Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মগ্নমৈনাক – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 5

মগ্নমৈনাক – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

শ্ৰীমতী সুকুমারীর বাসা মধ্য কলিকাতার ভদ্রপল্লীতে‌, আমাদের বাসা হইতে বেশি দূর নয়। বাড়ির নীচের তলায় দোকানপাট‌, দ্বিতলে শ্ৰীমতী সুকুমারীর বাসস্থান।

সিঁড়ি দিয়া উঠিতে উঠিতে মৃদঙ্গ ও খঞ্জনির মৃদু নিক্কণ শুনিতে পাইলাম। সঙ্গে তরল বিগলিত কণ্ঠস্বর-রাধেশ্যাম‌, জয় রাধেশ্যাম! এটা বোধহয় সুকুমারী বৈষ্ণবীর গলা-সাধার সময়।

কড়া নাড়ার উত্তরে একটি বর্ষীয়সী স্ত্রীলোক আসিয়া দ্বার খুলিয়া দিল। থান-পরা গোলগাল চেহারা, চোখে স্টীলের চশমা, মুখখানি জীবনের অভিজ্ঞতায় পরিপক্ক। অনুমান করিলাম-সুকুমারীর ‘মাসি’ এবং ‘বিজনেস ম্যানেজার’।

একটি ক্ষুদ্র ঘরে আমাদের বসাইয়া মাসি ভিতরে গেল। আমরা জাজিমপাতা তক্তপোশের কিনারায় বসিলাম। ঘরে অন্য আসবাব নাই‌, কেবল দেয়ালে গৌর-নিতাইয়ের একটি যুগ্নচিত্র বুলিতেছে।

ভিতরের ঘরে যন্ত্রসঙ্গীত বন্ধ হইল। মাসি আসিয়া আমাদের ভিতরে লইয়া গেল। এটি বেশ বড় ঘর‌, মেঝেয় কাপেট পাতা। একজন শীর্ণকায় কঠিধারী বৈষ্ণব মৃদঙ্গ কোলে লইয়া যামিনী রায়ের ছবির ন্যায় বসিয়া ছিলেন‌, আমাদের দেখিয়া কঠোর চক্ষে চাহিলেন‌, তারপর উঠিয়া চলিয়া গেলেন। অদূরে সুকুমারী খঞ্জনি হাতে বসিয়া ছিল‌, নতশিরে আমাদের প্রণাম করিয়া ললিতকণ্ঠে বলিল‌, ‘আসুন।’

এক একজন মানুষ আছে যাহাদের যৌবনকাল অতীত হইলেও যৌবনের কুহক থাকিয়া যায়। সুকুমারীর বয়স সাঁইত্রিশ-আটত্রিশের কম নয়‌, কিন্তু ওই যে ইংরেজিতে যাহাকে যৌন-আবেদন বলে তাহা এখনো তাহার সবঙ্গে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যামান; সাদা কথায়‌, তাহাকে দেখিলে পুরুষের মন অশ্লীল হইয়া ওঠে। উন্নত দীঘল দেহ‌, মুখখানিতে স্নিগ্ধ সরলতা মাখানো‌, চোখ দু’টি ঈষৎ ঢুলঢুলে। ছলাকলার কোন চেষ্টা নাই‌, অকপট সহজতাই যেন তাহাকে কেন্দ্ব করিয়া নিবিড় মায়াজাল বিস্তার করিয়াছে। তাহাকে দেখিয়া প্রত্যয় হয়‌, কেবল সুকণ্ঠের জন্যই সে বিখ্যাত কীৰ্তন-গায়িকা হয় নাই‌, রূপ-গুণ-চরিত্র মিশিয়া যে সত্তাটি সৃষ্টি হইয়াছে তাহাই বিদগ্ধজনের চিত্ত আকর্ষণ করিয়া লইয়াছে; সে যেন মহাজন কবিদের কল্প লোকবাসিনী চিরায়মানা বৈষ্ণবী।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘সন্তোষবাবু আপনার ঠিকানা দিয়েছিলেন‌, তাই ভাবলাম—’

সুকুমারী ব্যোমকেশের মুখের উপর মোহভরা চক্ষু রাখিয়া বলিল‌, উনি আপনার কথা ফোনে জানিয়েছেন।’ শুধু গানের গলা নয়‌, তাহার কথা বলার কণ্ঠস্বরও মধুক্ষরা।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘তাহলে হেনার কথা শুনেছেন?’

সুকুমারী একটু বিষণ্ণভাবে ঘাড় নাড়িয়া বলিল‌, ‘হ্যাঁ।’

‘হেনা নামে একটি মেয়েকে সন্তোষবাবু নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন‌, একথা আপনি আগে থেকেই জানতেন?’

‘হ্যাঁ। বাপ-মা হারা বন্ধুর মেয়েকে আশ্রয় দিয়েছিলেন আমি জানতাম।’

ব্যোমকেশ একটু কুষ্ঠিতভাবে বলিল‌, ‘দেখুন‌, আপনার সঙ্গে সন্তোষবাবুর দীর্ঘকালের ঘনিষ্ঠতার কথা আমি জানি‌, সুতরাং আমার কাছে সঙ্কোচ করবেন না। সেদিন—অর্থাৎ শনিবার দুপুরবেলা থেকে কি কি হয়েছিল আমায় বলুন।’

সুকুমারী কিছুক্ষণ নতমুখে পায়ের নখ খুঁটিয়া বলিল‌, ‘আমার মনে কোন সঙ্কোচ নেই‌, বরং গৌরব। কিন্তু ওঁর মান ইজ্জত আছে‌, তাই লুকিয়ে রাখতে হয়। সেদিনের কথা শুনতে চান বলছি। ও বাড়িটাকে আমরা ছোট বাড়ি বলি। সেদিন বেলা আন্দাজ দুটোর সময় এখানকার কাজকর্ম সেরে আমি ছোট বাড়িতে গেলুম। পাঁচ দিন বাড়ি বন্ধ থাকে‌, ঝাড়া মোছা করতে সাড়ে তিনটে বেজে গেল। তারপর উনি এলেন।

‘এসে অফিসের কাপড়-চোপড় ছেড়ে স্নান করলেন। ছোট বাড়িতে ওঁর পাঁচ সেট জামা-কাপড় আছে‌, অনেক ইংরেজি বই আছে। উনি নিজের ঘরে গিয়ে বই নিয়ে বসলেন‌, আমি জলখাবার তৈরি করতে গেলুম। বাজারের খাবার উনি খান না।

‘ছটার সময় উনি জলখাবার খেলেন। তুতারপর গান শুনতে বসলেন। ছোট বাড়িতে সঙ্গীতের যন্ত্র কিছু নেই‌, আমি কেবল খঞ্জনি বাজিয়ে গান গাই। মনে আছে‌, সেদিন তিনটে পদ গেয়েছিলাম। একটি চণ্ডীদাসের‌, একটি গোবিন্দদাসের‌, আর একটি জগদানন্দর।

‘একটি পদ গাইতে অন্তত আধা ঘন্টা সময় লাগে। আমি জগদানন্দর ‘মঞ্জু বিকচ কুসুম-পুঞ্জ’ পদটি শেষ করে এনেছি‌, এমন সময় পাশের ঘরে টেলিফোন বেজে উঠল। আমি উঠবার আগেই উনি গিয়ে ফোন ধরলেন। দুমিনিট পরে ফিরে এসে বললেন‌, ‘আমি এখনি যাচ্ছি‌, হেনা ছাদ থেকে পড়ে মারা গেছে।’

‘তিনি যে-বেশে ছিলেন সেই বেশে বেরিয়ে গেলেন।’

সুকুমারী নীরব হইলে ব্যোমকেশও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল‌, শেষে বলিল‌, ‘কে টেলিফোন করেছিল। আপনি জানেন না?’

সুকুমারী বলিল‌, ‘না। তারপর আমি এ-বাড়িতে খোঁজ নিয়েছিলাম‌, কিন্তু এ-বাড়ি থেকে কেউ ফোন করেনি।’

‘এ-বাড়িতে কে কে ফোন নম্বর জানে?’

‘কেবল দিদিমণি জানেন‌, আর কেউ না।’

‘দিদিমণি?

‘আমার অভিভাবিকা, কাজকর্ম দেখেন। তাঁকে ডাকব?’

‘ডাকুন।’

যাহাকে মাসি ভাবিয়ছিলাম। তিনিই দিদিমণি; আজকাল বোধহয় উপাধির পরিবর্তন ঘটিয়াছে। ব্যোমকেশের প্রশ্নের উত্তরে তিনি সুকুমারীর বাক্য সমর্থন করিলেন। সেদিন তিনি টেলিফোন করেন নাই‌, এ-বাড়িতে তিনি ও সুকুমারী ছাড়া ছোট বাড়ির টেলিফোন নম্বর আর কেহ জানে না।

দিদিমণি প্রস্থান করিলে ব্যোমকেশ উঠিবার উপক্রম করিয়া বলিল‌, ‘আপনার সকালবেলাটা নষ্ট হল।‘

সুকুমারী হাত জোড় করিয়া বলিল‌, ‘যদি পায়ের ধুলো দিয়েছেন‌, একটা গান শুনে যান। আমার তো আর কিছুই নেই।’

সাদা গলায় কেবল খঞ্জনি বাজাইয়া সুকুমারী গান করিল। বিদ্যাপতির আত্মনিবেদন-মাধব‌, বহুত মিনতি করি তোয়।

তাহার গান পূর্বে কখনো শুনি নাই‌, শুনিয়া বিভোর হইয়া গেলাম। কণ্ঠের মাধুর্যে উচ্চারণের বিশুদ্ধতায়‌, অনুভবের সুগভীর ব্যঞ্জনায় আমার মনটাকে সে যেন কোন দুর্লভ আনন্দঘন রসলোকে উপনীত করিল। এতক্ষণ তাহার চিত্তচাঞ্চল্যকর কুহকিনী মূর্তিই দেখিয়ছিলাম‌, এখন তাহার শুদ্ধশান্ত তদগত তাপসী রূপ দেখিলাম।

সেদিন বাসায় ফিরিতে বেলা একটা বাজিয়া গেল।

স্নানাহার সারিয়া আমি বাহিরের ঘরে আসিয়াছি‌, ব্যোমকেশ তখনো আচাইতেছে‌, টেলিফোন বাজিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি গিয়া ফোন তুলিয়া লইলাম। সঙ্গে সঙ্গে নারীকণ্ঠে প্রবল বাক্যস্রোত বাহির হইয়া আসিল–’হ্যালো‌, ব্যোমকেশবাবু্‌, আমি চামেলি সমাদ্দার। দেখুন‌, আপনি সন্দেহ করেন আমার ছেলেরা হেনাকে খুন করেছে। ভুল-ভুল। আমার ছেলেরা বাপের মত নয়‌, ওরা সচ্চরিত্র ভাল ছেলে। ওরা কেন হেনাকে খুন করতে যাবে? আমি বলছি আপনাকে‌, কেউ হেনাকে খুন করেনি‌, সে নিজে ছাদ থেকে পড়ে মরেছে। নীচের দিকে উঁকি মেরে দেখছিল‌, তাল সামলাতে পারেনি।’

এই পর্যন্ত বলিয়া তিনি দম লইবার জন্য থামিলেন‌, আমি অত্যন্ত সঙ্কুচিতভাবে বলিলাম‌, ‘দেখুন‌, আমি ব্যোমকেশ নই‌, অজিত। ব্যোমকেশকে ডেকে দিচ্ছি।’

কিছুক্ষণ হতচকিত নীরবতা‌, তারপর কটু করিয়া টেলিফোন কাটিয়া গেল।

ইতিমধ্যে ব্যোমকেশ আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল‌, তাহাকে শ্ৰীমতী চামেলির কথা বলিলাম। সে সিগারেট ধরাইয়া পায়চারি করিতে করিতে বলিল–’মহিলাটির প্রকৃতি স্নায়ুপ্রধান। আজ আমি। তাঁর ছেলেদের যে-সব প্রশ্ন করেছি তা বোধহয় জানতে পেরেছেন‌, তাই ভয় হয়েছে। পুলিস যে হাত গুটিয়েছে তা জানেন না‌, জানলে আমাকে ফোন করতেন না।’ আমি বলিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ‌, আজ তো সকলকেই নেড়েচেড়ে দেখলে। কিছু আন্দাজ করতে পেরেছে?’

সে হাত তুলিয়া বলিল‌, ‘দাঁড়াও‌, আরো ভাবতে দাও।’

অপরাহ্নে বিকাশ আসিল‌, সঙ্গে একটি ক্ষীণকায় যুবক। বিকাশের চেহারা বা বাকভঙ্গীতে কোনো পরিবর্তন নাই; সে যুবকের দিকে তর্জনি নির্দেশ করিয়া বলিল‌, ‘এর নাম গুপীকেষ্ট‌, আমার শাকরেদ। যদি দরকার হয় তাই সঙ্গে এনেছি স্যার।’

এমন লোক আছে যাহাকে একবার দেখিয়া ভোলা যায় না। গুপীকেষ্ট ঠিক তাহার বিপরীত‌, তাহার চেহারা এতাই বৈশিষ্ট্যহীন যে হাজার বার দেখিলেও মনে থাকে না‌, বহুরূপী গিরগিটির মত বাতাবরণের সঙ্গে বেবাক মিশিয়া অদৃশ্য হইয়া যায়।

ব্যোমকেশ গুপীকেষ্টকে পরিদর্শন করিয়া সহাস্যে বলিল‌, ‘বেশ বেশ‌, বোসো তোমরা। দু’জনকেই দরকার হবে। আরো দু’জন পেলে ভাল হত।’

বিকাশ সোৎসাহে বলিল‌, ‘আরো আছে স্যার। কয়েকটা ছেলেকে টিকটিকি-তালিম দিচ্ছি। যদি পিছনে লাগার কাজ হয়‌, তারা পারবে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হ্যাঁ, পিছনে লাগার কাজ। চারজন লোকের গতিবিধির ওপর লক্ষ্য রাখতে হবে।’

‘ব্যস‌, ঠিক আছে। বাবুই আর চিচিংকে লাগিয়ে দেব। ছেলেমানুষ হলেও ওরা হাঁশিয়ার আছে।’ বিকাশ ও গুপীকেষ্ট তক্তপোশের প্রান্তে বসিল‌, বিকাশ বলিল‌, ‘এবার সব কথা বলুন স্যার।‘

ব্যোমকেশ পুঁটিরামকে ডাকিয় চা-জলখাবার হুকুম করিল। তারপর মোটামুটি পরিস্থিতি বিকাশকে বুঝাইয়া দিল; চারজন লোকের উপর নজর রাখিতে হইবে; সন্তোষবাবু্‌, রবিবর্মা‌, যুগল এবং উদয়। তাহারা কোথায় যায়‌, কাহার সহিত কথা বলে‌, অগতানুগতিক কিছু করে কিনা। রোজ ব্যোমকেশকে রিপোর্ট দিবার প্রয়োজন নাই‌, কিন্তু কোনো বিষয়ে খাটুকা লাগিলে তৎক্ষণাৎ রিপোর্ট দিতে হইবে।

কাজকর্ম বুঝাইয়া দিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কাল থেকে কাজ শুরু করে দাও। আজ লোকগুলোকে তোমাদের চিনিয়ে দেব। সন্তোষবাবুর অফিস থেকে ফেরার সময় হল। চা খেয়ে নাও‌, তারপর আমি তোমাদের নিয়ে বেরুব।’ বিকাশ বলিল‌, ‘আপনার যাবার কিছু দরকার নেই স্যার। সন্তোষবাবুর ঠিকানা দিন‌, আমরা সবাইকে চিনে নেব।’

ব্যোমকেশ ঠিকানা দিল। বিকাশ বলিল‌, ‘এখন বলুন স্যার‌, কে কার পিছনে লাগবে। আমি কার পিছনে লাগব? সন্তোষবাবু?’

ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করিয়া বলিল‌, ‘না‌, তুমি লাগবে রবিবর্মার পিছনে। আর গুপীকেষ্ট লাগবে সন্তোষবাবুর পিছনে। বাকি দু’জন যেমন তেমন হলেই হল।’

‘তাই হবে স্যার।’ তাড়াতাড়ি জলযোগ সারিয়া বিকাশ ও গুপীকেষ্ট চলিয়া গেল। আমি বলিলাম‌, ‘সন্তোষবাবুকেও তাহলে তুমি সন্দেহ করা?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমি সকলকেই সন্দেহ করি। তুমি যদি সেদিন ওখানে উপস্থিত থাকতে‌, তাহলে তোমাকেও সন্দেহ করতাম।’

প্রশ্ন করলাম‌, ‘নেংটিকে সন্দেহ কর?’

সে বলিল‌, ‘নেংটি যদি আমাকে খবর না দিত তাহলে তাকেও সন্দেহ করতাম।’

‘আর চিংড়িকে?

‘চিংড়িকে সন্দেহ করি। বোধহয় লক্ষ্য করেছ‌, বয়সে ছেলেমানুষ হলেও সে যুগলকে ভালবাসে। হেনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বিনী‌, সুতরাং তার মোটিভ আছে। সুযোগও প্রচুর।’

‘কোথায় সুযোগ? যদি উদয়ের কথা বিশ্বাস করা যায়‌, হেনা ছাদে গিয়ে দোর বন্ধ করে দিয়েছিল।’

‘চিংড়ি আগে থাকতে ছাদে গিয়ে লুকিয়েছিল। কিনা কে জানে। এ যুক্তি শ্ৰীমতী চামেলির বেলাতেও খাটে। তিনি হেনাকে সহ্য করতে পারতেন না‌, তিনি মনে করতেন হেনার সঙ্গে তাঁর স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক আছে।’

ব্যোমকেশের কথাগুলো কিছুক্ষণ মনের মধ্যে তোলাপাড়া করিয়া বলিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ‌, তুমি এই কেস সম্বন্ধে কী বুঝেছি আমায় বল।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘একটি কথা নিঃসংশয়ে বলতে পারি—এটা দুর্ঘটনা নয়‌, খুন। এখন প্রশ্ন্‌্‌, কে খুন করেছে? একে একে সন্দেহভাজন লোকগুলিকে ধর। প্রথমে ধর সন্তোষবাবু। তিনি মস্ত বড় মানুষ‌, নামজাদা রাজনৈতিক নেতা। কিন্তু তাঁর একটি দুর্বলতা আছে। মৃত বন্ধুর অপূর্ব সুন্দরী মেয়েকে তিনি আশ্রয় দিলেন। তাঁর এই সৎকার্যটি সম্পূর্ণ নিঃস্বর্থ দয়াদাক্ষিণ্য না হতে পুঞ্জ‌, কিন্তু তিনি হেনাকে খুন করবেন কেন? সুন্ন করার কোন মোটিভ নেই থাকলেও আমরা জানি না।‘

বলিলাম‌, ‘সুকুমারীর ব্যাপার নিয়ে হেনা তাঁকে ব্ল্যাকমেল করছিল এমন হতে পারে না কি?’

‘হেনা পাকিস্তানের মেয়ে‌, সুকুমারী-ঘটিত ব্যাপার তার জানার কথা নয়। তবু মনে কর সে জানত। তাহলে সন্তোষবাবু তাকে নিজের বাড়িতে ঠাঁই দিলেন কেন? আর ব্ল্যাকমেলে তাঁর ভয়ই বা কিসের! তাঁর স্ত্রী জানেন তাঁর চরিত্র ভাল নয়‌, ছেলেরা জানে বাপ শনিবারে-রবিবারে বাড়ি আসে না। রবিবর্মা জানে নেংটি জানে‌, বাড়ির সবাই জানে‌, সুতরাং বাইরের লোকও জানে। কিন্তু কারুর কিছু বলবার সাহস নেই‌, কেউ কিছু প্রমাণ করতে পারে না।–হেনাকে সন্তোষবাবু ভয় করবেন কেন?’

‘তা বটে। তাছাড়া তাঁর অ্যালিবাই আছে।’

‘শুধু তাঁর অ্যালিবাই নয়‌, সুকুমারীরও। দু’জনে দু’জনের অ্যালিবাই যোগাচ্ছেন। সুকুমারীকেও সন্দেহ থেকে বাদ দেওয়া যায় না‌, তার সুযোগ যত কমই হোক‌, মোটিভ যথেষ্ট ছিল। সন্তোষবাবুর কাছ থেকে সে হাজার টাকা মাইনে পায়‌, হয়তো কিছু ভালবাসাও আছে। হেনাকে যদি সে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বিনী মনে করে তাহলে হেনাকে খুন করার মোটিভ তার আছে।’

‘তুমি সত্যিই সুকুমারীকে সন্দেহ কর?’

‘সত্যি-মিথ্যের কথা নয়‌, এ হচ্ছে হিসেবের কড়ি‌, একটি কানাকড়ি বাদ দেওয়া চলে না।’

‘তারপর?’

‘তারপর রবিবর্মা। তার সুযোগ ছিল প্রচুর‌, কিন্তু মোটিভ নিয়েই গণ্ডগোল। লোকটির প্রকৃতি পাঁকাল মাছের মত‌, ধরা-ছোঁয়া যায় না‌, ধরতে গেলেই পিছলে যায়। আমার মনে হয় রবিবর্মা আগে থেকে হেনাকে চিনত। হেনার প্রতি তার আকর্ষণ বিকর্ষণ দুইই ছিল। আকর্ষণ বুঝতে পারি‌, রবিবর্মা অবিবাহিত‌, হেনার মত সুন্দরী মেয়ের প্রতি সে আকৃষ্ট হবে এতে আশ্চর্য কিছু নেই। কিন্তু বিকর্ষণ কিসের জন্যে? হেনা কি তার কোন বিপজ্জনক গুপ্তকথা জানত? হেনা তাকে প্রণয়-ব্যাপারে প্রশ্বয় দেয়নি। তাই আক্রোশ? তাই কি সে উদয়কে ফাঁসাতে চায়?’

‘উদয়কে ফাঁসিতে চায়?’

‘উদয় হেনাকে উল কিনে দিয়েছিল‌, হেনা তার জন্যে সোয়েটার বুনছিল–একথা আমাকে বলবার দরকার ছিল না। এ থেকে মনে হয়‌, সে নিজের ঘাড় থেকে সন্দেহ নামিয়ে উদয়ের ঘাড়ে চাপাতে চায়।’

‘হুঁ। তারপর?’

‘তারপর উদয়। গোঁয়ার-গোবিন্দ ছেলে‌, কড়া মেজাজ‌, কিন্তু হেনার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়েছিল। হেনা বোধহয় তাকে অন্যদের চেয়ে একটু বেশি আশকারা দিত‌, উদয় ভাবত হেনা তাকেই ভালবাসে। তারপর সে জানতে পারল যুগলের সঙ্গে হেনার কবিতা লেখালেখি চলছে‌, গোলাপফুলের আদান-প্রদান চলছে। ছাদের ওপর এই নিয়ে হেনার সঙ্গে উদয়ের ঝগড়া হল‌, রাগের মাথায় উদয় হেনাকে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিল। হয়তো তার খুন করবার ইচ্ছা ছিল না—‘

বলিলাম‌, ‘আর যুগল? তার কী মোটিভ ছিল?’

সে বলিল‌, ‘একই মোটিভ-যৌন-ঈর্ষা। যুগল শান্তশিষ্ট কবি মানুষ‌, কিন্তু তার প্রাণের মধ্যে কি রকম দুবার আগুন জ্বলে উঠেছিল কে বলতে পারে। সে যদি জানতে পেরে থাকে যে‌, হেনা উদয়ের জন্যে পশমের জামা বুনছে—‘

‘কিন্তু সে ছাদে গেল কি করে? উদয় সিঁড়ি দিয়ে হেনার পিছু পিছু গিয়েছিল।’

‘যুগল বাগানে গিয়েছিল‌, বাগান থেকে গোলাপফুল তুলে জানোলা দিয়ে হেনরি টেবিলে ফেলে দিয়েছিল। তারপর ভারার মই বেয়ে ছাদে উঠে যাওয়া কি তার পক্ষে খুব শক্ত?’

‘না‌, শক্ত নয়। কিন্তু গোলাপফুল উপহার দিয়েই তাকে খুন করল?’

‘গোলাপফুলটা হয়তো ভাঁওতা‌, পুলিসের চোখে ধুলো দেবার চেষ্টা।’

‘বুঝলাম। আর কে বাকি রইল?’

‘শ্ৰীমতী চামেলি এবং চিংড়ি। দু’জনেরই মোটিভ আছে‌, দু’জনেরই সুযোগ সমান। শ্ৰীমতী চামেলি যখন বাথরুমে ছিলেন চিংড়ি তখন একলা ছিল‌, আবার চিংড়ি যখন বাথরুমে ছিল‌, শ্ৰীমতী চামেলি তখন একলা ছিলেন।’

আমি বলিলাম‌, ‘তাহলে দাঁড়াল কী? এই সাতজনের মধ্যে আসল দোষী কে?’

সে বলিল‌, ‘শুধু সাতজন নয়‌, আর একটি ছিপে রুস্তম আছেন যিনি মাউথ-অগনি বাজিয়ে হেনাকে ইশারা দিয়ে যেতেন।’

ঠিক তো‌, বংশীবদন বনমালীর কথা মনে ছিল না। প্রশ্ন করিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ‌, ও লোকটা কে?’

ব্যোমকেশ চিন্তা করিতে করিতে বলিল‌, ‘হিন্দু কি মুসলমান বলতে পারি না‌, কিন্তু পাকিস্তানী লোক সন্দেহ নেই। বোধহয় দু’জনের মধ্যে প্রণয় ছিল‌, লোকটা পাকিস্তান থেকে হেনাকে বই এনে দিত। প্রণয়-ঘটিত ব্যাপারে কখন কি ঘটে কিছুই বলা যায় না। প্রণয় হয়তো ক্রমশ বিষ হয়ে দাঁড়িয়েছিল‌, হেনার মন উদয়ের দিকে ঢলেছিল।’

‘লোকটা দশ-বারো দিন অন্তর আসত কেন?’

‘হয়তো সে প্লেনে আসত‌, হয়তো সে প্লেনের একজন অফিসার; দশ-বারো দিন অন্তর দমদমে নামে‌, হেনার সঙ্গে লুকিয়ে দেখা করে যায়। সবই অবশ্য অনুমান।’

কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া সে হঠাৎ উঠিয়া পাশের ঘরে গেল‌, শুনিতে পাইলাম কাহাকে ফোন করিতেছে। দু-তিন মিনিট পরে ফিরিয়া আসিলে জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কাকে?’

সে বলিল‌, ‘নেংটিকে। বংশীধারী লোকটি হেনার মৃত্যুর পর আর এসেছিল। কিনা খবর নিচ্ছিলাম। নেংটি বলল‌, আসেনি।’

‘না আসার কি কারণ থাকতে পারে?’ ‘হয়তো হেনীর মৃত্যুর খবর জানতে পেরেছে‌, কিংবা অসুখে পড়েছে‌, কিংবা মরে গেছে। কত রকম কারণ থাকতে পারে।’ হঠাৎ ব্যোমকেশ স্থিরদৃষ্টিতে আমার পানে চাহিল‌, অনেকক্ষণ চাহিয়া রহিল। দেখিলাম সে আমার দিকে চাহিয়া আছে বটে। কিন্তু আমাকে দেখিতেছে না‌, মনশ্চক্ষু দিয়া অভাবনীয় কিছু প্রত্যক্ষ করিতেছে। তারপর সে চাপা গলায় বলিল‌, ‘অজিত।’

বলিলাম‌, ‘কি হল?’ সে বলিল‌, ‘যেদিন হেনা মারা যায় সেদিনের কথা মনে আছে?’

‘মনে থাকবে না কেন? সে তো পরশু!’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ‌, দুপুরবেলা তুমি খবরের কাগজ পড়ে শোনালে। একটা পাকিস্তানী প্লেন বানচাল হয়ে বঙ্গোপসাগরে ডুবেছে‌, মনে আছে? আমি মৈনাক পর্বতের গল্প বললাম—‘

‘মনে আছে বৈকি?’

‘সেদিনকার খবরের কাগজটা খুঁজে বার করতে পার?’

‘পারি।‘

পুরানো খবরের কাগজগুলো একস্থানে জমা করা হইত‌, মাসের শেষে পুঁটিরাম সেগুলিকে বিক্রয় করিত। আমি সেদিনের কাগজটা খুঁজিয়া আনিয়া ব্যোমকেশকে দিলাম‌, সে সাগ্রহে কাগজের পাতা উল্টাইয়া বিমান-বিপর্যয়ের ব্বিরণ দেখিতে লাগিল।

জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘কি দেখছ?’

সে কাগজের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া বলিল‌, ‘ডাকোটা প্লেন। সিঙ্গাপুর থেকে কায়রো পর্যন্ত দৌড়। অফিসার সবাই মুসলমান‌, কেবল একজন পাইলট ইংরেজ। যাত্ৰিদলের মধ্যে সব জাতের লোক ছিল—‘

ধীরে ধীরে কাগজ মুড়িয়া রাখিয়া ব্যোমকেশ শূন্যদৃষ্টিতে কড়িকাঠের দিকে চাহিয়া রহিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress