নীলাঞ্জনা পিসি
নীলাঞ্জনা পিসি হাতে মুখে জল দিয়ে শাড়ীটা বদলে এসে ডাক দিলেন, সেলিনা। সাড়া দিয়ে সেলিনা বলল, আপনি কি প্রান্তিক ভাইযের ঘরে আসবেন না আপনার ঘরে দেব? বললেন, এ ঘরে নিয়ে এস। আমি তাকালাম সেলিনার দিকে। আমি ইঙ্গিতে ওকে কি যেন বলতে চাইছিলাম, সেলিনা বলল থাক না, ওকে কেন অপমান করতে চাইছেন। ওতো আছে ওর নিজের জায়গায়। হায় বোকা মেয়ে, তুমি বুঝবেনা যে, ভয়টা তোমাকে ন্য ভয় নীলাঞ্জনা পিসিকে। কি জানি, যদি প্রশ্ন করে জানতে চান, কে পরিয়ে দিল, প্রান্তিক?
সেলিনা কফি আর বিস্কুট নিয়ে নীলাঞ্জনার ঘরে গেল, পর্দাটা খোলা। দুটো ঘরের অবস্থান এমন যে পর্দা বা দরজা বন্ধ না করলে একটা ঘরেরই দুটো অংশ বলে মনে হয়।
দেখতে পাচ্ছি সেলিনা ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে, অপলক তাকিয়ে আছেন পিসি ওর দিকে, আর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কি যেন দেখছেন। সেলিনা বলল, অমন করে কি দেখছেন পিসি। চিন্তায় যেন ব্যাঘাত ঘটল এমন ভাবে নীলাঞ্জনা বললেন, না কিছুনা। তারপর জানতে চাইলেন কখন এসেছো? সন্ধ্যার একটু আগে। কাল এলেনা কেন? বা আপনাকে তো বলে গেলাম, আমার একটু কাজ আছে আসতে পারবো না।
নীলাঞ্জনা এতক্ষণে কফি খাওয়া শেষ করে বললেন, খোঁপায় ফুলগুলো কে পরিয়ে দিয়েছে? যা ভয় পেয়েছিলাম তাই হল। সেলিনা কি একটু লজ্জা পেল? এই কি প্রথম মনে হতে লাগল, সত্যি কথা বলবে কীনা। কিন্তু সেলিনাতো সেলিনা, বলল, খারাপ লাগছে? তা হলে খুলে ফেলি? এই দেখ মেয়ের অভিমান, আমি কি তাই বলেছি। তারপর বললেন আমার কাছে এস। সেলিনা কাছে এলে, ওর কপালে একটি চুম্বন একে দিয়ে বললেন, ভারি সুন্দর লাগছে। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে আলমারীর চাবি বের করে সেলিনাকে দিয়ে বললেন, ঐ আলমারিটা খোল। সেলিনা ইতস্তত করে বলল, আমি খুলব? কেন তুমি কি খুলতে জানো? পিসি। আমি দেখতে পাচ্ছি, সেলিনার চোখ ছল ছল করে উঠছে। কিন্তু নীলাঞ্জনার সে দিকে কোন ভূক্ষেপ নেই। বললেন, কি হলো তোমাকে খুলতে বলছিনা? ও বলল কোন চাবি দিয়ে খুলব বলে নীলাঞ্জনার দিকে চাবির রিং এগিয়ে দিল। নীলাঞ্জনা বললেন, এই চাবি দিয়ে খুলবে। সেলিনা একটু দ্বিধান্বিত হয়েও আলমারীটা খুলে ফেলল। নীলাঞ্জনা বললেন, ওই উপরেব তাকের থার্ড প্যাকেটটা নিয়ে এস। সেলিনা নিয়ে এলে নীলাঞ্জনা বললেন, খোল প্যাকেটটা। খুললে বেরিয়ে এল ময়ুর রং-এর একেবারে আনকোরা একটা শাড়ী, অপূর্ব রঙের বাহাব। নীলাঞ্জনা বলেলেন, ওটা দাও আমাকে। তারপর শাড়ীটা হাতে নিয়ে সেলিনাকে বললেন, গত নববর্ষে হঠাৎ খেয়ালে কিনেছিলাম এটা, ঠিক নিজে পরব বলে কিনিনি, তবু প্রান্তিক বলেছিল, পিসি এ শাড়ীটায় তোমাকে ভীষন মানাবে। বলেছিলাম ধ্যাৎ ঐ শাড়ী পড়ার বয়স আছে নাকি? উত্তরে ও কি বলেছিল জান? উৎসুক হয়ে তাকায় সেলিনা শোনার অপেক্ষায়। নীলাঞ্জনা বললেন ও সেদিন বলেছিল, আসলে তোমার মনটা মরে গেছে পিসি তা না হলে বয়স তোমার এমন কিছু নয় যে এই শাড়ী পরতে তোমার অরুচি হবে। সেলিনা বলল ঠিকইতে পিসি। প্রান্তিক ভাইতো কোন অন্যায় কথা বলেননি, আপনার মত সুন্দরী আমি খুব কমই দেখেছি। নীলাঞ্জনা সেলিনার কথাটাকে ঠাট্টার ছলে উড়িয়ে না দিয়ে বললেন, সব সন্তানের কাছে তার মা সুন্দর। তোমারও তাই মনে হয়েছে সেলিনা। যাক গে সে কথা। প্রান্তিকের সে দিনের সে কথায় খুব একটা গুরুত্ব দিইনি যে আমার মন মরে গেছে। আপন খেয়ালে যে শাড়ীটা কিনেছিলাম, পরা আর তা হয়নি। প্যাকেট সমেত ওটাকে যেখান থেকে তুমি নিয়ে এলে, ওখানেই ওটা আছে সেই প্রথম দিন থেকে। কেন? পরলেন না কেন? জানতে চাইলো সেলিনা। নীলাঞ্জনা বললেন সে তো ঠিক জানিনা সেলিনা, আসলে পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছিলাম প্রান্তিকই ঠিক, জোর করে মনটাকে যতই সতেজ রাখার চেষ্টা করিনা কেন, জলের অভাবে তা যে কখন শুকিয়ে যায় বুঝতেও পারিনা আমরা। একটা হতাশা ফুটে ওঠে নীলাঞ্জনার কণ্ঠে।
শুয়ে শুয়ে ভাবছি, কি বলতে চাইছেন পিসি? হ্যাঁ আমি জোর করে ঐ শাড়ীটা কিনিয়েছিলাম, কারণ কথাচ্ছলে একটা শাড়ীর দোকানে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন আমার ভীষণ পছন্দের শাড়ী, রঙটাও অপূর্ব। আমার ভীষণ মনে রাখবার মত রঙ। বলেছিলাম, তা হলে শাড়ীটা কিনে নাও। বলেছিলেন, আজ টাকা নেই, আর এক দিন কিনব। তাইতো জোর করেছিলাম।
সেলিনা বলল, বুঝতে পারছি প্রান্তিক ভাইয়ের প্রতি অভিমানে আপনি ও শাড়ীটা পরেননি। আজ তা হলে আমার অনুরোধে এই শাড়ীটা পরুন। সত্যি অপূর্ব লাগবে আপনাকে। ভাবছি পরবো, তারপর বললেন, এবার এই চাবিটা নিয়ে লকারটা খুলে ফেলতো। ওর ভিতর আমার গয়নার বাক্স আছে নিয়ে এস। সেলিনা বুঝতে পারছেনা এসব তাকে দিয়ে করানো হচ্ছে কেন? উনি নিজেও তো একাজটা করতে পারতেন। কিন্তু এটা তার মনের ভাবনা। বাইরে সে নীলাঞ্জনার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে চলল।
আমার কেমন যেন সন্দেহ হতে থাকে, পিসীর আজকের আচরণ মোটই স্বাভাবিক নয়। গয়নার বাক্সটা নিয়ে এলে, নীলাঞ্জনা বললেন, এই আমার যাবতীয় গয়না। বলত সেলিনা এই শাড়ীর সাথে কোন গয়না গুলো আমাকে মানাবে। সেলিনা বলল, আমিতো ঠিক অতশত বলতে পারবো না পিসি। কারণ গয়না পরার অভ্যেস খুব একটা নেই। আর তা ছাড়া আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে বেড়াতে গেলে, বা ছোট খাট উৎসবে যে গয়না মানাবে, কোন পার্টিতে নিশ্চয়ই তা মানাবেনা। নীলাঞ্জনা বললেন আমি কোথাও যাব না, তোমার সামনেই বসে থাকবো। তুমি শুধু দেখবে আমাকে, দেখবে আর বলবে, আমি কি আগের মত আছি তোমার চোখে আমাকে মানাবে, শুধু সেই গয়না গুলো বের কর। সেলিনা বলল, প্রান্তিক ভাইকে ডাকি। কেন ওকে কেন? শুধু আমি দেখব উনি দেখবেন না? তা ছাড়া যে সাজ আমার ভাল লাগবে ওনারতো তা নাও লাগতে পারে। নীলাঞ্জনা হঠাৎ বললেন প্রান্তিককে তুমি খুব ভালবাস তাইনা? আমি লজ্জায় অন্য দিকে ফিরে শুলাম। সেলিনা বলল, শুধু প্রান্তিক ভাই কেন, আমিতো আপনাকেও ভীষণ ভালবাসি? আমি বিশ্বাস করি সেলিনা, সত্যিই তুমি আমায় ভালবাস, তা না হলে তোমার জন্য এত অভাব বোধ করি কেন? কেন একদিন না এলে এমন শূণ্য শূণ্য লাগে। কিন্তু কি মনে হয় জান আমার? কি? প্রান্তিককে তুমি এত ভালবাস বলেই, আমাকে তুমি এত ভালবাস। তারপর কি যেন বলতে গিয়ে সেলিনাকে বশ্লেন দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে এস। সেলিনা বলে থাকনা। কেন আমাকে বিশ্বাস করতে পারছনা? সেলিনা আর কোন কথা না বলে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ফিরে আসে। নীলাঞ্জনা বললেন, প্রান্তিককে আর একজন ভালবাসে তার মন প্রান দিয়ে, তাই তুমি তোমার চঞ্চলতা, চপলতা, হাসি ঠাট্টার মাঝে নিজের বেদনাকে লুকিয়ে রেখে প্রান্তিকের ভালবাসার পাত্রীর জন্য পথ প্রশস্ত করে চলেছে এই তো।
তীব্র প্রতিবাদ করে বলে উঠলো সেলিনা না না পিসি এ মিথ্যা, আমি রেহানার মত ওকে ভালবাসি না। ওমন করে জীবনের সর্বস্ব দিয়ে, শুধু প্রান্তিক ভাইকে কেন কাউকে ভালবাসিনা। তারপর বলল আমি অনেক তুচ্ছ পিসি, রেহানার ভালবাসার কাছে, আমি একেবারে খেলার সামগ্রী মাত্র। কেঁদে ফেলল সেলিনা। ওকে নিজের বুকের পরে টেনে নিয়ে, চোখের জল নিজের আঁচলে মুছিয়ে দিতে দিতে নীলাঞ্জনা বল্লেন, আমি জানতাম সেলিনা কান্না ছাড়া তোমার কোন পথ নেই। যতই তুমি বক্সিং-এর মেয়ে হিসাবে নিজের পরিচয় দিতে ভালবাসনা কেন, আসলে তোমার মন রেহানার থেকেও নরম। আর নরম বলেই মুখে তুমি এত জোর দেখাও। রেহানাকে দেখিনি, হয়তো সে তোমার থেকেও সুন্দরী, হয়তো প্রান্তিককে ভালবেসে সে পৃথিবীকে ভুলে থাকতে পেরেছে। অবশ্য এ শুধু আমার অনুমান মাত্র। আর তুমি, সবাইকে ভালবেসে, প্রান্তিকের প্রতি তোমার ভালবাসাকে ভুলে থাকতে চেয়েছে। রেহানার কান্না হয়তো একদিন শুকিয়ে যাবে, কিন্তু সেলিনা এই ব্যঙ্গ বিদ্রূপ হাসি ঠাট্টার মাঝে যে চোখের জল তুমি অহর্নিশি ফেলে চলেছে তা শুকাবে কি করে?
এমন তীব্র আক্রমণ, মনের অষ্ঠমহলেব সত্যকে এমন করে তুলে নিয়ে আসার স্পষ্ট ঘোষণায় বিব্রত হয়ে পড়ে সেলিনা। তার তো বয়স এমন নয়, তাই আজ যা সে হেলায় হারিয়ে ফেলতে পারে, জীবন অভিজ্ঞতার আলোকে অভিজ্ঞ নীলাঞ্জনারা তা পারে না। তারা জীবনকে বুঝতে শিখেছেন অভিজ্ঞতার কষ্টি পাথরে যাচাই কবে। কিন্তু তবু সেলিনা একমত হতে পারে না নীলাঞ্জনার সাথে, বলে না পিসি এ আপনার ভুল। আমার কোন দুর্বলতাই প্রান্তিক ভাইকে স্পর্শ করেনি। আমিতো জানি তাকে। হয়তো আপনি আমার থেকেও অনেক বেশি জানেন, তবু বলব, আপনিও প্রান্তিক ভাইকেভাল চেনেননি। ক্ষণিকের দুর্বলতা, ক্ষণিকের ভাললাগা দিয়ে কোন মানুষের বিচার করা যায় না পিসি। তারপর বলল আমি যখন হাসপাতালে ছিলাম, তখনতো রোজ প্রান্তিক ভাই যেতেন আমাকে দেখতে। মান, অভিমান, অবুঝ জেদে মন যে একেবারে কখনো দুর্বল হয়নি–তা কিন্তু নয় পিসি। কিন্তু সে দিন আমি আর একজনকেও দেখেছি, দেখেছি তার নিবেদিত আত্ম সমর্পণকে, তবুতো রেহানার উপর থেকে এক বিন্দু টলানো যায় নি প্রান্তিক ভাইকে। আসলে আমার মনে হয়, ও কারো কাছে ধরা দিতে চায় না। ও যেন দূর আকাশের তারকা মাত্র। এরপর খিল খিল করে হেসে উঠে সেলিনা বলল, কি পাগল না আমি পিসি? যা নয় তাই ভেবে দুঃখ পাই। তারপর বলল এবার এই শাড়ীটা পরুনতো। নীলাঞ্জনা বললেন, হ্যাঁ এই পরি, তার আগে গয়না গুলো পছন্দ কর। সেলিনা, সত্যি নীলাঞ্জনাকে যা মানাতে পারে এমন বেশ কয়েকটি গয়না পছন্দ করে নীলাঞ্জনার হাতে দিল। নীলাঞ্জনা একটু হেসে তা গ্রহণ করল। তাবপর সেলিনাকে বল, এই ঘরের লাগোয়া একটা বাথরুম আছে। যাও ভাল করে চোখে মুখে জল দিয়ে এসো তো। কেন? তারপরে বলল একেবারে বাড়ী গিয়েই চোখে মুখে জল দেব তা ছাড়া রাতও তত বাড়ছে। নীলাঞ্জনা বললেন, আমি তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসব। আনন্দে হাততালি দিয়ে সেলিনা বলল আপনি যাবেন? হ্যাঁ যাবে, তবে একটা সত্ত্বে। কি? কোন সন্তানকি তার মাকে তোমার মত করে কথা বলে। না বুঝতে পেরে তাকিয়ে থাকে সেলিনা। নীলাঞ্জনা বললেন, প্রথম দিনই তুমি বলেছিলে প্রান্তিকের মা আমি নাইবা হলাম, কিন্তু তোমার মা হতে আপত্তি নেইতো।
না আগে বুঝতে পারেনি সেলিনা, কোন হৃদয়ের নিঃসঙ্গতা এমন করে কোন পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যায় কি না। সেদিন ছিল নীলাঞ্জনাকে বোঝার স্পৃহা। আর আজ নিজেকে বোঝার তাগিদ। কি চাই আমি? আমার পথ কি ঠিক পথ? বলল, কিন্তু পিসি, আমি কি পারব তোমার যোগ্য মেয়ে হতে। আবারও নীলাঞ্জনা তাকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে বললেন, একবার আমার বুকে কান পেতে শোনতো মেয়ে এ কিসের হাহাকার। আর তোকে বুঝতে পারব না? যে তুই, কি ভাবে আমার সমস্ত হৃদয়টাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর প্রায় ভগ্ন কণ্ঠে বলেন তোকে যদি আরো কিছুদিন আগে পেতাম সেলিনা। নিজেকে তাহলে কিছুতেই এমন করে শেষ হতে দিতাম না। সেলিনা অবাক। মুগ্ধ বিস্ময়ে একেবারে নিশ্চল। দুটি পা যেন নিথর। কোনদিকে এগোবার শক্তি নেই। নীলাঞ্জনা তা বুঝতে পেরে নিজেই সেলিনাকে নিয়ে গেলেন বাথরুমে। তারপর চোখে মুখে জল দিয়ে, আবার তাকে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। এবং ময়ুব রঙের শাড়ীটি তার হাতে দিয়ে বললেন আমি ও ঘরে যাচ্ছি, ততক্ষণে, শাড়ীটা পরে ফেলতো। আমি? হারে মেয়ে, তুই না পরলে কি আমি পরবো? পিসি। ঠিক আছে আর কথা বাড়াতে হবে না, তাড়াতাড়ি পরে ফেল।
অগত্যা সেলিনাকে শাড়ীটা পরতে হয়। মিনিট দশেক পরে শাড়ীটা পরে ফিরে এলো, নীলাঞ্জনাতে চোখ ফেরাতে পারেন না দেখে। অপূর্ব মানিয়েছে সেলিনাকে। কিন্তু বড্ড বেখাপ্পা লাগছে খোঁপা। ও টাকে সুন্দর করে বেনী করে দিলে ভাল লাগতো, কিন্তু কোথায় যেন বাধা, পারলেন না বলতে নীলাঞ্জনা। হয়তো ওর ভিতর আছে অনেক স্মৃতি। তাই ওদিকে না গিয়ে, তার জন্য যে গয়না পছন্দ করেছিল সেলিনা, এক এক করে সব গয়না নিজের হাতে পরিয়ে দিলেন তাকে। তারপর আয়নার কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, দেখতো ঠিক আছে কি না। আমি কি করে বলব, তুমিই দেখনা। নীলাঞ্জনা ওর খোঁপার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, ওটা থাকবে না খুলে নুতন করে বেঁধে দেব? তোমার যা ভাল লাগে। না থাক। তারপর, সন্ধ্যায় যে সাজে সাজতে হয় সেই সাজে সাজিয়ে দেওয়া হল সেলিনাকে। সাজানো শেষ হলে বললেন, চলতো প্রান্তিকের কাছে? কেন আবার ওর কাছে কেন? বাঃ তোর সাজে কোথাও কোন ত্রুটি আছে কি না ও দেখুক।
এই বোধ হয় প্রথম লজ্জায় ভেঙে পড়তে চাইল সেলিনা। বলল না পিসি, আমি যাব না। কেনরে? এই অল্প সময়ে এমন কি হল, যাতে ওর কাছে যাওয়া যাবে না। না ঠিক তা নয় পিসি। আসলে, প্রান্তিক ভাইয়ের ইচ্ছেয় একদিন যে শাড়ী তোমার জন্য কেনা হয়েছিল, সেই শাড়ী পরে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারব না আমি। বেশ, নীলাঞ্জনা বললেন, তা হলে ওকেই ডাকছি। বলে আর অপেক্ষা না কবে ওখান থেকেই চিৎকার করে বললেন, প্রান্তিক একবার এদিকে এসতো।
এতক্ষণে ওদের সব কথাই আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু সব কথা শোনা যায় নি। যা শুনেছি, তাতে মনে হয় না, সেলিনার সামনে আমি স্বাভাবিক হতে পারবো, সেলিনাও পারবে কী না আগের মত স্বাভাবিক হতে জানিনা। তবু পিসির ডাকে সাড়া দিয়ে এলাম। সত্যি অপরূপা যেন। এরই মধ্যে উধাও বেমানান খোঁপাটি। নীলাঞ্জনা বললেন, তোমরা কথা বলতে থাক, আমি আরেক কাপ চা খাব। তোমরা খাবে? আমি বললাম, আমি খাব, কিন্তু তোমার মেয়ে খাবে কি না জানি না।
অর্থাৎ প্রান্তিক সবই শুনেছে, ধরে নেয় সেলিনা। বলে আমিও খাব পিসি। নীলাঞ্জনা চলে গেলে, সেলিনা বলে, পিসি জোর করে পরিয়ে দিলেন। যেন আত্মপক্ষ সমর্থনের কৈফিয়ৎ দিচ্ছে সেলিনা। বললাম, মা তার মেয়েকে পরিয়ে দিয়েছেন, এটাই তো স্বাভাবিক নিয়ম। সেলিনা প্রতিবাদ করে বলল, হয়তো স্বাভাবিক নিয়ম, কিন্তু আমার কাছে এটা অস্বাভাবিক। কেন? এর কোনটার প্রতি আমার কোন অধিকার নেই। কেন? নেই কেন? কে আমি নীলাঞ্জনা পিসির? তুমি তার মেয়ে সেলিনা। পিসির সম্পর্কে তুমি কিছুই জানো তাই এসব বলছ। যদি তুমি জানতে, তার জীবনের কোন শূণ্যতাতুমি ভরে দিয়েছে, তা হলে একথা বলতে না।
তারপর হঠাৎ তার দিকে তাকিয়ে বললাম, পিসিকে বলনা মেকআপটাকে একটু খানি মডার্ন করে দিতে। কথাটা শুনতে ভুল হয় না নীলাঞ্জনার।
তিন কাপ চা নিয়ে এসে বললেন, যদি ওল্ড বলে কিছু মনে হয়, নিজেই তো তাকে মডার্ন করে দিতে পারো। পিসির উপর দোষারোপ করে কি লাভ? উত্তরে বললাম, লাভ লোকসানের কথা নয় পিসি, আসলে অধিকার। মা মেয়ের অধিকারে আমি বাইরের লোক, আমার প্রবেশাধিকার কি ঠিক হবে।
সবটা হয়তো ঠাট্টা, কিন্তু সেলিনার কেন যে সর্বাঙ্গ জ্বলে যেতে লাগল বুঝতে পারছেনা। তবে কি প্রান্তিক ভাই এসব চান নি? ক্ষণিকের জন্যও কি মনে হয় নি, সেলিনা অপূর্ব তুমি, সুন্দর তুমি, তোমাকেও ভালবাসা যায়।
সেলিনা বলল, আপনার যদি হিংসা হয়ে থাকে, পিসিকে আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিচ্ছি বলে, আপনি আসুন না, আমার বক্সিংএর রিং-এ। যদি পারেন আমাকে হারিয়ে দিয়ে ছিনিয়ে নিন না পিসিকে। পিরবো না। আমার না উত্তরে বলল পারবেন কি করে, আপনার তো সামান্য পছন্দটুকুর পর পর্যন্ত কোন অধিকার নেই, আপনি দাবি করবেন পূর্ণাঙ্গ মানুষটির অধিকার?
মনে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে সাবলীল ভাবে। মনে মনে ভাবি, এমন করে বলতে পারে কী করে? কোন লজ্জা বা সঙ্কোচ কি তার পথরোধ করে দাঁড়ায় না? তারপর যেন কত ব্যস্ত, এমনি দ্রুততায় বলল, কি হল, খুলুন না তাড়াতাড়ি, সময় যে বয়ে যাচ্ছে।
এ সেলিনাকে অস্বীকার করা যায় না। তার দাবি, তার জেদ, তার অভিমান, না মেটা পর্যন্ত যেন রেহাই নেই। আজ সেলিনার উপর কোন দাবি নয়। ও আজ পিসির হয়েই থাকুক। তার শূন্য হৃদয় ভরে উঠুক সেলিনার দুরন্তপনার স্পর্শে, ভালবাসায়, আর শ্রদ্ধায়। বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট দশেক পরে, আবার আমার ঘরে এসে বলল, কই চলুন। কোথায়?
এখনো রাত বেশী হয় নি। একটা খালি ট্যাক্সি পাওয়া দরকার। ওকে ওদের বাড়ীতে পৌঁছিয়ে দিয়ে আবার ফিরে আসতে হবে। উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে পিসি এবং কিছুক্ষণের মধ্যে সত্যি সত্যি পাওয়া গেল একটা ট্যাক্সি। কিছুতেই যাবে না। তারপর অবশ্য রাজী হয়েছে, তবে যাতায়াতে যা হবে তার থেকে ৫ টাকা বেশী দিতে হবে। পিসি তাতেই রাজী। আমার আর যাওয়া হয়না।
সেলিনা বাড়ীতে বেল দিতেই রেহানা দরজা খুলে দিলো। আর সামনে নীলাঞ্জনাকে দেখে অবাক হয়ে বলল, আপনি? আমাকে চেন কি? না মানে। সরাসরিই বল না আমাকে চেন কি না। ওর অবস্থা তো তথৈবচ। কিছু বলতেই যেন ভয় পাচ্ছে। সেলিনা পাশে এসে বলল। রেহানা আমার দিদি। সেতো বুঝতেই পারছি। কিন্তু ও আমাকে চেনে কী না, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে এত দ্বিধা কিসের? তবুও কোন উত্তর না দিয়ে এক পাশে সরে দাঁড়িয়ে বলল ভিতরে আসুন। নীলাঞ্জনা ভিতরে ঢুকতেই তাকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করল রেহানা। বলল, চলুন, ভিতরের ঘরে মা আছেন। রেহানা নীলাঞ্জনাকে ভিতরের ঘরে, যেখানে আফরোজ বেগম আছেন সেখানে নিয়ে এসে বলল, আমার মা। সেলিন্না সম্ভবত আগেই কিছু বলে থাকবে। নীলাঞ্জনা নমস্কার করতে আফরোজ বেগম বললেন,কি সৌভাগ্য আমার আপনি এসেছেন আমার ঘরে। কেন, আমি কি আসতে পারি না। আপনি এবং আপনার মেয়েরা এত করবেন। আর আমি সামান্য আসতে পারবো না। তা হয় নাকি? রেহানা তখনো দাঁড়িয়ে আছে দেখে আফরোজ বেগম বললেন, যা তো মা, ওনার জন্য এক কাপ কফি বা চা যা হোক নিয়ে আয়। রেহানা, রান্না ঘরে গিয়ে চায়ের জল বসিয়ে চলে এল নিজের ঘরে, সেলিনাও আছে ও ঘরে। ভীষণ ভাল লাগছে সেলিনাকে। সত্যি সাজলে ওকে এত ভাল লাগে, যা কল্পনাও করা যায় না। রেহানা অকারণ ওকে জড়িয়ে ধরল। সেলিনা একটু হাসল তারপর বলল, আচ্ছা রেহানা, আমি ওখান থেকে আসলে দেখি রোজ আমাকে জড়িয়ে ধরিস, কি পাস এতে। আর কেন যে তুই এত ভীরু, কেন যে তুই তোর দাবি প্রকাশ করতে পারিসনে, কেন যে মিছিমিছি কষ্ট পাস আমি বুঝি না। তারপর বলল, না রেহানা, আমি তোর হয়ে আর এত প্রক্সি দিতে পারবো না। এবার থেকে তোর নিজের জিনিষের দায়িত্ব নিজে বুঝে নিবি। আমার দ্বারা আর কিচ্ছুটি হবে না। আর তাছাড়া আজ প্রান্তিক ভাই যা অপমান করেছেন তাতে আমি আর কোনদিন যাবো না ওর কাছে।
ব্যাথা পায় রেহানা, বলে প্রান্তিক তোকে অপমান করেছে? সত্যি বলছিসতো। সেলিনা বলল তোকে মিথ্যে কথা বলে আমার লাভ? রেহানা বলল, দাঁড়া খুলিসনা কিছুই, আমি আসছি।
রেহানা চা মিষ্টি, নিমকি বিস্কুট সবকিছু একসঙ্গে সাজিয়ে নিয়ে আসে যে ঘরে নীলাঞ্জনা আছেন সে ঘরে। ওগুলো সব এক জায়গায় নামিয়ে রেখে পাশে সরে দাঁড়ায়। নীলাঞ্জনা অপলক তাকিয়ে আছেন ওর দিকে। এত কী দেখছেন কে জানে? লজ্জা পায় রেহানা। নীলাঞ্জনা বলেন বোস এখানে। রেহানা একটু দুরে বসে। নীলাঞ্জনা জানতে চায় তুমি তো প্রান্তিকের সঙ্গে এবার পরীক্ষা দেবে তাই না। রেহানা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। কলেজে যাচ্ছ তো নিয়মিত? হ্যাঁ। শুনেছিলাম তোমার শরীরও বেশ খারাপ ছিল। তা এখন ভাল আছো। ভাল আছি। নীলাঞ্জনা বললেন ওতো প্রায় দেড় মাস হতে চলল কলেজে যেতে পারছেনা। তুমি এর মধ্যে একদিনও গেলে না কেন আমাদের ওখানে? কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে রেহানা। অবশ্য তার উত্তর দেওয়ার মতো কিছু ছিলও না। চা খেতে খেতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ভাল করে দেখে নেন নীলাঞ্জনা রেহানাকে। রেহানা বলল আপনি মায়ের সঙ্গে কথা বলন, আমি আসছি। তাকে বাধা দিয়ে নীলাঞ্জনা বললেন না শান। ও দাঁড়ায়। তারপর নিজের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট এবং একটা গয়নার বাক্স তার হাতে দিয়ে বলেন শুধু ছোট মেয়েকে দেব, বড় মেয়েকে দেব না তা তো হয় না মা, এটা নাও। না করো না। আফরোজ বেগম বাধা দিয়ে বললেন এসব আপনি কি করছেন দিদি। এমন ভাবে ঋণে জড়াচ্ছেন কেন আমাদের। নীলাঞ্জনা খানিকটা আপন মনে বললেন ঈশ্বর আমাকে মা হওয়ার অধিকার দেন নি, ভালই করেছেন, তার যা ইচ্ছে। শুধু তার বিরুদ্ধে একটা মাত্র অভিযোগ, কেন তিনি আমার মাতৃ হৃদয়টাকে বাঁচিয়ে রাখলেন? একটা দীর্ঘশ্বাস টেনে নিয়ে এরপর রেহানাকে বললেন, ও মা না করোনা। রেহানা আবার এগিয়ে এসে তাকে প্রণাম করল এবং ওগুলো নিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে গেলো। নীলাঞ্জনা বললেন, এবার যে আমাকে উঠতে হবে দিদি। রাত হয়েছে, প্রান্তিক একা আছে। আফরোজ বেগম জানতে চাইলেন ও কেমন আছে? উত্তরে নীলাঞ্জনা বললেন এখন অনেকটা ভাল। তবে পুরো সুস্থ হতে হয়তো আরো কিছু সময় নেবে। আফরোজ বেগম আপন মনে বললেন আল্লাহ তুমি পরম করুণাময়। না আর দেরি নয়। উঠে পড়লেন নীলাঞ্জনা। ওখান থেকে এলেন ওরা দুবোন যে ঘরে আছে সে ঘরে। নীলাঞ্জনা শুনতে পাচ্ছেন, রেহানা বলছে ছিঃ সেলিনা, এই সামান্য ব্যাপারে কাউকে ভুল বুঝতে নেই। ও মোটেই তোকে অপমান করেনি। গোধুলি সন্ধ্যায় যা ছিল সত্য এবং সুন্দর, অস্ত সন্ধ্যায় তাকে হয়তো তত ভাল বলে মনে হয়নি, বাসি ফুলের মত তাই তাকে ফেলে দিয়েছে। এতে তুই অপমানিত বোধ করছিস কেন? নীলাঞ্জনা বাইরে থেকে ওকে বললেন, সেলিনা আমাকে যে উঠতে হবে মা, তারপর রেহানাকে বললেন, ডাঃ সরকারের চেম্বার তো কাছেই তাই না? চল না রেহানা আমাকে একটু ওই চেম্বার পর্যন্ত পৌঁছে দেবে।
পথে আসতে আসতে রেহানাকে বললেন, মিনতি সেন ফোন করেছিলেন। তোমাকে ও প্রান্তিককে ভীষণ ভাবে যেতে বলেছেন, বিশেষ দরকার। কাল দুপুরে তুমি প্রান্তিককে নিয়ে একবার যেও। আমাকে বলেন নি, কি দরকার, তবে প্রয়োজন এটা বুঝতে পারছি। যাচ্ছ তো? আস্তে রেহানা বলল নিশ্চয়ই যাব। চেন তো আমাদের বাড়ী। অসুবিধা হবে না। আচ্ছা এরপর আর কোন কথা না বাড়িয়ে একটা চলতি ট্যাক্সিতে উঠে পড়লেন নীলাঞ্জনা পিসি।
রেহানা বলল, আপনি ডাক্তার সরকারের চেম্বারে যাবেন বললেন যে। না আজ আর হবে না। ট্যাক্সিতে উঠতে উঠতে বললেন, কাল যেও কিন্তু। নিশ্চয়ই যাব। ট্যাক্সিটা ছেড়ে দিল।
দুপুর বেলা, বাড়ীতে এসে বেল দিল রেহানা, আমি শুয়ে আছি, আবারও ডোর বেলটা বাজছে। পিসি নেই। আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে আমিতো অবাক। কয়েকটা মুহূৰ্ত্ত মুখে কোন কথা নেই। তারপর বললাম রেহানা তুমি! মৃদু হেসে রেহানা বলল, তুমি বুঝি আমাকে চাওনি না? আমি অভিমান করে বললাম জানিনা। ভিতরে আসব? আসবে না কেন? যদি আমাকে দেখে তোমার ভাল না লাগে, যদি অসুস্থ হয়ে পড়। আমি ওর কথার প্রতিবাদ না করে বললাম, বাজে কথা না বলে ভিতরে এস।
বিছানার চাদরটা এলোমেলো। বালিশের ওয়াড় এবং ঢাকনা ঠিক জায়গায় নেই। পড়ার টেবিলটা কবে থেকে জঞ্জাল হয়ে আছে। আমি বিছানায় বসতে গেলে ও বলল, এই চেয়ারটায় বোস না। কেন? আরে বোস না? আমি চেয়ারটায় বসলে, ও তার অভ্যস্ত হাতে সুন্দর করে বিছানাটা গুছিয়ে দিল। পড়ার টেবিলটাও গুছিয়ে ফেলল এর মধ্যে। বালিশ ওয়াড় ঢাকনা যেমনটা হওয়ার কথা তেমনি করে দিয়ে বলল, এখন শোবে? না থাক বসেই কথা বলছি। রেহানা বলল না, তুমি শুয়েই পড়। আমি বলছি তোমার মাথার কাছে। তুমি শুয়ে শুয়েই কথা বল আমার সঙ্গে। আমি কোন কথা না বলে চুপ করে রইলাম। ও বলল আমার সঙ্গে কথা বলবেনা? তার পরে বলল এটা রাগ না আমার উপস্থিত্তি তোমার কাছে বিরক্তি কর লাগছে?
কি যে বলব ওকে। আমি ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, আমি নিষ্ঠুর তাই না? আমি পাষাণ এইতো? হ্যাঁ তাইতো। আর তুমি? কি আমি? এই দেড় মাস কি আমাকে ভুলে যাওয়ার সাধনা করছিলে? তুমি চুপ করবে? কেন চুপ করব? আমার প্রাণ নেই? মন নেই আমার? দেহ কি রক্ত মাংসের নয়? এই সব বুঝি ভাব সব সময়? সত্যি কি ছেলেমানুষ তুমি? হ্যাঁ হ্যাঁ আমি ছেলেমানুষ।
রেহানা বলল, থাক ও সব কথা প্রান্তিক। তুমি যেতে পারবে আমার সাথে? কোথায়? আমার সঙ্গে যাবে তাও প্রশ্ন? না প্রশ্ন নয়। শরীর পারমিট কববে কিনা তাই শুধু ভাবছি। ভাবছ, কিন্তু কেন? আমি তো সঙ্গে রয়েছি। বললাম, হ্যাঁ তাতো আছই। ও বলল আমার প্রশ্নের কিন্তু কোন উত্তর দাও নি এখনো। সব উত্তর দেওয়া যায় না রেহানা। তাছাড়া তুমিতো এই সবে এলে। এখন বলছ, তুমি আমার সঙ্গে আছো, অথচ এই দেড় মাস? তুমিতো একবারও আমার কথা ভাববার সময় পাওনি। ও বলল, কেন বোঝ না? তাছাড়া আমার আসাটাই কি সব? আমি তোমার মন জুড়ে আছি কিনা সেটাই তো আসল কথা? উত্তরে বললাম যদি বলি না নেই। রেহানা বলল, তোমার বলার অপেক্ষায় থাকবনা সেদিন। যেদিন জানতে পারবো, রেহানা নয়, আর কেউ তোমার মন জুড়ে আছে। কোন অনুযোগ বা অভিযোগ জানাব না। এমনিই চলে যাবো। তোমাকে বুঝতেও দেবনা। আমি বললাম, তুমি এমন করে দূরে দূরে থাক কেন? এ তোমার ভুল। আসলে এখনো তুমি আমায় আলাদা করে ভাবো। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, তোমার বুঝি তাই মনে হয়। না বলে একটু হেসে উঠে গিয়ে সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে বলল, কই ওঠ। তুমি আমাকে হাত ধরে তোল। তুমি নিজেই ওঠ প্রান্তিক। তবু তুমি কাছে আসবেনা। আসতাম, কিন্তু এই মুহূর্তে মন তোমার ভীষণ দুর্বল, তোমাকে আমি কোন ভাবেই ছোট হতে দিতে পারি না প্রান্তিক। তুমি যে আমার অহঙ্কার, একি তুমি বোঝনা? কিসে যে কার অহঙ্কার হয় এক দম বুঝিনা। কিন্তু একথা ঠিক, সত্যি বুঝি দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলাম। সত্যি বুঝি চরম ভাবে পেতে চেয়েছিলাম এমন কিছু, যা ভালবাসার ঐশ্বর্য নয় লুণ্ঠনের সম্পদ মাত্র। বললাম, না রেহানা তোমার অহঙ্কারের কোন অপমান হোক, তা আমি হতে দেবনা। এস, আমার কাছে, ভয় নেই।
রেহানা আস্তে আস্তে এল আমার কাছে। আমি হাত বাড়িয়ে দিলাম, ও নীচু হতেই আমি ওর গলাটা জড়িয়ে ধরে উঠে পড়লাম। ও বলল, জামা কাপড়টা পরে নাও। আমি পরে নিয়ে ওর সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম। জানতেও চাইলাম না কোথায় যাবে। রাস্তায় এসে জানতে চাইলাম, তুমি সঙ্গে আছে, তাইতো কোন ভয় নেই। তোমার সঙ্গে যাচ্ছি তাই আমি নিশ্চিন্ত। তবু রেহানা, কোথায় আমরা যাব তা কি আগে থেকে একবারও বলা যাবেনা? রেহানা বলল, তুমি মুখে যাই-ই বলনা কেন, আসলে তোমার মনের মধ্যে এখনো দ্বিধা। তারপর হেসে বলল, কিন্তু আমি চাইনা প্রান্তিক এ দ্বিধাটুকু মুছে যাক। তাই তুমি তোমার মতো ভাবতে থাক, দেখবে আমরা ঠিক জায়গায় পৌঁছে গেছি যেখানে তুমিও যেতে চেয়েছিলে। মিনতি সেনের বাড়ী বেল দিতেই মিনতি সেন বেরিয়ে এলেন। আমাকে দেখে বললেন একি চেহারা বানিয়েছ প্রান্তিক। মিনতি সেনকে সব কথা খুলে বললাম। তারপর বললাম দাদু কই। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেললেন মিনতি সেন। আমি বুঝতে পারছি কি হয়েছে। বললাম, একটা সংবাদ দিতে পারলেন না পিসি। কি করে দেব? আমি তো তোমার বাড়ীর ঠিকানা জানিনা। অফিসে তোমার পিসিকে বেশ কয়েক বার চেষ্টা করেছি, কিন্তু উনিও আসেননি। তারপর বললেন, তোমরা যেদিন গেলে, তার পরের দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। শ্বাস কষ্ট আরম্ভ হয়। ডাঃ বাবুকে কল দেওয়া হয়। আসেনও, কিন্তু তার আগেই সব শেষ। ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলেন মিনতি সেন। আমিও কেঁদে ফেললাম। রেহানার চোখেও জল। মিনতি সেন নিজের চোখের জল নিজে মুছে নিয়ে আমাদের বললেন কেঁদোনা। একটা বন্ধ খাম দিয়ে গেছেন তোমাকে। যখন তার প্রায় শেষ মুহূর্ত আমি তার মুখের পরে ঝুঁকে বললাম, কিছু বলবে বাবা। এই বন্ধ খামটা কাঁপা কাঁপা হাতে বালিশের নীচ থেকে বের করে আমার হাতে দিয়েই এলিয়ে পড়লেন, আর কোন সাড়া শব্দ নেই। সব শেষ। খামটা হাতে নিয়ে দেখি তোমার নাম। তুলে দিলেন বন্ধ খামটা আমার হাতে।
আমি বললাম কি আছে ওতে? মিনতি সেন বললেন জানিনা, আমি খুলিনি। তবে বাবা কি বলে গেছেন তোমাকে তা জানবার একটা ভীষণ ইচ্ছে থেকেই তোমাকে বার বার ফোন করেছি, তুমিও আসনা অনেকদিন। পরে জানতে পারি যে তুমি খুব অসুস্থ ছিলে। তোমার পিসিও খুব অসুস্থ ছিলেন।
রেহানা বলল, হ্যাঁ, পিসি, ওনার শরীর এখনো ঠিক নেই। নীলাঞ্জনা পিসিই আমাকে বললেন, আপনার মনে হয় খুব প্রয়োজন তাই যেন, আমি একবার অবশ্যই করে ওকে নিয়ে আসি আপনার এখানে। কিন্তু দাদু নেই, একদম ভাল লাগছেনা। মাত্র কয়েক দিনের পরিচয়, তাতেই যেন কত আপনার ছিলেন আমার। একবার শেষ দেখাও দেখতে পেলাম না। অভিমান বেজে ওঠে ওর কণ্ঠস্বরে।
আমি চিঠিটা খুলে ফেলি। কাঁপা কাঁপা হাতের অক্ষর। দাদু ভাই, আমার বোধহয় দিন ঘনিয়ে এসেছে, হয়তো তোমার সাথে আর কোন দিন দেখা হবে না। দিদি ভাইয়ের সঙ্গেও তাই। তোমাদের দুজনের জন্য আমার হৃদয় নিংড়ানো আশীর্বাদ রইল। অনেক বাধা আসবে তোমাদের জীবনে। সমাজ এখন তোমাদের মত মানুষদের গ্রহণ করবার জন্য প্রস্তুত নয়। তবু আমি সে যুগের ধ্যান ধারণা নিয়েও তোমাদের জন্য কল্যাণ কামনা করছি। একদিন তোমরাই এই হতভাগ্য সমাজকে নতুন পথের সন্ধান দিতে পারবে বলে আশা করি। যেখানে ধর্ম নয়, ভালবাসা আর মানবতাই মানুষের শেষ পরিচয়। আর একটা কথা, আমার মেয়ে মিনতি। জানি না তোমরা তার কথা জান কি না? যদি জান তা হলে আমার কথাও জান, আমি তোমাদের সেই সব ভয়ংকর কথাগুলো মনে করিয়ে দিতে চাইনা। তোমরা যেখানেই থাক, ওকে একটু দেখ। এই আমার শেষ অনুরোধ। তোমাকে এবং দিদি ভাইকে যেটুকু বুঝেছি, তাতে আমার মনে হয়েছে তোমাদের পেয়ে ও অনেক কিছু ভুলে থাকতে পারবে। যদি প্রতীমের সঙ্গে তোমাদের কখনো দেখা হয়, তাহলে বলল, সে যেন সব কিছু মেনে নিয়ে মিনতিকে গ্রহণ কবে, জানিনা সে এখন কোথায় আছে, জীবনে তার কেউ এসেছে কি না তাও জানিনা। তোমরা মিনতির ছেলে মেয়ের মতন, তবু কেন মোদের এই দায়িত্ব দিয়ে যাচ্ছি, সে উত্তর জানতে চেও না। শুধু এই বিশ্বাস রেখে যাচ্ছি, মিনতির মায়ের ভুলেব জন্য কিছুতেই তার জীবনটাকে তোমরা নষ্ট হতে দেবে না। তোমরা থাকবে ওর পাশে। যদি কোনদিনও প্রতীমের খোঁজ না পাও। ওর জীবনটা তোমবাই ভরে দিও। হাসি আর আনন্দে কোন দিনও যেন ও না ভাবে, ও বড় একা। দেখেছি তোমাদের পেয়ে ও কত বদলে গেছে। বাবা হয়ে সব সময়ই তো তার এই আনন্দময় জীবন আমি চেয়েছি। দিতে না পাবার জন্য আমার দায়িত্বকে আমি অস্বীকার করি না। আর একটা কথা, মিনতি আমার কোন কিছুই স্পর্শ করে না সেই ঘটনার পরে, তবু আমি তার বাবা। তাকেই দিয়ে গেলাম সর্বস্ব। তোমরা ওকে গ্রহণ করতে বল হতভাগ্য পিতার এই স্নেহের দানকে। সারাজীবনে যা পারলাম না, আজ প্রাক-বিদায় মুহূর্তেও তা পারবো না সাবা জীবন নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত করতে চেয়েছি, পারিনি। মিনতি আমায় তার মায়ের ওই ট্যাজিক মৃত্যুর জন্য সমস্ত দোষ আমাব পরে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। আমি তা মেনে নিয়েছি। তবু যে সে আমায় ক্ষমা করেনি, তা বুঝি। যদি তোমাদের কথাও সে না শোনে তবে আমার রেখে যাওয়া যাবতীয় সম্পদকে তোমরা মানবিকতার প্রচারে ব্যয় করো এই আমার শেষ দাবি। মিনতিকে বলে যেতে পারলাম না। নিজের অহঙ্কারের কাছে হার মেনেও জীবনের শেষ দিনেও জিততে চেয়েছি। আশা করবো, তোমরা আমাকে বুঝবে। সময় যে ফুরিয়ে আসছে তাও বুঝতে পারছি। হাত কাঁপছে। কাল চলে যাওয়ার পরে জবার মাকে বললাম, কালি আর কাগজ দাও। ওর কাছ থেকে কাগজ আর কালি নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতের অক্ষরে আমার যা কিছু বলার তোমাকে বলে গেলাম দাদুভাই। তোমাকে হয়তো মুখোমুখি কোন কথাই বলতে পারতাম না। প্রতীম, সব ভুলে ওকে গ্রহণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু তার মায়ের মৃত্যু যে জন্য দায়ী তাকে সে কেমন ভাবে গ্রহন করবে? তাইতো তাকে গ্রহণ করতে পারলনা মিনতি। তোমাকে বলে যাচ্ছি, মিনতির মা, একটা ভুলের পিছনে ছুটে নিজের জীবন যেমন শেষ করেছে, তেমনি অভিশপ্ত করে দিয়েছে মিনতির সমস্ত জীবনটাই। আর আজ এই মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তোমাকে বলছি। মিনতির মা সম্পূর্ণ ভুল আশঙ্কায় আমাদের পরিবারটাকে তছনছ করে দিয়ে গেছে। আমার এই কথাটা তুমি বিশ্বাস কর দাদুভাই। এত কথায় হয়তো ভাবছ, এত লোক থাকতে তোমাদের বললাম কেন। বললাম এই জন্য, যে মানবিকতা তোমদের ভিতরে আমি দেখেছি তাতে কেবল তোমাদের কাছে রেখে যাওয়া যায় আমার জবান বন্দী।
হয়তো মনে তোমার প্রশ্ন, প্রতীমকে কেন সহ্য করতে পারেনি মিনতির মা। এটা ওর মায়ের ভুল। আবারও বলছি আমার এই কথা তুমি নিশ্চিন্ত মনে বিশ্বাস করতে পার।
আলাদা একটা কাগজে আমি আমার যাবতীয় হিসেব দিয়ে গেলাম। মিনতিকেই দিলাম। বেঁচে থাকতে সে আমার কিছুই ছোঁয়নি। মৃত্যুর পরে ছোঁবে কিনা জানিনা, ভয় হয় যদি নিতে না চায়, ও যেন তোমাদেরই সব দিয়ে যায়, তার প্রতি এই আমার শেষ আদেশ। তোমাদে মঙ্গল কামনা করি। হতভাগ্য–দাদু।
আমি,যতক্ষণ চিঠি পড়েছি রেহানা ও মিনতি সেন তাকিয়ে ছিলেন আমার দিকে। আমার পড়া শেষ হলে দু চোখ ভরে জল নেমে এল। এতে এমন কোন আবেগ মাখা কথা নেই, আছে পিতা ও মেয়ের চরম মান–অভিমানের কথা। যা কখনো বুঝতে পারিনি। চিঠিটা পড়া হলে, ওটা আমি রেহানাকে দিই। রেহানা বলল আমাকে কেন? বললাম আগে তুমি পড়। তারপর পিসিকে দাও। উনি পড়বেন সবশেষে। কারণ শেষ সিদ্ধান্ত নেবেন উনি। আমার কথা কিছু লিখেছেন? বললাম, সব কথাই আপনাকে নিয়ে, তবু ও আগে পড়ুক। তারপর আপনি যা ভাল বুঝবেন করবেন। কিন্তু পিসি, এত ব্যথা কেমন করে গোপন করে এত দীর্ঘ দিন পথ চলেছেন আপনি। ভুলতো মানুষেই করে, তাই বলে, তাকে এমন শাস্তি দিতে হবে? আপনিতো মা। পারবেন এমন অন্যায় করলে আমাদেরও শাস্তি দিতে? পারবেন আমাদের দেওয়া কঠিন শাস্তি আপনার বাবার মতন গ্রহণ করতে? কেন এমন করলেন পিসি।
মিনতি সেন কোন কথা না বলে, রেহানার পড়া শেষ হলে চিঠিটা এক নিমেষে পড়ে নিলেন। তারপর কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তাকে বুকের পরে তুলে নিয়ে ওনার বিছানায় শুইয়ে দিলাম। রেহানাকে বললাম, চল আমরা নীচের ঘরে যাই, ওনার এখন একা থাকা দরকার। দরকার ভীষণ ভাবে দরকার কান্নার, তবেই যদি হাল্কা হতে পারেন। রেহানা বলল, কি অদ্ভুত তাইনা। অথচ এত ব্যথা যে দুজনেই বয়ে বেড়াচ্ছেন দেখে বোঝার উপায় নেই। আমি বললাম ঠিক তোমার মত। যা!
অনেকক্ষণ পরে, জবার মা আমাদের ডেকে পাঠালেন উপরে। মিনতি সেন কাঁদতে কাঁদতে একটু শান্ত হয়েছেন, চোখ দুটো লাল। চুল এলোমেলো। শাড়ী অবিনস্ত। তবু যেন কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। রেহানা ওকে নিয়ে ভিতরের ঘরে গিয়ে একটু বিন্যস্ত করে নিয়ে এলো। উনি বসলেন খাটের রেলিংএ হেলান দিয়ে। তারপর বললেন, তোমরা দুজনেই বাবার চিঠি পড়ছে? এখন তোমরাই বল আমার কি করণীয়।
আমরা সবাই চুপ করে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। কারো মুখে কোন কথা নেই। উনি বললেন, কি হলো প্রান্তিক কিছু বল। আমি বললাম পিসি। আজই কিছু করতে হবে, তারতো কোন প্রয়োজন নেই। থাক না কয়েকদিন পর করলেও হবে। আরো কয়েকবার পড়ন চিঠিটা। তারপর নিজেই বুঝতে পারবেন কি করা সম্ভব, বা কি করা উচিত। মিনতি সেন বললেন, বাবার বুকে যে এত ব্যাথা জমা ছিল আমি বুঝতে পারিনি। সব সময় মনে হয়েছে মায়ের মৃত্যুর জন্য বাবাই দায়ী। তাই তার অহঙ্কার আমি মেনে নিতে পারিনি। আর তাই তার সবকিছুকেই প্রাণপনে এড়িয়ে চলেছি। মায়ের যে কোন ভুল থাকতে পারে মনেই হয়নি কখনো। এখনতো আবার নতুন করে সব কিছু ভাবতে হবে। বললাম, তাই ভাববেন, তার আগে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। মিনতি সেন বললেন, সময়ই সব ঠিক করে দেবে জানি, হয়তো এমনও হতে পারে তোমাদেরও আমি আর সহ্য করতে পারছি না, তাই আমি বাবার সব কিছু তোমাদের দিয়ে যেতে চাই প্রান্তিক। বললাম তার মানে আপনার বাবার প্রতি অভিমান আজো তেমনি আছে, তার চেয়ে আমি বলি কি, এই মুহূর্তে তার কোন প্রয়োজন নেই। আমরা তো পালিয়ে যাচ্ছিনা। আর তাছাড়া আপনিও কোন দিন পারবেন না আমাদের এড়িয়ে চলতে। মা কি পারে তার সন্তানদের এড়িয়ে চলতে। পেরেছেন কি আপনার বাবা। পারেন নি? তাই কেন এসব ভাবছেন পিসি? অতীতের তিক্ততা মুছে ফেলুন। বরং ভাল করে নিজের অন্তরের দিকে তাকিয়ে দেখুন, সেখানে প্রতীমবাবুর কোন জায়গা আছে কি না। যদি থাকে, তাকে গ্রহণ করুন একান্ত আপন করে। তা হয় না প্রান্তিক। কেন হয় না। জানিনা। কিন্তু কোন সিদ্ধান্তই আবেগের বশে নেবেন না। আপনার হিতাকাঙ্কীর অভাব নেই। ব্যারিষ্ট্রার ভট্টাচার্য সাহেব, পুলিশ কমিশনার আপনার কাকাবাবু, এদের সবার সঙ্গে নিজের কথা নিয়ে আলোচনা করুন। তাদের কথা শুনুন। তারপর যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আপনি নিজেই নিন। আপনার বাবার ব্যাথাটাও বোঝবার চেষ্টা করুন। নিজের জেদটাকে বড় করবেন না পিসি। সত্যিকারের সত্যের আলোকে নিজেকে যাচাই করুন। এরপরও যদি মনে হয়, আপনার জেদটাই বড়, তবে জেদ নিয়েই থাকবেন, শুধু অকারনে কারো প্রতি কোন অবিচার করবেন না, এই আমাদের অনুরোধ। মিনতি সেন তাকালেন রেহানার দিকে, কি রে মেয়ে তুই কিছু বলবিনা?
ফোনটা বেজে উঠলো। আমি গিয়ে ফোনটা ধরলাম। হ্যালো আমি ভট্টাচার্য বলছি, মিস সেন আছেন? হ্যাঁ ধরুন আমি দিচ্ছি। হ্যালো আপনি কে বলেছেন? আমি প্রান্তিক। হ্যালো, ইয়ং ম্যান তোমাকেই দরকার। এতদিন কোথায় ছিলে? খুব অসুখে পড়েছিলাম। আজ একটু ভাল হতেই এখানেই এসেছি? খুব দরকার? হ্যাঁ দরকার তো বটেই। তোমার থেকেও বেশী দরকার রেহানাকে। আমি বললাম ওতো এখানে আছে। যদি বলেন আসতে পারি। দরকার নেই। তোমরা কতক্ষণ আছ? আমি আধ ঘন্টার মধ্যেই আসছি। মিস সেনকে বলে দিও। মিনতি সেনের সঙ্গে কথা না বলেই ফোনটা ছেড়ে দিলেন উনি। আমি মিনতি সেনকে সব কথা খুলে বললাম। উনি শুনলেন, কিন্তু কোন কিছু না বলে চুপ করে রইলেন। জবার মা এসে জিজ্ঞাসা করলেন, দিদিমনি, আপনাদের চা বা কফি দেব? হ্যাঁ দাও।
আধ ঘন্টার আগেই এলেন ব্যারিষ্টার সুরেশ ভট্টাচার্য। বড় এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়েই এলেন। মিনতি সেন বললেন কি ব্যাপার? মিষ্টি নিয়ে যে? হ্যাঁ ভাবলাম, এই ভাল সংবাদটি দেওয়ার জন্য আপনাকেই মিষ্টি খাওয়ানো দরকার। মিনতি সেন বললেন বুঝতে পারলাম না। অনুমান করুন না। কি অনুমান করি বলুনতো আপনাদের জীবন এত বিস্তৃত যে, কোনটা ভাল আর কোনটা ভাল নয় এতো বোঝা মুসকিল। পরে উনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন ইয়ং ম্যান তুমি কিছু অনুমান করতে পার? আমি শুধু তাকিয়ে রইলাম। উনি চোখ ফেরালেন রেহানার দিকে। বললেন মা আজকের দিনে জবার মায়ের হাতের কফি রুচবে না। বরং তুমিই কফিটা করে নিয়ে এস। মিষ্টি মিষ্টি হাসতে লাগলেন ভট্টাচার্য সাহেব। রেহানা বলল, এই আনি কাকাবাবু। ও চলে গেলে, মিনতি সেন বললেন, সংবাদ যে খুবই ভাল বুঝতে পারছি, কিন্তু আমাদের এই সংশয়ে রেখে আপনি কি সত্যি আনন্দ পাচ্ছেন? কিন্তু আপনারা যে বুঝতে পারছেন না তাতেই আমার আনন্দটা মাটি হয়ে যেতে বসেছে। তা হলে বলেই ফেলুন বললেন মিনতি সেন। ভট্টাচার্য সাহেব বললেন, এক নাম্বার ডালিমদের কেসটা যে এত তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তি হবে বুঝতে পারিনি। ডাক্তার সরকার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে এমন সাক্ষ দিলেন যে বিচারক আর জেরা করার প্রয়োজন মনে করলেন না। তিনি রায়ে জানিয়ে দিয়েছেন, ডালিমরা প্রশ্নাতীত ভাবে দোষী বলে তিনি মনে করেন। ভারতীয় ফৌজদারী দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারা উল্লেখ করে তিনি তার রায়ে ১০ বছর সশ্রম দণ্ডের আদেশ দিয়েছেন ডালিমকে। শুধু তাই নয়, দন্ড শেষ হলে, বাইরে এসে তারা যাতে এমন কোন অপরাধ না করতে পারে, তার জন্য পরবর্তী ১০ বছর পুলিশ যেন তাদের গতিবিধির উপর বিশেষ নজর রাখেন এ আদেশও দিয়েছেন। থামলেন ব্যারিষ্টার ভট্টাচার্য। তারপর বললেন, তার এই রায়ের পিছনে পুলিশের ভূমিকাও উল্লেখ করার মত। তবে অবশ্য সমস্ত কৃতিত্ত্ব আপনার কাকা মাননীয় পুলিশ কমিশনারের।
রেহানার আনন্দে চোখে জল এসে গেল। মিনতি সেন ওকে বুকের পরে টেনে নিয়ে বললেন, অপরাধের শাস্তি একদিন হবেই এ বিশ্বাস আমার ছিল বলেই ভট্টাচার্য সাহেবকে কেসটি নিতে এমন অনুরোধ করেছিলাম। ভট্টাচার্য সাহেব অবশ্য একটা কথা বললেন, ডালিমরা অপরাধ নিজমুখেই স্বীকার করে নিয়েছে তাই বিচারকের পক্ষে রায় দান অনেকটা সহজ হয়েছে।
আর ডালিমরা অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে এই একটা কথাতেই কেমন যেন হয়ে উঠলো রেহানা। তারপর অবশ্য সব ঠিক হয়ে যায়। মিনতি সেন বললেন, তাহলে তো মিষ্টি আপনাকেই খাওয়ানো উচিত। সে আর বলতে, তবে এই ভালো সংবাদটা দেওয়ার জন্যই আমি কিন্তু মিষ্টি নিয়ে আসিনি, আমি মিষ্টি নিয়ে এসেছি, আমার মেয়ে শান্তা আজ আমাকে সকালে বাঙালী কৃষ্টি অনুসারে প্রণাম করছে বলে। আমরা সবাই অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে। বলেন কি ব্যারিষ্টার ভট্টাচার্য। সামান্য একটা প্রণাম এত অসামান্য হয়ে উঠতে পারে তার মত ব্যক্তির কাছে ভাবতেও অবাক লাগে। মিনতি সেন বললেন এটাতো স্বাভাবিক ভট্টাচার্য সাহেব। জানি এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বাভাবিকতা যে কত অস্বাভাবিক হতে পারে আপনারা তা বুঝবেন না। আমার নিজেরও একদিন জীবনের সহজ স্বাভাবিকতা মেনে নিতে অসুবিধা হতো। পরে অবশ্য ধীরে ধীরে পরিবর্তন হয়েছে। যেদিন রেহানা বিধর্মী হয়েও আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করল, কি যে হল মিস সেন তা আমি আপনাকে বোঝাতে পারবো না। মনে হল এ যেন যুগ যুগান্ত প্রবাহিত এক স্রোতস্বিনী ধারা। জীবনের তন্ত্রীতে তন্ত্ৰীতে এ যেন এক সঙ্গীতের অনুরনন। মনে হল, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি যা যুগ যুগ ধরে চলে এসেছে, সেতো মায়ের আশীর্বাদ। বিলেতে প্রণামের মর্ম বোঝেনা। এর ভিতর যে মাধুর্য, সৌন্দর্যের আধারে জীবনকে তা রসারিত করে। যে প্রণাম করে তার স্বকীয় অবনমতায় ভাস্বর করে তাকে যাকে সে প্রণাম করে। জিজ্ঞেস করলাম শান্তাকে, হঠাৎ প্রণাম কবলি যে। বলল জানিনে কেন করলাম বাপী, এও এক পরিবর্তন মিস সেন যে কোনদিন ড্যাড ছাড়া বলেনি, সে বলছে বাপী, তারপর বলল, হঠাৎ ভারতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতার ইতিহাস পড়তে গিয়ে মনে হল কোন মানুষই তার মাটির স্পর্শ ছাড়া বড় হতে পাবে না। ঔদার্যের সঙ্গে অপরকে গ্রহণ করা যেতে পারে তাচ্ছিল্য করে নিজেকে অস্বীকার না করে। কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছিলাম, কি যেন ভাবছে মেয়েটি। একদিন বলল, ডন একদিন আসতে চেয়েছে নিয়ে আসব? ডন মানে যে ছেলেটিকে শান্তা ভালবাসে। আমি বললাম অবশ্যই আনবি। যাকে নিয়ে সারাজীবন কাটাতে চাস তাকে একবার দেখাবিনা। ও ভেবেছিল আমি বোধ হয় প্রতিবাদ করব। তাতে অবাক হয়ে বলল, আমি যাকেই পছন্দ করব তাকেই তুমি মেনে নেবে? বলেছিলাম না নেওয়ার কি আছে? জীবনটা তোমার, তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে। আজীবন ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলে এসে নিজের মেয়েব ক্ষেত্রে তা মানবনা তাতো হয় না। বলল, যদি তোমার সামাজিক আদর্শের সঙ্গে তার আদর্শের মিল না খায়? বলেছিলাম নাই বা খেল। আমিতো ধর্ম মানিনা মা, সমাজও বোধ হয় আমাকে খুব একটা পছন্দ করে না। তার জন্য মাঝে মাঝে অনুতাপ হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, এ অহংকার বোধ হয় ভাল নয়। যে মাটিতে আমার জন্ম তার রস না নিয়ে টবের ফুলের মত অন্যের পরিচর্যায় বড় হয়ে ওঠা হয়তো আপাত সৌন্দর্যের প্রকাশ ঘটাতে পারে তবে তার অপমৃত্যু হতে বেশীক্ষণ লাগে না। পরিচর্যার অভাবে তা শুকিয়ে যায় যে কোন মুহূর্তে, কিন্তু মাটির রসে যে ফুল ফোটে তাতে পরিচৰ্য্যার দরকার হয় না। সঞ্চিত জলধারাই তাকে বাঁচিয়ে রাখে। জাতীয় কৃষ্টি ও সভ্যতা তাই। সেতো মাটির নীচে সঞ্চিত জল ধারা। তাকে অস্বীকার করে কখনোই মহত্ত্বে উত্তীর্ণ হওয়া যায় না।
আমি যে আপন কৃষ্টি ও সভ্যতার পক্ষে এত ডিবেট করতে পারি, ও তা ভাবতেও পারেনি। বলল, তোমার কি হয়েছে বলতো ড্যাড? নিজের সভ্যতা কৃষ্টি আচার আচরণকে নিয়ে এত যে ওকালতি করছ, তার মানে কি এতদিন তুমি যা বিশ্বাস করে এসেছে তা ভুল। বললাম ভুল কি না জানিনে মা, তবু একটি মেয়ে সে আমার জাতের নয়। সে আমার ধর্মের নয়, তবু কাকাবাবু বলে সে যখন প্রণাম করল, কি যে হল তোকে বোঝাতে পারবো না। আমার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হতে লাগল এক আনন্দের স্রোত ধারা। ও অবাক হয়ে তাকালো আমার দিকে, বলল, দেখ ড্যাড তাকে স্নেহ করতে গিয়ে আবার আমাকে অস্বীকার করো না? হয়তো ঠাট্টাই। কিন্তু ভাল লাগেনি মিস সেন। বলেছিলাম। যদি সে বলে তোকে অস্বীকার করলে সে আমার হবে, জানবি মুহূর্তও লাগবেনা তোকে অস্বীকার করে সেই শূন্যস্থানে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে ও ভয় পেয়ে বলল, ড্যাড! আমি বললাম ভয় পেলিতে, আমার মনে হয়, রেহানা যে আদর্শে বিশ্বাস করে, যদি তার বাবা বা মা তাকে বলে, তোর আদর্শ ত্যাগ না করলে আমাকে হারাবি, সে হয়তো হাসিমুখে রাজী হয়ে যাবে। আমি তোমাকেই হারাবো তবু আমার বিশ্বাস আমার আদর্শ আমি ত্যাগ করতে পারবনা। শান্তা অবাক হয়ে বলে একটি দিন মাত্র তাকে দেখেছে তাতেই এত। দরকার নেই ডনের তোমার কাছে এসে। তুমি থাক তোমার সেই মেয়েটিকে নিয়ে। একথা বলে অভিমানে আমার কাছ থেকে সরে গেল ও। আমি তাকে ডাকতেই পারলাম না। এতদিন ধরে তার সঙ্গে আমার কোন কথা নেই। ডনও এলো না। হঠাৎ আজ সকালে ও আমার কাছে এসে আমাকে প্রণাম করে বলল, বাপী, আমারই ভুল। সেই অদেখা মেয়েটি জানিনা সে আমার থেকে বড় না ছোট তাকে বল, সে যদি পর হয়ে তোমার হৃদয় জয় করতে পারে আমি মেয়ে হয়ে কেন পারবো না। কি যে ভাল লাগল মিস সেন। ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললাম একবার দেখবি সেই মেয়েটিকে? ও রাজী হওয়াতেই আমি ফোন করলাম আপনাকে। এতক্ষনে ভট্টাচার্য সাহেবের কথাগুলো শুনছিলাম আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতন। সুঁচ পড়লেও যেন টের পাওয়া যায়। রেহানাই প্রথম এগিয়ে এলো ভট্টাচার্য সাহেবের কাছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে তার মাথার চুলের মধ্যে আঙুল গুলো সঞ্চালিত করতে করতে বলল, কাকাবাবু আপনার মনের মধ্যে যে এমন কোন দুঃখ থাকতে পারে সে তো ভাবনারও অতীত। তারপর বলল চলুন, আমি যাব। যাবি মা? যাব না কেন? এমন ভাবে কে আমার হৃদয়ের মর্মস্থলে আঘাত করতে পেরেছেন? আমি এক সামান্য মেয়ে কাকাবাবু, সেই সামান্য মেয়েকে অসামন্যতায় যে মেয়ে দেখতে চেয়েছে সে যে আমারও প্রণাম্য। আবেগে বুঝি কথা বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। ভট্টাচার্য সাহেব বললেন, সত্যি যাবি মা। তা হলে চল্। মিস সেন, আপনিও চলুন না। আর একটা ভাল সংবাদ দেব, প্রান্তিক তুমিও চল। রেহানা বলল, একটু অপেক্ষা করুন কাকু। কেন রে? ও আস্তে আস্তে বলল, সেদিন আপনাকে প্রণাম করেছিলাম বয়কনিষ্টের স্বাভাবিকতায়। আজ একটা প্রণাম করতে দিন শ্রদ্ধা ও ভক্তির অঞ্জলি হিসাবে। রেহানা। প্রণাম করলে ভট্টাচার্য সাহেব নিজের বুকের পরে টেনে নিয়ে কপালে বার বার স্নেহ চুম্বন একে দিতে লাগলেন যেন কোন হারানো মেয়ে ফিরে এসেছে অনেক অনেক দিন পরে তার বাবার বুকে।
কেটে গেছে এর পরে আরো বেশ কয়েকটা মাস। ঈদ ও পূজা কেটে গেছে প্রায় এক সাথে। রেহৃনাকে একদিন বললাম, আমার সাথে যেতে অসুবিধা হবে নাতো। ও বলল, বার বার তুমি আমায় কি পরীক্ষা করতে চাও প্রান্তিক? পরীক্ষা নয় ভয়? ভয় কেন? তুমি বোঝনা কেন ভয়? আগের মত কি তোমাদের বাড়ী আমাকে মেনে নিতে পারছে? রেহানা ভালভাবে জানে, কথাটা পুরো না হলেও আংশিক সত্য। সেলিনা যেমন অনেক বাঁকা বাঁকা কথা বলে, আফরোজ বেগমও অন্যের সঙ্গে যখন তখন বেরোনো পছন্দ করেন না। আমি এর অর্থ খুঁজে পাইনা। মানুষের কি অদ্ভুত পরিবর্তন। স্বপ্নেও ভাবিনি কোনদিন। জীবনের পরিবর্তন গুলো এ ভাবে বিপরীত গামী হয়ে নেমে আসতে পারে। রেহানা বলল, তোমার ব্যাথা বুঝি। আর এও বুঝি, আমাকে এসব কথা জিজ্ঞাসা করে আমার মনের সন্দেহকে যাচাই করে দেখতে চেয়েছে তাই তো? আজ যারা আমাকে তোমার মাধ্যমে চেনে, তুমি সরে গেলে বলতে পার আমি তাদের কাছে কি মুখ নিয়ে দাঁড়াবো। বললাম, রেহানা ভালবাসা কাকে বলে আমি জানিনে। রূপ বা সৌন্দর্য ভালবাসাকে প্রভাবিত করতে পারে কী না তাও জানিনে। আমি শুধু জানি প্রান্তিকের জীবনে রেহানাই একমাত্র সত্য। যদি জানো তা হলে ব্যথা দাও কেন? তোমাকে বুঝতে পারিনা বলে। আজ কাল দুম দাম বলে দাও আমার সময় হবে না, তুমি একা যাওনা লক্ষ্মীটি। কেন বলি সে কি বোঝনা? হয় তো বুঝি কিন্তু মন মানেনা। আগেতো তুমি এমন ছিলে না? না ছিলাম না, কিন্তু তুমি কি ছিলে? কি করে তোমাকে বুঝাবো, রেহানা শুধু তোমার? একমাত্র তোমার, আর কারো নয়।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বললাম, দুপুর আড়াইটায় ব্যাবাকপুর লোকাল। টিকিট কেটে অপেক্ষা করব। আচ্ছা বলে ও ক্লাসে চলে গেল। ওই ক্লাসটা আমার নেই। মধুদার চায়ের দোকানে ঢুকেছি, অবাক হয়ে দেখি অশ্রুকণা একা একা চা খাচ্ছে। ও আমাকে দেখে বললে প্রান্তিক অনেক অনেক দিন বাঁচবে তুমি। আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমায় কি তুমি তাড়াতাড়ি মেবে ফেলতে চাও কণা? ও বলল সব তাতেই তোমার বাঁকা বাঁকা কথা? তারপর বলল, আজ প্রিন্সিপাল রেহানাকে ডেকে পাঠিয়েছে জান? বলেনি তো ও কিছু? আজকে ওর সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে? হ্যাঁ এইতো ওর সঙ্গে কথা হল, ও ক্লাসে গেছে, আমার কোন ক্লাস নেই তাই মধুদার চায়েব দোকানে এলাম। তারপর চিৎকার করে বললাম, মধুদা দু কাপ চা। তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বললাম তুমি ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এখানে? তোমার জন্য। আমার জন্য? আশ্চর্য ব্যাপার। ও আস্তে বলল, ঠাট্টা নয় প্রান্তিক তোমার সঙ্গে সত্যি কথা আছে আমার? আমি আরো অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। বললাম কি ব্যাপার? ও বলল, যদিও আজ তোমাকে কোথাও ডেকে নেওয়ার অধিকার হয় তো হারিয়েছি তবু চল না, আমরা হাঁটতে হাঁটতে একটু গঙ্গার পার দিয়ে ঘুরে আসি। বললাম আমার যে ক্লাস আছে? জানি আমি, তবু বলছি চল তোমার সঙ্গে সত্যি কথা আছে এবং তা তোমার শোনা একান্ত দরকার। বেশ চল তা হলে।
দুপুরের গঙ্গা ঘাট, একেবারে নির্জন। বাঁধানো সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে ও বলল, আমায় একটা সত্যি কথা বলবে প্রান্তিক? কি? আজ যদি কোন কারণে রেহানা তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়। মানে? আমি তো অনুমানের কথা বলছি, মানে খুঁজছো কেন তবু কারণ তো নিশ্চয়ই কিছু আছে কণা? আছে, কিন্তু তার আগে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও? অসম্ভব। কি অসম্ভব? তোমার এই অনুমান। ও একটু ম্লান হেসে আমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, জীবনে অসম্ভব বলে কিছু নেই প্রান্তিক। তুমি হয়তো জানো, একদিন তোমার ভালবাসা পাওয়ার জন্য কি না করেছি আমি? আমি ঠাট্টা করে বনলাম, আজ কি চাও না আমাকে? না। আমি যদি চাই? তাহলেও না। কেন? ওই যে বললাম জীবনে অসম্ভব বলে কিছু নেই। বুঝলাম তোমার কথা। কিন্তু তোমার কেন মনে হচ্ছে রেহানা আমার জীবন থেকে হরিয়ে যেতে পারে। পারে না বুঝি? না পারে না। তারপর বললাম তুমি জানো ও আমার জীবনে কি ভাবে জড়িয়ে আছে। থাকগে সে সব কথা, তুমি তারপর বল? ও বলল, তোমার কথা মেনেও বলছি, সত্যি ও তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যেতে পারে। আমি চিৎকার করে বললাম কণা? আমার কথা প্রতিধ্বনিত হলো গঙ্গার নিঃশব্দতায়। কেঁপে উঠলো আমার সমস্ত শরীর। ও দুহাত দিয়ে আমায় জড়িয়ে ধরে বলল রেহানার অবস্থা তুমি বুঝতে চাইছে না প্রান্তিক। ওকে একটু বুঝবার চেষ্টা কর। আজকাল কলেজে যে সমস্ত আলোচনা হয় তুমিতো তার কিছুই জানো, জানবার চেষ্টাও কর না। অবশ্য রেহানার এই অবস্থার জন্য তোমার পিসিও কম দায়ি নয়। পিসি? তুমি কি বলছ কণা? আমি ঠিকই বলছি। তোমার পিসি সব কিছু জেনেও সেলিনার প্রতি তার দুর্বার ভালবাসা, সেলিনাকে তোমার দিকে নিয়ে যেতে সাহায্য করছেন। আমি চিৎকার করে বললাম আমি বিশ্বাস করি না, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না তোমার কথা। অধৈর্য হয়োনা প্রান্তিক। সেলিনাকে তুমি সত্যিই স্নেহ কর। তাই তোমার পক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন, কিন্তু সেলিনা তো মেয়ে। তুমি কোন দিনও তাকে একটা মেয়ে হিসাবে ভাবতে শেখোনি, তাকে তুমি তোমার আপন ছোট বোনের মর্যাদায়, তার সব দাবি মিটিয়ে এসেছো? তোমরা পুরুষরা এখানেই ভুল করে প্রান্তিক। তারপর বলল আজ তোমাকে একজনকেই বেছে নিতে হবে, যা তোমার পক্ষে অসম্ভব। না হলে দুজনার কাছ থেকেই দুরে সরে যেতে হবে। আরো বলল ঠিক জানিনা, শুধু বিশ্বাস করি, রেহানা চাইবে তুমি সেলিনাকে নিয়ে সুখী হও, সে থাকবে তোমার স্বপ্নের মানসী হয়ে। তাইতো সে চলে যেতে চাইবে তোমার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আর তাই বলছিলাম, আজ যদি সে তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যায়।
আমি চুপ করে রইলাম। অশ্রুকণার এত কথার কোন উত্তর দিতে পারলাম না। জীবনের অনেক ছোট ছোট ঘটনা মনে হতে লাগল। রাগ অনুরাগ-মান, অভিমান-জেদ, ঈর্ষা। হাসপাতালের স্মৃতি, ফুল দুটো ছুঁড়ে ফেলাতে তার তীব্র অভিমান, সব কিছু চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল একেব পর এক। সেলিনার প্রতি পিসির আলাদা আকর্ষণ। পিসির বাড়ীর সবকিছুর প্রতি তার এক ধরণের অনুভূতি। অশ্রুকণার ইঙ্গিতে যেন নতুন মাত্রা পেল। ও বলল, কি ভাবছ? না ভাবছিনা কিছুই। এতক্ষণতো তোমার কথা শুনলাম। আমাকে একটু ভাবতে দাও। তারপর বললাম, বিশ্বাস কর কণা, আমি আলাদা করে কোনদিনই তোমাদের ভাবতে শিখিনি। তুমি, রেহানা, অনুতপা, টুম্পা, পিঙ্কি, সুমিত, সুব্রত, রাহুল এদের কাউকে বন্ধুত্বের বাইরে গিয়ে কিছু ভাবা ভাবনার অতীত ছিল আমার কাছে। তারপর কেমন করে যে ধীরে ধীরে রেহানা এসে গেল আমার জীবনে, চিন্তায়, মননে, কল্পনায়, কেমন করে যে সে তার নিঃশব্দ পদসঞ্চারকে আরো গতিময় করে তুলল, সে এক চরম রহস্য। কিন্তু সেলিনার মধ্যে খুঁজে পেলাম আমার কৈশোরে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়া বোনের স্মৃতি। তার হাসি ঠাট্টার মধ্যে একটি নারীমন যে ধীরে ধীরে পাখা মেলতে পারে ভাবিনি। ও যখন বাগান থেকে ফুল তুলে আমায় বলতো, দিননা প্রান্তিক ভাই আমার বেনীতে গুঁজে, কখনো মনে হয়নি, তার ভিতর কোন প্রেমিকার আকুতি থাকতে পারে। আমার বোনটিও মাঝে মাঝে বলতো, দে-না দাদাভাই এই ফুলটা আমার চুলে গুঁজে। আমি গুঁজে দিয়ে তাকে বলতাম, তোকে ঠিক রাজকন্যার মত দেখাচ্ছে। সেলিনাকে সে কথা কোনদিন বলতে পারিনি, যদি অন্য অর্থ করে, তবুও ওকে সাজিয়ে দিতে গিয়ে আমার মনে পড়তো আমার বোনের কথা। হাসপাতালে তার কিছু কিছু দুর্বলতা আমার দৃষ্টি এড়ায়নি কলা, তবু তাকে আমি অন্য কোন ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারিনি। শুধু সেদিনই প্রথম খটকা লেগেছিল, যেদিন পিসি ওকে পিসির জন্য কেনা আমার পছন্দ করা শাড়িতে সাজিয়ে দিয়েছিল। সন্ধ্যায় ওর খোঁপায় খুঁজে দেওয়া ফুল দুটো অবহেলায় ফেলে দিয়েছিলাম। দেখে ছিলাম সে দিন তার তীব্র অভিমান। রেহানাকে বলেছিল, ওতে নাকি আমি ওকে অপমান করেছি। আমি ভুলে গিয়ে স্বাভাবিক হতে চেয়েছি, কিন্তু সেলিনা যেন কেমন অস্বাভাবিক হয়ে গেল আমার জীবনে। সব থেকে অবাক লাগে আফরোজ বেগমের এই পরিবর্তনে। কি চান তিনি আমি জানিনা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে পড়তে চাইলাম। ও বলল আরেকটু বোস না। আমি বসলাম। সামনে বয়ে চলেছে গঙ্গা। জোয়ারের জলে কানায় কানায় ভরে গেছে সিঁড়ির খাদগুলো। আর একটু হলে পা ভিজে যাবে। ও তাকালো আমার দিকে। বলল। আমায় বিশ্বাস করতে পারবে প্রান্তিক, বলে ও বলল, আমার মনে হয় রেহানার কাছ থেকেও তোমার কাছে একদিন এ অনুরোধ আসবেই, সেলিনাকে গ্রহণ করার। কি করবে সেদিন? আমার সমস্ত অন্তরটা পুড়ে ছাই হয়ে যেতে লাগল। আমার এই ছোট . জীবনে ভালবাসা যে এমন কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে ভাবিনি কোনদিন। বললাম, আজ থাক কণা। যদি সত্যি সেদিন আসে, রেহানাকে পাবোনা জেনেও সেলিনাকে মেনে নিতে পারব না কিছুতেই। কেন পারবে না? সেলিনা তোমাকে সতি ভালবাসে প্রান্তিক সেদিনই তা বুঝেছিলাম, যেদিন রেহানার পরিবর্তে ও গিয়েছিল আমাদের ওখানে তোমার সাথে। যদি বুঝেছিলে তবে বললেনা কেন? ভাবতে পারিনি তুমি এত অন্ধ প্রান্তিক। বললাম তোমার কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে তো আমি সত্যিই অন্ধ। কখন যে সূর্য গড়িয়ে গেছে পশ্চিম আকাশে খেয়াল নেই। বললাম, কণা আজ মনে হচ্ছে কি জান? কি? তোমার থেকে বোধ হয় ওরা কেউ আমাকে বেশী ভালবাসে না। অশ্রুকণা আবারও আমার হাতটা তার হাতের মধ্যে নিয়ে আস্তে আস্তে তার মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে হাতেই একটা চুমু খেয়ে বলল, তোমার স্বীকৃতিটুকু আমি চিরদিন মনে রাখব প্রান্তিক। যদি কখনো তোমার জন্য আমার প্রয়োজন হয়, বলল, দাঁড়াবো তোমার পাশে এসে, করবনা তোমার বিশ্বাসের কোন অমর্যাদা। তাই বলে প্রত্যাঘাত দিতে কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিওনা প্রান্তিক খারাপ লাগবে। আমি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকালাম ওর দিকে। বললাম, মনে রাখব তোমার কথা, এবার বলত কেন প্রিন্সিপাল সাহেব ডেকেছেন রেহানাকে। সে তুমি ওর কাছেই জেনে নিও। তারপর বলল ও হয়তো বলতে চাইবেনা, যা অদ্ভুত চাপা মেয়ে। আর একটা কথা, সেলিনাকে এড়িয়ে চলো না, যত এড়াবে, ততই জড়িয়ে যাবে প্রান্তিক। একেবারে স্বাভাবিক ভাবে ওকে বুঝতে চেষ্টা করো। আমি বললাম তাই হবে কণা। কিন্তু তুমি আমায় একটা কথা বলবে? কি কথা? তুমি এসব জানলে কি করে? তোমাকে জানতেই হবে? হ্যাঁ। অশ্রুকণা বলল, জানতাম আমি একদিন তুমি আমার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর জানতে চাইবে। তারপর বলল, দরকার কি প্রান্তিক উৎসকে জানার, বরং অপেক্ষা করো একদিন রেহানাই হয়তো তোমাকে সব বলবে। আর কেউ জানে? হয়তো জানে। কে? মিনতি সেন। মিনতি সেন? মানে পিসি? যিনি রেহানাকে তার মেয়ের মতন ভালবাসেন। কেন বিশ্বাস হচ্ছে না। তা বলছিনা। কিন্তু আমায় তো উনি কিছুই জানালেন না। অশ্রুকণা বলল, এতো চিন্তিত কেন? হয়তো তিনি নাও জানতে পারেন। তবে আমার অনুমান তিনি জানেন এবং হয়তো একদিন বলবেনও তোমাকে। আর কেউ? অশ্রুকণা বলল, তোমাকে যা জানাতে চেয়েছিলাম, সবই জানিয়েছি আর কোন প্রশ্ন করোনা। শূন্য হৃদয় একদিন যে ভালবাসার আস্বাদ লাভ করে ছিল, ভেবেছিল এর কোন ক্ষয় নেই। কোন দুর্বল মুহূর্তে তা যে ক্ষয়ে যেতে পারে, মন তা স্বীকার করে না বলেই এত দুঃখ এত বেদনা। ওঠো প্রান্তিক। আমি আকুল হয়ে বললাম, এই তোমার শেষ কথা। না এ আমার শেষ কথা নয়। আমি জানি আবার তুমি আসবে একদিন এই ঘাটে, অথবা অন্য কোথাও, পারলে সেদিন আমি তোমাকে নতুন জীবনের গান শোনাব প্রান্তিক। সেটা কবে? তাতো জানি না। আমি শুধু জানি রেহানার ভালবাসাই একদিন তোমাকে আমার কাছে নিয়ে আসবে, অথবা আমি আসব তোমার কাছে। জানি সেদিন আমাকে ফেরিয়ে দেওয়ার কোন ক্ষমতাই থাকবেনা তোমার। আমিতো আজো তোমাকে ফিরাতে চাইনে কেন তবে ভয় পাচ্ছ? ভয় নয়, হাসল অশ্রুকণা। আমি বললাম, চল ওঠা যাক। ও বলল চল, তাহলে।
ভেবেছিলাম, রেহানাই বলবে, কেন প্রিন্সিপাল তাকে ডেকেছিলেন, কিন্তু বেশ কয়েকদিন হয়ে গেল ও কোন কথাই বলল না। কেন বলল না আমাকে কি ওর সন্দেহ হয়? না আমাকে আর আগের মত বিশ্বাস করতে পারছেনা। মন জানতে চায় ওর কথা। কিন্তু আমারও যে কি হয়েছে, কে জানে? তবে কি আমিও মনে মনে ওর কাছ থেকে সরে আসতে চাইছি!
একটা অফ পিরিয়ড। ওরও অফ। বললাম চলনা এ সময়টুকু কোথাও থেকে ঘুরে আসি। বলল, তুমি যাও প্রান্তিক আমার ভাল লাগছেনা। কেন কি হয়েছে তোমার? একদিন বাড়ীতে এসো বলব। বাড়ীতে? বাড়ীতে বলতে পারবে? কেন তোমাকে কি বাড়ীতে কোন কথা কোন দিন বলিনি? বলেছ। কিন্তু সেদিনগুলো কি আর আছে আমাদের? কেন নেই কেন? আমার তো মনে হয় না কোন কিছু হারিয়ে গেছে। তাই যেন হয় রেহানা। ও হঠাৎ বলল তোমার কি হয়েছে বলত। কেন? আজ কাল কিছুই জিজ্ঞেস করো না আমাকে। সব সময় কি যেন চিন্তা করো। সেলিনা তোমাকে কিছু বলেছে? সেলিনা আবার আমাকে কি বলবে? কিছুই বলবেনা? ওর কি কিছুই বলার নেই তোমাকে?
আমি অবাক হয়ে বললাম, এ সব কি বলছ রেহানা। তুমি যেন আমার কাছে ক্রমশঃ রহস্যময়ী হয়ে উঠছে। আমি তো চিরদিনই রহস্যময়ী, শুধু তোমার কাছে কেন সকলেরই কাছে। তারপর নিজেই বলল, তোমার তো এর পরের ক্লাসটা আছে তাই না? হ্যাঁ। ফাঁকি দাওনা। কেন? চলনা ঘুরে আসি কোন জায়গা থেকে। কোথায়? যেখানে তোমার ইচ্ছে। তুমি কি ঠাট্টা করছ? তোমার সঙ্গে যাব এতে আবার ঠাট্টার কি হল? আচ্ছা কোথায় যেতে চাও। গড়ের মাঠে। বেশ চল। তাতে কিন্তু সারাদিনের ক্লাস ফাঁকি দিতে হবে। তাই দেব।
এ এক নতুন রেহানা। এ যেন কোন কিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। আমরা এলাম গড়ের মাঠে, মাথার উপর চড়া রোদ। শীতকাল তাই রোদটা যেন প্রেমিকার কবোষ্ণ পরশ। আমরা শুধু হাঁটতে লাগলাম। কোথাও যেন আমাদের বসার জায়গা নেই। ও বলল, আর পারছি না প্রান্তিক। একটু খানি বসা যাক। বেশ ঐ গাছটার নীচে চল। আমরা পাশাপাশি বসলাম। হঠাৎ মেয়েলি কণ্ঠে কে যেন তার সঙ্গীকে বলছে, দেখ কেমন কপোত কপোত বসে আছে আর তোমার সবতাতেই লজ্জা। রেহানার কানে যেতেই লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। বলল, চল আর বসবনা। আমি বললাম, এই গড়ের মাঠে হয়তো আরো অনেক কথা শুনতে হবে, তার থেকে চল, তপতী একদিন তোমাকে দেখতে চেয়েছিল ওর ওখানে যাই।