মহারাজ পটলাদেবের সঙ্গীতচর্চা
পটলার ছোট থেকেই গান গাইতে ভালো লাগে। কিন্তু আজকাল যখনই সে গান গাইতে যায় তখনই তার নতুন মা দাঁতমুখ খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলে “ষাঁঢ়ের মতো চ্যাঁচাস নি তো —কাজ নেই কর্ম নেই সারাদিন দেখ অ্যা অ্যা করে চেঁচিয়েই চলেছে। এমনি করে এতদিন চলেছে চলেছে এখন আর চলবে না –এই আমি সাফ জানিয়ে দিলুম। বাপের সাথে কাল থেকে হাটে যাবি।”
পটলা সবে সরগম দিয়ে গলা সাধতে গিয়েছিল তাতেই এতকিছু।
চোখ ফেটে জল আসে পটলার। মায়ের কথা বড্ড মনে পড়ছে পটলার।
মা ই নিজে হাতে যত্ন করে ‘সারেগামাপাধানিসা’ হারমোনিয়মে বাজাতে শিখিয়েছিল।
তারপরে বিকেলে মাঠ থেকে পটলা খেলে ফিরলে হাত পা ধুইয়ে বলতেন “পটলা ,চল এবার একটু গলা সেধে নিবি। নিয়ম করে গলা সাধতে হয়। এটা সাধনা। একে অন্তর দিয়ে নিষ্ঠা ভরে অভ্যেস করতে হয়।”
পটলাও মাকে বলত ” তবে তুমিও কি গানের সাধনা করতে মা?”
“করতাম বই কি — শীত , গ্রীষ্ম , বর্ষা ভোরবেলা উঠে রেওয়াজ করতে হতো নইলে —“
” নইলে কী হতো মা?”
“তোমার দাদুর কাছে পিটুনি খেতে হতো” — বলে একটা লম্বা নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসত পটলার মা কুমুর।
সেই নিঃশ্বাসের জোর টেনেই “জানিস পটলা, আমার বাবা বলতেন—সবার গলায় সুর থাকে না যারা মা সরস্বতীর আশীর্বাদ পায় তারাই সুরে গাইতে পারে। তাই এই আশীর্বাদকে সম্মান করিস।
বাবার বড় শখ ছিল আমি গান গেয়ে খুব নাম করি। গাইতামও বেশ।”
“তবে ছেড়ে দিলে কেন মা ?”
” ধ্যুর পাগল বিয়ের পর ওসব আর হয় নাকি মেয়েদের। যাক এবার তুই শিখবি আর গাইবি তাহলেই হবে।”
তারপর হঠাৎ করে তিনদিনের জ্বরে মা আকাশের তারা হয়ে চলে গেল।যাবার আগে পটলার হাত ধরে বলেছিল ” পটলা আমি চললাম। আমার হারমোনিয়ামটা রেখে গেলাম। আমার জন্য মন কেমন করলে গান গাইবি আমি ঠিক শুনতে পাব।”
তাই মা চলে যাবার পর থেকে পটলা হারমোনিয়ামটাকে বড় যত্ন করে। ইচ্ছে মতো গান গায়।
কিন্তু বাবা যেদিন থেকে নতুন মাকে ঘরে এনেছে সেদিন থেকেই এই হারমোনিয়ামটা নতুন মায়ের চক্ষুশূল।
মুখের কথায় কোনকাজ না হলে একদিন নতুন মা একটা হাতুড়ি দিয়ে হারমোনিয়ামটাকে ভাঙতে বসেছিল।
পটলা দৌঁড়ে এসে নতুন মা’র হাত থেকে হারমোনিয়ামটাকে বাঁচাতে পারলেও ওপরের কাঁচগুলো খানখান হয়ে যায়।
সেটা ছিল পূর্ণিমার রাত। বাড়ির সবাই খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও পটলার দু চোখে ঘুম নেই। কেঁদে কেঁদে চোখের জল যেন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
তক্তাপোষের ওপর বসে খোলা জানলার দিকে তাকাতেই চাঁদের সব চেয়ে কাছের তারাটার দিকে চোখ যায় পটলার “ঠিক যেন মায়ের মুখ। মা হেসে বলছে “মন খারাপ করতে নেই পটলা।বলেছি না –গান সাধনার জিনিস। অত সহজে কি সাধনা হয়?”
