Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভূপাল রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 7

ভূপাল রহস্য || Sunil Gangopadhyay

দ্বিতীয়বার গাড়ির আওয়াজ শুনে কাকাবাবু বললেন, হয়তো কোনও ভিজিটর আসছে। আমি এখানে বসে ছবি আঁকব, তোরা দুজনে দুদিকে চলে যা। বাইরের লোকেদের সঙ্গে কথা বলার দরকার নেই।

মিংমা চলে গেল আশ্রমের দিকে। আমি পাহাড়ের ভেতর দিয়ে দিয়ে চলে এলুম রাস্তার ধারে একটা গুহার কাছে। এ দিকের কয়েকটা গুহা আমাদের দেখা হয়নি।

এখানে রয়েছে একটা দোতলা গুহা। একটা ছোট গুহার অনেক ওপরে আর একটা। প্রকৃতিই নিজের খেয়ালে এরকম বানিয়েছে। ওপরের গুহাটায় ওঠা খুব সহজ নয়, পাশের একটা বড় পাথর বেয়ে-বেয়ে উঠতে হয়। খানিকটা ওপরে ওঠার পর পরিষ্কার দেখতে পেলুম রাস্তাটা।

একটা কালো রঙের গাড়ি এসে বড় নিমগাছটার তলায় থামল। তারপর গাড়ি থেকে যিনি নামলেন, তাঁকে প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল, বুঝি কোনও ধুতি-পাঞ্জাবি-পরা সাহেব। বেশ লম্বা, ধপধাপে ফসর্গ রং, মাথার চুল একদম সাদা। বেশ রাশভারী চেহারা।

লোকটি গাড়ি থেকে নেমে এদিক-ওদিক তাকাল।

এরপর নামল আরও দুজন গট্রিাগোটা গুণ্ডার মতন চেহারার লোক। একজনের হাতে লম্বা একটা বাক্স। বেশ সন্দেহজনক চরিত্র। এদের ইতিহাসে কোনও আগ্রহ আছে কিংবা গুহার মধ্যে আঁকা ছবি দেখবার জন্য এতদূর আসবে, তা ঠিক মনে হয় না। তাছাড়া এরা এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন এই জায়গাটা ওদের বেশ চেনা।

গাড়ি থেকে নেমেই ওরা কাকে যেন খুঁজছে মনে হল। চারিদিকটা দেখবার পর নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কিছু বলে ওরা এগোল আশ্রমের দিকে।

আমার মনে হল, কাকাবাবুকে বোধহয় সাবধান করে দেওয়া উচিত। নামবার জন্য পা বাড়াতেই আর একটু হলে আমি খতম হয়ে যেতাম। একটা আলগা পাথরে পা দিতেই সেটা গড়াতে-গড়াতে দারুণ শব্দ করে পড়ল নীচে। আমি কোনও রকমে ঝুঁকে একটা পাথরের দেয়াল ধরে সামলে নিলুম।

পাথরের আওয়াজ শুনতে পেয়ে লোক তিনটি থেমে গেল, দুজন ছুটে এল এদিকে। আমার তখন তাড়াতাড়ি নামবার উপায় নেই, এক যদি ওপরের গুহাটার মধ্যে লুকনো যায়। কিন্তু একটা পাথর সরে যাওয়ায় অনেকখানি উঁচুতে পা দিতে হবে। আমি ওপরে ওঠবার আগেই ওরা এসে পৌঁছে গেল। আমি আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে রইলুম। ফসলিম্বা লোকটি এসে পড়ে আমাকে ভাল করে দেখল। তারপর আমাকে দারুণ অবাক করে দিয়ে ভাঙা-বাংলায় বলল, এ খোঁকা, তোমার চাচাজি কোথায় আছে?

এই লোকটা আমায় চেনে? কাকাবাবুর কথা জানে? কিংবা শত্রুপক্ষের লোক, খবর পেয়ে আমাদের ধরতে এসেছে।

আমি কোনও উত্তর দিলুম না বলে লোকটি এবার হুকুমের সুরে বলল, নীচে উতারকে এসে।

পালাবার উপায় নেই, নামতেই হবে। আমি বসে পড়ে ছাঁচড়াতে ছাঁচড়াতে নীচে নামতে লাগলুম। ওদের একজন লোক একটু উঠে এসে আমার কোমর ধরে মাটিতে নামাল!

ফসলিম্বা লোকটির চোখের মণি নীল রঙের। যথেষ্ট বয়েস হলেও বোঝা যায় গায়ে বেশ শক্তি আছে। আবার গম্ভীর গলায় বলল, কোথায় তোমার চাচাজি? চলো।

আমি খুব জোরে চেঁচিয়ে বললুম, কা-কা-বা-বু! আপনাকে খুঁজতে এ-সে-ছে!

ফর্সা লম্বা লোকটি এবার হেসে বলল, হুঁ! ছোকরা বিলকুল তৈয়ার। তার মানে তোমার কাকাবাবু কাছাকাছিই আছে। চলো, চলো।

ওর গুণ্ডামতন একজন সঙ্গী আমার হাত ধরল। আমি হাঁটতে লাগলুম অডিটোরিয়াম গুহার দিকে। কাকাবাবুকে সাবধান করে দিয়েছি, এবার যা ব্যবস্থা করার উনিই করবেন।

যা ভেবেছি ঠিক তাই। একটু আগে তিনি যেখানে বসে ছবি আঁকছিলেন, এখন সেখানে নেই। নিশ্চয়ই আমার চিৎকার শুনতে পেয়ে লুকিয়েছেন।

ফসলম্বা লোকটি গুহার মধ্যে একবার উঁকি মেরে দেখে বলল, এখানে ছিল? নেই তো, কাঁহা গেল?

তারপর আমাকে আরও সাঙ্ঘাতিক অবাক করে দিয়ে সেই লোকটি চেঁচিয়ে ডাকিল, রাজা! রাজা! এদিকে এসো!

কাকাবাবুর ডাকনাম রাজা। একমাত্র আমার বাবা ছাড়া আর কারুকে ঐ নাম ধরে ডাকতে শুনিনি। এই লোকটি সেই নাম জানল কী করে?

এবার একটা গুহার আড়াল থেকে রিভলভার হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলেন কাকাবাবু। রিভলভারটা পকেটে ভরতে-ভরতে হেসে বললেন, চিরঞ্জীবদাদা?

বুঝতে বাকি রইল না যে, ইনিই ডক্টর চিরঞ্জীব শাকসেনা।

ডক্টর শাকসেনা এগিয়ে গিয়ে কাকাবাবুকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর খানিকটা স্নেহের সুরে বকুনি দিয়ে বললেন, রাজা, তুমি কি পাগল বনে গেছ? এই খোঁকাকে সোথ নিয়ে তুমি এখানে রাত কাটোচ্ছ? কত্ত রকম বিপদ হতে পারে।

কাকাবাবু বললেন, দাদা, আপনি ভাবিকে দিয়ে অতগুলো মিথ্যে কথা বললেন, ভাবির খুব কষ্ট হচ্ছিল। ওঁর তো মিথ্যে কথা বলার অভ্যোস নেই।

তুমি বুঝতে পারলে? তাজ্জব কথা।

হ্যাঁ, ভাবির সঙ্গে একটুক্ষণ কথা বলেই আমি বুঝে গিয়েছিলুম যে, উনি জানেন, আপনি কোথায় আছেন। তার মানে, আপনি নিরুদ্দেশ্য হননি, ইচ্ছে করে কোথাও লুকিয়ে আছেন।

তোমাকে ফাঁকি দেবার উপায় কী আছে। বীণার বোঝা উচিত ছিল, তোমাকে সত্যি কথা বলতেই পারত।

আপনি বলে গিয়েছিলেন, যেন কেউ জানতে না পারে।

কী করি বলো। বিদেশ থেকে ফিরতে না-ফিরতেই যদি শুনলাম কী যে অৰ্জ্জুন, সুন্দরলাল আর মনোমোহন মাডার হয়ে গিয়েছে, অমনি সামঝে নিলাম কী মাই লাইফ আলসো ইজ ইন ডেইনজার।

তখন আপনি আপনার ভাইপো বিজয়কে নিয়ে পাঁচমারি গিয়ে লুকোলেন।

পাঁচমারি খুব লোনলি জায়গা। ভাবলাম কী, ওখানে কেউ খোঁজ পাবে না, আমারও বিশ্রাম হবে। কিন্তু ওরা ঠিক হাজির হল।

চিরঞ্জীবদাদা, ওরা মানে করা? সেটা বুঝেছেন?

না। এখনও জানি না। বাট দে আর আ ডেঞ্জারাস লিট্‌! পাঁচমারিতেও হঠাৎ আমার সামনে একটা লোক এসে গোলি চালিয়ে দিল। খতুমই হয়ে যেতাম, বুঝলে, রাজা, ঝাটোকসে বিজয় এসে পড়ল। মাঝখানে। আমার বদলে সে-ই জীবন দিতে যাচ্ছিল।

হ্যাঁ, শুনেছি, সে আপনাকে খুব ভক্তি করে। যাক, সে বেঁচে গেছে শুনেছি।

আমিই তাকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে জিম্মা করে দিয়েছি।

পাশের লোক দুটিকে দেখিয়ে ডক্টর শাকসেনা বললেন, এঁরা দুজন পুলিশ অফিসার। তারপর থেকে এদের প্রটেকশান নিতে বাধ্য হয়েছি। ঠিক আছে, আপলোগ গাড়িমে যাকে আরাম করিয়ে।

পুলিশ দুজন চলে যাবার পর ডক্টর শাকসেনা আর কাকাবাবু পাশাপাশি বসলেন একটা পাথরে। মিংমাও আমাদের কথাবার্তা শুনে এসে হাজির হয়েছে এর মধ্যে। কাকাবাবু মিংমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন ডক্টর শাকসেনার। আমরাও দুজনে বসলুম সামনের একটা গুহার মুখে বেদীর মতন জায়গায়।

চিরঞ্জীব শাকসেনা পকেট থেকে লম্বা একটা চুরুট বার করে ধরালেন। তারপর এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, এবার বলো তো, রাজা, এই ভীমবেঠকায় রাত-পাহারা দেবার মতন বে-পটু ভাবনা তোমার মাথায় এল কী করে?

কাকাবাবু বললেন, তাতে আমি ভুল করিনি নিশ্চয়ই। ভীমবেঠক সম্পর্কে আপনারা নতুন কিছু আবিষ্কার করেননি?

নতুন আর কী হবে? নির্ঘাত নতুন-কিছু পেয়েছেন?

শোনো, আইডিয়াটা প্ৰথমে আসে মনোমোহনের মাথায়। সে একদিন বলল কী, এখানে যে এত গুহার মধ্যে ছবি আছে, তার সব ছবি সির্ক ছবি নয়। সেগুলো ভাষা। তার মানে চিত্ৰভাষা। মিশরে পিরামিডের মধ্যে যেমন হিয়েরোগ্লিফিকস, অর্থাৎ ছবির মধ্যে ভাষা আছে, সেই রকম?

আমিও সেইরকমই আন্দাজ করেছিলুম দাদা।

তুমি তো জানো রাজা, ঐ মনোমোহন ছিল, অ্যামেচার হিস্টোরিয়ান। তার কথা প্রথমে আমরা হেসে উড়িয়ে দিয়েছি। আহা বেচারা বড় ভাল-মানুষ ছিল। হার্ট অফ গোলড যাকে বলে। কে ওকে মোরল?

সেইটাই তো কথা, ওঁকে মোরল কে?

এ জরুর কোনও ম্যানিয়াকের কাজ। নইলে কী এমন বীভৎস ভাবে গলা কাটো?

কোনও ম্যানিয়াক বেছে-বেছে শুধু ইতিহাসের পণ্ডিতদের খুন করবে: কেন? যাই হোক, সে-কথা পরে ভাবা যাবে। আপনি বলুন, মনোমোহন এই গুহার চিত্রলিপি সম্পর্কে কী জেনেছিলেন?

শুনলে ওয়াইলন্ড আইডিয়া বলে মনে হবে। সে বলল, কিছু-কিছু ছবির মধ্যে একটা প্যাটার্ন আছে। সেই ছবি দিয়ে যেন কিছু বলা হচ্ছে। মনোমোহন সেই ভাষা পড়বার জন্য খুব মেতে উঠল আর আমরা হাসলুম।

মনোমোহনজি কিছু প্রমাণ করতে পেরেছিলেন?

হ্যাঁ। বড় তাজবের কথা। এক গুহার ছবি দেখে মনোমোহন বলল, এতে লেখা আছে, মহান বীর ভোমা তাঁর নিজের বাসগুহাতেই শুয়ে রইলেন।

এর তো একটাই মানে হয়।

ঠিক বলেছ। আমরা আধা বিশ্বাস আর অবিশ্বাস নিয়ে দেখলাম কী, যে-গুহাতে এই ছবি আছে, সেই গুহার জমিন খুব প্লেন, আর সেখানে পাথরের সঙ্গে মিশে আছে মাটি। জায়গাটা খোঁড়া হল। সেখানে পাওয়া গেল এক কঙ্কাল। বহুত পুরনো—

কোন পীরিয়ড?

চালকোলিথিক হবে মনে হয়। আমরা তো অ্যাসটাউণ্ডেড। সেই কঙ্কালের সঙ্গে পাওয়া গেল। কয়েকটা দামি জহরত। টারকোয়াজ! তার দাম তুমি জানো। এখন মনোমোহন তো আমাদের ধোঁকা দেবার জন্য ঐ গুহার মধ্যে একটা কঙ্কাল আর দামি জহরত পুঁতে রাখেনি।

এটা কতদিন আগের কথা?

পাঁচ মাস।

এ আবিষ্কারের কথা তো কোনও কাগজে বেরোয়নি দাদা?

ইচ্ছে করেই গোপন রেখেছি। ঠিক প্রমাণ দাখিল না করলে সবার কাছে লাফিং স্টক হয়ে যাব না? চিত্রভাষার অ্যালফাবেট তো বুঝাতে হবে? সেই কঙ্কাল আর জহরত জমা রেখেছিলাম। এখানকার মিউজিয়ামে।

অর্থাৎ সুন্দরলাল বাজপেয়ীর কাছে। সে-ও জেনেছিল।

সুন্দরলালেরই তো বেশি উৎসাহ হল। মনোমোহনকে নিয়ে সেও এখানে আসতে লাগল ঘন ঘন। কিন্তু মুশকিল বাধল, ঐ যে ছবির প্যাটার্ন, তা কিন্তু সব গুহাতে নেই। অধিক সংখ্যার গুহাতেই সাধারণ ছবি, বিচ্ছিরি ছবি। আদিম মানুষদের মধ্যে দুএকজন থাকত শিল্পী স্বভাবের, তারা ইচ্ছামতন এঁকেছে। সেখানে চিত্রভাষা নেই। এর মধ্যে অর্জন শ্ৰীবাস্তব আবার প্রমাণ করে দিলে যে, এত্তগুলো রক শেলটারের মধ্যে পাঁচ জায়গার ছবি সম্পূর্ণ আলাদা। ভিন্ন জাতের। সেই ছবি খুব পুরনো দেখতে লাগলেও আসলে নতুন, করিব এক দেড় হাজার বছরের বেশি বয়েস না?

তার থেকে আবার নতুন কিছু পাওয়া গেল?

মনোমোহন বলল, এই যে পাঁচটা রক শেলটারের ছবি, এর মধ্যেও চিত্ৰভাষা আছে। তখন তো পুরোদমে লিপি চলছে, তবু কেউ ইচ্ছা করে ছবির মধ্যে সাঙ্কেতিক কিছু লিখে রেখে গেছে।

এখানে তো ব্ৰাহ্মী লিপিও আছে, আপনি তা পড়ে ফেলেছেন?

তার মধ্যে এমন কিছু নেই। শুধু কয়েকটা নাম। কিন্তু আমাদের মনোমোহন আবার একটা চিত্ৰভাষা পাঠ করে ফেলল। আমার বিদেশ যাবার ঠিক চার-পাঁচ দিন আগে।

কী সেটা?

বুঝলে রাজা, আমার তো ধারণা সেটা গল্প। কেউ চিত্রভাষায় একটা গল্প লিখে গেছে। যদি অবশ্য ঐ ভাষা সত্যি হয়।

তবু বলুন, দাদা, কী লেখা আছে সেই গুহায়?

সেটা পড়ে মনে হয়, মধ্যযুগে কোনও এক রাজা তার রাজ্য হারিয়ে শত্রুর তাড়া খেয়ে এখানে কোনও গুহায় লুকিয়ে ছিল। তারপর এখানেই তার মৃত্যু হয়। গুহার দেয়ালে ছবিতে লেখা আছে যে, অক্ষম, বৃদ্ধ, পরাজিত এক রাজা বড় অতৃপ্তি নিয়ে চলে যাবে। তবু এখানেই রইল তার সব কিছু। চল্লিশ মানুষ দূরে রইল চল্লিশ। কোনও বংশধর একদিন পেলে নতুন রাজ্য পত্তন করবে।

চিরঞ্জীবদাদা, এ তো শুনে মনে হচ্ছে কোনও গুপ্তধনের সঙ্কেত।

আবার গাঁজাখুরি গল্পও হতে পারে। লোভী লোকদের জন্য কেউ ভাঁওতা দিয়েছে। এর মধ্যে সঙ্কেত কোথায়? চল্লিশ মানুষ দূরে চল্লিশ, তার মানে কে বুঝবে বলো?

একমাত্র আপনিই বুঝতে পারবেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের সঙ্কেত ও হেঁয়ালি, এই বিষয়ে আপনার থিসিস আছে, আমি জানি।

কিন্তু আমি মাথা ঘামাবার সময় পেলাম কোথায়! চলে তো গেলাম দেশের বাইরে?

দাদা এমনও তো হতে পারে যে, আপনি যখন বিদেশে ছিলেন, তখন মনোমোহন বা সুন্দরলাল বা অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তব এরা কেউ এই সঙ্কেতের অর্থ উদ্ধার করতে পেরেছে। অথাৎ গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে।

তা অসম্ভব কিছু নয়।

আপনার বাড়িতে যখন এই সব বিষয় নিয়ে আলোচনা হত, তখন আর কে উপস্থিত ছিল?

আর কে ছিল, কেউ না!

আপনারা পাঁচজন ছিলেন। বীণা ভাবিজি পাঁচ কাপ করে চা পাঠিয়েছেন।

পাঁচজন? অর্জুন, সুন্দরলাল, মনোমোহন, আমি আর হাঁ হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ তো, প্রেমকিশোর ছিল এক দুদিন।

এই প্ৰেমকিশোর গুপ্তধনের কথা শুনেছে।

তা শুনেছে।

তা হলে তো ঐ প্ৰেমকিশোরের ওপরেই সন্দেহ পড়ে। সে কোথায়? তিনজন খুন হয়েছে? আপনাকেও মারার চেষ্টা হয়েছিল। অথাৎ আপনারা চারজন এই পৃথিবী থেকে সরে গেলে শুধু প্রেমকিশোরই ঐ গুপ্তধনের কথা জানবে। এই সব ঘটনার পেছনে নিশ্চয়ই সে আছে।

চিরঞ্জীব শাকসেনা হেসে বললেন, প্রেমকিশোর কে তা তুমি জানো না? সে তো সুন্দরলালের ছেলে। সতেরো-আঠারো বছর মাত্র বয়েস, দিল্লিতে কলেজে পড়ে। কয়েকদিনের জন্য ছুটিতে এসেছিল।

কাকাবাবু একটুখানি চুপ করে গেলেন। আমি ওঁদের কথাবার্তা গোগ্ৰাসে গিলছিলুম এতক্ষণ। আমারও মনে হয়েছিল পঞ্চম ব্যক্তিই এ-সব কিছুর জন্য দায়ী। কিন্তু প্ৰেমকিশোরের এত কম বয়েস? তা ছাড়া, সে তো আর তার বাবাকেও খুন করবে না।

কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, প্ৰেমকিশোর এখন কোথায় তা জানেন?

ডক্টর শাকসেনা বললেন, দিল্লিতেই আছে নিশ্চয়ই। আমি তো ফিরে এসে আর কোনও খবর পাইনি!

এক্ষুনি তার খোঁজ নেওয়া দরকার। তারও তো কোনও বিপদ হতে পারে। এখন আমারও মনে পড়ছে বটে, সুন্দরলালের বাড়িতে তার ছেলেকে দেখেছিলুম, তখন সে খুবই ছোট। সুন্দরলাল খুবই ভালবাসত তার ছেলেকে।

তা ঠিক।

কাকাবাবু উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন, দাদা?

তই চলো, ফিরে যাওয়া যাক?

না, আমি ফিরে যাবার কথা বলিনি। যে গুহাটায় আপনারা ঐ গুপ্তধনের সঙ্কেতলিপি পেয়েছেন, আমি সেই গুহাটা দেখতে চাই।

সেটা অনেক নীচে। খুবই দুৰ্গম জায়গায়, তুমি সেখানে যেতে পারবে না।

ঠিক পারব।

তুমি ক্রাচ্‌ বগলে নিয়ে অতখানি নামবে? তোমার খুবই কষ্ট হবে। তা ছাড়া, বুজা, তুমি এই বিপদের মধ্যে জড়িয়ে পড়ছ কেন? আমি পুলিশকে সব জানিয়েছি…

চিরঞ্জীবদাদা, কষ্ট না করলে কেষ্ট পাওয়া যায় না। আর বিপদের মধ্যে না। জড়ালে বিপদকে জয় করা যাবে কীভাবে?

রাজা, তুমি এখনও এই কথা বলতে পারো! কিন্তু আমি বুড়ো হয়ে গেছি, থকে গেছি, আমি এখন ক্লান্ত। আমি এখন বিশ্রাম নিতে চাই-তবু চলো, তুমি যখন বলছি…

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress