Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

দক্ষিণারঞ্জনের দ্বিতীয় বিবাহ

বিবাহ হয়ে গেল দক্ষিণারঞ্জনের দ্বিতীয় বিবাহ, বসন্তকুমারীরও দ্বিতীয় বিবাহ, ৪৬ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে দুজনে সংসার শুরু করলেন। একেই বোধহয় বলে শুভ বিবাহ।

দক্ষিণারঞ্জন সরকারের অধীনে কলকাতার কালেক্টর হলেন। এই পদে সেকালে কোনও দেশীয় মানুষকে নিযুক্ত করা হত না। প্রবীণারা বলবেন, দেখেছ! বিয়ের পরেই ভাগ্য খুলে গেল! আবার যে-সে বিবাহ নয়, এক রাজার সঙ্গে এক রানির। রোমান্টিক, বিপদে ভরা। দক্ষিণারঞ্জনের প্রাণ যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। বৃদ্ধ রাজা তেজচাঁদ পরলোকে। অনেক বিধবা স্ত্রী রেখে গেছেন। বসন্তকুমারী তাঁদের একজন, সর্বকনিষ্ঠা। তাঁর পিতা পরাণচাঁদ সেই সময় জাল প্রতাপচাঁদকে নিয়ে জেরবার। বসন্তকুমারীর গতিবিধি নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই। লাভবান হলেন দক্ষিণারঞ্জন। জীবনসঙ্গিনীর প্রয়োজন ছিল। তিনি আবার ক্ষত্রিয় রাজকুমারী। অনেকটা রূপকথার গল্প।

কলকাতায় তখন স্ত্রী শিক্ষা নিয়ে বাঙালি সমাজপিতা ও ইউরোপিয় সংস্কারকরা খুব উদ্যোগী হয়েছেন। ইউরোপিয় রেনেসাঁর প্রভাব। পাশ্চাত্যের দার্শনিক ও চিন্তাবিদরা শুধু ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের, স্ত্রী, পুরুষ, নির্বিশেষে জাগরণ চান। মুক্তি চান। শিক্ষার বিস্তার চান। মধ্যযুগ থেকে নতুন যুগে বের করে আনতে চান–A new world। বড় চমৎকার একটা পৃথিবীর স্বপ্ন। এদেশের ইংরেজ শাসকরা নারীমুক্তি, স্ত্রী শিক্ষার কথা তখনও ভাবেননি। প্রথম ভাবনা এসেছিল পাদরিদের মনে। ১৮২১ সালে স্কুল সোসাইটির কয়েকজন সভ্য এই ব্যাপারে অগ্রণী হলেন। ইংল্যান্ড থেকে এক শিক্ষিতা মহিলাকে এদেশে আনলেন, তাঁর নাম কুমারী কুক। স্কুল সোসাইটি যেসব বিদ্যালয় স্থাপন করেছিল, সেগুলি পরিদর্শনে গিয়ে দেখলেন একটি বিদ্যালয়ে একজন ছাত্রের সঙ্গে তাঁর ছোট বোনও এসেছে। সে স্কুলে প্রবেশের অনুমতি চাইছে কাতর কণ্ঠে। কিন্তু গুরুমশাই কিছুতেই তাকে স্কুলে ঢুকতে দিলেন না। মিস কুক সেই দিনই সিদ্ধান্ত নিলেন, যেভাবেই হোক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। সেই কাল, অজানা এক বালিকা, আর একা বিদেশিনি, এই তিনের সমন্বয়ে সময়। কীরকম ঘুরে গেল। একটা অন্ধযুগের অবসান ঘটতে চলেছে। রেনেসাঁর সূত্রপাত। শ্রীমতী কুকের চেষ্টায় এক বছরের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে আটটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হল। কুমারী কুক রেভারেন্ড আইজ্যাক উইলসনকে বিবাহ করলেন। কিন্তু জীবনের ব্রত পরিত্যাগ। করলেন না। বিভিন্ন স্থানে একাধিক বিদ্যালয় পরিদর্শন করা সম্ভব নয়। স্থির করলেন যেভাবেই হোক উত্তর কলকাতার কেন্দ্র স্থলে বড় আকারের একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন। করতে হবে। চাই একটি গৃহ। ১৮২৪ সালে শ্রীমতী কুক কয়েকজন সম্রান্ত ইংরেজ মহিলাকে নিয়ে একটি মহিলা সমিতি স্থাপন করলেন–Bengal Ladies Society। সমিতির অধিনেত্রী হলেন লেডি অ্যামহার্স্ট। ১৮২৬ সালের ৮ মে সিমুলিয়ায় মহা সমারোহে স্কুলের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হল। ঠিক দু-বছর পরে ১৮২৮ সালের পয়লা এপ্রিল থেকে মিসেস উইলসনের স্কুল শুরু হয়ে গেল। হিন্দুদের মধ্যেও উৎসাহ জাগল, যেন ঘুম ভাঙল।

রাজা বৈদ্যনাথ রায়বাহাদুর শ্রীমতী কুকের স্কুল বাড়ি নির্মাণের জন্য কুড়ি হাজার টাকা দান করেছিলেন। ওদিকে রাজা স্যার রাধাকান্তদেব বাহাদুর একটি প্রস্তাব প্রকাশ করেছিলেন–স্ত্রী শিক্ষা বিধায়ক প্রস্তাব। এবার তিনি নিজেই নিজের বাড়িতে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। এই আন্দোলনে এইবার যিনি এলেন–তিনি বিখ্যাত ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন। আমাদের ইতিহাসে এই বিদেশি, মহাত্মা উপাধিতে ভূষিত। তিনি এসেই লক্ষ্য করলেন, সম্রান্ত পরিবারের মেয়েরা স্ত্রী শিক্ষার ব্যাপারে উৎসাহী হলেও সরকারের কোনও আগ্রহ নেই। বেথুন সাহেব নিজের অর্থে একটি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। সম্রান্ত হিন্দুদের আহ্বান জানালেন এই ব্রতে ব্রতী হওয়ার জন্য। প্রথমেই এগিয়ে এলেন দক্ষিণারঞ্জন। প্রতিদিন স্কুল চালানোর জন্য বেথুন সাহেবের অনেক খরচ। রাজা রাধাকান্তদেব, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, জাস্টিস শম্ভুনাথ পণ্ডিত, রাজা কালীকৃষ্ণ। দেবও বেথুন সাহেবকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এলেন। সম্রান্ত পরিবার থেকে ছাত্রীরাও এলেন বেথুন সাহেবের স্কুলে পড়ার জন্য। এখন চাই একটি নিজস্ব বিদ্যালয় গুহ। এই স্কুলে বেথুন সাহেব প্রতিমাসে প্রায় আটশো টাকা খরচ করতেন। তিনি বিদেশি, অনেক কষ্টে অর্থ। উপার্জন করেন। এরপরে খরচ যখন আরও বাড়বে তখন কী হবে! দক্ষিণারঞ্জন নিশ্চেষ্টভাবে বসে থাকতে পারলেন না। তাঁর জাতিরও তো একটা সম্মান আছে। স্যার বেথুনের সঙ্গে। সাক্ষাৎ করে বিদ্যালয় গৃহ নির্মাণের জন্য বারো হাজার টাকা মূল্যের বিরাট একটি জায়গা দান করলেন। বেথুন তখনও দক্ষিণারঞ্জনকে চেনেন না। অপরিচিত ব্যক্তির অযাচিত দানে। তিনি বিস্মিত। এই জমির ওপর ১৮৫০ সালের ৬ নভেম্বর বাংলার তদানীন্তন ডেপুটি গভর্নর স্যার জন লিটলার বেথুন বালিকা বিদ্যালয়ের ভিত্তি স্থাপন করলেন। সেদিনের বক্তৃতার একটি জায়গায় তিনি বললেন, Dakhina Runjun Mookerjee was an utter stranger to me. I had never before heard his name, when he introduced himself to me, a year and a half ago, for the purpose of letting me know that he heard of my intention of founding a Female School for the benefit of his Country, that he could not bear the thought that if should be said here after of his countrymen that they all stood idly looking on without offering any help in furtherance of the good work and in short, without further perface that he was the propritor of a picee of ground in Calcutta, Valued as I have since learned, at about twelve thousand Rupees, which he placed freely and unconditionally at my disposal for the use of the school. It was noble gift, and nobly given… It is due to Dakhina Runjun Mookerjee, that his name should be held in perpetual remembrance in connexion with the foundation of this school.

বেথুন স্কুল, বেথুন কলেজ কত বড় ইতিহাস এই কলকাতার বুকে! ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিনে অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিশিষ্ট কয়েকজন সাহেব–স্যার জন লিটলার, ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন, লর্ড বিশপ, স্যার এফ ক্যারি, মিস্টার লাউইস, স্যার আর্থার বুলার, স্যার জেমস কলভিল, ফ্রেডারিক হ্যাঁলিডে, স্যার জন রাসেল, স্যার জন পিটার, ডাক্তার মৌয়েট, রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণারঞ্জনের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে সান্ধ্য ভোজনে মিলিত হয়েছিলেন। কজনই বা মনে রেখেছে এই ইতিহাস! মহান বেথুন সাহেব মৃত্যুকালে এই বিদ্যালয়ের জন্য নগদ তিরিশ হাজার টাকা ও তাঁর অন্যান্য অস্থাবর সম্পত্তি দান করে যান। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে স্কুল পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ জানান। তাঁর মৃত্যর পর লেডি ডালহৌসি বিদ্যালয় পরিচালনার জন্য মাসে ছশো টাকা অর্থ সাহায্য করতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর লর্ড ডালহৌসি এই সাহায্য বজায় রেখেছিলেন। তারপরেই কোম্পানি বিদ্যালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

দক্ষিণারঞ্জনের তৃতীয় জীবন শুরু হয়েছে। প্রথম জীবনে অ্যাংরি ইয়ংম্যান, দ্বিতীয় জীবনে কর্মব্যস্ত আইনজীবী ও রানি বসন্তকুমারীর সঙ্গে চিরকালের গাঁটছড়া বাঁধা। তৃতীয় জীবনে চরম পরিণতি। কলকাতার কালেকটারি ছাড়তে হল। এই সময় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সুস্থ হয়ে ত্রিপুরায় গেলেন রাজসচিব হয়ে। এসব ১৮৫১ সালের কথা। ত্রিপুরাও ভালো লাগল না। কয়েকমাস পরে এলেন মুর্শিদাবাদে। তখন নবাব নাজিম ফরেদুনজা। দক্ষিণারঞ্জন দেওয়ান হলেন। এই সময়ে তিনি রাজ উপাধিতে ভূষিত হলেন। শুধু রাজা নয়। আর একটি নবাবি উপাধি পেলেন, মাদার-উল-মাহাম, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী। মুর্শিদাবাদের এই উচ্চ পদে তিনি যথেষ্ট সুখ্যাতি পেলেন। এই পদে থাকাকালীন গভর্নর জেনারেলের এজেন্ট মিস্টার হেনরি টরেন্সের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা হল। সাহেব তাঁকে ভীষণ ভালোবেসে ফেললেন। টরেন্স সেকালের একজন বিখ্যাত ব্যক্তি। সুদক্ষ রাজকর্মচারী, আবার একজন প্রকৃত পণ্ডিত ও সাহিত্যসেবী। সেই কারণেই ডিরোজিয়ান দক্ষিণারঞ্জনের সঙ্গে তাঁর এত ভাব-ভালোবাসা। টরেন্স তিনটি সংবাদপত্রের সম্পাদক-Calcutta Star, Eastern Star, Meerut Observer | অনুবাদক ও মৌলিক গ্রন্থপ্রণেতা। সাহিত্যের এইসব বিভাগ তাঁর প্রতিভা স্বীকৃত। সাত বছর এশিয়াটি সোসাইটির সভাপতি ও তিন বছর সহকারী। সভাপতি ছিলেন। এমন একজন বিদগ্ধ মানুষ দক্ষিণারঞ্জনের প্রতি আকৃষ্ট হতে বাধ্য। সেই সময় শাসন ক্ষেত্রে গুণী, আলোকিত মানুষ কোথায়!

নবাব ফরেদুনও দক্ষিণারঞ্জনকে খুব ভালো চোখে দেখতেন। তিনি সেই সময় বয়সে তরুণ। দক্ষিণারঞ্জন অত্যন্ত সৎ, রাজকার্যে অত্যন্ত পারদর্শী। তরুণ ফরেদুনের ইয়ার বন্ধুরা সুবিধের ছিলেন না। নবাবকে গোল্লায় পাঠাবার সব রাস্তাই এদের জানা। যেমন সিরাজের পতনের কারণ তাঁর অসভ্য সঙ্গীরা। টরেন্সের কালে ইংরেজ সরকার হঠাৎ নবাব সরকার থেকে যে বৃত্তি পেতেন, তা কমিয়ে দিলেন। আর নিজামত তহবিলেও ভাগ বসালেন। এই ইস্যুতে নবাবের সঙ্গে টরেন্সের লড়াই শুরু হল। মিটমাটের জন্য দেওয়ান দক্ষিণারঞ্জন প্রচুর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। হেনরি টরেন্স গভর্নর জেনারেলের সঙ্গে দেখা করার জন্যে কলকাতায় এসে উদরাময়ে আক্রান্ত হয়ে মারা গেলেন। সাল, ১৮২৫, ১৬ আগস্ট। সন্দেহজনক মৃত্যু। দক্ষিণারঞ্জন তাঁর এক প্রিয় বন্ধুকে হারালেন। বিরাট আঘাত।

টরেন্সের বিতর্কিত মৃত্যুর পর নবাব ফরেদুন তাঁর কুমন্ত্রীদের পরামর্শে লর্ড ডালহাউসির সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পড়লেন। ঘটনাটি এইরকমনবাবের কিছু জহরত চুরি হল। রাজকর্মচারীরা কয়েক জনকে ধরে এনে পিটিয়ে মেরে ফেলল। নবাবের প্রধান খোজা আমান আলিখাঁ ও আরও কয়েকজনকে ধরে এনে সুপ্রিম কোর্টে তোলা হল। প্রমাণের অভাবে তাঁরা ছাড়া পেলেও নবাবের কাছে সরকারি নির্দেশ এল, এদের যেন পুনর্বহাল করা না হয়। ফরেদুন এই আদেশ উপেক্ষা করলেন। সরকার সঙ্গে সঙ্গে নবাবের অনেক ক্ষমতা কেড়ে নিলেন। সম্মানসূচক ১৯ বার তোপধ্বনি কমে হল ১৩ বার। এই টালমাটাল পরিস্থিতিতে মুর্শিদাবাদের নিজামত দক্ষিণারঞ্জনের পক্ষে আর নিরাপদ রইল না। ফিরে এলেন কলকাতায়।

মানুষের জীবন সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো। ওঠা-পড়া। সামান্য সময়ের জন্য থমকে যাওয়া। এই সময় কয়েকটি বড় বড় মৃত্যু। প্রথমে বঙ্গবন্ধু বেথুন সাহেবের মৃত্যু। একদিকের আকাশ নক্ষত্রশূন্য। এরপরেই চিরবিদায় নিলেন প্রিয় বাল্যবন্ধু জ্ঞানান্বেষণ পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক সুধী, বাগ্মী, সুলেখক রসিককৃষ্ণ মল্লিক। দক্ষিণারঞ্জন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বন্ধুর শয্যাপার্শ্বে ছিলেন। খুব সেবা করেছিলেন। রসিককৃষ্ণ ছিলেন তাঁর হৃদয়ের হৃদয়। তাঁকে অদেয় কিছু ছিল না। একবার দক্ষিণারঞ্জনের বাড়িতে আহারাদির পর একটি বহু মূল্য সুন্দর সোনার তাম্বুল দান থেকে তাঁকে পান দেওয়া হচ্ছিল। রসিককৃষ্ণ মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতে দেখতে বললেন–ওঃ কী সুন্দর! দক্ষিণারঞ্জন সঙ্গে সঙ্গে সেই বহু মূল্য বস্তুটি বন্ধুকে উপহার দিলেন। এইরকম বড় মনের মানুষ ছিলেন রাজা দক্ষিণারঞ্জন। ক্রমশই বড় একা হয়ে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে শরীর বিদ্রোহ করছে। অজ্ঞাত এক অসুখ–প্রবল শিরঃপীড়া।

কলকাতায় তাঁর অনেক কাজ। দ্বারকানাথ ও প্রসন্নকুমার ঠাকুরের উৎসাহে স্থাপিত হয়েছিল জমিদার সভা। পরে এটি ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান সোসাইটির সঙ্গে মিলিত হয়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন নামে শুধু পরিচিত হল না, হয়ে উঠল একটি মাইল ফলক। ১৮৫৯, ১৮৬০, এই দু-বছর দক্ষিণারঞ্জন এই অ্যাসোসিয়েশনের অধ্যক্ষ হয়েছিলেন।

ডিরোজিওর ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র দক্ষিণারঞ্জনেরই প্রখর রাজনীতি জ্ঞান ছিল। রীতিমতো পড়াশোনা করতেন এই বিষয়ে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন দেশের অবস্থা বোঝার জন্যে। উত্তর-পশ্চিম ভারতে ভ্রমণের সময় দেশ উত্তাল হল সিপাহি বিদ্রোহের কারণে। বিদেশি ইংরেজরা ভারতবর্ষের অন্তর-চিত্রের কিছুই জানতেন না। ধর্ম, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, লোকাঁচার, ভাষা। এত বড় একটা দেশ। কত রকমের ভাষা, প্রথা! দক্ষিণারঞ্জন জানতেন। শাসক গোষ্ঠীর কোথায় ভুল হচ্ছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবার ক্ষমতাও তাঁর ছিল। লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় এই বিদ্রোহের কারণ ও প্রকৃতি সম্পর্কে পর পর কয়েকটি সুনিশ্চিত প্রবন্ধ লিখে শাসক মহলে আলোড়ন তুলে দিলেন। ক্যানিং-এর মতো বিচক্ষণ রাজনীতিকও বিস্মিত হলেন।

সিপাহি বিদ্রোহ অবদমিত হল। ইংরেজের পীড়ন, উৎপীড়ন, ইতিহাস হয়ে রইল। শাসন ক্ষমতা কোম্পানির হাত থেকে কুইনের হাতে সমর্পিত হল। মহারানি ভিক্টোরিয়ার এম্পায়ার। রাজ্যের নগরে নগরে ঘোষণা। দেশের সর্বত্র মহাসমারোহে উৎসব। নট-নাট্যকার গিরিশচন্দ্র মস্ত এক কবিতা লিখলেন। সেই কবিতায় এইসব লাইন, ভিকটোরিয়া তুমি মা আমার/ ইংল্যান্ডের রাজরানি, ছিল মা ইংরাজি বাণী/ছিল মা গো ইংরাজ আকার/কিন্তু এ ভারতে জানি, ভারতের মহারানি/ভারতসন্তান সাঙ্গপাঙ্গ মা তোমার/ভিকটোরিয়া কোথা মা আমার/ বাঙালি সন্তান দীন, তুমি দীন পুত্রাধীন কালার আশ্রয় তব হৃদয় আগার/ভক্তি, পুষ্প করি দান, নহে মা এ বাক্য ভান/স্বর্গ হতে উপহার করো মা গ্রহণ/ আমি মহা ভাগ্যবান করি তোরে শ্রদ্ধা দান/হীন বাঙালির শ্রদ্ধা নাহি মা বারণ/ভিকটোরিয়া মা আবার হবে কি কখন!

ঢাকার ব্রাহ্মসমাজে বিরাট অনুষ্ঠান। বিশিষ্ট সব মানুষ সমবেত হয়েছেন। মহারানির জন্যে পরমেশ্বরের কাছে শুভাশীর্বাদ প্রার্থনা করা হবে। দক্ষিণারঞ্জন সেই সময় ঢাকাতে। তিনি আমন্ত্রিত হলেন। মনোজ্ঞ এবং দীর্ঘ ভাষণে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের সুফল ব্যাখ্যা করলেন। পরমেশ্বরের কাছে ভারতবর্ষ ও ভারতশ্বেরীর মঙ্গল কামনা করলেন। ঢাকা ব্রাহ্মসমাজের এই দিনের কার্যবিবরণী ও দক্ষিণারঞ্জনের বক্তৃতা একটি পুস্তিকার আকারে প্রকাশিত হল।

দক্ষিণারঞ্জনের রাজভক্তি শাসক গোষ্ঠীর উচ্চ মহলে প্রশংসিত। লর্ড ক্যানিং দক্ষিণারঞ্জনের নামের সঙ্গে পরিচিত। তাঁর একান্ত পরামর্শদাতা ডাফ সাহেবের মুখে দক্ষিণারঞ্জনের প্রশংসা শুনেছেন। দক্ষিণারঞ্জনের প্রবন্ধাদি ডাফ সাহেবের মাধ্যমেই তাঁর হাতে এসেছে। ডাফ শুধু ধর্মপ্রচারকই ছিলেন না, সূক্ষ্ম রাজনীতিও করতেন। সিপাহি যুদ্ধের ওপর একটি বইও লিখেছিলেন। ক্যানিং বিচক্ষণ শাসক। যুদ্ধের পর যুদ্ধে সমস্যার প্রকৃত সমাধান হয় না। একজন ঠান্ডা মাথার বিচক্ষণ মানুষ চাই। বিদেশি নয়, শিক্ষিত, ভারতবোদ্ধা ভারতীয়। তাঁর কাজ হবে উত্তর-পশ্চিম ভারতের অর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত অভিজাতদের পোষ মানানো। ব্রিটিশ শাসনের সুফল বোঝাননা। বিনীত নাগরিকে পরিবর্তন করা। এই কাজ যিনি করবেন, তাঁর দুটো দিক থাকবে, এদিকের মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করবে। তাঁর কথায় আস্থা স্থাপনে দ্বিধা করবে না, আবার ইংরেজদেরও বিশ্বাসভাজন। দু-দেশের জ্ঞান থাকার প্রয়োজন। তিনি হবেন সম্রান্ত, আলোকিত, শ্রদ্ধেয় আবার সুকৌশলী। কে তিনি?ইন্দো-ব্রিটিশ, যোগসূত্রের নির্ভরযোগ্য সেতু!

ডাফ বললেন, দক্ষিণারঞ্জন। রাজভক্ত বনেদি পরিবারের শিক্ষিত সন্তান। তাঁর লেখা পড়েছেন, তাঁর লেখা, তাঁর বিচক্ষণ অ্যানালিসিস আপনাকে পড়িয়েছি, আপনার মন্তব্য তাঁকে শুনিয়েছি। আধার ইন্ডিয়ান, আধেয় ইংল্যান্ড। আপাতত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত বাঙালির এই অবস্থা পরের কথা পরে। দেখুন, বিখ্যাত, নট-নাট্যকার বাংলার গ্যারিক কি লিখছেন,

ভিকটোরিয়া কোথা মা আমার!
বাঙালি সন্তান দীন তুমি দীন পুত্রাধীন
কালার আশ্রয় তবু হৃদয়াগার।

এবার কেন্দ্র লখনউ। জীবনের পথে চলতে চলতে এইবার শীর্ষ। লর্ড ক্যানিংয়ের আহ্বান, চলে আসুন, অপেক্ষা করে আছে বিরাট কর্মক্ষেত্র। অযোধ্যায় শান্তি প্রতিষ্ঠা। বিদ্রোহীরা পরাজিত হলেও, বিদ্রোহ পরাস্ত হয়নি। অযোধ্যার দুর্দান্ত তালুকদারদিগকে বশীভূত করিয়া রাজভক্ত প্রজায় পরিণত করিবার দুঃসাধ্য কার্য আপনাকেই করিতে হইবে। আপনি আমাদের পরম আস্থাভাজন এক রাজভক্ত।

২৫ অক্টোবর, ১৮৫৯-দক্ষিণারঞ্জনের জীবনের রেড লেটার ডে। লর্ড ক্যানিং লখনউ দরবারে ঘোষণা করলেন, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, আপনাকে অযোধ্যায় অবৈতনিক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের পদে অধিষ্ঠিত করা হল। এই সঙ্গে আপনাকে রায়বেরেলির অন্তর্গত শঙ্করপুর তালুকটিও প্রদান করা হল। আপাতত, আপনার কর্মক্ষেত্র অযোধ্যা প্রদেশ।

শঙ্করপুরের তালুকটি ছিল রাজা বেণীমাধো বক্সের। তিনি সিপাহি আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন। সরকার তাঁর সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন। এই তালুকটির সেই সময় বাৎসরিক আয় ছিল পঞ্চাশ হাজার টাকা। তালুকটি যথেষ্ট বড়। জায়গায়, জায়গায় ভীষণ অরণ্য। হিংস্র পশু শুধু নয়, হিংস্র মানুষের বাস। দক্ষিণারঞ্জনের অক্লান্ত চেষ্টা ও ব্যবস্থাপনায় অঞ্চলটি উন্নত হল। জীবনের শেষ আকাশে সূর্যোদয় ঘটালেন ডফ সাহেব। এই সাহেবকে কী ভাবে তাঁর হৃদয়ের কৃতজ্ঞতা জানাবেন! তাঁর তালুকের একটি গ্রামের নাম রাখলেন, ডফপুর। তাঁর নামে ভারতের একটি গ্রাম চিহ্নিত হতে চলেছে শুনে সাহেব দক্ষিণারঞ্জনকে একটি আবেগভরা চিঠি লিখেছিলেন, তারই একটি অংশ:

I say them that seldom have I ever received a letter which has afforded me more real joy. I could almost weep for joy. you are now at least in your right place-your proper sphere-a sphere in which, if spared. You have before you a long, honorable and distinguished career, alike of usefulness to your self and benefit poor bleeding country.

এই চিঠিতে ডফ সাহেব দক্ষিণারঞ্জন সম্পর্কে তাঁর ধারণা প্রকাশ করেছেন, যা দক্ষিণারঞ্জনের চরিত্রের প্রকৃত গ্রহণযোগ্য আলেখ্য। দেশের মানুষ, কিংবা বিদেশিরা তাঁকে চিনেছিল কি? এতটা সাফল্য ঈর্ষার কারণ তো হবেই। সেই এডওয়ার্ড সাহেব দক্ষিণারঞ্জনকে তখনও অব্যাহত দেননি। কুৎসার পর কুৎসা রটনা করেই চলেছেন। ডফ সাহেব লিখছেন, ৩০ বছর আগে প্রথম দেখাতেই আমি তোমার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলুম you are so frank, so open, so manly, so straight forward, so energetic, so overflowing also with generous and benevolent impulses. That I felt irresistibly drawn to you. And never never for a moment was my own confience in you shaken.

কেন রাজবধূ বসন্তকুমারী রাজগৃহ পরিত্যাগ করে তাঁর সঙ্গে বর্ধমানের পথে নেমেছিলেন? ডফ সাহেবের এই উক্তি থেকেই বোঝা যায়! প্রকৃত একজন পুরুষ। অপ্রতিরোধ্য তাঁর আকর্ষণ। সহজ, সরল, উদার, উপকারী, দয়ালু। তিরিশ বছরেও আলেকজান্ডার ডফের তাঁর প্রতি আকর্ষণ এতটুকু কমেনি। দুর্জয় সাহসী এই মানুষটি যখন অযোধ্যায় এলেন, তখন বিদ্রোহের আগুন নিবে গেলেও ধোঁয়া উঠছে। ইংরেজদের শাসনের মুঠো দৃঢ় হচ্ছে। ভারতবর্ষকে বিদেশিরা এইবার বজ্রমুষ্টিতে ধরবেন। এই সব সায়েবদের সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়ে চলবেন। প্রয়োজনে সমালোচনা করবেন, প্রতিবাদ করবেন। তাঁর চাপে উচ্চ পদস্থ ইংরেজ অফিসার বদলি হবেন। তৎকালের অযোধ্যাবাসী তাঁদের এমন একজন সুহৃদকে পেলেন, যিনি ইংরেজ শাসনের চড়া আলোয় ভালোবাসার ছত্রচ্ছায়া। দীর্ঘকাল ধরে এই অঞ্চলের তালুকদাররা নিজেদের ভোগ-সুখের কথাই ভেবেছেন। এতদিনে এমন একজন এলেন যিনি জনহিতের কথা ভাবেন। যাঁর লক্ষ্য সমাজের সর্বস্তরের সর্ব বিষয়ে উন্নতি। বিদ্রোহদীর্ণ একটি প্রদেশকে গড়ে তোলা। প্রকারান্তরে বিদেশি শাসকদের জনমুখী করে তোলা।

সংস্কারমূলক প্রথম কাজটি হল–শিশুহত্যা নিবারণ। অযোধ্যা প্রদেশে বসবাসকারী রাজপুতরা শিশুকন্যাদের বধ করতেন। দক্ষিণারঞ্জনের চেষ্টায় এই নৃশংস প্রথা বন্ধ হল। এরপর ভূমি সংক্রান্ত প্রচলিত আইনের সংস্কার। দুটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন, সমাচার হিন্দুস্থানি ও ভারত পত্রিকা। তাঁরই প্রচেষ্টায় আমিনাবাদ প্রাসাদে স্থাপিত হল ক্যানিং স্কুল। পরে এটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে উন্নীত হল কলেজে। কয়েক বছর পরে আইন বিভাগও চালু হল। স্থাপিত হল অভিজাত ওয়ার্ড ইনস্টিটিউশন ও নৈশ বিদ্যালয়। নিজের তালুকে চালু করলেন একটি দাঁতব্য চিকিৎসালয়। খরচ চালাবার জন্যে ৪৮০ একর জমি দান করলেন।

শুধু অযোধ্যা প্রদেশে নয় সারা ভারতে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। অতঃপর এল সেই দিন– ১৮৭১ সালের ৫ মে, তিনি রাজ উপাধিতে ভূষিত হলেন। সনদ–ভারত সরকারের মোহর, ফরেন ডিপার্টমেন্ট–

To

Rajhah Dakshina Ranjan Mookherjee, Talooqdar of Oudh in consideration of your meritorius endeavours to promote the good of the province of Oudh, I hereby confer upon you the title of Raja as a personal distinction. (Sd) Mayo.

Dated, Simla, the 5th May, 1871

ডাক্তার ডফ এডিনবরা থেকে লিখলেন। তিনি অসুস্থ। পূর্বের কর্মশক্তি নেই, কিন্তু ভারত সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ এতটুকু কমেনি। তিনি খুশি, ভীষণ খুশি। তিনি জানতেন স্বীকৃতি আসবেই; একটু দেরিতে এল–Better late then never.

আর মাত্র তিন বছর। বেশ যখন জমে উঠছে যশ, খ্যাতি, প্রতিপত্তি, বাদ-বিবাদ-বিসম্বাদ। বড় গাছে বাতাস বেশি ধরে। সে বাতাস প্রতিহত করার ক্ষমতা রাজার ছিল। ভেবেছিলেন, সাগর পারে, ইংল্যান্ডে যাবেন। শেষ পর্যন্ত যাওয়া হল না অজ্ঞাত কারণে। ইন্দোরের রাজা হোলকার তাঁকে প্রধানমন্ত্রী করতে চাইলেন, দক্ষিণারঞ্জন প্রত্যাখ্যান করলেন বিনীতভাবে, অজ্ঞাতকারণে। ইংরেজ সরকার এবং অযযাধ্যাবাসী দেশীয়রা–উভয়েই দক্ষিণারঞ্জনের প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি বিদ্রোহের পর যে বিভেদ সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করে মৈত্রীর বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিলেন, যা একা ইংরেজদের পক্ষে করা কখনওই সম্ভব হত না। স্যার রোপার লেথব্রিজ লিখলেন :

He did much to remove the racial antipathies between the English and the Indians.

কৃতজ্ঞ অযোধ্যাবাসীরা মহারাজ দিগ্বিজয় সিং-এর প্রতিনিধিত্বে একটি সভা আহ্বান করে দক্ষিণারঞ্জনকে স্বর্ণপদক প্রদান করলেন। একদিকে ইংরেজি অন্য দিকে পারস্য ভাষায় Grah 007: Oudhs love and gratitude through its British Indian Association to Baboo Dakshina Ranjan Mukherjee Bahadur.

