ভালোবাসা নাও, হারিয়ে যেও না
নিজের সঙ্গে সংলাপে আমি এতই নিমগ্ন হয়ে পড়েছিলুম যে আর একটা ট্রেন এসে যে থেমেছে তা খেয়াল করিনি। এমনকি আওয়াজ পর্যন্ত পাইনি। সামনে দিয়ে অনেক লোকজনের যাতায়াতে ঘোর ভাঙল। তাড়াতাড়ি একটা ডাক শুনে চমকে উঠলুম!
পান–বিড়ি! পান–বিড়ি–সিগ্রেট! চাই পান…
আমার থেকে মাত্র দু’তিন গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটি। পনেরো–ষোলো বছর বয়েস হবে। পাজামা আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরা। কোমরের কাছে ঝোলানো ডালাটিতে অল্প কিছু সিগারেট আর পান।
এই সেই বুড়ির নাতি?
এতক্ষণ এই পানওয়ালা কোথায় ছিল? হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হলো। ছেলেটির খালি পা, মাথার চুল চটলা মতন, সমস্ত চেহারাটিতেই দারিদ্র্য মাখানো। ব্যাবসার উন্নতির জন্য ও আরো খাটে না কেন? সকাল থেকে কতগুলো ট্রেন চলে গেল।
আমি ছেলেটিকে চোখে চোখে রাখলুম। ট্রেনটা চলে যাক। যাত্রীর সংখ্যা কমুক, তারপর ওকে ধরব।
কিন্তু একটা ব্যাপারে খটকা লাগল। বুড়ির নাতি জেল খেটেছিল। পনেরো– ষোলো বছরের ছেলে কি জেলে যায়? ছিঁচকে চুরি–টুরি কিছু করেছিল বোধহয়। একজন মহিলা অনেকগুলো কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে বসেছে আমার বেঞ্চের বাকি জায়গাটায়। একটা বাচ্চা আবার বমি করতে শুরু করেছে।
আমি উঠে পায়চারি করতে শুরু করলুম। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরমও পড়েছে খুব। পিঠের জামা ভিজে ভিজে। প্রথমে এসে এই স্টেশনে যত লোক দেখেছিলুম, সেই তুলনায় এখন লোক অনেক কম। দুপুরের দিকে ট্রেনও কম থাকবে।
প্রত্যেক রেল স্টেশনের কিছু পোষ্য থাকে। এক জায়গায় মাদুর পেতে কিছু লোক তাস খেলছে। জলের কলের কাছেই একটি পরিবারের পাকাপাকি আস্তানা। এক জায়গায় পড়ে আছে কয়েকটা সোডার বোতলের ক্রেট। বোতলগুলোতে কোনো লেবেল নেই। এইসব সোডা কলকাতায় চলে না। লোকাল ট্রেনে আমি অনেকবার দেখেছি, পনেরো–কুড়ি পয়সায় এক এক বোতল বিক্রি হয়। এগুলো আসলে ভুসভুসে জল। চালওয়ালী, ফড়েরা এই সোডা কেনে। একটা হাফ পাউণ্ড পাঁউরুটির মাঝখানটায় গর্ত করে একটু একটু এই সোডা ঢালে আর কামড়ে কামড়ে খায়। পাঁউরুটি আর সোডা, এই হলো তাদের খাদ্য।
পান–বিড়িওয়ালাকে একটু নিরালায় ডেকে নিয়ে গিয়ে বললুম, এক খিলি পান সাজ তো। আর এক প্যাকেট চার্মিনার দে!
যা পান সাজার ছিরি, এর পান বিক্রি হবে কেন? কিচ্ছু জানে না। পুরো এক প্যাকেট সিগারেটও আমাকে দিতে পারল না, মোটে ছ’টা আছে।
আমি কস্মিনকালে পান খাই না। এই ছোড়ার পান খাওয়া তো আরো অসম্ভব। আমি বললুম, পানটা কাগজে মুড়ে দে। তোর বাড়ি কোথায় রে?
ছেলেটি বাঁ হাত তুলে বলল, ঐ ওদিকে।
—কাদাগোলা গাঁয়ে?
অচেনা একজন লোকের মুখে নিজের গ্রামের নাম শুনে যে–কেউ একটু সচকিত হবে। এ ছেলেটার বোধহয় আশ্চর্য হবার ক্ষমতাই কম। সে শুধু মাথা নাড়ল দু’দিকে।
– কাদাগোলা গ্রামটা কোথায় তুই চিনিস?
– না, বাবু।
—তুই সোনারপুরে থাকিস, কাদাগোলা চিনিস না?
—না। দিয়াশলাই নেবেন?
—আর কিছু চাই না। একটা কথা শোন। একজন বুড়িকে তুই চিনিস? বেশ বুড়ি, গড়িয়াহাট বাজারে রোজ ডিম বিক্রি করতে যায়। এইখান থেকেই ট্রেনে চাপে।
–কত বুড়ি–টুড়িই তো যায়।
–তোর কোনো দিদিমা বা কেউ যায় না?
— না!
আমি একেবারে নিরাশ হয়ে গেলুম। এ ছেলেটা একেবারে অপদার্থ! ও বড়ির নাতি না হতে পারে, একটা কিছু খবর তো অন্তত দিতে পারত! কিছুই জানে না!
বিরক্ত মুখে আমি দূরে সরে গিয়ে রেল লাইনে ফেলে দিলুম পানের খিলিটা। আমার বেশ আশা হয়েছিল এই ছেলেটাকে সঙ্গে নিয়ে আমি কাদাগোলায় যাব।
আবার আর একটা ট্রেন আসছে কলকাতার দিক থেকে। আজকের মতন আমার গোয়েন্দাগিরি শেষ। এই ট্রেনটা যদি ক্যানিং–এর হয় তাহলে উঠে পড়ব। পান–বিড়িওয়ালা ছোকরাটি ঘুরে এসে আমার কাছে দাঁড়িয়ে বলল, বুঝিচি বাবু, আপনি লোচনদাকে খুঁজছেন।
–না তো। কে লোচনদা? তাকে খুঁজব কেন?
–আপনি যে লোচনদার ঠাকুমার কথা বললেন? সেই বুড়ি ডিম ব্যাচে। কলকেতায় যায়। যাবার সময় রোজ লোচনদার পিঠে হাত বুলোয়। এক একদিন ফেরত আসার সময় লোচনদাকে পয়সা দেয়।
—সেই লোচনদা কোথায়?
–সেও পান–সিগ্রেট ব্যাচে। তিন চারদিন আসবে না। কোথায় যেন নুকিয়ে রয়েছে।
–কেন, লুকোবে কেন?
—একজনের সঙ্গে মারমারি হয়েছে। এই এস্টেশনে এক শালা হারামী আচে, আমাদের ব্যাবসা করতে দেবে না। আমাদের কাছ ঠেঙে পয়সা চায়। জবরদস্তি করে। আমারও মালপত্তর একদিন ছিরকুট করে দিয়েচে।
কথা বলতে বলতে ছেলেটি চায়ের দোকানের দিকে আড়চোখে তাকায়। তারপর ট্রেনটি প্ল্যাটফর্মে ঢুকতেই এগিয়ে যায় সেদিকে।
তাহলে বুড়ির নাতি একজন সত্যিই আছে এই সোনারপুরে। কিন্তু তার দেখা পাওয়া যাবে না। সে লুকিয়ে আছে কোথাও। সেই পুরোনো কাহিনী। একদল লোক কাজ করে, আর একদল লোক কাজ না করে অন্যের উপার্জনে ভাগ বসাতে চায়। সব বড় বড় স্টেশনেই এরকম মাস্তান থাকে দু’একজন।
প্রথম এসে চা খেতে খেতে যে লোকটির কথা শুনছিলাম, সেই বোধহয় ওদের মধ্যে একজন। এখন এই লোচন নামের লোকটির বেশি খোঁজ খবর নেওয়া আমার পক্ষে নিরাপদ নয়। অবশ্য, বারাসত থানার ও সি যে আমার মামা এই কথাটা আণ্ডার ওয়ার্ল্ডে রটে গেছে নিশ্চয়ই। সহজে কেউ আমার গায়ে হাত দেবে না।
কলকাতার ট্রেন থেমেছে, কাছাকাছি একটা কামরা থেকে নামল চার পাঁচটি মেয়ে। তাদের একজনের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হলো।
এই সেই হিলহিলে কিশোরী ময়না, আজ সকালেই যার কাছ থেকে আমি এক কিলো ঝিঙে কিনেছি! আজ সকালেই মাত্র জেনেছি ওর নাম। তবু মনে হচ্ছে কতদিনের চেনা!
বাজার সেরে এরা এত দেরি করে ফেরে? এরপর পায়ে হেঁটে গ্রামে যাবে।
এরা খায়–দায় কখন?
ময়নাই প্রথম কথা বলল আমার সঙ্গে।
এক একজনের মুখে বিস্ময়বোধ চমৎকার ফোটে। ময়নার সারা মুখ জোড়া বিস্ময়। ঠোটে পাতলা হাসি। খানিকটা খুশিও হয়েছে। হাতের খালি ঝুড়িটা দোলাতে দোলাতে এগিয়ে এসে বলল, ও বাবু, তুমি এতদূর এয়েচো? ও মা গো!
তারপর ময়না তার ব্লাউজের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে একটা ছোট কাপড়ের থলে বার করল। তার থেকে আবার একটা সিকি বার করে বলল, এই নাও!
– এ কি!
–তোমার পঁচিশ পয়সা বাকি ছিল।
—তা বলে সেটা এখানে দিতে হবে? আর একদিন বাজার থেকে নিয়ে নিতে পারতুম না!
অন্য মেয়েগুলো,হেসে উঠল। একজন বলল, এই বাবুকে তো বাজারে প্রায়ই দেখি। অন্য মেয়েরা মাথা নাড়ল। তারা সবাই আমাকে চেনে, যদিও ওদের মুখ আমার কাছে অচেনা।
ময়দানে রফিকের সঙ্গে যে পাঁচটি নারীকে দেখেছিলুম, তাদের মধ্যে মিতুন নামের মেয়েটির সঙ্গে ময়নার মুখের বেশ মিল আছে। মিতুনের ভুরু প্লাক করা, মুখে প্রচুর প্রসাধন। কথা বলে আধো–আধো সুরে, সেই তুলনায় ময়নার মুখে ঘাম মেশানো ময়লা, কিন্তু ব্যবহার কত সাবলীল। একটা অদম্য প্রাণশক্তি ফুটে বেরুচ্ছে তার সারা শরীর দিয়ে। বাজারে ময়নাকে আমি শুধু বসে থাকা অবস্থাতেই দেখেছি, এখন বোঝা গেল সে বেশ লম্বা। তার কোমরটি অতি দর্শনীয়। এই মেয়েটিকে যত্ন করে খেলাধুলো শেখালে অলিম্পিক থেকে সোনা–রুপো কিছু একটা নিয়ে আসতে পারত মনে হয়।
ময়না জিজ্ঞেস করল, তুমি কোথায় যাবে, ক্যানিং?
–না, কাদাগোলা।
—সত্যি? হি–হি–হি–হি!
একজন দুঃখী দুঃখী চেহারার মধ্যবয়স্ক লোক এবারে কাছে এসে দাঁড়াল। এ কিন্তু বুড়ির অন্য পাশে বসা বিক্রেতাটি নয়। তবে এর চেহারা দেখলেই বাজারের দোকানদার বলে মনে হয়।
একে দেখে আমি একটু স্বস্তি বোধ করলুম। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে চার–পাঁচটি যুবতী মেয়ের সঙ্গে কথাবার্তা চালানো আমার কর্ম নয়। ময়না বার বার হেসে আমাকে নার্ভাস করে দিচ্ছে।
লোকটির থুতনিতে ছাগল–দাড়ি, মাথার চুল পাতলা, হেঁটো ধুতির ওপর সে যে ফতুয়াটা পরে আছে সেটা এককালে নিশ্চয়ই সাদাই ছিল। তার চোখ দুটি দেখলে মনে হয় কাজল টানা, তাতে গভীর দুঃখের ছাপ।
লোকটি নম্র গলায় জিজ্ঞেস করল, বাবু, কোথায় যাবেন?
—এদিকে কাদাগোলা নামে একটা গ্রাম আছে না?
–সেখেনে যাবেন? রাস্তা বেশ খারাপ, আপনারা যেতে পারবেন না।
–শোনো, আমাদের বাজারে একজন বুড়ি ডিম বিক্রি করতে আসত, তার সঙ্গে আমি দিদিমা সম্পর্ক পাতিয়েছিলুম।
ময়না আবার হি হি করে জোরে হেসে উঠল। তার হাসির ছোঁয়াচ লাগল অন্য মেয়েদের মুখে। কিন্তু তাদের হাসির মধ্যে আমার কথার সম্মতি আছে।
দুঃখী লোকটি অবাক ভাবে চেয়ে আছে আমার দিকে।
এদের কাছে আমি কোনো মিথ্যে কথা বলব না ঠিক করেছিলুম, কিন্তু এরা যে সত্যি কথা নিয়েও কৌতুক করে।
—সেই বুড়ি একদিন তার বাড়িতে আমায় নেমন্তন্ন করেছিল, খুব করে যেতে বলেছিল। আজ এদিকে এসেছিলুম একটা অন্য কাজে, তাই ভাবছি একবার ওর বাড়ি ঘুরে আসব। তোমরা কেউ তার বাড়ি চেন?
লোকটি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কে রে
ময়না ও আরো একটি মেয়ে একসঙ্গে বলল, ঐ যে কাদাগোলা থেকে আসে, আক্কাসের নানী।
আর একটি মেয়ে বলল, এই টেরেনেই তো রোজ ফেরে। দু’ চারদিন দেখছি না। একদিন আমাদেরকে পান খাওয়ালে!
লোকটি চিনেছে, মাথা নাড়ল দু’বার।
তারপর আমার দিকে ফিরে বলল, আপনি কাদাগোলায় যাবেন?
এটা নিছক প্রশ্ন নয়, এই সরল বাক্যটির মধ্যে যেন অনেক কিছু আছে।
সে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।
–তোমরা একটু রাস্তাটা যদি দেখিয়ে দাও!
—চলেন!
টিকিট চেকিং–এর কোনো ব্যাপার নেই, আমরা রেল লাইন ধরেই হাঁটতে লাগলুম। ট্রেনে আমিও কয়েকবার টিকিট ফাঁকি দিয়েছি, কিন্তু তার মধ্যে কত উত্তেজনা, রোমাঞ্চ, শিহরণ ছিল। এদের ব্যাপারটা একেবারেই নিরামিষ।
কৌতূহল দমন করতে না পেরে আমি লোকটিকে জিজ্ঞেস করলুম, তোমরা যে রোজ ট্রেনে যাতায়াত করো, তোমাদের পয়সা লাগে না বুঝি!
লোকটি অভিযোগের সুরে বলল, মাঝে মাঝে লাগে।
ময়না বলল, একটা কালো কোট আছে, মহা ঢেঁটিয়া!
আর একটি মেয়ে বলল, আজ লোকটাকে দেখলুম, ঢাকুরিয়া এস্টেশনে ডাঁড়িয়ে আছে, ডাঁড়কাকের মতন এদিক উদিক চাইছে।
ময়না বলল, ডাঁড়কাক না শকুনি!
তারপর শুরু হলো টুকিটাকি ট্রেনের গল্প। মেয়েরা ঐ লোকটাকে দিন্দা বলে ডাকছে। বোধহয় ওর নাম দিনু। কিংবা দিন্দাও কারুর নাম হতে পারে। কথা শুনে বোঝা গেল এই দিন্দা বেশ নিরাসক্ত ধরনের মানুষ। মাস খানেক আগে ট্রেনে ফেরার সময় তার টাকার গেঁজে চুরি গেছে। সে জন্য তার খুব হা–হুতাশ নেই। সে বলল, যে নিয়েছে সে কি বড়লোক হবে? দু’ দিন বাদে আবার যে– কে সেই। আমায় সুদুমুদু সুদ গুণতে হলো!
দিন্দার সঙ্গে কথা বলে আর একটা নতুন তথ্য জানতে পারলুম। এই যেসব ছোট ছোট দোকানদাররা গ্রাম থেকে জিনিসপত্তর কিনে শহরের বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে, এই সামান্য ব্যাবসার মুলধনের টাকাটাও মহাজনের কাছ থেকে ধার করতে হয়। তার সুদ টাকায় দশ পয়সা, প্রতিদিন!
ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার করলে বোধহয় আঠেরো পার্সেন্ট সুদ দিতে হয় বছরে। আর এই যে মহাজনেরা প্রতিদিন দশ পার্সেন্ট সুদ নেয়, সেটা বছরের হিসেবে কত পার্সেন্ট হয় সে অঙ্ক কষার সাধ্য আমার নেই। চাষীর উৎপাদন আর শহরের ‘ক্রেতা, এর মাঝখানে যে কতগুলি মিডলম্যান থাকে, তার সঠিক হিসেব কি কেউ রাখে?
একবার বন্ধুবান্ধবরা মিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম কাকদ্বীপে। গঙ্গায় এক মাছ– ধরা নৌকো থামিয়ে ইলিশ কিনতে চেয়েছিলুম, চকচকে ঝকঝকে গোটা দশেক ইলিশ দেখেছিলুম সেই নৌকোয়, কিন্তু জেলেরা বলেছিল, ও ইলিশ বিক্রির নয়। মহাজনের কাছ থেকে দাদন নেওয়া আছে, সব মাছ আগে তাকে দিতে হবে।
এই মহাজনদের কী রকম দেখতে হয়? যারা সুদে টাকা খাটায়, তাদের মহাজন নাম রেখেছে কে?
রোদের ঝাঁঝ এমন যে সারা গায়ে যেন বিছুটি লেগেছে। ময়নাদের কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই, ওরা এই পথে নিত্য তিরিশ দিন যাতায়াত করে। আমারও হাঁটতে খারাপ লাগে না, তবে এই অ্যাডভেঞ্চারটি শীতকালে হলে আরো মনোরম লাগত।
রেললাইন ছেড়ে আমরা চলেছি মাঠের রাস্তা দিয়ে। দুটি মেয়ে একটু আগে বিদায় নিয়েছে। আরো দু’জন এখন চলে গেল। ময়না আর দিন্দা থাকে একই গ্রামে।
ময়না আগে চাল চোরাচালানের কাজ করত, তখন সে বেশ ছোট ছিল, তবে সেই কারবারে লাভ ছিল বেশি, ঝুঁকিও ছিল অবশ্য। এখন চালের কারবারে ভাটা পড়ে গেছে।
সেই একটা সময় গেছে বটে। জেলায় জেলায় কর্ডন, এ জেলার চাল অন্য জেলায় নেওয়া যাবে না। র্যাশনিং ব্যবস্থা অনুযায়ী প্রত্যেককে কম চাল খেতে হবে। কিন্তু শহরে যাদের ক্রয়ক্ষমতা আছে, তারা চাল কিনবেই, বেশি দাম দিয়ে কিনবে, তারা র্যাশনিং ব্যবস্থা মানে না। ডিমাণ্ড থাকলে সাপ্লাই লাইনও যে–রকম ভাবেই হোক চালু থেকে যায়। সরকারের অদ্ভুত নীতির ফলে বাংলার গ্রামের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বে–আইনী চালের কারবারে নেমে পড়ে। লোক্যাল ট্রেনে এক সময় যাত্রীর বদলে চোরাচালানীরা বেশি থাকত। স্টেশন আসবার আগে রেল লাইনে ধপাধপ করে পড়ত চালের বস্তা।
সেই সময় চালের চোরাচালানীদের দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকাতুম। মনে হতো, গ্রামের বউ–ছেলে–মেয়েরাও ক্রিমিনাল হয়ে গেল? তাদের কারুর সঙ্গে কথা বলিনি। ময়নাও ওদেরই একজন। কিন্তু ময়নার মুখ দেখলে মনে হয় না যে ওর জীবনে কোনো পাপের দাগ আছে।
এই রকম প্রাণচঞ্চল মেয়ে, অথচ স্কুলে যাবার সুযোগ পায়নি, খেলাধুলোও করে না। ওর এখন যা বয়েস, এই বয়েসের মেয়েরা গল্প–উপন্যাসে গ্রাম্য প্রেমের নায়িকা হয়, কিন্তু ওর কি প্রেম করারও সময় আছে? রাত থাকতে থাকতেই উঠে, এতটা পথ হেঁটে, ট্রেন ধরে গড়িয়াহাট বাজারে পৌঁছতে হয় সাতসকালে! ফেরে এইরকম মধ্যদুপুরে, তারপর বাড়িতে গিয়ে খাবে, কে জানে রান্না করা আছে কি না। বিকেলে আবার হাটে যাবে সওদা করতে, মহাজনের টাকা শোধ করবে…সন্ধের পর গ্রামের জীবনে আর কিছু ক্রিয়াকলাপ নেই। সারাদিন যে মেয়েটিকে এত খাটতে হয়, তা তো খেলাচ্ছলে নয়। সুতরাং যে–কাজে সামান্য বেশি রোজগার, সেই কাজেই ও ঝুঁকবে।
সেই বাহাত্তর বছরের ডিমওয়ালি বুড়িও এতখানি পথ হেঁটে যেত? এ যে কল্পনা করাই শক্ত। তার একটা নাতি আছে, সে ঐ বুড়িকে খাওয়াতে পারে না?
ওরা বলল, বুড়ির নাতির নাম আক্কাস। স্টেশনের পান–বিড়িওয়ালা যে বলল, বুড়ির নাতির নাম লোচন? দু’জন তা হলে আলাদা নয় তো? আমি কি ভুল বুড়ির কাছে যাচ্ছি?
ময়নাকে জিজ্ঞেস করলুম সে কথা।
ময়না বলল, ঐ আক্কাস আর লোচন একই মানুষ গো! এস্টেশানে ওকে লোচন লোচন বলে, একটা চোখ কানা কিনা!
দিন্দা বলল, ছোঁড়াটা বড় চুলবুলে। কাজকর্মে মন নেই, উকু ঝেন্ঝাটে বেশি মন।
ময়না প্রতিবাদ করে বলল, আহা, ওর কি দোষ? গায়ে খেটে রোজগার করলেও দুটো গুণ্ডো জোর করে পয়সা আদায় করে ওর কাছ ঠেঙে। ও তাই জেদাজেদি করে।
দিন্দা বলল, ঐ করেই তো একটা চোখ খোয়ালে। তারপর আবার গারদে গেল। আমাদের কি বাবু ওসব পোষায়? ঐ গুণ্ডোদের সঙ্গে পারবে কেন? আমাদের সঙ্গে বাজারে বসলেই পারত। তা নয়, ও এস্টেশানেই থাকবে!
আমি বললুম, আবার তো শুনলুম মারামারি করেছে।
দিন্দা উদাসীনভাবে বলল, ও লেগেই থাকবে। বুড়িটারই যত কষ্ট।
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। ঐ বুড়ির ব্যবহার, হাসির ভঙ্গি, চেহারার মধ্যে আমি আমার দিদিমার অনেকটা আদল খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু বুড়ি আমার মধ্যে কী পেয়েছে? আমার প্রতি তার এত স্নেহ কেন?
আমি জিজ্ঞেস করলুম, হ্যাঁ গো, ঐ বুড়ির নাতি যে আক্কাস বা লোচন, তার চেহারার সঙ্গে কি আমার মিল আছে?
ময়না কাঠঠোকরা পাখির মতন হি হি হি হি করে তীব্র গলায় হেসে উঠল।
দিন্দা দু’ দিকে ঘাড় নেড়ে বলল, না গো বাবু, সে কোনো মিল নেই। আপনি হলেন গে ভদ্দরলোক।
আমি বললুম, আহা, ভদ্দরলোক আর অন্য লোকের কী আছে। চেহারার মিল থাকতে পারে না! এই যে ময়না, ওর সঙ্গে তো এক মেমসাহেবের চেহারার মিল আছে তার নাম নাদিয়া কোমানচিয়া।
ময়না আবার হাসিতে শরীর দুলিয়ে দেয়।
দিন্দাকে বললুম, তোমাকেও ধুতি আর পাঞ্জাবি পরিয়ে দিলে আমাদের পাড়ার একজন ইস্কুল মাস্টারমশাইয়ের মতন দেখাবে!
দিন্দা সহজে হাসে না। সে অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আমার বাপ– চোদ্দপুরুষে কেউ ইস্কুলে যায় নে।
তারপর সে থমকে দাঁড়িয়ে খালি দূরের এক জোড়া তালগাছ দেখিয়ে বলল, ঐ উদিকে আপনার হলো গে কাদাগোলা। আর আধ কোশ টাক।
আমি বললুম, এতখানি রাস্তা এলুম, কই কাদা পাইনি তো। সবাই কাদার ভয় দেখাচ্ছিল?
ময়না বলল, এবার যান না উদিকে!
দিন্দা বলল, ওদিকটেয় নাবাল জমি তো, আগে নদীর গবভো ছিল, তাই ওদিকে পাঁক হয়। হ্যাঁ, একটু বেশিই হয়। যেতে আপনার কষ্ট হবে।
–কতখানি কাদা, হাঁটু ডুবে যাবে?
দিন্দা খানিকটা সান্ত্বনার সুরে বলল, না তা নয়। হাঁটুর কমই হবে! এই ধরুন গে, এতকখানিক।
ময়না আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আপন মনে বলে উঠল, আ মরণ, আজ এত শকুন কেন? আবার কার বাড়ি গোরু ম’লো?
আমিও ওপরে তাকিয়ে দেখলুম, আকাশ একেবারে শকুনে শকুনে ছয়লাপ। যতক্ষণ আকাশে থাকে ততক্ষণ পাখি হিসেবে শকুনগুলোকে দেখতে খারাপ লাগে না।
দিন্দা ওপরে তাকিয়ে কী যেন বিড়বিড় করে বকছে। তারপর হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় সে এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
ময়না ডান দিকে একটা সরু রাস্তা দেখিয়ে বলল, এইটে আমাদের গাঁ।
দিন্দা বলল, বাবু, আপনি এখন যাবেন? আমাদের গাঁয়ে গিয়ে একটু জিরিয়ে, জলটল খেয়ে নিলে হতো না!
–না–না, তার দরকার নেই। দেরি হয়ে যাবে। আমায় আবার ফিরতে হবে তো?
—বেশি দূর নয়, আমাদের গাঁ ঐ তো হেথায়। গরিবের বাড়িতে একটু বসবেন। আমরাও মুখে কিছু দিয়ে নিতুম। তারপর একজন কেউ যেতুম আপনার সঙ্গে।
–কেন, আমি একলা যেতে পারব না?
—তা পারবেন। তবে কী দেখতে গিয়ে কী দেখবেন সেই হলো কথা। তুই কী বলিস রে, ময়না? কাদাগোলায় পরশুদিন কে যেন মারা গ্যাছে শুনছিলুম যেন। যদি সেই বুড়িটাই হয়।
আমার বুকটা ধক্ করে উঠল। আমি দেরি করে ফেলেছি।