পটলা দু হাত দিয়ে চোখ মুছে নিজের মনকে শক্ত করে ফেলে।
পরেরদিন কাকভোরে মায়ের টিনের বাক্স থেকে মায়ের একটা শাড়িকে হারমোনিয়ামে বেঁধে হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়ে নিরুদ্দেশের পথে।
সারাদিন হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে পৌঁছোয় একবনে। বাইরে থেকে বনের ঘনত্ব বোঝার উপায় নেই। দুপাশে বড় বড়গাছ তার মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা।
এগিয়ে চলছে পটলা।
এমনি করে পটলাকে বনের মধ্যে যেতে দেখে একজন কাঠুরে কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বলে ” তুমি এখন এদিকে কোথায় চললে গো — সন্ধ্যে নামলেই এখানে বেড়িয়ে আসবে বন্যজন্তূজানোয়ারের দল আর সাথে ভূত প্রেত।
“আমার খুব জল তেষ্টা পেয়েছে —জল কোথায় পাব একটু বলবে।”
“হ্যাঁ ডানদিকে একটু গিয়ে বাঁদিকে গেলেই একটা ঝিল পাবে। তাড়াতাড়ি জল খেয়ে বেড়িয়ে এসো কিন্তু নাহলে বেঘোরে প্রাণ যাবে বলে দিলুম।”
ঝিলের সামনে গিয়ে হারমোনিয়ামটা গলা থেকে নামিয়ে রেখে ঝিলের ঠান্ডা জল চোখে মুখে দিয়ে দু এক আঁচলা জল খেতেই পটলার মনে হল হারমোনিয়ামটা বেজে উঠল।
নিজের মনেই হেসে ভাবে “এখানে আবার কে হারমোনিয়াম বাজাবে।”—
ভাল করে জল খেয়ে ধুতির কোঁচরে হাত মুছতে মুছতে হারমোনিয়ামটার কাছে আসতেই পটলা যা দেখল তাতে ওর ভিমড়ি খাওয়ার জোগাড়—
একা একাই হারমোনিয়ামের রিডগুলো বেজে চলেছে আর ব্লো হয়ে চলেছে।
ভাল করে চোখ মুছে হারমোনিয়ামের কাছে এসে হারমোনিয়ামটা তুলে নিতে গিলে পটলার মনে হয় কেউ যেন তার হারমোনিয়ামটাকে টেনে ধরেছে।
অনেকক্ষণ টানাটানি করেও হারমোনিয়ামটাকে তুলতে পারে না পটলা।
ক্লান্ত হয়ে ধপ করে মাটিতে বসে পড়লে কানের কাছে কেউ ফিসফিস করে বলছে “একটা গান শোনা দেখি?”
ততক্ষণে আকাশে চাঁদের আলো একটু আধটু ফুটতে শুরু করেছে। পটলার রেওয়াজ করবার সময় —
হারমোনিয়ামটা টেনে প্রথম সরগম করে গলা সেধে নেয় পটলা।
পটলার গানের আওয়াজ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে বনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে।
সরগম শেষ হতেই অজস্র হাততালির আওয়াজ শুনে পটলা কানটা চুলকে পরিষ্কার করে নেয়।
এবার আরো অবাক হয় ” আহা বড় মিষ্টি গলা রে তোর। ওয়ানস্ মোর– হোক হোক আরো একখানা গান —আহা কবে থেকে ভালো গান শুনি না।”—এই কথাগুলো শুনে।
পটলার হাত তখন ভয়ে থরথর করে কাঁপছে গলা কেমন শুকিয়ে আসছে—কোনরকমে ঢোক গিলে বলে ” তুমি –না মানে আপনি কে ? আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন ?”
“সে সব পরে শুনিস বাপু।এইটুকু বলতে পারিস আমি একজন সঙ্গীতপ্রিয় ভূত —-“
“ভূত?—-ওরে বাবা —“
” ভয় পাস না , আমি তোর কোন ক্ষতি করব না। তোর গলা শুনেই বুঝতে পারছি —তোর মধ্যে প্রতিভা আছে। ধর ধর গান ধর দেখি—“
পটলা চোখবন্ধ করে গায় “বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ”—
“আহা , এমন মন ভাল করা গান কতদিন পর শুনলাম। তবে তোর গলার আওয়াজটা বড় কম লাগছে রে —মনে হচ্ছে সাবু খেয়ে গাইলি।”
খাবারের নাম শুনে পটলার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।তাই না দেখে সঙ্গীতপ্রেমী ভূত “আহা , বাপু তুই কাঁদছিস কেন ? আমার তো তোর গান ভালো লেগেছে রে —“
তাতেও পটলাকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে ভূত বলে ” এ্যাই দ্যাখো, তাও কাঁদে — আচ্ছা বল কি বললে বিশ্বাস করবি তোর গান আমার ভালো লেগেছে।”
পটলা কাঁদতে কাঁদতে বলে “আজ সারাদিনে সাবুও জোটে নি গো —“
“আহা রে, বেচারা দাঁড়া —তোর খাবারের ব্যবস্থা করি। কি খাবি বল চাউমিন না পাস্তা ?”
চাউমিন ,পাস্তা —এগুলো পটলা টিভিতে কখনো সখনো দেখেছে তবে খায় নি কখনো —-ভূতের কাছে চাউমিন, পাস্তা পাওয়া যায় ?– ভেবে খুব অবাক হল পটলা।
ঘাড় নাড়িয়ে বললো ” না ,একবাটি মুড়ি আর বাতাসা বা চিঁড়ে গুড় হলেই চলবে।”
“সে কি রে তুই চাউমিন , পাস্তা , বার্গার , পীৎজা –এগুলো খাস না?”
“না , আমি এসব খাবার কখনো খাই নি –আর তাছাড়া আমার দেশি খাবারই ভালো।”
“বেশ ,বেশ “—- বলার সাথে সাথে পটলার সামনে একটা ধোঁয়ার কুন্ডলী এসে দাঁড়ায় আর থেকে এক ধামা মুড়ি বাতাসা আর একটাতে চিঁড়ে গুড় এসে পড়ে —সাথে একটা কাঁসার ঘটিতে একঘটি জল।
পেট ভরে খেয়ে পটলা ঘটির জলটা প্রায় শেষ করে ফেলে।
এবার আবার সেই কন্ঠস্বর “নে এবার গান শোনা দেখি ——- আমাদের ভূতের জলসার গান শুনে শুনে কান পচে গেলো —ধর দেখি— সেই গানখানা —বসে আছি পথ চেয়ে ফাগুনের গান গেয়ে ।”
ভূতের সঙ্গীতের এমন রুচিবোধ দেখে অবাক হয় পটলা— যথাসাধ্য দরদ দিয়ে গানখানা গায়।
পটলার গান শুনে বেজায় খুশী। সঙ্গীতপ্রেমী ভূত বলে “আহা মনটা ভরে গেল রে — তোর কাছে একটা জিনিস চাইবো দিবি?”
পটলা ভ্রুকুঁচকে ভাবছিল —মায়ের কাছে শুনেছি ভূতরা খুশি হয়ে নাকি বর দেয়।এ কেমন ভূত– উল্টে কিছু চাইছে।
পটলার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ” কিরে কি ভাবছিস এত —দিবি না তাই তো?”
পটলা আমতা আমতা করে বলে ” না , মানে আমার কাছে তো কিছুই নেই —তোমাকে কী দেব বলো।শুধু ঐ হারমোনিয়ামটা ছাড়া।ওটা তো আমার মায়ের , মাকে কথা দিয়েছি ওটাকে খুব যত্নে রাখব।”
ভূত খিক খিক করে হেসে বলে “আমি ভূত বলে আমাকে বোকা ভেবেছিস। যা তোর কাছে নেই তা তোর কাছ থেকে চাইব ?আমাকে একটা কথা দিবি ?”
এবার পটলাও হেসে ফেলে ” ও তাই বলো। আমি তো ভাবলাম কি না কি চাইছো —-ঠিক আছে বলো কী চাও “?
“আমার বহুদিনের শখ আমি গান শিখব —কিন্তু মনের মতো গুরুই এতদিন পাই নি। তাই মনের ইচ্ছেটা মনেই রেখেছিলাম। কিন্তু আজ তোর গান শুনে মনে হচ্ছে এবার সে শখ পূরণ হবে।”
পটলার তো না আছে ভূত না আছে ভবিষ্যৎ —তার উপর মাকে দেওয়া কথাটাও রাখার সুবর্ণ সুযোগ।
পটলা আনন্দের সঙ্গে বললো “এ তো উত্তম প্রস্তাব — আমি রাজি। কিন্তু—“
“কি ভাবছিস আমি এমনি এমনি গান শিখবো ? উঁহু একদম না — আজ থেকে তোর থাকা ,খাওয়ার দায়িত্ব আমার ।”
“আর তোমাকে গান শেখাবার দায়িত্ব আমার “—
পরদিন থেকেই শুরু হয় সঙ্গীত শিক্ষা। খুব অল্পদিনের মধ্যেই পটলার শিষ্য নিজের নিষ্ঠায় খুব ভাল গায়ক হয়ে উঠল। প্রেত জগতের সবচেয়ে বড় রিয়্যালিটি শো তে সঙ্গীতশিল্পী ভূতের গান গাইবার খুব শখ। তাই সে মনপ্রাণ দিয়ে চর্চা শুরু করে। পটলা সবধরনের গানের তালিম দিয়ে ছাত্রকে তৈরী করে ফেলে।
অডিশনেই বিচারকদের নয়নের মণি হয়ে ওঠে এই গায়ক ভূত। স্বভাবিকভাবেই গুরুর নাম জানতে চান বিচারকেরা — সঙ্গীতশিল্পী ভূত গুরুর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় বিচারকমণ্ডলীকে।
এরপর থেকে পটলাকে আর পিছন ফিরে দেখতে হয় না—
ভূতের খোকা ,খুকিদের নিয়ে ভূত ,ভূতনীরা পটলাস্যারের কাছে ধর্ণা দেয় যদি তার কাছে গান শেখবার একটা সুযোগ পাওয়া যায় —
প্রেতজগতের এখন সেলিব্রিটি সঙ্গীত গুরু মহারাজ পটলাদেব। প্রেতজগতে যুবসমাজ এখন গাছের ডালে পা দুলিয়ে বসে আড্ডা মারে না ,টিটকিরি দেয় না , চুরি ,রাহাজানিও করে না— সর্বত্র এক শান্তির পরিবেশ।
পটলাদেব বেজায় খুশি মায়ের মুখ উজ্জ্বল করতে পেরে— হলোই বা সেটা প্রেতজগতে। সঙ্গীত তো সবার জন্যই –তাই না ?