দিনের আলো কি কমছে? আসল মানুষটি কোথায়। রাজনারায়ণ বুঝতে পারছেন না, তিনি। ব্রাহ্ম, না টিকিধারী ব্রাহ্মণ। মহর্ষির বেদ, না, রামমোহনের উপনিষদ! ব্রিটিশ বন্ধু, না ভারত বন্ধু। নিঃসন্দেহে এক কৃতী স্টেটসম্যান। তাঁর পারিবারিক জীবন? প্রথম স্ত্রী জ্ঞানদাসুন্দরী তাঁকে একটি গুণী, অসীম পিতৃভক্ত কন্যা দিয়েছে মুক্তকেশী। মুক্তকেশী প্রতিটি দিন শুরু করেন পিতাকে একটি চিঠি লিখে। মুক্তকেশী শিল্পী! দক্ষিণারঞ্জন খুব ভালোবাসেন। বিবাহ। দিয়েছেন, স্বনামধন্য মহাত্মা হরিমোহন ঠাকুরের প্রপৌত্র ললিতমোহন ঠাকুরে পুত্র। রঘুনন্দনের সঙ্গে। মুক্তকেশীর তিন কন্যা, এক পুত্র রণেন্দ্রমোহন। দক্ষিণারঞ্জনের প্রাণপ্রতিম রণজিৎ। বহু গুণের অধিকারী-সুপুরুষ।

দক্ষিণারঞ্জনের প্রেমিকা বসন্তকুমারী, যাঁর জীবন এক দীর্ঘশ্বাস। দক্ষিণারঞ্জন যাঁকে বর্ধমানের ধুলো থেকে বহু ঝুঁকি সত্বেও তুলে নিয়েছিলেন বুকে। রাজকন্যা নন এক রাজবধূ। তিনি উপহার দিয়েছিলেন একমাত্র বংশধর মনোহররঞ্জন। কান্যকুজ দেশীয় হিন্দুস্থানি ব্রাহ্মণ কাশীরাম শুকুলের কন্যা রামকুমারী দেবীর সঙ্গে মনোহরের বিবাহ দিলেন। মনোহরের দুটি কন্যা ও একটি পুত্র হল। পুত্র ভুবনরঞ্জনের বিবাহ হল এক ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে। অনেক আলোর ঝাড়বাতি।

কিন্তু নায়ক এইবার যাবেন বুঝি চির বিশ্রামে। তা অনেক হল! কী বলো বসন্তকুমারী! চিরকাল কি কেউ বসন্তে থাকে? শীত আসবেই শীতল মৃত্যু নিয়ে। অযোধ্যা কী শ্রীরামচন্দ্রকে ধরে রাখতে পেরেছে যে আমাকে পারবে! বসন্ত! নবাব ওয়াজিদ আলি সাহেবের কথা মনে পড়ে! সেই হতভাগ্য রাজা! কৈসার বাগ! কৈসার বাগ! প্রমোদ উদ্যান, প্রমোদ ভবন। মঞ্জিলা! ফোয়ারা, গীত, গজল এক কোটি টাকা খরচ করেছিলেন নবাব! প্রাচীর ঘেরা সেই বাগান! এক-একটি সৌধে এক-একজন বেগম। প্রতিটি সৌধে আলাদা বাগান। আনন্দের ফোয়ারা! বসন্ত সব শ্মশান। দেশীয় রাজাদের দিন শেষ। ইংরেজের ঘোড়া ছুটছে। কামানের গর্জন! হাত ছাড়ো! আমি যাই। তুমি আরও কিছু দিন থাকো। আমি তোমাকে ভালোবাসি বসন্ত! সেই ভালোবাসারই টানে আবার কোনওদিন ফিরে আসব। আবার, আবার সেই এক খেলা। শত্রু, মিত্র সবাই রইল, পরিবার, পরিজন তাদের দেখো!

আমার কথাটি ফুরলো,
নটে গাছটি মুড়লো।।

তুমি চিরকালই একা। মনোহররঞ্জনও অকালে চলে গেল। কে যায়, কে থাকে?

ক্যালেন্ডার লিখে রাখে–১৮৭৮ সাল, ১৫ জুলাই, ৬৪ বছর বয়সে লখনউ নগরীতে রাজা দক্ষিণারঞ্জন মুখোঁপাধ্যায়ের জীবনাবসান।

ঋণ স্বীকার
মন্মথনাথ ঘোষ।।
সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।।
আবদুল গণি খান।।

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 6 of 6 ): « পূর্ববর্তী1 ... 45 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress