Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » মগ্নমৈনাক – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 3

মগ্নমৈনাক – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

পরদিন রবিবার সকাল সাতটার সময় ব্যোমকেশ ও আমি সবেমাত্র চায়ের পেয়ালা লইয়া বসিয়াছি‌, হুড়মুড় শব্দে নেংটি ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিল‌, ‘ব্যোমকেশদা‌, ভীষণ কাণ্ড!’

ব্যোমকেশ ভ্রূ তুলিয়া বলিল‌, ‘ভীষণ কাণ্ড!’

নেংটি বলিল‌, ‘হ্যাঁ। একটা সিগারেট দিন।’

ব্যোমকেশ সিগারেট দিল‌, নেংটি তাহা ধরাইয়া দুই-তিনটা লম্বা টান দিয়া বলিল‌, ‘কাল রাত্তিরে হেনার ঘরটা কে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।’

আমি বলিলাম‌, ‘অ্যাঁ! বাড়ি পুড়ে গেছে!’

নেংটি বলিল‌, ‘বাড়ি নয়‌, শুধু হেনার ঘরটা পুড়েছে। খাট-বিছানা‌, টেবিল-আলমারি কিছু নেই‌, সব ছাই হয়ে গেছে।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল‌, শেষে বলিল‌, ‘রাত্তিরে কখন তোমরা জানতে পারলে?’

নেংটি বলিল‌, ‘আমরা রাত্তিরে জানিব কোথেকে‌, আমরা তো দোতলায় শুই। রবিবর্মা নীচের তলায় শোয়‌, সে-ই কিছু জানতে পারেনি। একেবারে সকালবেলায় জনাজানি হল।’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কি‌, বাড়িতে চেঁচামেচি হৈ হৈ চলছে। আমি স্যুট করে পালিয়ে এসেছি আপনাকে খবর দিতে।’

‘হুঁ। কে ঘরে আগুন দিতে পারে‌, বাড়ির লোক না বাইরের লোক?’

‘তা আমি কি করে বলব? রাত্তিরে নীচের তলার দরজা-জানালা সব বন্ধ থাকে।’

‘সকালে যখন দেখলে তখন কি হেনার ঘরের জানোলা দুটো খোলা ছিল?’

‘দরজা-জানালা সব পুড়ে কয়লা হয়ে গিয়েছে‌, খোলা ছিল কি বন্ধ ছিল বোঝবার উপায় নেই। তবে–’ বলিয়া নেংটি থামিয়া গেল।

ব্যোমকেশ প্রশ্ন করিল‌, ‘তবে কি?’

নেংটির সিগারেট আধাআধি পুড়িয়ছিল‌, বাকি অর্ধেক নিভাইয়া সে সযত্নে পকেটে রাখিল‌, বলিল‌, ‘সিঁড়ির তলায় এক টিন পেট্রোল রাখা থাকতো‌, দেখা গেল টিন খালি।’

‘তার মানে—’ ব্যোমকেশ কথা অসমাপ্ত রাখিয়া চিন্তার মধ্যে ডুবিয়া গেল।

নেংটি উঠিয়া পড়িল‌, বলিল‌, ‘আমি পালাই। মাসিমা যদি জানতে পারে আমি বাড়ি নেই, রক্ষে থাকবে না।’

ব্যোমকেশ মুখ তুলিয়া বলিল‌, ‘বোসো। তোমাকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করব।’

নেংটি অনিচ্ছাভরে বসিয়া বলিল‌, ‘আর কি জিজ্ঞেস করবেন‌, যা জানি সব বলেছি। এবার আপনি বুদ্ধি খাটিয়ে বের করুন‌, কে খুন করেছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘খুন করেছে তার কোন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। কিন্তু সে যাক। যে-সময় হেনা ছাদ থেকে পড়ে যায় সে-সময় তুমি কোথায়?’

নেংটি বলিল‌, ‘আমি বাড়ির মধ্যে ছিলাম না‌, সিগারেট খেতে বেরিয়েছিলাম।’

‘কি করে জানলে যে‌, তুমি যখন সিগারেট খেতে বেরিয়েছিলে ঠিক সেই সময় হেনা ছাদ থেকে পড়ে যায়?’

‘শুনুন। সাড়ে পাঁচটার একটু আগে আমি যখন বাড়ি থেকে বেরুচ্ছি‌, তখন হেনার ঘরের দোর একটু ফাঁক হয়ে ছিল‌, দেখলাম সে খাটে বসে কাঠি দিয়ে পশমের গেঞ্জি বুনছে। আধঘণ্টা পরে যখন ফিরে এলাম‌, তখন বাড়িতে ভীষণ কাণ্ড‌, সবেমাত্র হেনরি লাশ পাওয়া গেছে।’

‘কে লাশ পেয়েছিল?’

‘রবিবর্মা।’

‘তুমি যখন বেরুচ্ছিলে তখন হল-ঘরে আর কেউ ছিল?’

‘উদয়দা ছিল‌, আর কেউ ছিল না।’

‘তুমি যখন সিগারেট খেয়ে ফিরে এলে তখন বাড়ির সবাই বাড়িতেই উপস্থিত ছিল?’

নেংটি একটু ভাবিয়া বলিল‌, ‘মেসোমশাই ছাড়া আর সবাই উপস্থিত ছিল।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া ভাবিল‌, তারপর বলিল‌, ‘আর একটা কথা। হেনার চিঠিপত্র আসতো। কিনা জানো?’

নেংটি দৃঢ়স্বরে বলিল‌, ‘আসতো না। সকাল বিকেল যখনই চিঠি আসে‌, আমি পিওনের হাত থেকে চিঠি নিই। হেনার নামে একটাও চিঠি আজ পর্যন্ত আসেনি।’

বাইরের কারুর সঙ্গে হেনার কোন যোগাযোগ ছিল না?’

নেংটি মাথা নাড়িতে গিয়া থামিয়া গেল‌, তারপর কুঞ্চিত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিল। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কী?’

নেংটি বলিল‌, ‘কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম‌, ব্যোমকেশদা। তুচ্ছ কথা বলেই বোধহয় মনে ছিল না—‘

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘হোক তুচ্ছ‌, বলে শুনি।’

নেংটি ধীরে ধীরে ভাবিয়া ভাবিয়া বলিতে আরম্ভ করিল‌, ‘হেনা আসবার দশ-বারো দিন পর থেকেই ব্যাপারটা আরম্ভ হয়। আমাদের রাস্তায় বেশি গাড়ি-মোটরের চলাচল নেই‌, নির্জন বড়মানুষের পাড়া। একদিন বিকেলবেলা একটা ট্যাক্সি আস্তে আস্তে বাড়ির সামনে দিয়ে চলে গেল‌, তার ভেতরে একটা লোক বসে মাউথ-অগনি বাজাচ্ছে। মাউথ-অগনি জানেন তো। চশমার খাপের মত দেখতে‌, ঠোঁটের ওপর ঘষলে প্যাপপো পাপপো করে বাজে-খুব জোর আওয়াজ হয়—‘

‘জানি। তারপর বলে।’

ট্যাক্সি চলে গেল‌, দুতিন মিনিট পরে আবার উল্টে দিক থেকে মাউথ-অগনি বাজাতে বাজাতে বাড়ির সামনে দিয়ে গেল। এই ঘটনার দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে হেনা ঘরে তালা লাগিয়ে বেরুলো। আমি প্রথমবার যোগাযোগটা বুঝতে পারিনি—’

‘যে লোকটা মাউথ-অগনি বাজাচ্ছিল তাকে দেখেছিলে?’

‘দেখেছিলাম। কোট-প্যান্ট-পরা একটা লোক।’

‘তারপর!’

‘তারপর দশ-বারো দিন চুপচাপ‌, হেনা বাড়ি থেকে বেরুলো না। একদিন আমি দোতলার বাড়ির কাছাকাছি আসতেই তার ভেতর থেকে মাউথ-অগনি বেজে উঠলো‌, আবার বাড়ি পার হয়েই থেমে গেল। কিছুক্ষণ পরে ট্যাক্সি ফিরে এল‌, বাড়ির সামনে আর একবার প্যাপপো পাপপো বাজিয়ে চলে গেল। আমি ভাবতে লাগলাম‌, কী ব্যাপার‌, আমাদের বাড়ির সামনেই মাউথ-অগনি বাজায় কেন? এমন সময় দেখি‌, হেনা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেদিকে ট্যাক্সি গেছে। সেই দিকে চলে গেল। হঠাৎ বুঝতে পারলাম‌, কেউ হেনাকে ইশারা করে যায়‌, অমনি হেনা তার সঙ্গে দেখা করতে বেরোয়।’

‘‘হেনা কখন ফিরে আসতো?’

‘ঘণ্টাখানেক পরেই ফিরে আসতো।’

‘কোথায় যায় তুমি জানো?’

‘কি করে জানব? একবার হেনার পিছু নিয়েছিলাম। বাড়ি থেকে শাখানেক গজ দূরে রাস্তার ধারে ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে ছিল‌, হেনা টুক করে তাতে উঠে পড়ল‌, ট্যাক্সি চলে গেল।’

‘হুঁ। শেষবার কবে হেনা বেরিয়েছিল?’

‘দশ-বারো দিন আগে। —আচ্ছা ব্যোমকেশদা‌, আজ তাহলে আমি পালাই‌, বডড দেরি হয়ে গেল। সুবিধে পেলেই আবার আসব।’

‘আচ্ছা‌, এস।’

নেংটি চলিয়া যাইবার পর ব্যোমকেশ অনেকক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল। অবশেষে আমি নীরবতা ভঙ্গ করিয়া বলিলাম‌, ‘কি বুঝছ?’

ব্যোমকেশ অন্যমনস্কভাবে সিগারেট ধরাইতে ধরাইতে বলিল‌, ‘মাউথ-অগানের ব্যাপারটা গোলমেলে ঠেকছে‌, কিন্তু একটা জিনিস বোঝা যায়। হেনা কলকাতা শহরে নেহাৎ একলা ছিল না! যাহোক‌, হেনার মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চয় হওয়া গেল; অপঘাত মৃত্যু নয়‌, তাকে কেউ খুন করেছে। এখন প্রশ্ন–মগ্নমৈনাকটি কে?’

বলিলাম‌, ‘ঘরে যে আগুন লাগিয়েছিল সে-ই নিশ্চয়।’

কথাটা ব্যোমকেশের মনঃপূত হইল না‌, সে মাথা নাড়িয়া বলিল‌, ‘হতে পারে‌, আবার না-ও হতে পারে। ব্যাপারটা বুঝে দেখ। একটা লোক হেনাকে খুন করেছে‌, তার মোটিভ আমরা জানি না। যৌন-ঈর্ষা হতে পারে‌, আবার অন্য কিছুও হতে পারে। কিন্তু যে-লোকটা ঘরে আগুন দিয়েছে তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে; হেনার ঘরে এমন একটা মারাত্মক জিনিস আছে যা সে নষ্ট করে ফেলতে চায়। আমরা ঘরটা একবার মোটামুটি রকম তল্লাশ করেছি‌, কিন্তু মারাত্মক কিছু পাইনি। আবার তল্লাশ করে যদি মারাত্মক বস্তুটি খুঁজে পাই! অতএব পুড়িয়ে শেষ করে দাও।’

‘কী মারাত্মক জিনিস হতে পারে?’

‘হয়তো কাগজ‌, এক টুকরো কাগজ। বড় জিনিস হলে আমরা খুঁজে পেতাম।’

হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল‌, বলিলাম‌, ‘ব্যোমকেশ‌, সেই গোলাপী কাগজের টুকরো! তাতে কি লেখা আছে?’

ব্যোমকেশ দেরাজ হইতে কাগজের টুকরাটি বাহির করিয়া দিল‌, বলিল‌, ‘কবিতা। পড়ে দেখ দেখি‌, কাব্য হয়েছে কি না।’

কবিতা পড়িলাম–

তোমার হাসির ঝিলিকটুকু
ছুরির মত রইল বিঁধে বুকে
বিনা দোষে শাস্তি দিতে
পারে তোমার ঠোঁটদুটি টুকটুকে।

বলিলাম‌, মন্দ নয়‌, অনেকটা সংস্কৃত উদ্ভট কবিতার মত। কে লিখেছে?

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ওদের বাড়িতে কবি একজনই আছে-যুগল।’

অপরাহ্নে এ কে রে স্বয়ং জবানবন্দীর নকল লইয়া আসিলেন।

আজ তাঁহার চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের সঙ্গে ফষ্টি-নিষ্টি করিলেন‌, দুই চারিটা মজাদার গল্প বলিলেন‌, ব্যোমকেশ যে পুলিসে যোগ না দিয়া শূন্যোদরে বন্যমহিষ তাড়াইয়া বেড়াইতেছে তাহা প্রমাণ করিলেন‌, সময়োচিত পানাহার গ্রহণ করিলেন; তারপর কাজের কথায় উপস্থিত হইলেন। জবানবন্দীর ফাইল ব্যোমকেশকে দিয়া বলিলেন‌, ‘এই নাও‌, পড়ে দেখতে পার। কিন্তু তোমার কোন কাজে লাগবে না।’

ভু তুলিয়া ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কাজে লাগবে না কেন?

এ কে রে বলিলেন‌, ‘পুলিস-দপ্তরের মতে হেনীর মৃত্যু অপঘাত ছাড়া আর কিছু নয়‌, তদন্ত চালানো নিরর্থক।’

ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ চাহিয়া থাকিয়া বলিল‌, ‘আগুন লাগার খবর পেয়েছ?’

এ কে রে বলিলেন‌, ‘পেয়েছি। ওটা সমাপতন। ইচ্ছে করে কেউ আগুন লাগিয়েছিল তার কোন প্রমাণ নেই।’

ব্যোমকেশ একবার তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাঁহাকে নিরীক্ষণ করিয়া জানালার বাহিরে চাহিয়া রহিল। শেষে বলিল‌, ‘তাহলে সন্তোষবাবু আমাকে যে কাজ দিয়েছিলেন‌, সেটা গেল। তাঁর পরিবারিক স্বার্থরক্ষার আর দরকার নেই।’

এ কে রে হাসিয়া বলিলেন‌, ‘না। তুমি তাঁকে আশ্বাস দিতে পোর পুলিস তাঁর পরিবারের ওপর আর কোনো জুলুম করবে না। —ভাল কথা‌, আগুন লাগার খবর পেয়ে আমি সন্তোষবাবুর বাড়িতে গিয়েছিলাম। তিনি উপস্থিত ছিলেন। কাল হেনার দেরাজের মধ্যে যে ফটোগ্রাফ পাওয়া গিয়েছিল‌, সেটা তাঁকে দেখলাম। তিনি বললেন‌, ওটা হেনার মায়ের ছবি।’

ব্যোমকেশ ঘাড় নাড়িল‌, বলিল‌, ‘ময়না তদন্তে কী পেলে?’

এ কে রে বলিলেন‌, ‘এ রকম অবস্থায় যা আশা করা যায়। তার বেশি কিছু নয়। পাঁজরার একটা হাড় ভেঙ্গে হৃৎপিণ্ডকে ফুটো করে দিয়েছে‌, তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে। অন্য কোন জটিলতা নেই।’

‘মৃত্যুর সময়?’

‘সাড়ে পাঁচটা থেকে ছাঁটার মধ্যে।’

তারপর এ কে রে দু’ একটা হাসি-তামাশার কথা বলিয়া ব্যোমকেশের পিঠ চাপড়াইয়া প্রস্থান করিলেন। ব্যোমকেশ অনেকক্ষণ নীরবে বসিয়া রহিল।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘এ কে রে কি খুব বুদ্ধিমান লোক?’

ব্যোমকেশ আমার পানে চোখ তুলিয়া বলিল‌, ‘ওর বুদ্ধি কারুর চেয়ে কম নয়।’

বলিলাম‌, ‘দোষের মধ্যে পুলিস।’

‘হ্যাঁ, দোষের মধ্যে পুলিস।’ ব্যোমকেশ জবানবন্দীর ফাইলটা তুলিয়া লইল।

আধঘণ্টা পরে জবানবন্দী পাঠ শেষ করিয়া সে ফাইল আমাকে দিল‌, বলিল‌, ‘বিশেষ কিছু নেই‌, দেখতে পারো।–আমি একটু ঘুরে আসি।’

‘কোথায় যাচ্ছ?

‘অনেক দিন দোকানে যাওয়া হয়নি‌, যাই দেখে আসি প্রভাত কি করছে।’

সে চলিয়া গেল। আমি ফাইল খুলিয়া জবানবন্দী পড়িতে আরম্ভ করিলাম—

রবীন্দ্রনাথ বর্মণ। বয়স ৩৯। সন্তোষ সমাদ্দারের অন্যতম সেক্রেটারি। সন্তোষবাবুর বাড়িতে থাকেন। বেতন ৩৫০ টাকা।

আজ শনিবার। কত অফিস থেকে চলে যাবার পর আমি আন্দাজ সাড়ে তিনটের সময় ফিরে আসি। হেনা তখন কোথায় ছিল আমি লক্ষ্য করিনি। সম্ভবত নিজের ঘরেই ছিল।

আমি কিছুক্ষণ নিজের ঘরে বিশ্রাম করলাম। সাড়ে চারটের সময় চাকর চা-জলখাবার এনে দিল‌, আমি খেলাম। তারপর পাঁচটা নাগাদ বাড়ি থেকে বেরুলাম। বাজারে কিছু কেনাকাটা করবার ছিল‌, সাবান টুথপেস্ট দাড়ি কামাবার ব্লেড অ্যাসপিরিন‌, এই সব।

আমি যখন বেরুই‌, তখন হল-ঘরে কেবল একজন মানুষ ছিল-উদয়। তার সঙ্গে আমার কোন কথা হয়নি‌, সে কিছুই করছিল না‌, বুকে হাত বেঁধে ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছিল। উদয় কলেজে পড়ে। বইকি‌, তবে যখন ইচ্ছে চলে আসে‌, পড়াশুনোয় মন নেই।

আমি বাজার করে ফিরলাম ছাঁটার সময়। তখনো অন্ধকার হয়নি‌, আমি নিজের ঘরে জিনিসপত্র রেখে পুবদিকের গোলাপ-বাগানে গেলাম। সেখানে কিছুক্ষণ বেড়াবার পর হঠাৎ নজরে পড়ল বাড়ির কোলে মানুষের চেহারার মত কি যেন একটা পড়ে আছে। কাছে গিয়ে দেখি-হেনা।

চেঁচামেচি করে লোক ডাকলাম। চাকরেরা ছুটে এল‌, যুগল আর উদয়ও এল-হ্যাঁ‌, ওরা দু’জনেই বাড়িতে ছিল। সবাই মিলে ধরাধরি করে লাশ বাড়িতে নিয়ে এলাম‌, তারপর পুলিসকে ফোন করলাম। না‌, কর্তা বাড়িতে ছিলেন না। শনিবার-রবিবার তিনি বাড়িতে থাকেন না। কোথায় থাকেন আমি জানি না।

যুগলচাঁদ সমাদ্দার। বয়স ২০। সন্তোষ সমাদ্দারের পুত্র।

আমি কলেজে পড়ি। আজ দুটোর পর ক্লাস ছিল না‌, তাই তিনটের সময় বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। আমার ঘর দোতলায়‌, রবিবর্মার ঘরের ওপরে।

ঘরে এসে একটা বই নিয়ে বিছানায় শুয়েছিলাম‌, তারপর ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম ভাঙল একেবারে সাড়ে পাঁচটার সময়ে। তাড়াতাড়ি উঠে নীচে নেমে গেলাম। না‌, হল-ঘরে কেউ ছিল না। আমি গোলাপ-বাগানে গিয়ে কিছুক্ষণ বেড়ালাম‌, তারপর ফিরে এসে দোতলায় গেলাম। চিংড়ি আমাকে চা-জলখাবার এনে দিল‌, আমি খেলাম। তারপর নিজের ঘরে গিয়ে লেখাপড়া করতে বসলাম।

বাগানে আমি বেশিক্ষণ ছিলাম না‌, পনেরো-কুড়ি মিনিট ছিলাম। ধরুন‌, সাড়ে পাঁচটা থেকে পৌঁনে ছটা পর্যন্ত। না‌, রব্বিমাকে বাগানে দেখিনি। বাড়ির পাশে হেনার মৃতদেহ দেখিনি। ছাঁটার পর নীচে চেঁচামেচি শুনে আমি নেমে এলাম। ওরা তখন হেনার মৃতদেহ বাড়ির মধ্যে নিয়ে আসছে।

আমার সঙ্গে হেনার ঘনিষ্ঠতা ছিল না‌, কারুর সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা ছিল না। সে কারুর সঙ্গে মিশতো না।

উদয়চাঁদ সমাদ্দার। বয়স ২০। সন্তোষ সমাদ্দারের পুত্র।

আজ আমি কলেজে যাইনি। দুপুরবেলা বিলিয়ার্ড খেলতে ক্লাবে গিয়েছিলাম। ক্লাবের নাম গ্রেট ইস্টার্ন স্পোর্টিং ক্লাব।

সাড়ে চারটের সময় আমি বাড়ি ফিরেছি। দোতলায় হেনার ঘরের ওপর আমার ঘর। আমি নিজের ঘরে গেলাম‌, কাপড়-চোপড় বদলে নীচের হল-ঘরে নেমে এলাম। কেন নেমে এলাম তার কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য নই। আমার বাড়ি‌, আমি যখন যেখানে ইচ্ছা থাকি।

প্রশ্ন : আপনি যতক্ষণ হল-ঘরে ছিলেন‌, সেই সময়ের মধ্যে অন্য কাউকে হল-ঘরে দেখেছিলেন?

উত্তর: রবিবর্মা নিজের ঘরে ছিল‌, মাঝে মাঝে হল-ঘরে আসছিল। সে আন্দাজ পাঁচটার সময় বেরিয়ে গেল।

প্রশ্ন: আর কেউ?

উত্তর : নেংটি ছোঁক ছোঁক করে বেড়াচ্ছিল‌, আমার কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিয়ে বাইরে চলে গেল।

প্রশ্ন : হেনা তখন কোথায় ছিল?

উত্তর: নিজের ঘরে।

প্রশ্ন : আপনি হল-ঘরে থাকতে থাকতেই হেনা ছাদে যাবার জন্যে নিজের ঘর থেকে বেরিয়েছিল?

উত্তর : হ্যাঁ।

প্রশ্ন : তার হাতে কিছু ছিল?

উত্তর; একটা ছোট মাদুর ছিল। ভ্যানিটি-ব্যাগ ছিল।

প্রশ্ন : আপনি তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন?

উত্তর : নো কমেন্ট।

প্রশ্ন : হেনা চলে যাবার পর আপনি হল-ঘরে কতক্ষণ ছিলেন?

উত্তর: পাঁচ মিনিট।

প্রশ্ন : তারপর কোথায় গেলেন?

উত্তর: নিজের ঘরে।

প্রশ্ন : হেনার সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা ছিল?

উত্তর : নো কমেন্ট।

শ্ৰীমতী চামেলি সমাদ্দার। বয়স ৪৪। সন্তোষ সমাদ্দারের স্ত্রী।

ছ’মাস আগে হেনা মল্লিক। আমার বাড়িতে এসেছিল। তার সঙ্গে আমার কোনো সম্বন্ধ ছিল না‌, তাকে কখনো দোতলায় উঠতে বলিনি। আমি মুখ দেখে মানুষ চিনতে পারি‌, হেনা ভাল মেয়ে ছিল না। আমার স্বামী কেন তাকে বাড়িতে এনেছিলেন। আমি জানি না। আমি বিরক্ত : হয়েছিলাম। কিন্তু কর্তার ইচ্ছায় কর্ম‌, আমি কী করতে পারি। হেনাকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়নি‌, কোন কথাই হয়নি।

আমার দুই ছেলেই ভাল ছেলে‌, সচ্চরিত্র ছেলে। হেনার সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক ছিল না‌, উটুকো মেয়ের সঙ্গে তারা মেলামেশা করে না।

আজ পাঁচটা থেকে ছাঁটার মধ্যে আমি চিংড়ির চুল বেঁধে দিয়েছিলুম‌, চিংড়ি আমার চুল বেঁধে দিয়েছিল‌, তারপর আমি বাথরুমে গা ধুতে গিয়েছিলুম! হেনাকে তেতলার ছাদে যেতে দেখিনি‌, ছাদের ওপর কোন শব্দ শুনিনি।

শেফালিকা‌, ওরফে চিংড়ি। বয়স ১৫। সন্তোষবাবুর গৃহে পালিত। দু’বছর আগে আমাদের মা-বাবা মারা যান। সেই থেকে দাদা আর আমি মাসিমার কাছে আছি।

হেন যখন এ-বাড়িতে এসেছিল‌, তখন তাকে দেখে আমার খুব ভাল লেগেছিল। এত সুন্দর মেয়ে আমি দেখিনি। আমি একবার গিয়েছিলুম ভাব করতে‌, কিন্তু সে আমার মুখের ওপর দোর বন্ধ করে দিল। সেই থেকে আমি আর ওর কাছে। যাইনি‌, মাসিমা মানা করে দিয়েছিলেন। ওকে দু-একবার মেসোমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে শুনেছি। মেসোমশাইয়ের সঙ্গে ও ভালভাবে কথা বলত। দশ-বারো দিন অন্তর ভাল কাপড়-চোপড় পরে বাইরে যেত। কোথায় যেত। জানি না। একলা যেত‌, আবার ঘন্টাখানেক পরে ফিরে আসত। হ্যাঁ‌, রোজ সন্ধ্যার সময় হেনা ছাদে যেত‌, সেখানে একলা কি করত। জানি না; বোধহয় পায়চারি করত‌, কিংবা মাদুর পেতে বসে থাকত। মাসিমার বিশ্বাস‌, হেনা ছাদে গিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খেত।

আমি স্কুলে পড়ি না‌, মাসিম আমাকে স্কুলে পড়তে দেননি। তিনি বলেন‌, স্কুল-কলেজে পড়লে মেয়েরা বিগড়ে যায়‌, সিগারেট খেতে শেখে। আমি মাসিমার কাছে ঘর-কান্নার কাজ শিখেছি।

আজ বিকেলবেলা মাসিম আমার চুল বেঁধে দিলেন‌, আমি মাসিমার চুল বেঁধে দিলুম; তারপর মাসিম বাথরুমে গেলেন। আমি দাদাদের জলখাবার দিতে গেলুম। যুগলদা নিজের ঘরে ছিলেন‌, তাঁকে খাবার দিয়ে উদয়দা’র ঘরে গেলুম। উদয়ন্দা ঘরে ছিলেন না; তাঁর টেবিলে খাবার রেখে আমি চলে এলুম। তারপর আমিও বাথরুমে গা ধুতে গেলুম। দোতলায় পাঁচটা বাথরুম আছে।

না‌, হেনা কখন ছাদে গিয়েছিল। আমি জানতে পারিনি। ছাদের ওপর শব্দ শুনিনি। বাথরুম থেকে বেরুবার পর নীচের তলা থেকে চেঁচামেচি শুনতে পেলুম‌, জানতে পারলুম হেনা ছাদ থেকে পড়ে মরে গেছে।

নির্মলচন্দ্র দত্ত, ওরফে নেংটি। বয়স ১৭। সন্তোষবাবুর গৃহে পালিত।

চিংড়ি আমার বোন। আমরা মা-বাবার মৃত্যুর পর থেকে মাসিমার কাছে আছি। আমি লেখা পড়া করি না। মেসোমশাই বলেছেন‌, আমার আঠারো বছর বয়স হলে তিনি তাঁর কোম্পানিতে চাকরি দেবেন।

হেনা দেখতে খুব সুন্দর ছিল‌, কিন্তু ভারি অহংকারী ছিল‌, আমার সঙ্গে কথাই বলত না। বাড়িতে কেবল মেসোমশাইয়ের সঙ্গে হেসে কথা বলত‌, যুগলদা আর উদয়দা’র সঙ্গে দুটো-একটা কথা বলত। হেনা সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না।

আজ বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় আমি বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। তখন হেনা নিজের ঘরে ছিল। ছটার পর ফিরে এসে শুনলাম সে ছাদ থেকে পড়ে মরে গেছে। এর বেশি আমি আর কিছু জানি না।

জবানবন্দী পড়া শেষ করিয়া কিছুক্ষণ নীরবে সিগারেট টানিলাম। এই কয়জনের মধ্যেই কেহ হেনাকে ছাদ হইতে ঠেলিয়া ফেলিয়া দিয়াছিল মনে হয় না। উদয় ছেলেটা একটু উদ্ধত‌, কিন্তু তাহাতে কিছুই প্রমাণ হয় না। সত্যিই কি কেহ হেনাকে ছাদ হইতে ফেলিয়া দিয়াছিল? হয়তো পুলিসের অনুমানই ঠিক‌, ব্যোমকেশ ঝোপে ঝোপে বাঘ দেখিতেছে। কিন্তু ঘরে আগুন লাগাও কি আকস্মিক?

নেংটি একটা লোকের কথা বলিল‌, হেনা দশ-বারো দিন অন্তর মাউথ-অগানের বাজনা শুনিয়া তাহার সহিত দেখা করিতে যাইত। লোকটা কে? সে-ই কি কোন অজ্ঞাত কারণে হেনাকে খুন করিয়াছে? সম্ভোষবাবুর তেতলার ছাদটি অবস্থা গতিকে বাহিরের লোকের পক্ষে সহজগম্য হইয়া পড়িয়াছে‌, ভারার মই বাহিয়া যে কেহ ছাদে উঠিতে পারে; অর্থাৎ‌, বাড়ির লোক এবং বাহিরের লোক সকলেরই ছাদে উঠিবার সমান সুবিধা।

সান্ধ্য চায়ের সময় হইলে ব্যোমকেশ ফিরিল। জিজ্ঞাসা করিলাম‌, ‘দোকানে কী মতলবে গিয়েছিলে?’

সে চায়ের পেয়ালায় চামচ ঘুরাইতে ঘুরাইতে বলিল‌, ‘মতলব কিছু ছিল না। মাথার মধ্যে গুমোট জমে উঠেছিল‌, তাই একটু হাওয়া-বাতাস লাগাতে বেরিয়েছিলাম। দোকানে বিকাশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে মাঝে মাঝে প্রভাতের সঙ্গে আড্ডা দিতে দোকানে আসে।’ চায়ে একটি চুমুক দিয়া সে সিগারেট ধরাইল‌, বলিল‌, ‘বিকাশের সঙ্গে দেখা হল ভালই হল‌, তাকে কাল বিকেলে আসতে বলেছি।’

‘তাকে তোমার কী দরকার?’

‘দরকার হবে কিনা সেটা নির্ভর করছে সন্তোষবাবুর ওপর। কাল সকালে তাঁর সঙ্গে দেখা করব। তিনি যদি আমায় বরখাস্ত করেন তাহলে আর কিছু করবার নেই।’ সে পৰ্যায়ক্রমে চা ও সিগারেটের প্রতি মনোনিবেশ করিল। আরো কয়েকটা প্রশ্ন করিয়া ভাসা-ভাসা উত্তর পাইলাম। তাহার স্বভাব জানি। তাই আর নিষ্ফল প্রশ্ন করিলাম না।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress