রাজমোহন ওয়াইফ লেখা মাঝপথে বন্ধ করে
বাংলায় কলম ডোবালেন বঙ্কিমচন্দ্র
দেড় শতাব্দী পরে খর চোখে তাকালেন আমার দিকে
তাঁর কপালের ভাঁজ ও ভ্রূকুটি দেখে
কে না কেঁপে উঠবে?
আমি মুখ নিচু করে থাকি অপরাধীর মতন
রামধনু আঁকা আকাশের শেষ প্রান্তে উড়ে যাচ্ছে যে-সব পাখি
সেগুলি বিলীয়মান বঙ্গদর্শনের পৃষ্ঠা…
পাতলা বইখানা হাতে নিয়ে দীনবন্ধু মিত্র বললেন,
এই নীলদর্পণ কেন লিখেছিলাম জানো?
একদিন হঠাৎ মনে হল, আমাদের তলোয়ার-বন্দুক নেই বটে
কিন্তু ভাষার অস্ত্র তো রয়েছে হাতে
তোমাদের তা মনে নেই? মনে রাখো নি?
কার্মাটায় খুব মন দিয়ে সাঁওতালি ভাষা শিখছেন বিদ্যাসাগর
এবার তিনি এই ভাষায় ব্যাকরণ লিখবেন
তাঁর কপালের ভাঁজে অনেকগুলি সিঁড়ি
বাংলার কথা তাঁর মনেও পড়ে না, মনে করতে চান না
ক্যাপটিভ লেডির নামও আর উচ্চারণ করেন না মধুসূদন
ঘরের মধ্যে অবরুদ্ধ সিংহের মতন পায়চারি করতে করতে
মাঝে মাঝেই বলে উঠছেন ভাঙা গলায়:
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন
হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব…
হঠাৎ টিভি-তে হিন্দি রামায়ণ সিরিয়াল দেখে
চোখ উলটে গেল তাঁর
অজ্ঞান হয়ে ধড়াম করে পড়ে গেলেন মাটিতে
পণ্ডিতদের দিয়ে সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করাচ্ছিলেন কালীপ্রসন্ন
বাংলা মহাভারত দেশের মানুষদের বিনা পয়সায় পড়াবেনই পড়াবেন
তার জন্য জমিদারি বিক্রি হয়ে যায় তো যাক
এখন নিজেই সে মহাগ্রন্থের পাতা ছিঁড়ছেন
আর কেউ পড়বে না, আর কেউ পড়বে
না গঙ্গায় নৌকোতে যেতে যেতে বিস্ময়ে ধনুক হয়ে গেল
বিবেকানন্দর ভুরু
দু’ পাশে কীসের এত ধ্বংসস্তূপ?
নিবেদিতা বললেন, এটা কোন্ দেশ, চিনতে পারছি না।
গান লিখছেন রবীন্দ্রনাথ আর গুনগুন করে সুর ভাঁজছেন
এক সময়, মুখ তুলে প্রশ্ন করলেন খুব মৃদু কণ্ঠে
তোমরা দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গ রোধ করতে পারলে না?
কৃষ্ণনগরের বাড়িতে দিলীপকে গান শেখাচ্ছেন তার বাবা
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
আচমকা থেমে গিয়ে হা-হা করে হাসতে লাগলেন দ্বিজেন্দ্রলাল
জানলা দিয়ে তাকিয়ে বললেন, দ্যাখ, দ্যাখ
কী ভেবে লিখেছিলাম, আর আজ তার কী অর্থ
সকল দেশের রানি যে চাকরানি হতে চলেছে এই দেশ?
আর একটু দূরে, মুর্শিদাবাদে নিখিলনাথ রায় কাতরাচ্ছেন ঘুমের মধ্যে
বারবার বলছেন, আমার বাংলা কোথায় গেল আমার বাংলা!
দর্শক আসন শূন্য, মঞ্চে একা গিরিশচন্দ্র
দু চোখে জলের ধারা, ফিসফিস করে বলছেন,
আমার সাজানো বাগান, শুকিয়ে গেল? নাটকে নয়, সত্যি শুকিয়ে গেল?
সাজানো বাগান, আমার দেশ?
অন্য একটি মঞ্চে রবীন্দ্রনাথ, পার্ট ভুলে গেছেন
দু’ চোখে বিস্ময়, বিশ্বাস করতে পারছেন না নিজের কান
উইংসের আড়ালে যারা কথা বলছে, তাদের মাতৃভাষা নেই?
সুকুমার রায় ‘আবার যদি ইচ্ছা করো আবার আসি ফিরে’
গানটি গাইতে গাইতে হঠাৎ থেমে বললেন বাবা উপেন্দ্রকিশোরকে
না, না, আর ফিরে কী হবে এই হাঁসজারুর দেশে
অবনঠাকুর হাত তুলে কিছু বলতে গিয়ে চিত্রার্পিত
নজরুল আর শরৎচন্দ্র হাঁটছেন একই রাস্তার দু’ পাশ দিয়ে
যেন কেউ কারুকে চেনেন না
রাস্তার লোকেরাও চিনতে পারছে না তাঁদের
একটি অল্প বয়েসী রোগা ছেলে, তার কাশিতে রক্ত পড়ে
দাঁড়ালো এসে নজরুলের সামনে
নজরুল তার কাঁধ ছুঁয়ে বললেন, তবু তোমায় লিখে যেতে
হবে, সুকান্ত!
তারাশঙ্করকে হাতছানি দিয়ে ডেকে শরৎচন্দ্র বললেন,
জানো, শিশির নামে ছেলেটি ইংরিজি অধ্যাপনা ছেড়ে
বাংলায় নাটক করছে?
তারাশঙ্কর বললেন, কে শিশির, আজ কেউ তাকে চেনে না দাদা,
সত্যি কথাটা শুনবেন, শতবার্ষিকী হলেই আমাদের
সবাই ভুলে যায়
নজরুল বললেন, তাই তো আমি চলে যাচ্ছি, ওপারে বাংলাদেশে!
জগদীশচন্দ্র আর সত্যেন বসু ব্যাকুলভাবে ডাকছেন ছাত্র-ছাত্রীদের
কেউ শুনছে না, বিমানে চেপে মিলিয়ে যাচ্ছে পশ্চিম দিগন্তে
বুদ্ধদেব বসু চেয়ে আছেন তাঁর ক্ষত বিক্ষত বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের দিকে
কৈশোরে যার প্রেমে পড়েছিলেন, সেই ভাষাই খেয়ে নিচ্ছে তাঁর আয়ু
জীবনানন্দ কালি ঢেলে দিচ্ছেন রূপসী বাংলার পাণ্ডুলিপিতে
হঠাৎ আপন মনে বলে উঠলেন, মহাপৃথিবী না ছাই! জন্মভূমিটাই
থাকল না!
প্রেমেন্দ্র আর শৈলজানন্দ কাঁধ ধরাধরি করে হাঁটছেন
শ্মশানের বাগানে
সেখানে দিন দুপুরে চলছে প্রেতের নৃত্য
বিভূতিভূষণ দাঁড়িয়ে আছেন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের সামনে
বার বার ডাকছেন, অপু, অপু, ছেলেরা কেউ গ্রাহ্য করছে না
বনফুল আর সতীনাথ কথা বলতে পারেন হিন্দিতে,
লেখেন বাংলায়
এক সময় কলম থামিয়ে চেয়ে রইলেন উদভ্রান্ত ভাবে
আজ উনুন জ্বলবে কি জ্বলবে না ঠিক নেই, তবু দুর্দান্ত তেজে
কী লিখছেন মানিক
এক সময় চেঁচিয়ে উঠলেন, উল্লুকদের চিৎকার থামাও, গায়ে জ্বালা
করছে আমার
রান্নাঘরে বাঁধাকপির তরকারি চাপিয়ে এসেছেন আশাপূর্ণা
ফাঁকে ফাঁকে লিখে ফেলছেন কয়েক পাতা, কারা যেন হুড়মুড় করে
ছুটে যাচ্ছে পাশের গলি দিয়ে
ওরা কেউ কিছু পড়ে না
রেডিওর সামনে বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ
শুনছেন নিজেরই গান
এখনো অনেক ছেলেমেয়ে তাঁর গান দিব্যি গাইছে
একটু আধটু সুর এদিক ওদিক হয় বটে, তবু তৃপ্তির সঙ্গেই
মাথা দোলাচ্ছেন তিনি
এক সময় খেয়াল হল, তাঁর একটা গান তো কেউ আর গায় না
সীমান্তের ওপারেও না, এ পারেও না
সহ্য করতে পারবেন না বলে এতদিন সীমান্ত দেখতে যাননি
আজ গিয়ে দাঁড়ালেন সেখানে
এখন শিলাইদহে যেতে তাঁর ভিসা লাগবে
নিজেই গলা খুলে ধরলেন তাঁর সেই প্রিয় গানটি
বাঙালির গান, বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা
সত্য হউক, সত্য হউক…
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন, বাঙালির ঘরে যত ভাই বোন
এক হউক, এক হউক, এক হউক…
এ কী, রবীন্দ্রনাথ কাঁদছেন?