Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মর্মমূল ছিঁড়ে যেতে চায় || Shamsur Rahman

মর্মমূল ছিঁড়ে যেতে চায় || Shamsur Rahman

আজ সন্ধেবেলা চলে যাবে তুমি ভিড়াক্রান্ত সদরঘাটের
টার্মিনাল ছেড়ে।
যখন দাঁড়াবে ডেকে, হাওয়ায় উড়বে
শ্যাম্পুকরা রেশম-মসৃণ চুল, তখন তোয়ার
মুখ কোন্‌ দিকে, কোন্‌ ভঙ্গিতে স্থাপিত,
জানবো না। সৌন্দর্যখচিত সেই মুখ
তখন কি আমার সত্তার উল্টোদিকে
ফেরানো বিষণ্নতায় ছাওয়া? নাকি আমার দিকেই
প্রসারিত চুম্বনের প্রতীক্ষায় থরথর? তুমি
কখনো উচ্ছল জলরাশি
দেখবে, কখনো আসমানে লেগে থাকা
চিতার স্তিমিত আগুনের মতো কিছু আবীরের
ছোপ; যদি আরো কিছুক্ষণ
সেখানে নজর রাখো, দেখবে পাখিরা
ডানায় আমার যন্ত্রণার ভস্ম মেখে উড়ে যাচ্ছে অতিশয়
দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ের লোভে, কে জানে কোথায়।

‘আজ সন্ধেবেলা চলে যাবে তুমি’, এই
ছোট বাক্যে খৃষ্ট পূর্বকালের করুণ দীর্ঘশ্বাস, মরুচারী
কায়েসের দশদিক দীর্ণ-করা উদ্‌ভ্রান্ত, পবিত্র, ব্যক্তিগত
আর্তনাদ, ফরহাদ-রচিত অনিন্দ্য নহরের
উন্মথিত কান্না আছে আর
হঠাৎ শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের ঘ্রাণ, ঝরাপাতা
আর মৃত দোয়েলের পালকের ফিস্‌ফিসসে শিহরণ আছে,
তুমি কি জেনেছো? সন্ধ্যেবেলা
তোমার এ যাওয়া
যেন ঢাকা শহরের সব রূপ রস গন্ধ নিয়ে
চলে যাওয়া। কাল ভোর থেকে
কোনো রাগরাগিণী কলাপ মেলবে না,
এবং প্রেমিক-প্রেমিকারা
‘ভালোবাসা’ শব্দের বদলে বারংবার
‘ঘৃণা’ উচ্চারণ করে নিজেরাই বিস্ময়ের ঘোরে
ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হবে। লুটেরা, ছিঁচকে চোর দেখে
পুলিশ চম্পট দেবে করতলে প্রাণ ভোমরাটা
রেখে, গেরস্তেরা দিনদুপুরেও ভয়ে
প্রকাশ্য রাস্তায় বেরুবে না,
রাস্ট্রাদূতগণ বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক
চুক্তিপত্রে সই করা থেকে
নিয়ত বিরত থাকবেন!

পানি কেটে যাচ্ছে জলযান। হঠাৎ ফেনিল
ঢেউ এসে ঢুকে পড়ে ফ্ল্যাট বাড়িটার ছোট ঘরে,
ছিঁটে লাগে চোখে মুখে, কবিতার বই
টেবিলে শুইয়ে রেখে ভাবি সেই জলযানটির
কথা, যাকে দেখিনি কখনো, যে তোমাকে
নিয়ে যাচ্ছে গন্তব্যে তোমার। সে মুহূর্তে মনে হলো
আমার এ মুখের ওপর
ছড়িয়ে পড়েছে একরাশ কালো চুল। আজ রাতে কিছুতেই
ঘুম আসবে না; সারারাত
তোমার রেশমি চুল আঙুলে জড়িয়ে নিরিবিলি
খেলবো, কখন পূর্বদিক রাঙা হয়ে
উঠবে আবীরের ছোপে, যেমন ঈষৎ
লজ্জায় তোমার গাল। অলৌকিক পঞ্চ ডাল থেকে
যুঁই চামেলীর মতো ঝরে যাবে হৃদয়ে কবিতা,
তুমি আর কবিতা নিমেষে একাকার। ছিটিয়ে স্মৃতির পানি
জলযান যাচ্ছে চলে আমার হৃদয় ভেদ করে।

সূর্যোদয়ে আহত আলোর মৃত্যুচিহ্ন দেখে ফেলে
আমার আপন কবিতার খাতা মরাল সঙ্গীত
গেয়ে ডুবে যাবে
সুদূর মানস সরোবরে নাকি বিদ্রোহ বিদ্রোহ
বলে রুদ্র রোষে ফেটে পড়বে, চৌদিকে
ব্যাপক ছড়িয়ে দেবে মোহন আতশবাজি। তুমি
কেবিনে ঘুমুবে গুটিসুটি
অথবা নামবে ঘাটে, বহুদিনকার
বন্ধ জানালাটা খুলে দিয়ে গাছগাছালির স্তব্ধ শ্যামলিমা
মেখে নেবে চোখে, তখন কি মনে পড়বে তোমার
বেকার কবির কথা যে সংঘের ভেতরে থেকেও
চকিতে কেমন একা, ভীষণ একলা হয়ে যায়।
তুমি চলে যাবার পরেই শুরু হলো একটানা
টিপ্‌ টিপ্‌ বৃষ্টি, যেন গাছের সবুজ পাতা, ছাদের কার্ণিশ
থেকে ঝরে অবিরল ব্যথিত রাজধানীর অশ্রুজল।
তুমি নেই বলে কিছুতেই শহরের
ক্রন্দন থামে না। গুলীবিদ্ধ চখার চৌদিকে চখী
চক্রাকারে উড়ে উড়ে কাঁদে যে ধরনে
অবিকল সে রকম আর্তনাদ করে এ শহর,
মর্মমূল ছিঁড়ে যেতে চায়।

তুমি চলে যাবার পরেই
টিপ্‌ টিপ্‌ বৃষ্টি, এ শহর
কেমন হতশ্রী হয়ে গ্যাছে, দেখে যাও একবার।
আসবে কদিন পরে? অপেক্ষায় আছি নিত্যদিন,
যেমন প্রকৃত
মোমিন থাকেন প্রতীক্ষায় ঈদের চাঁদের জন্যে রমজানে।

আমার নিকট থেকে কতদূরে চলে গ্যাছো শরীরে জড়িয়ে
আসমান। কতকাল কেটে গেল, তবু
আসোনি এখানে ফিরে স্যুটকেস হাতে,
কপালে খয়েরি টিপ, অনিদ্রার ছাপ
টাঙ্গাইল শাড়ীটির ভাঁজে। প্রেমের দেবতা বুঝি
ফৌত হয়ে গেছেন হঠাৎ
গুপ্ত ঘাতকের হাতে। নইলে কেন আজ
দিগঙ্গনা জুড়ে
দিয়েছে বিলাপ আর আমার প্রেমের
পদাবলী কেবলী আছড়ে পড়ে, মাথা কোটে শিলাতটে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *