Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

গর্ডন সাহেবের ওয়ার্কশপে

গর্ডন সাহেবের ওয়ার্কশপে গিয়ে কয়েকদিন থাকা লাটুর পক্ষে খুব সহজ নয়। বাড়ি থেকে তাকে ছাড়বে কেন? যদি পালিয়ে যায়, তবে সাঙ্ঘাতিক হৈ-চৈ পড়ে যাবে, কান্নাকাটি শুরু হবে। সুতরাং পালানো উচিত নয়। তাহলে কী করা?

লাটু খানিকক্ষণ ভাবল। হঠাৎ হাতে ধরা যন্ত্রটার দিকে নজর পড়ায় সে একটু নড়েচড়ে বসে। কাজিকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়ে যায়। তাই না? সমস্যা হল, কাজি বাংলা ভাষা বোঝে কি না এবং জবাবটাও বাংলায় দেবে কি না।

হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। অত ভাবনায় কাজ কী? জিজ্ঞেস করলেই তো হয়।

লাটু কাজির ডায়ালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সব তো বুঝতে পারছ। এখন বলল তো কী করব?”

কাজির কোনও ভাবান্তর দেখা গেল না।

লাটু তার টুলবক্স থেকে একটা ইলেকট্রিক তার বের করে একটু তামার সুতো ছিঁড়ে নিল, তারপর কাজির একটা সূক্ষ্ম ফুটোয় তারটা ঢুকিয়ে সামান্য চাপ দিয়ে আবার প্রশ্নটা করল। এবার আশ্চর্য কাণ্ড ঘটল একটা।

কাজি ভারী বিরক্ত হয়ে বলে, “ভুল ফুটোয় চাপ দিয়েছ। একটা ত্রিভূজ মাকা ফুটো আছে দেখ। ওটায় তার ঢোকাও।”

হতভম্ব লাটু তা-ই করল।

এবার কাজি বলল, “মামাবাড়ি যাওয়ার নাম করে বেরিয়ে পড়ো।”

লাটুর বিস্ময় আর ধরে না। বাস্তবিকই তার খেয়াল ছিল না যে, মামাবাড়ির নাম করে বেরিয়ে পড়া যায়। বেশি দূরও নয়। দুই স্টেশন। সেখানে একজন গুণী লোক চমৎকার লাটাই বানায়। সেই লাটাই আনতে যাওয়ার একটা কথাও ছিল বটে।

লাটু কাজিকে নিজের টুলবক্সে লুকিয়ে রেখে মায়ের কাছে। গেল।

“মা, আমি একটু মামাবাড়ি যাব।”

“মামাবাড়ি! হঠাৎ কী মতলব।”

“বাঃ, লাটাই আনতে যাওয়ার কথা ছিল না?”

মা আর বিশেষ আপত্তি করলেন না, শুধু বললেন, “দাদু আর ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করে তবে যাস।”

লাটু যখন দাদুর ঘরে গিয়ে ঢুকল তখন আলমারির দরজা হাট করে খোলা আর তার সামনেই বাসবনলিনী এবং হারানচন্দ্রের মধ্যে তুলকালাম হচ্ছে। বাসবনলিনী চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন, “ফের ঘড়ি হারিয়েছ আর বলছ আলমারিতে রেখেছিলে! রেখেছিলে তো গেল কোথায় শুনি! কী সুন্দর ঘড়ি! ঘড়িকে ঘড়ি, তার সঙ্গে আবার রেডিও লাগানো। আর কি সে জিনিস পাওয়া যাবে? পইপই করে বললাম–”

এই গোলমালের মধ্যেই লাটু দাদুকে জিজ্ঞেস করল, “যাই দাদু?”

হারানচন্দ্র বিরক্ত হয়ে বললেন, “যা না!”

লাটু ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করে, “যাই ঠাকুমা?”

“তাড়াতাড়ি ফিরিস ভাই।”

লাটু এক লাফে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। কয়েকটা জামাকাপড় গুছিয়ে একটা ব্যাগে ভরে নিল। পরদিন ভোরবেলা মামাবাড়ি যাওয়ার জন্য রওনা হয়ে সে গিয়ে গর্ডনের বাড়ির পাঁচিল টপকে ওয়ার্কশপে ঢুকে পড়ল।

গর্ডনের কুকুরগুলো জেগে উঠেছে বটে, কিন্তু সব কেমন যেন মোহাচ্ছন্ন অবস্থা, তাকে দেখেও গা করল না।

ত্রিভুজ মার্কা ফুটোয় তার ঢুকিয়ে লাটু কাজিকে বলল, “কুকুরগুলোকে চাঙ্গা করে তোলো। ওরা আমাদের পাহারা দেবে।”

একথা বলার সঙ্গে-সঙ্গে কাজির ভিতরে একটা অদ্ভুত রিনরিনে শব্দ-তরঙ্গ উঠে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কুকুরগুলো সেই শব্দের প্রভাবে হঠাৎ চনমনে হয়ে লাফ দিয়ে উঠে চারদিকে প্রচণ্ড দৌড়োদৗড়ি শুরু করে দেয়। তারপর এসে লাটুকে ঘিরে ধরে প্রবলভাবে ল্যাজ নাড়তে থাকে।

লাটু গম্ভীর হয়ে কুকুরগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, “বেশ ভাল করে চারদিক নজর রাখবি, বুঝলি! এখন যা।”

সঙ্গে-সঙ্গে কুকুরগুলো বেরিয়ে গিয়ে গোটা ওয়ার্কশপটাকে প্রায় ঘিরে ফেলে পাহারা শুরু করে দেয়।

লাটু এবার ওয়ার্কশপটা পরীক্ষা করে দেখে। গর্ডন সাহেবের এই বিটকেল ওয়ার্কশপে কাজের ও অকাজের হাজার রকম যন্ত্রপাতি রয়েছে। লাটু তার অধিকাংশই চেনে না। আছে নানারকম রাসায়নিক দ্রব্যও। গর্ডনসাহেব যে উড়কু মোটর সাইকেল তৈরি করছিল সেটা একটা বড়সড় মজবুত ডাইনিং টেবিলের ওপর দণ্ডায়মান। মোটর সাইকেলের গায়ে একটা প্লট দাঁড় করানো। তাতে চক দিয়ে লেখা ফুয়েল চার্জড।

অলমোস্ট রেডি ফর ফ্লাইং। ওনলি ওয়ান থিং মিসিং। অর্থাৎ সব কিছুই প্রস্তুত, মোটর সাইকেল উড়বার জন্য তৈরি। শুধু একটা জিনিসের অভাবেই সেটা হচ্ছে না।

কিন্তু জিনিসটা কী?

লাটু কাজির বিজ্ঞান-জিজ্ঞাসার ছিদ্রে তারটা ঢুকিয়ে সমস্যাটা জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, “জিনিসটা কী কাজি?”

কাজি বলল, “খুব দুর্লভ জিনিস নয়। রাসায়নিকের তাকে দ্যাখো, একটা নীল রঙের শিশি আছে। তার গায়ে লেখা ‘পয়জন’। খুব সাবধানে ফুয়েল ট্যাংকের মধ্যে ঠিক চার ফোঁটা ফেলে দাও।”

লাটু দিল। “এবার কী করব কাজি?”

“সিটে উঠে বোসো। স্টার্টারে খুব আস্তে চাপ দাও। কোনও শব্দ হবে না, কিন্তু একটা জোর হাওয়া বেরোবে।”

“তারপর?”

“খুব সোজা। মোটর সাইকেলটা শূন্যে ভাসবে। বাঁ হাতের হাতলটা নিজের দিকে একটু ঘুরিয়ে দিলেই চলতে থাকবে। বেশি ঘোরালে স্পিড বাড়বে।”

লাটু খুব ভয়ে ভয়ে সিটে উঠে বসে স্টাটারে একটা পা ছোঁয়াতে না ছোঁয়াতেই মোটর সাইকেলটা থরথর করে কেঁপে উঠল। একজস্ট পাইপ দিয়ে প্রবলবেগে হাওয়া বেরোনোর মৃদু শব্দ টের পেল সে। তারপরই প্রকাণ্ড মোটর সাইকেলটা ধীরে ধীরে শূন্যে উঠে ভাসতে লাগল।

“কাজি!” আতঙ্কে চেঁচায় লাটু।

“ভয় নেই। হাতলটায় চাপ দাও।”

লাটু অবাক ভাবটা সামলে নিতে কিছুক্ষণ সময় নিল। তারপর কাজির কথামতো কাজ করতেই মোটর সাইকেল ধীরে ধীরে শূন্যে চলতে থাকে। লাটুর চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া। এত অবাক হয়ে গিয়েছিল সে যে, সময়মতো দিক পরিবর্তন না করায় মোটর সাইকেলটা গিয়ে একটা দেয়ালে মৃদু ধাক্কা খায়।

কাজি বিরক্ত হয়ে বলে, “অ্যাকসিডেন্ট হবে যে! এত অবাক হওয়ার কী আছে? এ তো একেবারে প্রাথমিক জিনিস!”

লাটু হাঁ হয়ে বলে, “প্রাথমিক বিজ্ঞান?”

“তা ছাড়া কী? তোমরা এখনও বিজ্ঞানের অন্ধকার যুগে পড়ে আছ। আকাশে উড়তে এখনও তোমাদের এরোপ্লেন, হেলিকপটার বা রকেটের মতো সেকেলে জিনিস লাগে। আমাদের দেশের মানুষেরা স্রেফ একটা কলমের মতো যন্ত্রের সাহায্যে উড়ে যেতে পারে।”

“বলো কী?”

“ঠিকই বলছি। এখন সাবধান হও, নইলে আবার ধাক্কা খাবে। দরজা খোলা রয়েছে, হ্যান্ডেলটা ঘুরিয়ে দিয়ে বাইরে চলো।”

লাটু উড়ুক্কু মোটর সাইকেলে বাইরে বেরিয়ে এল। বিস্তর গাছপালা-ছাওয়া বিশাল বাগান। দিনের বেলাতেও অন্ধকার হয়ে থাকে। আজ উড়কু মোটর সাইকেলে চেপে লাটু গাছপালার ওপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে ঘুরে বেড়াতে লাগল। এরকম অদ্ভুত অভিজ্ঞতা তার জীবনে হয়নি। কী মজা!

“স্পিডটা একটু বাড়াব কাজি?”

“বাড়াও। তবে সাবধান, পড়ে যেও না। শক্ত করে ধরে থাকো।”

লাটু স্পিড বাড়াল। মোটর সাইকেল প্রবল বেগে বাগানের ওপর চক্কর দিতে লাগল।

ওয়ার্কশপে ফিরে এসে মোটর সাইকেল যথাস্থানে রেখে লাটু অন্য সব যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজে লেগে গেল। সুবিধের জন্য কাজিকে সে বাঁ হাতের কব্জিতে ঘড়ির মতো বেঁধে নিয়েছে। কাজি নানারকম নির্দেশ দেয়, আর লাটু অদ্ভুত অদ্ভুত সব যন্ত্র তৈরি করে ফেলতে থাকে। আসলে নতুন কিছুই নয়। গর্ডনের আধাখ্যাঁচড়া জিনিসগুলিকেই সম্পূর্ণ করে সে।

গর্ডন একটা যন্ত্রমানব তৈরি করেছিল। বাইরেটা বেশ হয়েছে, কিন্তু স্লেটে লেখা ছিল এভরিথিং কমপ্লিট, বাট দি ফুল উজষ্ট মুভ। ইট ওনলি মুভস ওয়ান অফ ইটস হ্যান্ডস অ্যান্ড স্ল্যা মি ফ্রম টাইম টু টাইম। অর্থাৎ, সবই হয়েছে, কিন্তু বোকাটা তবু নড়ে না। মাঝে মাঝে শুধু একটা হাত নাড়ে আর আমাকে চড় কষায়। এই যন্ত্রমানবটা লাটুর হাতে পড়ে দিব্যি চলতে ফিরতে পারল এবং টুকটাক কাজও করতে লাগল।

ছোট একটা ট্রাঙ্কের মতো বাক্স বানিয়েছে গর্ডন। তার গায়ে লেখা : প্যাণ্ডোরাজ বক্স। ইট ইজ সাপোজড টু ক্রিয়েট স্টর্ম। বাট দি গড্যাম থিং ওনলি ক্রিয়েটস এ হেল অব এ নয়েজ। অর্থাৎ, এ বাক্সটার ঝড় সৃষ্টি করার কথা ছিল। কিন্তু এই কিতটা শুধু বিকট শব্দ করে। লাটু কাজির পরামর্শ মতো বাক্সটাও সম্পূর্ণ করে ফেলল। একটা বোম টিপতেই চারধারে গাছপালার মড়মড় শব্দ তুলে ছোটখাটো একটা ঝড় উঠতেই লাটু তাড়াতাড়ি লাল বোতাম টিপে ঝড় থামাল।

কাজি একটু হেসে বলে, “অনেক কিছু তো তৈরি করলে, কিন্তু রামরাহার সঙ্গে লড়ার অস্ত্র কই তোমার? এসব ছোটখাটো খেলনা দিয়ে কী হবে?”

লাটু ভাবনায় পড়ল। খ্রাচ খ্রাচের কাছে সে যা শুনেছে, তাতে রামরাহা প্রায় অপ্রতিরোধ্য এক শক্তিমান লোক। তাকে ঠকানোর মতো কিছুই তার জানা নেই। রামরাহা শুধু যে ঘণ্টায় একশো মাইল বেগে দৌড়োয়, দশ ফুট হাইজাম্প দেয় আর মহম্মদ আলি এবং ব্রুস লি’কে দুহাতে নিয়ে লোফালুফি করতে পারে তাই নয়, বুদ্ধি এবং প্রযুক্তিতেও সে বহু বহু গুণ শক্তিশালী।

লাটু বলে, “কী করব তাহলে কাজি?”

কাজি একটা দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করে বলে, “ভেবে দেখি। রামরাহার বুদ্ধি এমন এক স্তরের যে, তাকে হারাতে হলে অতি মগজ দরকার। অনেক ভাবতে হবে।”

লাটুও ভাবে।

আস্তে আস্তে রাত হতে থাকে। গর্ডনের ওয়ার্কশপটা ভারী নির্জন হয়ে যায়। লাটু বলতে গেলে একা। কাজি আছে বটে, কিন্তু সে তো পুঁচকে একটা যন্ত্র মাত্র। কুকুরগুলোকেও সঙ্গী হিসেবে ধরা যায় না। লাটু তার দাদুর অন্ধ সমর্থক। সেও দাদুর মতো ভূত বিশ্বাস করে না, ভগবান মানে না। কিন্তু সন্ধের পর গা ছমছম করেই। আর পরীক্ষার সময় ঠাকুর-দেবতাকে অগ্রাহ্য করতে কেমন যেন সাহস হয় না। ওয়ার্কশপের নির্জনতায় তার একটু ভয়-ভয় করতে লাগল। বাগানের গাছপালায় নানারকম শব্দ হচ্ছে। দূরে শেয়াল হাঁক মারছে। সেই শুনে কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করে ছুটে যাচ্ছে। তারের বাজনার মতো ঝিঁঝি ডেকে যাচ্ছে একটানা।

লাটু একটু ফাঁকা গলায় ডাকল, “কাজি!”

“বলো।”

“তুমি কি ভূত মানো?”

“কেন মানব না?”

“ভূত কি সত্যিই আছে?” কাজি খিকখিক করে একটু হেসে বলে, “তোমাদের বিজ্ঞান এখনও এত পিছিয়ে আছে যে বলার নয়। আমাদের ওখানে তো ভূতের একটা চমৎকার লাইব্রেরিই আছে। থাকে-থাকে খোপে-খোপে হাজার রকমের ভূত। ভূতেরা সেখানে নানারকম কাজও করে দেয়।”

লাটু কেঁপে উঠে বলে, “ইয়ার্কি করছ না তো কাজি? সত্যিই ভূত আছে?”

কাজি ফের একটু ঠাট্টার হাসি হাসল। বলল, “তোমাদের এখানকার ভূতদের আমি ঠিক চিনি না বটে, কিন্তু তারা যে আছে তা আমার ট্রেলারে ধরা পড়ছে। যে ফুটোটায় মড়ার খুলির চিহ্ন আছে সেটাতে তারটা ঢোকাও তো।”

লাটু বলল, “থাক। কাজ নেই।”

কাজি মোলায়েম গলায় বলে, “আমি তো আছি, ভয় কী? ঢোকাও।”

খুব ভয়ে ভয়ে লাটু তারটা নির্দিষ্ট ফুটোয় ঢুকিয়ে দিল, কাজিকে অমান্য করতে সাহস পেল না। যদি বিগড়ে যায়?

তারটা ঢোকানোর পরই ঘরে যে দুটো ইলেকট্রিক বাল্ব জ্বলছিল সেগুলো কেমন যেন একটা অদ্ভুত লাল-বেগুনি রং ধরতে লাগল। ঘরটা হয়ে উঠতে লাগল থমথমে। খুব আস্তে-আস্তে–ফিসফিস কথার মতো, বেড়ালের পায়ের শব্দের মতো–কী সব শব্দ হতে লাগল চারদিকে।

কাজি নিচু স্বরে বলল, “আমার ভূত-চুম্বকটা চালু করে দিয়েছি। এবার দ্যাখো কী মজা হয়।”

“আমার মজা লাগছে না। ভয় লাগছে।”

“আরে দূর! ভূতকে ভয় কী? দেখো চেয়ে। ওই একটা ঢুকেছে।”

প্রথমটায় লাটু দেখতে পায় না। তারপর ঘরের চালের কাছ থেকে একটা স্প্রিঙের মত জিনিসকে ঝুল খেতে দেখে।

“বাবা গো! ওটা কী কাজি?”

“প্যাঁচ-খাওয়া চেহারা দেখে বুঝতে পারছ না?”

“না।”

“ভূত হল মানুষের মানসিক-আত্মিক একটা অস্তিত্ব। মানুষের মন আর চরিত্র জ্যান্ত অবস্থায় যেমন ছিল মরার পর তার ভূতের চেহারাটা ঠিক সেরকম হয়ে যায়। ওই ভূতটা জ্যান্ত অবস্থায় ছিল ভারী প্যাঁচালো স্বভাবের, খুব কুটিল আর ধূর্ত।”

“বুঝেছি। আর ওই যে একটা লালমতো জোঁক তিড়িং তিড়িং করে লাফাচ্ছে?”

“ওটা ছিল এক ঝগড়াটি মহিলা।”

নানান চেহারার অজস্র ভূত ঘরে বিচরণ করছে। কেউ কেউ টুপটাপ করে চাল থেকে খসে পড়ছে, কেউ বাতামে সাঁতার কাটছে, কেউ মেঝেয় পড়ে বলের মতো লাফিয়ে উঠছে। নানান চেহারা, হরেক রং তাদের। একখানা ভূতকে দেখল লাটু, অবিকল একখানা বই। কাজি বলল, “এ লোকটা নাকি ছিল বইয়ের পোকা আর ভারী পণ্ডিত। বই পড়তে পড়তে বই হয়ে গেছে।”

লাটু কাজির ফুটো থেকে তারটা খুলে নিয়ে বলল, “আর নয়। একদিনে যথেষ্ট ভূত দেখা হয়েছে।”

ঘরের থমথমে ভুতুড়ে ভাবটা মিলিয়ে গেল। ভুতগুলোও আর রইল না।

কাজি বলল, “ভূতের ভয় ভেঙেছে তো!”

লাটু একগাল হেসে বলল, “ভেঙেছে কি না বলতে পারব না। তবে তেমন ভয় করছে না।”

কাজি এবার হুকুমের স্বরে বলল, “এবার ওঠো। অনেক রাত হয়েছে। ঘরের কোণে গর্ডনের মস্ত ফ্রিজ রয়েছে। তাতে ঠাসা খাবার। বের করে গ্যাস-উনুনে গরম করে খেয়ে নাও।”

লাটু, তাই করল।

কাজি হুকুম করল, “এবার ইজিচেয়ারে শুয়ে চোখ বোজো। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। আর শোনো, আমার ট্রেসারে এখনও রামরাহার কোনও নড়াচড়া টের পাচ্ছি না। পঞ্চাশ মাইলের মধ্যে এলে আমি তার গায়ের গন্ধ পাব। পেলেই তোমাকে জাগিয়ে দেব। নিশ্চিন্তে ঘুমোও।”

লাটুর ঘুম ভাঙল সকালবেলায়। শরীর বেশ তাজা আর ঝরঝরে লাগছে। আসন্ন বিপদের কথা মনে থাকলেও বেশ স্ফূর্তি লাগছে তার।

দাঁত মেজে, মুখ ধুয়ে, বাথরুম সেরে এবং ফ্রিজের খাবার ভরপেট খেয়ে সে উড়কু মোটর সাইকেলে চড়ে বাগানের ওপর কয়েকটা চক্কর দিল। কলের মানুষটাকে দিয়ে ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করাল। সামান্য একটু ঝড় তুলে মজা দেখল।

কাজি আজ বেশি সাড়াশব্দ করছে না। ঝিম মেরে আছে। লাটু বলল, “কী গো কাজি? চুপচাপ যে!”

“রোসো। পশ্চিম দিকটায় ভারত মহাসাগর আছে না তোমাদের! সেখানে একটা কিছু ঘটছে।”

লাটু সভয়ে বলে, “কী ঘটছে?”

“এখনও বুঝতে পারছি না। আমার ট্রেসারে অন্য একটা ট্রেসারের ছায়া পড়ে কাটাকুটি হয়ে যাচ্ছে। খুব উন্নত ধরনের ট্রেসার সেটা। তোমাদের পৃথিবীর তৈরি জিনিস নয়। মনে হচ্ছে সমুদ্রের তলায় রামরাহা নড়াচড়া শুরু করেছে। “

“তাহলে?”

“তাহলে আর কী? লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হও।”

“কিন্তু কী দিয়ে লড়ব? আমার যে একটা বন্দুকও নেই।”

“বন্দুক! হাঃ হাঃ! বন্দুক কেন, কামান বা অ্যাটমবোমাও রামরাহার কাছে কোনও অস্ত্রই নয়। ওসব ভেবে লাভ নেই। আমি অবশ্য একটা কাউন্টার এনার্জি ফিল্ড তৈরি করে দিচ্ছি। তার ফলে রামরাহার ট্রেসার প্রথম চেষ্টায় আমার অবস্থান ধরতে পারবে না। কিন্তু চালাকিটা বেশিক্ষণ টিকবে না।”

“আমার যে মাথায় কোনও বুদ্ধিও আসছে না।”

“ঠিক আছে। তুমিও ভাবো, আমিও ভাবি। একটা দুঃখের কথা তোমাকে এখনই বলে রাখি লাটু। আমি এখন তোমার হয়ে লড়ছি বটে। কিন্তু আমি তো আসলে যন্ত্র। যন্ত্রের কোনও পক্ষপাত থাকে না। রামরাহা যদি আমাকে হাতে পেয়ে যায়, তাহলে কিন্তু আমি তোমার বিরুদ্ধেই লড়াই করব।”

“বলো কী কাজি?”

“বললাম না, দুঃখের কথা! তাই বলি, হাতছাড়া কোরো না।”

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress