Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভূতের ছেলে || Bhooter Chele by Lila Majumdar

ভূতের ছেলে || Bhooter Chele by Lila Majumdar

রাত যখন ভোর হয়ে আসে তখন ওই তিন-বাঁকা নিম গাছটায় হুতুম প্যাঁচাটারও ঘুম পায়। নেড়ু দেখেছে ওর কান লোমে ঢাকা, ওর চোখে চশমা, ওর মুখ হাঁড়ি। হুতুমটা কেন যে চিল-ছাদের ছোটো খুপরিতে পায়রাদের সঙ্গে বাসা করে না, নেড়ু ভেবেই পায় না। বোধ হয় ভূতদের জন্যে।

নিম গাছতলায় ভূত আছে।

একদিন ভোর বেলায়, মই বগলে ছাগলদাড়ি লোকটা রাস্তার আলো নিবিয়ে নিবিয়ে চলে গেলে পর, নেড়ু দেখেছিল কোমরে রুপোর ঘুনসিওয়ালা, মাথায় গুটিকতক কোঁকড়া চুল, ভূতদের ছোটো কালো ছেলে নিম গাছতলায় কাঁসার বাটিতে নিম ফুল কুড়চ্ছে। নেড়ুকে দেখেই ছেলেটা এক চোখ বুজে বগ দেখাল। নেড়ু, ভাবল, ভূত কিনা, তাই ভদ্রলোক নয়।

তারপর অনেক দিন নেড়ু অনেক বেলা পর্যন্ত গাঁক গাঁক করে ঘুম লাগিয়েছে, শেষটা এমনকী ভজাদা এসে ঠ্যাং ধরে টেনে খাট থেকে নামিয়েছে। নেড়ু, কিন্তু একটুও রেগেমেগে যায়নি। ও তো আর সুকুমারদা নয় যে মুখ দেখলে বালতির দুধ দই হয়ে যাবে! কিন্তু সেই ছানাটাকে আর দেখা হয়নি।

শেষটা হঠাৎ একদিন নেড়ু স্বপ্ন দেখল কালো ছেলেটা ওকে লেঙ্গি মেরে মাটিতে ফেলে নাকের ফুটোয় কাগের নোংরা পালক দিয়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। রাগের চোটে নেড়ুর ঘুম ছুটে গেল। ইচ্ছে করল ছেলেটার মাথায় সুপুরি বসিয়ে লাগায় খড়ম! খানিক চোখ রগড়ে, জিভ দিয়ে তালুতে চুকচুক করে চুলকে, রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখল, মই বগলে সেই লোকটা। তারপর নিমতলায় তাকিয়ে দেখল ভূতের ছানাটা একলা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বেজায় হাসছে, যেন কালো ভাল্লুক মুলো চিবোচ্ছে। সে কী বিশ্রী হাসি! গোটা কতক শুট লাগালে হয়!

ছেলেটা নেড়ুকে দেখে আজ আর বগ দেখাল না, ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। ভূতের ছেলে বাবা! বিশ্বাস নেই! নেড়ুর একটু ভয় করছিল, ঘরের ভিতর এদিক-ওদিক একবার তাকাল। দেখে ভূতের ছেলে কিনা কুঁজোর পিছন থেকে একটা এয়া বড়া টিকটিকি মুণ্ডু বাড়িয়ে, ঘোলাটে চোখ পিটপিট করে ঘুরিয়ে আহ্লাদে আহ্লাদে ভাব করে টিক-টিকটিক করে আবার মুণ্ডুটা ঢুকিয়ে নিল, কেমন যেন তুচ্ছতাচ্ছিল্য ভাব! নেড়ুর ভারি রাগ হল। কী, ভয় পাই। নাকি!

নেড়ু আস্তে আস্তে নীচে গেল। দাঁত মাজল না। চোখ ধুল না। তাতে কী হয়েছে? সেই ছেলেটার তো নাকে সর্দি!

নিমতলায় যাবার পথে দেখে দুই দিকে দেয়ালে খুঁটে। দেওয়া। কতকগুলো গোল গোল মতন, সেগুলো ধোপার। মা দিয়েছে; আর কতকগুলো ঠ্যাংওয়ালা, সেগুলো ধোপার মায়ের মেয়ে দিয়েছে। কিন্তু নিমতলায় গিয়ে দেখে ছেলেটা কোথায় যেন সটকে পড়েছে। কী। জানি ভোর হয়ে এসেছে, আলো-টালো দেখে উঠে গেল না তো!

সেই দিনই সন্ধ্যা বেলায় নেডুর দাঁত ব্যথা করছিল, তাই লবঙ্গ-জল দিয়ে মুখ ধুয়ে জানলার উপর বসে ভাবছিল, আচ্ছা নেপাল খুড়োর কেনই-বা অমন সিন্ধুঘোটকের মতন গোঁফ, আর বিধুদাই-বা কেন দিনরাত টিকটিক করেন!

এদিকে ওদের বাড়ির দারোয়ান কী যেন গাইছিল, মনে হচ্ছিল–

নিমতলাতে আর যাব না,
কেলো-ভূ-তে-র-কা-লো-ছা-না!

হঠাৎ শুনল, এইয়ো।

চমকে আর একটু হলে ধুপুস করে পড়েই যাচ্ছিল! আবার শুনল, এইয়ো!

চেয়ে দেখে নিমতলায় আবছায়াতে সেই ভূতের ছানাটা! নেড়ু গলা নামিয়ে হিন্দিতে ফিসফিস করে বললে, হাম শুনতে পাতা।

ছানাটা আবার বাংলায় বললে– সকালে কি পায় শেকড় গজিয়েছিল?

নেড়ু বললে, আমি তো গেলুম, তুমিই আলো দেখে চলে গেছিলে।

ছেলেটা বললে, দ্যুৎ, আলো নয়, বাবাকে দেখে।

নেড়ু, ভাবল– কেন, বাবাকে দেখে চলে যাবে কেন? নেড়ু শুধু এক বার বাবাকে দেখে চলে গিয়েছিল সেই যেবার দরোয়ানের হুঁকা টেনেছিল। তাই জিজ্ঞেস করল– হুঁকো টেনেছিলে?

ছেলেটা মাথা নেড়ে বললে, দুৎ। তার থেকে বিড়ি ভালো।

তোমার বাবা কি গাছে থাকেন?

দুৎ! থাকেন না, চড়েন। আমি অনেক তাগ করে থাকি, কিন্তু কক্ষনো পড়েন না!

তিনি কি প্যাচা?

দুৎ! তারপর ছেলেটা একটা কথা বললে যেটা মা একদম বলতে বারণ করেছেন। নেড়ু বললে ছি!– আচ্ছা, তাঁর পা কি উলটোবাগে লাগানো?

এবার ছেলেটা বেদম রেগে গেল। ভুরু কুঁচকে, ফেসফাস করতে লাগল, আর হাতটাকে ঘুসি পাকাতে আর খুলতে লাগল, যেন এই পেলেই সাবড়ে দেয়। তারপর কী ভেবে ঠান্ডা হয়ে বললে—

ওই যে মিস্ত্রিগুলো সারাদিন বাঁশের টঙে চড়ে তোমাদের বাড়ির বিশ্রী জানালাগুলোতে তোমার গায়ের রঙের মতন বদ সবুজ রং লাগায়, ওদের একটা দড়িবাঁধা রঙের টিন, আর একটা বড়ো চ্যাপটা রং লাগাবার জিনিস যদি আমাকে এক্ষুনি না এনে দাও তাহলে তোমাকে, তোমার বাবাকে, তোমার দাদাকে, আর তোমার মাকে কচুকাটা করব। তোমাদের ছোটো খুকিকে পানের মশলা বানিয়ে কড়কড়িয়ে চিবিয়ে খাব। তোমাদের মাসি-পিসি যে যেখানে আছে তাদের থেতলোকরব! তোমাদের রুটিওয়ালা, ঘিওয়ালা, আর যা যা তোমরা রাখ সব কটাকে লম্বা লম্বা ফালি করে ছিঁড়ে কাপড় শুকুবার দড়িতে ঝুলিয়ে শুঁটকি মাছ বানাব। আর তোমার যত বন্ধু আছে সবগুলোকে নুনজল দিয়ে কঁচা কাঁচা গিলে খাব।

বাপরে, কী হিংস্র খোকা!

নেড়ু তাড়াতাড়ি একটা টিন, আর দু-তিনটে বুরুশ তাকে দিয়ে এল। ছেলেটা ফ্যাচফ্যাচ করে। হাসতে হাসতে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

রাতে নেড়ু শুনতে পেল ফিসফিস করে কারা কথা বলছে। কানে আঙুল দিয়ে শুল, তবু মনে হল কে যেন বলছে–

আছে– আছে!
নিম গাছে!

নেড়ু ভাবলে, ওরে বাবা, কী আছে রে?– পান্তভূত? কবন্ধ? পিশাচ? স্কন্ধকাটা? গন্ধবেনে? শাঁখচুন্নি? পেতনি? প্যান্তাখেচি?

নেড়ু তো নাক-মুখ ঢেকে রাম ঘুম লাগ।

পরদিন সকালে নীচে যাবার সময় সিঁড়ির জানলা দিয়ে দেখে, রাস্তায় ওবাড়ির বড়ো কর্তা, এবাড়ির দরোয়ান, দাদা, বাবা, মন্টুর বাবা, দিনদা, আরও কত কে। সবাই ঠ্যাং হাত ছুঁড়ে বেজায় চাঁচাচ্ছে!

নেড়ু, আরও দেখল রাস্তার সব বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে সবুজ রং দিয়ে নানানরকম চিত্তির করা, পাশের বাড়ির সাদা গেটটা ডোরাকাটা!

হঠাৎ নেড়ুর চোখ দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবার জোগাড় করল– সেই হিংস্র ছানাটা পথের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে, তার এক হাতে রভের বুরুশ, আর-এক হাতে রঙের টিন, এক কান ওবাড়ির। দরোয়ান ধরেছে, আর-এক কান এবাড়ির লছমন সিং। আর ছেলেটা জোরসে চেল্লাচ্ছে।

তারপর ভঁকভঁক করে একটা মোটর ডাকল, আর পথ ছেড়ে সকলে চলে এলেন। লছমন সিংও কানে শেষ একটা প্যাঁচ দিয়ে খুব অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছেড়ে দিল। তারপর ওদের বাড়ির দরজায়ান ওর হাত থেকে খামচা মেরে রঙের টিন আর বুরুশ নিয়ে গেল, হিন্দিতে আর বাংলাতে বিড়বিড় কীসব বকতে বকতে, শুট মারতে মারতে ওদের বাড়ি দিয়ে গেল!

নেড়ু, পাড়াসুদ্ধ সক্কলের সাহস দেখে এমন হাঁ হয়ে গেল যে দেখতেই ভুলে গেল ছেলেটার পা উলটোবাগে লাগানো কি না!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *