মকর পরব ও পৌষ লক্ষ্মীর পরম্পরা
জঙ্গলমহলের সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসব মকর পরব! পৌষ লক্ষ্মীর আরাধনা ও পিঠে পুলির পরব। এই উৎসবের সাথে জড়িয়ে আছে চিরন্তনী লোকাচারের আবেগ ও সাংস্কৃতিক পরম্পরা। জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এই ঐতিহ্য বংশপরম্পরায় বাহিত হয়ে চলেছে। আমার যাপন ও এরই অঙ্গ। আমিও বয়ে নিয়ে চলেছি এই ঐতিহ্যের পরম্পরা। আমি কাঁসাই কুলের কন্যা বিবাহ সূত্রে এসে পড়েছি কেলেঘাই – সুবর্ণরেখার তীরে! শৈশব কৈশোরের সোনালী অভিজ্ঞতা বিবাহ পরবর্তী লোকাচার কে আপন করতে সাহায্য করেছে। কংসাবতীর ঘাটে ঘাটে বসে মকর মেলা! পৌষ লক্ষ্মী র আরাধনায় মেতে থাকে বাঁকুড়া জেলা। টুসু ও পৌষ লক্ষ্মী যেন একাত্ম হয়ে ওঠেন কৃষিজীবীদের যাপনে। নল সংক্রান্তি বা ডাক সংক্রান্তিতে ধরিত্রীর সাধ ভক্ষণের লোকাচার থেকে শুরু হয় উৎসবের আবহ। নবান্নের সোনালী নতুন ধানের সৌন্দর্যের সাথে সাথে উচ্চারিত হয় লৌকিক মন্ত্র—” নতুন বাঁধি পুরানো খাই খেতে খেতে যেন জীবন যায় নতুন বস্ত্র পুরনো অন্ন তাই যেন খাই জন্ম জন্ম।”
এই নবান্নের উৎসবে নতুন চালের গুঁড়ি ও পিঠে পায়েসের ভোগে অন্নপূর্ণা রুপি মা লক্ষ্মীরই তো আরাধনা হয়। পৌষ লক্ষ্মীর রূপে আকাটা ধান গাছ যা “ঠাকুরউঠাই” এ লক্ষ্মী রূপে খামারে আনা হয়েছিল পৌষ সংক্রান্তিতে তারই পূজা করা হয়। খামারের মাঝে ওই ধান গাছকে স্থাপন করা হয় পৌষ লক্ষ্মী রূপে। এই ঠাকুরকে ঘিরে খড়ের ঘেরা দেওয়া হয়। সারা খামার জুড়ে চাষ যন্ত্রের আলপনা দেওয়া হয়। পিটুলি গোলার শ্বেত শুভ্রতায় জ্বলজ্বল করতে থাকে খামার উঠোন।
” মকর”— এক বিশেষ ভোগ যা দেবতাদের উৎসর্গ করা হয় এই জঙ্গলমহলে! পৌষ লক্ষ্মীকে খামারে পূজা করার এক বিশেষ রীতি হল “ডাক ধরা”! সাঁঝের বেলায় প্যাঁচা শেয়াল বা পাখির ডাক শুনলে — জল ছড়া দিয়ে, শাঁখ বাজিয়ে খামার লক্ষ্মীকে প্রদক্ষিণ করাকেই “ডাক ধরা “বলে! তিন/পাঁচ/সাত বারএই ভাবে ডাক ধরা হয়।
মকর সংক্রান্তির পরের দিন অর্থাৎ পয়লা মাঘ এখান পরবের দিন।আইখ্যান বা এখানদিন হলো জঙ্গলমহলের কৃষি বর্ষের শুরু। এই দিন হলকর্ষণ বা লাঙ্গলের দাগ দেওয়া হল বিশেষ রীতি। এই দিন শিকার যাত্রা করে ভূমিপুত্ররা। পহেলা মাঘ কৃষি বর্ষের সূচনায় প্রতিটি গ্রামের গ্রাম দেব দেবীর আটনে “আমিন “চড়ায়। হাতি ঘোড়ার ছলন বাঁধে। ঝারি ভোগে” তুষ্ট করে গ্রাম দেবতাকে!
পৌষ সংক্রান্তির আগের দিন “বাউনি দিন”! পৌষ কে আহবান করে মরাই ,গোলায় সিঁদুর চন্দন মাটির ফোঁটা দিয়ে, খডের শিকলে আম পাতার মালা গাঁথা হয়। নতুন চালের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি করা হয় পিঠে। পৌষকে বরণ করে সোনার পৌষ বলে গৃহস্ত ঘরে অচলা থাকার জন্য খডের শিকলে আম পাতার মালায় বাঁধা হয়।
” আউনি বাউনি চাউনি তিন দিন তিন রাত কোথাও না যেও ঘরে বসে পিঠে ভাত খেও!”
আউনি র অর্থ দেবী লক্ষ্মীর আগমন বাউনির অর্থ মা লক্ষ্মীর বন্ধন বা স্থিতি আর চাউনির অর্থ হলো দেবীর কাছে প্রার্থনা। বাউনি দিনে চালের গুঁড়ো দিয়ে সেদ্ধ পিঠে আশকা পিঠে ও সরু চাকলি বানাতে হয় একে গুঁড়ি হাত বলে।
এইভাবেই শুরু হয় মকর সংক্রান্তির তিন দিনের উৎসবের। পূর্ণ হয় লোকাচার। শীতের হিমেল বাতাসে কুয়াশার আবছায়া ওড়নায় ঢাকা প্রকৃতিতে ভেসে চলে নলেন গুড় আর পুলি পিঠের সৌরভ। জঙ্গলমহলের নদী ঘাটে টুসুর চৌদলের রাম ধনু রং আর অস্তরবির লালিমা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। টুসু বিসর্জনের বিষাদ সুর ভেসে বেড়ায়—-
” তিরিশ টি দিন রাখি মাকে তিরিশটি ফুল দিয়েগো
আর রাখতে লারবো মাকে, মকর হইলো বাদী গো–“!