Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

কী বা করবার থাকতে পারে চিরকালের চেনা-জানা দুনিয়ার সঙ্গে একেবারে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দু-চার হাজার নয়, অমন দু-চার কোটি কিলোমিটার ভেসে ভেসেই ছাড়িয়ে যেতে যেতে!

হ্যাঁ, ক-দিন বাদে তা-ই তখন আমাদের অবস্থা।

অনেক কিছুই তার মধ্যেই জানতে পেরেছি।

জেনেছি যে ফোঁপরা ঢিবির খাঁচায় বন্দী হবার পর অদ্ভুত যে মানুষটার প্রথম দেখা পেয়েছিলাম, মিথ্যা সে কিছু বলেনি।

সত্যিই আমাদের অপেক্ষাতেই সে ছিল। আমাদের মানে, একেবারে নাম ধরে সুরঞ্জন, ঘনশ্যাম, বটুকেশ্বরের নয়, মানুষ হিসেবে যে-কেউ আসে।

কিন্তু কেন? কী তার মতলব? কে সে?

তাও জেনেছি। সে নিজেই বড়াই করে সব শুনিয়েছে, কিন্তু আমাদের জানপ্রাণের চাবিকাঠি যে তার হাতে সে কথাটা ভাল করে বোেঝবার আগে নয়।

ঢিবির ফোঁপরা গহ্বরটা তখন বেশ বিশ্রীভাবে কাঁপতে শুরু করেছে। যেখান দিয়ে ঢুকেছিলাম সেখানকার ফাঁকটা ঝাঁপের মতো একটা কিছু পড়ে তখন বন্ধ।

এ সব থেকে তখন বুঝতে পারছিলাম যে বাইরে যেটার বালির ঢিবির মতো চেহারা, আসলে সেটা কোনওরকম একটা ধাতুর তৈরি বিরাট আশ্রয় গোছের।

মরুভূমির মাঝখানে এরকম একটা আস্তানা বানাবার কী উদ্দেশ্য তা অবশ্য তখন ধরতে পারিনি। মরু সম্পর্কে কোনওরকম বৈজ্ঞানিক গবেষণাই উদ্দেশ্য বলে মনে হয়েছে।

খাঁচার মতো আস্তানাটার ঝাঁপ বন্ধ হয়ে সেটা অমন বিশ্রীভাবে কাঁপতে শুরু করায় বেশ একটু অস্বস্তি বোধ হয়েছে।

আমার চেয়ে সুরঞ্জনেরই বেশি। লোহার সিঁড়িতে দাঁড়ানো অদ্ভুত মূর্তিটাকে তাই সে প্রথমেই প্রশ্ন করেছে, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন কেন? কে আপনি?

আমি, শুটকো লোকটা অদ্ভুত ভাবে হেসে বলেছে, আমাকে সারেং বলতে পারো, আর তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছি সওয়ারি দরকার বলে।

সারেং, সওয়ারি—-লোকটা এসব বলছে কী? লোকটার চেহারায় চোখের দৃষ্টিতে একটা পাগলাটে ছাপ কিন্তু আছে।

একটু কড়া গলাতেই তাই জিজ্ঞাসা করেছি, কীসের সারেং তুমি? আমাদের সওয়ারি বলছ কেন?

কেন বলছি, দেখবে?

এবার সত্যিই পাগলের হাসি হেসে উঠেছে লোকটা। তারপর লোহার সিঁড়িটা দিয়ে একটু ওপরে উঠে—কোথায় একটা বোম টেপার সঙ্গে সঙ্গে অবাক হয়ে দেখেছি আমাদের খাঁচার মতো আশ্ৰয়টার একটা দিকের গোল দেওয়াল আপনা থেকেই সরে গিয়ে বিরাট একটা জানলা গোছের বেরিয়ে পড়ছে।

কিন্তু জানলার বাইরে ও কী দেখা যাচ্ছে?

আকাশ তো পরিষ্কার। ঝলমল করছে তার মধ্যে তারাগুলো! বালির ঝড় তা হলে থেমে গেছে? ঝড়ে আকাশটার এক রকম ঝাড়পোঁছ হয়ে গেছে বলেই বোধহয় তারাগুলো অত বেশি উজ্জ্বল মনে হচ্ছে।

কিন্তু তারাগুলো মিটমিট করছে না কেন?

ব্যাপারটা চোখে পড়লেও তার সঠিক তাৎপর্যটা তখনও বুঝিনি।

বুঝতে অবশ্য দেরি হল না। যার মধ্যে আছি সেই রহস্যময় আশ্রয়টার অদ্ভুত কাঁপুনি তখন আশ্চর্যভাবে থেমে গেছে। কিন্তু সব কিছু ব্যাপার মিলে আমাদের অস্বস্তি আর উদ্বেগ দিয়েছে বাড়িয়ে।

সুরঞ্জন তাই তার মনের কথাটা জোর গলাতেই জানিয়ে দিলে। বললে, সওয়ারি-টওয়ারি আমরা হতে চাই না। আকাশ দেখে তো বুঝছি বাইরের ঝড় থেমে গেছে। দরজা খুলিয়ে দিন, আমরা বেরিয়ে যাব।

বেরিয়ে যাবে? লোকটার আবার সেই শয়তানি হাসি, বেশ, যাও। তবে একটু লাফ দিতে হবে। পারবে?

লাফ দিতে হবে। এবার আমিই সন্দিগ্ধ হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?

তা না হলে নামবে কী করে? বাচ্চাদের সঙ্গে যেন তামাশা করার ধরনে লোকটা বললে, বেশি কিছু নয়! এখন হাজার বিশ কিলোমিটার লাফ দিলেই চলবে।

বিশ হাজার কিলোমিটার!

শুধু সন্দিগ্ধ আর নয়। রীতিমত ভীত হয়েই জানলাটার দিকে ছুটে গেলাম। খোলা বলে যা মনে হচ্ছিল সে জানলা দেখলাম বন্ধ, তবে কাঁচের চেয়ে স্বচ্ছ এমন কিছু জিনিস, যা হাতে না ছুঁলে কাছে থেকেও বোঝা যায় না।

তারাগুলোকে ঝিকমিক করতে না দেখে ক্ষীণ যে সন্দেহটুকু মনে জেগেছিল আর নেহাত আজগুবি ভেবে যে ধারণাকে আমল দিইনি, স্তম্ভিত হয়ে বুঝলাম তা-ই সম্পূর্ণ সত্য।

জানলার কাছে ছুটে আসার সময়ই অবশ্য ব্যাপারটার আভাস পাওয়া উচিত ছিল।

ছুটতে গিয়ে আধা-ভাসমান অবস্থাতেই সবেগে জানলাটার কাছে পৌঁছেছি। দুহাত বাড়িয়ে দেয়ালে না ভর দিলে মাথাটাই ঠুকে যেত!

উত্তেজনা ও উদ্বেগে ব্যাপারটা তখন তেমন গ্রাহ্যের মধ্যে আনিনি।

এখন জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্যের সঙ্গে অন্য সব কিছু মিলিয়ে হতাশ হয়ে বুঝলাম, যেখানে ছিলাম থরের সেই মরুতে তো নয়ই, পৃথিবীরই কোথাও নামবার আর উপায় নেই।

পৃথিবীকে বহুদূরে পেছনে ফেলে আমরা মহাশূন্যে ভেসে চলেছি।

ওই উন্মাদ লোকটা যা বলেছে—পৃথিবী ক্রমশ প্রতি মুহূর্তে সেই বিশ হাজার কিলোমিটারের থেকেও দূরে সরে যাচ্ছে।

বিস্ময়ে যেমন হতভম্ব, নিজেদের নিরুপায় অবস্থায় তেমনই হতাশ হয়ে উন্মাদ চেহারার লোকটার দিকে এবার ফিরেছি।

লোকটা তখন আমাদের অবস্থা দেখে মিট মিট করে হাসছে।

চেহারা যার উন্মাদের মতো, লোকটা সত্যি কি তাই?

উন্মাদ হলে এমনই অবিশ্বাস্য আশ্চর্য একটা ব্যাপার সে কি সম্ভব করে তুলতে পারে?

পরে বুঝেছি যে উন্মাদ বলেই সে তা পেরেছে।

নাম অ্যালজার লুটভিক। পৃথিবীর কোনও দেশের বৈজ্ঞানিকদের তালিকায় তার নাম পাবে না।

তবে কোথা থেকে তার উদয় হল? লুটভিক কি ভুঁইফোড়?

না, নানা দেশে নানা নামে বহুকাল ধরে সে তার গবেষণা চালিয়ে এসেছে। তার আসল কাজ আর উদ্দেশ্য কাউকে বুঝতে না দেবার জন্যই এই চালাকি।

সব গবেষণা শেষ করার পর তার অবিশ্বাস্য পরীক্ষা চালাবার সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা হিসেবে বেছে নিয়েছে থরের এই মরুভূমি।

মরুভূমিই তার দরকার ছিল। কারণ পৃথিবীর সব জায়গায় বিঘ্ন হবার ভয় অনেক বেশি। সাহারায় তখনও ফরাসিদের দাপট। তারা নিজেরাই সেখানে পারমাণবিক পরীক্ষা-টরিক্ষা চালাচ্ছে। সুতরাং সেখানে নিশ্চিন্তে নিরিবিলিতে কাজ করা যাবে না।

টাকলা মাকানেও তাই। সেখানে চিনের নজর এড়িয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে ভাল মনে হয়েছে থরের মরুর এই অঞ্চলটা। একদিকে ভারত, একদিকে পাকিস্তান। মাঝখানে খানিকটা প্রায় বেওয়ারিশ নো-ম্যানস-ল্যান্ড। একেবারে নিষ্ফলা ধু-ধু মরু বলে কারওর জায়গা নিয়ে মাথাব্যথা নেই।

লুটভিক তাই নিঝাটে এখানে তার আস্তানা গেড়েছে। সরকারের তরফ থেকে সামান্য খোঁজখবর যা হয়েছে তার মুখ চাপা দিয়েছে জ্যোতির্বিদ্যার মানমন্দির বসাবার জায়গা খোঁজার অজুহাত দিয়ে। অবিশ্বাসের কিছু নেই। মহাশূন্যের দুরবিন বসাবার মানমন্দিরের জন্য নির্মেঘ শুকনো এমনই মরু-অঞ্চলই সত্যি লাগে।

লুটভিক বড়াই করে নিজেই নিজের এসব কীর্তি শুনিয়েছে।

এ বিবরণে তার ধূর্ত বুদ্ধির পরিচয় থাকলেও সে যে অমানুষিক অপ্রকৃতিস্থ কিছু, এমন কোনও আভাস পাওয়া যায়নি।

সুরঞ্জনের পরের প্রশ্নের জবাবেই লুটভিক-এর সেই ভয়ংকর রূপটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

লুটভিক-এর বাহাদুরির ইতিহাস শুনতে শুনতে সুরঞ্জন স্বাভাবিক কৌতূহলেই জিজ্ঞাসা করেছে, বুঝলাম, আপনি মস্ত একজন বৈজ্ঞানিক, যা এখানে গড়ে তুলেছেন তা আশ্চর্য এক মহাকাশযান। কিন্তু এতে আমাদের সওয়ারি নেবার আপনার কী দরকার ছিল?

কী দরকার ছিল? লুটভিক-এর সেই শয়তানি হাসি আবার তখন শুরু হয়েছে—ল্যাবরেটরিতে গিনিপিগ কি সাদা ইঁদুরের কী দরকার থাকে? ইচ্ছে করলে জন্তু-জানোয়ারও নিতে পারতাম, কিন্তু তার চেয়ে মানুষই ভাল মনে হল।

আমাদের আপনি আপনার বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় গিনিপিগের মতো ব্যবহার করবার জন্য সঙ্গে নিয়েছেন? আমাদের সকলের স্তম্ভিত প্রশ্নটাই সুরঞ্জনের মুখ দিয়ে বার হল। কী করবেন আমাদের দিয়ে?

যা-ই করি না, লুটভিক আমাদের যেন লোভ দেখিয়ে আশ্বাস দিলে, খাওয়া-দাওয়া থেকে আরামে থাকার ব্যবস্থার কোনও ত্রুটি হবে না। উপরি হিসেবে এই আশ্চর্য শূন্য প্রয়াণ তো আছেই। মিছে বাজে ভাবনা ভেবে তো লাভ নেই। বিজ্ঞানের জন্যই নিজেদের উৎসর্গ করছ জেনে এখন খাওয়া-দাওয়া বিশ্রাম করো। এখানে সবরকম ব্যবস্থা আছে। ইচ্ছে করলে ওই জানলা দিয়ে মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রের শোভাও দেখতে পারো।

শেষ একটা নিষ্ঠুর শয়তানি হাসি হেসে লুটভিক আমাদের কামরার দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যখন চলে গেল তখন আমরা সবাই বোবা হয়ে গেছি। ভয়ে ভাবনায় হতবুদ্ধি হয়ে আমাদের জিভগুলোও তখন আড়ষ্ট।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *