত্যাগ করেছিলেন। কারণ সালভা তার স্নেহাস্পদ শিষ্য ছিল। আল আমিরি একজন সৈন্যকে ইঙ্গিত করল। সৈন্যটি এসে ফ্রান্সিসের হাত থেকে নকশাটা নিয়ে আল আমিরিকে দিল। আল আমিরি খুব মনোযোগ দিয়ে নকশাটা দেখতে লাগল। তারপর কিছুই বুঝতে না পেরে বলল–এই নক্‌শার তো কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। তুই কী করে বুঝলি যে এটাতে গোপন পাণ্ডুলিপির হদিশ আছে? ফ্রান্সিস বলল–

দেখুন রামন লাল বুঝেছিলেন যে তার মৃত্যু আসন্ন। তখন তার বাকরোধ হয়েছে। সালভাকে যে মুখে কিছু হদিশ বলবেন তার উপায় ছিল না। প্রায় অসাড় হয়ে আসা হাতে বেশি আঁকাও সম্ভব ছিল না। তাই খুব ছোটো টানে নক্শাটা এঁকে দিয়েছিলেন। কোথাও কোথাও টান অস্পষ্ট হয়ে গেছে। আল আমিরি নক্শাটা আবার দেখতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল–লক্ষ্য করুন নীচে একটা ছোটো চৌকোণোর মধ্যে হয়তো একটা বিন্দু বসাতে গিয়েছিলেন বা কিছু লিখতে চেয়েছিলেন। অসাড় হয়ে আসা হাতের কলমের টান বেঁকে নেমে এসেছে। আর আঁকতে পারেননি। আল মিরি ভালো করে নকশাটা দেখতে দেখতে বলল–তোর বুদ্ধি আছে দেখছি। ফ্রান্সিস বলল–আর একটা কথা। নকশাটার মধ্যে যে জায়গাটার ইঙ্গিত করা হয়েছে সেটা নিশ্চয়ই সালভার পরিচিত জায়গা। কারণ সালভাকেই তিনি হদিশটা দিয়ে গেছেন। আল আমিরি এবার একটু উঠে পাথরের আসনে ভালো করে বসল। বলল–তুই তো ভিনদেশী–পারবি এই নকশার নির্দেশ বের করতে?

–এখনই সেটা বলতে পারবো না। পালমার রাজপ্রাসাদে সালভা রামন লালের কাছে বেশ কয়েক বছর পড়াশুনো করেছে। এই পড়াশুনোর জায়গাটা রামন লাল যেখানে থাকতেন–মানে সেইসব জায়গাগুলো ভালো করে দেখতে হবে। এর জন্যে সালভাকে আমার সঙ্গে থাকতে হবে। ওর সাহায্য ছাড়া কিছুই করা যাবে না। ওকে নিয়েই আমাকে পালমার রাজপ্রাসাদে যেতে হবে। কারণ মৃত্যুকালে রামন লাল অনেক কষ্টে আলমুদাইলা মানে পালমার রাজপ্রাসাদের নাম বলেছিলেন।

–হুঁ। আল আমিরি একটু ভাবল। তারপর বলল–ঠিক আছে সালভা যাবে তোর, সঙ্গে। তোরা পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার করে গোপনে এখানে নিয়ে আসবি।

–আমি চেষ্টা করবো। ফ্রান্সিস বলল।

–কিন্তু একটা শর্ত আছে। আল আমিরি আবার পা ছড়িয়ে বসতে বসতে বলল।

ফ্রান্সিস বুঝল–আল আমিরি অত সহজে ওদের ছেড়ে দেবে না। আল আমিরি মারিয়ার দিকে ইঙ্গিত করে বলল।

–এ কে? ফ্রান্সিস বলল–আমাদের দেশের মাননীয়া রাজকুমারী।

–তা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে এখানে এসেছে কেন? আল আমিরি বলল।

–আমি ওঁর স্বামী। তাই আমার সঙ্গে এসেছেন। ফ্রান্সিস বলল।

আল আমিরি এবার একটু ভদ্র হবার চেষ্টা করল। মুখে শব্দ করল। তারপর সেঁতো হাসি হেসে বলল–তোমরা যতদিন না পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করে নিয়ে আসছো ততদিন তোমার স্ত্রী এখানে কয়েদঘরে বন্দি থাকবে। কী? রাজি?

ফ্রান্সিস এ ধরনের একটা কিছু আগে থেকেই আঁচ করেছিল।

ও বলল–বেশ, আমি আপনার শর্তে রাজি আছি।

মারিয়া চমকে উঠে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। বলল–

-কী বলছো তুমি? শাঙ্কোও বলে উঠল–ফ্রান্সিস–এরকম একটা সাংঘাতিক শর্তে তুমি রাজি হলে? তোমার কি মাথা খারাপ হল? ফ্রান্সিস কোনো কথা বলল না।

আল আমিরি বলল–তোমরা কালকে পালমা রওনা হবে।

এবার আর একটা শর্ত–তোমরা কাউকে বলতে পারবে না যে আমি এই পালমা নোভার দুর্গ অধিকার করে এখানেই আছি। যদি বলো–

–ঠিক আছে। আমরা বলবো না–ফ্রান্সিস বলল–এবার আমাদের বাঁধা হাত খুলে দিতে বলুন।

–না এখন নয়–কালকে যখন রওনা হবে তখন। আল আমিরি বলল। ফ্রান্সিস। বলল–বেশ–কিন্তু আমার একটা অনুরোধ আছে।

–বলো। আল আমিরি বলল। মারিয়াকে দেখিয়ে ফ্রান্সিস বলল–

–রাজকুমারী মারিয়া কয়েদঘরের জীবনে অভ্যস্ত নন। মারিয়াকে দুর্গের অন্দরমহলে নজরবন্দি করে রাখুন–আপত্তি নেই।

–ভেবে দেখি–আল আমিরি বলল।

–সালভার চিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন–আমার অনুরোধ–ফ্রান্সিস বলল।

–হুঁ। আল আমিরি মুখে শব্দ করল। ফ্রান্সিস বলল–এবার তাহলে নকশাটা দিন। ওটা নিয়ে তো আমাকে ভাবতে হবে। আল আমিরি নকশাটা একজন সৈন্যকে ইশারায় ডেকে দিল। ফ্রান্সিস নশাটা নিয়ে ফিরে দাঁড়াল। শাঙ্কো গিয়ে আহত সালভাকে বাঁধা হাতে কোনোরকমে উঠে দাঁড় করাল। নিজে নিচু হয়ে বসল। দু’হাত বাঁধা সালভাকে নিজের পিঠের ওপর ভর রাখতে বলল। সেইভাবে সালভাকে প্রায় পিঠে করে নিয়ে চলল।

মূর সৈন্যদের পাহারায় ওরা ঘরের বাইরে এলো। পাথুরে চত্বর দিয়ে চলল কয়েদঘরের দিকে। ফ্রান্সিস মারিয়ার থমথমে মুখের দিকে তাকাল। বুঝল–মারিয়া রাগ করেছে। হাঁটতে হাঁটতে আস্তে ডাকল–মারিয়া। মারিয়া বেশ বিরক্ত গলায় বলল–তোমার এক কোনো কথা আমি শুনতে চাই না। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল–সঠিক মুহূর্তে বুঝতে পারবে শর্তে রাজি হয়ে আমি ভুল করেছি না ঠিক করেছি। মাথা ঠাণ্ডা রাখো। এখন রাগারাগির সময় নয়। মারিয়া কিছু বলল না। হাঁটতে লাগল।

মারিয়া নিজের কয়েদঘরে ঢুকে পড়ল। ফ্রান্সিসরাও নিজেদের ঘরে ঢুকল। শাঙ্কো প্রায় পিঠে করে সালভাকে নিয়ে ঢুকল। সালভা দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। শুয়ে পড়ল। কালমা দরজা বন্ধ করে দিল। ফ্রান্সিস ঘাসের বিছানায় শুয়ে পড়ল। বাঁধা হাত মাথার নীচে রাখল। অনেক চিন্তা মাথায়।

ঠাং-ঠঠাং শব্দ তুলে দরজা খুলে গেল। একজন পাকা দাড়ি গোঁফঅলা বৃদ্ধ ঢুকল। মাথায় হলদে কাপড়ের ফেট্টি। গলায় নীলরঙের পাথরের মালা। কাঁধে একটা ছোটো কাপড়ের বোঁচকামতো ঝোলানো। কালমা বলে উঠল–বৈদ্যি। বৈদ্যি বোঁচকা নামিয়ে বসল সালভার কাছে। সালভা উঠে বসল। বৈদ্যি ওর পিঠের দিকে পোশাকটা তুলল। দেখা গেল পিঠে চাবুকের কালশিটে দাগ। কয়েকটা জায়গা বেশ কেটে গেছে। চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে। বৈদ্যি বোঁচকা থেকে একটা কাঠের ছোটো বাটি বের করে রাখল। শাঙ্কোর দিকে তাকিয়ে জল আনতে ইঙ্গিত করল। শাঙ্কো উঠে কোণা থেকে জল নিয়ে এলো। বৈদ্যি বোঁচকা থেকে একটা লাল কাপড়ের টুকরো বের করল। একটা কাঠের ছোটো লম্বা কৌটো বের করল। কৌটো থেকে কীসের গুঁড়ো নিয়ে জলে ফেলল। জলটা কালো হয়ে গেল। কাপড়ের টুকরোটা সেই জলে ভিজিয়ে সালভার ক্ষতস্থানে বুলিয়ে দিতে লাগল। সালভা প্রথমে একটু ঝাঁকিয়ে উঠল। তারপর চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ ওষুধটা লাগাল বৈদ্যি। তারপর কী বলে চলে গেল। কালমা দরজায় তালা লাগাতে লাগাতে বলল-”বৈদ্যি আবার সন্ধেবেলা আসবে।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর ফ্রান্সিস নক্শাটা নিয়ে বসল। অনেকক্ষণ ধরে দেখে দেখে বুঝল যে জায়গাটা খুব কম টানে কাগজে আঁকা হয়েছে। সেই জায়গাটা রামন লাল আর সালভা দু’জনেরই খুব পরিচিত। জায়গাটা পালমার রাজপ্রাসাদেরই কোনো জায়গা। ফ্রান্সিস ডাকল–সালভা। সালভা শোয়া অবস্থায়ই ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস বলল–সালভা তোমরা কোথায় থাকতে? পড়শুনো করে?

–আলমুদাইলা রাজপ্রাসাদের দক্ষিণকোণে। সালভা বলল।

–রামন লালও কি ওখানেই থাকতেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–হ্যাঁ–আরো কয়েকজন পণ্ডিতও থাকতেন। সালভা বলল।

তারাও কি রামন লালের মতোই পণ্ডিত ছিলেন? ফ্রান্সিস বলল।

–না-না। রামন লাল ছিলেন অলৌকিক শক্তির অধিকারী। দেশের লোক তার নাম দিয়েছিল–ডক্টর ইলিউমিনাডো।

–তাহলে তো এ দেশের খুব সম্মানিত ব্যক্তি ছিলেন তিনি। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল।

নিশ্চয়ই। সালভা বলল।

সন্ধে হ’ল। বৈদ্যি আবার এলো। ওষুধ দিয়ে গেল। ফ্রান্সিস বলল–সালভা– এখন কেমন লাগছে? সালভা দুপুর থেকেই উঠে বসে ছিল। হেসে বলল–অনেকটা ভালো।

রাত হতেই ফ্রান্সিস বেশ চঞ্চল হয়ে উঠল। ঘাসের বিছানায় পায়চারি করতে লাগল। শাঙ্কো বুঝল ফ্রান্সিস পালাবার ফন্দি আঁটছে। ফ্রান্সিস লোহার দরজার কাছে গেল। দেখল কালমা খোলা তলোয়ার হাতে বারান্দায় পাহারা দিচ্ছে। মারিয়ার ঘরের সামনেও একজন মূর পাহারাদার। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে ডাকল–

কালমা? কালমা এগিয়ে এলো।

–খেতে-টেতে দাও। ফ্রান্সিস বলল।

–এখনও সময় হয়নি। কালমা বলল।

কী মুস্কিল। ভীষণ খিদে পেয়েছে যে। ফ্রান্সিস বলল।

–হুঁ।কালমা মারিয়ার ঘরের দিকে গেল। ওখানকার মূর পাহারাদারটিকে কী বলল। চলে গেল। এবার ঐ পাহারাদারটি দুটো ঘরের সামনেই খোলা তলোয়ার হাতে পাহারা দিতে লাগল।

ফ্রান্সিস দেখল–মুস্কিল। এই মূরটাকে তো সরাতে হয়। ফ্রান্সিস দরজার কাছে মুখ নিয়ে নিজেদের দেশীয় ভাষায় চিৎকার করে বলল–মারিয়া শুনতে পাচ্ছো? মারিয়ার কানে ডাক পৌঁছল। ও চম্‌কে চেঁচিয়ে বলল–

–হ্যাঁ শুনতে পাচ্ছি। ফ্রান্সিস আবার চেঁচিয়ে বলল

–চিৎকার কান্নাকাটি জুড়ে দাও। তাড়াতাড়ি। মারিয়ার সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে উঠলো তারপরই গলা ছেড়ে কান্না জুড়ে দিল। মূর পাহারাদারটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। ও কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। ও জাতিতে মূর। ফ্রান্সিসদের কথার বিন্দুবিসর্গও বুঝল না। ও একবার ফ্রান্সিসদের ঘরের সামনে আর একবার মারিয়ার ঘরের সামনে ছুটোছুটি করতে লাগল। এবার ফ্রান্সিসদের শেখানোমতো সালভা আরবীতে বলল–শিগগির দেখো ঐ রাজকুমারীর কী হয়েছে? যদি রাজকুমারীর কিছু হয় আল আমিরি তোমার মুণ্ডু উড়িয়ে দেবে। পাহারাদারটি ছুটে গেল মারিয়ার ঘরের দিকে। এত জোরে মারিয়া জীবনেও চাঁচায়নি। ওর গলা ভেঙে গেল। তবু চাঁচাতে লাগল। কাঁদতে লাগল।

ফ্রান্সিস এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। চাপাস্বরে বলল শাঙ্কো-ছোরাটা। শাঙ্কো ছুটে এলো ফ্রান্সিসের কাছে। মাথাটা নিচু করল। ফ্রান্সিস ওর পোশাকের মধ্যে দিয়ে বাঁধা হাত দুটো গলিয়ে দিয়ে ছোরাটা বের করে আনল। শাঙ্কো ওর বাঁধা হাতদুটো এগিয়ে ধরল। ফ্রান্সিস বাঁধা হাতে দ্রুত শাঙ্কোর হাতবাঁধা দড়িতে ছোরাটা ঘষতে লাগল। তাড়াহুড়োয় ছোরার মুখটা এদিক-ওদিক সরে যেতে লাগল। ছোরার খোঁচা লেগে শাঙ্কোর হাত কেটে ছড়ে গেল। রক্ত বেরোলো। শাঙ্কো চুপ করে রইল। দড়ি বেশ কিছুটা কেটে যেতেই শাঙ্কো এক ঝটকা টানে দড়িটা ছিঁড়ে ফেলল। খোলা হাতে ফ্রান্সিসের হাতবাঁধা দড়ি কাটতে লাগল। এবার দড়ি তাড়াতাড়ি কেটে গেল। শাঙ্কো যখন সালভার হাতের দড়ি কাটছে তখন ফ্রান্সিস চেঁচিয়ে বলে উঠল–মারিয়া চুপ। মারিয়া কান্না চাঁচামেচি থামাল। ওদিকে দু’তিনজন সৈন্য ছুটে এসেছে মারিয়ার ঘরের সামনে। ওখানকার পাহারাদারটি হড়বড় করে সৈন্যদের কী বলল। ফ্রান্সিসরা লম্বা দড়ি হাতে পেঁচিয়ে চুপ করে ঘাসের বিছানায় বসে রইল। ও ঘরের পাহারাদারকে নিয়ে সৈন্য ক’জন ফ্রান্সিসদের ঘরের সামনে এলো। দেখল–কয়েদীরা শান্তভাবে বসে আছে। হাতে দড়ি বাঁধা। সৈন্য ক’জন চলে গেল। মূর পাহারাদারটি আবার খোলা তলোয়ার নিয়ে ঘুরে ঘুরে পাহারা দিতে লাগল।

কালমা ছোটো বড়ো কাঠের থালায় খাবার নিয়ে এলো। মারিয়ার ঘরের দরজা খুলে দিল। মূর পাহারাদারটি খাবার দিল মারিয়াকে। কালমা ফ্রান্সিসদের ঘরের দরজা খুলে খাবার নিয়ে ঢুকল। কালমার কোমরের খাপে তলোয়ার গোঁজা। নিচু হয়ে কালমা থালা নামাচ্ছে তখনই ফ্রান্সিস চাপাস্বরে ডাকল–শাঙ্কো। কালমা সরে উঠে দাঁড়িয়েছে। শাঙ্কো এক লাফে ছুটে গিয়ে কালমার গলায় ছোরাটা চেপে ধরল। কালমা তো অবাক। ফ্রান্সিসও লাফিয়ে উঠে কালমার তলোয়ারটা এক হ্যাঁচকা টানে খুলে নিল। তলোয়ারের ডগাটা কালমার গলায় চেপে ধরল। দাঁতচাপাস্বরে বলল–টু শব্দটি করেছো কি মরেছো। শাঙ্কো ছোরা দিয়ে কালমার বর্মের চামড়ার ফিতে কেটে দিল। খোলা ভারী বর্মটা আস্তে আস্তে ঘাসের বিছানায় নামিয়ে রাখল যাতে কোনো শব্দ না হয়। খোলা পাথরের মেঝেয় পড়লেই শব্দ হত। পাশের ঘরের মূর পাহারাদারটি কানে শব্দ পৌঁছতো।

ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–শাঙ্কো–কালমাকে সামলাও। ফ্রান্সিস তলোয়ার নামাল। শাঙ্কো কালমার বুকে ছোরা চেপে ধরল।

ফ্রান্সিস কয়েদঘর থেকে বেরিয়ে এলো। পাথরের দেয়ালে গা ঘেঁষে মারিয়ার কয়েদঘরের দিকে চলল। আসতে আসতে দেখল সামনের চত্বরে কোনো সৈন্য নেই। চত্বরের পরে কাঠের সদর দরজার কাছে মশাল জ্বলছে। তার আলোয় দেখল কয়েকজন মূর সৈন্য দাঁড়িয়ে আছে।

মারিয়ার ঘরের দরজার কাছে উঁকি দিয়ে দেখল মূর পাহারাদারটি জল ঢেলে দিচ্ছে। মারিয়া আঁজলা ভরে জল খাচ্ছে। পাহারাদারটি বেশ তাগড়াই জোয়ান। ওর সঙ্গে তলোয়ারের লড়াই চালানো যাবেনা। শব্দ হবেই। লড়াই করতে করতেমূর পাহারাদারটিও দরজার কাছে দাঁড়ালো। মূর সৈন্যদের চেঁচিয়ে ডাকতে পারে। না–অন্যভাবে ওকে ঘায়েল করতে হবে যাতে টু শব্দটিও গলা দিয়ে না বেরোয়। দেয়ালের আংটায় আটকানো দুটো মশাল জ্বলছে। মশালের আগুন হাওয়ায় কাঁপছে। পাহারাদারটি ঘর থেকে বেরোলেই ওকে দেখে ফেলবে। ফ্রান্সিস পাথরের দেয়ালে যেন সেঁটে রইল। পাহারাদারটি মারিয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিচ্ছে তখনই ফ্রান্সিস এক লাফ দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল পাহারাদারটির ওপর। আচমকা প্রচণ্ড ধাক্কায় পাহারাদারটির লোহার দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে ওর মাথার পেছনে তলোয়ারের বাঁট দিয়ে জোরে ঘা মারল। পাহারাদারটি লোহার দরজায় ঘাড় গুঁজে পড়ল। তারপর জ্ঞান হারিয়ে বারান্দায় গড়িয়ে পড়ল। আর উঠল না! ফ্রান্সিস চাপাস্বরে ডাকল–মারিয়া। মারিয়া অবাক চোখে এই কাণ্ড দেখছিল। ডাক কানে যেতেই ছুটে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। দু’জনে ছুটে এলো শাঙ্কোদের ঘরে। ফ্রান্সিস হাতের ইশারায় শাঙ্কো আর সালভাকে ডাকল। কালমার পিঠে ছোরা চেপে ধরল শাঙ্কো। বলল, চলো। ওরা ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই ফ্রান্সিস আংটায় রাখা জ্বলন্ত মশালটা তুলে ছুঁড়ে ফেলল ঘাসের বিছানায়। শুকনো ঘাসে আগুন লেগে গেল।

বারান্দা দিয়ে নিঃশব্দে চলল ওরা। ফ্রান্সিস বারান্দার একটা জ্বলন্ত মশাল ছুঁড়ে ফেলল মারিয়ার কয়েদ ঘরটায়। ও ঘরেও আগুন লেগে গেল। অজ্ঞান মূর পাহারাদারটি তখনও বারান্দায় পড়ে আছে। ওকে ডিঙিয়ে পার হ’ল সবাই। এবার ফ্রান্সিস কালমার পিঠে তলোয়ারের ডগা ঠেকিয়ে বলল কালমা-মরণজলা দিয়ে পালাবো আমরা। মরণজলায় নিয়ে চলো। কালমা চমকে উঠল। ভয়ার্তস্বরে বলে উঠল–না-না-মরণজলা পার হতে পারবে না। মারা পড়বে।

-এখানে থাকলেও মরবো। ফ্রান্সিস বলল।

–কিন্তু–কালমা কী বলতে গেল।

–কোনো কিন্তু না। –তিনজন বন্দি ঐ পথে পালিয়েছিল। ফ্রান্সিস বলল।

–পরে ওদের কেউ দেখেনি। কালমা বলল।

–পলাতকরা কি পালানোর গপপো বলে বেড়ায়। নিশ্চয়ই ওরা পালাতে পেরেছিল। তাড়াতাড়ি চলো। ফ্রান্সিস তাড়া লাগাল।

ওদিকে কয়েদঘরে ধোঁয়া আগুন ততক্ষণে ছড়িয়ে পড়েছে। মূর সৈন্যরা হৈ হৈ করে উঠল। বারান্দার পরেই বাঁ দিকে অন্ধকার ঢালু পাথুরে জমি। ফ্রান্সিসরা সেই পাথুরে জমিতে ততক্ষণে নেমে পড়েছে। অল্প চাঁদের আলোয় ওরা দ্রুত চলেছে।

বেশ কিছুটা নেমে শুরু হল এবড়ো-খেবড়ো পাথর জংলা গাছ ঘাস ঢাকা জায়গা। কালমা সবার আগে নামতে লাগল। পেছনে ফ্রান্সিসরা। ওদিকে মূর সৈন্যদের হৈ হল্লা চলছে তখন। আগুন নেভানো চলছে। ফ্রান্সিস চাপাস্বরে বলল–কালমা জলদি।

একটু পরেই সামনে বিরাট দেয়াল। কালো রঙের পাথরের। কালমা দেয়ালের নীচে একটা ছোটো কাঠের দরজার সামনে এসে হাঁপাতে লাগল। দরজায় একটা তালা ঝুলছে। এখন হাঁপাচ্ছে সকলেই। অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় কালমা চাবির গোল রিং-এ চাবি খুঁজতে লাগল। মারিয়ার দু’হাত তখনও বাঁধা। শাঙ্কো ছোরা দিয়ে তাড়াতাড়ি বাঁধা দড়ি কেটে দিল। মারিয়া মরণজলা কথাটা শুনে পর্যন্ত ভীষণ চিন্তায় পড়েছে। ও আর থাকতে না পেরে ফ্রান্সিসকে বলল–মরণজলা পার হতে পারবে?

–পারতেই হবে। নইলে এই দুর্গে পচে মরতে হবে। ফ্রান্সিস বলল। কালমার দুটো চাবি লাগল না। তার পরেরটা ঢুকিয়ে চাপ দিতেই কড়াৎ-তালা খুলে গেল। শাঙ্কো ছোটো দরজাটা খুলে দিল। প্রথমে শাঙ্কো ঢুকে গেল। তারপর সালভা মারিয়া। ফ্রান্সিস যখন ঢুকছে তখন শুনল কালমা বিড় বিড় করে বলছে–যীশু তোমায় রক্ষা করুন। ফ্রান্সিস একবার কালমার দিকে তাকিয়ে দরজা পার হল।

ছপ ছপ হাঁটুর নিচ অব্দি কাদাজলে ডুবে গেল সকলের। চারদিকে চাঁদের অনুজ্জ্বল আলো। এখানে অন্ধকার কাটেনি তাতে।

ফ্রান্সিস সামনে তাকিয়ে দেখল–লম্বা লম্বা বুনো ঘাসের জঙ্গল। আশ্চর্য!

ঘাসগুলো সবুজ নয়। মরা ঘাসের মতো হলুদ ঘাসের বনের এখানে-ওখানে ঘন কুয়াশা জমে আছে। বুনো ঘাসের জঙ্গলের উপরে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। সাদাটে কুয়াশা ঢাকা। বোঝাও যাচ্ছে না–এই বন কতদূর বিস্তৃত। ওদিকে দুর্গের মধ্যে মূর সৈন্যদের চিৎকার চাঁচামেচি কমে এসেছে। ফ্রান্সিস বলল–সালভা–মূর সৈন্যরা কি আমাদের ধাওয়া করতে পারে?

–পাগল হয়েছেন। এই মরণজলার কথা ওরা এরমধ্যেই ভালো করে জেনে গেছে। সালভা বলল।

–জলাটা কতদুর ছড়িয়ে আছে? ফ্রান্সিস বলল।

-বড়ো রাস্তা থেকে তো বহুদিন দেখে আসছি। জলাটা ডাইনে বাঁয়ে লম্বাটে। কিন্তু পাশে কম। উত্তরমুখো গেলে পার হতে কম সময় লাগবে। সালভা বলল। ফ্রান্সিস তলোয়ার হাতে ঘাসের বনের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে গলা চড়িয়ে বলল–উত্তরমুখো চলো। আমার পেছনে পেছনে এসো। সবাই ঘাসের বনে ঢুকল।

জলকাদা ভেঙে চলল। উঁচু উঁচু ঘাসের জঙ্গলে ওরা ঢাকা পড়ে গেল। শুধু মাথার ওপরে সাদাটে মেঘের আকাশ আর অনুজ্জ্বল চাঁদ। দিক ঠিক রেখে ফ্রান্সিস এগিয়ে চলল। পেছনে মারিয়া, শাঙ্কো, সালভা। কাদাজলের নীচে পাথরকুচি রয়েছে। ওরা এগিয়ে চলল। ফ্রান্সিস তলোয়ার চালিয়ে ঘাস কাটতে কাটতে এগিয়ে যেতে লাগল। তলোয়ারের কোপে হলুদ ঘাসগুলো বেশি কাটছে না। যতখানি কাটা পড়ছে তার মধ্যে দিয়েই ওরা চলল। শুধু জলকাদা ভাঙার ছপছপাৎ শব্দ। চারদিকে আর কোনো শব্দ নেই। চারপাশের ঘাসগুলো ওদের গায়ে মুখে হাতে ঘষে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস হাতে জ্বালা। অনুভব করল। চাঁদের অল্প আলোয় দেখল-ধারালো ঘাসের ঘষায় হাত আঁচড়ে গেছে। সেই জায়গাগুলোয় জ্বালা শুরু হ’ল। মারিয়া বলে উঠল–ফ্রান্সিস হাতে-মুখে ভীষণ জ্বালা করছে। শাঙ্কো সালভাও বলে উঠল–হাতমুখ জ্বালা করছে। ফ্রান্সিস অস্পষ্ট চাঁদের আলোয় দেখল–মারিয়ার সারা মুখে ঘাসের আঁচড়ের দাগ। অল্প রক্তেরও দাগ এখানে-ওখানে। হাতে-মুখে জ্বালা সহ্য করতে করতে ফ্রান্সিস বুঝল–কেন এটাকে মরণজলা বলে।

জলকাদা ঠেলে চলতে চলতে তখন ভীষণ হাঁপাচ্ছে সবাই। একদিকে পা সাবধানে ফেলতে হচ্ছে। দু’হাতে সরাতে হচ্ছে ঘাসের বাধা। তারপর প্রায় অন্ধকারে হাঁটতে হচ্ছে। তার ওপর আঁচড়কাটা হাতে-মুখে জ্বলুনি।

কতদূর এলো। আরো কতদূর যেতে হবে কিছুই বুঝতে পারছে না ওরা। মারিয়া আর সহ্য করতে পারল না। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–ফ্রান্সিস–সারা গা জ্বলে যাচ্ছে। ফ্রান্সিস হাঁটতে হাঁটতে বলল–ভাবো যে, দেশের রাজধানীর পাথরবাঁধানো পরিষ্কার পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছো, দেখবে পারছো। মারিয়া মুখ দিয়ে শ্বাস নিতে নিতে এলোমেলো পা ফেলে চলল। আর পারল না। ভীষণ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল–প্রান্সিস আমি পড়ে যাচ্ছি। ফ্রান্সিস সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে পড়ল। তলোয়ারটা কোমরে গুঁজল। দু’হাত নিচু করে একহ্যাঁচকা টানে মারিয়াকে তুলে কাঁধে শুইয়ে দিল। তারপর বাঁ হাতে মারিয়াকে চেপে ধরে হাঁটতে লাগল। আস্তে আস্তে সকলেরই সারা গায়ে জ্বলুনি শুরু হল। শাঙ্কো মুখ বুজে সহ্য করতে লাগল। একে সালভা চাবুকের মার খেয়ে আহত। বৈদ্যির ওষুধে একটু সুস্থ হয়েছিল। এখন এই পরিশ্রম সারা শরীরে জ্বলুনি। ওর মুখ থেকে গোঙানির শব্দ শোনা গেল। ফ্রান্সিস ডান হাত বাড়িয়ে সালভাকে চেপে ধরে রাখল যাতে পড়ে না যায়। সালভা এলোমেলো পা ফেলে চলল।

হঠাৎ ঘাসের জঙ্গল পাতলা হয়ে এলো। অল্পক্ষণের মধ্যেই পায়ের নীচে শক্ত পাথুরে জমি ঠেকল। সালভা অনেক কষ্টে সামনের দিকে তাকাল। ঘাসের বন শেষ। আবছা দেখল একটা ঘাসে ঢাকা টিলা। সালভা সমস্ত গায়ের শক্তি একত্র করে চিৎকার করে উঠল–ফ্রান্সিস–অমরা এসে গেছি। সামনে–টিলা।

আস্তে আস্তে হেঁটে ওরা পাথুরে জমিতে উঠল। প্রায় ভেঙে পড়া শরীর নিয়ে টলতে টলতে গিয়ে সালভা পাথুরে জমিতে শুয়ে পড়ল। শাঙ্কোও বসল। তারপর শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে কাঁধ থেকে মারিয়াকে নামিয়ে দিল। মারিয়া শুয়ে পড়ল। চোখ বোজা ফ্রান্সিস মারিয়ার এই অসাড় অবস্থা দেখে চমকে উঠল। ডাকল—মারিয়া?মারিয়া চোখ মেলে তাকাল। একটু হাসল। ফ্রান্সিস হেসে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর আস্তে আস্তে পাথুরে জমিতে বসে পড়ল। তাকিয়ে রইল মরণজলার দিকে। তারপর শুয়ে পড়ল।

পুব আকাশ লাল হয়ে উঠল। একটু পরেই সূর্য উঠল। আস্তে আস্তে রোদের তেজ বাড়তে লাগল। এতক্ষণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে শুয়ে থাকা ফ্রান্সিসরা যেন শরীরে একুট সাড় পেল। প্রথমে ফ্রান্সিসই উঠে বসল। দেখো রোদ পড়েছে টিলার গায়ে মরণজলায় দূরের দুর্গের মাথায়। হাতে মুখের জ্বালাভাবটা এখনও আছে। এ যে বাড়ে নি। ও তাকাল পায়ের দিকে। প্রায় হাঁটু পর্যন্ত জলকাদায় মাখামাখি। গায়ের পোশাকেও জলকাদার ছিটে। পায়ের কালো কাদা এখনও শুকোয় নি। শাঙ্কোদের দিকে তাকাল। ওদেরও এক অবস্থা। ফ্রান্সিস গলা চড়িয়ে ডাকল–শাঙ্কো, সালভা–ওঠো। ডাক শুনে মারিয়া উঠে বসল। এবার শাঙ্কো আর সালভা উঠল। ফ্রান্সিস নিজের ঢোলা পোশাকটার মধ্যে ঢোলা গলা দিয়ে হাত ঢোকাল। নকশাটা বের করে আনল। যাক–নকশাটা ঠিকই আছে। জলকাদা লেগে আঁকা মুছে যায়নি।

সালভা বলল–ফ্রান্সিস টিলাটার ওপাশে চাষিদের বসতি আছে। ফ্রান্সিস বলল– ওখানে বৈদ্যিটদ্যি পাওয়া যাবে। সবারই হাত মুখ ঘাসের ঘষায় যেভাবে আঁচড়ে গেছে। জ্বালা জ্বালাভাব। ওষুধ চাই।–খোঁজ নিয়ে দেখি। চলুন। সালভা উঠে দাঁড়াল।ফ্রান্সিসও উঠে দাঁড়াল। বলল–শাঙ্কো–মারিয়া চলো।

ওরা আস্তে আস্তে হেঁটে চলল টিলাটার পেছন দিকে। একটু এগিয়ে যেতেই দেখল কিছু গাছপালা। তারই পরে দেখা যাচ্ছে পাথরের কিছু বাড়িঘর।

ওরা বাড়িগুলোর কাছে আসতেই বাড়ির বাইরে স্ত্রীপুরুষ যারা ছিল তারা ওদের দেখল। জলকাদামাখা মানুষগুলো কোত্থেকে এলো? সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কে চেঁচিয়ে বলল–কারা আসছে গো? বাড়িঘর থেকে আরো মেয়েপুরুষ বেরিয়ে এলো। হঠাৎ সালভা ওদিকে ছুটতে ছুটতে ডাকল–বাবা-আ। দেখা গেল জেলেদের পোশাক পরা একজন মধ্যবয়স্ক লোক দু’হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। সালভা ছুটে গিয়ে ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরল। একটি ছোটো ছেলে আর একটি অল্পবয়সী মেয়েও ছুটে এসে সালভাদের ঘিরে দাঁড়াল। দুটি ছেলেমেয়েই খুশির হাসি হাসছে। বোঝা গেল সালভার ভাই বোন। সালভা ওর বাবার সঙ্গে কথা বলতে লাগল। ফ্রান্সিসরা এসে ওখানে দাঁড়াল। সালভা বলল–ফ্রান্সিস–আমার বাবা ভাইবোন বেঁচে আছে। মূর সৈন্যরা আমাদের বস্তীতে আগুন লাগিয়েছিল। অনেকেই পালিয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছে।

-তোমার মা? মারিয়া বলল।

কয়েক বছর আগে মাকে হারিয়েছি। সালভা বলল।

–বাবা–এখানে কোনো বৈদ্যি আছে?

হা হা। তোরা স্নানটান করে আয়–আমি বৈদ্যিবুড়োকে ডেকে আনছি। সালভার বাবা চলে গেল।

সালভার বোনটি তখনও মারিয়ার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। মারিয়ার হাতে সারা মুখে আঁচড়ের মতো দাগ। জলকাদা মাখা পোশাক। মারিয়া বেশ অস্বস্তিতে পড়ল। চলল বাড়িগুলোর পেছন দিকে। সালভা বলল-ফ্রান্সিস চলো স্নান সেরে নিই।শরীরের যা অবস্থা। সালভা চলল–ঢালু উপত্যকার দিকে। ফ্রান্সিস শাঙ্কোও চলল। ওর পেছনে পেছনে নেমে আসতেই দেখল–দুতিনটে পাথরের গা বেয়ে ছোটো ঝর্ণার জল নেমে আসছে। ঝিরঝির ঝর্ণার জল পাথর-ঘেরা একটা জায়গায় হাঁটু অব্দি জমে আছে। ফ্রান্সিস আর শাঙ্কো স্নান করতে লাগল। সালভার পিঠের চাবুকের ঘা তখনও তো সারে নি। সালভা হাঁটু পর্যন্ত ভালো করে ধুলো। মাথায় বুকে জল দিল। ঐ যা স্নান হল ওর।

স্নান সেরে ওরা ফিরে এলো। দেখল একটা ঘরের সামনে একটা পাথরের ওপর মারিয়া স্নান সেরে চাষি মেয়েদের পোশাক পরে বসে আছে। ওর সামনে দাঁড়িয়ে একজন বুড়ো। হাতের একটা পুঁটুলি খুলছে। বোঝা গেল–বৈদ্যিবুড়ো। একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ায় বৈদ্যি একটা কাঠের বাটি ভর্তি জল তুলে নিল। পুঁটুলিটা জলে নাড়তে লাগল। আস্তে আস্তে জলের রঙ হলুদ হয়ে গেল। এবার বৈদ্যিবুড়ো ঐ পুঁটুলিটা মারিয়ার আঁচড় কাটা হাতে মুখে গলায় বুলোতে লাগল। কয়েকবার বুলোতেই মারিয়া হেসে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। বলল–আঁচড়গুলোর জ্বালা অনেক কমে গেছে। মারিয়ার পর ফ্রান্সিসদেরও বদ্যিবুড়ো ওষুধ লাগিয়ে দিল। সবাইয়ের জ্বালা কমে গেল। সালভা পিঠের ঘা-এর কথা বলল। পোশাক খুলে দেখাল। বৈদ্যিবুড়ো ওষুধ তৈরি করতে বসল। ওদিকে বাড়ির মেয়েরা ফ্রান্সিসদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করতে লাগল।

সালভাকে ওষুধ দিয়ে বৈদ্যিবুড়ো ওষুধের ঝোলা গোছাতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল– সত্যি আপনার ওষুধে অনেক উপকার হল। জ্বালাভাবটা প্রায় নেই বললেই হয়। বদ্যিবুড়ো ফোকলামুখে হাসল। বলল–মরণজলার মতো লম্বা লম্বা ঘাস এখানে অনেক জায়গায় আছে। এই ঘাস শুকিয়ে ঘরের ছাউনিতে লাগে। ঘাস কাটতে গিয়ে ধারালো ধারগুলোয় লেগে হাতমুখ নখের আঁচড়ের মতো কেটে যায়। জ্বালা করে। এই ওষুধেই সেরে যায় সেসব।

তবে মরণজলার ঐ নাম হয়েছে কেন? ফ্রান্সিস জানতে চাইল। বৈদ্যিবুড়োর মুখ গম্ভীর হল। বলল –তোমরা ভিনদেশী জানো না। মরণজলার ঘাসের আঁচড় সেরে যায়। কিন্তু মরণজলার মারাত্মক জলকাদায় তুমি যদি একবার পড়ে যাও–ঐ আঁচড়কাটা জায়গা বিষিয়ে উঠে কিছুক্ষণের মধ্যেই তুমি জ্ঞান হারাবে–তারপর। বৈদ্যিবুড়ো চুপ করে গেল। তারপর আনমনে হেঁটে চলে গেল। সে কি! মারিয়া ভীত মুখে ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ভয়ার্ত স্বরে বলল–ফ্রান্সিস–আমরা–মানে–আমরা– ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসল। বলল–হ্যাঁ–আমরা বেঁচে আছি। শাঙ্কো দু’হাতে মুখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ল। কী সাংঘাতিক! মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে ওরা।

ফ্রান্সিসরা সেই রাতটা ঐ চাষিদের বস্তিতেই কাটাল। ওদের একটা ঘর চাষিরা ছেড়ে দিয়েছিল।

পরদিন সকালে ফ্রান্সিস শাঙ্কোকে বলল সালভাকে ডেকে আনতে। সালভা এলো। দেখা গেল সালভা ওর তলোয়ার কাটা চাবুকে ছেঁড়া পোশাটা পাল্টে নতুন পোশাক পরেছে। ফ্রান্সিস বলল সালভা তোমার শরীর এখন কেমন? সালভা বলল–এমনিতে ভালোই। তবে বৈদ্যিবুড়ো বলল–পিঠের ঘা এখনো সম্পূর্ণ সারে নি। আর দু’দিন ওষুধ পড়লেই সেরে যাবে।

–কিন্তু আমরা তো বেশি দেরি করতে পারবো না। তাড়াতাড়ি জাহাজে ফিরতে হবে আমাদের। বন্ধুরা চিন্তায় পড়বে নইলে। ফ্রান্সিস বলল।

–ঠিক আছে। আপনারা এখন কি করবেন? জাহাজে ফিরে যাবেন? সালভা বলল।

–না না। এখন রাজধানী পালমায় যাবো।

আলিমুদাইনা রাজপ্রাসাদে রামন লালের প্রথম পাণ্ডুলিপি খুঁজে বের করবো। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ চলুন। সালভা বলল।

–কিন্তু তুমি তো এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ নও। মারিয়া বলল।

–ওষুধ নিয়ে যাবো লাগাবো। আমি যেতে পারবো। সালভা বলল। ফ্রান্সিস বলল–এবার বলো তো রাজধানী পালমাতে আমরা কোন্ পথ দিয়ে যাবো?

–একটা তো রাস্তা, মানে বড়ো রাস্তা। পালমা নোভার ঐ দুর্গের পাশ দিয়েই রাস্তাটা এসে এখান থেকে একটু দূর দিয়ে সোজা রাজধানী পালমাতে চলে গেছে। সালভা বলল। ফ্রান্সিস একটু চুপ করে থেকে বলল

–কিন্তু আল আমিরির মূর সৈন্যরা নিশ্চয়ই রাস্তাটা পাহারা দিচ্ছে যাতে কেউ রাজধানীতে যেতে না পারে।

হ্যাঁ তা বটে। ঠিক আছে আমি যাচ্ছি গোপনে খোঁজ-খবর করে আসছি। সালভা বলল। তারপর চলে গেল।

দুপুরের আগেই সালভা ফিরে এলো। ও তখন বেশ হাঁপাচ্ছে। বলল-দুর্গের পর থেকেই অনেকদূর রাস্তার ধারে ধারে আল আমিরির মূর সৈন্যরা ঘাঁটি গেড়েছে। ফ্রান্সিস বলল–পালমার দিকে শেষ ঘাঁটিটা কোথায়?

–কিছু দূরে একটা কাঠের সাঁকোর পাশে। সালভা বলল।

–তাহলে ঐ একটা ঘাঁটি পার হতে পারলেই নিশ্চিন্ত। ফ্রান্সিস বলল। সালভা চলে গেল। মারিয়া বলল কী করে সাঁকোটা পার হবে?

–তাই ভাবছি। ফ্রান্সিস ছোটো ঘরটার মেঝেয় পায়চারি করতে করতে বলল। ফ্রান্সিস ভেবে চলেছে। হঠাৎ ও দাঁড়িয়ে পড়ল। শাঙ্কো বলে উঠল কী হল? ফ্রান্সিস বলল–সব ছক কষা হয়ে গেছে।

–শিগগির সালভাকে ডাকো। সালভাকে ডাকতে হল না? ও তখনই ডুমুরের ঝোল আর ক’টা গোল রুটি নিয়ে এলো কাঠের থালায় করে। সবাই খেতে লাগল। ফ্রান্সিস বলল

–সালভা–এখানে তো চাষবাস হয়?

–হ্যাঁ হা-বেশ কিছু ক্ষেতখামার আছে এখানে। সালভা বলল।

–কী কী বেশি চাষ হয়? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

ডুমুর বাদাম খুবানি এসব। সালভা বলল।

–ঐসব চাষিরা কোথায় বিক্রি করে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–এখান থেকে পালমা যাওয়ার রাস্তার ধারে কোস্তা বন্দর থেকেই এসব মজোরকা আর্মিনিয়া চালান যায়। সালভা বলল।

–এসব ফসলটসল কী করে কোস্তায় নিয়ে যাওয়া হয়? ফ্রান্সিস বলল।

–খচ্চরের টানা গাড়িতে করে। সালভা বলল।

–বেশ বর্ধিষ্ণু চাষি–খচ্চর টানা গাড়িটাড়ি আছে।

মালপত্র চালান দেয়–তোমার চেনা এমন কেউ আছে এখানে? ফ্রান্সিস জানতে চাইল।

–হ্যাঁ, হ্যাঁ। সালভা বলল।

–চলো–তার সঙ্গে আমি কথা বলবো। ফ্রান্সিস বলল।

খাওয়া সেরে চলল দু’জনে। একটা বাড়ির সামনে সালভা ফ্রান্সিসকে নিয়ে এলো। বাড়িটার পাশেই বেশ লম্বা একটা ঘর। সালভা বলল–এটা গুদোম ঘর, মালিক চাষি পাঁচ-ছ’টা খচ্চরকে দানাপানি খাওয়াচ্ছিল। ওদের দিকে এগিয়ে এলো। সালভা ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে বলল–আমার বন্ধু। একটা ব্যাপারে আপনার সাহায্য চাইছে। চাষিটি ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস বলল–আপনার মালভর্তি গাড়ি নিয়ে যাবো আমরা। (কোস্তার আড়তে সব পৌঁছে দেব। চাষিটি দাড়ি চুলকোতে চুলকোতে হেসে বলল–এতো ভালো কথা। মূর সৈন্যদের জ্বালায় কোনো মালই পাঠাতে পারছি না গুদোমে সব ভঁই হয়ে জমে আছে।

–ঠিক আছে। আমরা খেয়েদেয়ে আসছি। আপনি চারটে বস্তায় মাল ভরিয়ে রাখুন। ফ্রান্সিস বলল।

–বেশ তো। আমার লোকই গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে। চাষিটি খুশি হয়ে বলল। ফ্রান্সিস বলল–কে চালিয়ে নিয়ে যাবে সেটা পরে ঠিক করছি।

ফেরার সময় ফ্রান্সিস বলল–সালভা তোমার বাবাকে নিয়ে এসো। একটু কাজ আছে।

— খাওয়া-দাওয়ার পর ফ্রান্সিসরা তৈরি হয়ে গুদোম ঘরের দিকে চলল। ফ্রান্সিস দেখল মারিয়া সেই চাষি মেয়েদের ঢোলা পোশাকটাই পরে আছে। বললকী ব্যাপার? তোমার গাউনটা কী হল?

–ওটা সালভার বোনকে দিয়ে দিয়েছি। মারিয়া হেসে বলল। ফ্রান্সিস অর কিছু বলল না।

ফ্রান্সিস গুদোম ঘরে ঢুকে দেখল–চারটে ডুমুর বাদাম খুবানি ভর্তি বড়ো বস্তা রাখা হয়েছে। সালভার বাবাই এসব বস্তায় নোক এনে ভরিয়েছে। ফ্রান্সিস ঐ লোকগুলোকে চলে যেতে বলল। লোকগুলো চলে গেল। এবার ফ্রান্সস সালভার বাবাকে বলল দেখুন–আমরা চারজন চারটে বস্তার মধ্যে লুকোব। আমরা বস্তায় ঢোকার পর আপনি ডুমুর বাদাম এসব ঢেলে বস্তার মুখটা বেঁধে দেবেন। সালভার বাবা তো অবাক। ফ্রান্সিস বুঝিয়ে বলল–মুর সৈন্যদের শেষ ঘাঁটিটা আমাদের এভাবেই পার হতে হবে। ওরা বুঝতেই পারবে না। সালভার বাবা মাথা ঝাঁকাল। তারপর কাজে হাত লাগাল। প্রথমে একটা বস্তা থেকে ডুমুর বাদাম বের করল। ফ্রান্সিসের নির্দেশে মারিয়া বস্তাটায় বসে পড়ল। ফ্রান্সিস এগিয়ে এলো। বলল–চোখ বন্ধ করো। মারিয়া মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করল। ফ্রান্সিস এবার ডুমুর বাদাম এসব ঢালল। বস্তা ভরে গেল।

একইভাবে শাঙ্কো আর সালভাও বস্তাবন্দি হল। এবার ফ্রান্সিস সালভার বাবাকে বলল–একটি অল্প বয়েসের ছেলেকে ডেকে আনুন যে খচ্চরের গাড়ি ভালো চালাতে পারে। কিন্তু সাবধান ছেলেটিকে আমাদের কথা বলবেন না। বলবেন এইসব মাল তোকে কোস্তের আড়তে পৌঁছে দিতে হবে। ছেলেটা এলে কাজের লোকগুলো ডেকে গাড়িটার একপাশে প্রথমে আমাকে তার ওপরে মারিয়াকে রাখবেন। সালভার পিঠের ঘা এখনও সম্পূর্ণ সারেনি। আর একপাশেশাঙ্কোর ওপর সালভাকে রাখবেন। বুঝেছেন সমস্ত ব্যাপারটা? সালভার বাবা মাথা নেড়ে হাসল। এবার ফ্রান্সিস বস্তায় ঢুকল। সালভার বাবা ওকে বস্তাবন্দি করল।

ফ্রান্সিসের নির্দেশমতো সালভার বাবা কাজের লোকদের ডেকে ওদের গাড়িতে তুলে সাজিয়ে রাখল। একটা অল্পবয়সী ছেলেকেও জোগাড় করা হল। ছেলেটির হাতে কাঠের ছোটো লাঠির মাথায় চামড়া বাঁধা চাবুক দেওয়া হল। ছেলেটি খুব খুশি। গাড়িতে উঠেই চাবুক হাঁকাল খচ্চর দুটোর পিঠে। একটা ঝাঁকুনি খেয়ে গাড়ি চলল। কাঁচ ক্যাচ শব্দ তুলে ঝাঁকুনি খেতে খেতে গাড়ি চলল। এবড়ো-খেড়ো রাস্তা দিয়ে গাড়ি এসে উঠল সদর রাস্তায়। এবার গাড়ির ঝাঁকুনি অনেকটা কমল। শাঙ্কোর নাকে ডুমুরের বোঁটার খোঁচা লাগল। হেঁচে ফেলতে গিয়ে শাঙ্কো ডুমুরগুলোর মধ্যেই নাক চেপে ধরল। হাঁচি আটকে গেল। শাঙ্কো নিশ্চিন্ত হল। গাড়ি চলল ঢিকির ঢিকির। ছেলেটির ছলাৎ ছপাৎ চাবুক চালাবার শব্দ শোনা যেতে লাগল। হঠাৎ ছেলেটি সরু গলায় জোরে গান গাইতে লাগল। গাড়িও চলেছে গানও চলেছে। মাঝে মাঝে পাথরের টুকরোয় চাকা লেগে গাড়িটা লাফিয়ে উঠছে। জোর ঝাঁকুনি ফ্রান্সিসরা মুখ বুজে সহ্য করছে।

হঠাৎ ছেলেটির গান বন্ধ হয়ে গেল। গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল। বোঝা গেল সাঁকোর কাছে গাড়ি এসেছে। একজন পাহারাদার মূর সৈন্যের চড়া গলা শোনা গেল। কী যেন বলল। ছেলেটিও ভাঙা ভাঙা আরবী ভাষায় কী বলল। কোস্তা’ কথাটা ফ্রান্সিস বুঝল। ছেলেটি কোস্তার আড়তে যাবার কথা বলছে। আরো কিছু কথা হল। ফ্রান্সিসের পরিকল্পনার হিসেব মিলে গেল। একে বিকেলবেলা তার ওপরে মালগাড়িটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছে একটা অল্পবয়সী চাষি ছেলে। সৈন্যদের মনে সন্দেহ হল না। গাড়ি চলতে শুরু করল। তখনই হঠাৎ একটি সৈন্য বস্তার তলোয়ারের খোঁচা দিল। মারিয়ার হাতের ফাঁক দিয়ে তলোয়ারের ডগাটা লাগল ফ্রান্সিসের পিঠে। ফ্রান্সিস একচুল নড়ল না। বস্তার গায়ে রক্ত ফুটে ওঠার আগেই গাড়ি কিছুটা চলে গেল। গাড়ি চলল।

ছেলেটার মুখের হাঃ হাঃ শব্দ আর হাতের চাবুকের শব্দ শুনতে শুনতে ফ্রান্সিসরা এগিয়ে চলল।

বেশ কিছুটা সময় গেল। ফ্রান্সিস বস্তার মধ্যে থেকে চাপা গলায় ডাকল–মারিয়া। মারিয়া মৃদু শব্দ করল–উ? ফ্রান্সিস তেমনি চাপা গলায় বলল–মনে হচ্ছে না যেন বাড়ির নরম পালকের বিছানায় শুয়ে আছি। মারিয়া একটু জোরেই বলে ফেলল– তোমার মুণ্ডু। ছেলেটির কানে আস্তে হলেও কথাটা পৌঁছল। ছেলেটি চম্‌কে পেছনের বস্তাগুলোর দিকে তাকাল। ঠিক বুঝল না। তবু ও ভুল শুনল কিনা বুঝতে চেঁচিয়ে বলল–কে কথা বলল? এ্যা? শাঙ্কো আর নিজেকে সামলাতে পারল না। বলে উঠল– ভূত। আর কোথায় যাবে। ছেলেটি চাবুক ছুঁড়ে ফেলে একলাফে গাড়ি থেকে নেমেই রাস্তার পাশের ডুমুর ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে ছুট লাগাল। শাঙ্কো ছোরা দিয়ে বস্তা কিছুটা কেটে ফেলে মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে ডাকল–এই ছোঁড়া–ভয় নেই। চলে আয়। কে কার কথা শোনে। ছেলেটি ততক্ষণে ডুমুর ক্ষেত পার হয়ে ছুটে চলেছে।

শাঙ্কো ছোরা দিয়ে বস্তার অনেকটা কেটে বেরিয়ে এলো। মারিয়া ফ্রান্সিস আর সালভার বস্তার মুখ বাঁধা দাড়ি কেটে দিল। সবাই বস্তা থেকে বেরিয়ে হাঁফাতে লাগল। বস্তার মধ্যে এতক্ষণ আধশোয়া হয়ে থাকা। দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। ততক্ষণে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছে। সালভা রাস্তা থেকে চাবুকটা তুলে নিয়ে চালকের জায়গায় বসল। গাড়ি চালাতে লাগল সালভা।

ফ্রান্সিস ঘুরে বসতেই মারিয়া দেখল ফ্রান্সিসের পিঠের দিকে জামাটায় রক্তের দাগ। মারিয়া বলল–তোমার পিঠটা তলোয়ারে কেটে গেছে। ফ্রান্সিস হাসলও কিছু না। এখন অনেক ভাবনা–এসব ভাবার সময় নেই।

সন্ধের পরে কোস্তার কাছাকাছি এসে সালভা বলল–ফ্রান্সিস কোস্তা এসে গেছি। কী করবে এখন? ফ্রান্সিস বলল–ঐ চাষির মালগুলো যা আছে তোমার কোনো পরিচিত আড়তদারের কাছে রাখো। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে এই গাড়িতে চড়েই পালমার দিকে যাত্রা শুরু করবো।

রাতটা বিশ্রাম নেবে না? সালভা বলল।

উঁহু-হাতে সময় কৈ। ফ্রান্সিস বলল।

সালভা গাড়ি থেকে নেমে গেল। কোস্তা বন্দর এলাকাটা বেশ জমজমাট। তিন চারটে জাহাজ জাহাজঘাটায় রয়েছে। একপাশে বেশ কয়েকটা গুদোমঘরের মতো। খচ্চরে টানা গাড়ি আসছে যাচ্ছে দাঁড়িয়ে আছে। মালপত্র গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে। লোকজনের ব্যস্ততা।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সালভা ফিরে এলো। বলল–ঠিক আড়তদারকেই পেয়েছি। লোক পাঠাচ্ছে। মাল তুলে নেবে। আড়তদারের লোকজন এলো। সব মাল নিয়ে গেল আড়তে।

রাত বাড়ছে। ফ্রান্সিস বলল–খেতে চলো সব। গাড়ি থেকে নামল সবাই। এদিক ওদিক খুঁজে ফ্রান্সিস একটা ছোটো সরাইখানা বের করল। একটা বড়ো সরাইখানা ছিল। বেশ ভিড়। ফ্রান্সিস ঐ ভিড়ের সরাইখানায় গেল না।

গরম গরম গোল রুটি মুরগির মাংস পাওয়া গেল। বেশ সুস্বাদু রান্না। ফ্রান্সিসরা সবাই পেট ভরে খেল।

গাড়িতে ফিরে এলো সবাই। সালভা বলল–ফ্রান্সিস সারারাত তো গাড়ি চালাতে হবে।

–হ্যাঁ। শাঙ্কো আর আমিও চালাবো। ফ্রান্সিস বলল।

-তাহলে তো খচ্চর দুটোকে দানাপানি খাওয়াতে হয়। সালভা বলল। তারপর গাড়ি থেকে খচ্চর দুটোকে নিয়ে চলল যেখানে লোকেরা ঘোড়া খচ্চরগুলোকে দানাপানি খাওয়াচ্ছে।

ফ্রান্সিস মারিয়া আর শাঙ্কো গাড়িতে উঠল। ওরা সালভার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

সালভা কিছুক্ষণের মধ্যে ফিরে এলো খচ্চর দুটোকে নিয়ে। গাড়িতে জুড়ে দিল। তারপর চালকের জায়গায় বসল। রাত বেড়েছে। সারা কোস্তা বন্দরে এখন আর লোকজনের সাড়াশব্দ নেই।

সালভা গাড়ি চালাতে শুরু করল। গাড়ি চলল পালমার উদ্দেশ্যে। টানা রাস্তা চলেছে। জ্যোত্সা অনেকটা উজ্জ্বল। দু’পাশে কোথাও ক্ষেতখামার কোথাও ছোটো ছোটো পাথুরে টিলা। মারিয়া কিছুক্ষণ জেগে রইল। তারপর আর পারল না। গাড়ির দুলুনিতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলো। ও গাড়ির মধ্যে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস চোখ ঝুঁজে বসেছিল। একবার চোখ খুলে ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকাল। একটু এগিয়ে এসে মারিয়ার মাথাটা নিজের ডানপায়ের উরুর ওপর তুলে নিল। মারিয়া নিশ্চিন্তে ঘুমুতে লাগল। শাঙ্কো জেগেই ছিল। এবার উঠে দাঁড়াল। বলল–সালভা–তুমি একটু বিশ্রাম করে নাও। আমি চালাচ্ছি। সালভা সরে এলো। শাঙ্কো গাড়ি চালাতে লাগল। রাত শেষ হয়ে আসছে। তখন ফ্রান্সিস গাড়ি চালাচ্ছে।

পুব আকাশ লাল হয়ে উঠল। সেই লাল দিগন্তের আকাশের নীচে কিছু কালো কালো বাড়িঘরের মাথা দেখা গেল। ফ্রান্সিস বুঝল ওটাই রাজধানী পালমার বাড়িঘর। ও ঘুমন্ত সালভাকে আর ডাকল না।

পালমা নগরে ওদের গাড়ি যখন ঢুকল তখন চারদিকে উজ্জ্বল রোদের ছড়াছড়ি। মারিয়ার ঘুম ভাঙল তখন। ও দু’পাশের বাড়িঘর দেখতে লাগল। সালভা আর শাঙ্কোও ঘুম ভেঙে উঠল। ফ্রান্সিসকে সালভা বলল–আপনি সরে আসুন আমি চালাচ্ছি।

সালভা গাড়ি চালাতে চালাতে বলল–এখন কী করবেন? কোনো সরাইখানায় খেয়েটেয়ে একটু বিশ্রাম করে রাজপ্রাসাদে যাবেন? ফ্রান্সিস মারিয়ার দিকে তাকাল। বলল–তোমার কি একটু বিশ্রাম চাই? মারিয়া মাথা নেড়ে বলল-না। ঘুমিয়ে আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ।

–তাহলে আলমুদাইনা রাজপ্রাসাদেই চলো। ফ্রান্সিস বলল। তখনই ফ্রান্সিস লক্ষ্য করল মারিয়া সেই চাষি মেয়েদের ঢোলা পোশাকটাই পরে আছে। এখন তো রাজপ্রাসাদে যেতে হবে। রাজার সঙ্গে দেখা করতে হবে। মারিয়া ওদের দেশের রাজকুমারী। তার এই পোশাকে যাওয়া ভালো দেখাবে না। ফ্রান্সিস বলল–সালভা তুমি তো এখানে ছিলে। মহিলাদের ভালো পোশাক কোথায় পাওয়া যায় নিশ্চয়ই জানো।

-হা হা। যাবেন? সালভা গাড়ি থামিয়ে বলল। মারিয়া বুঝল ফ্রান্সিস কী চাইছে। মারিয়া বলল–আমার অন্য পোশাকের কোনো প্রয়োজন নেই।

–কিন্তু এ দেশের রাজার সামনে এই পোশাকে–ফ্রান্সিস মৃদু আপত্তি করল। মারিয়া বলল–এটা তা এই দেশের চাষি মেয়েদেরই পোশাক। ফ্রান্সিস আর কোনো কথা বলল না। সালভা গাড়ি চালাল।

পালমা নগরীতে তখন লোকজনের ব্যস্ততা শুরু হয়েছে। একটু পরে ফ্রান্সিসদের গাড়ি বিরাট রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারে এসে দাঁড়াল।

সালভা গাড়ি থেকে নামল। চারজন দ্বাররক্ষী লোহার দরজার দু’পাশে ঝকঝকে পেতলের কারুকাজ করা বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে আছে।,

সালভা দ্বাররক্ষীদের সঙ্গে কী কথাবার্তা বলে ফিরে এলো। বলল–মুস্কিল হয়েছে। বছর কয়েক আগে এখান থেকে চলে গেছি। এরা সব নতুন দ্বাররক্ষী। আমাকে চেনে না। ফ্রান্সিস বলল–রাজার দেখা পাওয়া সহজে হবে না। বলল–তাহলে চলো– কোনো সরাইখানায় যাই। অপেক্ষা করি। তুমিও সাক্ষাতের ব্যাপারে চেষ্টা চালিয়ে যাও।

ওরা কথা বলছে তখনই দ্বারক্ষীরা হঠাৎ বেশ তৎপর হ’ল। লোহার দরজার টানা টানা গারদের মাথাখোলা কালো রঙের গাড়ি ভেতর থেকে আসছে। একটু পরেই গাড়িটা দরজার কাছাকাছি আসতেই দ্বাররক্ষীরা দু’জন দু’দিক থেকে দরজা খুলে ধরল। গাড়ির কালো গায়ে রুপোর কাপড়ের জোব্বামতো পরা এক বৃদ্ধ। সালভা বলে উঠল–আরে মন্ত্রীমশাই। সালভা ছুটে গাড়িটার কাছে গেল। মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলে উঠল– মাননীয় মন্ত্রী মহাশয়–আমার কিছু খুব প্রয়োজনীয় কথা বলার আছে। মন্ত্রীমশাই বোধহয় সালভাকে চিনলেন। আস্তে কী বললেন। গাড়ি থামল। সালভা মন্ত্রীমশাইর খুব কাছে গেল। মন্ত্রীমশাই পাকা দাড়ি গোঁফের ফাঁকে হাসলেন। বললেন–কী ব্যাপার সালভা? পড়া ছেড়ে চলে গিয়েছিলে কেন? সালভা হেসে মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল– সব বলবো আপনাকে। তার আগে দু’টো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংবাদ আপনাকে জানাচ্ছি। মহান পুরুষ রামন লাল আমাদের কুটীরে কয়েকদিন আগে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মন্ত্রীমশাই চমকে আসনে উঠে বসলেন। বলে উঠলেন–এ কী বলছো সালভা। এতো– সাংঘাতিক খবর।

—-আর একটা খবর –। মন্ত্রীমশাই সালভাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন–সব শুনবো। তুমি গাড়িতে ওঠো। এক্ষুণি মাননীয় রাজাকে খবরটা দিতে হবে। সালভা ফ্রান্সিসদের দেখিয়ে বলল–কিন্তু আমার এই বন্ধুদের সঙ্গে আমি যেতে চাই। মন্ত্রীমশাই ফ্রান্সিসদের একবার দেখলেন। বললেন–ঠিক আছে তুমি ওদের নিয়েই এসো। এই বলে উনি গাড়িচালকের দিকে তাকিয়ে বললেন–প্রাসাদে ফিরে চলো। মন্ত্রীমশাইর গাড়ি ঘুরল। সালভা হাতছানি দিয়ে ফ্রান্সিসদের ডাকল। ফ্রান্সিসরা গাড়ি থেকে নেমে এলো। তারপর মন্ত্রীমশাইর গাড়ির পেছনে পেছনে ওরা সদর দেউড়ি পার হয়ে রাজপ্রাসাদের দিকে হেঁটে চলল। দ্বাররক্ষীরা আর বাধা দিল না।

চারদিকে পাথরের দেয়ালঘেরা বিরাট জায়গা নিয়ে রাজপ্রাসাদ। এখানে ওখানে চৌকোণো তিনকোণা ফুলের বাগান। রোদে ঝলমল করছে ফোঁটা ফুল। বাগানের মাঝখানে ফোয়ারার পর ফোয়ারা। পাথরে বাঁধানো ঝকঝকে রাস্তা চলে গেছে প্রধান দ্বারের দিকে। চারপাশের বাগান সবুজ মখমলের মতো ঘাসে ঢাকা। ছোটো ছোটো মাঠ দেখতে দেখতে ওরা এগিয়ে চলল সেইদিকে। প্রধান দ্বারের সামনেই মন্ত্রীমশাই গাড়ি থেকে নামলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন ফ্রান্সিস সালভাদের জন্য।

ওরা এলো। মন্ত্রীমশাই ওদের নিয়ে প্রাসাদের ভেতরে ঢুকলেন। পাথরের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠলেন। দ্রাররক্ষীরা সবাই পেতলের বর্শা হাতে দাঁড়িয়ে। ওরা মন্ত্রীমশাইকে মাথা নুইয়ে সম্মান জানাতে লাগল। ডানহাতি একটা ঘরে মন্ত্রীমশাই ঢুকলেন। পেছনে ফ্রান্সিসরা।

ঘরের মাঝখানে বেশ বড়ো চকে কালো পাথরের একটা গোল টেবিল। টেবিলের চারপাশে গদীঅলা ওককাঠের বাঁকা পায়ার কারুকাজ করা চেয়ার পাতা। বোঝা গেল– এটা রাজার মন্ত্রণাকক্ষ। মন্ত্রীমশাই হাত বাড়িয়ে সবাইকে বসতে ইঙ্গিত করলেন। আস্তে বললেন–সংবাদ পাঠানো হয়েছে। মাননীয় রাজা এক্ষুণি আসবেন। ফ্রান্সিসরা চেয়ারে বসল। মন্ত্রীমশাইও একটা চেয়ারে বসলেন। তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি খুবই চিন্তান্বিত। সবাই চুপ করে বসে রইল।

একটু দ্রুতপায়েই রাজা তৃতীয় জেমস্ মন্ত্রণাকক্ষে ঢুকলেন। রাজা মধ্যবয়স্ক। মুখে ছাটা দাড়ি গোঁফ। পরনে সাধারণ পোশাক। হলুদ রঙের জোম্বামতো গায়ে। বুকের কাছে সোনার সুতোয় কাজ করা জলপাই পাতার মতো নকশা। সবাই দাঁড়িয়ে উঠে মাথা নুইয়ে রাজাকে সম্মান জানাল। রাজা সবাইকে হাতের ইঙ্গিতে বসতে বলে নিজে বড়ো চেয়ারটায় বসলেন। সবাই বসল। মন্ত্রীমশাই সালভার দিকে তাকিয়ে বললেন– তোমার সংবাদ জানাও। সালভা তখন রমন লালের নৌকোয় চড়ে আসা অসুস্থতা ও মৃত্যুর সংবাদ জানল। রাজা বলে উঠলেন–সেই শ্রদ্ধেয় পুরুষের পবিত্র দেহ এখন কোথায়? সালভা তখন আল আমিরি কর্তৃক দুর্গ দখল–সেই সংবাদ গোপন রাখার ব্যবস্থা–রমান লালের মৃতদেহ আনার সময় ধরা পড়া–এ সব কথা বলল। সবশেষে বলল–গুরুদেবের পবিত্র দেহ আল আমিরি কী করেছে আমি জানি না। সবাইচুপ করে রইল। এবার ফ্রান্সিস একটু মাথা নুইয়ে নিয়ে বলল–মাননীয় রাজা–আপনি অনুমতি দিলে আমি দু’একটা কথা বলবো। রাজা একবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকালেন। তারপর তাকালেন সালভার দিকে। সালভা বলল–মাননীয় রাজা–এর নাম ফ্রান্সিস। সঙ্গে তার স্ত্রী মারিয়া। বন্ধু শাঙ্কো। এঁরা জাতিতে ভাইকিং। রাজা একটু চুপ করে থেকে বললেন–ভাইকিংদের সাহস আর জাহাজ চালনায় দক্ষতার কথা আমরা শুনেছি। ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে বললেন–বলো। ফ্রান্সিস বলল–মহান রামন লালের পোশাকের পকেটে ছিল তার দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপি। সেটা এখন আল আমিরির কাছে আছে। এই পাণ্ডুলিপি সালভা পড়েছে। এটার শেষ পাতায় রামন লাল লিখেছেন প্রথম পাণ্ডুলিপিতে তিনি অ্যালকেমির যে সূত্রগুলো লিখেছেন সেগুলো নির্ভুল। তাঁর বাসনা ছিল ফিরে এসে তিনি এই সূত্রগুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবেন। কিন্তু তিনি তা করলেন না। ফ্রান্সিস থামল। রাজা বললেন হা–প্রথম পাণ্ডুলিপিটা কোথায় আছে। তা আমরা খুঁজে বের করবার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

মৃত্যুর পূর্বে মহান রামন লালের বাক্‌রোধ হয়ে গিয়েছিল। তাই একটা কাগজে তিনি একটা নকশা এঁকে সালভাকে দিয়ে গিয়েছিলেন। ফ্রান্সিস বলল। তারপরে ওর পোশাকের ভিতর থেকে নক্শাটা বের করে রাজার দিকে এগিয়ে ধরল। রাজা বেশ আগ্রহের সঙ্গেনশাটা নিলেন। মনোযোগ দিয়ে দেখতে দেখতে বললেন কিন্তু নকশার নির্দেশটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ফ্রান্সিস বলল–আপনি যদি আমাকে অনুমতি দেন। তাহলে আমি চেষ্টা করতে পারি এই নকশার নির্দেশ বের করতে। ফ্রান্সিসের মুখের দিকে তাকালেন। বললেন–তুমি পারবে?

–যথাসাধ্য চেষ্টা করবো এই পর্যন্ত বলতে পারি। ফ্রান্সিস বলল। রাজা নকশাটা ফিরিয়ে দিলেন। বললেন–

–বেশ। আমি তোমাকে অনুমতি দিলাম।

–তাহলে সালভাকে নিয়ে আমি চেষ্টা করবো। সালভাকে এই ক্ষমতা দিন যাতে সে এই রাজপ্রাসাদের সর্বত্র স্বাধীনভাবে আমাদের নিয়ে চলাফেরা করতে পারে– ফ্রান্সিস বলল। রাজা মন্ত্রীমশাইয়ের দিকে তাকালেন। বললেন–আপনি কী বলেন?

–এ ব্যাপারে খোঁজ-খবর করবার জন্যে এই স্বাধীনতাটুকু তো ওদের দিতেই হবে। মন্ত্রীমশাই বললেন।

–ঠিক আছে। সেই অনুমতি দেওয়া হবে। রাজা বললেন। তারপর দ্বাররক্ষীর এ দিকে তাকিয়ে বললেন–সেনাপতিকে এক্ষুণি আসতে বলো। দ্বাররক্ষী মাথা নুইয়ে কার সম্মান জানিয়ে দ্রুত চলে গেল।

একটু পরেই সেনাপতি বেশ দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকলেন। সেনাপতি দীর্ঘকায়। বলিষ্ঠ গড়ন। সাধারণ জোব্বামতো পোশাক গায়ে। কোমরের চামড়ার চওড়া কোমরবন্ধ। তা’তে কোষবদ্ধ তলোয়ার ঝুলছে। সেনাপতি মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল। রাজা বললেন–আপনি বোধহয় খবর রাখেন না যে মূরনেতা আল আমিরি পালমা নোভার দুর্গ দখল করে আছে। সেনাপতি বেশ চমকে উঠল। অবাক চোখে একবার রাজা আর একবার মন্ত্রীমশাই-এর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। রাজা বললেন–বসুন। সেনাপতি তাড়াতাড়ি বসে পড়লেন একটা চেয়ারে। রাজা বললেন

–একটি বড়োই শোক সংবাদ পেলাম–মহান পণ্ডিত রামন লাল দেহরক্ষা করেছেন। সেনাপতি উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। রাজা আঙ্গুলের ইঙ্গিতে তাকে বসতে বললেন। সেনাপতি আস্তে আস্তে চেয়ারে বসলেন। রাজা বললেন– শুনুন–সৈন্যবাহিনী নিয়ে আপনি এক্ষুণি পালমা নোভা যাত্রা করুন। দুটি কাজ আপনাকে করতে হবে। আল আমিরিকে বন্দি করে মহামতি রামন লালের দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিটা উদ্ধার করবেন। পাণ্ডুলিপিটা ওর কাছেই আছে। যাবার সময় একটি মূল্যবান কফিন নিয়ে যাবেন। রামন লালের পবিত্র দেহ আল আমিরি কোথায় কবরস্থ করেছে সেটা জানবেন। সেই পবিত্র দেহ কফিনে করে যথাযোগ্য মর্যাদায় এখানে নিয়ে আসবেন। এই প্রাসাদ সংলগ্ন সমাধিভূমিতে মহান রামন লালের পবিত্র দেহ রাজকীয় প্রথায় সমাধিস্থ করা হবে।

মাননীয় রাজা–আপনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হবে। সেনাপতি বললেন।

–এইসব কাজ আপনাকে করতে হবে কাল সূর্যোদয়ের পূর্বেই। রাজা বললেন। সেনাপতি মাথা নুইয়ে বললেন

–যথা আজ্ঞা মাননীয় রাজা। চেয়ার ছেড়ে উঠলেন সেনাপতি। তারপর মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে দ্রুতপায়ে চলে গেলেন। রাজাও উঠলেন। মন্ত্রীমশাইয়ের সঙ্গে ফ্রান্সিসরা প্রাসাদের বাইরে এলো। মন্ত্রীমশাই গাড়িতে উঠে চলে গেলেন।

রাজপ্রাসাদ পাথরের দেয়ালে ঘেরা। দেয়ালের ওপাশেই বিস্তৃত প্রান্তর। সেনাপতি বেলোর পাথরের বাড়ি প্রান্তরের একপাশে। অন্যদিকে যোদ্ধাদের ছাউনি। ছাউনি বেশ লম্বা টানা ঘর। ছোটো ছোটো ঘর পরপর চলে গেছে। যোদ্ধাদের আবাসস্থল।

সেনাপতি বেলা রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। প্রান্তরে এলেন। চললেন যোদ্ধাদের আবাসস্থলের দিকে। সেনাপতি বেলোকে যোদ্ধাদের ছাউনির দিকে যেতে দেখে পাহারাদার কিছু যোদ্ধা এগিয়ে এলো। মাথা নিচু করে সেনাপতিকে অভিবাদন জানাল। সেনাপতি তাদের বললেন–যাও–সব যোদ্ধাদের বলো এক্ষুণি জড়ো হতে। আমি সব যোদ্ধাদের কিছু বলবো।

যোদ্ধা ক’জন ছুটে গেল যোদ্ধাদের আবাসস্থলের দিকে। কিছুক্ষণ যোদ্ধাদের মধ্যে সেনাপতির আদেশ জানানো হল। সব যোদ্ধা প্রান্তরে এসে আস্তে আস্তে সার দিয়ে দাঁড়াল। যোদ্ধাদের সামনেই একটি পাথরের বেদী। বেদীর রং কালো। রাজা বা সেনাপতি যোদ্ধাদের কোনো আদেশ দেবার সময় এই বেদীতে উঠে আদেশ দেন।

সেনাপতি বেদীতে উঠে দাঁড়ালেন। চারদিক নিস্তব্ধ। যোদ্ধাদের সমাবেশের দিকে তাকিয়ে সেনাপতি বলতে লাগলেন–আমার বীর যোদ্ধারা–দুটো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সংবাদ জানাচ্ছি। প্রথম সংবাদ হল–মহামতি রামন লাল কয়েকদিন আগে দেহত্যাগ করেছেন! সেনাপতি কথাটা বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। সৈন্যদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হল। অনেকেই মুখে হায় হায়’ করে উঠল। গভীর শোকে অনেক সৈন্য কেঁদে ফেলল। সেনাপতি কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে রইলেন। তারপর মাথা তুললেন। সেনাপতি হাত তুলে পোশাকের হাতাটা চোখে ঘষে চোখের জল মুছলেন। তারপর বললেন–দ্বিতীয় সংবাদ হল–কিছুদিন আগে এক আরবীয় দলনেতা আমাদের পালমা নোভার দুর্গ দখল করেছে। এই সংবাদটা যাতে রটে না যায় যাতে কেউ রাজধানী পালমায় এসে খবরটা বলতে না পারে তার জন্যে বড়ো রাস্তাটায় পাহারা বসিয়েছে। সে। তাই এই দুটো সংবাদ এতদিন আমরা জানতে পারিনি। সেনাপতি থামলেন। তারপর বললেন-”রাজার হুকুম-কালকের মধ্যে পালমা মুর্গ অধিকার করতে হবে। তারপর আরবীয় দলনেতাকে বন্দি করে নিয়ে আসতে হবে। আর একটি কাজ–মহান চিন্তানায়ক রামন লালের নশ্বর দেহ এনে রাজপরিবারের কবরখানায় যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে সমাহিত করা হবে। সেনাপতি থামলেন। তারপর বললেন–জানি, রামন লালের মৃত্যুতে আমরা শোকস্তব্ধ। কিন্তু কর্তব্য তো করতেই হবে। কাজেই সবাই তৈরি হও। আমরা সন্ধেবেলা পালমা নোভার দিকে যাত্রা করবো। যেভাবেই হোক পালমা নোভা দুর্গ অধিকার করতে হবে। সেনাপতি থামলেন। তারপর পাথরের বেদী থেকে নেমে এলেন। রাজার আদেশ জানা হল। যোদ্ধাদের সমাবেশ ভেঙে গেল। যোদ্ধারা কথা বলতে বলতে তাদের আবাসস্থলের দিকে চলল। সেনাপতি বেলোও তার বাড়ির দিকে চললেন।

তখন সন্ধে হয় হয়। বিস্তৃত প্রান্তরে পদাতিক বাহিনী সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে ঘোড়সওয়ার বাহিনী। তারপর একটা তিরন্দাজ বাহিনী। ধন্ধবে সাদা ঘোড়ায় চড়ে সেনাপতি এলেন। তিরন্দাজ বাহিনী সকলের সামনে সেনাপতি এলেন। তলোয়ার কোষমুক্ত করলেন। সামনের দিকে তলোয়ারটা তুলে চিৎকার করে বললেন যাত্রা শুরু। যোদ্ধাবাহিনী যাত্রা শুরু করল।

যোদ্ধাবাহিনী নগরের রাজপথে এলো। চলা শুরু করল দক্ষিণমুখো পালমা নোভার দিকে। ততক্ষণে পালমা নগরের রামন লালের মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। যোদ্ধারা পালমা নোভা দুর্গ দখল করতে যাচ্ছে। আর রামন লালের নশ্বর দেহ আনতে যাচ্ছে। এই সংবাদও ছড়িয়ে পড়েছে। হাজার হাজার নগরবাসী পথের দু’ধারে এসে দাঁড়াল। নগরবাসী নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল। তারা সবাই শোকস্তব্ধ। যোদ্ধাদের উৎসাহ দেবার জন্যেও কেউ ধ্বনি তুলল না। যোদ্ধারা চলল। চারদিক নিঃশব্দ। শুধু যোদ্ধাদের পায়ে চলার শব্দ। আর অনেকেহ ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ।

যোদ্ধাবাহিনী যখন পালমা নোভার দুর্গের কাছে এলো তখন বেশ রাত হয়েছে। ওদিকে বড়ো রাস্তার ধারে যে নজরদারদের পহারা রাখা হয়েছিল তারা দূর থেকে রাজা দ্বিতীয় জেমসের ঐ যোদ্ধাবাহিনী দেখে ছুটে এলো দুর্গে। আল আমিরিকে সংবাদ দিল রাজা দ্বিতীয় জেমসের যোদ্ধাবাহিনী পালমা নোভা দুর্গ অধিকার করতে আসছে। আল আমিরি হুকুম দিলে সব যোদ্ধারা যেন দুর্গের চত্বরে এসে জড়ো হয়।

সব সৈন্যরা বর্ম আর শিরস্ত্রাণ পরে তলোয়ার বর্শা হাতে দুর্গের চত্বরে এসে সার বেঁধে দাঁড়াল। তিরন্দাজরাও এল।

একটু পরেই আল আমিরি এলো। যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে বলল। আমরা যে এই দুর্গৰ্তা অধিকার করেছি সেটা যেমন করেই হোক রাজা জেমসের কানে উঠেছে। আমাদের এত কড়া নজরদারি সত্ত্বেও এটা কীভাবে হল জানি না। যাহোক, আর কিছুক্ষণের মধ্যে রাজার যোদ্ধাবাহিনী এসে পড়বে। আমরা দুর্গের বাইরের প্রান্তরে যুদ্ধ করবো। ঐ যোদ্ধাদের দুর্গ পর্যন্ত আসতে দেব না। কাজেই শরীরে সমস্ত শক্তি নিয়ে লড়াই চালাতে হবে। আল আমিরি থামল। মূর যোদ্ধারা মুখে একটা অদ্ভুত শব্দ করল। এটা ওদের যুদ্ধে নামার আগের ধ্বনি। আল আমিরি যোদ্ধাদের দুটো দলে ভালো করল। একদল বাইরের প্রান্তরে গিয়ে জড়ো হল। অন্যদল দুর্গের মধ্যেই রইল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সেনাপতি বেলো আর ঘোড়সওয়ার বাহিনী দুর্গের বাইরের রাস্তায় এসে থামলেন। সেনাপতি বেলো একজন ঘোড়সওয়ার সৈন্যকে বললেন–যাও–ঐ মূরবাহিনীর দলনেতা কে তা জানো আর তাকে আমার কাছে আসতে বলে। যুদ্ধের চেয়ে যদি কথা বলে সমস্যাটা মেটানো যায় সেই শেষ চেষ্টাটা করবো আমি।

ঘোড়সওয়ার সৈন্যটি দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে আল আমিরি যোদ্ধাবাহিনীর কাছে এলো। যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বলল–তোমাদের দলনেতা কে? একজন যোদ্ধা বলল– আল আমিরিআমাদের দলনেতা। সেনাপতির পাঠানো যোদ্ধাটি বলল–আল আমিরিকে এখানে আসতে বলো। আমাদের সেনাপতি বেলো তার সঙ্গে কথা বলবেন। আল আমিরির এক সৈন্য বলল–যদি একা পেয়ে আমাদের দলনেতাকে মেরে ফেলে। সেনাপতির যোদ্ধা বলল–আমাদের সেনাপতিও একাই থাকবেন। আল আমিরির সৈন্যরা আর কিছু বলল না। দু’জন দুর্গের দিকে চলল আল আমিরিকে প্রস্তাবটা জানাতে।

সেনাপতি বেলোর একটু সন্দেহ ছিল আল আমিরি আসবে কিনা। কিছুক্ষণ পরেই দেখা গেল আল আমিরি ঘোড়ায় চড়ে দুর্গ থেকে বেরিয়ে এলো। ঘোড়া ছুটিয়ে তার যোদ্ধাবাহিনীর সামনে এসে দাঁড়াল। সেনাপতি বেলো আস্তে আস্তে ঘোড়া চালিয়ে আল আমিরির কাছে এসে বললেন–শুনলাম–আপনার নাম আল আমিরি। আপনি আরবীয় দলনেতা।

–ঠিকই শুনেছেন। আল আমিরি বলল।

–আপনি রাজা দ্বিতীয় জেমসের এই দুর্গ অন্যায়ভাবে দখল করে আছেন সেনাপতি বললেন।

হ্যাঁ। লড়াইয়ে রাজার যোদ্ধাদের হারিয়ে তবে দখল করেছি। আল আমিরি বলল।

–ঠিক আছে–এবার আমি রাজা জেমসের সেনাপতি বেলো আপনাকে বলছি। আপনি ভালোয় ভালোয় দুর্গ ছেড়ে দিয়ে চলে যান। সেনাপতি বললেন।

–যদি না যাই। আল আমিরি বলল।

–তাহলে যুদ্ধ হবে। আমাদের যোদ্ধাবাহিনীর যোদ্ধাদের সংখ্যা আপনার যোদ্ধাদের চেয়ে অনেক বেশি। শুধু শুধু রক্তপাত মৃত্যুকে ডেকে আনবেন না। আপনার দুর্গ ছেড়ে চলে যান। সেনাপতি বললেন।

–না। আমরা লড়াই করবো। আল আমিরি বলল।

–আমি শেষ পর্যন্ত শান্তি সব মিটিয়ে নিতে চেয়েছি। আপনারা তা হতে দিলেন না। তবে যুদ্ধই হোক। সেনাপতি বললেন।

সেনাপতি নিজের যোদ্ধাবাহিনীর কাছে ফিরে এলেন। আল আমিরিও ঘোড়া ছুটিয়ে দুর্গে ঢুকল।

চাঁদের আলো অনুজ্জ্বল। দুর্গে প্রান্তরে সেই আলো ছড়িয়ে আছে। সেনাপতি বেলো নিজেদের বাহিনীর কাছে ফিরে এলেন।

দু’পক্ষের যোদ্ধাবাহিনীর অনড় অপেক্ষা চলছে। সমুদ্রের দিক থেকে জোরালো বাতাস আসছে। শাঁ শাঁ শব্দ উঠছে। একটু দূরের বন-জঙ্গলে।

সেনাপতি বেলোই প্রথম খোলা তলোয়ার মাথার ওপর তুলে চিৎকার করে বলল– আক্রমণ করো। ঘোড়সওয়ার বাহিনী ছুটল।মূর যোদ্ধারা মুখে শব্দ তুলে ঘোড়সওয়ারদের মোকাবিলায় এগিয়ে এলো। ওরা ঘোড়সওয়ার বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। শুরু হল যুদ্ধ। ঘোড়ার ক্ষুরের আঘাতে চাপে বেশ কিছুমূর সৈন্য আহত হল। তবু অশ্বারোহী যোদ্ধাদের শরীরে ঘোড়ার গায়ে তলোয়ারের কোপ বসাল। বর্শা দিয়ে বিদ্ধ করল। কিন্তু রাজা জেমসের সুশিক্ষিত যোদ্ধাবাহিনীর সামনে মূরবাহিনী আর কতক্ষণ দাঁড়াবে। তবুওরা লড়াই করতে লাগল। প্রান্তর ভরে উঠল আর্ত চিৎকার গোঙানি আর তলোয়ারের ঠোকাঠুকির শব্দে।

এবার সেনাপতির নির্দেশে পদাতিকবাহিনী ছুটে এলো। যুদ্ধে নামল। চলল যুদ্ধ। কিছুক্ষণের মধ্যেই আল আমিরির যোদ্ধারা হার স্বীকার করতে লাগল। ওদের সংখ্যাও কমে আসতে লাগল। জীবন বিপন্ন দেখে কিছুমূর যোদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালাল। মূর যোদ্ধাবাহিনী পরাস্ত হল। বেশ কিছু দূর যোদ্ধাকে বন্দি করাও হল। এবার সেনাপতি বেলো ঘোড়ায় চড়ে চললেন দুর্গের প্রধান প্রবেশপথের দিকে। তার পেছনে পেছনে যোদ্ধাবাহিনীও চলল।

দুর্গা ঘিরে চারদিকে পরিখা। পরিখা জলে ভর্তি। পরিখা পার হয়ে দুর্গের পাথুরে দেয়ালের কাছে পৌঁছোতে হবে।

প্রধান প্রবেশপথে যেতে পরিখার ওপর কাঠের সেতু দিয়ে যেতে হয়।

ঘোড়ায় চড়ে সেনাপতি বেলো সেতুর কাছে এলেন। দেখলেন দুর্গের বিরাট কাঠের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজার কাছে দেয়ালে তখনও মশাল জ্বলছে। আল আমিরির কোনো প্রহরী ওখানে নেই। সেনাপতি বেলো গলা চড়িয়ে যোদ্ধাদের বললেন–আমার বীর যোদ্ধারা–সেতু দিয়ে ওপারে গিয়ে দেয়ালের চারপাশ ঘিরে দাঁড়াও। যোদ্ধারা কাঠর সেতুর ওপর দিয়ে পরিখার ওপরে গেল। দেয়াল ঘিরে দাঁড়াল। সেনাপতি বেলো আবার উচ্চস্বরে আদেশ দিলেন–দেয়াল ধরে ধরে ওপরে ছাদের দিকে ওঠো।

যোদ্ধারা দেয়ালের কাছে ছুটে এলো। দুর্গের এবড়ো-খেবড়ো দেয়াল ধরে ধরে ওপরের দিকে উঠতে লাগল। এবার শুরু হল আল আমিরির যোদ্ধাদের আক্রমণ। ওরা দুর্গের ছাত থেকে যোদ্ধাদের লক্ষ্য করে তির বর্শা ছুঁড়তে লাগল। কিছু যোদ্ধা আহত হল। মারাও রগেল।

তখন সেনাপতি বেলো চিৎকার করে যোদ্ধাদের চলে আসতে বললেন পরিখার কাছে কাছে যোদ্ধাদের দাঁড়াতে বললেন। যোদ্ধারা তাই দাঁড়াল।

এবার আল আমিরির যোদ্ধারা দুর্গের ছাত থেকে পাথরের ছোটো ছোটো চাই স্লিং এ চড়িয়ে ছুঁড়তে লাগল। স্লিং হচ্ছে কাঠের লম্বা পাটাতন। দড়ি দিয়ে পাটাতন বাঁকিয়ে তার ওপর পাথরে ছোটো ছোটো চাই রাখা হয়। দড়ির বাঁধন খুলে দিলেই বাঁকা পাটাতন প্রচণ্ড জোরে সোজা হয়। পাটাতনে রাখা পাথরের চাঁই ছিটকে গিয়ে মাটিতে দাঁড়ানো যোদ্ধাদের ওপর পড়ে। কিছু যোদ্ধা মরে কিছু আহত হয়। এভাবেই সাত আটটা স্লিং থেকে পাথরের ছোটো ছোটো চাই ছোঁড়া হতে লাগল।

সঙ্গে সঙ্গে সেনাপতি বেলো যোদ্ধাদের উদ্দেশে চিৎকার করে বলতে লাগলেন– সবাই পরিখা সাঁতরে পার হয়ে চলে এসো। যোদ্ধারা পরিখার জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল জল গলা পর্যন্ত। কাউকে সাঁতরাতে হল না। জল ঠেলে যোদ্ধারা এপারে চলে এল। সেনাপতির হুকুমে সার বেঁধে দাঁড়াল। স্লিং থেকে ছোঁড়া পাথরের ছোটো ছোটো চাইগুলো এতদূর এলো না। যোদ্ধারা এবার নিরাপদ।

সেনাপতি বেলো এই স্লিং-এর কথা শুনেছেন কিন্তু আগে কখনো দেখেননি। এবারই প্রথম দেখলেন। স্লিং-এর কর্মক্ষমতা দেখলেন।

সেনাপতি বেলো ভেবে দেখলেন এভাবে দুর্গের বাইরে থেকে আক্রমণ করে দুর্গ দখল করা যাবে না। অন্য কোনো উপায় দেখতে হবে।

ওদিকে দুর্গ থেকে পাথর ছোঁড়া বর্শা ছোঁড়া বন্ধ হল। সেনাপতি বেলোর যোদ্ধারা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে অতদূর পর্যন্ত স্লিং দিয়ে ছোঁড়া ছোটো পাথরের চাঁই উড়ে আসছে না।

তখন পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। একটু পরেই সূর্য উঠল। ভোরের নরম আলো ছড়ালো দুর্গের গায়ে গাছগাছালির মাথায়। পাখি-পাখালির ডাক শোনা গেল।

সেনাপতির যোদ্ধারা তখন অত্যন্ত ক্লান্ত, সেই পালমা নগর থেকে হেঁটে আসা সারারাত যুদ্ধ করা। কিছু যোদ্ধা এত ধকল সইতে পারল না। ঘাসের প্রান্তরে বসে পড়ল। সেনাপতি দেখলেন কিন্তু কিছু বললেন না।

এখন যুদ্ধবিরতি চলছে। সেনাপতির আদেশে কয়েকজন যোদ্ধাকে নিয়ে রসুইকর চলল বনজঙ্গলের দিকে। গাছগাছালির আড়ালে রসুইকররা সকালের খাবার তৈরির জন্য তিনটে পাথর বসিয়ে উনুনের মতো বানাল। রান্নার আয়োজন চলল।

ঘোড়ার তদারক করে যারা তাদেরই একজন সেনাপতির কাছে এলো। সেনাপতি ও ঘোড়া থেকে নামলেন। যোদ্ধাটি ঘোড়াটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল দানাপানি খাওয়াতে।

সেনাপতি প্রান্তরে পড়ে থাকা একটা পাথরের চাইয়ের ওপর বসলেন।

তখন বেলা হয়েছে। দুর্গ বড়ো সড়ক পুবদিকে বনজঙ্গল সবই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সেনাপতি একবার চারদিকে তাকিয়ে দেখলেন। ভাবতে লাগলেন কীভাবে দুর্গা দখল করা যায়। রাতের অন্ধকারে দুর্গের দেয়াল ডিঙানো যায়। কিন্তু দুর্গের ছাদে জ্বলন্ত মশালের আলোতে যোদ্ধারা ধরা পড়ে যেতে পারে। অন্য কোনো উপায় ভেবে বের করতে হবে।

সকালের খাবার খেল সবাই। সেনাপতিও ঐ পাথরে বসেই খাবার খেলেন। খেতে খেতে সর্বক্ষণ ভেবে চললেন কীভাবে দুৰ্গটা দখল করা যায়।

হঠাই একটা উপায়ের কথা মাথায় এলো। দুর্গের সদর দরজা ভেঙে ঢুকতে হবে। সেনাপতি দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। কয়েকন যোদ্ধাকে হাত তুলে ডাকলেন। যোদ্ধারা কাছে এসে মাথা নিচু করে সম্মান জানাল। সেনাপতি বললেন–ঐ বনজঙ্গলের সামনে দেখো। সকলে সেদিকে তাকাল। দেখা গেল ঐ দিকে মানুষের বসতি এলাকা। পাথরের বাড়িঘরদোর। সেনাপতি বললেন–ওখানকার লোকজনের কাছ থেকে কয়েকটা কুড়ুল জোগাড় কবো। চলো আমিও যাচ্ছি।

সেনাপতি ঐ জেলেদের বসতির দিকে চললেন। পেছনে কয়েকজন যোদ্ধা চলল। বসতির পাথরের বাড়িগুলোর সামনে এসে সেনাপতি দেখলেন সব বাড়িই আগুনে পোড়া। আশেপাশে কোথাও মানুষজন নেই। সেনাপতি যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বললেন মনে হচ্ছে এখানে বসতি ছিল। পেছনেই বনজঙ্গল। এই বসতির লোকেরা নিশ্চয়ই বনজঙ্গ ল থেকে কাঠকুটো জোগাড় করত। কাজেই কুড়ুল ব্যবহার করতো। নিশ্চয়ই এই পোড়া বাড়িগুলো ভালো করে খুঁজলে কুড়ুল পাওয়া যাবে। তোমরা খোঁজো। যোদ্ধারা পোড়া বাড়িগুলোয় ঢুকে কুড়ুল খুঁজতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই যোদ্ধারা তিনটে কুড়ুল পেল। কুড়ুল নিয়ে ওরা সেনাপতির কাছে এলো। সেনাপতি বললেন–এবার চলো বনের মধ্যে। সেনাপতি বনের দিকে চললেন। পেছনে কুঠার নিয়ে যোদ্ধারা চলল।

বনের মধ্যে সেনাপতি একটা বড়ো গাছ খুঁজতে লাগল। পেয়েও গেল। একটা খাড়া উঠে-যাওয়া চেস্টনাট গাছ। বেশ মোটা গাছ। সেনাপতি যোদ্ধাদের গাছটা দেখিয়ে বলল–এই গাছটা কাটো। যোদ্ধারা কুঠার নিয়ে তৈরি হল। প্রথমে দু’জন কুঠার নিয়ে তৈরি হল। প্রথমে দু’জন কুঠারের কোপ পরপর বসিয়ে গাছের গোড়াটা কাটতে লাগল। দু’জনের মধ্যে একজন পরিশ্রান্ত হল। হাঁ করে হাঁপাতে লাগল। তৃতীয়জন এগিয়ে এলো। এবার দুজনে মিলে আগে পরে কুঠার চালিয়ে গাছটা কাটতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে গোড়া কাটা হয়ে গেল। আশেপাশের গাছের ডালে শব্দ তুলে কাটা গাছটা ঝপ করে মাটিতে পড়ল। সেনাপতি বললেন–গাছটার ডালগুলো ছেটে ফেল। যোদ্ধারা কুঠার চালিয়ে গাছটার ডালগুলো কেটে ফেলল। শুধু লম্বা মোটা কাণ্ডটা রইল। সেনাপতি এবার শুধু কাণ্ডটা দেখে দেখে কী হিসেব করে কাটার ওপরের দিকে একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন–এখানটা কাটো। একজন যোদ্ধা কুঠার চালিয়ে সেটা কাটল। এবার রইল শুধু বড়ো লম্বা মোটা কাণ্ডটা। সেনাপতি যোদ্ধাদের বললেন–এবার এটা নিয়ে চলো।

যোদ্ধারা এবার কাটা লম্বা কাণ্ডটা কাঁধে নিয়ে চলল। ওরা সেনাপতির নির্দেশমতো কাণ্ডটা নিয়ে দুর্গের প্রধান প্রবেশপথের দিকে চলল। এবার কাঠের সেতুটা পার হতে লাগল। তখনই দুর্গের ছাত থেকে আল আমিরির যোদ্ধারা স্লিং-এ পাথর চড়িয়ে ছুঁড়তে লাগল। একটা পাথর সেতুর মধ্যে এসে পড়ল। সেতুর ঐ জায়গার কাঠটা ভেঙে জলে পড়ে গেল। সেনাপতি গলা চড়িয়ে বললেন–ঐ কাঠের কাণ্ডটা নিয়ে কুড়িজন যোদ্ধা প্রধান দেউড়ির দরজার কাছে চলে যাও। ছোটো–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।

কুড়িজন যোদ্ধা সঙ্গে সঙ্গে কাণ্ড ঘাড়ে বসিয়ে ছুটে দেউড়ির কাঠের দরজার সামনে চলে এলো। এখন আর স্লিং-এ চড়িয়ে পাথর ছুঁড়ে লাভ নেই। এত কাছে পাথর গিয়ে পড়বে না। স্লিং থেকে পাথর ছোঁড়া বন্ধ হল। শুধু তিরন্দাজরা তির ছুঁড়তে লাগল। ওদিকে সেনাপতির হুকুমে তার তিরন্দাজ বাহিনী তির ছুঁড়তে লাগল। সেনাপতি চিৎকার করে বলল–শুধু ওদের তিরন্দাজদের মারো নয়তো আহত করো। তিরন্দাজরা নিশান ঠিক করে তির ছুঁড়তে লাগল।

এবার সেনাপতি দ্রুতপায়ে সেতুটা পার হলেন। এলেন দুর্গের সদর দরজার কাছে। যোদ্ধাদের বললেন –এই গাছের কাণ্ডটার কুড়িজন কাঁধে নাও। তারপর ছুটে গিয়ে দুর্গের দরজায় একসঙ্গে কাণ্ডটা দিয়ে ঘা মারো। এভাবে বারবার ঘা মারো।

একজন যোদ্ধা সরু গলায় বলতে লাগল –ধাক্কা মারো একসঙ্গে। যোদ্ধারা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে গিয়ে গাছের কাণ্ডটা একসঙ্গে ধরে কাঠের দরজার মাঝখানে ঘা মারতে লাগল। দড়াম্ দড়াম্ শব্দ হতে লাগল। কাঠের দরজাটা নড়ে উঠতে লাগল।

কুড়িজন যোদ্ধা পরিশ্রান্ত হল। হাঁপাতে লাগল। সেনাপতি তা দেখে সেতুর ওপারে জড়ো হওয়া যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে গলা চড়িয়ে বললেন-কুড়িজন চলে এসো। জদি। দৌড়ে আসবে।

কুড়িজন যোদ্ধা সেতুর ওপর দিয়ে দ্রুত ছুটে এলো। আগের কুড়িজনকে সেনাপতি হাতের ইঙ্গিতে চলে যেতে বললেন। কুড়িজন যোদ্ধা চলে গেল।

এবার নতুন কুড়িজন যোদ্ধা কাণ্ডটা ঠেলে নিয়ে দরজায় ঘা মারতে লাগল। ঘা পড়ছে আর দরজার মাঝখানের ফাঁকটা বড়ো হচ্ছে। কাঠের দুটো মোটা আগল দরজার মাঝখানে এবার দেখা যাচ্ছে। আগল দুটো দেখে যোদ্ধাদের উৎসাহ বেড়ে গেল। চলল দুম দুম্ শব্দ তুলে আগলদুটোয় ঘা মারা। পরিখার ওপারে দাঁড়ানোর সৈন্যরাও চিৎকার করে উৎসাহ দিতে লাগল। পর পর ঘা পড়তে লাগল বিরাট দরজাটা নড়তে লাগল।

হঠাৎ একটা ধাক্কায় কাঠের একটা আগল ভেঙে ছিটকে পড়ল। যোদ্ধারা চিৎকার করে উঠল। যোদ্ধারা হাঁপাচ্ছে তখন। সেনাপতি ওদের বলল–এবার অন্যদের ডাকছি। তোমরা যাও। ওরা বলে উঠলনা। দু’একজন বলল–একটা আগল ভেঙেছি অন্যটাও ভাঙবো। আমরাই ভাঙবো।

আবার ঘা পড়ল অন্য আগলটায় বারে বারে। যোদ্ধারা হাঁপাচ্ছে তখন। একজন যোদ্ধা বলে যেতে লাগল ধাক্কা মারো একসঙ্গে। কাঠের আগলটা ক্রমাগত এই ধাক্কা সামলাতে পারল না। একটা জোর ধাক্কা খেয়ে কাঠের আগলটা দু’টুকরো হয়ে ছিটকে পড়ল। বন্যার জলের মতো যোদ্ধারা চিৎকার করতে করতে দুর্গের মধ্যে ঢুকে পড়ল। দুর্গের ছাত থেকে দুর্গের ঘরগুলোর আশপাশ থেকে আল আমিরির যোদ্ধার তির বর্শা ছুঁড়তে লাগল। কিন্তু সেনাপতি যোদ্ধাদের থামাতে পারল না। দুর্গের ঘরগুলো থেকে আল আমিরির যোদ্ধারা খোলা তলোয়ার হাতে সেনাপতির যোদ্ধাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেনপতির যোদ্ধারা তলোয়ারের লড়াই চালাল। ততক্ষণে বাইরে পরিখার ওপারে দাঁড়ানো সেনাপতির যোদ্ধারা চিৎকার করতে করতে ছুটে এলো। আল আমিরির যোদ্ধারা তাদের রুখতে পারল না। আল আমিরির সৈন্যদের ঘিরে ফেলল সেনাপতির যোদ্ধারা চলল তলোয়ারের লড়াই দুর্গের চত্বরে। চত্বরটা ভরে উঠল আহতের আর্ত চিৎকারে গোঙানিতে। কিছুক্ষণের মধ্যে আল আমিরির যোদ্ধারা হার স্বীকার করতে লাগল। সেনাপতির যোদ্ধারা সাহসী আর রণনিপুণ। আমিরির মূর সৈন্যরা পেরে উঠল না।

দুর্গের ঘরগুলোর বারান্দায় দাঁড়িয়ে সেনাপতি চিৎকার করে বললেন–বীর যোদ্ধারা–আর ইত্যা নয়। ওরা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হার স্বীকার করবে। ওদের এখন বন্দি কবো। এই দুর্গে নিশ্চয়ই কয়েদঘর আছে। ওদের কয়েদঘরে ঢুকিয়ে দাও।

সেনাপতির যোদ্ধারা তার নির্দেশমতো আল আমিরির যোদ্ধাদের বন্দি করতে লাগল। ওদের দু’হাত দড়ি দিয়ে বেঁধে নিয়ে চলল কয়েদঘরের দিকে।

লড়াই শেষ। সেনাপতির যোদ্ধারা তখন হাঁপাচ্ছে। সেনাপতি গলা চড়িয়ে বললেন– কিছু যোদ্ধা ছাতে চলে যাও। ওখান থেকে মাঝে মাঝেই তির বর্শা ছোঁড়া হচ্ছে। কিছু যোদ্ধা ছুটল ছাতে ওঠার সিঁড়ির দিকে। ছাতে উঠে আল আমিরির যোদ্ধাদের আক্রমণ করল। তারা কিছুক্ষণের মধ্যেই আত্মসমর্পণ করল। তাদের ছাদ থেকে নামিয়ে এলে কয়েদঘরে বন্দি করে রাখা হল।

তখনই দেখা গেল আল আমিরি খোলা তলোয়ার হাতে ছুটে এলো। সেনাপতি দ্রুত তার সামনে এলেন। বললেন–আল আমিরি–অস্ত্র ত্যাগ করো। লড়াই শেষ হয়ে গেছে। তোমার যোদ্ধারা হয় মরেছে নয়তো আহত হয়েছে অথবা কয়েদঘরে বন্দি হয়ে আছে। তুমি একা লড়ে কী করবে?

আল আমিরি মাথা ঝাঁকিয়ে বলল–আমি লড়াই করবো। মরতে হয় মরবো তবু লড়াই থেকে পিছিয়ে আসবো না।

–তাহলে আমার সঙ্গেই লড়াই করো। সেনাপতি কথাটা বলেই তলোয়ার হাতে আল আমিরির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। আল আমিরি কোনোরকমে সেই মার আটকাল। শুরু হল আল আমিরির সঙ্গে সেনাপতির লড়াই।

তলোয়ারের লড়াইতে কেউ কম যায় না। সেনাপতির যোদ্ধারা লড়াইয়ের জায়গাটা ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়াল। লড়াই দেখতে লাগল।

তলোয়ারের লড়াই চলল। সেনাপতি এগিয়ে পিছিয়ে নিপুণ হাতে তলোয়ার চালাতে লাগলেন। আল আমিরিও কম যায় না। সেনাপতির মার ঠেকাতে লাগল। আবার আক্রমণও করতে লাগল। দু’জনেই তখন হাঁপাচ্ছে। তরোয়ারের ঠোকাঠুকির শব্দ আর শাস ফেলার শব্দ।

এতক্ষণ আল আমিরির তলোয়ার যত দ্রুত এদিক-ওদিক ঘুরছিল এখন কিন্তু সেই দ্রুততা আর নেই। তবু হঠাৎ দ্রুত ঘুরে আল আমিরি তলোয়ার চালাল। রোদে ঝলসে উঠল তলোয়ার। সেনাপতির বাঁ বাহু ছুঁয়ে তলোয়ারের ফলা নেমে এলো। পোশাকের কাপড় কেটে রক্ত বেরিয়ে এলো। সেনাপতি কাটা জায়গাটা দেখলেন। এবার সেনাপতি দ্রুত তলোয়ার চালাতে লাগলেন। আল আমিরি সেই তলোয়ারের মার ঠেকাতে ঠেকাতে পিছু হঠতে লাগল। সেনাপতি ওর ওপর সমান চাপ রেখে এগিয়ে চললেন। হঠাৎ সেনাপতি এত দ্রুত আর এত জোরে তলোয়ার চালালেন যে পরিশ্রান্ত আল আমিরি সেই মার ঠেকাতে পারল না। ওর হাত থেকে তলোয়ার ছিটকে গেল। সেনাপতি আল আমিরির গলায় তলোয়ারের ডগাটা ঠেকিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন–তোকে মেরে ফেলার হুকুম নেই। তারপর যোদ্ধাদের বললেন–এটাকে বন্দি করো। একজন যোদ্ধা ছুটে গেল। আল আমিরির কোমরের ফেট্টি খুলে তাই দিয়ে ওর হাত বাঁধল। সেনাপতি বললেন–মহামতি রামন লালের নশ্বর দেহ কোথায় সমাধিস্থকরা হয়েছে? আল আমিরি। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল–দুর্গের উত্তর দিকে প্রান্তরে।

–আমাদের নিয়ে চলো। সেনাপতি বললেন। তারপর বললেন–এখানে বেলচা কোথায় থাকে? আল আমিরি বলল–আমি জানি না। রামন লালের মৃতদেহ কবর দেবার সময় আমরা কেউ যাই নি। কবর খোঁড়েটোড়ে এমন দু’জন গিয়েছিল। সেনাপতি শুধু বলল–আশ্চর্য। তারপর যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বললেন–এই দুর্গের ঘরগুলো খোঁজ। কোথাও দু-একটা বেলচা নিশ্চয়ই পাবে। যোদ্ধারা কয়েকজন বেলচা খুঁজতে গেল।

কিছু পরে তারা দুটো বেলচা নিয়ে এলো। সেনাপতি আল আমিরিকে বললেন– চলোকবরের জায়গাটা দেখিয়ে দেবে।

–সেই জায়গাটা কোথায় তা তো আমি জানি না। আল আমিরি বলল।

তার মানে? সেনাপতি বললেন।

কবরের সময় তো আমরা যাই নি। আল আমিরি বলল।

–ও। ঠিক আছে আমরাই খুঁজে নেব। সেনাপতি বললেন। তারপর দু’জন যোদ্ধাকে বললেন–আল আমিরিকে কয়েদঘরে বন্দি করে রাখো।

সেনাপতি দুর্গ থেকে বেরিয়ে উত্তরমুখো চললেন। তরো যোদ্ধারাও নিঃশব্দে তার পেছনে পেছনে চলল। ওরা সেনাপতি আর আল আমিরির সব কথাই শুনেছে। উত্তরের প্রান্তরে এসে সেনাপতি যোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে বললেন–এখানে খুঁজে দেখো তো কোথায় মাটি কাটা আছে। দু’একদিন আগেই কবর কাটা হয়েছে। সবাই এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়ল। কবর খুঁজতে লাগল। পাওয়া গেল। ঘাসের মধ্যে সহজেই মাটি খোঁড়া জায়গাটা দেখা গেল।

কবরের জায়গাটাতে সেনাপতি এলেন কবরের সামনে কিছুক্ষণ চোখ বুজে দাঁড়ালেন। এ তারপর যে দু’জন যোদ্ধা বেলচা নিয়ে এসেছিল তাদের বললেন কবরটা খোঁড়। কফিনটা তুলতে হবে। যোদ্ধা দু’জন বেলচা দিয়ে কবর খুঁড়তে লাগল। হাত দুয়েক খুঁড়েই কফিনটা পাওয়া গেল। একটা সস্তা দামের কাঠের কফিন। সালভার পক্ষে এর চেয়ে বেশি দামের কফিন জোগাড় করা সম্ভব ছিল না।

কফিনটা উপরে তোলা হল। সবাই মাথায় বুকে ক্রশ চিহ্ন আঁকল। এবার সেনাপতির নির্দেশে কয়েকজন কফিনটা কাঁধের কাছে তুলল। সবার আগে সোনপতি কফিনটার সামনের দিকেকঁধ দিল।তখনও সেনাপতির বাঁ বাহু থেকে রক্ত পড়ছিল। কিন্তু সেনাপতি সেটা গ্রাহ্য করল না। বাকি কয়েকজন কঁধ দিল। সেনাপতি সেটা গ্রাহ্য করল না। বাকি কয়েকজন কঁধ দিল। সেনাপতি কফিন নিয়ে চলল।

দুর্গের বাঁ দিকে বনজঙ্গলের কাছে পালমা থেকে আনা দামি কাঠের তৈরি সোনা রুপোর ফুল লতা পাতার কাজ করা কফিনটা রাখা ছিল। সেই কফিনের কাছে এই কফিনটা আনা হল। নতুন কফিনটার মুখ খোলা হল। আগের কফিনের মুখটা খোলা হল। রামন লালের শায়িত মৃতদেহ বেশ কয়েকজন হাত লাগিয়ে তুলল। তারপর নতুন কফিনে আস্তে আস্তে রাখল। কফিনের মুখ বন্ধ করা হল। সেনাপতির দু’চোখে জলে ভরে গেল। যোদ্ধাদের মধ্যেও অনেকে কাঁদছিল।

দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর সব যোদ্ধারা ঘাসের প্রান্তরে শুয়ে বসে বিশ্রাম করছিল। সেনাপতি সেখানে এলেন। গলা চড়িয়ে বললেন–বীর যোদ্ধারা এখন সবাই বিশ্রাম করো। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর আমরা পালমা নগরের দিকে যাত্রা করবো। ভোর ভোর সময়ে পালমা পৌঁছে যাবো।

রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হল। চারদিক খোলা যে গাড়িটা সেনাপতি এনেছিল সেই গাড়িতে কফিনটা রাখা হল। দুটো ঘোড়া গাড়িটা টানবে। আল আমিরিকে হাত বাঁধা অবস্থায় একটা ঘোড়ায় বসানো হল। একজন অশ্বারোহী যোদ্ধা সেই ঘোড়ায় আল আমিরির পেছনেই বসল।

একেবারে সামনে রাখা হল কফিনের গাড়িটাকে। তারপর ঘোড়ায় চড়ে সেনাপতি। তারপর অশ্বারোহী যোদ্ধারা। তারপর পদাতিক যোদ্ধারা, তিরন্দাজরা। সবশেষে বন্দি আল আমিরি।

সেনাপতি তলোয়ার কোষমুক্ত করল। রাজধানী পালমা নগরের দিকে তলোয়ার তুলে চিৎকার করে বললেন–যাত্রা শুরু।

যাত্রা শুরু হল।

আজ চাঁদের আলো খুব উজ্জ্বল নয়। চাঁদ মেঘেও ঢাকা পড়ছে মাঝে মাঝে। সমুদ্রের দিক থেকে জোরালো হাওয়া বইছে!

পালমা নগরে পৌঁছোবার আগেই ভোর হল।

ওদিকে রাজবাড়ি থেকে ফিরে সালভা বলল–ফ্রান্সিস এখন কী করবেন?

ফ্রান্সিস বলল-রামন লাল কোথায় থাকতেন?

ছাত্রাবাসের পাশেই শিক্ষাগুরুদের আলাদা আবাস। তারই একটিতে রামন লাল থাকতেন। সালভা বলল।

–তাহলে ঐ ছাত্রাবাসেই একটা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করো। আমরা সেই ঘরেই থাকবো। ফ্রান্সিস বলল। উত্তরমুখো কিছু পাথরের ঘরের দিকে দেখিয়ে সালভা বলল–

ছাত্রাবাস শিক্ষাগুরুদের আবাস ঐদিকে। সেইদিকে চলল ওরা। তখনি প্রাসাদের দক্ষিণ দিককার দেয়ালের ওপাশ থেকে বহু মানুষের কোলাহল ঘোড়ার ডাক শোনা গেল। সালভা বলল–ঐ দিকেই সৈন্যবাস। একটা বিরাট প্রান্তর আছে ঐদিকে। বোধহয় সৈন্যসজ্জা চলছে সেখানে।

হাঁটতে হাঁটতে উত্তরের ঘরগুলোর কাছে ওরা এলো। সালভা প্রথম ঘরটার দরজায় দাঁড়াল। ফ্রান্সিসরাও এসে ওর পেছনে দাঁড়াল। দেখা গেল ছোটো একটা ঘর। একপাশে পাথরের মেঝেয় কম্বলমতো মোটা কাপড়ের বিছানা পাতা। বিছানায় একজন বৃদ্ধ বসে আছেন। গায়ের ছাইরঙের মোটা কাপড়ের একটা অংশ ঘোমটার মতো তার মাথায় টানা। বৃদ্ধ একটি পাণ্ডুলিপি পড়ছেন।

সালভা গিয়ে বৃদ্ধের সামনে মেঝেয় বসল। বৃদ্ধ মুখ তুলে সালভার দিকে তাকালেন। সালভা মাথা নুইয়ে সম্মান জানাল। হেসে বলল–শ্রদ্ধেয় ম্যাস্ত্রো আমাকে চিনতে পারছেন? বৃদ্ধ ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হাসলেন। কপালে মুখে বলিরেখা স্পষ্ট হল। বললেন–তুমি সালভা–তাই না? সালভা হেসে মাথা ঝাঁকাল। বলল শ্রদ্ধেয় ম্যাস্ত্রো–মহামতি রামন লালের প্রথম পাণ্ডুলিপিটা তো এখনো পাওয়া যায় নি। ম্যাস্ত্রো মাথা নাড়লেন। সালভা ইশারায় ফ্রান্সিসকে ডাকল। ফ্রান্সিস এগিয়ে এলো। ফ্রান্সিসকে দেখিয়ে সালভা বলল–এর নাম ফ্রান্সিস। আমার বন্ধু। ম্যাস্ত্রো একবার তাকিয়ে ফ্রান্সিসকে দেখলেন। সালভা বলল–রাজা এই ফ্রান্সিসকেই দায়িত্ব দিয়েছেন ঐ পাণ্ডুলিপিটা খুঁজে বের করার জন্যে।

“ভালোই তো। ম্যাস্ত্রো বললেন।

তাই ফ্রান্সিস তার বন্ধুদের নিয়ে এখানে থাকবেন। একটা ঘরের ব্যবস্থা আপনাকে করে দিতে হবে। সালভা বলল।

–এ আর বেশি কথা কি। তুমি তো সবই চেনো। যেকোনো একটা খালি ঘর পছন্দ করে থাকো। ম্যাস্ত্রো বললেন। একটু থেমে সালভা বলল–এবার আপনাকে একটা শোক সংবাদ জানাচ্ছি। আমাদের গুরুদেব মহাতি রামন লাল কিছুদিন আগে দেহত্যাগ করেন। ম্যাস্ত্রো কেমন বিহ্বলচোখে সালভার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন– দীর্ঘদিন আমরা অনেক চেষ্টা করেও তার কোনো খোঁজ পাই নি। কিন্তু তুমি জানলে কী করে?

পরে সব বলবো আপনাকে। সালভা বলল। মাথা নাড়তে নাড়তে ম্যাস্ত্রো বললেন–এখানে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলবার চেষ্টা করছি আমরা। আশা ছিল, যশস্বী রামন লাল ফিরে আসবেন। আমরা তার সাহায্য ও পরামর্শ পাবো। আঃ বড়ো কষ্ট হচ্ছে। ম্যাস্ত্রো মাথা নাড়লেন। সালভা উঠে দাঁড়াল। মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে ঘরের বাইরে এলো। চলল টানা বারান্দা ধরে। ফ্রান্সিসরাও চলল। পর পর বেশ ক’টা ঘর পার হল ওরা। প্রত্যেকটাতেই ছাত্ররা রয়েছে। পাথরের বারান্দাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে সেখানে একটা খালি ঘর পাওয়া গেল। ঘরটায় ঢুকল সবাই। ঘরটা বড়ো। কিন্তু ঘরটার মেঝেয় কোনো বিছানামতো কিছু নেই। ঘরটার পাথুরে দেয়ালের ওপরের দিকে চ্যাপ্টালোহার কয়েকটা গরাদ বসানো জানলা। ওরা ঘরটা দেখছেতখনই একটি অল্পবয়সী ছেলে এসে দরজায় দাঁড়াল। ছেলেটার মাথা ন্যাড়া। সালভা বলল–কীরে–তুই এখানে কাজ করিস?

–হ্যাঁ। কর্তা আমাকে পাঠিয়ে দিলেন। ছেলেটি বলল। বোঝা গেল ম্যাস্ত্রো পাঠিয়েছেন।

ন্যাড়া মাথা ছেলেটিই ফ্রান্সিসদের ওখানে স্নান খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিল।

ঘরে এসে দেখল চারজনেরই বিছানার ব্যবস্থা হয়েছে। ফ্রান্সিস বিছানায় শুয়ে পড়ল। তারপর ক্লান্তিতে চোখ বুজল। শাঙ্কো আর মারিয়াও বিছানায় বসল। ক্লান্ত সকলেই। সালভা বলল–আমি রাজবৈদ্যির কাছ থেকে পিঠের ওষুধটা নিয়ে আসছি। ঘা শুকিয়ে এসেছে কিন্তু টনটনানিটা যাচ্ছে না। সালভা চলে গেল।

শাঙ্কো টান টান হয়ে শুয়ে পড়ল। ফ্রান্সিস চোখ বন্ধ অবস্থাতেই বলল–মারিয়া শুয়ে বিশ্রাম করো। অনেক ধকল গেছে। মারিয়া শুয়ে পড়তে পড়তে বলল–ফ্রান্সিস পারবে পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করতে? চোখ না খুলেই ফ্রান্সিস বলল–আগে রামন লালের থাকার ঘর–পড়ার ঘর–পেছনের ছোটো গীর্জাটা–শিক্ষাগুরুদের থাকার জায়গাগুলো–এসব দেখি–তারপর বুঝবো পারবো কি পারবো না।

বিকেল হয়ে এলো। সালভা ফিরল তখন। ওর পোশাকের পকেট থেকে একটা তামার চৌকোণো চাকতি বেরকরল। ফ্রান্সিসের হাতে দিয়ে বলল–পাঞ্জা। রাজা পাঠিয়ে দিয়েছেন। এটা দেখিয়ে যেখানে খুশি আমরা যেতে পারবো। মারিয়া হাত বাড়িয়ে পাঞ্জাটা নিল। দেখতে লাগল। শাঙ্কো দেখল। ওরা নিশ্চিন্ত হল যে এখন রাজপ্রাসাদে ঢোকবার বা বেরোবার জন্যে আর সমস্যা থাকবে না। সালভা ফ্রান্সিসকে বলল– জানেন–মহামতি রামন লালের দেহরক্ষার সংবাদে সারানগর শোকে মুহ্যমান। বন্দরে সব কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। দোকানটোকানও বন্ধ হয়ে গেছে। পথ জনশূন্য। সবাই অধীর আগ্রহে আপেক্ষা করছে কালকে কখন সেনাপতি রামন লালের পবিত্র দেহ নিয়ে আসে। ফ্রান্সিস শুনল। কোনো কথা বলল না। ওর তখন চিন্তা নক্শায় কীভাবে কী। নির্দেশ দিয়েছেন রামন লাল?

সন্ধে হ’ল। ফ্রান্সিস তখনও চুপ করে শুয়ে ভাবছে। সালভা বলল–কী করবেন এখন?

সন্ধে হয়ে গেছে। অন্ধকারে শুধু মোমবাতির অলোয় কিছু বোঝা যাবে না। আজ রাতে শুধু বিশ্রাম। কালকে সকাল থেকে কাজে লাগতে হবে। ফ্রান্সিস বলল।

রাতে খাওয়াদাওয়ার পর ফ্রান্সিস মোমবাতির আলোয় নকশাটা দেখল বেশ কিছুক্ষণ। তারপর মোমবাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল।

ভোর হতেই পালমার অধিবাসীরা দলে দলে এসে জড়ো হতে লাগল রাজপ্রাসাদের বাইরে। আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে লাগল। সকাল হতেই বহুলোক জড়ো হল। সবাই শ্রান্ত। কারো মুখে কথা নেই। এত লোক। কিন্তু কোনো শব্দ নেই। শুধু এখানে ওখানে দু’চারজন বুড়োবুড়ির ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ শোনা গেল।

হঠাৎ জনারণ্যে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হল। দেখা গেল দূরে যুদ্ধসাজে সজ্জিত সেনাপতি ঘোড়া ছুটিয়ে আসছেন। তার পেছনে একটা ঘোড়ায়টানা গাড়িতে রাখা কাঠের কফিন। গাড়িটা চারদিক থেকে ঘিরে আসছে একদল অশ্বারোহী সৈন্য। দেখেই বোঝা যাচ্ছে সৈন্যরা সবাই পরিশ্রান্ত। অপেক্ষারত নগরবাসীদের মধ্যে চাঞ্চল্য জাগল। সবাই সেই কফিনের কাছে যেতে চায়। কিন্তু সৈন্যরা কাউকে এগোতে দিল না।

রাজা প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলেন। সঙ্গে মন্ত্রীমশাই। পেছনে প্রাসাদরক্ষীরা। রাজা ও মন্ত্রীমশাই পায়ে হেঁটে সিংহদ্বারের কাছে এলেন। সিংহদ্বার আগেই খুলে রাখা হয়েছিল। কফিনের গাড়ি আস্তে আস্তে সিংহদ্বার দিয়ে ঢুকল। রাজা আর মন্ত্রী মাথা নুইয়ে সম্মান জানালেন। সিংহদ্বারের সামনেই কফিনের গাড়িটা থামিয়ে দেওয়া হল। বন্ধ করে দেওয়া হল সিংহদ্বার। সিংহদ্বারের লোহার গরাদের ওপর মানুষের ঢল নামল। সবাই সেই কফিনটা দেখতে চায়। শেষ শ্রদ্ধা জানাতে চায় রামন লালের নশ্বর দেহকে।

ফ্রান্সিসরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সেই দৃশ্য দেখছিল। ফ্রান্সিস আস্তে আস্তে বলল– বুঝলে মারিয়া–মাজোরকার মানুষরা সত্যিই রামন লালকে শুধু শ্রদ্ধাই করতো না ভালোবাসতো।

ওদিকে বন্দি আল আমিরিকে নিয়ে যাওয়া হল সৈন্য আবাসের লাগোয়া কয়েদখানায়। উদ্ধার করা দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে সেনাপতি রাজার পেছনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। রাজা প্রাসাদে ফিরলেই পাণ্ডুলিপিটা দেবেন।

রামন লালের পবিত্র দেহ প্রাসাদ সংলগ্ন সমাধিস্থলে সমাধিস্থ করার আয়োজন চলল।

ফ্রান্সিস সালভাকে বলল–চলো–রামন লালের থাকার ঘর যেখানে ছিল সেখানে। মারিয়া শাঙ্কো এগিয়ে এলো। চলল সবাই।

শিক্ষাগুরুদের বাসস্থানের এলাকায় এলো ওরা। সালভা ওদের নিয়ে এলো পর পর কয়েকটা আলাদা আলাদা বাড়ির কাছে। বাড়িগুলো পাথরের দেয়াল ঘেরা। কয়েকটা বাড়ির পরে একটা বাড়ির সামনে সালভা দাঁড়াল। বাড়িটার সাধারণ কাঠের দরজায় তালা ঝুলছে। সালভা পকেট থেকে চাবি বের করতে করতে বলল–শ্রদ্ধেয় ম্যাস্ত্রোর কাছ থেকে আমি চাবিটা নিয়ে রেখেছি। জানি আপনারা এখানে আসবেন। রামন লালের আবাসস্থল দেখতে চাইবেন।

দরজা খোলা হল। ভেতরে ঢুকল সবাই। সামনেই একটু বাঁধানে জায়গা। তার পরে ঘর। ওরা ঘরটার কাছে এলো। দরজা ভেজানো ছিল। ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। ঘরে ঢুকল সবাই। ঘরের একপাশে মেঝেয় বিছানা রয়েছে। অন্যপাশে দেয়ালে পাথরের তাক। তাতে হাতে লেখা চামড়া বাঁধানো পাণ্ডুলিপি। পরপর সাজানো। সবই পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন। বোঝা গেল–নিয়মিত ঘরটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যবস্থা আছে। ঘরটা বেশ বড়ো। পেছনের দেয়ালের ওপরের দিকে তিনটি চ্যাপ্টা লোহার গরাদ বসানো জানলামতো চৌকোণো ফোকর। আলো হাওয়া আসছে। সালভা বলল–এখানেই মহামতি রামন লাল থাকতেন।

ফ্রান্সিস ঘুরে ঘুরে ঘরটা দেখতে লাগল। বলল–সালভা–তুমি তো অনেকবার এখানে এসেছো।

–হ্যাঁ হা। ঐ যে জানলার নীচে একটা বড়ো চৌকোণো পাথর আর তার পাশে নিচুতে একটা পাথর ওটাই ছিল মহামতি রামনের লেখাপড়ার জায়গা। ফ্রান্সিস ওখানটায় গেল। দেখল ওপরের জানলা দিয়ে এখানে যথেষ্ট আলো আসছে। এবার ফ্রান্সিস পাথরের তাকে রাখা পাণ্ডুলিপির পাতা উল্টে দেখতে লাগল। মারিয়াকে ডেকে বলল–

–এই পাণ্ডুলিপিগুলো দেখো তো। আমার বিদ্যে তো জানো। মারিয়া এগিয়ে এলো। পাতা উল্টে দেখতে লাগল। দেখে নিয়ে বলল–গ্রীক আরবী আর ল্যাতিন ভাষায় লেখা। এটুকু বুঝতে পারছি। তার বেশি বোঝার বিদ্যে আমারও নেই। সালভা বলল– এসব পুরোনো সংগ্রহের কিছু কিছু আমার পড়ার কাজে লেগেছে। দর্শন, রয়াসন আর জ্যোতির্বিদ্যার ওপরেই লেখা বেশি।

–আচ্ছা–গ্রীক ভাষায় লেখা রামন লালের কোনো পাণ্ডুলিপি এখানে আছে? মারিয়া বলল। ফ্রান্সিস বলে উঠল-আমিও ঠিক এই কথাটাই জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম। সালভা সেই পাথরপাতা জায়গাটায় গেল। পাশেই পাথরের তাকটার দিকে তাকিয়ে বলল–রামন লালের নিজের পাণ্ডুলিপিগুলো সব এখানেই থাকতো। এখন দেখছি না। শ্রদ্ধেয় ম্যাস্ত্রো হয়তো বলতে পারবেন।

–চলো তো। ফ্রান্সিস বলল। ওরা বাড়ির বাইরে এলো। দরজায় তালা লাগিয়ে সালভা চলল ম্যাস্ত্রোর ঘরের দিকে। যেতে যেতে সালভা বলল–শ্রদ্ধেয় ম্যাস্ত্রো এখানকার ছাত্রাবাসের দায়িত্বে আছেন। তাই শুধু উনিই ছাত্রাবাসের ঘরে থাকেন। কিন্তু ম্যাস্ত্রোর ঘরের সামনে এসে দেখল ঘরে তালা ঝুলছে। ম্যাস্ত্রো নেই। সালভা ছাত্রদের ঘরে গিয়ে জেনে এলো যে রমন লালের পবিত্র দেহ সমাধিস্থ করার আয়োজনে উনি এখন ব্যস্ত।

দুপুরে খাওয়াদাওয়ার সময় ম্যাস্ত্রো এলেন। তখন সালভা ফ্রান্সিসকে নিয়ে গেল। ম্যাস্ত্রোকে ফ্রান্সিস বলল–মহামতি রামন লালের নিজের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি একটু দেখতে চাই। ম্যাস্ত্রো পাশের দেয়ালের তাক থেকে চারটে পাণ্ডুলিপি বের করলেন। মরক্কো চামড়ায় বাঁধানো বড়ো বই মতো বেশ মোটা ভারী। ফ্রান্সিস বইটার লেখাগুলো দেখল। তারপর মারিয়ার হাতে দিল। মারিয়াও দেখল–গ্রীক ও আরবী ভাষায় লেখা। বাকিগুলোও দেখল ওরা। খুব পরিচ্ছন্ন হস্তাক্ষর। ফ্রান্সিস ভাবল এমনি হাতে লেখা একটা পাণ্ডুলিপি নিখোঁজ। এখন সেটাই খুঁজে বের করতে হবে। ভরসা শুধু নকশাটা।

ফেরার সময় সালভা বলল–দর্শনশাস্ত্র নিয়ে ঐ পাণ্ডুলিপিগুলোতে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা আছে।

ওদিকে প্রাসাদসংলগ্ন রাজপরিবারের সমাধিভূমিতে রামন লালের মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হচ্ছে। বহুলোক জড়ো হয়েছে সেখানে। মারিয়া বলল–ফ্রান্সিস–এরকম একটা অনুষ্ঠান তো বড়ো একা দেখা যায় না। আমি যাবো দেখতে। ফ্রান্সিস বলল–তোমার সঙ্গে শাঙ্কোও থাক।

–তুমিও চলো না। মারিয়া বলল। ফ্রান্সিস মাথা নাড়ল। তারপর বিছানায় শুয়ে পড়ল।

রামন লালের পবিত্র দেহ সমাধিস্থ হওয়ার পরেও লোকের আসার বিরাম নেই। বিকেল নাগাদ সমাধিভূমি জনশূন্য হয়ে গেল।

সন্ধেবেলা ফ্রান্সিস সালভাকে বলল তুমি বলেছিলে এই প্রাসাদের চৌহদ্দির মধ্যে একটা ছোটো গীর্জা আছে। —-শিক্ষাগুরুদের বাড়িগুলোর ওপাশে। এই গীর্জাটা ছাত্র আর শিক্ষাগুরুদের জন্যে। সালভা বলল।

–রামন লালও কি ঐ গীর্জায় উপাসনা করতে যেতেন? ফ্রান্সিস বলল।

–না। তার থাকার ঘরের পাশে আছে একটা ছোটো ঘর। সেখানে যীশুর মূর্তি আছে। তিনি সেই ঘরেই নিয়মিত উপাসনা করতেন। সালভার কথাটা শেষ হতেই ফ্রান্সিস সাগ্রহে বলল–এরকম একটা ঘর আছে নাকি?কিন্তু তুমি তো আমায় বলোনি।

–রামন লাল শুধু উপাসনার সময় আধঘণ্টার জন্যে ঐ ঘরটায় যেতেন। সালভা বলল। ফ্রান্সিস বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল চলো তো আর একবার রামন লালের ঘরগুলো দেখবো।

–কিন্তু অন্ধকারে এখন–সালভা বলল।

–মোমবাতির আলোয় দেখবো। ফ্রান্সিস বলল। মারিয়া বলে উঠল–কোথায় ভাবলাম পালমানগরটা আজকে সন্ধেবেলা একটু ঘুরেটুরে দেখবো–ফ্রান্সিস হাসল। বলল–

তুমি আর শাঙ্কো যাও–ঘুরে এসো তো। শাঙ্কো বলল–তুমিও চলো না।

–না শাঙ্কো–নকশার রহস্যটাই এখন আমার চিন্তায়–আর কিছু ভাবতে পারছি না। ফ্রান্সিস বলল। মারিয়া কিন্তু নগরে বেড়াতে গেল না। ফ্রান্সিস আর সালভার পিছু পিছু চলল। শাঙ্কোও চলল সঙ্গে।

তালার চাবিটা সালভাই নিজের কাছে ম্যাস্ত্রোর কাছ থেকে চেয়ে রেখেছিল।

রামন লালের ঘরের কাছে সবাই। সালভাদুটো মোমদানিতে দুটো বেশ মোটা লালচে রঙের মোম এনেছিল। মোম জ্বালাল। একটা মোমদানি নিজে নিল। আর একটা ফ্রান্সিসের হাতে দিল।

রামন লালের থাকার ঘরটা মোমবাতির আলোয় ফ্রান্সিস আবার খুঁটিয়ে দেখল। সেই ওপরের দিকে ফোকর মতো জানলা। চ্যাপ্টা লোহার গরাদ বানানো। নকশার রহস্যভেদে কাজে লাগবে এমন কিছুই পেল না। বলল–সালভা উপাসনার ঘরটায় চলো। সালভা আলো নিয়ে ঘরের বাঁদিকের কোণায় এলো। দেখা গেল একটা ছোটো সাধারণ কাঠের দরজা। সালভা কয়েকটা ধাক্কা দিতেই দরজাটা খুলে গেল। মাথা নিচু কী করে সবাইকে ঘরটায় ঢুকতে হল।

মোমবাতির আলোয় ফ্রান্সিসরা দেখল অন্য ঘরগুলোর মতো এই ঘরেও উঁচুতে দেয়ালের দুটো চ্যাপ্টা লোহার গরাদ বসানো চৌকোণো জানলামতো। তার নীচে দেয়ালে গায়ে যীশুর কাঠের একটা মূর্তি। একটা হালকা নীল সার্টিন কাপড়ে ঢাকা চৌকোণো লম্বাটে বেদীর ওপর মূর্তিটা রাখা। মূর্তির নীচে মেঝেয় একটা পশমের আসন এখনও পাতা রয়েছে। আলো নিয়ে ফ্রান্সিস ছোট ঘরটা ঘুরে ঘুরে দেখল। তারপর বলল সালভা–এই উপাসনার ঘরে কি তুমি আসতে?

–হ্যাঁ হ্যাঁ–কত এসেছি। সকালবেলা রামন লাল উপাসনা করতেন ঐ আসনে বসে। আমিও মাঝে মাঝে আসতাম। দেখতাম রামন লাল চোখ বুজে মাথা নিচু করে আসনে বসে আছেন। আমিও চুপ করে তার পেছনে বসে প্রার্থনা করতাম। উপনাস সেরে আমাকে দেখে খুশি হতেন। একটু থেমে সালভা বলল–উনি আমাকে পুত্রের মতো স্নেহ করতেন। সালভার দু’চোখ জলে ভরে উঠল। ও হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছল। মারিয়া বলল-যীশুর মূর্তিটা কী সুন্দর। সালভা বলল-রামন লাল যখন প্রথম পরিভ্রমণে বেরিয়েছিলেন তখনই মূর্তিটা এনেছিলেন। জুডিয়ার এক গ্রাম্য মিস্ত্রির হাতে তৈরি।

ফ্রান্সিস কয়েকবার সমস্ত ঘরটা দেখল। তারপর বলল–চলো সব। সবাই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।

রাতে সবাই শুয়ে পড়েছে তখন। ফ্রান্সিস ডাকল–সালভা। সালভা ওর দিকে তাকাল। ফ্রান্সিস বলল–দেখো নকশাটা প্রথম দেকে আমি যা অনুমান করেছিলাম এখন সেটা আর অনুমান নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস–রামন লাল নকশায় যে জায়গাটা নির্দেশ করেছেন সেই জায়গাটা তোমার খুবই পরিচিত।

–কিন্তু আমি তো সেই জায়গাটা কোথায় কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। সালভা বলল।

–সেটা আমিই তোমাকে বোঝাবো। আমার মনে হচ্ছে আমি সমাধানের কাছাকাছি এসেছি। ফ্রান্সিস বলল। তারপর বলল–রামনের দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিটা তুমি পড়েছে। সবশেষের পাতায় যা লেখা আছে তুমি কি সেদিন সেটা ঠিক ঠিক আমাকে বলতে পেরেছিলে? সালভা একটু ভেবে বলল তখন আমার যা মনের অবস্থা–ঠিক ঠিক মনে রাখা সম্ভব ছিল না।

–যা হোক–দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিটা রাজার কাছে রয়েছে। কাল সকালে তুমি আমাদের রাজার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দাও। ঐ পাণ্ডুলিপিটা আমি চাইবো। রাজা দিলে পড়বো মানে তুমি পড়ে আমাকে অর্থ বলবে। রামন লাল ঠিক কী বলতে চেয়েছেন সেটা আমি জানতে চাই। ফ্রান্সিস বলল।

পরদিন সকালে সালভা রাজপ্রাসাদে গেল। একটু পরেই ফিরে এলো। বলল– রাজা নিজেই তোমাকে দেখা করবার জন্যে একজন প্রহরীকে পাঠিয়েছেন।

তাহলে তো ভালোই হল। ফ্রান্সিস বলল।

প্রহরীর সঙ্গে ফ্রান্সিসরা রাজার সাক্ষাতের জন্যে রাজপ্রাসাদের দিকে চলল। প্রহরী ফ্রান্সিসদের রাজার মন্ত্রণাকক্ষে নিয়ে এসে বসাল।

কিছু পরে রাজা এলেন। ফ্রান্সিসরা উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাল। রাজা বললেন– তোমরা পাণ্ডুলিপি খোঁজার ব্যাপারে কতদূর এগিয়েছো?

মহামান্য রাজা–ফ্রান্সিস বলল–আমরা অনেকটা এগিয়েছি।

–খুশি হলাম। রাজা বললেন। তারপর মারিয়াকে বললেন–শুনলাম তুমি নাকি রাজকুমারী?

ফ্রান্সিস বলল হা মহামান্য রাজা-উনি আমাদের দেশের রাজকুমারী।

-কী আশ্চর্য তোমার পোশাক দেখে আমি ভেবেছিলাম তুমি এই দেশের গ্রামের লোক। রাজা বললেন। মারিয়া বলল–আমি এই পোশাক স্মারক হিসেবে আমাদের দেশে নিয়ে যাবো। রাজা একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন–সত্যিই আমি প্রীত হলাম। এবার ফ্রান্সিস বলল

মাননীয় রাজা–একটা অনুরোধ ছিল।

বলো। রাজা বললেন।

–মহামতি রামন লালের দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিটা কিছুক্ষণের জন্যে আমি পড়তে চাই– বিশেষ করে শেষাংষটুকু।

–বেশ তো। সালভা নিয়ে যাবে তোমাদের পড়ে বুঝিয়ে দেবে। রাজা উঠলেন। ভেতরে গেলেন। সালভাকে রেখে ফ্রান্সিসরা চলে এলো।

কিছুক্ষণ পরে সালভা ফ্রান্সিসদের ঘরে এলো। হাতে রামন লালের দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিটা। মারিয়া হাত বাড়িয়ে নিল ওটা। গ্রীক ভাষায় লেখা। ওর বোঝার কথা নয়। ফ্রান্সিস বলল–সালভা-কালিকলমের ব্যবস্থা করতে পারো? সালভা হাসল। বলল–এটা লেখাপড়ারই পীঠস্থান। আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন। ফ্রান্সিস হাসল। মাথা নেড়ে বলল–সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম। সালভা চলে গেল। মারিয়া পাণ্ডুলিপিটা ফ্রান্সিসদের হাতে দিল। একটু পরেই সালভা রুপোর দোয়াতদানি আর পালকের কলম নিয়ে এলো। ফ্রান্সিসদের বিছানায় বসল। ফ্রান্সিস বিছানার তলা থেকে নকশাটা বের করল।–নকশাটা মারিয়াকে দিয়ে বলল–সালভা পাণ্ডুলিপির শেষাংশটুকু স্পেনীয় ভাষায় অনুবাদ করে বলবে তুনি নকশার কাগজের পেছনে সেটা লিখবে। মারিয়া বসল। নকশার উল্টোপিঠে শেষ পাতাটা বের করল। অনুবাদ করে বলতে লাগল। মারিয়া লিখতে লাগল। পাণ্ডুলিপির পার্চমেন্ট কাগজগুলো খোলা। তখনও বাঁধানো হয় নি।

লেখা শেষ হলে ফ্রান্সিস পড়তে লাগল–গ্রীস, মিশর, মেসোপটেমিয়া আরো নানা জায়গায় ঘুরে আমি নানাভাবে যেসব জায়গার অ্যালকোমিচর্চার তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম এবং যেসব তথ্য সূত্রাকারে লিখে রেখেছিলম সেসব আমার পরিভ্রমণকালে লেখা প্রথম পাণ্ডুলিপিতে।

এবার পরিভ্রমণে বহির্গত হবার পূর্বে সেই পাণ্ডুলিপি এক পবিত্রস্থানে গোপনে রেখে এসেছিলাম।

এবারের পরিভ্রমণকালে আমি অনেক কষ্টে কখনও জীবন বিপন্ন করে আরো তথ্য সংগ্রহ করেছি। এখন মাজোরকা ফিরে যাবো। সব তথ্য সূত্র একত্র করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করবো। যদি সত্যিই আমি নিকৃষ্ট ধাতু সীসে দস্তা আর পারদ সোনায় রূপান্তরিত করতে পারি তাহলে সমস্ত সূত্র তথ্য ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাগজপত্র অগ্নিতে নিক্ষেপ করবো।” এই পর্যন্ত পড়ে ফ্রান্সিস আশ্চর্য হয়ে গেল। ও একবার সালভার মুখের দিকে তাকাল। মারিয়ার দিকে তাকাল। তারপর আবার পড়তে লাগল–”পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করবো যে মানুষও পারে বিপুল স্বর্ণসম্পদ সৃষ্টির অধিকার লাভ করেও তা তুচ্ছজ্ঞানে পরিত্যাগ করতে।”

পাণ্ডুলিপি এখানেই শেষ। ফ্রান্সিস কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলি। তারপর আস্তে আস্তে বলল–সালভারামন লাল শুধু মনস্বীই ছিলেন না–মহামতিও ছিলেন। এককথায় খাঁটি মানুষ ছিলেন। তারপর মাথা নিচু করে বলল–আমি তাকে নতমস্তকে আমার অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। সবাই চুপ করে রইল।

একটু পরে সালভা উঠে দাঁড়াল। বলল–সৈন্যদের ছাউনিতে আল আমিরির বিচার চলছে। আমাকে যেতে হবে। আমাদের আগুনে পোেড়া বস্তির পুননির্মাণের খরচ আল আমিরির কাছ থেকে আদায় করবো। সালভা চলে গেল।

ফ্রান্সিস বিছানায় আধশোয়া হ’ল। রামন লালের সংকল্পটা আবার পড়তে লাগল।

হঠাৎ দরজার কাছে কাদের পায়ের শব্দ শোনা গেল। শোনা গেল–ফ্রান্সিস ফ্রান্সিস ডাক। ফ্রান্সিস উঠে বসল। মারিয়া উঠে দাঁড়ল। ঘরে ঢুকল হ্যারি। পেছনে বিস্কো। হ্যারি আর ফ্রান্সিসকে উঠতে দিল না। বসা অবস্থাতেই ফ্রান্সিসকে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। ফ্রান্সিসের গায়ে হাত বুলোতে লাগল। ওর দু’চোখ জলে ভরে উঠল। ফ্রান্সিস বুঝল সেটা। ধমক লাগাল–এই হ্যারি–কী ছেলেমানুষি হচ্ছে। বিস্কো তখন মারিয়াকে বলছে–দিন কয়েক আমরা অপেক্ষা করলাম। যেদিন রাতে রাজার সৈন্যবাহিনী পালমা নোভার দুর্গ দখল করল, আল আমিরিকে বন্দি করল সেদিনই আপনাদের জন্যে ভীষণ চিন্তা হল। পরদিনই এলাম। আগুনে পোড়া জেলেবস্তিতে তখন কয়েকটা পরিবার ফিরে এসেছে। সালভার কথা জিজ্ঞেস করতে ওরা সালভার বাবার কাছে আমাদের নিয়ে গেল। তার কাছেই আপনাদের সব সংবাদ পেলাম। বিস্কো থামতেই হ্যারি বলে উঠল–ফ্রান্সিস তোমরা মরণজলা পার হয়েছিলে? মারিয়া বলে উঠল–আমি তো মরেই যাচ্ছিলাম। ফ্রান্সিস মুখে শব্দ করল। বলল–তারপর তোমরা জাহাজ চালিয়ে পালমা বন্দরে এলে। হ্যারি বলল–হ্যাঁ। আজ খুব ভোরে এসেছি। জাহাজ থেকে নেমে সোজা ছুটে এলাম এখানে। আমি রামন লাল এখানে থাকতেন। তোমরা এখানেই আসবে। কিন্তু দ্বাররক্ষীরা আটকাল। ভিনদেশি আমাদের রাজপ্রাসাদে ঢুকতে দেবে না। অগত্যা প্রধান ফটকের বাইরে আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম যদি তোমরা কেউ বেরিয়ে আসো বা তোমাদের কাউকে যদি দেখতে পাই।

সে কি ফ্রান্সিস বলল–সেই ভোর থেকে দাঁড়িয়ে আছো! মাথা নেড়ে হ্যারি হাসল। বলল–সালভাকে প্রধান ফটকের দিকে আসতে দেখে আমরা চাঁচামেচি শুরু করে দিলাম। সালভা ছুটে এলো। তারপর এখন–হে বন্ধু তোমার সম্মুখে। হ্যারির বলার ভঙ্গী শুনে ফ্রান্সিস মারিয়া হেসে উঠল। ফ্রান্সিস বলল–শোনো হ্যারি–এখন আমি জাহাজে যাবো না। মারিয়া আর শাঙ্কো যাক। মারিয়াকে দেখিয়ে বলল–মারিয়ার পোশাকের চেহারা দেখেছো?মারিয়া বলে উঠল–পোশাক পাল্টাতে নয়। আমি জাহাজে যাবো আমার বন্ধুদের দুশ্চিন্তা দূর করতে।

কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে মারিয়া শাঙ্কো হ্যারিদের সঙ্গে জাহাজঘাটার দিকে চলে গেল।

ফ্রান্সিস রামন লালের লেখাটা পড়তে পড়তে হঠাৎ ডাকল–সালভা। সালভাদরজার কাছে সেই ন্যাড়া ছেলেটাকে বলছিল–কীরে তুই এখানে কবে থেকে কাজ করছিস্? ছেলেটা কী বলতে যাচ্ছিল ফ্রান্সিসের ডাক শুনে থেমে গেল। সালভা ফ্রান্সিসের দিকে তাকাল–কী হল? ফ্রান্সিস দ্রুত পায়ে দরজার কাছে এলো। বলল-রামন লালের উপাসনা ঘরে চলো।

–কেন? সালভা আশ্চর্য হয়ে বলল। ফ্রান্সিস বলল–

–রামন লাল তার লেথায় বলেছেন–”পবিত্রস্থান’-এ তিনি পাণ্ডুলিপি গোপনে রেখে গেছেন। উপাসনা ঘরের মতো পবিত্রস্থান আর কী আছে। চলো। যেতে যেতে। বলল–সালভানক্শার রহস্যের কুয়াশা কেটে যাচ্ছে।

দু’জনে রামন লালের উপাসনা ঘরে এলো। ফ্রান্সিস ঘরটার চারদিকেতাকাতে লাগল। এখন দিনের বেলা। ওপরের চ্যাপ্টা লোহার গরাদ বসানো দুটো জানলা দিয়ে ঘরটায় আলো আসছে। জানলাটা দেখতে দেখতে ফ্রান্সিস বলল–সালভা এখানকার শিক্ষাগুরুদের ঘরগুলো সব একদিকে আর সব ঘরেই এরকম জানলা আছে–তাইনা?

–মনে তো হয়। লক্ষ্য করি নি তেমন। সালভা বলল।

এখন যাও–সব ঘরে ক’টা করে জানলা আছে আর ক’টা করে গরাদ আছে। দেখে এসো। ফ্রান্সিস বলল।

–আপনার মাথায় বোধহয় ভূত চেপেছে। বিড় বিড় করে কথাটা বলতে বলতে সালভা চলে গেল।

কিছুক্ষণ কাটাল। ফ্রান্সিস তাকিয়ে আছে যীশুর মূর্তি আর বেদীর দিকে।

সালভা ফিরে এলো। বলল–তিনটে করে জানলা আর ছ’টা করে গরাদ। তাতে হলটা কী? ফ্রান্সিস বলল।

–এ ঘরে জানলা দুটো আর গরাদ পাঁচটা করে দেখো। সালভা জানলা দুটো দেখল। গরাদগুলো গুনল। পাঁচটা।বলল–হ্যাঁ। ফ্রান্সিস হাতের নকশাটা ওকে দেখিয়ে বলল– এই দেখো এই দুটো জানলা আঁকা। সালভা দেখল। বলল–কিন্তু গরাদ তো পাঁচটা আঁকা নেই।

–যেটা আঁকা আছে সেটা রোমান অক্ষরে পাঁচ কিনা। দেখো ভালো করে। ফ্রান্সিস বলল! সালভা দেখে বলল হ্যাঁ পাঁচই তো! ফ্রান্সিস বলল–

–ভুলে যেও না–রামন লাল যখন নক্শাটা আঁকেন তখন তার মৃত্যুকাল উপস্থিত। অসাড় হয়ে আসতে থাকা হাতে পাঁচটা দশটা টান দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। তাই রোমান ‘দ্দ” এঁকেছেন। এই ঘরের জানলার গরাদও পাঁচটা। মিলে গেল কিনা। সালভা বলেউঠল–সত্যিই তো। ফ্রান্সিস বলল–এবার শেষ সূত্র। দেখো নীচে একটা লম্বাটে চৌকোণা দাগ আছে কিনা।

-হা আছে তো। সালভা বলল। ফ্রান্সিস বলল–

যীশুর মূর্তির নীচে বেদীটা কাপড়ে ঢাকা। তাই বুঝতে পারছি না ওটা পাথরের না কাঠের। তুমি কাপড়টা একটু সরিয়ে দেখো–ওটা কীসের? সালভা বেদীর সামনে গেল। বুকে ক্রশ এঁকে মাথা নুইয়ে যীশুকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আস্তে কাপড়টা কিছু সরিয়ে দেখল–লম্বাটে কাঠের দেরজামতো। ফ্রান্সিস দেখল সেটা। আরও দেখল সামনেটায় কাঠের ঢাকনা মতো। সালভা কাপড়টা ছেড়ে দিল। দেরাজ ঢাকা পড়ে গেল। পেছনে ফিরে সালভা দেখল–ফ্রান্সিস মাথা নিচু করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে। একটুক্ষণ। চোখ মেলে ফ্রান্সিস বলে উঠল–মহামতি রামন লাল–আপনার আশীর্বাদে আমি আপনার পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করতে পারলাম। সালভা তো অবাক। বলল–কিন্তু পাণ্ডুলিপি কোথায়? ফ্রান্সিস দরজার দিকে যেতে যেতে বলল–সব বলবো মহামান্য রাজাকে।

তুমি এক্ষুণি রাজাকে গিয়ে বলে তিনি যেন এখানে একবার দয়া করে আসেন। কারণ পাণ্ডুলিপি পাওয়ার অধিকারী একমাত্র তিনিই।

নিজের ঘরে ফিরে এলো ওরা। ফ্রান্সিস কলমে কালি নিল। তারপর নকশাটায় কী লিখতে লাগল। লেখা শেষ হলে ফ্রান্সিস সেই উপাসনা ঘরে গিয়ে রাজার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল।

অল্পক্ষণের মধ্যেই রাজা এলেন। সঙ্গে মন্ত্রীমশাই। পেছনে সালভা আর ম্যাস্ত্রো। ফ্রান্সিস মাথা নুইয়ে দু’জনকেই সম্মান জানাল। রাজা বললেন–পাণ্ডুলিপি কোথায়? ফ্রান্সিস রাজার হাতে নকশাটা দিল। উল্টোপিঠটা দেখিয়ে বলল–মহামতি রামনের শেষ সংকল্পটা আপনি আর একবার পড়ুন–এই অনুরোধ। রাজা একবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে নিয়ে অনুবাদটা পড়লেন। মন্ত্রীমশাইকে দিলেন। মন্ত্রীমশাইও পড়লেন। ফ্রান্সিস বলল–মহামতি রামনের অ্যালকেমিচর্চার আগ্রহ ছিল। কিন্তু তার শেষ সংকল্প তো জানেন। এরপরও কি প্রথম পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের প্রয়োজনীয়তা আছে মাননীয় রাজা? রাজা একটু চুপ করে থেকে বললেন–দেখোনিকৃষ্ট ধাতুকে সোনায় রূপান্তরিত করার আগ্রহ নিয়ে আমি প্রথম পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের চেষ্টা করিনি। আমরা ধরে নিয়েছিলাম তিনি দেহরক্ষা করেছেন। তার পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন হিসেবেই প্রথম পাণ্ডুলিপি উদ্ধারের চেষ্টা করেছি।

–তাহলে–আপনিই ঐ বেদীর ঢাকনার কাপড়টি দয়া করে সরান। ফ্রান্সিস বলল । রাজা একবার ফ্রান্সিসের দিকে তাকিয়ে নিয়ে যীশুর মূর্তির বেদীর সামনে এলেন। মাথা নিচু করে বুকে ক্রশ আঁকলেন। তারপর আস্তে আস্তে বেদী তক কাপড়টা সরালেন। সেই ওক কাঠের লম্বাটে দেরাজমতো।

–ঢাকনাটা দয়া করে খুলুন। ফ্রান্সিস বলল। রাজা দেরাজের ঢাকনাটা আস্তে আস্তে খুললেন। ভেতরে দেখা গেল একটা মরোক্কো চামড়ায় বাঁধানো পাণ্ডুলিপি। রাজা পাণ্ডুলিপিটা আস্তে আস্তে বের করে আনলেন। সামান্য ছাইরঙা পার্চমেন্ট কাগজের পাণ্ডুলিপির পাতা ওল্টালেন। কিছুটা পড়লেন। তারপর মন্ত্রীমশাইর দিকে তাকিয়ে বললেন–হ্যাঁ–এটাই প্রথম পাণ্ডুলিপি। তারপর ফ্রান্সিসের দিকে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকালেন। বললেন–তুমি নশার সমাধান বের করলে কী করে? ফ্রান্সিস রাজার হাতে নটা দিয়ে বলল–মাননীয় রাজা-মহামতি রামন লাল মৃত্যুকালীন দুঃসহ কষ্টের মধ্যেও যা আঁকতে চেয়েছিলেন কিন্তু পারেন নি আমি সেটাই সম্পূর্ণ করে এঁকে এবং লিখে দিয়েছি। রাজা নকশাটা দেখলেন–

আনন্দিত রাজা বললেন, “আমি নিজে এবং মাজোরকার অধিবাসীদের পক্ষ থেকে তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।” রাজা পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঘরের বাইরে এলেন। প্রাসাদের দিকে চললেন। পেছনে মন্ত্রী।

ফ্রান্সিসরা নিজেদের ঘরে এলো। তখনই সালভা ঘরে ঢুকল। বলল, “ফ্রান্সিস, আপনার বন্ধুরা জাহাজ চালিয়ে পালমা বন্দরে এসেছে। ওরা রাজপ্রাসাদের বাইরে অপেক্ষা করছে।”

ফ্রান্সিস বলে উঠল, “আমাদের কাজ শেষ।মারিয়া, শাঙ্কো, চলো আমাদের জাহাজে।”

ওরা রাজপ্রাসাদের বাইরে আসতে হ্যারি, বিস্কো, পেড্রো ছুটে এলো। হ্যারি ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরে প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “তোমাদের সব কথা আমরা শুনেছি।” বন্ধুরা আনন্দের ধ্বনি তুলল, “ও হো-হো।” পালমার লোকেরা ওদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। ভাইকিংরা এত আনন্দের কারণ বুঝল না।

ফ্রান্সিসরা দলবেঁধে এগিয়ে চলল জাহাজঘাটার দিকে। নকশাটা ভালো করে দেখে রাজা ফ্রান্সিসের দিকে তাকালেন। বললেন–সত্যি তুমি যথেষ্ট বুদ্ধি ও চিন্তাশক্তির পরিচয় দিয়েছে। তারপর রাজা মন্ত্রীমশাইকে বললেন মহান রামন লালের পরিভ্রমণের দুটি পাণ্ডুলিপিই এই পবিত্রস্থানে রাখা হবে। ফ্রান্সিস মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল

–মহামান্য রাজা–যদি অভয় দেন তাহলে আমি বিনীতভাবে একটা অনুরোধ করছি।

-বলো। রাজা বললেন। ফ্রান্সিস বলল সালভা দ্বিতীয় পাণ্ডুলিপিটা পড়েছে। প্রথম পাণ্ডুলিপির বিষয়ে সে জানে। সে বলেছে মহামতি রামন দেশে দেশে তার বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা এই দুটি পাণ্ডুলিপিতে লিখেছেন। শুধু অ্যালকেমির তথ্য ও সূত্র আলাদা করে এই পবিত্রস্থানে রাখুন। কিন্তু তার পরিভ্রমণের মূল্যবান কাহিনী থেকে এখানকার শিক্ষাগুরু ও ছাত্রদের বঞ্চিত করবেন না। মহামতি রামন লালের রচনা তাদের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করুক একটা কি মহামান্য রাজা চান না? রাজা ফ্রান্সিসের কথা মন দিয়ে শুনলেন। বললেন–তোমার কথাটা ভেবে দেখবো। ফ্রান্সিস মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে বলল মহামান্য রাজা–আমার কর্তব্য শেষ। আমাকে আমাদের জাহাজে ফিরে যেতে হবে। আপনি অনুমতি দিন। রাজা বললেন—

আমি নিজে এবং মাজোরকার অধিবাসীদের পক্ষ থেকে তোমাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। ফ্রান্সিস মাথা নুইয়ে সম্মান জানিয়ে ঘরের বাইরে এলো। সালভা ছুটে এল। বলল–চলুন–আপনাকে জাহাজঘাটায় নিয়ে যাই। ফ্রান্সিস হেসে বলল–ধন্যবাদ সালভা–আমি একাই যেতে পারবো। তুমি রাজা ও মন্ত্রীমশাইয়ের কাছে থাকো।

বন্দরে যখন ফ্রান্সিস পৌঁছল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। বেশ কটা জাহাজ রয়েছে বন্দরে। নিজেদের বহু পরিচিত অনেক সুখ-দুঃখের সঙ্গী সেই জাহাজ খুঁজে নিতে দেরি হল না।

ফ্রান্সিস যখন পাতা পাটাতন দিয়ে জাহাজে উঠছে রেলিঙে দাঁড়ানো বন্ধুরা চেঁচিয়ে বলল–ফ্রান্সিস এসেছে। মুহূর্তে বন্ধুরা অনেকেট ডেক-এ উঠে এলো। ফ্রান্সিস জাহাজের ডেক-এ পা ফেলা মাত্র ওরা ছুটে এলো। সবাই ফ্রান্সিসকে জড়িয়ে ধরতে চায়। আনন্দের ধ্বনি তুলল ওরা—ও হো হো। মারিয়া আর হ্যারি ছুটে এলো। মারিয়া বলল পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করতে পেরেছো? ফ্রান্সিস হেসে বলল–হ্যাঁ। মারিয়া বলে উঠল– আমাকে তো থাকতেই দিলে না। ফ্রান্সিস মারিয়া–তোমার অনেক ধকল গেছে। পরিচিত পরিবেশে তোমার বিশ্রামের দরকার ছিল। তাই তোমাকে জহাজে পাঠিয়েছিলাম। মারিয়া আর কিছু বলল না। ফ্রান্সিস হেসে দু’হাত ছড়িয়ে বলল–মারিয়া–এবারও আমার হাত শূন্য। আমি কিছুই আনতে পারিনি। মারিয়া মাথা নেড়ে বলল– তাতে আমার বিন্দুমাত্র দুঃখ নেই। শাঙ্কো বলল–সবাই জানতে চাইছে তুমি কী করে পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করলে।

ফ্রান্সিস বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল–ভাইসব–সব তোমাদের বলবো কিন্তু। তার আগে আমাকে খেতে দাও। বড্ড খিদে পেয়েছে।

বন্ধুরা ফ্রান্সিসকে প্রায় পাঁজাকোলা করে নিয়ে চলল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *