Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভূপাল রহস্য || Sunil Gangopadhyay » Page 2

ভূপাল রহস্য || Sunil Gangopadhyay

মধ্যপ্রদেশের নাম শুনলেই আমার মনে পড়ে শুধু জঙ্গল আর ছোট ছোট পাহাড়ের কথা। এছাড়া যেন ওখানে আর কিছু নেই। আমাদের চিড়িয়াখানায় যে সাদা বাঘ, তাও তো প্রথম এসেছিল। ঐ মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল থেকে।

কিন্তু ভূপাল রেল স্টেশন থেকে বেরিয়ে খানিকটা আসবার পর আমি অবাক। এমন সুন্দর শহর আছে এই মধ্যপ্রদেশে! দারুণ দারুণ চওড়া রাস্তা, পরিষ্কার ঝকঝকে। দু পাশে নতুন ডিজাইনের নানা রকম বাড়ি। শহরের মাঝখানে একটা বিশাল লেক, তার ওপাশে পুরনো শহর। একটা মস্ত বড় মসজিদের চুড়া দেখতে পাওয়া যায় অনেক দূর থেকে। নিপুদার মুখে শুনলাম, বিখ্যাত ক্রিকেট খেলোয়াড় নবাব পতৌদির বাড়ি আছে ওখানে। ঠিক করলুম, একদিন পতৌদির সঙ্গে দেখা করে ওঁর অটোগ্রাফ নিতে হবে।

শহরটা ঠিক সমতল নয়, রাস্তাগুলো উঁচুনিচু। পাহাড় কেটে যে শহরটা বানানো হয়েছে, তা বেশ বোঝা যায়। এক এক জায়গায় বাড়িগুলো বেশ উঁচুতে। যেদিকেই তাকাই, চোখে বেশ আরাম লাগে।

ট্যাক্সিটা প্রায় সারা শহরটা পেরিয়ে এসে ঢুকল আরেরা কলোনিতে। এখানকার বাড়িঘরগুলো যেন আরও বেশি কায়দার যেন কার বাড়ি কত সুন্দর হবে এই নিয়ে একটা প্ৰতিযোগিতা আছে। প্ৰায় প্রত্যেক বাড়ির সঙ্গেই একটা করে বাগান। ইংরেজি সিনেমায় যে রকম বাড়ি-টাড়ি দেখি, সে তো এই রকমই।

একটা পার্কের পাশ দিয়ে যেতে যেতে নিপুদা বলল, এই পার্কেই পাওয়া গিয়েছিল। সেকেণ্ড ডেড বডিট।

ডান দিকে হাত তুলে একটা হালকা নীল রঙের তিনতলা বাড়ি দেখিয়ে বলল, আর ঐ বাড়িতে থাকতেন অর্জন শ্ৰীবাস্তব। ঐ যে ছাদের ঘরটা দেখতে পাচ্ছিস, ঐটাই ছিল ওঁর পড়ার ঘর।

এর পর ট্যাক্সিটা ডান দিকে ঘুরতেই আমরা বাড়ি পৌঁছে গেলুম।

ছোড়দি তো আমায় দেখে অবাক! আগে থেকে আমরা কোনও খবরও দিইনি। আমায় জড়িয়ে ধরে ছোড়দি বলল, খুব ভাল সময়ে এসেছিস রে সন্তু! আমরা এই শনিবারই পাঁচমারি যাবার প্ল্যান করেছি। দেখবি, দারুণ ভল व्लॉकंद।

আমি মিংমার সঙ্গে ছোড়দির আলাপ করিয়ে দিলুম। মিংমা। এমনিতেই কম কথা বলে, নতুন জায়গায় এসে একদম চুপা।

ছোড়দি মিংমার দিকে তাকিয়ে বলল, বা, ছেলেটির চেহারা খুব সুন্দর তো!

আমি বললুম, ছেলেটা বলছি কী। ওর বয়েস একত্রিশ বছর, তোমার চেয়েও বয়েসে বড়। আর ও বাংলা বোঝে!

ছোড়দি বলল, চট করে হাত মুখ ধুয়ে নে। তোদের খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই?

সত্যিই বেশ খিদে পেয়েছে। ভূপালে কলকাতা থেকে একটানা ট্রেনে আসা যায় না। নাগপুর থেকে বদল করতে হয়। শেষের দিকে মনে হচ্ছিল, চলেছি তো চলেইছি, রাস্তা আর ফুরোচ্ছে না।

প্রথমে টপাটপ মিষ্টি খেয়ে ফেললুম কয়েকটা। তারপর ছোড়দি প্লেটে করে লুচি এনে দিল।

এ বাড়িটা দোতলা। ওপরে বেশ চওড়া বারান্দা, সেখানেই বসে গল্প করতে লাগলুম। বিকেল পেরিয়ে সবে মাত্র সন্ধে হব-হব সময়। আকাশে ঘুরছে। কালো কালো মেঘ। রত্নেশদা এখনও অফিস থেকে ফেরেননি। নিপুদাও আমাদের পৌঁছে দিয়েই ছুটেছে নিজের অফিসের দিকে।

ছোড়দিদের বাড়ির সামনেও একটা বেশ সাজানো বাগান। সেখানে লাফালাফি করছে মেটিকা-সোটকা খুব লোমওয়ালা একটা কুকুর। একটু দূরে আর একটা বাড়িতে একটা কুকুর অনবরত ডেকে চলেছে। আমরা আসার পর থেকেই ঐ কুকুরটার ঐ রকম একটানা ডাক শুনতে পাচ্ছি।

ছোড়াদিই এক সময় বলল, ইশ, ধীরেনদাদের কী অবস্থা! সৰ্বক্ষণ ঐ রকম কুকুরের ডাক সহ্য করা….

আমি জিজ্ঞেস করলুম, কুকুরটার কী হয়েছে? পাগল হয়ে গেছে নাকি?

না। ঐ কুকুরটা ছিল অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তব নামে এক ভদ্রলোকের। তিনি হঠাৎ মারা গেছেন কিছুদিন আগে। তারপর থেকেই কুকুরটা ঐ রকম ডেকে চলেছে। মনিবের জন্য ও কাঁদে।

কিন্তু অর্জন শ্ৰীবাস্তবের বাড়ি তো এই ডানদিকে, আর কুকুরটা ডাকছে। এদিকের একটা বাড়ি থেকে!

ছোড়দি একটু অবাক হয়ে তাকাল, আমার দিকে। তারপর বলল, ও, নিপু বুঝি। এর মধ্যেই তোদের সব বলেছে? শ্ৰীবাস্তবজী মারা যাবার পর কুকুরটাকে দেখাশুনো করবার কেউ ছিল না, উনি তো একলাই কুকুরটাকে নিয়ে থাকতেন–সেই জন্য ধীরেনদা নিজের বাড়িতে কুকুরটাকে নিয়ে এসেছেন।

ধীরেনদা কে?

নিপু তোদের ধীরেনদার কথা কিছু বলেনি?

নামটা শুনেছি একবার।

সন্ধেবেলা তোদের নিয়ে যাব ধীরেনদাদের বাড়িতে।

কুকুরটা তখনও ডেকেই চলেছে। কী রকম যেন অদ্ভুত করুণ সুর। আমার মনে পড়ল, সেই নেপালের অভিযানে কেইন শিপটিনেরও একটা সাদা লোমওয়ালা সুন্দর কুকুর ছিল। কেইন শিপটন পালাবার পর সেই কুকুরটাও এরকম এক-একা কাঁদত। কেউ খাবার দিলে খেতে চাইত না। শেষ পর্যন্ত কুকুরটা যে কার কাছে রইল কে জানে!

সন্ধেবেলা সবাই মিলে যাওয়া হল ধীরেনদার বাড়িতে। ধীরেনদা মানে ধীরেন চক্রবর্তী, একটা বিদেশি কোম্পানির বিরাট একটা কারখানার উনি ম্যানেজার। মানুষটি কিন্তু খুব হাসিখুশি। এখানকার অনেক বাঙালিই আসে এঁর বাড়িতে আড্ডা দিতে। সবাই ওঁকে ডাকে ধীরেনদা আর ওঁর স্ত্রীকে বলে রিনাদি।

ছোড়দি আমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার পর ধীরেনদা বললেন, আরে, তাই নাকি? এই তাহলে পাহাড়চূড়ায় আতঙ্কের সেই হীরো সন্তু, আর এই সেই মিংমা? আজ তো দুজন খুব বিখ্যাত মানুষ এসেছে আমাদের বাড়িতে। কাকাবাবু এলেন না? ইশ, কাকাবাবুকে একবার দেখবার খুব ইচ্ছে ছিল?

ধীরেনদাদের দুটি ছেলে, দীপ্ত আর আলো। এদের মধ্যে দীপ্ত প্রায় আমারই বয়েসি!

রিনাদি জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা সন্তু, তোমরা যে সিয়াংবোচিতে ছিলে, এভারেস্টের অত কাছে, সেখানে তোমাদের নিশ্বাসের কষ্ট হয়নি?

আমি বললুম, হ্যাঁ, প্রথম-প্রথম দু একদিন হয়েছিল, আমাদের সঙ্গে অক্সিজেন মাস্ক-ও ছিল, কিন্তু পরে সেগুলোর দরকার হয়নি, এমনিই অভ্যোস হয়ে গিয়েছিল।

ধীরেনদা বললেন, পাহাড়চূড়ায় আতঙ্কের হীরোরা এসেছে, আজ ওদের মাগুর মাছ খাওয়াব।

কথাটা শুনে একটু অবাক হয়ে গেলুম। মাগুর মাছ খাওয়ার মধ্যে আবার এমন কী বিশেষত্ব আছে?

ধীরেনদা বললেন, দীপ্ত, আলো, চলো আমরা এখন মাছ ধরব।

সবাই মিলে চলে এলুম। বাগানে। প্রথমে মনে হয়েছিল কোনও পুকুরে বুঝি মাছ ধরতে যাওয়া হবে। তা নয়। বাগানের এক কোণে রয়েছে একটা বেশ বড় চৌবাচ্চার মতন। পাশাপাশি চারখানা ক্যারাম বোর্ড সাজিয়ে রাখলে যত বড় হয়, ততখানি। কালো মিশমিশে জল, ওপরে ভাসছে পদ্মপাতা, দুটো পদ্মফুলও ফুটে আছে।

দুটো ব্যাডমিন্টনের র‍্যাকেটের মতন হাত-জাল নিয়ে ধীরেনদা আর দীপ্ত সেই জলের মধ্যে মাছ খুঁজতে লাগল। এক সময় দীপ্তর জাল থেকে একটা কী যেন লাফিয়ে পড়ল আমাদের সামনে।

প্রথমে চমকে উঠে আমি ভেবেছিলাম। ওটা বুঝি সাপ! এত বড় মাগুর মাছ কখনও দেখিনি, প্ৰায় এক হাত লম্বা। আর অ্যাত্তি বড় মাথা!

ছোড়দি ফিসফিস করে আমাকে বলল, ধীরেনদা এই মাগুর মাছ সহজে তুলতে চান না। এখানে তো মাগুর মাছ পাওয়া যায় না। তোদের বেশি খাতির করার জন্যই ধরলেন।

চৌবাচ্চাটায় নিশ্চয়ই অনেক মাছ কিলবিল করছে, কারণ অল্পক্ষণের মধ্যেই ধীরেনদা আর দীপ্ত সাত-আটাটা মাছ তুলে ফেলল।

রিনাদি বললেন, আর দরকার নেই, সাতটা মাছ থাক, একটাকে জলে ছেড়ে দাও।

বাগানের অন্যদিকে অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তবের কুকুরটা ডেকেই চলেছে। একটা খুঁটির সঙ্গে চেন দিয়ে বাঁধা। মিংমা মাছ ধরা না দেখে সেই কুকুরটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

ধীরেনদা চেঁচিয়ে বললেন, ওর গায়ে হাত মাত দেও। কামড়ে দিতে পারে।

কুকুরটা খয়েরি, খুব বেশি বড় নয়, কিন্তু গলার আওয়াজ বেশ জোরালো। মিংমা কুকুর খুব ভালবাসে। কাছে দাঁড়িয়ে কুকুরটাকে লক্ষ করল একটুক্ষণ। তারপর খপ করে এমন কায়দায় ওর ঘাড়টা এক হাতে চেপে ধরল যে কুকুরটার কামড়াবার কোনও সাধ্য রইল না।

অন্য হাত দিয়ে মিংমা কুকুরটার লোমের ভেতর থেকে পোকা বাছতে লাগল। বড় বড় এটুলি।

কুকুরটা ডাক থামিয়ে দিয়েছে। মনে হল যেন বেশ আরাম পাচ্ছে। ধীরেনদা বললেন, এই মিংমার তো বেশ এলেম আছে। কুকুরটাকে এ পর্যন্ত কেউ সামলাতে সাহস পায়নি।

আমি বললুম, আচ্ছা ধীরেনদা, অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তবের ঘরটা একবার দেখতে পারি? ঘরটা কি বন্ধ আছে?

ধীরেনদা বললেন, কেন, তুমি এখানে গোয়েন্দাগিরি করবে নাকি? বেশ তো!

ছোড়দি বলল, না, না, সন্তুর ও-সবে মাথা গলাবার দরকার নেই। মা আমাকে চিঠি লিখে বারণ করে দিয়েছেন। কাকাবাবু সঙ্গে থাকলেও না হয় আলাদা কথা ছিল!

ধীরেনদা বললেন, কাকাবাবু নেই বটে, কিন্তু আমরা তো আছি। সন্তুর অভিজ্ঞতা আছে, সেই সঙ্গে যদি আমরাও সাহায্য করি, তা হলে হয়তো খুনিকে ধরে ফেলা যেতে পারে। মধ্যপ্রদেশের সরকার এর মধ্যেই দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছেন।

আমার অবশ্য খুনের তদন্ত করার কোনও অভিজ্ঞতাই নেই। কাকাবাবুর সঙ্গে আমি যে-সব অ্যাডভেঞ্চারে গেছি, তা আরও অনেক বড় ব্যাপার। তবু চুপ করে রইলুম।

ধীরেনদা বললেন, চাবি আমার কাছেই আছে। চলো, এখুনি ঘুরে আসি!

ধীরেনদা, আমি, দীপ্ত আর মিংমা বেরিয়ে পড়লুম রাস্তায়। মিংমা কুকুরটাকেও সঙ্গে নিয়ে নিল। তিনতলার ওপর শুধু দুখানা ঘরের ফ্ল্যাট আর ছাদ। অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তব সেখানে একাই থাকতেন। সেখানে গিয়ে অবশ্য চমকপ্রদ কিছুই চোখে পড়ল না। দুখানা ঘরেই ঠাসা বইপত্র, প্রায় সব বইই ইতিহাস বিষয়ে। মনে হয় যেন বই ছাড়া অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তবের আর কোনও সম্পত্তি ছিল না। কোথাও মারামারি, ধস্তাধস্তির কোনও চিহ্নই নেই। দুটো বাক্স আর একটা আলমারি আছে, সেগুলোরও তালা ভাঙা হয় নি। চাবিও পাওয়া গিয়েছিল, পুলিশ এসে খুলে দেখেছিল যে, ভেতরে ঘাঁটাঘাঁটি করেনি কেউ।

ধীরেনদা বললেন, পার্কে অর্জন শ্ৰীবাস্তবের দেহ যদিও পাওয়া গিয়েছিল ভোরবেলা, কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় জানা গেছে যে, তাঁকে খুন করা হয়েছিল রাত একটা দেড়টার সময়।

অত রাতে শ্ৰীবাস্তবজি কি নিজেই পার্কে গিয়েছিলেন? না চেনা কেউ তাঁকে বাইরে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল?

কুকুরটা এখানে এসেই আবার চ্যাঁচাতে শুরু করেছে। ও নিশ্চয়ই অনেক কিছু জানে। কিন্তু আমরা যে ওর ভাষা বুঝি না!

শার্লক হোমসের মতন একটা পোড়া দেশলাই-কাঠি কিংবা এক টুকরো কাপড়ের মতন কোনও সূত্রই চোখে পড়ল না। তবু আমি উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখতে লাগলুম খাটের তলা-টলা।

ধীরেনদা জিজ্ঞেস করলেন, কী হে, সন্তু, কিছু বুঝতে পারলে?

আমি চুপ করে রইলুম। অনেক বইতেই পড়েছি, বড়-বড় ডিটেকটিভরা কোনও সূত্র বা প্রমাণ পেলেও প্রথম দিকটায় কিছুই বলতে চান না।

আমার একবার মনে হল, কাকাবাবু এখানে উপস্থিত থাকলে কী করতেন? তিনি কোন কোন জিনিস পরীক্ষা করতেন আগে? হয়তো তিনি এই বইগুলোই পড়তে শুরু করে দিতেন!

অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তবের বিছানাটা এখনও একইরকমভাবে পাতা আছে। চাদরে কোনও ভাঁজ নেই, মনে হয় রাতে শ্ৰীবাস্তবজি শুতেই যাননি। বিছানাটার দিকে তাকাতেই আমার গা শিরশির করছে। এই বিছানায় কয়েকদিন আগেও একজন মানুষ শুয়েছে, আজ সে বেঁচে নেই!

ধীরেনদা বললেন, শ্ৰীবাস্তবজি ছিলেন আমার বন্ধু। অতি নিরীহ, শান্ত মানুষ, তাঁকে যে কেউ ওরকম ভয়ঙ্করভাবে খুন করতে পারে বিশ্বাসই করা যায় না।

খানিক বাদে আমরা চলে এলুম। সেখান থেকে।

তারপর ধীরেনদার বাড়িতে থাকা হল অনেক রাত পর্যন্ত। গল্প হল অনেক রকম। আমরা এই শনিবারই পাঁচমারি বেড়াতে যাচ্ছি শুনে ধীরেনদা বললেন, ইশ, আমরাও আর একটা গাড়ি নিয়ে তোমাদের সঙ্গে গেলে পারতুম। কিন্তু শনিবার তো হবে না, সেদিনই আমাদের কোম্পানির এক সাহেব আসছে। আমেরিকা থেকে।

ছোড়দি বলল, একটু চেষ্টা করে দেখুন না, ধীরেনদা, কোনও রকমে ম্যানেজ করতে পারেন না? আপনি গেলে খুবই ভাল হত!

ধীরেনদা বললেন, কোনও উপায় নেই! ঠিক আছে, তোমরা পাঁচমারি থেকে ঘুরে এসো, তারপর আমি তোমাদের আর একটা জায়গায় নিয়ে যাব।

ছোড়দি বলল, কোথায়? সাঁচি?

সাঁচি তো আছেই। সেখানে যে-কোনও দিন যাওয়া যেতে পারে। আমি তোমাদের নিয়ে যাব। ভীমবেঠকায়।

ভীমবেঠকায়? সেটা আবার কোন জায়গা?

নাম শোনোনি তো? যারা ভূপাল বেড়াতে আসে, তারা সবাই সাঁচি স্তৃপ দেখে কিংবা পাঁচমারি যায়। কিন্তু আমার মতে ভীমবেঠকই সবচেয়ে ইণ্টারেস্টিং জায়গা। তোমাদের মতন যারা ভূপালে এসে বেশ কিছুদিন আছে, তারাও ঐ জায়গাটার নাম শোনেনি।

রিনাদি বললেন, ঐ ভীমবেঠক তোদের ধীরেনদার খুব ফেভারিট জায়গা। অবশ্য গেলে তোদেরও খুব ভাল লাগবে। ঐ অৰ্জ্জুন শ্ৰীবাস্তবই আমাদের প্রথম ভীমবেঠকায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তার আগে আমরাও নাম জানতুম না।

ভীমবেঠক নামটা শুনে আমারও কী রকম অদ্ভুত লাগল। ঐ রকম কোনও জায়গার নাম শুনলেই যেতে ইচ্ছে করে।

যাই হোক, আগে তো পাঁচমারি ঘুরে আসা যাক।

পরের দিন নিপুদা আমাদের গাড়ি করে ভূপালের বিখ্যাত লেক দেখিয়ে আনল। নবাব পতৌদির বাড়িতেও গেলুম। কিন্তু সেখানে গিয়ে শুনলুম, পতৌদি এখন ভূপালে নেই, অষ্ট্রেলিয়ায় টেস্ট খেলা দেখতে গেছেন।

শনিবার সকালে পাঁচমারি যাবার জন্য আমরা তৈরি হচ্ছি। রত্নেশদ একটা বড় স্টেশন ওয়াগান জোগাড় করে এনেছেন, আমরা সবাই তো যাবই, ধীরেনদার ছেলে দীপ্তও যাবে আমাদের সঙ্গে। এর মধ্যে দীপ্তর সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়ে গেছে।

একে-একে সব জিনিস-পত্ৰ তোলা হচ্ছে। পাঁচমারিতে নাকি রাত্রে খুব শীত পড়ে, তাই নিতে হচ্ছে কম্বল-টম্বল। রত্নেশদা সঙ্গে নিলেন একটা শটগান, যদি শিকার-টিকার কিছু করা যায়। আগেই শুনেছিলুম, পাঁচমারি যাবার পথে বাঘ দেখা যেতে পারে।

নিপুদা একটা ছোট্ট রেডিও এনে বলল, এটাকেও সঙ্গে নিয়ে যাই, কী ধলো? ওখানে গিয়ে গান-টান শোনা যাবে।

রেডিওর ব্যাটারি ঠিক আছে কিনা দেখবার জন্য নিপুদা একবার ওটা চালাল।

সঙ্গে সঙ্গে আমরা শুনতে পেলুম একটা দারুণ দুঃসংবাদ!

রেডিওতে তখন স্থানীয় খবর শোনাচ্ছে। তাতে জানা গেল যে, বিখ্যাত পণ্ডিত এবং ভূপাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রধান অধ্যাপক ডঃ চিরঞ্জীব শাকসেনাকে গত চব্বিশ ঘণ্টা ধরে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ছোড়দি বলল, অ্যাঁ? কী সর্বনাশ!

রত্নেশদা বলল, চুপ করো! আগে শুনতে দাও পুরো খবরটা?

আরও জানা গেল যে, ডঃ শাকসেনা একটা আন্তজাতিক সম্মেলনে যোগ দেবার জন্য জেনিভা গিয়েছিলেন। সেখান থেকে পরশু রাত্রে ফিরেছেন ভুপালে। রাত্রে তিনি যথারীতি খাওয়া-দাওয়া করে ঘুমিয়েছিলেন, সকালবেলা থেকে তাঁকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। বাড়িতে তিনি কিছু বলে যাননি, এমনভাবে তাঁর হঠাৎ উধাও হয়ে যাবার কোনও কারণই নেই। এর আগে যে তিনটি বীভৎস হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তার জের টেনে ডঃ শাকসেনা সম্পর্কেও চরম আশঙ্কা করা হচ্ছে। পুলিশ সারা মধ্যপ্রদেশ জুড়ে তল্লাশি শুরু করেছে এবং দিল্লিতে সি বি আইকেও জানানো হয়েছে।

নিপুদা বলল, এই রে, আর দেখতে হবে না! ওঁকেও মেরেছে।

ছোড়দি বলল, চুপ করো! আগে থেকেই এরকম বলতে শুরু কোরো না। এখনও তো কিছু পাওয়া যায়নি।

নিপুদা বলল, ওঁর মতন একজন শিক্ষিত, বয়স্ক লোক কারুকে কিছু না বলেই বাড়ি থেকে চলে যাবেন, এ কি হয়? এ নিশ্চয়ই গুম খুনের কেস।

রত্নেশ বলল, আমাদের অফিসের ঐ যে বিজয় শাকসেনা, তার তো আপন কাকা হন ইনি। একদিন বিজয়ের বাড়িতে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। এমন সৌম্য চেহারা যে, দেখলেই ভক্তি হয়। ঐ রকম মানুষের যে কোনও শত্ৰু থাকতে পারে, তাই তো বিশ্বাস করা যায় না।

নিপুদা বলল, এখন হোল ইণ্ডিয়াতে ডঃ শাকসেনার মতন ইতিহাসের এত বড় পণ্ডিত আর কেউ নেই। এত জায়গা থেকে ওঁকে চাকরি দেবার জন্য সোধেছে! কিন্তু উনি ভূপাল ছেড়ে কোথাও যেতে চান না।

এই সময় এসে পড়লা খবরের কাগজ। তাতেও প্রথম পাতাতে ডঃ শাকসেনার ছবি দিয়ে বড়-বড় অক্ষরে খবর বেরিয়েছে।

ছোড়দি আর নিপুদা কাগজটা আগে পড়বার জন্য কড়াকড়ি করতে লাগল। রত্নেশদ ব্যস্ত হয়ে বলল, না, না, এখন নয়, আগে গাড়িতে উঠে পড়ে, যেতে-যেতে পড়বে! অনেক বেলা হয়ে গেছে।

একটু বাদেই আমাদের গাড়ি ছুটিল পাঁচমারির দিকে।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress