পাঞ্জাব মেল
পাঞ্জাব মেল মোগলসরাই স্টেশন সবে ছেড়েছে, এমন সময় ফার্স্ট ক্লাস কামরায় এক ভদ্রমহিলা আর্তনাদ করে উঠলেন, “আমার হারটা! ওগো, আমার হারটা যে ছিঁড়ে নিয়ে গেল! কী হবে!”
ভদ্রমহিলার স্বামী মাঝবয়সী নাদুস-নুদুস ভিতু চেহারার একজন লোক। তিনি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললেন, “নিয়ে গেল! অ্যাাঁ! কী সর্বনাশ! সোনার ভরি যে এখন প্রায় দু হাজার টাকা যাচ্ছে! চেন টানো! চেন টানো!”
উল্টোদিকে জানালার কাছ ঘেঁষে একজন লম্বাচওড়া যুবক চুপচাপ বসে ছিল এতক্ষণ। ঠিক চুপচাপ নয়, মাঝে-মাঝে সে একটা অদ্ভুত সুরে শিস দিচ্ছিন। যুবকটি ছ ফুটের ওপর লম্বা, দারুণ স্বাস্থ্য এবং দেখতে ভীষণ রকম সুপুরুষ। সে একটা খবরের কাগজ পড়ার চেষ্টা করছে আর আড়ে-আড়ে দেখছে সবাইকে।
মাঝবয়সী ভদ্রলোক চেন টানার জন্য হাত বাড়িয়েছিলেন, যুবকটি হঠাৎ বলল, “গাড়ি থামালেও কি জিনিসটা পাবেন?”
লোকটা থমকে গিয়ে ইতস্তত করে বলে, “তা পাব না ঠিকই। বরং আড়াইশো টাকা জরিমানা গুনতে হবে। জেলটেলও হতে পারে। কিন্তু কিছু তো করতে হবে।”
যুবকটি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “ট্রেন থামালে আমার অসুবিধা হবে। আমি একটা জরুরি কাজে যাচ্ছি। তার চেয়ে ট্রেনটা চলুক, হার আমি এনে দিচ্ছি।”
“আপনি এনে দেবেন! বলেন কী? ট্রেন এখন স্পিড দিয়ে। দিয়েছে যে!”
“কোনও চিন্তা নেই।” বলেই যুবকটি করিডোরে বেরিয়ে গেল। তারপর দরজা খুলে প্রায় চল্লিশ মাইল বেগের ট্রেন থেকে অনায়াসে নেমে গেল। ভদ্রলোক ভদ্রমহিলা আর একজন অবাঙালি যাত্রী ভয়ে কাঠ হয়ে জানালা দিয়ে চেয়েছিলেন। ছেলেটা হাড়গোড় ভেঙে দ হয়ে গেল নাকি!
কিন্তু ঠিক দশ মিনিটের মাথায় দেখা গেল, ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে একটি লোক লাইনের ধার ধরে দৌড়ে আসছে। ট্রেনের গতি আরও বেড়েছে। বোধহয় ঘণ্টায় ষাট মাইল। কিন্তু লোকটা অনায়াসে কামরাগুলোকে পিছনে ফেলে ফার্স্ট ক্লাসের দরজার হ্যান্ডেল ধরে লাফিয়ে উঠে পড়ল। কামরায় ঢুকে একমুখ হেসে হারটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “লোকটা বেশি দূর যেতে পারেনি। নদীর ওপর একটা ব্রিজ আছে, সেখানে একটা ঘোড়ায় টানা গাড়িতে বসে যাচ্ছিল। নিন।”
ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা এবং কামরার আর একজন অবাঙালি যাত্রী এত অবাক হয়ে গেলেন যে, কথা বলতে পারলেন না।
যুবকটি অবশ্য কিছুই তেমন গ্রাহ্য করল না। একটু হাঁফাচ্ছিলও না সে। ফের নিজের জায়গায় বসে সেই অদ্ভুত সুরে শিস দিতে লাগল।
রাত একটু গম্ভীর হল। সহযাত্রীরা বিছানা-টিছানা পাতছে। এমন সময় আচমকা কামরার দরজাটা দড়াম করে খুলে চার-পাঁচজন ভয়ংকর চেহারার লোক ঢুকল। হাতে রিভলভার, ছোরা, স্টেনগান।
ঢুকেই তারা হিন্দিতে ধমক দিয়ে বলল, “কেউ নড়বে না, চেঁচাবে না। একদম জানে মেরে দেব।”
সকলেই হতভম্ব, ভয়ে হাত পা কাঁপছে। শুধু যুবকটি একটু অবাক হয়ে মাঝবয়সী ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে, “এরা কারা? এরকম করছে কেন?”
“বুঝছেন না মশাই!” ভদ্রলোক কাঁপতে কাঁপতে বলেন, “ডাকাত!”
“ডাকাত! সে আবার কী?”
“মেরেধরে কেড়েকুড়ে নেবে সব। যা আছে দিয়ে দিন যদি প্রাণে বাঁচতে চান।”
যুবকটি খুব অবাক ভাবে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ডাকাতদের দিকে। ডাকাতরা তখন উদ্দাম উল্লাসে ভদ্রমহিলার হাত থেকে চুড়ি খুলবার চেষ্টা করছে, বাক্স ভাঙছে।
যুবকটি উঠে একজন ডাকাতকে একটা চড় মারতেই সে ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ আর একজন ডাকাত যুবকটির বুকে নল ঠেকিয়ে পিস্তলের ঘোড়া টানল। আর একজন হাতের ছোরা খচ করে বসিয়ে দিল যুবকের পেটে।
যে কারও এতে সঙ্গে সঙ্গে পড়ে মরে যাওয়ার কথা। কিন্তু সকলে অবাক হয়ে দেখে, পিস্তলের গুলিটা ছিটকে গেল তার বুকে ধাক্কা খেয়ে। ছোরার ডগাটা ভেঙে পড়ে গেল মেঝেয়। পরের কয়েক সেকেন্ড সময় কাটল শুধু একতরফা মারে। পাঁচজন ডাকাত পাঁচ সেকেণ্ডে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মেঝেয়। যুবকটি তাদের দেহ একসঙ্গে দু বগলে তুলে নিয়ে করিডরের এককোণে রেখে এসে ফের সেই অদ্ভুত শিস দিতে লাগল।
মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর থাকতে পারলেন না। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কে বলুন তো!”
যুবকটি হেসে বলে, “আমার নাম রামচন্দ্র রাহা।”
“থাকেন কোথায়?”
“একটু দূরে।”
“যাচ্ছেন কোথায়?”
রাম কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি একটা জিনিস খুঁজে বেড়াচ্ছি। কিন্তু সেটা যে ঠিক কোথায় আছে, সেটাই ধরা যাচ্ছে না।”
এইসব রহস্যময় কথাবার্তা শুনে ভদ্রলোক আর দ্বিরুক্তি করলেন না।
সকলে বিছানা-টিছানা পেতে শুয়ে পড়তেই রামচন্দ্র তার শিসের সুর পাল্টে ফেলল। এবার যে সুরটা সে বাজাচ্ছিল, সেটা বড় মাদকতাময়। শুনতে শুনতে ঝিম ধরে যায়, ঘুম পেয়ে যায়।
অল্প সময়ের মধ্যেই তিনজন সহযাত্রী গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল। রামচন্দ্র তার পকেট থেকে একটা চৌকোনো যন্ত্র বের করে নানারকম সুইচ আর নব টিপে এবং ঘুরিয়ে কী যেন দেখল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “র্যাডাক্যালি! র্যাডাক্যালি!”
আবার কিছুক্ষণ যন্ত্রটা নাড়াচাড়া করল সে। তারপর বিষণ্ণভাবে মাথা নেড়ে আপনমনে বলল, “হিমালয়! হিমালয়!”
একটা জংশন স্টেশনে গাড়ি দাঁড়াতেই রামচন্দ্র তার স্যুটকেসটা নিয়ে নেমে পড়ল।
কাজি আচমকা বলে উঠল, “শোনো লাটু! রামরাহা আসছে।”
“আসছে!” লাটু মাঝরাতে ঘুম ভেঙে তড়াক করে উঠে বসে।
কাজি বলে, “আসছে বটে। তবে আমি তাকে একটু দিকভ্রান্ত করে দিতে পেরেছি। সে আমার অবস্থান বুঝতে পারছে না। কলকাতার দিকে আসতে আসতে সে তাই মাঝপথে এক জায়গায় নেমে পড়েছে।”
“এরপর রামরাহা কী করবে?”
“খুব সম্ভব সে হিমালয়ের দিকে যাবে। আমি তাকে ওই দিকেই যেতে বাধ্য করেছি। তবে ভুলটা ধরা পড়তে তার বেশিক্ষণ লাগবে না।”
লাটু শিউরে উঠে চোখ বোজে। তারপর খুব ক্ষীণ গলায় জিজ্ঞেস করে, “কাজি, রামরাহা লোকটা কি খুবই ভয়ংকর?”
কাজি একটু চুপ করে থেকে বলে, “হ্যাঁ, শত্রু হিসেবে ভয়ংকর।”
“সে কি তোমার জন্য আমাদের খুন আর পৃথিবী ধ্বংস করবে?”
কাজি আবার একটু চুপ করে থেকে ধীর স্বরে বলল, “ইচ্ছে করলে সে পারে।”
লাটু হাল ছেড়ে ফের ইজিচেয়ারে শুয়ে পড়ল।
কাজি বলল, “রামরাহা এখন কোথায় জানো?”
“না। বলো তো কোথায়?”
“একটা শহর ছেড়ে সে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে হাঁটছে। সামনেই খাড়া পাহাড় এবং গিরিপথ। তারপরই তুষাররাজ্য। রামরাহা ভ্রূকুটি করছে, ঠোঁট কামড়াচ্ছে, সন্দেহ দেখা দিয়েছে তার মনে। সে ট্রেসার যন্ত্র বের করে আবার কিছু দেখে নিচ্ছে… না, সে এগিয়ে যাচ্ছে।..আপাতত কিছুক্ষণ নিশ্চিন্ত।”
রামচন্দ্র রাহা নামক সেই যুবকটি অত্যন্ত সংকীর্ণ একটা গিরিপথ দিয়ে এগোচ্ছিল। বাঁয়ে খাড়া পাহাড়ের দেয়াল, ডাইনে অতলগভীর খাদ। রাস্তা ভাঙা, এবড়োখেবড়ো, ভাল করে পা রাখার জায়গা নেই, তার ওপর বড্ড খাড়াই।
কিন্তু রামচন্দ্রের হাঁটা দেখে মনে হয়, তার বিশেষ কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। বেশ লঘু দ্রুত পায়ে সে এগিয়ে যাচ্ছে।
পাকদণ্ডির শেষ। সামনে একটা মস্ত উপত্যকা। পুরোটা পুরু বরফে ঢেকে আছে। শোঁ শোঁ করে তুষারঝড় বয়ে যাচ্ছে তার ওপর দিয়ে। আকাশ কালো, কিছুই ভাল দেখা যায় না। তাপাঙ্ক শূন্যের পনেরো-কুড়ি ডিগ্রি নীচে নেমে গেছে।
রামচন্দ্রের পরনে শুধু পাতলা কাপড়ের একটা স্যুট। শীত সে টেরই পাচ্ছে না। উপত্যকার দিকে চেয়ে সে এক অদ্ভুত সুরে শিস দিয়েই যাচ্ছে। একবার সে ক্যালকুলেটরের মতো যন্ত্রটার দিকে তাকাল। দুটো একটু কোঁচকাল।
উপত্যকায় নামবার কোনও পথ নেই। রামচন্দ্র রাহা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক তার সামনেই গভীর খাদ। প্রায় তিন হাজার ফুট নীচে তুষারক্ষেত্র। রামচন্দ্র রাহা শিস দিতে দিতেই সেই খাদের ধারে এসে দাঁড়াল। চারদিকে একটু চেয়ে দেখল সে। তারপর লাফিয়ে পড়ল নীচে।
তিন হাজার ফুট তো সোজা নয়। রামচন্দ্র রাহার ওপর থেকে নীচে পড়তে অনেকটা সময় লাগল। পড়তে-পড়তেই সে সেই অদ্ভুত সুরে শিস দিয়ে যাচ্ছিল।
নীচে নরম তুষার। তবু তিন হাজার ফুট ওপর থেকে পড়লে যে-কোনও মানুষেরই মাঝপথেই দম আটকে মরার কথা এবং শরীরটা একদম ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা। রামচন্দ্র রাহার অবশ্য কিছুই হল না। তুষারের ওপর বেড়ালের মতো হালকাভাবে নামল সে, এবং ছোট্ট যন্ত্রটায় কী একটা দেখে নিয়ে এগোতে লাগল উত্তরের দিকে। যেদিকে আরও ঘোর গহিন তুষারের রাজ্য। মস্ত উঁচু দুর্গম সব মহাপর্বত। কীটপতঙ্গ, জনমানুষ, পশুপাখি কিছু নেই। শুধু সাদা তুষারের মরুভূমি। অবিরল হুহু করে ঝোড়ো বাতাস বইছে। রাশি রাশি পাতার মতো আকাশ থেকে নেমে আসছে তুষার। এত শীত যে, রক্ত জমাট বেঁধে যায়, হাত পা অসাড় হয়ে আসে। বাতাসে অক্সিজেন এত কম যে, দম নিতে কষ্ট হয়।
শিস দিতে দিতে প্যান্টের দু পকেটে দুটো হাত ভরে রামচন্দ্র রাহা একটা গিরিশিরা বেয়ে পিছল বরফের ওপর দিয়ে ওপরে উঠতে লাগল। এ পথ এত সরু যে, কোনওরকমে একটা পায়ের পাতা রাখা যায়। এত খাড়া যে, বরফ কাটার কুড়ল, পিটন এবং দড়ির অবলম্বন ছাড়া এ-পথ দিয়ে কোনও মানুষের পক্ষেই ওঠা সম্ভব নয়। ঝড়ের গতি এত বেশি যে, উড়িয়ে নিয়ে যেতে পারে।
সামনেই দুটো বিশাল চেহারার তুষারশুভ্র মূর্তি। ভালুক নয়, আবার মানুষও নয়। স্থির হয়ে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের দৃষ্টিতে আদিম হিংস্রতা। বড় বড় সাদা লোমে ঢাক শরীর। কিংবদন্তীর ইয়েতি।
রামচন্দ্র রাহা এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল। তারপর হাসল। ছোট্ট যন্ত্রটা বের করে সে নিজের ভাষায় বলল, “সুপ্রভাত। আমি তোমাদের দেশে একজন অচেনা বিদেশী অতিথি।”
যন্ত্রটার ভিতর দিয়ে রামচন্দ্র রাহার এই কথাগুলো কয়েকটা অচেনা শব্দ হয়ে বেরোল। কিন্তু ইয়েতি দুজন পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। অর্থাৎ তারা কথাগুলো বুঝতে পেরেছে।
রামচন্দ্র ফের জিজ্ঞেস করল, “আমি সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টা খুঁজছি। তোমরা দেখিয়ে দিতে পারো?”
ইয়েতিরা মাথা নাড়ল। দুজনেই হাত তুলে ওপরটা দেখাল। একটু অদ্ভুত শব্দ করল, “উমম! উমম্!”
যন্ত্রের ভিতর দিয়ে রামচন্দ্র রাহা শুনল, “ঐ যে! ঐ যে!” ইয়েতিরা পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। রামচন্দ্র রাহা পৃথিবীর সব থেকে উঁচু গিরিশৃঙ্গ এভারেস্টে উঠতে থাকে। শিস দিতে দিতে, পকেটে হাত ভরে।
দৃশ্যটা গর্ডন সাহেবের ওয়ার্কশপে বসে কাজির পর্দায় দেখতে পাচ্ছিল লাটু। সুপারম্যান, টারজান, ম্যানড্রেক : কাছে ছেলেমানুষ। যত সে দেখে, তত সম্মোহিত হয়ে যেতে থাকে।
কাজি প্রশ্ন করে, “রামরাহাকে কী রকম মনে হচ্ছে তোমার?”
“দারুণ।”
“ওর সঙ্গেই তোমার লড়াই কিন্তু। খ্রাচ খ্রাচের কথা ভুলে যেও না।”
এ-কথা শুনে কেন কে জানে লাটুর মনটা একটু খারাপ হয়ে। গেল।
কাজির পর্দায় তখন এভারেস্টে আরোহণকারী দুজন অভিযাত্রীকে দেখা যাচ্ছিল। পর্বতারোহীর পোশাক, অক্সিজেন সিলিন্ডার, কুড়ল, পিটনে সজ্জিত দুজন মানুষ অত্যন্ত ধীর গতিতে ওপরে উঠছিল। আচমকাই প্রথমজনের বরফে গাঁথা পিটনটা খসে যাওয়ায় সে পিছলে পড়ে যেতে লাগল নীচে। নীচে মানে অনেক নীচে। কয়েক হাজার ফুট।
লাটু ভয়ে চোখ বুজে ফেলে চেঁচিয়ে উঠল, “গেল গেল!” কিন্তু না। চোখ খুলে লাটু দেখল ঠিক সময়ে কখন রামরাহ। পথচ্যুত অভিযাত্রীর তলায় এসে দাঁড়িয়েছে। দুটো বিশাল হাতে সে বলের মতো লুফে নিল লোকটাকে। তারপর অনায়াসে তাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে ফের গিরিশিরায় উঠে এসে যথাস্থানে নামিয়ে দিল। ফের পকেটে হাত ভরে এক উদাস সুরে শিস দিতে দিতে সে উঠে এল এভারেস্টের চূড়ায়।
লাটু মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখল, রামরাহা এভারেস্টের চূড়ায় উঠে আকাশের দিকে হাত বাড়াতেই তার সুটকেসটা কোন শূন্য থেকে ভাসতে ভাসতে নেমে এল। তিনটে ঠ্যাং বেরিয়ে এল সুটকেস থেকে। সেই তিন পায়ের ওপর সেটা স্থির হয়ে দাঁড়াল। রামরাহা একটা সুইচ টিপল স্যুটকেসের গায়ে।
কাজি ফিসফিস করে বলল, “লাটু, একটুও শব্দ কোরো না। রামরাহা তার বিমার চালু করেছে। একটু শব্দ হলেও সে টের পেয়ে যাবে।”
লাটু ভয়ে দম বন্ধ করে রইল।
আচমকাই সে কাজির ভিতর থেকে রামরাহার অদ্ভুত গম্ভীর গভীর কণ্ঠস্বর শুনতে পায়।
“রাডাক্যালি, আমি তোমার আবিষ্কর্তা, আমি তোমার স্রষ্টা। কেন ধরা দিচ্ছ না র্যাড়াক্যালি? কেন আবরণী রশ্মি দিয়ে ঢেকে রেখেছ নিজেকে? তোমার ক্ষমতা অসীম। তুমি আকাশের সমস্ত গ্রহনক্ষত্রকে কক্ষচ্যুত করে দিতে পারো, সমস্ত কসমিক প্যাটার্নকে পাল্টে দিতে পারো তুমি। এ গ্রহের নাবালকেরা তোমাকে ভুলভাবে ব্যবহার করলে কত সর্বনাশ ঘটে যেতে পারে রাডাক্যালি! খ্রাচ খ্রাচ তোমাকে পেলে ব্যবহার করবে দাসত্বের কাজে। তোমার সত্যিকারের সদ্ব্যবহার জানে একটিমাত্র তোক। সে তোমার আবিষ্কতা এই আমি। ধরা দাও র্যাড়াক্যালি। আর সময় নেই।”
সেই গলার স্বর শুনে লাটুর সারা শরীরের রোমকূপ শিউরে ওঠে। বুকের ভিতরটা কেমন করতে থাকে। সে হঠাৎ সব ভুলে বলে ওঠে, “কাজি! রাডাক্যালি কে?”
পর্দায় রামরাহ হঠাৎ চমকে ওঠে। তারপর খুব দ্রুত হাতে একটা নব ঘোরাতে থাকে।
কাজি হতাশ গলায় বলে, “ছিঃ, লাটু! একটু সংযম নেই তোমার! আমি ধরা পড়ে গেলাম। ওই দ্যাখো, রামরাহা তার যন্ত্র গুটিয়ে নিচ্ছে। আর উপায় নেই।”
লাটু লজ্জায় ভয়ে কাঠ হয়ে গেল।
কাজি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “রাডাক্যালি আমারই নাম। রামরাহা আমাকে উদ্দেশ করেই কথাগুলো বলছিল।”
খুব সংকোচের সঙ্গে লাটু জিজ্ঞাসা করে “রামরাহাই কি তোমাকে আবিষ্কার করেছিল?”
“হ্যাঁ, লাটু।”
“তবে কেন তুমি ওর কাছে ধরা দিতে চাও না? রামরাহা তো দারুণ লোক।”
“ধরা দেওয়া সম্ভব নয় লাটু। খ্রাচ খ্রাচ আমাকে প্রি-প্ল্যানড করে রেখেছে। শত হলেও আমি যন্ত্র, আমাকে যান্ত্রিক নিয়মেই চলতে হয়। আমি কারও প্রতি পক্ষপাত পোষণ করতে পারি না। প্রয়োজন হলে তোমার সাহায্যে আমি রামরাহাকে মেরে ফেলব। হয়তো সেটাই একমাত্র পন্থা।”
“মেরে ফেলবে?”
লাটু খুব দুঃখের সঙ্গে বলল। তারপর অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলে, “আমার সাহায্যে কেন কাজি?”
“ওই যে বললাম, শত হলেও আমি যন্ত্র। কেউ না চালালে আমার পক্ষে চলা শক্ত। এখন একটা কাজ করো। ব্যান্ডের কাছে একটা আলপিনের মাথার মতো ছোট্ট বোম আছে। নখের ডগা দিয়ে সেটা খুব জোরে চেপে ধরো।”
লাটু বোতামটা খুঁজে পেয়ে নখ দিয়ে চেপে ধরল। ভিতরে ক্লিক করে একটা শব্দ হল মাত্র।
কাজি বলল, “এবার শোনো। রামরাহা আমার সন্ধান পেয়ে গেছে। কিন্তু সে তাড়াহুড়ো করবে না। তার কাছে এমন যন্ত্র আছে যার সাহায্যে সে চোখের পলকে এখানে পৌঁছে যেতে পারে। কিন্তু সেটা হঠকারীর মতো কাজ হবে। সে জানে আমি আত্মরক্ষার কৌশল জানি। তা ছাড়া সে ওইসব অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করলে তোমাদের এই গ্রহের সাংঘাতিক ক্ষতি হতে পারে। রামরাহা সুতরাং সেগুলো ব্যবহার করবে না। সে বাস, ট্রেন ইত্যাদি যানবাহন ব্যবহার করবে। এখানে আসতে আমার হিসেবে রামরাহার সময় লাগবে আরও দু’দিন। ততক্ষণে খ্রাচ খ্রাচ পৌঁছে যাবে। আমাকে রেখে দাও সামনের টেবিলে। এই দুটো দিন তুমি চুপচাপ বসে থাকো। আমাকে ভুলেও স্পর্শ কোরো না। আমার কাছেও এসো না।”
“কেন কাজি?”
“তুমি কাল সকালে দেখতে পাবে সামনের টেবিলে হুবহু আমার মতো দেখতে দুটো কাজি রয়েছে। তোমার বাঁ দিকে থাকব সত্যিকারের আমি, ডান দিকে থাকবে প্রতিবস্তুতে তৈরি আমার দোসর। রামরাহা যদি এসেই পড়ে তাহলে তুমি বাঁ দিক থেকে আসল আমাকে সাবধানে সরিয়ে নিয়ে বাইরের জঙ্গলে ফেলে দিও। খবর্দার, ডানদিকেরটায় হাত দিও না। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে মারা পড়বে। রামরাহা প্রতিবস্তুতে তৈরি আমাকে স্পর্শ করা মাত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশ্য সেইসঙ্গে আমিও। এটাই অন্তিম উপায়।”
লাটু খুব ভয়ে ভয়ে কাজিকে টেবিলের ওপর রেখে দিল। কাজির ভিতরে বিচিত্র শব্দ উঠছিল। যেন কেউ খুব যন্ত্রণা পাচ্ছে, মর্মন্তুদ ব্যথা বেদনায় নানারকম শব্দ করছে।
এই কয়দিনে লাটু কাজিকে বড় ভালবেসে ফেলেছে। করুণ মুখে সে জিজ্ঞেস করল, “তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে কাজি?”
“ভীষণ। মৃত্যুর আগে মানুষের এরকম যন্ত্রণা হয়।”
“কেন যন্ত্রণা হচ্ছে কাজি?”
“প্রতিবস্তুতে নিজের প্রতিকৃতি তৈরি করার মানে হল নিজের মৃত্যুর পথ পরিষ্কার করা। তুমি ঠিক বুঝবে না। আমার ভিতরে অণু ও পরমাণুর দুরকম চলন তৈরি হচ্ছে। একটা চলন আর-একটা চলনের ঠিক উল্টো। বড় কষ্ট।”
“রামরাহা কীরকম মানুষ কাজি?”
“সে আমার শত্রু।”
“খ্রাচ খ্রাচ কীরকম মানুষ কাজি?”
“সে আমার প্রভু।”
লাটু চুপচাপ বসে ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখল, টেবিলের ওপর পাশাপাশি দুটো কাজি পড়ে আছে।
হাত বাড়িয়ে বাঁ দিকের কাজিকে হাতে তুলে নেয় লাটু। “কাজি! কেমন আছ?” জবাব নেই। “কাজি! কথা বলছ না কেন?”
আচমকা টেবিলের ওপর থেকে প্রতিবস্তুতে তৈরি কাজি বলে উঠল, “ও কাজি মরে গেছে লাটু। ওকে বিরক্ত কোরো না।”
লাটু সভয়ে ডানদিকের কাজির দিকে চেয়ে রইল। তারপর ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করল, “তুমি কি প্রতিবস্তুতে তৈরি কাজি?”
“হ্যাঁ, লাটু। আমাকে ভুলেও ছুঁয়ো না।”
“তুমি আর আগের মতো আমার বন্ধু নও?”
“না, লাটু। তবে আমি তোমার ক্ষতিও করব না। কাজি আমাকে প্রি-সেট করে রেখেছে। আমাকে না চুলে তোমার ভয় নেই।”
লাটু একটু ভেবে নিয়ে বলে, “রামরাহা কি ধরতে পারবে না যে, তুমি আসল কাজি নও! তার বুদ্ধি তো সাংঘাতিক।”
“না লাটু, আমাকে স্পর্শ করার আগে আমি আসল না প্রতিবস্তু তা বোঝার কোনও উপায় নেই। আর স্পর্শ করার পর বুঝলেও লাভ নেই।”
কাজিকে দু হাতের আঁজলায় ধরে চেয়ে থাকে লাটু। দুঃখে তার চোখে জল এসে যায়। সে কাজির দোসরের দিকে চেয়ে কান্নায় অস্ফুট স্বরে বলল, “এই কাজি কি আর কখনও বেঁচে উঠবে না?”
“আমি তা বলতে পারি না। শুধু জানি, তোমাকে বাঁচানোর জন্যই কাজি তার প্রাণ দিয়ে আমাকে তৈরি করে গেছে।”
“আমাকে বাঁচানোর জন্য?”
“হ্যাঁ, লাটু। দুই মহাশক্তিধর মানুষের লড়াই শুরু হত আগামীকাল। কাজির জন্য। সে লড়াইয়ের মাঝখানে পড়ে তোমাকে মরতে হত। কিন্তু এখন সেই সম্ভাবনা রইল না। যে প্রথমে আসবে তাকেই তুমি দান করে দিও আমাকে। আমি তাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ধুলো বানিয়ে দেব। তোমার কোনও ক্ষতি হবে না।”
“আর তুমি?”
“ধ্বংস করা এবং ধ্বংস হওয়ার জন্যই আমার জন্ম। আমার জন্য ভেবো না। কাজিকে কবর দিয়ে এসো।”
লাটু এ-আদেশ পালন করতে পারল না। সারাদিন সে কাজির মৃতদেহ হাতে নিয়ে বসে রইল পুতুলের মতো। আস্তে আস্তে দিন গিয়ে বিকেল, তারপর সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি নামল চারধারে।
আগামী কাল সকালে আসবে রামরাহা আর খ্রাচ খ্রাচ। কিন্তু লাটুর ভয় ছিল না। এক গভীর শোকে তার বুক ভার হয়ে আছে। কাজিকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রেখে লাটু ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।
খুব ভোররাত্রে আকাশে কয়েকটা অদ্ভুত চলমান উজ্জ্বল নক্ষত্রকে দেখা গেল। অতি দ্রুত তারা পশ্চিমের আকাশ থেকে ছুটে আসছিল পৃথিবীর দিকে। কয়েক সেকেন্ড পৃথিবীর সমস্ত মানমন্দিরের দূরবীক্ষণে দেখা গেল তাদের। একটা হৈচৈ পড়ে গেল। কিন্তু আচমকাই কী হল, সমস্ত আলোগুলো অদৃশ্য হয়ে গেল। চলমান নক্ষত্রগুলোকে আর কোথাও দেখা গেল না।
শেষ রাত্রে এক ট্রেন থামল স্টেশনে। ছ ফুট লম্বা এবং অতিকায় সুদর্শন একজন যুবক স্যুটকেস হাতে প্ল্যাটফর্মে নামল। চারদিকে একবার চেয়ে সে পকেট থেকে ক্যালকুলেটরের মতো একটা যন্ত্র বের করে কী যেন দেখল। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে লাগল গর্ডনসাহেবের বাড়ির দিকে।
কোনও শব্দ হয়নি, তবু ভোর রাত্রে ঘুম ভেঙে গেল লাটুর।
চোখ চেয়ে চমকে সোজা হয়ে বসল সে। তার সামনে টেবিলের ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে রামরাহা। কী অসাধারণ সুপুরুষ! কী চওড়া কাঁধ! কী বিশাল দুই হাত! চোখ দুটি স্নিগ্ধ, মুখে মৃদু একটু হাসি।
লাটু তাকাতেই রামরাহা বলল, “আমার কথা বোধহয় তুমি জানো?”
“হ্যাঁ। আপনি রামরাহা।”
“আমি র্যাডাক্যালিকে নিয়ে যেতে এসেছি। তুমি কি অনুমতি দেবে?”
লাটুর মাথা ঘুলিয়ে যাচ্ছিল। রামরাহা টেবিলের ওপর রাখা প্রতিবস্তুর কাজির দিকে চেয়ে আছে। মুখোনা স্নেহসিক্ত, সেইভাবে চেয়ে থেকেই রামরাহা বলল, “বড় দুষ্টু যন্ত্র। কিছুতেই স্থির থাকতে চায় না। আমি ওকে নিয়ে যখন পালিয়ে আসছিলাম তখন তোমাদের গ্রহে আশ্রয় নিতে হয়। সেই সময় ও আমার মহাকাশযান থেকে ছিটকে পড়ে পালিয়ে যায়। অনেকদিন পর আজ ওর খোঁজ পেয়েছি।”
লাটু মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকে। রামরাহার চেহারা সুন্দর, ব্যবহার ভাল, কিন্তু তাতে কী? ও যে কাজির শত্রু!
রামরাহা টেবিলের দিকে একটা হাত প্রসারিত করে বলে, “এর বদলে তোমাকে আমি একটা সুন্দর জিনিস দেব।”
প্রতিবস্তুর তৈরি কাজি টেবিলের ওপরে থেকেও কিন্তু টেবিলকে স্পর্শ করেনি। দুই সেন্টিমিটার ওপরে ভেসে ছিল। কেন তা লাটু জানে। পৃথিবীর বিজ্ঞান যত অনুন্নতই হোক তবু লাটু এ খবর রাখে যে, প্রতিবস্তুকে স্পর্শ করলেই অন্য যে কোনও জিনিসের অস্তিত্ব লোপ পায়। রামরাহা কি লক্ষ করছে যে, প্রতিবস্তুর তৈরি কাজি ভাসছে? না, করেনি। রামরাহার হাত এগিয়ে যাচ্ছে মারাত্মক জিনিসটার দিকে।
এখন কী করবে লাটু? রামরাহাকে তার ভীষণ ভাল লাগছে যে! সে বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলল, “ওটা ছুঁয়ো না, ওটা আমার জিনিস!”।
ঠিক এই সময়ে তাদের চমকে দিয়ে হঠাৎ মাটি কেঁপে উঠল থরথর করে। রাডাক্যালির একটা অদৃশ্য বস্তু যেন ধাক্কা দিল পৃথিবীর গায়ে। ভূমিকম্প নয়, ভূমিকম্প অন্যরকম।
রামরাহার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। সে একবার ওপরের দিকে চাইল। তারপর বলল, “খ্রাচ খ্রাচ বাতাসের বুদ্বুদ ছুঁড়ে মারছে। শোনো ছোট্ট মানুষ, আর সময় নেই। খ্রাচ খ্রাচ যদি আমার নাগাল পায়, তবে লড়াই হবেই। আমাদের মধ্যে কে হারবে জানি না, কিন্তু সে লড়াইয়ে পৃথিবী শেষ হয়ে যাবে। অনুমতি দাও, আমি র্যাডাক্যালিকে নিয়ে মহাশূন্যে চলে যাই। লড়াই হলে সেখানেই হোক।”
রামরাহা কাজির দিকে ফের হাত বাড়াতেই আবার পৃথিবী দুলে উঠল প্রবল ধাক্কায়। খ্রাচ ব্রাচের বিশালকায় বাতাসি বুদ্বুদ ঘণ্টায় কয়েক হাজার মাইল বেগে এসে পড়েছিল আশেপাশে। বাইরে কুকুরগুলো মর্মন্তুদ আর্তনাদ করে ওঠে। ওয়ার্কশপের একটা ধার ভেঙে পড়ে মাটিতে। বাগানের গাছপালায় তীব্র আন্দোলন, পাখিরা প্রাণভয়ে সমস্বরে চেঁচাতে থাকে।
ইজিচেয়ার সুদ্ধ পড়ে গিয়েছিল লাটু। চারদিক ভয়ংকর জ্বলছে, তার মাথা ঘুরছে। আতঙ্কে শুকিয়ে যাচ্ছে বুক। রামরাহা তাকে তুলে দাঁড় করায়। কী জোরালো হাত, অথচ কী নরম!
রামরাহা মাটি থেকে কী একটা কুড়িয়ে নিয়ে লাটুর দিকে অবাক হয়ে চেয়ে বলল, “এটা কী? এই তো দেখছি র্যাড়াক্যালি!”
লাটু হঠাৎ ডুকরে উঠে বলে, “কাজি মরে গেছে! কাজি মরে গেছে!”
রামরাহার মুখটা কেমন অদ্ভুত করুণ হয়ে যায়।
বাতাসের গোলা কোথায় দাগছে খ্রাচ খ্রাচ তা বোঝা যায় না ঠিক। তবে মাটি আরও জোরে কেঁপে ওঠে। গাছপালা ভেঙে পড়তে থাকে বাগানে। কয়েকটা কুকুর আর্তনাদ করে চিরকালের মতো চুপ করে যায়। গর্ডনের পিসি, “ও গড! ও গড!” বলে চিৎকার করে উঠোনে দৌড়াদৌড়ি করে।
রামরাহা টেবিলের প্রতিবস্তুর দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে। তারপর বিষণ্ণ মুখে মাথা নেড়ে বলে, “র্যাডাক্যালি, এভাবে আত্মহত্যা করার প্রয়োজন ছিল না তোমার।”
লাটু পড়ে গিয়েছিল ফের। উঠতে উঠতে বলল, “কাজি তোমাকে শত্রু ভাবত।”
রামরাহা মাথা নেড়ে বলল, “ভাবত না। তাকে ওরকম ভাবতে শিখিয়েছিল খ্রাচ খ্রাচ। র্যাডাক্যালির নৈতিক বোধ নষ্ট করেছে খ্রাচ খ্রাচ। আর কয়েকটা দিন তাকে হাতে পেলে শুধরে নিতাম।
বাইরে এক অপার্থিব বেগুনি আলোয় ভরে যাচ্ছিল চারদিক। মুহুর্মুহু বাতাসের গোলা এসে ছয়ছত্রখান করে দিয়েছে সবকিছু। ধড়াস করে ওয়ার্কশপের অনেকটা দেয়াল ধসে গেল একদিকে। উড়ুক্কু মোটর সাইকেলটা মুখ থুবড়ে পড়ে একেবারে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে গেল। টুকরো-টুকরো হয়ে গেল গর্ডনের কলের মানুষ। ঝড়ের বাক্স চৌচির। লাটু আর কাজি মিলে সম্পূর্ণ করেছিল গর্ডনের এসব খেলনা। লাটু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখল শুধু।
ঘনীভূত ও নিরেট বাতাসের আর-একটা অতিকায় গোলা পড়ল কোথায় যেন। খুব কাছে। একটা একশো মাইল বেগের ঝড় এসে বাগানের গাছপালা শিকড়সমেত উড়িয়ে নিয়ে গেল। সেইসঙ্গে উড়ে গেল ওয়ার্কশপের চাল।
লাটু আকাশের দিকে চেয়ে দেখে, তারাভরা আকাশ থেকে একটা মস্ত থালার মতো মহাকাশযান নেমে আসছে।
রামরাহা মৃদু স্বরে বলে, “চুপ করে থাকো, কোনও কথা বোলো।”
“তুমি?”
“আমি! আমাকে একটু লুকিয়ে থাকতে হবে। তুমি ভয় পেও না। আমি কাছেই থাকব।”
মহাকাশযান ত্রিশ ফুট ওপরে ভাসতে লাগল স্থির হয়ে। তার তলায় একটা ছোট্ট গোল ছিদ্র দেখা দিল। কে যেন সেই ফুটো দিয়ে লাফ দিল নীচে। সোজা সে এসে নামল লাটুর সামনে।
লাটু দেখল থ্রাচ খ্রাচ। তেমনি অদ্ভুত পোশাক তার পরনে, তেমনি অদ্ভুত টুপি, আব্রাহাম লিঙ্কনের মতো লম্বা মুখ! দশাসই চেহারা। একবার টেবিলের প্রতিবস্তু এবং একবার লাটুর মুখের দিকে চেয়ে সে একটু হাসল। তারপর ভারী একটা হাতে লাটুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, “শাবাশ! তুমি কথা রেখেছ।”
লাটু-জবাব দিতে পারল না। সম্মোহিতের মতো চেয়ে রইল।
খ্রাচ খ্রাচ টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে লোভাতুর চোখে চেয়ে রইল প্রতিবস্তুর কাজির দিকে। অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে লাটুর দিকে হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে হিংস্র গলায় বলল, “রামরাহা কোথায়? সে এখানেই ছিল। আমি তার স্পন্দন আমার সেনসরে টের পাচ্ছি। কোথায় সে?”
লাটু মাথা নেড়ে জানাল, সে জানে না, তার গলার স্বর ফুটছিল না।
খ্রাচ ব্রাচ গম্ভীর বজ্রনিনাদে বলল, “শোনো খুদে মুখ মানুষ, রামরাহা যতদিন বেঁচে থাকবে, ততদিন কাজি নিরাপদ নয়। তাকে ধ্বংস করতেই হবে। যদি সত্যি কথা না বললো, তা হলে পৃথিবীকে ধ্বংস করা ছাড়া আমার উপায় থাকবে না।”
ভয়ে লাটুর হাত পা হিম হয়ে যাচ্ছিল, সে কোনও জবাব দিতে পারল না। খ্রাচ খ্রাচ জ্বলন্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তার দিকে চেয়ে থেকে বলল, “রামরাহা এখনও পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে পারেনি, আমি জানি। কিন্তু তাঁকে খুঁজে বের করার মতো সময় আমার নেই। আমি কাজিকে নিয়ে যাচ্ছি। মহাকাশযানে ফিরে গিয়েই আমি সুপারচার্জার দিয়ে পৃথিবীকে একেবারে ধুলো করে দেব। তুমি আমার মস্ত উপকার করেছ, তবু আমার কিছু করার নেই।”
এই বলে খ্রাচ খ্রাচ হাত বাড়িয়ে প্রতিবস্তুর কাজিকে স্পর্শ করল।
লাটু কোনও মানুষকে এরকমভাবে বাতাস হয়ে যেতে দেখেনি কখনও। আজ সে চোখের পলক একবারও না ফেলে দৃশ্যটা দেখল। খ্রাচ খ্রাচ কাজিকে স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার মস্ত শরীরটায় একটা তীব্র শিহরণ বয়ে গেল। হঠাৎ শূন্যে উৎক্ষিপ্ত হল সে। তারপর অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন কয়েকটা ঘূর্ণিঝড় তার শরীরে পাক দিতে লাগল। হাত গলে গেল, পা গলে গেল, মাথা, বুক, চোখ সব যেন গলে গলে মিশে যেতে লাগল বাতাসে।
মাত্র কয়েক সেকেন্ড, তারপর খ্রাচ খ্রাচ এবং প্রতিবস্তুতে তৈরি কাজির কোনও চিহ্নও রইল না কোথাও।
শূন্যে ভাসমান ব্রাচ খ্রাচের মহাকাশযান কী বুঝল কে জানে। হঠাৎ একটা বেগুনি রশ্মিতে চারদিক উদ্ভাসিত করে বিদ্যুৎ-বেগে সেটা মিলিয়ে গেল আকাশে।
লাটু ক্লান্তভাবে বসে পড়ল ইজিচেয়ারটায়।
একটা. কাবার্ডের আড়াল থেকে রামরাহা বেরিয়ে এল ধীর পায়ে। হাতে কাজির মৃতদেহ। মাথা নেড়ে বলল, “কাজি বেঁচে নেই। তবু আমাকে চেষ্টা করে যেতে হবে ওকে আবার বাঁচিয়ে ভোলার জন্য। যতদিন না পারছি, ততদিন তোমাদের গ্রহে আমাকে থেকে যেতে হবে।”
লাটু লাফিয়ে উঠল আনন্দে। থাকবে? থাকবে রামরাহা?” রামরাহা মাথা নেড়ে বলে, “থাকব, তবে সমুদ্রের তলায়, আমার মহাকাশযানে।”
“কিন্তু তোমাকে যে আমার দেখতে ইচ্ছে করবে!”
“ডাকলেই আমি দেখা দেব।”
“কীভাবে?”
রামরাহা একটা ঘড়ি বের করে লাটুর হাতে দিয়ে বলে, “এটা একটা সাধারণ ঘড়ি। তবে এর চাবিটা উল্টোদিকে ঘোরালেই আমি সংকেত পাব। তবে খুব প্রয়োজন ছাড়া আমাকে ডেকো না। কেমন?”
লাটু আনন্দে উদ্ভাসিত মুখে মাথা নাড়ল। “আচ্ছা।”
রামরাহা সেই অদ্ভুত বিষণ্ণ সুরে শিস দিতে দিতে ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
ঘড়ি দেখে হারানচন্দ্ৰ আঁতকে উঠে বললেন, “ও বাবা! আর ঘড়ি নয়। এ জন্মে আর ঘড়ি পরবো না আমি। ওটা তুই-ই পর! আর ঘড়ি হারাতে আমি পারব না।”
অগত্যা ঘড়িটা লাটুই পরতে থাকে।
জটাই তান্ত্রিক আর গর্ডন আবার স্বাভাবিক হয়েছেন। জটাই এসে হারানচন্দ্রকে প্রায়ই বলেন, “হুঁ হুঁ বাবা, ভূত ব্যাটার কাণ্ডটা দেখলে! সেদিন কেমন তুলকালাম ঝড়টা বইয়ে দিয়ে গেল। ওঃ, গর্ডনের কারখানাটার আর কিছু রাখেনি।”
হারানচন্দ্ৰ খেঁকিয়ে উঠে বলেন, “ভুতুড়ে কাণ্ডটা কী রকম?”
জটাই মৃদু হেসে বলেন, “আরে চটো কেন? ভূতের স্বভাবই ওই। যখনই কিছু ছাড়তে হয়, তখনই রেগেমেগে ভাঙচুর করে যায়। তোমার ঘড়িটার ভূত হে। যেই তাড়িয়েছি, অমনি সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। তেজ ছিল খুব ব্যাটার।”
“কিন্তু ঘড়িটাও তো গায়েব! সেটার কী হল?”
হরি ডোমের করোটিতে চা খেতে খেতে জটাই গম্ভীর মুখে বলেন, “ঈশ্বরে মন দাও হারান, ঈশ্বরে মন দাও। ‘কালী কালী’ বলে দিনরাত ডাকো। বিষয়-চিন্তা করে করে যে একেবারে হয়রান হয়ে গেলে!”