Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

মাধবী পৌর্ণমাসীর প্রভাতে স্থবির পিথুমিত্ত সঙ্ঘের এক প্রকোষ্ঠে বসিয়া পাতিমোক্ষ পাঠ করিতেছিলেন। সঙেঘর একমাত্র শ্রমণ, ভিক্ষু উচণ্ড তাঁহার সম্মুখে মেরু-যষ্টি ঋজু করিয়া স্থিরভাবে বসিয়াছিলেন। শ্রোতা কেবল তিনিই।

দীর্ঘ পঞ্চদশ বৎসর উভয়ের দেহেই কালকরাঙ্ক চিহ্নিত করিয়া দিয়াছে। সঙ্ঘ-স্থবিরের বয়স এখন ন্যূনকল্পে সত্তর বৎসর। মুণ্ডিত মস্তকে মেদহীন চর্মের আবরণতলে করোটির আকৃতি সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে, দেখিয়া শুষ্ক দাড়িম্বফলের ন্যায় মনে হয়। চক্ষুতারকা বর্ণহীন, দৃষ্টি নিষ্প্রভ—যেন মরুভূমির উষ্ণ নিশ্বাসে চোখের জ্যোতি নির্বাপিত হইয়াছে। তবু, এই জরা-বিশীর্ণ মূর্তির চারি পাশে জীবনব্যাপী সচ্চিন্তা ও শুচিতার মাধুর্য একটি সূক্ষ্ম অতীন্দ্রিয় শ্রী রচনা করিয়া রাখিয়াছে। ত্রিতাপ তাঁহার চিত্তকে স্পর্শ করিতে পারে নাই।

ভিক্ষু উচণ্ডেরও যৌবন আর নাই; বয়ঃক্রম অনুমান পঁয়তাল্লিশ বৎসর। কিন্তু দেহ এখনও সবল ও দৃঢ়। সমান্তরালরেখা-চিহ্নিত ললাট-তটে ঘন রোমশ ভ্রূ দুই-একটি পাকিতে আরম্ভ করিয়াছে। চোখের দৃষ্টি কঠোর ও বৈরাগ্যব্যঞ্জক। তাঁহাকে দেখিয়া মনে হয়, প্রকৃতির সহিত নিরন্তর যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হইয়াও তিনি পরাভব স্বীকার করেন নাই; বিদ্রোহীর সদা-জাগ্রত যুযুৎসা তাঁহার ছিন্ন গলিত চীবর ভেদ করিয়া বাহির হইতেছে।

পাতিমোক্ষ পাঠ শেষ হইল। নিদান হইতে অধিকরণ শমথ পর্যন্ত বিবৃত করিয়া পরিশেষে স্থবির বলিলেন, হে মাননীয় ভিক্ষু, আপনার নিকট পারাজিক সংঙ্ঘাদিশেষ প্রভৃতি ধর্ম আবৃত্তি করিলাম। শেষবার প্রশ্ন করিতেছি, যদি কোনও পাপ করিয়া থাকেন খ্যাপন করুন, আর যদি পাপ না করিয়া থাকেন, নীরব থাকুন।

দীর্ঘ পাতিমোক্ষ পাঠ শুনিতে শুনিতে ভিক্ষু উচণ্ড বোধ করি আত্মস্থ হইয়া পড়িয়াছিলেন, অথবা বিষয়ান্তরে তাঁহার মন সংক্রামিত হইয়াছিল; স্থবিরের শেষ জিজ্ঞাসা কর্ণে যাইতেই তিনি চকিত হইয়া একবার নিজের উভয় পার্শ্বে দৃষ্টিপাত করিলেন। তাঁহার ললাটের ভ্রুকুটি যেন ঈষৎ গভীরতর হইল। ওষ্ঠাধর দৃঢ়বদ্ধ করিয়া তিনি মৌন হইয়া রহিলেন।

স্থবির তখন কহিলেন, হে মাননীয় ভিক্ষু, আপনার মৌনভাব দেখিয়া জানিলাম আপনি পরিশুদ্ধ আছেন। মনে হইল এই বাক্যের সঙ্গে সঙ্গে তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস মোচন করিলেন।

অনুষ্ঠান শেষ হইল।

দিবা তখনও প্রথম প্রহর অতীত হয় নাই। অলিন্দপথে তির্যক সূর্যরশ্মি প্রবেশ করিয়া কক্ষের ম্লান ছায়াচ্ছন্নতা দূর করিয়াছে। উভয়ে এই তরুণ রবিকর অনুসরণ করিয়া বাহিরের দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন। স্বণাভ সিকতার পটভূমিকায় কয়েকটি আন্দোলিত খর্জুরশীর্ষ চোখে পড়িল।

উভয়ে গাত্রোত্থান করিলেন।

সহসা উচণ্ড কহিলেন, থের, একটি কথা আপনাকে বলিবার অভিলাষ করিয়াছি। নির্বাণকে উপসম্পদা দান করা কর্তব্য; তাহার বিংশ বর্ষ বয়ঃক্রম হইয়াছে।

স্থবির উচণ্ডের মুখের পানে চাহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে বলিলেন, নির্বাণের যথার্থ বয়ঃক্রম বিংশ বর্ষ কি না তাহা আমরা জ্ঞাত নহি।

উচণ্ডের কণ্ঠস্বরে ঈষৎ অধীরতা প্রকাশ পাইল, তিনি কহিলেন, এস্থলে অনুমানই যথেষ্ট।

স্থবির ক্ষণেক নীরব থাকিয়া বলিলেন, নির্বাণ কি উপসম্পদা লইতে ইচ্ছুক?

উচণ্ড কহিলেন, অবশ্য ইচ্ছুক। সঙ্ঘের উপাসকরূপে সে এত কাল আমার নিকট শিক্ষা গ্রহণ করিয়াছে। সঙেঘই সে পালিত ও বর্ধিত, সঙ্ঘ ভিন্ন তাহার স্থান কোথায়?

স্থবির আবার রবিকরোজ্জ্বল বহিঃপ্রকৃতির পানে ক্ষণকাল চাহিয়া রহিলেন, শেষে বলিলেন, ভাল, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখা যাউক। আবার মনে হইল একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল।

উচণ্ড তীক্ষ্ণ চক্ষে স্থবিরের পানে চাহিলেন; একবার যেন কিছু বলিতে উদ্যত হইলেন, কিন্তু পরক্ষণেই বা সংযত করিয়া বলিলেন, উত্তম! তাহাকে আপনার নিকট ডাকিয়া আনিতেছি। বলিয়া তিনি সঙ্ঘের বাহিরে চলিলেন।

গত পঞ্চদশ বৎসরে বিহারের বহিরাকৃতির কোনও পরিবর্তন হয় নাই, বালুঝটিকার পর যেমন অর্ধপ্রোথিত ছিল তেমনই আছে। যে বিরাট বালুপ তাহাকে আবৃত করিয়াছিল তাহা হইতে মুক্ত করা দুই জন মানুষের সাধ্য নয়। উপরিতলের কয়েকটি প্রকোষ্ঠ কোনক্রমে পরিকৃত হইয়াছিল, তাহাতেই ভিক্ষুদ্বয় শিশু দুইটিকে লইয়া আশ্রয় লইয়াছিলেন। সঙেঘর নিম্নতল চিরতরে অবরুদ্ধ হইয়া গিয়াছিল।

সঙ্ঘ হইতে অবতরণ করিয়া উচণ্ড খর্জুরকুঞ্জের দিকে চলিলেন।

খর্জুরকুঞ্জের ছায়ায় গুহানিঃসৃত প্রস্রবণের মন্দ স্রোত স্বচ্ছ ধারায় বহিয়া গিয়াছে। কাকচক্ষু জল, মাত্র বিতস্তিপ্রমাণ গভীর, নিম্নে বালুকার আকুঞ্চিত স্তর দেখা যাইতেছে।

গুহামুখের সন্নিকটে নির্বাণ অধোমুখে শয়ান হইয়া মৃদুপ্রবাহিত জলধারার প্রতি চাহিয়া ছিল, দুই বাহুর উপর চিবুক ন্যস্ত করিয়া অন্যমনে কি জানি চিন্তা করিতেছিল। খর্জুরশাখার রন্ধ্রচ্যুত এক ঝলক রৌদ্র তাহার পৃষ্ঠের উপর পড়িয়া তাহার স্বর্ণাভ দেহবর্ণকে মার্জিত ধাতুফলকের ন্যায় উজ্জ্বল করিয়া তুলিতেছিল। ঋজু নাতিমাংসল দেহে কেবল একটি শুভ্র বহিবাস, কটি হইতে জানু পর্যন্ত আবৃত। উন্মুক্ত স্কন্ধ বাহু ও বক্ষ দৃঢ় পেশীবদ্ধ। মস্তকের কৃষ্ণ কেশ সর্পশিশুর মতো মুখমণ্ডলকে বেষ্টন করিয়া আছে। যৌবনের নবারুণ ঊষালোকে নির্বাণের দেহকান্তি দেখিয়া গ্রীক ভাস্করের রচিত ভাস্কর-দেবতার মূর্তি মনে পড়ে। কিন্তু তাহার মুখে ভাস্কর-দেবতার বিজয়দৃপ্ত গর্বের ব্যঞ্জনা নাই; নবযৌবনের স্বাভাবিক পৌরুষের সহিত চিৎ-শক্তির এক অপরূপ করুণ মাধুর্য মিশিয়াছিল, গ্রীক ভাস্কর এই অপূর্ব সংমিশ্রণ পরিকল্পনা করিতে পারিতেন না।

প্রস্রবণের দিকে চাহিয়া নির্বাণ চিন্তা করিতেছিল। কি গহন দুরবগাহ তাহার চিন্তা সে নিজেই জানে না। নিষ্পলক দৃষ্টি অগভীর জলের স্তর ভেদ করিয়া নিম্নে, আরও নিম্নে, পৃথিবীর কেন্দ্রগুহায় যেখানে কেবল নিরাসক্ত প্রাণধর্মের ক্রিয়া চলিতেছে—বোধ করি সেইখানেই উপনীত হইয়াছিল। বহিঃপ্রকৃতির প্রতি তাহার মন ছিল না। কিন্তু তথাপি, এই অন্তর্মুখী তন্ময়তার মধ্যেও তাহার চক্ষু এবং শ্রবণেন্দ্রিয় অলক্ষিতে সতর্ক উৎকর্ণ হইয়া ছিল।

সহসা তাহার বক্ষ বিস্ফারিত করিয়া একটি গভীর নিশ্বাস নির্গত হইল।

কিছু দিন যাবৎ নির্বাণের মনে এক ভীষণ বিপ্লব উপস্থিত হইয়াছে। যাহারা শিশুকাল হইতে একসঙ্গে বর্ধিত হয়, তাহাদের মনে পরস্পর সম্বন্ধে প্রায় কোনও মোহ থাকে না; নির্বাণের মনেও ইতি সম্বন্ধে মোহ ছিল না। বরং ইতি স্ত্রীসুলভ নমনীয়তায় নির্বাণকে পুরুষত্ব ও বয়োজ্যেষ্ঠতার মর্যাদা দিয়া সসম্ভ্রমে তাহার পিছন পিছন ঘুরিয়াছে। দুজনে কলহ করিয়াছে, আবার গলা জড়াজড়ি করিয়া খেলা করিয়াছে। বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে ইতির দেহে যৌবনের মুকুলোদগম হইয়াছে, আয়ত নীল চোখে সৃষ্টির অনাদি কুহক ফুটিয়া উঠিয়াছে, কিন্তু নির্বাণের মনে ভাবান্তর আসে নাই। ইতি যে নারী এ অনুভূতি তাহার অন্তরকে স্পর্শ করে নাই। এইভাবে পঞ্চদশ বর্ষ কাটিয়াছে। তারপর সহসা একদিন নির্বাণের মনের কৌমার্য পরিণত ফলের প্রান্ত হইতে শীর্ণ পুষ্পদলের মতো খসিয়া গেল।

সেদিন দ্বিপ্রহরে নির্বাণ একাকী খর্জুরকুঞ্জে দাঁড়াইয়া ঊর্ধ্বমুখে একটা ভ্রমরের গতিবিধি নিরীক্ষণ করিতেছিল। ভ্রমরটা প্রতি বৎসর এই সময় কোথা হইতে আসিয়া উপস্থিত হয়, বহু দূরান্তর হইতে বোধ হয় বাতাসের মুখে বার্তা পায়—মরুর খর্জুরশাখায় ফুল ধরিয়াছে। কৃষ্ণকায়। ভ্রমর, পাখায় রামধনুর বর্ণ; সে গভীর গুঞ্জন করিয়া এক পুষ্পমঞ্জরী হইতে অন্য পুষ্পমঞ্জরীতে উড়িয়া যাইতেছে, নিঃশব্দে পুষ্পপাত্রে সঞ্চিত রস পান করিতেছে, আবার উড়িয়া যাইতেছে। নির্বাণ উজ্জ্বল কৌতূহলী চক্ষে মুগ্ধ হইয়া এই দৃশ্য দেখিতেছিল।

সহসা ইতি পিছন হইতে আসিয়া দুই বাহু দ্বারা নির্বাণের গলা জড়াইয়া ধরিল; উত্তেজনা-সংহত স্বরে তাহার কর্ণে বলিল, নির্বাণ, একটা জিনিস দেখিবে?

ইতি স্বচ্ছন্দচারিণী, মরুভূমির যত্রতত্র ঘুরিয়া বেড়ায়; কোথায় বালুর তলে শাখাপত্রহীন মূল বা কন্দ লুক্কায়িত আছে, আহরণ করিয়া আনে। মরুর নিপ্রাণ বক্ষে যাহা কাহারও চক্ষে পড়ে না, তাহা ইতির চক্ষে পড়ে।

নির্বাণ ভ্রমরের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া বলিল, কি?

ইতি দুই হস্তে সবলে তাহার মুখ নিজের দিকে ফিরাইল, বলিল, এস, দেখিবে এস। বলিয়া তাহার হাত ধরিয়া শবরীর মতো নিঃশব্দ পদে লইয়া চলিল। নির্বাণ দেখিল, আনন্দ-উদ্দীপনায় তাহার দুই চক্ষু নৃত্য করিতেছে।

ওয়েসিসের সীমান্ত পার হইয়া তাহারা মরুভূমির উপর বহুদূর গমন করিল। মধ্যাকাশে জ্বলন্ত সূর্য, চারিদিকে কোটি কোটি বালুকণায় তাহার তেজ প্রতিফলিত হইতেছে। দুজনে নীরবে চলিয়াছে, মাঝে মাঝে ইতি নির্বাণের মুখের পানে প্রোজ্জ্বল চক্ষু তুলিয়া চুপি চুপি দু-একটি কথা বলিতেছে—যেন জোরে কথা বলিলেই তাহার রহস্যময় দ্রষ্টব্য বস্তু মায়ামৃগের ন্যায় মুহূর্তে

অন্তর্হিত হইবে।

প্রায় এক ক্রোশেরও অধিক পথ চলিবার পর সম্মুখে একটা প্রকাণ্ড বালিয়াড়ি পড়িল। সেই বালিয়াড়ির কূর্মপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া ইতি দিগন্তের প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, ঐ দেখ।

অঙ্গুলির নির্দেশ অনুসরণ করিয়া নির্বাণ সহসা বিস্ময়ে নিস্পন্দ হইয়া গেল। দূরে দিগন্তরেখা যেখানে আকাশে মিশিয়াছে সেইখানে একটি হরিদ্বর্ণ উদ্যান-শ্যামল তরুশ্রেণী বাতাসে আন্দোলিত হইতেছে, তৃণপূর্ণ প্রান্তরে মেষ-ছাগ চরিতেছে; এমন কি, আকাশে নানা আকৃতির পাখি উড়িতেছে, তাহাদের ক্ষুদ্র দেহ সঞ্চরমাণ বিন্দুর মতো দেখা যাইতেছে। একটি নদী এই নয়নাভিরাম শ্যামলতার বুক চিরিয়া খরধার তরবারির মতো পড়িয়া আছে।

বিস্ময়ের প্রথম অভিভূতির পর প্রতিক্রিয়া আসিল, নির্বাণ উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিল। ইতি অপেক্ষা তাহার জ্ঞান বেশি।

ইতি কিন্তু উত্তেজনার আতিশয্যে নির্বাণের গলা বাহুবেষ্টিত করিয়া প্রায় ঝুলিয়া পড়িল, মুখের কাছে মুখ লইয়া গিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিল, দেখিতেছ? নির্বাণ, দেখিতেছ? কি সুন্দর! চল, আমরা দুইজনে ঐখানে চলিয়া যাই। আর কেহ থাকিবে না, শুধু তুমি আর আমি। —চল, চল নির্বাণ।

স্মিতমুখে নির্বাণ তাহার পানে চাহিল। ইতির পলাশরক্ত অধর নির্বাণের এত নিকটে আসিয়াছিল যে, কিছু না বুঝিয়াই সে নিজ অধর দিয়া তাহা স্পর্শ করিল। সঙ্গে সঙ্গে তাহার মুখ বিবর্ণ হইয়া গেল, হৃৎপিণ্ডের মধ্যে রক্ত তোলপাড় করিয়া উঠিল। দেহের অভ্যন্তর হইতে স্নায়ুর সীমান্ত পর্যন্ত একটা অনির্বচনীয় তীক্ষ্ণ অনুভূতি অসহ্য হর্ষ-বেদনায় তাহাকে নিপীড়িত করিয়া তুলিল। সে থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল।

প্রথম চুম্বনের স্পর্শে ইতি দংশনোদ্যতা সর্পিণীর মতো গ্রীবা পশ্চাতে আকর্ষণ করিয়া নির্বাণের মুখের পানে চাহিল। মনে হইল তাহার নীল নেত্র হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বর্ষণ হইতেছে। ক্ষণকাল এইভাবে থাকিয়া সে দুরন্ত ঝড়ের মতো আবার নির্বাণের বুকের উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল। একবার দুইবার, অগণিত বার নির্বাণের অধর চুম্বন করিতে করিতে অবশেষে যেন নিজের দুর্জয় আবেগের নিকট পরাজিত হইয়া শিথিল দেহে অবনত মুখে বালুর উপর বসিয়া পড়িল। শ্রান্ত ঝড়ের অবসন্ন আক্ষেপের মতো তাহার বক্ষ হইতে এক প্রকার অবরুদ্ধ আর্তশ্বাস বাহির হইতে লাগিল।

নির্বাণও জানু মুড়িয়া তাহার পাশে বসিয়া পড়িল। অকস্মাৎ এ কি হইয়া গেল! এই অজ্ঞাতপূর্ব অচিন্তনীয় আবির্ভাবের সম্মুখে উভয়ে যেন বিমূঢ় হইয়া রহিল।

বহুক্ষণ দুইজনে এইভাবে অগ্নিবর্ষী আকাশের তলে বসিয়া রহিল। তারপর শুষ্ক তপ্ত চক্ষু তুলিয়া দিগন্তের পানে চাহিল। শ্যামল উপবন তখন অদৃশ্য হইয়াছে।

অস্ফুট স্বরে নির্বাণ বলিল, মরীচিকা।

সেই দিন হইতে নির্বাণের সহিত ইতির সহজ সরল সখ্যের অবসান হইল; নির্বাণ যেন ইতিকে ভয় করিয়া চলিতে আরম্ভ করিল। তাহাকে দূর হইতে দেখিয়া সে সঙ্কুচিত হইয়া উঠে, তাহার সহিত কথা বলিতে রসনা জড়িত হয়, মুখ উত্তপ্ত হইয়া উঠে; অথচ অন্তরের অন্তস্থল হইতে একটা দুর্নিবার আকর্ষণ তাহাকে ইতির দিকে টানিতে থাকে। ইতির তপ্ত কোমল অধর স্পর্শের স্মৃতি মাদক সুরার মতো তাহার চিত্তকে বিশৃঙ্খল করিয়া তোলে। সে এই সর্বগ্রাসী মোহের আক্রমণ হইতে দূরে নির্জনে পলায়ন করিতে চায়।

ইতির মনোভাব কিন্তু সম্পূর্ণ বিপরীত; এত দিন সে নির্বাণের খেলার সাথী ছিল, অনুজা সখী ছিল, আজ বিপুল নারীত্বের সঙ্গে সঙ্গে সে নির্বাণকেও যেন সম্পূর্ণ নিজস্বভাবে পাইয়াছে। নির্বাণ তাহারই, আর কাহারও নয়—নিজ অধর, দেহ, নারীত্বের নিয়ে সে নির্বাণকে আপন করিয়া লইয়াছে। এই চূড়ান্ত দাবির কাছে পৃথিবীর অন্য সমস্ত দাবি মাথা নীচু করিয়া থাকিবে।

তাহার আচরণে, এমন কি চাহনিতে ও দেহভঙ্গিমায় এই অবিসম্বাদী অধিকারের গর্ব পরিস্ফুট হইয়া উঠিতে লাগিল। নারী ও পুরুষের প্রভেদ বোধ করি এইখানে।

ইহাদের অন্তরের এই বিপ্লব অন্য দুইজনের কাছেও গোপন রহিল না। মনুষ্যসমাজে যাহা লজ্জা নামে পরিচিত তাহা ইতি কোনও দিন শিখে নাই, তাই তাহার মনের কথাটি কুণ্ঠাহীন অলজ্জিত আনন্দে প্রকাশ পাইল। পিথুমিত্ত ও উচণ্ড সব দেখিলেন, বুঝিলেন। স্থবিরের বর্ণহীন। চক্ষু করুণায় নিষিক্ত হইয়া উঠিল; এত দিন যাহা আশঙ্কিত সম্ভাবনা ছিল, আজ তাহা সত্য হইয়া উঠিয়াছে। হায় তথাগত, সঙেঘর বৈরাগ্যভস্মের মাঝখানে এ কোন ভঙ্গুর সুকুমার পুষ্প ফুটাইয়া তুলিলে! ভিক্ষু উচণ্ডের কঠোর ললাটে কিন্তু আঁধির অন্ধকার পুঞ্জিত হইয়া উঠিল। তিনি অন্তরমধ্যে গর্জন করিতে লাগিলেন, মার প্রবেশ করিয়াছে! সঙেঘ মার প্রবেশ করিয়াছে!

প্রথম দিন হইতেই ক্ষুদ্র মানবিকা ইতির প্রতি ভিক্ষু উচণ্ডের মনে একটা বিমুখতা জন্মিয়াছিল। ভিক্ষুর মনে ভেদজ্ঞান থাকিতে নাই; কিন্তু ভিক্ষু উচণ্ড নির্বাণকে কাছে টানিয়া লইলেন, ইতিকে দূরে দূরে রাখিলেন। নির্বাণ ধর্ম-বিষয়ে শিক্ষা পাইতে লাগিল, ইতি মরুবিহারিণী প্রকৃতিকন্যা হইয়া রহিল। ইতির দেহে যখন প্রথম যৌবন-লক্ষণ প্রকাশ পাইল, সর্বাগ্রে উচণ্ডই তাহা লক্ষ্য করিলেন। তাঁহার বিমুখতা গভীর আক্রোশে পরিণত হইল; ভিক্ষুর নিপীড়িত ব্যর্থ যৌবন যেন ইতির মূর্তি ধরিয়া নিরন্তর তাঁহাকে কশাঘাত করিতে লাগিল। জর্জরিত উচণ্ডের মস্তিষ্কে সঙ্গীতের ধ্রুবপদের ন্যায় কেবল ধ্বনিত হইতে লাগিল—মার প্রবেশ করিয়াছে! মার প্রবেশ করিয়াছে!

নির্বাণের প্রতিও তাঁহার আচরণ কঠোর হইয়া উঠিল। তিনি দেখিলেন, ইতি সর্বদা নির্বাণের সঙ্গে ঘুরিতেছে, এক দণ্ড উভয়ে পৃথক থাকে না। তাঁহার বক্ষে অগ্নিশলাকা বিদ্ধ হইতে লাগিল। মার প্রবেশ করিয়াছে—ইতি নির্বাণকে প্রলুব্ধ করিবে! তার পর? বুদ্ধের সঙ্ঘ ব্যভিচারের আগার হইয়া উঠিবে! কখনও না—কখনও না! উচণ্ড নির্বাণকে সুকঠিন ব্রহ্মচর্য শিক্ষা দিতে আরম্ভ করিলেন। মনে হইতে লাগিল তিনি নির্বাণকে উপলক্ষ করিয়া ভিক্ষু-জীবনের পরুষ নির্মমতা নূতন করিয়া সঙেঘ প্রবর্তন করিতেছেন।

নিগৃহীত নিপীড়িত আকাঙ্খা যখন বিকলাঙ্গ মূর্তিতে বাহির হইয়া আসে, তখন তাহার স্বরূপ সকলে চিনিতে পারে না। সঙেঘ সত্যই মার প্রবেশ করিয়াছিল—কিন্তু কাহার দুর্বলতার ছিদ্রপথে প্রবেশ করিয়াছিল তাহা ভিক্ষু উচণ্ড জানিতে পারেন নাই।

মরুভূমির স্বল্পায়ু বসন্ত এইভাবে নিঃশেষ হইয়া আসিল। ইতিমধ্যে নির্বাণ ও ইতির মনোভাব প্রকট হইয়া পড়িল। তখন একদিন মাধবী পূর্ণিমার প্রভাতে উচণ্ড নির্বাণকে উপসম্পদা দান করিয়া পরিপূর্ণ রূপে সঙেঘর নিয়মাধীন করিবার প্রস্তাব করিলেন।

Pages: 1 2 3 4

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress