মন্টুর মাস্টার
বি এ পাস করে বসে আছে মিহির, কী করবে কিছুই স্থির নেই। এমন সময়ে দৈনিক আনন্দবাজার-এ একটা বিজ্ঞাপন দেখল কর্মখালির। কোনো বনেদি গৃহস্থের একমাত্র পুত্রের জন্য একজন বি এ পাস গৃহশিক্ষক চাই—আহার ও বাসস্থান দেওয়া হইবেক, তা ছাড়া বেতন মাসিক ত্রিশ টাকা।
বিজ্ঞাপনটা পড়েই লাফিয়ে উঠল মিহির। এইরকমই একটা সুযোগ খুঁজছিল সে…খাওয়া-থাকাটা অমনিই হবে, তা ছাড়া ত্রিশ টাকা মাস মাস—কিছু কিছু বাড়িতেও পাঠাতে পারবে, এম এ-টাও পড়া হবে সেইসঙ্গে, সিনেমা ফুটবল ম্যাচ দেখার মতো পকেট-খরচারও অভাব হবে না।
একবার তার মনে হল এই বিজ্ঞাপনটা এর আগেও যেন দেখেছে সে—ওই আনন্দবাজার-এ। হ্যাঁ, প্রায়ই সেদেখেছে। গতবছরও দেখেছিল, তখনই তার ইচ্ছা হয়েছিল একটা আবেদন করে দেয়, কিন্তু তখনও সেবি এ পাস করেনি। খুব সম্ভব ছেলেটি একটি গবাকান্ত—তাই বেতন ভারী দেখে কেউ এগোলেও ছেলে আবার তার চেয়ে ভারী দেখে পিছিয়ে পড়ে।
সেকিন্তু পেছোবে না, প্রাণপণে পড়াবে ছেলেটাকে—পড়তে গিয়ে যদি পাগল হয়ে যেতে হয় তবুও। ত্রিশ টাকা কম টাকা নয়—তার জন্য গাধা পিটিয়ে মানুষ করা আর বেশি কথা কী, মানুষ পিটিয়েও গাধা বানানো যায়। ভদ্রলোক অতগুলো টাকা কি মাগনা দিচ্ছেন নাকি?
বিকেলেই মিহির সেই ঠিকানায় গেল। বি এ-র সার্টিফিকেটটা সঙ্গেই নিয়ে গেছল কিন্তু ভদ্রলোক তা দেখতেও চাইলেন না, কেবল মিহিরকে পর্যবেক্ষণ করলেন আপাদমস্তক। মিহিরই যেন মিহিরের সার্টিফিকেট, মিহির খুশিই হল এতে।
অবশেষে ভদ্রলোক বললেন, ‘তোমার জামাটা একবার খোলো তো বাপু?’
মিহির ইতস্তত করে। জামা খুলতে হবে কেন? বুঝতে পারে না সে!
—‘আপত্তি আছে তোমার?’
—‘না, না।’ মিহির জামাটা খুলে ফ্যালে। ত্রিশ টাকার জন্য জামা খোলা কেন, যদি জামাই হতে হয় তাতেও রাজি।
—‘তুমি এক্সারসাইজ কর?’
—‘এক-আধটু!’
—‘বেশ বেশ।’ ভদ্রলোককে একটু চিন্তান্বিত দেখা যায়। মিহির ভাবে, এক্সারসাইজ করার অপরাধে চাকরিটা খোয়াল না তো? নাই বলত কথাটা, কিন্তু কী করেই-বা সেজানবে যে ভদ্রলোক এক্সারসাইজের উপর এমন চটা। কিন্তু এও তো ভারি আশ্চর্য, সেগ্রাজুয়েট কি না, কোন বছরে পাস করেছে এসবের কিছুই তিনি জিজ্ঞেস করছেন না।
—‘আর একটা কথা খালি জিজ্ঞাসা করব তোমায়।’
মিহির পকেটের মধ্যে সার্টিফিকেটটা বাগিয়ে ধরে—এইবার বোধ হয় সেই প্রশ্নটা আসবে! আর সেউত্তর দিয়ে চমৎকৃত করে দেবে যে বি এ-তে সেফার্স্ট ক্লাস উইথ ডিস্টিংশন পেয়েছে।
ভদ্রলোক মিহিরকে আর একবার ভালো করে দেখে নিয়ে বললেন, ‘তোমার শরীরটা নেহাত মন্দ নয়। ওজন কত তোমার!’
‘ওজন?’ আকাশ থেকে পড়ে মিহির—অবশেষে কিনা এই প্রশ্ন—‘তা প্রায় দু-মনের কাছাকাছি।’
—‘বেশ বেশ। কিছুদিন টিকতে পারবে তুমি, আশা হয়। কী বলিস মন্টু, তোর এ মাস্টারমশাই কিছুদিন টিকে যাবে, কী মনে হয় তোর?’
মিহিরের ছাত্র কাছেই দাঁড়িয়েছিল, সেসায় দিল—‘হ্যাঁ বাবা, এ মাস্টারমশায়ের গায়ে অনেক রক্ত আছে।’
ভদ্রলোক অবশেষে তাঁর রায় প্রকাশ করলেন—‘কিছুদিন টেকা আশার কথা, বেশ কিছুদিন টেকাটাই হল আশঙ্কার। যাক, সবই শ্রীভগবানের হাত—’
মন্টু বাধা দিল—‘ভগবানের হাত নয় বাবা, শ্রী ছার—’
—‘চুপ! কথার উপর কথা কস কেন? কিছু বুদ্ধিশুদ্ধি হল না তোর। হ্যাঁ, দ্যাখো বাপু, পড়াশুনোর সঙ্গে এটিকেটও একে শেখাতে হবে। পিতা-মাতা গুরুজনদের কথার উপর কথা বলা, অতিরিক্ত হাসা—এইসব মহৎ দোষ সারাতে হবে এর। বেশ, আজ থেকেই ভরতি হলে তুমি। ত্রিশ টাকাই বেতন হল, মাসের পয়লা তারিখেই মাইনে পাবে, কিন্তু একটা শর্ত আছে। পুরো এক মাস না পড়ালে, এমনকী একদিন কম হলেও একটা টাকাও পাবে না। পাঁচ দিন, দশ দিন পড়িয়ে অনেক প্রাইভেট টিউটার ছেড়ে চলে গেছে, সেরকম হলে আমি বেতন দিতে পারি না, সেকথা আমি আগেই বলে রাখছি—’
মন্টু বলল, ‘একজন কেবল বাবা উনত্রিশ দিন পর্যন্ত ছিলেন—আরেকটা দিন যদি কোনোরকমে থাকতে পারতেন, কিন্তু কিছুতেই পারলেন না।’
—‘থাম। তা তোমার জিনিসপত্র সব নিয়ে এসো গে। আজ সন্ধ্যা থেকেই ওকে পড়াবে। মন্টু, যা, মাস্টারমশায়ের ঘরটা দেখিয়ে দে, আর ছোট্টু রামকে বলে দে বেতন-নিবারকে মাস্টারমশায়ের বিছানা পেড়ে দিতে।’
আগাগোড়াই অদ্ভুত ঠেকছিল মিহিরের, কিন্তু ত্রিশ টাকা—এক সঙ্গে ত্রিশ টাকা মাসের পয়লা তারিখে পাওয়াটাও কম বিস্ময়ের নয়। চিরকাল মাস গেলে টাকা দিয়েই সেএসেছে—কলেজের টাকা, মেসের টাকা, খবরের কাগজওয়ালার টাকা। এই প্রথম সেমাস গেলে নিজে টাকা পাবে। এই অনির্বচনীয় বিস্ময়ের প্রত্যাশায় ছোটোখাটো বিস্ময়গুলো সেগা থেকে ঝেড়ে ফেলল।
সন্ধ্যার আগেই সেজিনিসপত্র নিয়ে ফিরল। বেশ ঘরখানি দিয়েছে তাকে—ভারি পছন্দ হল তার। এমন সাজানো-গোছানো ঘরে এর আগে থাকেনি কখনো। একধারে একটা ড্রেসিং টেবিল—পুরোনো হোক, বেশ পরিষ্কার। একটা ছোটো বুককেসও আছে—তার বইগুলি সাজিয়ে রাখল তাতে। আর একধারে পড়াশুনোর টেবিল, তার দু-ধারে দুটো চেয়ার—বুঝল, এই ঘরেই পড়াতে হবে মন্টুকে। সবচেয়ে সেচমৎকৃত হল নিজের বিছানাটা দেখে।
ঘরের একপাশে একখানা খাট, তাতেই তার শোবার বিছানা। চমৎকার গদি-দেওয়া, তার উপরে তোশক, তার উপরে ধবধব করছে সদ্য পাটভাঙা বোম্বাই চাদর। ভারি ভদ্রলোক এরা,— না, কেবল ভদ্র বললে এদের অপমান করা হয়। যথার্থই এরা মহৎ লোক।
সত্যিই খাটে শোবার কল্পনা তার ছিল না। জীবনে কখনো সেগদিমোড়া খাটে শোয়নি। আনন্দের আতিশয্যে সেতখনই একবার গড়িয়ে নিল বিছানায়। আঃ, কী নরম! আজ খুব আরামে ঘুমানো যাবে—খেয়েদেয়ে সেতো এসেছেই, আজ আর কোনো কাজ নয়, এমনকী মন্টুকে পড়ানোও না, আজ খালি ঘুম! তোফা একটা ঘুম বেলা আটটা পর্যন্ত।
মন্টু এল বইপত্র নিয়ে। মিহির প্রস্তাব করল, এসো, খাটে বসেই পড়াই।
—‘না সার, আমি ও-খাটে বসব না!’
মিহির বিস্মিত হল, ‘কেন? এমন খাট!’
—‘আপনি মাস্টারমশাই গুরুজন, আপনার বিছানায় কি পা ঠেকাতে আছে আমার? বাবা বারণ করেছেন।’
—‘ওঃ তাই? তা হলে চলো, চেয়ারেই বসি গে।’ ক্ষুণ্ণমনে সেচেয়ারে গিয়ে বসল। —‘কিন্তু যা-ই বল, বেশ বিছানাটি তোমাদের। ভারি নরম। বেশ আরাম হবে ঘুমিয়ে।…দেখি তোমার বই। …Beans!…বিনস মানে জান?’
মন্টু ঘাড় নাড়ে। তার মানে সেজানে না।
—‘Beans মানে বরবটি। বরবটি একরকম সবজি—তরকারি হয়, আমরা খাই। Beans দিয়ে সেনটেন্স করো দেখি। পারবে?’
মন্টু ঘাড় নেড়ে জানায়—হ্যাঁ। তারপর অনেক ভেবে বলে—‘I had been there.’
মিহির অত্যন্ত অবাক হয়—এ আবার কী! উঃ, এতক্ষণে সেবুঝতে পারল কেন সব মাস্টার পালিয়ে যায়। গবাকান্ত বলে গবাকান্ত। মরিয়া হয়ে সেজিজ্ঞাসা করে—‘তার মানে কী হল?’
মন্টুও কম বিস্মিত হয় না—‘তার মানে তো খুব সোজা সার! আপনি বুঝতে পারছেন না? সেখানে আমার বরবটি ছিল। আই হ্যাড বিন দেয়ার—আমার ছিল বরবটি সেখানে…সেইটাই ঘুরিয়ে ভালো বাংলায় হবে সেখানে আমার—’
—‘থামো থামো, আর ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না তোমাকে। আই হ্যাড বিন দেয়ার মানে—আমি সেখানে ছিলাম।’
মন্টু আকাশ থেকে পড়ে—‘তবে যে আপনি বললেন বিন মানে বরবটি? তাহলে আমি সেখানে বরবটি ছিলাম—বলুন।’
মিহির সন্দেহ প্রকাশ করে—‘খুব সম্ভব তা-ই ছিলে তুমি। Bean আর Been কি এক জিনিস হল? বানানের তফাত দেখছ না? এ Been হল be ধাতুর form—’
বাধা দিয়ে মন্টু বলে, ‘হ্যাঁ বুঝেছি সার, আর বলতে হবে না। অর্থাৎ কিনা এ-Been হল মৌমাছির চেহারা। বি মানে মৌমাছি আর ফর্ম মানে চেহারা! আমি জানি।’
বিস্ময়ে হতবাক মিহির শুধু বলে, ‘জান তুমি?’
—‘হ্যাঁ, আজ সকালেই জেনেছি। আপনি চলে যাবার পর বাবা বললেন, তোর নতুন মাস্টারমশায়ের বেশ ফর্ম। তখনই জেনে নিলাম।’
মিহির কথাটা ঠিক ধরতে না পেরে বলল, ‘আমার চেহারা মৌমাছির মতো? জানতাম না তো। কিন্তু সে-কথা যাক, যে Beans মানে বরবটি, তা দিয়ে সেনটেন্স হবে এইরকম—Peasants grow beans অর্থাৎ চাষিরা বরবটি উৎপন্ন করে, বরবটির চাষ করে। বরবটি ফলায়। বুঝলে এবার?’
মন্টু ঘাড় নেড়ে জানায়, বুঝেছে।
—‘অতটা ঘাড় নেড়ো না, ভেঙে যেতে পারে। তোমার তো আর মৌমাছির চেহারা নয় আমার মতন। বেশ, বুঝেছ যদি, এইরকম আর একটা সেনটেন্স বানাও দেখি বিনস দিয়ে।’
অনেকক্ষণ ধরে মন্টুর মুখ নড়ে, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বার হয় না। মিহির হতাশ হয়ে বলে, ‘পারলে না? এই ধরো যেমন, Our cook cooks beans, আমাদের ঠাকুর বরবটি রাঁধে। এখানে তুমি কুক কথাটার দু-রকম ব্যবহার পাচ্ছ, একটা নাউন আরেকটা ভার্ব। আচ্ছা, আর একটা সেনটেন্স করো দেখি।’
এতক্ষণে বিনস ব্যাপারটা বেশ বোধগম্য হয়ে এসেছে মন্টুর। সেএবার চটপট জবাব দেয়—‘We are all human beans.’
—‘অ্যাঁ? বল কী? আমরা সবাই মানুষ-বরবটি? বরবটি-মানুষ?’
—‘কেন? বাবাকে অনেক বার বলতে শুনেছি যে হিউম্যান বিনস।’
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে মিহির। অর্থাৎ বসে তো সেছিলই, মাথায় হাতটা দেয় কেবল। দিনের পর দিন—মাসের পর মাস এই ছেলেকেই পড়াতে হবে তাকে? ওঃ, এইজন্যই মাস্টাররা টিকতে পারে না? কী করে টিকবে? পড়াতে আসা—কুস্তি করতে তো আসা নয়। রোজই যদি এরকম ধস্তাধস্তি করে দু-বেলা ওকে পড়াতে হয়, তাহলেই তো সেগেছে। তাহলে তাকেও পালাতে হবে টুইশানির মায়া ছেড়ে, ত্রিশ টাকার মায়া কাটিয়ে, নরম গদির আরাম ফেলে—
না, সেকিছুতেই পালাচ্ছে না। একজন উনত্রিশ দিন পর্যন্ত টিকেছিল আর একদিন টিকতে পারলেই ত্রিশ টাকা পেত, কিন্তু একটা দিনের জন্য এক টাকাও পেল না। বোধ হয় তার কেবল পাগল হতেই বাকি ছিল—পাগল হয়ে যাবার ভয়ে পালিয়েছে। আর একটা দিন পড়াতে হলেই পাগল হয়ে যেত। কিংবা পাগল হয়েই সেপালিয়ে গেছে হয়তো, নইলে ত্রিশ-ত্রিশটা টাকা কোনো সুস্থ মানুষ ছেড়ে যায় কখনো? কী সর্বনাশ! ভাবতেও তার হৃৎকম্প হয়।
সেকিন্তু চাকরিও ছাড়বে না, পাগলও হবে না, তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। মন্টু যা বলে বলুক—না পড়ে না পড়ুক—বোঝে বুঝুক, না বোঝে না বুঝুক—মন্টুকে সেবই খুলে পড়িয়ে যাবে—এই মাত্র; ওকে নিয়ে মোটেই সেমাথা ঘামাবে না। আর মাথাই যদি না ঘামায় পাগল হবে কী করে? নির্বিকারভাবে সেপড়াবে—কোনো ভয় নেই তার।
তার গবেষণায় বাধা পড়ে, মন্টু হঠাৎ জিজ্ঞাসা করে বসে—‘বেতন-নিবারক বিছানা—এর ইংরেজি কী হবে সার?’
—‘বেতন-নিবারক বিছানা আবার কী?’
—‘সেএকটা জিনিস। বলুন-না ওর ইংরেজিটা জেনে রাখা দরকার।’
—‘ওরকম কোনো জিনিস হতেই পারে না।’
—‘হতে পারে না কী হয়ে রয়েছে। আপনি জানেন না তাহলে ওর ইংরেজি। সেই কথা বলুন।’
—‘ওর ইংরেজি হবে পে-সেভিং বেড (Pay-saving bed)।’
মন্টু সন্দেহ প্রকাশ করে—‘শেভিং মানে তো কামানো। ছোট্টুরাম আমাদের চাকর, সেবেতন কামায়, বেতন-নিবারকে শোয় না তো সে। তাকে অনেকবার অনেক করে বলা হয়েছে কিন্তু কিছুতেই সেশোয় না। সেইজন্যই তো এ-চাকরটা টিকে গেল আমাদের। বাবা ভারি দুঃখ করেন তাই।’
কীসব হেঁয়ালি বকছে ছেলেটা? মাথা খারাপ না কি এর? অ্যাঁ? যাক, ওসব ভাববে না সে। সেপ্রতিজ্ঞাই করেছে—মোটেই মাথা ঘামাবে না এদের ব্যাপারে। একবার ঘামাতে আরম্ভ করলে তখন আর থামাতে পারবে না—নির্ঘাত পাগল হতে হবে। আজ আর পড়ানো নয়, অনেক পড়ানো গেল, কেবল মাথা কেন, সর্বাঙ্গ ঘেমে উঠছে তার ধাক্কায়। আজ এই পর্যন্তই থাক। মন্টুকে সেবিদায় দিল। —যাও আজকের মতন তোমার ছুটি।
এইবার একটা তোফা নিদ্রা নরম গদির বিছানায়। দু-দু বার বউবাজার আর বাগবাজার করেছে আজ, অনেক হাঁটাচলা হয়েছে—ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসছে। আজ রাত্রে সেখাবে না বলেই দিয়েছে—এক বন্ধুর বাড়িতেই খাওয়াটা সেরেছে বিকেলে। ব্যাস, আলোটা সুইচ অফ করে এখন শুলেই হয়।
নরম বিছানায় সর্বাঙ্গ এলিয়ে দিয়ে আরামে মিহিরের চোখ বুজে এল—আঃ। নিদ্রার রাজ্যে সবেমাত্র প্রবেশ করেছে সে, এমন সময়ে তার মনে হল সর্বাঙ্গে কে যেন এক হাজার ছুঁচ বিঁধিয়ে দিল একসঙ্গে। আর্তনাদ করে মিহির লাফিয়ে উঠল বিছানা ছেড়ে। বাতি জ্বেলে দেখে, সর্বনাশ—সমস্ত বিছানায় কাতারে কাতারে ছারপোকা…ছারপোকা আর ছারপোকা! হাজারে হাজারে, লাখ লাখ—গুনে শেষ করা যায় না। শুধুই ছারপোকা।
এতক্ষণে বেতন-নিবারক বিছানার মানে সেবুঝল, বুঝতে পারল কেন মাস্টাররা টেকে না। ও বাবা:! কেবল ছাত্রই নয়, ছারপোকাও আছে তার সাথে। ঘরে-বাইরে যুদ্ধ করে একটা লোক পারবে কেন? তবু সেভদ্রলোক উনত্রিশ দিন যুঝেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলেন না—ছেড়ে পালাতে হল যাঁকে তিনি একজন শহিদ পর্যায়ের সন্দেহ নেই। ত্রিশ টাকা মাইনের মাস্টার রেখে বেতন না দিয়েই ছেলে পড়ানো না:, ভদ্রলোক কেবল উদার আর মহৎ নন, বেশ রসিক লোকও বটেন তিনি! মায়া দয়া নেই একটুও, একেবারে অমায়িক।
ভীতিবিহ্বল চোখে সেছারপোকা-বাহিনীর দিকে তাকিয়ে রইল। গুনে শেষ করা যায় না—ওকি মেরে শেষ করা যাবে? আর সারা রাত ধরে যদি ছারপোকাই মারবে তো ঘুমোবে কখন? না:, চেয়ারে বসেই আজ কাটাতে হল গোটা রাতটা!
আলো দেখামাত্র ছারপোকাদের মধ্যে বেশ চাঞ্চল্য পড়ে গেছল—দু-তিন মিনিটের মধ্যে তারা কোথায় আবার মিলিয়ে গেল। মিহির ভাবল—বাপস, এরা রীতিমতো শিক্ষিত দেখছি! যেমন কুচকাওয়াজ করে এসেছিল তেমনি কুচকাওয়াজ করে চলে গেল—আধুনিক যুদ্ধের কায়দাকানুন সব এদের জানা দেখা যাচ্ছে। কোথায় গেল ব্যাটারা?
সদ্য পাট-ভাঙা ধবধবে চাদরের এক কোণ তুলে দেখে তোশকের গদির খাঁজে খাঁজে থুক থুক করছে ছারপোকা—অন্যধারেও তাই। আর বেশি সেদেখল না, কী জানি এখন থেকেই যদি তার মাথা খারাপ হতে থাকে। চেয়ারে গিয়ে বসল, কিন্তু ভয়ে আলো নিবোল না—কী জানি যদি ব্যাটারা সেখানে এসেও তাকে আক্রমণ করে। বলা যায় না কিছু…
পরদিন মন্টুর বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বেশ ঘুম হয়েছিল রাত্রে?’
—‘খাসা! অমন বিছানায় ঘুম হবে না, বলেন কী আপনি?’
ভদ্রলোক একটু অবাক হয়ে বললেন, ‘বেশ বেশ, ঘুম হলেই ভালো। জীবনের বিলাসই হল গিয়ে ঘুম।’
—‘আর ব্যসন হল বেগুনি? না বাবা?’
—‘তা তোমার ঘুমটা বোধ হয় বেশ জমাট? ঘুমিয়ে আয়েস পাও খুব?’
—‘আজ্ঞে, সেকথা আর বলবেন না। একবার আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাশের বাড়ি চলে গেছলাম কিন্তু মোটেই তা টের পাইনি।’
—‘বল কী?’
—‘আমাদের বাড়ি বর্ধমানে। শুনেছেন বোধ হয় সেখানে বেজায় মশা—মশারি না খাটিয়ে শোবার জো নেই। একদিন পাশের বাড়িতে খুব দরকারে ডেকেছিল আমাকে, কিন্তু ভুলে গেছলাম কথাটা। যখন শুতে যাচ্ছি তখন মনে পড়ল, কিন্তু অনেক রাত হয়ে গেছে, অত রাত্রে কে যায়, আর দরজাটরজা বন্ধ করে তারা শুয়ে পড়েছে ততক্ষণ। আমি করলাম কী, সে-রাত্রে আর মশারি খাটালাম না! পরের দিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল মশাই, বলব কী, দেখি পাশের বাড়িতেই শুয়ে রয়েছি!’
দারুণ বিস্মিত হলেন ভদ্রলোক—‘কীরকম?’
—‘মশায় টেনে নিয়ে গেছে মশাই! সেইজন্যই তো মশারি খাটাইনি। রাতবিরেতে অনায়াসে পাশের বাড়ি যাবার ওইটেই সহজ উপায় কিনা!’
ভদ্রলোক বেজায় মুষড়ে পড়লেন যেন—‘মশাতেই যখন কিছু করতে পারেনি তখন কীসে আর কী করবে তোমার! তুমি দেখছি টিকেই গেলে এখানে।’
মিহির বলল, ‘আমার কিন্তু একটা নিবেদন আছে। কয়েকটা টাকা আমাকে দিতে হবে আগাম। ছারপোকার অর্ডার দেব।’
—‘ছারপোকার অর্ডার! কেন? সেআবার কী হবে?’
—‘ও, আপনি জানেন না বুঝি? ছারপোকার মতো এমন মস্তিষ্কের উপকারী মেমারি বাড়ানোর মহৌষধি আর নাই। বিলেতে ছারপোকার চাষ হয় এইজন্যে। গাধা ছেলে সব দেশেই আছে তো, তাদের কাজে লাগে।’ একটু থেমে সেআবার বলল, ‘আমার এক বন্ধু তো এই ব্যাবসাতেই লেগে পড়েছে—রেলগাড়ির ফাঁকফোঁকর থেকে সব ছারপোকা সেটেনে বার করে নেয়।’
সাগ্রহে ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, ‘কীরকম, কীরকম? বিলেতে ছারপোকার চাষ হয়? দাম দিয়ে কেনে লোকে? আমদানি-রপ্তানি হয় তুমি জান? আমি বেচতে পারি, হাজার হাজার, লাখ লাখ—যত চাও।’
—‘বেচুন-না। আমিই কিনে নেব। আমার নিজের কাজে লাগবে। ছারপোকার রক্ত ব্রেনের ভারি উপকারী—একটা ছারপোকা ধরে নিয়ে এমনি করে মাথায় টিপে মারতে হয়, এইরকম হাজার হাজার লাখ ছারপোকার রক্তে এক ছটাক ব্রেন হয়; সঙ্গে সঙ্গে ব্রেন,—বি এ পাশের সময়ে আমি নিজে পরীক্ষা করে দেখেছি। সারা বছর ফাঁকি দিয়েছি, ফেল না হয়ে আর যাই না। এমন সময়ে এক বিলেতি কাগজে ছারপোকার উপকারিতা পড়া গেল, অমনি সমস্ত বাসা খুঁজে যার বিছানায় যা ছারপোকা ছিল, সব সদব্যবহার করলাম। পরীক্ষা দেবার তখন মাত্র তিন দিন বাকি। তারপর ফল যা পেলাম নিজের চোখেই দেখুন, আমার কাছেই আছে বি এ পাস করলাম উইথ ডিস্টিংশন—ফার্স্ট ক্লাস উইথ…
কাল থেকেই সেব্যগ্র হয়ে ছিল,—এখন সুযোগ পেতেই সার্টিফিকেটখানা মন্টুর বাবার মুখের সামনে মেলে ধরল। ভদ্রলোকের চোখ দুটো ছানাবড়ার মতো হয়ে উঠল বিস্ময়ে—সত্যিই! একটা কথাও মিথ্যে নয়, Passed with Distinction—লেখাই রয়েছে। বটে, এমন জিনিস ছারপোকা! কে জানত গো!
—‘পয়সা খরচ করে ছারপোকা কিনতে হবে না, তোমার বিছানাতেই রয়েছে—হাজার হাজার, লাখ লাখ, যত চাও। তোমার ভয়ানক ঘুম বলে জানতে পারনি।’
এতক্ষণ কেন বলেননি আমায়? অনেকখানি ব্রেন করে ফেলতাম। এবেলা আমার নেমতন্ন আছে ভবানীপুরে, এখনই বেরোতে হবে নইলে এক্ষুনিই, যাক, দুপুরে ফিরেই ওগুলোর সদব্যবহার করব। তারপরে পড়াতে বসব মন্টুকে।
মিহির চলে গেলে পিতাপুত্রের চাওয়াচাওয়ি হয়। অবশেষে মন্টুর বাবা বললে, ‘ছারপোকার সঙ্গে যে ব্রেনের সম্বন্ধ আছে, অনেকদিনই একথা মনে হয়েছে আমার। ছারপোকার ব্রেনটা একবার ভাব দিকি—অবাক হয়ে যাবি তুই। খুচ করে এসে কামড়েছে, তক্ষুনি উঠে দেশলাই জ্বাল, আর পাবি না তাকে, কোথায় সেপালিয়েছে, তার পাত্তা নেই। মানুষ যে দেশলাই আবিষ্কার করেছে, এ পর্যন্ত ওদের জানা। এটা কি কম ব্রেন? আর এ ব্রেন তো ওদের ওই রক্তেই, কেননা মাথা তো নেই ওদের, গায়েই ওদের সব ব্রেন। ঠিক বলেছে মিহির। তুই কী বলিস মন্টু?’
—‘হ্যাঁ বাবা।’
—‘তারপর ছারপোকার সঙ্গে শিক্ষার সম্বন্ধও কম নয়। ছারপোকা বিস্তারের সাথে সাথে শিক্ষার বিস্তার বাড়ে। ট্রামে বাসে সিনেমায় যেমন ছারপোকা বেড়েছে, তেমনি হুহু করে খবরের কাগজের কাটতিও বেড়ে গেছে। এই সেদিন বায়োস্কোপে আমাদের সামনেই সাড়ে চার আনার সিটে একটা কুলি বসেছিল, তোর মনে পড়ে না মন্টু?’
—‘হ্যাঁ—বাবা।’
—‘সেতো লেখাপড়া কিছুই জানে না। দু-মিনিট না বসতেই দু-পয়সা খরচা করে একখানা আনন্দবাজার কিনে আনল সে। এতে শিক্ষার বিস্তার হল না কি? মন্টু কী বলিস তুই?’
—‘হ্যাঁ বাবা।’
—‘চল তবে এক কাজ করি গে। তোর মাস্টারমশাই ফেরার আগে আমরাই ছারপোকাগুলোর সদব্যবহার করে ফেলি। ব্রেন তো তোরও দরকার, আর আমারও—মেমারিটাও দিন দিন কেমন যেন কমে আসছে। সেদিন শ্যামবাবুকে মনে হল গোবর্ধনবাবু আর গোবর্ধনবাবুকে মনে হল হারাধনকান্ত! এ তো ভালো কথা নয় রে মন্টু। কী বলিস তুই?’
—‘হ্যাঁ বাবা।’
সন্ধ্যের পরে ফিরল মিহির। কাল সারা রাত ঘুম নেই, তার পর আজ সমস্ত দিন বন্ধুদের আড্ডায় তাস পিটে এতই ক্লান্ত হয়েছে যে ঘুমোতে পারলে বঁাচে। আজ সেআলো জ্বালিয়েই শোবে—আলো দেখে যদি না আসে ব্যাটারা। এখন ‘নমো নমো’ করে মন্টুকে খানিকক্ষণ পড়ালেই ছুটি।
মন্টু বই নিয়ে আসতেই গোটা ঘরটায় একটা বিশ্রী দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
—‘নতুন ধরনের এসেন্স-টেসেন্স মেখেছ না কি কিছু? ভারি গন্ধ আসছে তোমার গা থেকে।’ মিহির জিজ্ঞাসা করল।
—‘গা নয় সার, মাথার থেকে।’
—‘কীসের গন্ধ? বেজায় খোশবাই দিচ্ছে।’
—‘ছারপোকার! আপনি চলে যাবার পর বাবা আর আমি দুজনে মিলেই বেতন-নিবারকের যত ছারপোকা ছিল সব শেষ করেছি! ছোট্টুরামকেও বলা হয়েছিল কিন্তু সে-ব্যাটা মোটেই ব্রেন চায় না। বলে যে বিরেন সেকেয়া কাম? আর একটাও ছারপোকা নেই আপনার বিছানায়! হি-হি-হি!
—‘হ্যাঁ?’ সিংহনাদ করে মিহির চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বিছানায় গিয়ে পড়ে সটান চিতপটাং। মন্টু তো হতভম্ব। দারুণ সেই চিৎকার শুনে মন্টুর বাবা ছুটে আসেন—‘কী হয়েছে রে মন্টু? কী হল?’
—‘ছারপোকা নেই শুনে মাস্টারমশাই অজ্ঞান হয়ে গেছেন।’
—‘তা তুই বলতে গেলি কেন? বারণ করলাম না তোকে? অতগুলি ছারপোকার ব্রেনের শোক—’
—‘আমি কী করে জানব যে উনি অমন করবেন। আমি কিছু বলিনি। উনি কী করে গন্ধ পেলেন উনিই জানেন। মুখে জল ছিটোলে জ্ঞান হয় শুনেছি, ছিটোব, বাবা?’
অজ্ঞান অবস্থাতেই মিহিরের গলা থেকে বের হয়—‘উঁহু!’
মন্টুর বাবা বললেন—‘কাজ নেই। জ্ঞান হলে যদি কামড়ে দেয় রে? ওই দ্যাখ বিড়বিড় করছে—’
মিহির তার শোক সামলে উঠল পরদিন সাড়ে আটটায়। ষাঁড়ের মতন সারারাত এক নাগাড়ে নাক ডাকাবার পর।