বিগ্রহ এবং CL-X
ওরা আমাকে একটা ঘরের মেঝেয় মড়ার মতো চিৎ করে শুইয়ে রেখেছিল। চোখের বাঁধন খুলে দিয়েছিল। ঘুটঘুঁটে অন্ধকার ঘর। কিছুক্ষণ পরে আমার মাথার দিক থেকে একজন গলায় ছুরির ডগা ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলল, এই ব্যাটা! বাঁচতে যদি চাস, ওই ঘুঘু ব্যাটাচ্ছেলেকে একটা চিঠি লেখ।, বলব লিখবি। কৈ হে? কাগজ কলম দাও। দেরি করা যাবে না।
মাথার দিকে টর্চের আলো জ্বলল। পুরনো জরাজীর্ণ ঘর। পলেস্তারা খসে গেছে। এটা সেই সন্ধ্যানীড় নয় তো?
খসখস করে কাগজ ছেঁড়ার শব্দ হল। তারপর একজন আমাকে কাত করে হাতের বাঁধন খুলে দিল। আগের জন তেমনই ভুতুড়ে গলায় বলল, কিসের ওপর কাগজ ফেলে লিখবে? নোটবইটা দাও। ওটার ওপর লিখুক।
আমার চোখের সামনে ফুলহাতা সোয়েটার পরা একটা হাতে শ্যামসুন্দরের সেই কালো নেটবইটা এবং তারই একটা ঘেঁড়া পাতা দেখতে পেলাম। বুঝলাম, হরিবাবুর কাছ থেকে এরাই তা হলে নোটবইটা হাতিয়েছিল। গলায় ছুরির ডগা এবং মুখে টেপ সাঁটা। চুপ করে থাকা ছাড়া উপায় কী?
যা বলছি লেখ। কর্নেল নীলাদ্রি সরকার বরাবরেষু।
লিখলাম। হাতের লেখা জড়িয়ে যাচ্ছিল।
এবার লেখ। আপনি অত্র পত্রপাঠকপূর্বক মাল মুনলেক রোডের মোডে মাইল স্টোনের পিছনে রাখিয়া দিবেন। সাবধান! কাহাকেও জানাইবেন না। আমি বন্দী হইয়াছি। মাল পাইলে আমার প্রাণ বাঁচিবে। আপনি পুলিশ কিংবা নিজের জোরে হস্তক্ষেপ করিলে আমার গলা শ্যামসুন্দরের মতো ফাঁক হইয়া যাইবে। ইহারা নজর রাখিয়াছে। আমার প্রাণরক্ষা করুন। ইতি। নাম সই কর। হ্যাঁ– জয়ন্ত চৌধুরি।
অন্যজন ভুতুড়ে গলায় বলল, পুনশ্চ লেখাও। টাইম দিতে হবে না?
ঠিক, ঠিক। এই ব্যাটা! পুনশ্চ লেখ। রাত্রি দশটা পর্যন্ত সময়। দশটা বাজিয়া গেলেই আমার গলা ফাঁক। হুঁ। ফের সই কর। তারিখ লেখ। গুড! এই! এক্ষুণি চলে যাও। হিলটপের গেটের সামনে ঢিল চাপা দিয়ে রেখে এসো। সাবধান। গুঁড়ি মেরে ঝোঁপের মধ্যে এগোবে। বুঝেছ? তুমি ধরা পড়লে মাল পাব না। কিন্তু এ ব্যাটার গলা ফাঁক হবে এই যা!
শুনেই আমার মাথা ঘুরে উঠল। টর্চ ততক্ষণে নিভে গেছে। আবার আমাকে কাত করে হাত দুটো বাঁধল ওরা। ছুরির ডগা সরে গেল। অন্ধকারে একটা ছায়ামূর্তি দরজা ফাঁক করে বেরিয়ে গেল। দরজা আবার বন্ধ হল। মাথার কাছের লোকটা হুমকি দিল, নড়বে না। নড়লেই গলা ফাঁক। কারণ চিঠি তো লিখেই দিয়েছ। আর তুমি বাঁচলেই বা কী, মরলেই বা কী? তবে খামোকা এই শীতের রাত্তিরে ছুরি চালাতে ইচ্ছে করছে না। ইস! হাত দুটো ঠাণ্ডায় পাথর হয়ে গেছে। একটু আগুন জ্বেলে সেঁক দিতে পারলে হত। দেখা যাক।
এতক্ষণে গলাটা একটু চেনা মনে হল, যদিও ফিসফিস করে কথা বলছিল সে। হারাধন নাকি? কে জানে! চুপ করে পড়ে থাকাই ভাল। কর্নেলের পাল্লায় পড়ে এমন ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়, কিন্তু এবার যা বুঝছি, বাঁচার আশা কম। কারণ কর্নেল সহজে হার স্বীকার করতে চাইবেন না। দুর্ভাবনায় বুকের স্পন্দন বেড়ে গেল।
মাথার কাছের লোকটা ফস্ করে দেশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাল। যেন ইচ্ছে করেই আমার মুখের দিকে ধোঁয়া ছাড়ছিল সে। মুখে টেপ সাঁটা। কাশি আসছিল। কাশবার চেষ্টা করতেই আবার গলায় ছুরির ডগা। চুপ ব্যাটা! টু শব্দ করলেই জবাই করব।
সময় কাটছিল না। ফাঁসির আসামীদের মনের অবস্থা বুঝি এইরকমই হয়। শেষ পর্যন্ত হয়তো তারা আমার মতোই মরিয়া হয়ে ওঠে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণের জন্য।
কতক্ষণ–কতক্ষণ পরে বাইরে কোথাও দুবার কেউ শিস দিল। আমার মাথার কাছে বসে থাকা লোকটাও পাল্টা দুবার শিস দিল।
তারপর দরজা খুলে একটা ছায়ামূর্তি ঘরে ঢুকল এবং দরজা বন্ধ করল। টর্চের আলো জ্বলছিল। তাই সেই রাক্ষুসে মুখোশে ঢাকা মুখটা দেখতে পেয়েছিলাম। গায়ে ফুলহাতা বেঢপ নীলচে সোয়েটার। পরনে নোংরা প্যান্ট কাদায় বিচিত্তির।
টর্চ নিভে গেল। পেয়েছ? দিয়েছে ব্যাটা ঘুঘু?
হুঁঃ!
এদিকে নিয়ে এস। মালটা দেখি।
আমার নড়া বারণ। তবে টের পেলাম আমার মাথার দিকে টর্চ জ্বেলে ওরা। মাল পরীক্ষা করছে।
এটাই বটে তো?
হুঁউ। একই প্যাকেট। খুলে দেখে নিয়েছি। গয়নাটয়না সব আছে।
শ্যামা হারামজাদা ট্রেচারি না করলে মারা পড়ত না।
ছাড়ো! বেরুনো যাক।
শোনো! এই খুদে টিকটিকিটাকে বরং শেষ করে ফেলো।
না, না। খুনখারাপি করার রিস্ক আছে।
শ্যামার মতো ইদারায় বডি ফেলে দিলেই হবে। তারপর পাথর ফেলে ঢেকে দেব। শ্যামার বডি এখনও ইদারার তলায় আছে। টের পেয়েছে কেউ?
বোকামি হবে বুঝছ না কেন? বুড়ো টিকটিকিকে সেবার ফাঁকি দেওয়া কঠিন হয়নি। এ ব্যাটা ওর কাছের লোক। তাছাড়া রক্তটক্ত পড়ে থাকবে। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। ইদারায় জলও ছিল। এখন ইঁদারায় পাথর ভর্তি। রক্ত কিসে? চলো! এ ব্যাটা এমনিভাবে পড়ে থাক।
ওরা বেরিয়ে গেল। দরজা ভেজিয়ে দিয়েই গেল।
কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হলাম। হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা করলাম। দ্বিতীয় বারের বাঁধনটা আগের মতো মজবুত ছিল না। গিট টানাটানি করে কবজিতে ব্যথা ধরে গেল। তারপর অবশেষে খুলে গেল। এবার পায়ের বাঁধন খুলে ফেললাম। তারপর মুখের টেপ খুলতে সে এক যন্ত্রণা!
ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে সাবধানে পা বাড়িয়ে এবং টলতে টলতে দেওয়াল হাতড়ে দরজা পেলাম। আমার বরাত! দরজা ওরা বাইরে থেকে আটকে দিয়ে যায়নি।
হাতের যন্ত্রণা তেমন কিছু নয়। কিন্তু পায়ে খিল ধরে গেছে। বেরিয়ে গিয়ে বারান্দা পেলাম। এবার অন্ধকার কিছুটা স্বচ্ছ হয়ে উঠল। একটু পরেই জায়গাটা চিনতে পারলাম। সন্ধ্যানীড়ের একতলার একটা ঘরে ছিলাম।
কিন্তু বেরুনোর দরজা বন্ধ। অগত্যা উঠোনে নেমে গিয়ে পাঁচিল আঁকড়ে অনেক কষ্টে ওপরে উঠলাম। তারপর ঝাঁপ দিলাম। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলাম।
গাড়ির হেডলাইট লক্ষ্য করে বরমডিহি-জাহানাবাদ রোডে পৌঁছুলাম। তারপর উল্টোদিকে হিলটপ বাংলোর আলো চোখে পড়ল।
বাংলোর গেটে পৌঁছুতে কতক্ষণ সময় লেগেছিল জানি না। আমাকে দেখতে পেয়েছিল বৈজু। সে দৌড়ে এল। তারপর চাচামেচি শুরু করল, হুজুর। কর্নিলসাব! হুজুর। ছোটাসাব আয়া!
আশ্চর্য! কর্নেলের কোনও সাড়া পেলাম না। টলতে টলতে বারান্দায় উঠলাম। তারপর ঘরে ঢুকে দেখলাম, কর্নেল হেলান দিয়ে বসে চুরুট টানছেন।
উনি মুখ তুলে আমাকে দেখে একটু হাসলেন। আগে পোশাক বদলাও, ডার্লিং! বাথরুমে গরম জলে হাত-পা-মুখ ধুয়ে নাও! একেবারে পোডড়া বাড়ির ভূত হয়ে ফিরেছ। বলে হাঁক দিলেন, বৈজু! জলদি কফি লাও!
ক্ষোভে অভিমানে গুম হয়ে বাথরুমে গেলাম। একটু পরে পোশাক বদলে সোফায় বসলাম। কর্নেল চোখ বুজে চুরুট টানছিলেন। বৈজু এক পেয়ালা কফি রেখে গেছে। কফি পানের দরকার ছিল।
কর্নেল চোখ বুজেই বললেন, একটু রিস্ক ছিল তা অস্বীকার করছি না। তবে প্ল্যানমাফিক কাজ হয়েছে। তরুণবাবু যে ফাঁদ পেতেছিলেন, তা অনবদ্য। ওঁর সহযোগিতা না পেলে শ্যামবাবুর খুনীদের ধরার চান্স ছিল না। হ্যাঁ, খুনীরা এতক্ষণ অবশ্যই ধরা পড়ে গেছে। প্রতি মূহূর্তে আশা করছি, তরুণবাবুর গাড়ির হর্ন বেজে উঠবে।
এতক্ষণে মুখ খুলতে হল। আপনার সঙ্গে এই শেষ।
কর্নেল চোখ খুলে হাসলেন। শেষ কী জয়ন্ত? শুরু বলো!
আশ্চর্য! আপনি আমাকে একলা ফেলে রেখে—
কর্নেল আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, তরুণবাবুর প্ল্যান!
তার মানে?
তরুণবাবু গত রাত্রে আমাদের সঙ্গে ট্রেনেই এসেছেন। এ. সি. কামরায় ছিলেন। ওঁর জিপে আসানসোল হয়ে আসার ব্যাপারটা একটা চাল মাত্র। তাছাড়া আমার সঙ্গে পরামর্শেরও দরকার ছিল। কিন্তু তখনও আমি বিগ্রহ কোথায় আছে জানতাম না। আজ সকালে এখানে আসার পথে দৈবাৎ যখন বিগ্রহের সন্ধান পেলাম, তখন আবার নতুন প্ল্যান ছকতে হল। চলে গেলাম ওঁর কাছে। কথা মতো উনি উঠেছিলেন ওঁর এক বন্ধুর বাড়িতে। উনি বললেন, পুরো প্ল্যান সত্যি বদলানো দরকার। খুনীদের একবারে হাতেনাতে ধরতে হবে নইলে পুলিশ নিছক সন্দেহক্রমে ওদের ধরার ঝুঁকি নেবে না। আদালতে কিছু প্রমাণ করাও কঠিন হবে। শ্যামসুন্দরের লাশই তো পাওয়া যায়নি। ওদের হাতে যাওয়া দরকার। কিন্তু কী ভাবে তা ওদের হাতে যাবে? তখন তরুণবাবু বললেন, জয়ন্তবাবুকে কাজে লাগানো যাক। হাতার আগে বলা দরকার, বিগ্রহচোর শ্যামবাবুর খুনীদের একজন কলকাতাতেই তরুণবাবুর সঙ্গে ইদানীং ফোনে যোগাযোগ রাখত। সে বলত, বিগ্রহ উদ্ধার করতে পারলে তরুণবাবুকেই সে দেবে। তাকে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিতে হবে। তরুণবাবু প্রথমে রাজি হননি। পরে রাজি হন। কেন রাজি হন, বলছি। উনি ঠিক করেন, বিগ্রহ পেলে বেনামী চিঠি লিখে ওঁর দাদা শচীনবাবুকে জানাবেন, মামলা মিটমাট করে নিলে বিগ্রহ ফেরত পাবেন। আর মামলা মিটমাট করার মানে তরুণবাবুর মাকে মহেন্দ্রবাবুর বিবাহিতা স্ত্রী বলে স্বীকার করে নেওয়া। এখানেই তো তরুণবাবুর যত ক্ষোভ!
বললাম, কিন্তু আমাকে কাজে লাগানো ব্যাপারটা কী? কী বাঁচা বেঁচেছি, এখনও তো শোনার মর্জি নেই আপনার।
শুনবখন। আগে তুমি ব্যাকগ্রাউন্ডটা শুনে না। কাল দুপুরে তো তরুণবাবুর সঙ্গে আমার বরমডিহি আসার কথা হয়ে গেছে। বিকেলে সেই লোকটা ট্রাঙ্ককল করে তরুণবাবুকে জানায়, বিগ্রহ উদ্ধারের কাজ চলছে। তরুণবাবু যেন বরমডিহি চলে আসেন। সে তার সঙ্গে এখানে যোগাযোগ রাখবে। কিন্তু তরুণবাবু হিলটপে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছেন। তাই তাকে বলেন, তিনি বরমডিহি যেতি রাজি। রাতের ট্রেনেই যাবেন। তবে হিলটপে যোগাযোগ করার ঝুঁকি আছে। দৈবাৎ তার দাদা শচীনবাবুর কোনও বন্ধুর চোখে পড়ে গেলে ঝামেলা হবে। তার চেয়ে বরং তাঁর সঙ্গে সে যেন রেল স্টেশনেই যোগাযোগ করে। লোকটা বলে, তার পরনে থাকবে নীলচে সোয়েটার। মাথায় মাংকিক্যাপ। চোখে সানগ্লাস। মুখে দাড়ি। কর্নেল নিভে যাওয়া চুরুট জ্বেলে ফের বললেন, দুপুরে তরুণবাবুর কাছে গিয়ে শুনলাম দেখা হয়েছে। লোকটাকে খুব চেনা মনে হচ্ছিল। কিন্তু স্মরণ করতে পারেননি। সে ফিসফিস করে কথা বলছিল। বিগ্রহ উদ্ধারের কাজ নাকি পুরোদমে চলছে। উদ্ধার হলেই সে যোগাযোগ করবে। তবে তরুণবাবুর ঠিকানা তার জানা দরকার। তরুণবাবু তাকে তার বন্ধুর বাড়ি ঠিকানা দেন এবং দুটো নাগাদ সেখানে দেখা করে কাজ কত দূর এগোলো তা জানাতে বলেন। এটা তরুণবাবুর একটা আইডিয়া। কারণ লোকটার সঙ্গে আরও কথা বলা দরকার। কেন তাকে তার চেনা মনে হয়েছে, এই খটকা দুর করার ইচ্ছে ছিল। ইতিমধ্যে আমি গিয়ে সব জানালাম তাকে। তখন উনি বললেন লোকটা এলে তাকে এখানে আমার আসার কথা জানাবেন। আমিই যে বিগ্রহ উদ্ধার করেছি, তাও জানাবেন। আমার হাত থেকে বিগ্রহ উদ্ধারের ফন্দি বাতলাবেন। অর্থাৎ তোমাকে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে।
কর্নেল সকৌতুকে হাসলেন। লোকটা এই টোপ গিলবে কি না তরুণবাবুর অবশ্য সন্দেহ ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, সে টোপ গিলেছিল। এক সাঙ্যাতকে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল। বাইনোকুলারে দূর থেকে তোমার দুর্দশা দেখে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু কী আর করা যাবে? ওই সময় ওদের পুলিশ ধরলে বড় জোর একটা ছিনতাই কেট-টেস হত। তোমাকে কিডন্যাপ করার যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখানো যেত না। আবার বিগ্রহের প্রসঙ্গ তুললে বিগ্রহ রহস্য ফাঁস হয়ে যেত। শচীনবাবু নিশ্চয় এসে নাক গলাতেন। অনেক হ্যাঁপা ছিল না কি? তাঁর অলরেডি পুলিশের কাছে এ বিষয়ে ডায়েরি করা আছে।
এ-ও কম হ্যাঁপা গেল না আমার ওপর!
তা একটু থ্রিলিং অভিজ্ঞতা হল। মন্দ কী?
এইসময় বাইরে হর্ন বাজল। কর্নেল নড়ে বসলেন। একটু পরে বাংলোর পোর্টিকোতে গাড়ি থামার শব্দ হল। তারপর তরুণবাবু ঘরে ঢুকে ধপাস করে বসে বললেন, কর্নেল সায়েব। শেষ পর্যন্ত প্ল্যান ভেস্তে গেল! এতক্ষণ অপেক্ষা করেও বদমাসটা এল না। রাত সাড়ে এগারোটা বাজে। আর কী করা যাবে? বিগ্রহ হাতে পেয়েই কেটে পড়েছে! আমারই বোকামি হয়ে গেল।
কর্নেল হঠাৎ হা-হা করে হেসে উঠলেন।
তরুণবাবু ভুরু কুঁচকে বললেন, হাসছেন যে?
ওটা নকল বিগ্রহ মিঃ মুখার্জি।
নকল? সে কী!।
হ্যাঁ। হরিবাবুর বাসায় আপনাদের গৃহদেবতার ছবি দেখে আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছিল। জয়ন্ত যেদিন ওয়ার্ডগেম নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিল, সেইদিন ও বাড়ি যাওয়ার পর আমি বৈষ্ণবদের আরাধ্য রাধাকৃষ্ণের প্রাচীন বিগ্রহ সংক্রান্ত বই পড়ছিলাম। ষোড়শ শতকে একই ছাদের বিগ্রহ তৈরি হত। সেই রাত্রে আমার স্নেহভাজন এক ভাস্করকে ফোনে ডেকে পাঠাই। তাকে একটি বিগ্রহ পরদিন তৈরি করে দিতে বলি। সাধারণ কালো পাথরের বিগ্রহ তৈরি করে নকল অলঙ্কারে সাজিয়ে দিয়েছিল সে। আমার স্মৃতি প্রখর। কী কী অলঙ্কার আপনাদের বিগ্রহে ছিল, আমার মনে স্পষ্ট। কাজেই নকল প্রাচীন শৈলীর বিগ্রহ তৈরিতে অসুবিধে হয়নি। অবশ্য তখনও জানতাম না, কেন এটা করলাম। হয়তো ভেবেছিলাম, এটা কোনও কাজে লাগতেও পারে। তবে–নাহ। সঠিক জানি না। ইনটুইশন বলতেও পারেন!
তরুণবাবু শুনছিলেন অবাক হয়ে। আবার বললেন, তা হলে ওটা নকল বিগ্রহ?
আমি বললাম, খুনী দুটো বলছিল, একই প্যাকেটে মোড়া আছে। প্যাকেট পেলেন কোথায়?
কর্নেল বললেন, হ্যাঁ। প্যাকেটটা একই। যে প্যাকেটে শচীন্দ্রলাল মুখার্জি–
তরুণবাবু তার কথার ওপর বললেন, আগে বলুন, আসলটা কি সত্যিই আপনার কাছে আছে?
আছে। দেখাচ্ছি। তার আগে বলি, কীভাবে ওটার খোঁজ পেলাম। বলে কর্নেল ঘড়ি দেখলেন। সংক্ষেপেই বলি। শ্যামসুন্দরের নোটবইয়ের ওয়ার্ডগেম গ্র্যাব, রেয়ার, আর্টস, বেস্ট শব্দছকের কথা আজ দুপুরে আপনাকে বলেছিলাম। জয়ন্ত অক্ষরগুলো সংখ্যায় রূপান্তরিত করে টোটাল ফিগার ১৬০ দেখিয়েছিল। জয়ন্ত ইজ রাইট। এই সংখ্যাটা সত্যিই একটা সংকেত। এটাকে রোমানসংখ্যায় দেখলে হবে [ ঈ অর্থাৎ সি ১০০, এল ৫০ এবং এক্স ১০। তো আজ সকালে কুয়াশার মধ্যে ট্রাক ড্রাইভার আমাদের মুনলেক রোডের মোড়ে নামিয়ে দিয়েছিল। জঙ্গল এবং পাথরে ভর্তি চড়াই ভেঙে শর্টকাটে আসার সময় জয়ন্ত একখানে হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিল। ওকে টেনে তুলতে গিয়ে একটা পাথর চোখে পড়ল। পাথরটা ছোট্ট একটা মাইলস্টোনের মতো মাটিতে পোঁতা ছিল। ঘাসের মধ্যে ইঞ্চি ছয়েক বেরিয়েছিল। ওতেই হোঁচট খেয়েছিল জয়ন্ত। চমকে গেলাম। পাথরটায় খোদাই করা আছে [ ঈ!ৈ সন্দেহ চেপে রাখলাম তখনকার মতে। দুপুরে আপনার সঙ্গে দেখা করে ফেরার সময় পাথরটা টানাটানি করে উপড়ে ফেললাম। এ আমার পক্ষে সহজ কাজ। তলায় নাইলনের দড়িতে বাঁধা পলিথিন পেপারে মোড়া একটা প্যাকেট ছিল। টেনে তুললাম। বাঁধন খুলে পলিথিন পেপারের মোড়ক ছাড়িয়ে আরও একটা মোড়ক দেখলাম। সেটা শক্ত খাকি রঙের প্যাকিং পেপার। ব্যস! বেরিয়ে পড়ল রাধাকৃষ্ণের যুগল বিগ্রহ। ছোট্ট বিগ্রহ। ৯ ইঞ্চি বাই ৬ ইঞ্চি সাইজ। তবে গয়নাগুলো নেই। শ্যামসুন্দর রত্নের লোভ সামলাতে পারেনি। বেচে দিয়েছিল নিশ্চয়।
বলে কর্নেল তার স্যুটকেস খুলে সাদা পলিথিন পেপারে মোড়া বিগ্রহ বের করলেন। মোড়ক খুলতেই কষ্টিপাথরের তৈরি রাধাকৃষ্ণের প্রাচীন বিগ্রহ বেরিয়ে পড়ল। তরুণবাবু গৃহদেবতাকে দুহাতে তুলে মাথায় ঠেকিয়ে তারপর টেবিলে রাখলেন। তারপর মৃদুস্বরে বললেন, অক্টোবর মাসে শ্যাম টেলিফোনে আমার সঙ্গে এখানে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিল। এত বছর গা ঢাকা দিয়ে থাকার পর হঠাৎ তার ফোন এবং হারানো গৃহদেবতা উদ্ধারের গল্প! স্বাভাবিকভাবে আমি আগ্রহ দেখিয়েছিলাম। কিন্তু সে এসে এক লক্ষ টাকা ক্যাশ দাবি করল। তার স্পর্ধা দেখে রাগ হয়েছিল। উপরন্তু সে হুমকি দিতে শুরু করল। দাদাকে সে জানিয়ে দেবে আমিই বিগ্রহ চুরি করেছিলাম তাকে দিয়ে। সেই বিগ্রহ কোথায় আমি লুকিয়ে রেখেছি, তা-ও নাকি জানিয়ে দেবে। দাদা নাকি বরমডিহিতে এসেছেন এবং এক বন্ধুর বাড়িতে আছে। বুঝুন তাহলে! আমার মনে হল এটা ব্ল্যাকমেল করার শামিল। আমি ওকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম।
কর্নেল একটু হেসে বললেন, শ্যামসুন্দর এর পর আপনার দাদার কাছে গিয়ে ফাঁদে পড়েছিল। সেদিন ২৫ অক্টোবর। তবে এটা ঠিক, শচীনবাবু খুনখারাপি চাননি। ওঁর অত্যুৎসাহী সাঙ্গোপাঙ্গ ওকে খুন করে ওর পকেট হাতড়ে কালো একটা নোটবই পেয়েছিল মাত্র। যাই হোক, রাত হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়া যাক। আপনি কি এখানে থাকবেন, নাকি বন্ধুর বাড়ি ফিরে যাবেন?
তরুণবাবু বললেন, নাহ্। আমি ব্রতীনের কাছে বিদায় নিয়ে এসেছি। গাড়িটা নিতে সকালে ওর ড্রাইভার আসবে।