মিনতি সেন বুঝতে পারেনি
মিনতি সেন বুঝতে পারেনি, প্রতীম চৌধুরী ফোনে কি বলেছেন। আমি প্রতীম চৌধুরীর কাছে এগিয়ে এসে বললাম, কাকু এ আপনি কি করেছেন। সেলিনা মারা গেছে কি না আপনি তো জানেন না। তা হলে মিথ্যে খুনেব দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে আপনি কেন পুলিশকে আসতে বললেন? এসেছে পুলিশ? না আসেনি, ওদের আসতে দাও।
হঠাৎ পুলিশের গাড়ীর হর্ন বাজতেই, মিনতি সেন অবাক হয়ে বললেন, পুলিশ? আমার বাড়ীতে পুলিশ কেন? প্রতীমবাবু এগিয়ে এসে বললেন, মিস সেন, আমিই ওদের আসতে বলেছি। অবাক হয়ে বললেন, আপনি? কেন? সেলিনার মৃত্যুর জন্যতো আমি দায়ী। সেলিনা যে মারা গেছে আপনাকে কে বলল? গেছে মিস সেন সেলিনা বেঁচে থাকতে পারে না। এ আপনি কি বলছেন? সেলিনা বেঁচে থাকতে পারে না মানে? মানে যা সত্য তাই আপনাকে বললাম মিস সেন।
সেলিনা তখন আস্তে আস্তে চোখ মেলেছে। অজ রক্ত পাতে নিজেকে কেমন হাল্কা মনে হচ্ছে। আস্তে ডাকলো কাকু। প্রতীমবাবু এগিয়ে এলেন, আমি ও মিনতি সেন এই অবাক দৃশ্য দেখতে লাগলাম, বললেন কিবে রেহানা, কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে? ও বলল, আমি রেহানা তো! হা মা, তুইতো রেহানা! তা হলে সেলিনা কোথায়? এই তো একটু আগে এই খানেই ছিল, এখন আর নেই। তা হলে পুলিশ কেন? ওরা আমাকে এ্যারেষ্ট করতে এসেছে মা। এ্যারেষ্ট করতে? তোমাকে? কেন? আমি যে ওদের আসতে বলেছি। সেলিনা বলল তুমি ওদের আসতে বলেছো কেন? যে ভাবে তুই ওপর থেকে দৌড়ে আসছিলি এবং আমিও তোকে ডাকতে ডাকতে উপরে উঠছিলাম, তাতে পা পিছলে পড়ে যাস, এবং একটা এক্সিডেন্ট কল্পনা করে পুলিশকে সংবাদ দিতে বাধ্য হই। ও তাই বল, তারপর আস্তে আস্তে মিনতি সেনকে বলে, মা কাকুকে বসতে বলবে না? আর পুলিশদের লক্ষ করে বলল, ওরা কষ্ট করে এলেন, ওদের একটু চা খাওয়াও না মা? মিনতি সেন বল্লেন এই খাওযাই। প্রতীমবাবু জানতে চান, এখন কি একটু ভাল লাগছে রেহানা। হ্যাঁ কাকু। তাহলে শুয়ে থাক। আমি আসছি। প্রতীমবাবু ডাঃ মুখার্জীকে ফোনে একবার আসতে বলেন। আধঘন্টার মধ্যে আসেন ডাঃ মুখার্জী।
মিনতি সেন অবশ্য তার আগেই, সেলিনার রক্তে ভেজা শাড়ী বদলিয়ে দিয়ে তাকে নতুন শাড়ী পরিয়ে, চুল আচড়িয়ে দিয়ে, আবার বিছানায় শুইয়ে দিয়েছেন। ডাঃ মুখার্জী তাকে দেখলেন। তারপর প্রেসক্রিপশান লিখে দিয়ে চলেও গেলেন। প্রতীম বাবু জিজ্ঞাসা করায় ডাঃ মুখার্জীকে বলেন, না ভয় নেই। শুধু নাসিং হোমে ভৰ্ত্তি করে একটা ছোট্ট অপারেশান করতে হবে। এতে খুব মানসিক আঘাত পাবেন উনি, তাই ওর মনটাকে দেখার দায়িত্ব আপনাদের। তারপর ডাঃ মুখার্জী জিজ্ঞাসা করেন, আপনি ওকে রেহানা বলে ডাকছিলেন, রেহানা কে? প্রতীমবাবু সংক্ষেপে রেহানার ইতিহাস ডাঃ মুখার্জীকে জানান। ডাঃ মুখার্জী জানান, একজন সাইকোলোজিস্টকে দেখালে ভাল হয়। আপনি যা বললেন, তাতে মনে হচ্ছে, রেহানার ভীতি তার মন থেকে যাওয়ার নয়। একটা অপরাধ বোধও ভিতরে ভিতরে কাজ করছে। সব থেকে ভাল হয়, যদি রেহানাকে খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতীম চৌধুরী বললেন, কিন্তু তাতে উল্টেটাতো হতে পারে। সেই জন্যই তো একজন সাইকোলজিস্ট দেখাতে বলছি। তবে আমার মনে হয় আপনি যা আশঙ্কা করছেন তা হবেনা। বরং রেহানা যদি সামনে এসে ওকে মেনে নেয় তাহলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যদি তাকে না পাওয়া যায় তাহলে মাঝে মাঝে এরকম অস্বস্তিকর অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার ভয় থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকছে। আরো বললেন, আপনি যখন বলছেন, রেহানা চলে যাওয়ার পরেও ২/৩ জায়গায় গেছেন, তাহলে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও তিনি আছেন, একবার দেখুন না চেষ্টা করে। আর তার সন্তান, যার জন্য সে স্বপ্ন দেখছে, সেই স্বপ্ন ব্যার্থ হয়ে গেলে কি হবে? ডাঃ মুখার্জী বললেন, আমি আশাবাদী মিঃ চৌধুরী। এতরক্ত ক্ষরণের পরেও আমি মনে করি তার সন্তান ভালই আছে। আর একান্তই যদি ভুল প্রতিপন্ন হই, কি আর করা যাবে। আবার নতুন আগুন্তুকের অপেক্ষায় থাকতে হবে। কিন্তু সবার আগে দরকার রেহানাকে একবার খুঁজে পাওয়া। আমি দেখছি, নমস্কার।
প্রতীমবাবু ফিরে এলেন। মিনতি সেন বললেন, সেই আসার পর থেকেই একটানা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ছেন, শরীরও তো আপনার ঠিক সুস্থ নয়। একটু বসুন না। হ্যাঁ বসি, সত্যি ক্লান্তি লাগছে। তা হলে এক কাপ গরম কফি দিই। হলে মন্দ হতোনা, ওই যে কে যেন জবার মা, ওকেই বলুন না, কড়া করে এক কাপ কফি। আমিই নিয়ে আসছি, আপনি বসুন। সেলিনা বলল, কাকু, তুমি আমাকে রেহানা রেহানা বলে ডাকলে কেন? আমিতো সেলিনা। কি জানি ঐ নামটাই বেরিয়ে গেল তোমাকে ডাকতে গিয়ে। ওকে আপনি চেনেন? দেখেছেন কখনন? শুনেছেন ওর কথা কিছু? না, শুনিনি, তবে নামটা তোমাদের মুখে এতবার শুনেছি যে, ভুলতে পারিনি, তাই হয়তো অসতর্কতায় বেরিয়ে গেছে। সে না হয় ভুল করে আমি তোমায় ডাকলাম, কিন্তু তুমি অমন দৌড়িয়ে এলে কেন?
জানিনা কাকু, তবে ওই নামে আমাকে কেউ ডাকলে আমার ভীষণ ভাল লাগে। ভাল যদি লাগে তা হলে সকলকে তো বলতে পারো তোমাকে ওই নামে ডাকতে। বলেছিতো, কিন্তু কেউ ডাকে না। এতদিনের অভ্যেসতো মা তাই হয়তো অসুবিধা হচ্ছে। তার চেয়ে তুমি এক কাজ করো। বল। তুমি আমার ওখানে চলো, আমি সব সময় তোমাকে ঐ নামেই ডাকবো। সেলিনা আমার দিকে তাকালো, বললাম যাবে কাকুর ওখানে? যাও না। তুমিও চল। আমি কি করে যাই বল। আমার তো কাজ আছে। শুধু কাজ আর কাজ। একদম সময় দাওনা তুমি আমাকে। আমি হাঁপিয়ে উঠি। এত কাজ করতে হবে না তোমার। আমি লজ্জা পেয়ে বললাম, তুমি কাকুর সঙ্গে কথা বল।
মিনতি সেন, এর মাঝে কাকে দিয়ে যেন গরম সিঙ্গারা আনিয়েছেন। সেই সিঙ্গারা এবং কফি এগিয়ে দিয়ে বললেন এটা খেয়ে নিন, আর রাতে কিন্তু খেয়ে যাবেন। মিনতি সেনের দিকে না তাকিয়েই বললেন, আজ নয় মিস সেন? কেন? একটু অসুবিধা আছে। মিথ্যে অজুহাতটা বুঝি এখনো তৈরি করতে পারেননি। না তা নয়। সেদিনও মিথ্যে বলিনি মিস সেন আসলে…। কি আসলে? থাক ওসব কথা। বরং যদি অসুবিধা না হয়, কয়েকদিন মেয়েটাকে নিয়ে যাবো? আমার কাছে অনুমতি নিচ্ছেন? অনুমতিতে নিতে হবে বৈকি। ও আপনার ছেলের স্ত্রী। আপনার সম্মতি ছাড়া আমি কি ওকে নিয়ে যেতে পারি? ঠাট্টা করছেন? না ঠাট্টা নয়, সত্যি বলছি যদি আপনি অনুমতি দেন, তা হলে ওকে নিয়ে কয়েকদিন রাখব আমার কাছে। অশ্রুদের স্কুলে একবার যেতে হবে। ভাবছি ও যদি যায় আমার সঙ্গে, ওর ভাল লাগবে, অশ্রুরও হয়তো ভাল লাগবে। সেলিনা বলল তুমি যাবে কাকু অশ্ৰুদির ওখানে? হ্যাঁ মা যেতে তো হবেই একবার। আমিও যাব তোমার সাথে। অবশ্যই যাবি, কিন্তু তোর শ্বাশুড়ীর মতটা তো আমার দরকার।
এই শ্বাশুড়ী শব্দটায় ভীষণ লজ্জা পেলেন মিনতি সেন। বললেন, আপনার মেয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন, আমার মত দেওয়ার কোন অধিকার আছে কি না জানিনে। তবুও আমি সম্মতি দিচ্ছি, নিয়ে যান ওকে ক দিনের জন্যে। আমার এখানকার থেকে ও আপনার কাছে মনে হয় ভাল থাকবে। অনেক কথা ও আমাকে বলতে পারে না। কিন্তু আপনাকে মনে হয় ও বলতে পারবে। প্রতীমবাবু বললেন কিন্তু প্রান্তিক? না ওর সম্মতির জন্য ভাবতে হবে না, ওটা আমার উপরে ছেড়ে দিন।
প্রতীমবাবু উঠে পড়লেন এবং বললেন, তাহলে ঐ কথা রইল, আমি কাল সকালে নিজেই আসব, নমস্কার। মিনতি সেন প্রতি নমস্কার করে বললেন, তাই আসবেন, প্রতীমবাবু এক পা এগিয়ে এসে আবার পিছিয়ে গিয়ে বললেন, কাল কিন্তু আপনার হাতের রান্না খেয়ে যাবো, দেখবেন, হোটেল থেকে আনিয়ে আমার খাওয়ার ইচ্ছেটাকে নষ্ট করে দেবেন না।
মিনতী সেন ভাবতে লাগলেন, কি অদ্ভুত মানুষ কোন লজ্জা নেই। এতবড় মেয়ের সামনে এমন ইচ্ছের কথা কেউ বলে নাকি! খেতে চেয়েছেন, আর আমি নিজের হাতে রান্না না করে হোটেল থেকে এনে খাওয়াবো, ভাবলেন কি করে? প্রতীমবাবু চলে যাওয়ার পরে, মিনতি সেন, সেলিনার বিছানায় বসে, ওর হাতের আঙুল গুলো টিপে দিতে লাগলেন। হাসছে ও মিটি মিটি। মিনতি সেন বললেন, অমন লুকিয়ে লুকিয়ে হাসছিস কেন? তোমার অবস্থা দেখে। আমার আবার কি অবস্থা। কাকু যখন তোমার হাতের রান্না খেতে চাইলো, মুখটা তোমার কেমন প্যাচার মত হয়ে গেল, কি হাসি না পাচ্ছিল তোমাকে দেখে, তা আর কি বলব, মা। খালি ঠাট্টা সব সময় ইয়ার্কি। ইয়ার্কি না মা, সত্যি। তারপর বলল এটা কিন্তু কাকুর খুব অন্যায়। কেন তুমি রায়া করবে, জবার মতো আছে। আসলে কোন কাজের লোকের হাতে উনি খাবেন না। তাই কায়দা করে বললেন, তোমার হাতে খাবেন। এদের মুখে এক মনে আরেক। তুই চুপ করবি। মিনতি সেন ধমক দিয়ে উঠলেন। আচ্ছা মা, একটা কাজ করলে হয় না? কি? রান্নাটা না হয় আমিই করলাম, তুমি বললে তুমি করেছো? খালি ফাজলামো তারপর বললেন, তুই এখন কি খাবি বল। না আমি কিছু খাব না, শুধু তোমার সঙ্গে গল্প করব। পাগলি মেয়ের আবদারের জন্যে আর পারিনে। তোমার পেরেও কাজ নেই। তারপর চিৎকার করে ডাকলো জবার মা। জবার মা কাছে এসে দাঁড়ালে বলল, কাল কাকু এখানে খাবেন জান? শুনেছি বৌদিমনি। আর মাই সব রান্না করবে তা জান? জবার মা বললেন উনি কেন রান্না করবেন, আমিই করব। এই সেরেছে, দেখেছো মা, কাকুর খাওয়াটার বারোটা বাজল। জবার মা বলল, আমি কি কোন অন্যায় করেছি বৌদিমনি। মিনতি সেন বললেন, না তুমি যাও জবার মা। সেলিনা বলল, জবার মা, তুমি চা বা কফি খাওয়াতে পারবে? এখনি আনছি। জবার মা চলে গেলে, সেলিনা বলল, কাকুকে দেখলে তুমি অত কঁপ কেন বলত মা। তোমাকে দেখলে অন্যেরা কাঁপে আর তুমি কাকুকে দেখলে কাপ। কথা বলতে গেলেও গলায় সেই জোর থাকে না কেন? মিনতি সেন বললেন তুই এখন চুপ করতো। তোর কাকু কি কি খেতে ভালবাসেন তাই বল। বা আমি জানব কি করে? জানিসনা তো অত কাকু কাকু করিস কেন? যেন কাকুই সব, আর আমরা সব বানের জলে ভেসে আসা মানুষ। কপট অভিমান দেখায় মিনতি সেন।
সেলিনা খিল খিল করে হেসে উঠলো। মিনতি সেন বললেন হাসলি যে। তোমার অবস্থা দেখে। রাগটাও প্রকাশ করতে জানো। তার থেকে চলনা মা, তুমিও কয়দিন থাকবে আমার সাঙ্গে কাকুর ওখানে। মিনতি সেন বললেন বেশ বলেছিস, সেই কাকু আর কাকু। তুই একা একা কাকুর কথা ভাব। আমার কাজ আছে।
এর মাঝে কেমন করে যেন, নীলাঞ্জনা পিসিকে সংবাদ দিয়েছেন, মিনতি সেন। তাই ভোর না হতেই নীলাঞ্জনা এসে উপস্থিত। সেলিনা বলল, মা তুমি? হারে। তা এখন ভাল আছিস তো? কি কাণ্ডটা বাঁধিয়েছিলি বলত। একটু সাবধানে থাকতে পারিসনে। জান মা, আজ কাকু আসবেন, তুমি একটা কাজ করনা। কি? কাকু কি কি খেতে ভালবাসেন একটু ফোন করে জেনে নাওনা। কেন? বা উনি যে খাবেন এখানে বলে গেছেন। মা তো জানেনইনা, তার কি পছন্দ। ও তাই বল, তাই মিনতি আমায় ফোন করে আসতে বলেছে। বাঙালী মানুষ কি আর খাবেন, মাছের ঝোল ভাত, বড় জোর সাথে মাংস। তা যাইই খানা কেন, মিনতি যাই দেবে তাইই খাবে। এতে আবার জানবার কি আছে? প্রান্তিক কোথায়? আছে কোথাও।
নীলাঞ্জনা বললেন, তুই নাকি আজ কাকুর ওখানে যাবি? প্রান্তিক যাচ্ছে? তুমি চলনা মা। কি যে বলিস সেলিনা? তোর মাথাটা একদম খারপ হয়ে গেছে। ও মৃদু মৃদু হাসতে হাসতে বলল, আমারও তাই মনে হয়।
বেলা ৯টা নাগদ এলেন প্রতীমবাবু। নিজে ড্রাইভ করে। আজ আর বাইরে থেকে ডাকলেন না। আস্তে আস্তে এসে বেল বাজালেন। নীলাঞ্জনা দরজা খুলে প্রতীমবাবুকে দেখে যেন কিছু জানেন না এমনি অবাক হয়ে বললেন, আরে আপনি? হ্যাঁ, আমি, একটু দেরি হয়ে গেল। কেন কোথাও আটকে পড়েছিলেন? না। তবে? আসলে আমি আপনার ওখানে গিয়েছিলাম। অবাক হয়ে নীলাঞ্জনা বললেন, আমার ওখানে? খুব কি প্রয়োজন? প্রয়োজন কিছু নেই। তারপর নিজেই জানতে চাইলেন আচ্ছা প্রয়োজন ছাড়া কি আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতে নেই? আমাকে ভুল বুঝবেন না, আমি কিন্তু তা বলিনি। সে আমি জানি, আসলে আপনার মেয়েকে আমি কয়েকদিন কাছে রাখতে তাই। যদি আপনার অমত থাকে। মেয়ে আমার হতে পারে। কিন্তু ওর গার্জিয়ানতো এখন মিনতি ও মত দিয়েছে তো। হ্যাঁ, গতকাল সেটা উনি দিয়েছেন। তাহলে? তাহলেও আপনিতো ওর মা? কথা বলতে বলতে ওরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছেন। নীলাঞ্জনা বললেন, আসলে আপনি এখনো আমাদের একজন হয়ে উঠতে পারেন নি। কি করে বুঝলেন? যদি পারতেন, তা হলে এত শিষ্টাচারের ভিতর দিয়ে এগোতেন না। অধিকার এভাবে পাওয়া যায় না মিঃ চৌধুরী। কেউ অধিকার দেয় না। অধিকার অর্জন করে নিতে হয়। আজ যদি আমি বলি, না ও যাবেনা। আপনি নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে যাবেন না। না তা কি করে যাই। যদি ওকে না নিয়ে যান, ওর মনের কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছেন? ওতো ওর কাকুর কাছে যাওয়ার জন্য সেই সকাল থেকে সেজে গুঁজে বসে আছে। তা হলে আমার কি করণীয় বলুন। শুধু একটু জোর খাটাতে বলেছি। আর কিছু না। তারপরে বললেন শুধু অর্থের জোরটাই জোর নয়, মনের জোরটাও দরকার। আর তার জন্য দরকার ভালবাসার অধিকার বোধ। এরপর প্রতীমবাবুকে উপরের ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে বললেন, যান, আপনি, মেয়ের সঙ্গে গল্প করুন আমি আসছি।
নীলাঞ্জনা রান্না ঘরে গেলে মিনতি সেন বললেন, কি রাঁধি বলত। রান্নার অভ্যেস একদম নেই, আগে মা করতো। তারপর জবার মা। তারপর কালে ভদ্রে রান্না ঘরে এলেও যাকে রান্না বলে তা কোন দিন করিনি। তাহলে জবার মাকেই বল না রান্নাটা করে দেবে। কিন্তু ওর কাকু যে আমার হাতে রান্না খাবেন বলেছেন, কি করি বলত। কি আর করবে, খেতে যখন চেয়েছেন যা পার তাই কর, যদি খেতে না পারেন। হেসে ফেলে নীলাঞ্জনা বললেন, পারবে মিনতি পারবে। ভালবাসার আকর্ষণে পারা যায় না এমন কিছু নেই। তোমার সব তাতেই ঠাট্টা। ঠাট্টা নয় ভাই, এমনতো নয় যে, তোমার হাতের রান্না তিনি আগে খান নি। সেদিন অসুস্থ মানুষটাকে তো তুমিই খাইয়েছিলে, তা যখন খাওয়া গেছে আজো যাক চিন্তা করো না। বরং তমি চা বা কফি দিয়ে এস, আমি দেখছি।
দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে প্রতীমবাবু বললেন, তাহলে মিস সেন এবারে আমাকে উঠতে হবে। সেলিনা তার আগেই সেজে গুঁজে প্রস্তুত। আমাকে বলল, তুমি যাবে না? না, আমি কি করে যাব বল? আমি একা যাব? তাইতো কথা হয়েছে। না কখনো হয়নি, এ তোমার অজুহাত মাত্র তা হলে আমিও যাব না। ছেলেমানুষি করো। সবাই কি ভাববে? কিছু ভাববে না, তোমাকে যেতেই হবে। গিয়ে কি করব, কালতো তোমরা অশ্রুর ওখানে যাবে। তুমিও যাবে। কি যে গোঁয়ারতুমি কর।
নীলাঞ্জনা পিসি এগিয়ে এসে বলেন, প্রান্তিক তুমিও যাওনা ওর সাথে। মিনতি সেনও বল্লেন যা প্রান্তিক। বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হয় তুমি এখন কাকুর সঙ্গে চলে যাও। আমি রাতে যাবে। ঠিক আছে, বলে সেলিনা আস্তে আস্তে নেমে গাড়ীতে গিয়ে ওঠে।
শেষ পর্যন্ত সেলিনার নাছোড় বান্দা পনে আমাকেও আসতে হয় অশ্রুদের এখানে। প্রতীম বাবু কাউকে না জানিয়ে এখানে এসেছেন। উঠেছেন সত্যভুষণবাবু যে কোয়ার্টারে থাকেন সেখানে। সেলিনা বলল, তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে না কাকু? কেন মা আমিতো কাছেই আছি। যে দু তিন দিন থাকব রোজ তোমাদের কাছে আসবো। অশ্রুকে বলবে, আমি ওর ওখানেই খাব, তা হলেতো তোমার আর কোন অভিমান থাকবে না। বেশ, কিন্তু এখন তুমি যাবে না আমাদের সঙ্গে? না মা, আমি কোয়ার্টারে গিয়ে জামা কাপড় বদলে আসি, ততক্ষণ তোমাদের চা বা কফি হয়ে যাবে। আমি এসে খাবো।
গেট খুলে আমাদের ঢুকতে দেখে সীতা চিৎকার করে বলে ওঠে দিদিমনি, দাদাবাবু এসেছেন। অশ্রু বুঝতে না পেরে বলে, কে এসেছেন? সেলিনা ততক্ষণে ঘরে ঢুকে অশ্রুকে জড়িয়ে ধরে বলে চিনতে পাবছোনা? শুধু হাসছে সেলিনা। তাহলে, অশ্ৰুদিকে মনে পড়েছে তোমার? তারপর আমাকে বলল, কি হলো প্রান্তিক চুপ চাপ আছে যে। না দেখছি তোমাকে। কি দেখছো? দেখছি ভারি সুন্দর হয়েছে তুমি। তা কেমন আছ কণা? খুব ভাল। সেলিনা বলল, শুধু আমরা দুজন আসিনি অদি, আরো একজন এসেছেন? কে? বলতো কে? কি করে বলি। এক এক করে নাম ধরে ধরে বলতে আরম্ভ কর, দেখবে ঠিক এক জায়গায় এসে মিলে যাবে। না ভাই অতটা পারবো না, তার চেয়ে বরং তুমিই বলে দাও কে এসেছেন? সেলিনা বলল, প্রতীমকাকু? কানটাকে যেন বিশ্বাস হচ্ছে না অশ্রুকণার। তাই পুনরাবৃত্তি করে বলল, কি যেন বললে প্রতীম …! আমি বললাম প্রতীম চৌধুরী এসেছেন, সম্ভবত তোমাদের এখানে অফিসিয়াল কাজেই এসেছেন। কিন্তু যে ২/৩ দিন থাকবেন তোমার এখানেই খাবেন। তুমি যেন সেইভাবে ব্যবস্থা কর, তাই বলে পাঠিয়েছেন। অশ্রুকণা অবাক হয়ে বলল, তুমি বলছ কি প্রান্তিক, স্যার আমার এখানে খাবেন? কই উনিতো আগে বলেননি কিছু। উনি আসবেন একথা তো এখানকার কেউ জানে না। সেলিনা বলল, অতশত জানিনে অশ্রুদি, তোমাকে কফি করতে বলেছেন উনি এখনি আসবেন।
তাড়াহুড়ো করে ভিতরে গেল অশ্রুকণা। সীতাকে বলল, একটু স্টোরে যাতো সীতা, স্টোর বাবুকে বল, আলু, পিয়াজ, ডিম, ডাল দুতিন দিনের মত দিয়ে দিতে, আর জণ্ডকে বলে মাছ জোগাড় করা যাবে সীতা! সীতা বলল, আমি দেখছি দিদিমনি, বলে বেরিয়ে গেল।
খানিক পরে এলেন প্রতীমবাবু। নিজেই এলেন সঙ্গে কেউ নেই। অশ্রুকণা তাকে বাড়ীর গেট থেকে অভ্যর্থনা করে নিয়ে এলো। বললো স্যার, এরকম হঠাৎ চলে এলেন, এখানে কোন গণ্ডগোল? দরাজ হাসিতে প্রতীমবাবু বললেন, নারে মেয়ে না। অনেক দিন তোমার খোঁজ নেওয়া হয় না, তাই ভাবলাম, প্রান্তিক সেলিনা যখন আসছে, ওদের সঙ্গে আমিও আসি। তা কেমন আছো অশ্রু। জায়গাটা ভাল লাগছে তো। হ্যাঁ স্যার। তারপর হঠাই অক্রর মাথায় হাত দিয়ে বললেন, কি স্যার স্যার করছ তখন থেকে। লজ্জা এবং ভাল লাগলেও সঙ্কুচিত ভাবে অশ্রুকণা বলল, তা হলে কি বলব? কেন, ওরা যা বলে তাই। ওরা কি বলে তাতো আমি জানিনা, তাছাড়া ওরা যাই বলুক, আমার মুখে তা মানাবে কেন? দুঃখ পেলেন প্রতীমবাবু। বললেন তুমি একথা বলছ নে অশ্রু! কথা বলতে বলতে প্রতীম বাবুকে নিয়ে অশ্রুকণা ঘরে এসে ভিতর থেকে কফি এবং সামান্য খাবার এনে সামনে রাখল। প্রতীমবাবু বললেন, আমার উত্তর কিন্তু দাওনি অশ্রু। অশ্রুকণা বলল, কি উত্তর দেব, বলুন। আপনি শুধু এই প্রতিষ্ঠানের নয়। এরকম অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার। আমি সামান্য একজন কর্মী। প্রান্তিক বা সেলিনার যে অধিকারই থাকুক আপনার ওপরে আমার তা কি করে থাকবে। তাছাড়া যদি আপনি আমাকে প্রান্তিক বা সেলিনার মত একজন মনে করতেন তবে আপনি তো ওদের সঙ্গে আমার কাছে আসতেন না। তাতে আপনি করেননি। আপনি এসেছেন ওদের সঙ্গে। যে অধিকারে আপনি সেলিনা বা প্রান্তিককে বুকে তুলে নিতে পারেন, সে অধিকার তো আমার ওপর থাকতে পারে না। গলাটা ভারি হয়ে এলো, তবুও বলে চলে শুধু আজই নয়, ২/৩ মাস আগেও আপনি এসেছিলেন, এখান থেকে ২/৩ মাইল দূরে আপনাদের যে নতুন ইউনিট খুলছে সেখানে। আপনার আসার সময় হয়নি, অথচ এখানে যদি অশ্রুকশা না থেকে সেলিনা বা প্রান্তিক থাকতো, পারতেন আপনি না এসে? সুতরাং ওদের সমকক্ষতা দাবী করার অধিকার কোথায়? আমি ও সেলিনা অবাক হয়ে শুনছিলাম অশ্রুকণার কথা। হয়তো অশ্রুকণা ওর দিক দিয়ে ঠিক। কিন্তু প্রতীমকাকুর অন্তরের কথা যদি জানতো, তা হলে হয়তো নিজের প্রতি নিজে লজ্জায় তাকাতে পারতোনা। অশ্রুকণা কফি তৈরির জন্য দুধ ঢালছিল। প্রতীমবাবু এক হাতে তা সরিয়ে দিয়ে অশ্রুকণাকে নিজের কাছে টেনে এনে বললেন, সত্যি কি অশ্রু তুমি বিশ্বাস কর, আমি ওদের থেকে তোমাকে আলাদা করে দেখি। আমি তো ওদের বলিনি আমাকে কাকু বলে ডাকতে, তবু ওরা ডাকে, তুমিও তো পার ঐ ভাবে যা হোক কিছু বলে আমাকে ডাকতে। তারপর যে কথা বলেছে, এখানে প্রান্তিক বা সেলিনা থাকলে আমি আসতাম কি না। না মা আসতাম না কারণ সেদিনের আসাটা ছিল অফিশিয়াল। তাই মন চাইলেও আসা সম্ভব হতো না। আজ এসেছি তোমার কাছে, আমার সেলিনার মত আরেকটা মেয়ে অশ্রুর কাছে। আর সহ্য করতে পারল না অশ্রু। এত বড় মাপের একটা হৃদয়কে এমন ভাবে আঘাত দিল সে। কেমন করে। কান্নায় ভেঙে পড়ে পায়ের কাছে প্রণাম করে বলল, আমায় ক্ষমা করুণ কাকু। আমি বুঝতে পারিনি। তাকে পায়ের উপর থেকে তুলে নিয়ে বললেন, দুর পাগলি, বাবার কাছে মেয়ে কোন অপরাধ করে নাকি? তারপর যেন কিছু হয়নি, এমনি ভাবে, অনেক দেরি হয়ে গেল রেহানা, কফিটা মিক্সড কর। অশ্রু বলল, ও থানা কাকু আমি করছি। কিন্তু কানে তার একটা কথা লেগে আছে সেলিনাকে প্রতীমবাবু রেহানা বলে ডাকছেন, কিন্তু কেন?
বিকেলে আমায় একা পেয়ে অশ্রুকশা জিজ্ঞাসা করল, সেলিনাকে কেন রেহানা বলে ডাকছেন প্রতীমবাবু। এর উত্তরে অনেক কথা বলতে হয়। বলতে হয় খুটিনাটি সব। কিন্তু কোন উত্তর দিতে ইচ্ছে করছেনা। প্রতীমকাকু সেলিনাকে নিয়ে বেরিয়েছেন, বলে গেছেন রাত হবে। এ সময়টুকু অশ্রুকণা আর আমি একেবারে একা। ওর হয়তো অনেক কথা বলার আছে, আমারও যে নেই, তা নয়। মাত্র এ কয়দিনেই নিজেকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছে। বললাম, সেতো প্রতীমকাকু বলতে পারবেন, আমি কি করে বলব? তুমি কি কিছুই জানো, না বলতে চাওনা। বলতে চাইলেই কি সব কথা বলা যায় কশা। পারবে তুমি বলতে যা তোমার বুকের মধ্যে জমা হয়ে আছে এত দীর্ঘদিন। কেন পারবনা প্রান্তিক? তুমি যদি শুনতে চাও আমি নিশ্চয়ই বলতে পারব। শুনতে না চাইলে বুঝি তোমার বলার কিছু নেই। আছে। তবে তাই বল। থানা ওসব কথা। অশ্রুকণা বলল, কি যেন লুকাচ্ছো তুমি। না, কণা, লুকাবার কিছু নেই। সত্যি আমি ক্লান্ত। আমি আর পারছি না। কি হয়েছে তোমার বলতো তুমি তো এমন ভাবে কথা বল না। সেলিনা কি তোমাকে কোন ভাবে আঘাত দিয়েছে? না কণা, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। ও আমাকে আঘাত দিতে চায় না। আমার সব শূন্যতা ও একাই ভরে দিতে চায়। আর এই খানেই আমার ক্লান্তি। বিশ্বাস কর, ওর মধ্যে আমি মুক্তি চেয়েছিলাম। অশ্রুকণা বলল তোমার হেঁয়ালি কথা আমি বুঝতে পারছি না প্রান্তিক। আমি অন্য প্রসঙ্গ টেনে এনে বললাম, সত্যভূষণবাবু কেমন আছেন? অশ্রুকণা বলল, নিজের মনের ঠিকানা খুঁজছো? মানে? মানে তো অতি সহজ, সত্যভূষণবাবুর সঙ্গে আমার কি সম্পর্ক, যে তিনি কেমন আছে, সেটা আমার জানা দরকার। কোন সম্পর্কই কি নেই? তুমি আমায় সন্দেহ করছ? এ তুমি কি বলছ? তোমাকে কেন সন্দেহ করব? তা না হলে ওর কথা জিজ্ঞাসা করে আমার কাছ থেকে তুমি কি জানতে চাইছো?। জানতে চাইছি তোমার মনের ঠিকানা। তাই বল। অর্থাৎ সত্যভূষণবাবুর যাবতীয় ব্যাপার আমি জানলে আমার মনের ঠিকানার সন্ধান তুমি পেয়ে যাবে তাই না? তুমি এভাবে বলছ কেন? তিনি তো তোমার একজন হিতাকাঙ্খী না প্রান্তিক, তিনি এই প্রতিষ্ঠানের হিতাকাঙ্খী। প্রয়োজন না হলে তিনি এখানে আসেন না। আর যদি উনি আসেন আমার অস্বস্তি হয়। কেন? সব কেনর উত্তর দেওয়া যায় না। তুমি এখানে এলে কেন পারবে দিতে উত্তর? তোমাকে দেখতে। আমাকে তো সেলিনার মধ্যে প্রতিমুহূর্তে দেখ তুমি। দেখনা? আমি অবাক হয়ে বললাম, তোমরা কেউ বোধ হয় সোজা কথা বলতে পারনা, তাইনা? সোজা কথাতো তুমি শুনতে চাওনি। তুমি যা জানতে চাইছো তা হবে না। আমার পথে আমাকে চলতে দাও। তারপর বলল, দেখবে আমি কেমন আছি বলে তার গলায় সর্বক্ষণ চেনের সঙ্গে লাগানো থাকে যে লকেটটা, তা চাপ দিয়ে খুলে ফেলে আমার সামনে মেলে ধরল। আর আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার দেওয়া ফটোটা লকেটের মধ্যে। আমার বিস্ময় কাটবার আগেই, ও আবার লকেটটা বন্ধ করে গলায় পরে নিল। তারপর বলল, দেখলে তো আমি কেমন আছি। আমি শুধু বললাম কণা। ও বলল, থাক, এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। সত্যি তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে, যদিও তোমার ক্লান্তি দূর করবার আমার কোন উপায় নেই, তবু এই সময়টুকুকে অন্তত তোমার জন্য ব্যয় করতে দাও। কি করবে তুমি। শুধু তোমার পাশে থাকবো। পাশে থাকতে থাকতে যদি অন্য কোন ইচ্ছে তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চায়। ভয় নেই প্রান্তিক, আমি যা পেয়েছি, তাতে যেমন আমি নিজেও ভাবনা, অন্যকেও ভাসাবো না। আমি বললাম, কেন তুমি জীবনটাকে এমন নিঃসঙ্গতার মধ্যে দিয়ে শেষ করে দিতে চাইছছ? ও বলল, নিঃসঙ্গতার খোঁটা দিচ্ছ? বলত সেলিনাকে বুকের মধ্যে নিয়ে তাকে আদর করতে করতে তুমি নিঃসঙ্গতা অনুভব কর না? কঠিন প্রত্যাঘাত? কি উত্তর দেব এর? আমি কোন উত্তর না দিয়ে চুপ করে আছি দেখে ও বলল, জানি এর তুমি কোন উত্তর দিতে পারবেনা। তুমিতো হেরে গেছে প্রান্তিক। জীবনের সর্বক্ষেত্রে হেরে গেছে। সেলিনাকে পেয়েও তুমি পাওনি। আর ও কখনো অশ্রুকণা কখনো রেহানা এই গোলক ধাঁধায় পথ হারিয়ে ফেলেছে। ও হয়তো জয়ী হয়েছে, কিন্তু পানি তোমাকে। তুমিও পাওনি ওকে। অথচ উভয়ে উভয়ের প্রতি তীব্র আকর্ষণের চোরাবালিতে কেবলি হাবুডুবু খাচ্ছ? বল সত্যি কিনা।
আমি আর কথা বলতে পারছি না। গলাটা শুকিয়ে আসছে। বললাম একটু জল খাওয়াবে? হায় প্রান্তিক শুধু জলে কি মিটবে এই আবক্ষ তৃষ্ণা? আমি আর থাকতে না পেরে বললাম, তা হলে এক বোতল মদ নিয়েই এসো। হেসে অশ্রুকণা বলল প্রান্তিক, মদেও মিটবেনা তোমার এ তৃষ্ণা। অংক তোমার মেলেনি। অথচ আনন্দে ভাবছে তোমার অঙ্ক বুঝি মিলে গেলো। তুমি পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের সেই লাইনগুলো জান? কোন গুলো? ওই যে যেখানে
নকশী কাঁথার মাঠের নায়িকা বলছে,
“মন সেতো নয় কুমড়ার ফালি
যাহারে তাহারে কাটিয়া বিলানো যায়।
তোমারে যা দিছি, অপরে তা চায়
কি হবে উপায় হায়”
তাই বলছিলাম, মনটাকে কুমড়ার ফালি করতে গিয়েই যত বিপত্তি। বললাম, কবি বললেও আমি তা মানিনা। কেন? মনের উপর আমার কোন অধিকার নেই বলেই, তাকে আমার ইচ্ছে মত চালনা করতে পারিনা। ওতো বেহুলার বাসর ঘর। যতই চেষ্টা করোনা কেন, ফঁক তার থাকবেই। সেই ফাঁককে ভরাট করতেই তুমি এখানে এসেছো? সত্যি তাই। দেবে আমার সেই ফাঁকা জায়গাটা সিমেন্ট দিয়ে গেঁথে।
অশ্রুকণা অবাক হয়ে বলল, তোমার মনের নাগাল আজো পেলাম না। তুমি কি আমায় ঠাট্টা করছ? না কণা মোটেই ঠাট্টা নয়। যা সত্যি তাই শুধু চাইছি তোমার কাছে। না প্রান্তিক এটা সত্যি নয়। তুমিতো আমার ঠিকানা পেয়ে গেছে। হয়তো পেয়েছি কিন্তু পৌঁছাতে পারিনি। এভাবে আমায় দুর্বল করে দিও না প্রান্তিক। তা হলে তুমি দুর্বল হয়ে যাচ্ছ বল? অশ্রুকণা বলল, দুর্বলতাই মানুষের ধর্ম, তার ভালবাসার আধার, তার অহংকারের ধন। যেদিন সত্যি আরো দুর্বল ছিলাম, সেদিন তুমি ফিরেও তাকাও নি। আজ এসেছে করুণা করতে। কিন্তু প্রান্তিক, আজ যদি আমি তুমি যা চাইছো, তা দিতেই চাই, তুমি নিতে পারবে তো? দিয়েই দেখনা। তারপর ওর একখানা হাত নিজের বুকের পরে রেখে বললাম, হাত দিয়ে বুঝতে পারবে এখানকার কান্নার ওজন, যদি না পার, অদ্ভুত কান পেতে শোন কি ভাবে কাঁদছে এ মন তোমার জন্য। আমার জন্য নয়। তবে কার জন্য? ওখান কার কান্না শুধু সেলিনার জন্য। বললাম তুমি ওকে হিংসা কর? যদি করতে পারতাম, তোমার কাছে পৌঁছাবার ঠিকানা হারিয়ে ফেলতাম। তারপর বলল জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখ, বিকেলের রোদ ফিকে হয়ে এসেছে, হলুদ গোলাপী আভায় আকাশে কে যেন আবীর ছড়িয়ে দিয়েছে। পারবে কি তোমার অনুরাগের আবিরে আমায় রাঙিয়ে দিতে।
ভিতরের আবেগে থর থর করে কাঁপছি আমি, আর সেই আবেগে ওকে আকর্ষণ করতে চাইলে, ও বাধা দিয়ে বলল, প্রান্তিক, কেন এই দেহটা নিয়ে টানাটানি করছ। আমাকে আলাদা করে পেতে চেওনা, তাতে আমাকেও পাবে না, সেলিনাকেও হারাবে। আমি ওকে ছেড়ে দিয়ে বললাম, জানতাম কণা, কিছুই নেই তোমার দেওয়ার। অশ্রুকণা বলল, আমার কোন আলাদা অস্তিত্ব থাকলে নিশ্চয়ই তোমাকে দেওয়ার থাকতত প্রান্তিক। আমি তো মিশে আছি তোমাতে কি নেবে আলাদা করে আমার কাছ থেকে। ওই বুঝি সীতা এলো। তুমি উঠোনা আমি আসছি।
সীতা নয়, এলেন সত্যভূষণবাবু। অশ্রুকণা বললেন, আপনি? হ্যাঁ আমি। আসতে হলো। অসময়ে আসবার জন্য আমি দুঃখিত অঞদেবী। বুঝলাম না। তাছাড়া আমার কোয়ার্টারে এসেছেন, এখনো সন্ধ্যা হয়নি। এতে আবার সময় অসময়ের কি আছে? সত্যভুষণবাবু শুধু বললেন, স্যার আজকে আসতে পারবেন না। তাই আপনাকে বলতে বললেন, আপনি যেন চিন্তা না করেন। অশ্রুকণা উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন আসতে পারবেন না? না, আর তাই আপনাকে একটা চিঠি দিয়েছেন। ওতেই যা জানাবার জানিয়েছেন। আমাকে শুধু বলেছেন, যদি আপনারা যেতে পারেন, তা হলে যেন সকাল ৭টায় প্রস্তুত থাকেন। আমি গাড়ী নিয়ে আসবো। কোথায় যেতে হবে? সেতো জানিনা। উনি এখন আছেন কোথায়? এখান থেকে প্রায় ২৫ কিমি দূরে এক আদিবাসীদের গ্রামে। সেখানে উনি গেলেন কেন? ওনার সঙ্গে আর কে কে আছেন? আমি কিছুই জানি না অশ্রুদেবী। উনি যা বলার চিঠিতে বলেছেন, আপনি শুধু চিঠিটা পড়ে জানিয়ে দিন কাল সকালে গাড়ীর প্রয়োজন আছে কি না। অশ্রুকণা বললেন, ভিতরে আসুন।
সত্যভূষণবাবু ভিতরে এলে আমি উঠে বসলাম। উনি আমাকে দেখে বললেন প্রান্তিক বাবু যে, কবে এসেছেন? কাল খুব ভাল কথা। আছেন কেমন? ভালো। আনন্দের কথা, কিন্তু আপনাকে দেখেতো মনে হচ্ছে না আপনি খুব ভাল আছেন? কি করে বুঝলেন? দুটো চোখ লাল, মনে হচ্ছে খুব কান্নাকাটি করেছেন অথবা জ্বর এসেছে? আমি হাসতে হাসতে বললাম, এর কোনটাই নয়, সত্যি আমি ভাল আছি তা আপনি কেমন আছেন? আমি সব সময় ভালো থাকি। এটাতো ভাল থাকার লক্ষণ নয়। নয় বুঝি? তাহলে ভাল নেই। আসলে জানেন কি প্রান্তিক বাবু, আপনাদের শহরের মান দণ্ডে এখানকার ভালমন্দ থাকা না থাকা নির্ভর করে না। এখানে সবকিছুর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া একটা শক্তি। যারা পারেন, তাদের কাছে ভাল থাকা না থাকা এই কথার এপিঠ ওপিঠ।
ততক্ষণে অশ্রুকণার চিঠিটা পড়া শেষ হয়ে গেছে। ও সামনে এসে বললেন, কাল সাতটায় প্রস্তুত থাকবো। আপনি ব্যবস্থা করুন। আমি ওর কোন কথা বুঝতে পারলাম না। শুধু অবাক হয়ে ওদের দুজনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যভূষণবাবু বললেন তা হলে উঠি অশ্রুদেবী। উঠবেন? চা বা কফি? কেন বার বার আমাকে এসব খেতে বলেন, জানেন তো এসব আমি খাইনে।
অশ্রুকণা বলল জানতাম না, তবে জেনে নিলাম। ভবিষ্যতে এ ভুল হতে হবে না। ভবিষ্যতের কথা থাক। আপাততঃ আজ রাতে কি আপনাকে এবং প্রান্তিক বাবুকে আমি নিমন্ত্রণ করতে পারি? অশ্রুকণা একটু হেসে বললেন, হঠাৎ নিমন্ত্রণ। না এমনি! এমনি এমনি কেউ নিমন্ত্রণ কবে নাকি? ঠিক জানিনা অশ্রুদেবী আমি এমনি এমনি নিমন্ত্রণ করি কিনা। তবে অনেক দিন ভেবেছি এখানকার সকলে আমার ওখানে যান, শুধু আপনি ছাড়া। তাই মনে হল আপনাকে বোধ হয় নিমন্ত্রণ না কবলে যাবেন না। আর সে জন্য উপলক্ষ খুঁজছিলাম। আজ হঠাৎ একটা উপলক্ষ জুটে গেছে। তাই বলছি। অশ্রুকণা বলল, উপলক্ষ ছাড়াও যদি কোন দিন বলতেন, যেতাম। তা উপলক্ষটা কি? উনি সঙ্কুচিত ভাবে বললেন, আমার এক বন্ধু এসেছেন, তিনি এখানেই থাকবেন, তাই আর কি। তিনি যখন থাকবেন, তখন তো অন্য যে কোনদিন বলা যেতো। সত্যভূষণবাবু বললেন, আপনার যদি সত্যি অসুবিধা হয় তাহলে থাক। এই দেখুন, রাগ করলেন তো! না না তা হবে কেন? অশ্রুকণা বলল, আমি যাব। আব প্রান্তিক বাবু? ওকেও নিয়ে যাবো। কটায় যেতে হবে। যখন খুশী। বা যখন খুশী কোথাও যাওয়া যায় নাকি? কোন অসুবিধা নেই অশ্রুদেবী। আপনারা যতক্ষণ না যাবেন, বন্ধুকে নিয়ে আমি জেগেই থাকব। না জেগে থাকার দরকার নেই, আমরা রাত ৮টার মধ্যেই যাব। ধন্যবাদ বলে সত্যভূষণবাবু বেরিয়ে গেলেন। কিন্তু ফিরে এসে বললেন, আর একটা কথা। অশ্রুও কি বলেন তা শোনার জন্য অপেক্ষায় রইল। সত্যভূষণবাবু বললেন, সীতার ছেলেটির জ্বর খুব বেড়েছে। ও আসতে পারবেনা। তাই রাতে যদি আমার ওখানে যা হোক কিছু খেয়ে নেন! অশ্রু অবাক হয়ে বললেন আপনার ওখানে? কে রান্না করবে আপনি? মিথ্যেই খোঁটা দিচ্ছেন অশ্রুদেবী, রান্না আমি খারাপ করিনা। তবু যদি আপনারা রাজী হন, তাহলে আমি এবং আমার বন্ধু ভাগাভাগি করে রান্না করবো। হাসি সজোরে চেপে রেখে অশ্রু বলল, বাড়ীতে এসে আবার রান্না ঘরে ঢুকতে হবে নাতো। সে আপনার অভিরুচি বলে, উনি চলে গেলেন।
উনি চলে গেলে বললাম, হঠাৎ তোমাকে নিমন্ত্রণ, বন্ধুর আগমন, তোমাকে ওখানে খেয়ে আসার অনুরোধ সব কিছুর মধ্যে একটা রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি? তোমার হিংসে হচ্ছে? ভীষণ। কেন? নিঃসঙ্গতার অবকাশ থেকে এই সময়টুকুকে চুরি করার জন্য। দুঃখ পেওনা। সামান্য যে সময়টুকু চুরি হয়ে গেছে, তার থেকে বেশী সময় আমি তোমায় উপহার দেব আর সেই বেশী সময়টাকে কি করবে সেই ধন্ধেয় পড়ে না যাও। বলে হাসতে হাসতে ও আমার সামনে থেকে চলে গেলো।
ফিরে এলো মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কফি ও বিস্কুট নিয়ে। আমি বললাম তোমারটা? আমি খাব না। হঠাৎ খাবে না কেন? না সত্যভূষণবাবুর রোগ হোয়াচের মত তোমাকেও স্পর্শ করেছে। সব সময় শুধু ইয়ার্কি। দাঁড়াও একটা আলাদা কাপ নিয়ে আসছি, ভাগ করে দেবে। ভাগ করতে গেলে শুধু কফি কেন অনেক কিছু ভাগ করতে হয় জান? জানি। তবে সেটা ভাগ করে দেবে তো? দেবার ইচ্ছাতো ষোলআনা ছিল, কিন্তু সময় যে চুরি হয়ে গেছে বন্ধু! তবে দুঃখ পেওনা, যে সময়টুকু চুরি হয়ে গেছে তার থেকে অনেক গুন সময় আমি জোগাড় করে নেবো। তখন কিন্তু নিজের ভাগে কম পড়বে বলে, এড়িয়ে যেতে পারবেনা। আমি বললাম আগেতো সময়টা পাই।
কোয়ার্টারটা ফুলে ফুলে সাজানো। বাইরের রাস্তা থেকে ঘরের গেট। গোটা বাড়ী, ফুল দিয়ে সাজানো। অনেকগুলো আলো এক সঙ্গে জ্বেলে বাড়ীটাকে বড় মায়াবী করে তোলা হয়েছে। নতুন পাজামা পাঞ্জাবি পরে সত্যভূষণবাবু আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। আমরা ছাড়া আর কাউকে কোথাও দেখছিনা। সত্যভূষণবাবু আমাদের সঙ্গে বসে গল্প করছেন, তার বাল্য কৈশোর ও যৌবনের কথা। মুখে আসলেও বলতে পারছি না, কেন বাড়ীটাকে ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে। এক সময় অশ্রুকণা বলল, কই আপনার বন্ধুকে দেখছিনা তো। সত্যভূষণবাবু বললেন, এখনি আসবেন। আমাকে বলেছে, কফি ও টিফিনটা নিজের হাতে করে নিয়ে আসবে। আমি ও অশ্রুকণা এ ওর দিকে তাকিয়ে চুপ করে আছি।
ছিপছিপে, যেন সন্ধ্যার রজনীগন্ধা, সিঁথিতে সিঁদুর, কপালে সিঁদুরের টিপ, হাতে শাখা, গলায় মোটা চেনে লকেট, খোঁপায় জুই ফুলের মালা, দাঁতগুলো মুক্তোর মত সাদা, একটু চাপা শ্যামাঙ্গী তাতেই তার রূপে যেন দূরন্ততার হাতছানি, কফির সরঞ্জাম নিয়ে ঢুকলেন। ওগুলো সামনে রেখে কৈফিয়ৎ দেওয়ার ভঙ্গীতে বললেন অনেকটা দেরি করে দিলাম, আমি কনক, সত্যভূষনের বন্ধু, ওর কাছে থাকবো বলে জামসদেপুরের এক অনাথ আশ্রম থেকে আসছি, নমস্কার। অবাক হওয়ার পালা তখনো যায়নি আমার। রূপ যে এমন আকর্ষক এবং মিন্ধ হতে পারে, ওকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। অশ্রুও প্রতি নমস্কার করে বলল, দেরির জন্য কোন দুঃখ নেই, দুঃখটা হচ্ছে, এমন একটা মধুর মুহূর্তকে ছলনার জন্য মাটি করে দেওয়াতে। কণা নিজের হাতের কঙ্কনটা খুলে ওর হাতে পরিয়ে দিয়ে বলল, খালি হাতে তোমাকে দেখা যায় না ভাই, তাই উপস্থিত যা আছে তাই দিয়ে তোমায় বরণ করে নিলাম, আমার ও প্রান্তিকের তরফ থেকে। ওটা ফিরিয়ে দিয়ে দিদিকে অপমান করো না। অবাক শুধু কনক নয়, অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন সত্যভূষণবাবুও। আর আমি। ভাবছিলাম, জীবনের গ্রন্থি বোধ হয় এমনি করে হঠাৎ হঠাৎ এক অদৃশ্য সূতায় বাধা পড়ে যায়। তা না হলে, কোন অনুরাগের ছোঁয়ায়, অশ্রুকণা দিতে পারে তার মহামূল্যবান করুন, কোন এক অচেনা অজানা, কনককে। কনক, বাধা না দিয়ে, কঙ্কনটাকে পরাতে দিল নিজের হাতে, তারপর অশ্রুকণাকে প্রণাম করতে গিয়ে বলল, জানতাম না দিদি, এখানে তোমার মত কেউ আমাকে বরণ করে নেবে। তাই আমার অন্তরের শ্রদ্ধাকে তুমি ফিরিয়ে দিওনা। কনক প্রণাম করে উঠতেই তাকে বুকের মধ্যে জাড়িয়ে নিয়ে অশ্রুকণা বলল, এই বুঝি চিনেছে আমায়। তুমি অনাথ আশ্রমের মেয়ে বলে, তোমার দেওয়া শ্রদ্ধাকে ফিরিয়ে দেব ভাবলে কি করে। তারপর আমাকে প্রণাম করে ও বলল, আমাকে নিশ্চয়ই চিনতে পারছ না। আমার চিন্তায় বাধা পড়ল, কোথায় যেন দেখেছি, কিছুতেই মনে করতে পারছি না। ও আমার চিন্তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে বলল, থাক দাদা, অত কষ্ট করে চেনার চেষ্টা করতে হবে না। সময় মত আমি তোমাকে বলব, আমি কে? তবু সন্দেহ যায় না। নিজের মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। এই মনে পড়ছে অথচ মনে না পড়ার জন্য। অশ্রুকণা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। হঠাৎ সব মনে পড়ে যেতে বললাম আরে কুঁড়ি তুই? কত বছর পরে তোর সঙ্গে দেখা। সত্যি চিনতে পারিনি। কিন্তু তোর সঙ্গে অনাথ আশ্রমের কি সম্পর্ক? না প্রান্তিকদা কোন সম্পর্ক নেই। এই যে অশ্রুদি, এর সঙ্গে কি কোন সম্পর্ক ছিল, কিন্তু হতে তো মুহূর্তও লাগেনি। তাই যে সমাজ আমাকে বাঁচাতে পারল না, ফিরে এলে তারা জায়গা পর্যন্ত দিল না। সেই অনাথাকে অনাথ আশ্রম ছাড়া কে জায়গা দেবে? গ্রামের সেই কেলেঙ্কারি সবই মনে পড়ে গেল। প্রতিবাদ করতে গিয়ে বদনামের ভাগী হয়ে গেলাম আমিও। সেই তিক্ত স্মৃতি আর মনে করতে চাইলাম না। বললাম, ঠিকই বলেছিস? আসলে আমরা সকলে এক একজন অনাথ। দয়া করে যদি কেউ আশ্রয় দেয়, তবে সেটা তো আশ্রম, তাই আমরা এক অর্থে অনাথ আশ্রমের বাসিন্দা। পুরানো স্মৃতিচারণা করে লাভ নেই। সব সময়ে সামনের দিকে তাকা। অবশ্য তোকে আর কি উপদেশ দেব। অতীতকে ঘৃণায় প্রত্যাখান করতে পেরেছিস বলেই তো, আজ সত্যভূষণবাবুর মত মানুষের সন্ধান পেয়েছিস। ও বলল, তুমি আমায় আর্শীবাদ কর দাদা আমি যেন কেবল মাত্র তার নমসহচারী না হয়ে সত্যিকারের কর্মসহচারী হতে পারি। ওর মাথায় হাত রেখে বললাম, পারবি বোন, সত্যি তুই পারবি। এবার তা হলে কফিটা ঢাল, সত্যি তৃষ্ণা পেয়েছে।
প্রায় রাত ১১টা। এক গভীর আনন্দ ও বেদনা নিয়ে ফিরে এলাম। অশ্রুকণা বলল কবি বলেছেন, কি যেন একটা কথা, হ্যাঁ, মনে পড়েছে, তারপর যেন আবৃত্তির মত একটু টেনে টেনে উচ্চারণ করল
“দেশে দেশে মোর ঘর আছে
আমি সেই ঘর মরি খুঁজিয়া”
আসলে প্রান্তিক তোমার ভাগ্যটাকে আমার ভীষণ হিংসা করতে ইচ্ছে করে। বললাম আমারও। অবাক হয়ে ও বলল তোমারও। হ্যাঁ বন্ধু হ্যাঁ। আজ পর্যন্ত তোমাকে ছাড়া তো কোন পথই খুঁজে পাইনি। এমন অন্ধকে যে পথ দেখায় তাকে হিংসে না করে উপায় আছে?
অনেক রাত হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছেনা। সত্যভূষণবাবুর বাড়ী থেকে যখন ফিরেছি, ওই অতরাতেও অশ্রুকণা গেট বন্ধ করতে করতে বলল, একটু দাঁড়াও। আমি অবাক হয়ে বললাম এতরাতে লেটার বক্স খুলছ যে। অনেকদিন ভোলা হয় না। দেখি যদি কোন চিঠি পড়ে থাকে। সেটার বক্সটাও এমন যে বাইরে থেকে দেখার উপায় নেই ভিতরে কিছু আছে কি না। একটা চিঠি পাওয়া গেল। উপরে প্রেরকের নাম নেই। এক দিকে শুধু অশ্রুকণার নাম ও তার ঠিকানা দেওয়া। খাম থেকে চিঠিটা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, কি জানি কদিন পড়ে আছে। তারপর ভিতরে ঢুকে, চিঠিটা ওর হাতে দিয়ে বললাম, তোমার চিঠি দেখ কে লিখেছে। তোমার খুব কৌতূহল হচ্ছে? তা একটু হচ্ছে বৈকি। তাহলে তুমিই পড়। কৌতূহলটা নিজেই মিটিয়ে নাও। আসার পথে বলেছিল, সেলিনারা আজ আসবেনা। চিঠিতে জানিয়েছেন, কাল সকালে, এখান থেকে প্রায় ২৫ কি মি দূরে একটা আদীবাসী গ্রামে ওরা আছেন, আমাদের যেতে বলেছেন। আমি একটু কৌতুক করে বললাম, সেলিনার সাহস আছে কি বল? তা আছে বৈকি? আমি কিন্তু পারতাম না। সে তো সত্যভূষণের কথা বলতে গিয়ে তোমার চোখ মুখে স্পষ্ট হয়েছিল। তারপর বলল, আচ্ছা প্রান্তিক, এই যখন তোমার মনের অবস্থা তখন আমাকে এই গভীর জঙ্গলে রেখে, কি ভাবে নির্লিপ্ত থাক। কোথায় আব থাকি। জান কতরাত আমার ঘুম হয় না। ও মৃদু হেসে বলল, এবার নিশ্চয়ই ঘুমাতে কোন অসুবিধা হবে না। হাজার হোক কণকের বরকে নিয়ে তোমার কোন দুশ্চিন্তা নেই। বললাম সে আমি জানিনা কণা, ভাবছি তোমাকে আর এখানে থাকতে দেব না। ও ভয় পেয়ে গিয়ে বলল সে কি কথা। তুমি আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে? আমার কাছে। প্রান্তিক এ ভাবে কথা বল না। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? না যায়নি, তবে যাবে। কি চাও তুমি আমার কাছে? তুমি শুধু আমার এইটুকু চাই কণা। ও বলল, আমি তো তোমারি এই সামান্য কথাটা বুঝতে চাইছে না কেন? কেন আমাকে পাগল করে দিচ্ছ? বললাম, তুমি তোমার দাবী ছাড়বে কেন? দাবীটা কি, তোমাকে নিয়ে ঘর করা, না নিত্য ঝগড়া করা। তারপর মান অভিমান অবশেষে একই জিনিষের অনুশীলন হয়তো। বললাম জানিনা কণা, যে ভাবেই তুমি ব্যাখ্যা কর না কেন, আমি কিছুতেই তোমাকে এখানে একলা রেখে থাকতে পারব না। তবে কি তোমাকে সেলিনার সঙ্গে ভাগ করে নিতে বলছ? না। তবে? আমি সম্পূর্ণ ভাবে তোমার হতে চাই। তাহলে কি আমাকে মেনে নিতে হবে, সেলিনার মোহ তোমার কেটে গেছে? তাও বলতে পারবো না। রেগে গিয়ে বলল, কিছুই যখন বলতে পারবেনা, তাহলে কেন সে দাবীর অধিকারের বড়াই কর। শোন প্রান্তিক, অযথা রাত করে লাভ নেই। শুয়ে পড়। আমাকে ঘুমোত হবে।
ও অন্য ঘরে চলে গেল। আমি শুধু ভাবতে লাগলাম কেন আমার এমন হচ্ছে। যতই না সেলিনার কথা ভাবতে চাইছি ততবার অশ্রুকণার মুখটা ভেসে উঠছে কেন? আমি কি তবে সারা জীবন ধরে অশ্রুকণাকে চেয়েছি? চিঠিটা পড়েছিল তুলে নিলাম। নিপুণ ভাবে মুখটা কেটে নিয়ে ভিতরের চিঠিটা বের করে নিলাম। সুন্দর চিঠির প্যাড। ডান দিকে প্রেরকের ঠিকানা। বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট হসপিটাল, বাকুঁড়া, পশ্চিম বাংলা। লিখেছে, অশ্ৰুদি, তোমার সাথে আমার পরিচয় অতি সামান্য সময়ের। সেদিন যতদুর মনে হয়, আমাকে তুমি তপতীদি বলে ডেকেছিলে। আমি তোমাকে কি ভাবে ডেকেছিলাম মনে করতে পারছি না। পরিচয়টা ক্ষণিকের হলেও অন্তরের একটা টান ছিল। সেই অধিকারে দিদি বলেই সম্বোধন করলাম। প্রায় মাস খানেক হল আমাদের হাসপাতালে একজন পেসেন্ট ভর্তি হয়েছেন। ওকে দেখে প্রথমে চমকে উঠেছিলাম। অবিকল যেন রেহানা। কিন্তু ও বলল ওর নাম রুকসানা। তাতে আমার সন্দেহ কিছুতেইনা মেটার জন্য বলি, আপনি মিথ্যে কথা বলেছেন। আপনি কিছুতেই রুকসানা নন। আপনি রেহানা। আপনার বোন সেলিনা। প্রান্তিক আপনার বন্ধু, অশ্রুকণা আপনার বন্ধু। আমি তপতী। আমাদের হাসপাতালে আপনার বোন দীর্ঘদিন ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু তার ওই এক কথা, না না, আমি এদের কাউকে চিনিনা, আমি রুকসানা।
প্রান্তিককে লিখব ভেবেছিলাম। কিন্তু জেনেছি ও সেলিনাকে বিয়ে করেছে। যাকে সে মন থেকে ভুলে গেছে কেন তার জীবনে আর এই বিপত্তি ঘটাই? নীলাঞ্জনা পিসি এবং মিনতি পিসিকেও একই কারণে বলতে পারিনি, যদি আমার ভুল হয়। তাই তোমাকে বলছি অশ্রুদি, মিনতি পিসির কাছ থেকে তোমার ঠিকানা নিয়েছি। একটু দেরি হয়ে গেল। যদি তাড়াতাড়ি আস, দেখা হবে। শরীরের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। কিন্তু রেহানার মিষ্টি মুখটা চির উজ্জ্বল। তারপর কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন। কেমন আছ? প্রান্তিক ও সেলিনা কি তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখে? ওদের সঙ্গে যদি দেখা হয় বলে আমার কথা।
তোমাকে উপদেশ দেওয়া মানায় না অশ্রুদি। জানি অনেক কষ্টের। নিজের জীবন দিয়ে বুঝি। ওর মত ছেলেকে ভুলে থাকা সম্ভব নয়। তবু যা তোমাকে বলতে চাইছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ। তপতী।
তারিখের দিকে চোখ বুলিয়ে দেখি প্রায় সাতদিন আগে লেখা চিঠি। আমার ভিতর যে কি তোলপাড় আরম্ভ হয়ে গেল তা বোঝাবার নয়। অশ্রু খানিকটা অভিমানে আর খানিকটা নিজের অসহায়তার জন্য, ওর ঘরে গিয়ে আলো নিভিয়ে দিয়ে উপুড় হয় শুয়ে আছে, আমি আস্তে আস্তে উঠে গেলাম ওর কাছে। শাড়ীর আঁচলটা খানিকটা সরে গিয়ে পিঠটাকে উন্মুক্ত করেছে। আমার আলতো হাতের স্পর্শ সেখানে রাখতেই ও বলল, না প্রান্তিক না, এভাবে তুমি আমায় ছোট করো না। আমি বললাম, কেন তুমি আমায় বুঝতে চাইছো না, ভিতরে যতই আগুন জ্বলুক, তোমাকে ছোট করব এ তুমি ভাবলে কি করে? যার আলাদা কোন অস্তিত্ব নেই প্রান্তিক ছাড়া, তাকেই করবে প্রান্তিক অপমান, এই বিশ্বাস নিয়ে তুমি আমার স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছো? একবার তাকাও আমার দিকে কণা। দেখ আমাকে। জানতে চাইবে না গোপন পায়ে কেন তোমার ঘরে এসেছি? না গো না এমন করে বলল না। বলেই পাশ ফিরে সে আমাকে টেনে নিলো একেবারে তার বুকের কাছে। তারপর বলল, যেভাবে ইচ্ছে সেই ভাবে গ্রহণ কর প্রান্তিক। আমিও যে পারিছি না। ওকে জোর করে তুলে বসিয়ে দিয়ে বললাম, পারতে তোমাকে হবেই কণা। আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চল। কোথায়? এই রাত শেষে ভোরের সূর্যের দিকে। চলনা ওই ফাঁকা আকাশের নীচে। মনকে যেখানে প্রসারিত করা যায় দিক থেকে দিগন্তরে। সত্যি যাবে? হ্যাঁ যাবো। তোমাকে যে আমার অনেক কথা বলার আছে কণা। চল তা হলে। তারপর বলল, একটু দাঁড়াও। আমি বসে রইলাম। ও আমার সামনে দিয়ে ড্রেসিংরুমে ঢুকে গেল। প্রায় আধ ঘন্টা পরে যখন বেরোল, তাকে যেন চেনা যায় না।
পরেছে সব থেকে দামী লাল বেনারসী। কানে পরেছে ঝুমকো দূল। মূল্যবান স্বর্ণালংকারে সাজিয়েছে কণ্ঠদেশ থেকে বুক, সেখান থেকে নাভি। দু হাতে বেশ কয়েকটি আংটি। সুন্দর করে বেধেছে খোঁপা, চোখে দিয়েছে কাজল। তারপর আমার কাছে এসে একটি প্যাকেট আমার হাতে তুলে দিয়ে বলছে, পোষাকটা বদলে নাও। বললাম এই এতো রাতে এমন সাজে সেজে তুমি কোথায় যেতে চাও কশা? কৌতুকে মুখ ভরিয়ে দিয়ে বলল, সত্যভূষণ যে সময়টুকু চুরি করে নিয়েছে তোমার কাছ থেকে, সুদে আসলে তাকে ফিরিয়ে দিতে। আমি তবুও স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে আছি দেখে বলল, কি হল, বদলাবেনা পোষাক? আমি বললাম, না থাক। কেন তোমার কশাকে জানতে ইচ্ছে করেনা? করে ভীষণ ভাবে করে। তবে? আমি ভয় পাচ্ছি কশা। কেন? এ আলোক যে চোখ ধাঁধানো। পথের অন্ধাকার কাটে বটে, কিন্তু সম্মুখটা হয়ে যায় আরো অন্ধকার। ও বলল, আমি তো মাত্র একটি রাতও নয় অর্ধেক রাত তোমার কাছে ভিক্ষে চাইছি। সেলিনা থাকুক তোমার চিরদিনের জন্য। মাত্রতো অর্ধেকটা রাত, পারনা সেটুকুও আমাকে দিতে? বললাম, কি করতে হবে। প্যাকেটটা দেখিয়ে বলল, ওটা পরে এস। আমি তাই করলাম, তারপর ওর কাছে এসে বললাম চল।
বিশাল বাগানের মধ্যে যে বেদী, সেখানে এসে বসলাম আমরা। ও বসল আমার পাশে। তারপর নিজের আঙুল থেকে একটা আংটি আমার আঙুলে পরিয়ে দিয়ে বলল, কথা দাও জীবনে যত ঝড় ঝাঁপটা আসুক, ওটা তোমার হাত থেকে কখনো খুলবেনা। বললাম যদি মুহূর্তের অসতর্কতায় খুলে ফেলি, কি হবে? জানিনা কি হবে? কিন্তু আমার মন বলছে, সেদিন তোমার কণার মৃত্যু হবে। আমি আবেগ মথিত কণ্ঠে বললাম কণা! ও আমার একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ, নীল আকাশ যেন জোছনায় স্নান করে সূর্যের প্রতীক্ষায় আছে। তারপর বলল, আমার দানের প্রতিদান দেবে না কিছু আমায়? বললাম বোস। ও বসে রইল। আমি উঠলাম। সারা বাগান যেন ফুলের বন্যায় ভাসছে। তুলে নিলাম গোলাপ ও চন্দ্রমল্লিকা। তারপর একটা একটা করে তার খোঁপায় গুঁজে দিয়ে বললাম, আর কি চাও। আজ তো আমি ভিখারিনী প্রান্তিক, যা তুমি দেবে তাই নেবো দুহাত ভরে। বললাম তাহলে এস আমার কাছে। ও এগিয়ে এলো। থর থর করে কাঁপছে ও। তৃষ্ণাব্যাকুল ওষ্ঠ প্রান্ত বারবার ছুঁয়ে যেতে চাইছে ওকে। কিন্তু সবই ব্যর্থ, পারলামনা। সমস্ত পৃথিবী যেন ঘুরতে লাগল। আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগে, দুহাত দিয়ে ও আমাকে তুলে নিল তার বুকের মধ্যে। আর আমার মনে হতে লাগল, রেহানাই যেন দুই পাশে বেঁধে নিয়েছে আমাকে। আমি অস্পষ্ট উচ্চারণে বলতে লাগলাম কেন এমন করে পালিয়ে গেলে? কার প্রতি অভিমান করে? একবারও ভাবলেনা আমার কি হবে? আমি কি করব? নিজেকে মহান করতে গিয়ে আমাকে এত ছোট করলে কেন? আজো নিজের পরিচয় দিতে এত ভয়? মিথ্যা পরিচয়ের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে আজো কি তোমার শাস্তি দেওয়া সম্পূর্ণ হয় নি? কি চেয়েছিলে তুমি আমার কাছে? আমাকে নিয়ে যদি পথ চলতে না পারবে কেন তবে মিথ্যে আশ্বাসে বুক ভরিয়ে দিয়েছিলে? তুমি তো বলেছিলে আবার আসবে। এই কি তোমার আসা? তোমার জন্য পথ চেয়ে বসে আছে আমার মা, একবার দেখবে না তাকে? এত অভিমান?
অশ্রুকণা বলল, প্রান্তিক এসব কি বলছ? আমি যেন তার কথা শুনতে পাইনি। নিজের মনেই বলে চলেছি, আসলে তুমি কোন দিন আমাকে চাওনি, মিথ্যেই তোমার প্রেমকে বড় করে দেখেছে অশ্রুকণা, সেলিনা এমনকি তপতীও। তারপরও বলে চলেছি, রেহানা, এখনো কি তোমার পথ চলা শেষ হয়নি। এখনো কি মনে কর অশ্রু ও সেলিনার পরীক্ষা দেওয়া শেষ হয় নি? একদিন মনে হতো তুমি দেবী, আজ তোমাকে অভিনেত্রী ছাড়া আর কিছু মনে হয় না রেহানা। ভেবেছিলে রুকসানা নামের মেয়েটাকে কেউ চিনবে না। কিন্তু তোমকে চিনতে কারো বাকী নেই। কি লাভ হলো? ডালিম তোমার জন্য এ পৃথিবী থেকে চলে গেল। তোমারি জন্যে সেলিনা আজ বিকার গ্রস্থ। আর তোমারি জন্যে আজ অশ্রুকণা রিক্ত নিঃস্ব। যে তার সর্ব তোমার হাতে তুলে দিতে পেরেছিল, দেখেছে তার মন? যার করুণায় নিজেকে তুমি গরবিনী মনে কর, দেখে যাও, শুধু একবার দেখে যাও তার ভিখারিনী রূপ। কি পেয়েছে সে দেখবেনা? হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে শুয়ে আজো তুমি মিথ্যে করে বলে যাও তুমি রেহানা নও, তুমি রুকসানা। দাঁড়াও রুকসানা পালিয়ে যেওনা। আমি আসছি। তপতীকে ফাঁকি দিতে পারলেও, আমাকে দিতে পারবেনা।
আমাকে ধাক্কা দিয়ে অশ্রুকণা বলল, কি আবোল তাবোল বলছ? কোথায় রেহানা? কে বা ককসানা? কার কথা বলছ তুমি?
আমি চোখ মেলে তাকালাম। আমাকে তার কোলের উপরে টেনে নিয়ে অপলক তাকিয়ে আছে অশ্রুকণা। বললাম কি বলছ কণা? কে রুকসানা? বললাম আমার জীবনের অভিশাপ। মানে? মানে তুমি বোঝনা কণা? কে আমার জীবনটাকে এমনি তিলে তিলে ধ্বংস করে দিয়েছে? কে আমাকে মৃত্যুর কিনারে দাঁড় করিয়ে দিয়ে এখনো বলছে তোমার পরীক্ষা শেষ হয় নি। কে? ওই রাক্ষসী রুকসানা। ওর হাত থেকে তুমি আমায় বাঁচাও কণা। ও আমার সেলিনাকেও ধ্বংস করে দিতে চায়। তারপর অশ্রুকণার হাত দুটো ধরে কাকুতি করে বললাম, তুমি আমায় বাঁচাও কণা। বাঁচাও সেলিনাকে। না হলে ওর গরল নিশ্বাসে ও যে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। চোখে জল এস গেল অশ্রুকণার। টপটপ করে শিশির ফোঁটার মত তা গড়িয়ে পড়তে লাগল অশ্রুকণার দুই কপোল বেয়ে। ভিতরে যতটা আবেগ সবটা উজাড় করে দিয়ে ও বলতে লাগলো। তোমার কি হয়েছে প্রান্তিক আমায় বল না লক্ষ্মীটি। তোমার এ অবস্থা যে আমি দেখতে পাচ্ছি না। আমি বললাম আমি কি পারছি তোমাকে এমন ভাবে দেখতে? গ্রামের এক সাধারণ অতি সাধারণকে কোথায় পৌঁছিয়ে দিয়েছে ভাবতেও পারছনা তুমি, তাইনা কণা? একদিন তুমি রেহানার শান্ত প্রেমে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলে। যেটুকু দ্বিধাছিল, তাও একদিন সেলিনাকে দিয়ে মনে করলে ঋণমুক্ত হলে বুঝি? পারলে কি? ও দৃপ্ত কণ্ঠে বলল কে বলেছে পারিনি? হাসলাম আমি। তারপর বললাম, যদি পারতে তবে তোমার নিঃসঙ্গ অনুভূতি কেন এমন করে আমায় নেশায় আচ্ছন্ন করে রাখে? আসলে যা তুমি দিতে চেয়েছিলে, নেওয়ার যোগ্যতা না থাকায় তাই তোমার বুকের মধ্যে দ্বিগুন হয়ে ফিরে এসেছে। এতক কেমন করে সইবে কণা। ও বলল, তোমার জন্য কোন কষ্টই আমার কষ্ট বলে মনে হয় না। তাইতো তোমায় হাসি মুখে তুলে দিতে পেরেছি কখনো রেহানাকে, কখনো বা সেলিনাকে। আমি বললাম আমি কি জড় পদার্থ যে এই ভাবে তুলে দেওয়া যায়?
ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় গায়ে কাঁপুনি দিচ্ছে। এই লাল মাটির দেশে শেষ রাতটা বেশ ঠান্ডা। বললাম, কশা চল ঘরে। ও বলল তাই চল, তারপর ও ওর খোঁপা থেকে একটা একটা করে ফুল যা আমি পরম যত্নে পরিয়ে দিয়েছিলাম তা খুলে খুলে প্রতিটি ফুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে আর ছড়াতে ছড়াতে ঘরে এলো। আমি বললাম, মনে পড়ে কণা, একদিন তোমার জন্য যে ফুল কিনেছিলাম তোমার অবহেলায় তা আমি বাইরের রাস্তায় ফেলে দিয়েছিলাম, আজ কি তবে তার শোধ নিলে? ও শুধু বলল, জীবনে কোন কিছু কি শোধ করা যায় প্রান্তিক? যায় না। তুমি বোস। আমি তোমার জন্য কফি নিয়ে আসছি। কফি? এই এত রাতে? রাত বেশী নেই। তারপর ঠাট্টা করে বলল, সত্যভূষণের চুরি করা সময় কিন্তু তোমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলাম প্রান্তিক? হ্যাঁ দিয়েছিলে, অনেকগুণ বেশী ফিরিয়ে দিয়েছিলে। তাহলে? আমি হাসিমুখে বললাম, তা হলে কি? কিছু না, বলে ও চলে গেল। খানিক পরে ধূমায়িত কফি নিয়ে এসে রাখল আমার সামনে। বললাম তোমারটা? ও বলল, একটা অনুরোধ রাখবে আমার? বল? আমাকে ভুলে যেতে পার না? পারি। তা হলে তাই যাও না? যাব।
ও কি আঘাত পেল? না হলে অমন চুপ হয়ে গেল কেন? বললাম কি হলো? দেখছিলাম তোমার ব্যথার অতলান্ত সাগর। ঠিক আছে, আমি আর রান্না ঘরে যেতে পারব না, তোমার অর্ধেক খাওয়া শেষ হলে, বাকীটা আমায় দিও। তারপর বলল রেহনার কথা কি বলছিলে, আর রুকসানা বা কে? আমি বললাম ওরা দুজনেই একজন। কালকে রাতে যে চিঠিটা আমায় দিয়েছিলে তা নিশ্চয়ই পড়ে দেখনি? না। আমি বললাম ওটা তপতীর চিঠি। তপতীদি? হ্যাঁ, কি লিখেছে তপতীদি? আমি বললাম, ও লিখেছে বাঁকুড়া জেনারেল হাসপাতালে রুকসানা নামে একটি মেয়ে ভর্তি আছে ও ঠিক রেহানার মত। তাই তোমাকে যেতে লিখেছে। ঠিক বলছ? হা কশা ঠিক বলছি। তারপর বললাম এই রেহানাই একদিন রুকসানার নাম নিয়ে ডালিমের সঙ্গে দেখা করে। তাকে বলে তুমি ভাল হয়ে ফিরে এস আমি তোমাকে বাঁচার পথ দেখাব। আশ্চর্য হয়ে অশ্রুকণা বলে, তারপর? সাতদিন সময় নেয় ডালিম। কিন্তু যে দিন সেই সাতদিন আসে যাওয়ার কথা ডালিমের কাছে, সেদিন সকালেই সে আত্মহত্যা করে। সত্যি বলছ তো তুমি। ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলি, সব সত্যি কণা। ও জানতে চাইল রেহানা এসেছিল সাতদিন পরে? হয়তো এসেছিল, কিন্তু ডালিমতো তার আগে নিজের ঠিকানায় পৌঁছিয়ে গেছে। দেখা আর হয়নি। তুমি জানলে কি করে? সেটা জানতে গিয়েই তো জীবনের সব এলোমেলো হয়ে গেল। ও গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, বলা যাবে না সে কাহিনী? সংক্ষেপে ওকে সব খুলে বললাম। মোসলেউদ্দীন সাহেব, মনোয়ারা বেগম। কেন সেলিনাকে হাতে নোয়া, সিঁথিতে সিঁদুর পরতে হয়েছিল সব। তারপর প্রতীমকাকুর কথা, হাওড়া স্টেশনের সেই ঘটনা, গ্রামের বাড়ী থেকে বাবার আগমন, সেলিনা কেন রেহানা হতে চায়, তার মাতৃত্বের কথা, কোনটাই বাকী না রেখে এক এক করে সব খুলে বললাম। ও শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে কেঁপে কেঁপে উঠলো। সব শুনে গম্ভীর হয়ে উঠে গেল ও। তারপর কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলল, তা হলে সেলিনাকে তুমি বাধ্য হয়ে গ্রহণ করেছে? এ প্রশ্ন কেন কণা। আমার মন বলছে তুমি একটা জিনিষ এড়িয়ে গেছে। কি? তুমি নিজেই যে তাকে সিঁদুরের অধিকার দিয়েছ একথা তুমি একবারও বলনি। আমি চুপ করে রইলাম। তারপর বললাম দাঁড়াও। ও ব্যাকুল হয়ে বলল, কোথায় যাচ্ছ? আমি বললাম আসছি। ফিরে এলাম একটু পরে সেভ করার একটা ব্লেড নিয়ে মুহূর্তে একটা আঙুলের উপর জোরে চেপে ধরতে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। ও ভয় পেয়ে বলল, একি করলে প্রান্তিক এত রক্ত। আমি হাসছি, বললাম কাছে এগিয়ে এস কণা। ও কাছে এগিয়ে এলে আমি ওকে এক হাতে নিজের কাছে টেনে সেই রক্তে ওর সিঁথি রাঙিয়ে দিলাম। ও বলল একি করলে তুমি প্রান্তিক। বললাম, যে অধিকার দিতে আমি পথে পথে ঘুরেছি, আমার রক্তে সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা করলাম। আমার মৃত্যুতে সেলিনার সিঁথির সিঁদুর হয়তো মুছে যাবে। কিন্তু এ রক্তের দাগ তো মুছবেনা কোন দিন। কোনদিন তোমাকে আর হারাবার ভয় থাকবেনা। জীবন যুদ্ধে বারবার হেরে গেছি। অন্তত একবার যে জয়ী হতে পেরেছি, এটা কি কম বড় প্রাপ্তি? ও বলল, তোমার কাছে যা প্রাপ্তি, আমার কাছে তা পূর্ণতা, সেকি তুমি বোঝ প্রান্তিক? আজ যে বাঁধনে বাঁধলে, প্রভাত সূর্যের আলোকে যখন অন্ধকার কেটে যাবে, ক্ষণিকের আবেগ বলে, তুমি আমাকে এড়িয়ে যাবে না তো? প্রভাত সূর্যকে সাক্ষী রেখেই তো অলক্তরাগে বেঁধে দিলাম এই বন্ধন হীন গ্রন্থি। ও বলল, তা হলে আমি এখন কি করব? তোমার পথের ঠিকানা তুমি নিজেই খুঁজে পাবে একদিন কণা। এবার আমার মুক্তি।
ও বলল, একটু দাঁড়াও প্রান্তিক। আমি ওর কথা শুনে দাঁড়ালেও তার শাড়ীর আঁচলটা গলায় জড়িয়ে আমায় প্রণাম করল। আমি ওকে তুলে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে বললাম, আর কোন অভিমান নেইতো কণা? আছে। এখনো অভিমান। হ্যাঁ, আমার এ অভিমান কোন দিন যাবে না প্রান্তিক। আজ যা তুমি আমায় দিলে বিনিময়ে তোমায় কি দেব বল? বললাম যা তুমি দেবে তাই নেবো দুহাত ভরে। যদি কোন শূন্যতা থাকে, পূর্ণ করে নেবো তোমার সে দানে। তাহলে কথা দাও, জীবনে কোন দিন কোন ভাবে তুমি সেলিনাকে অবহেলা করবেনা, ও তোমার স্ত্রী। স্ত্রীর প্রাপ্য মর্যাদা থেকে তুমি ওকে কোনদিন বঞ্চিত করবে না। হতভাগীকে আদর করতে করতে কোন দিন তোমার কণার মুখটি ভেসে উঠবে না। বল প্রান্তিক কথা দাও। বললাম, এ বড় কঠিন শাস্তি কণা। ও বলল, আমার সিঁথির রক্ত থেকেও কঠিন? বেশ কথা দিলাম। স্ত্রীর মর্যাদা থেকে কোন দিন তাকে বঞ্চিত করব না। আরেকটা কথা, যতই আমাকে দেখতে ইচ্ছে করুক, সেলিনাকে না নিয়ে কোনদিন তুমি আসবে না আমার কাছে। আমি প্রায় কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললাম, কণা! জানিগো কষ্ট হবে তোমার। কিন্তু তোমার নিঃসঙ্গতায় আমার যে কি কষ্ট হয় তাকি একবারও বুঝবেনা। বেশ তাই হবে। রাগ করলে? না। শোন প্রান্তিক, সেলিনা তোমাকে পেয়েছে তার তীব্র চাওয়ার মধ্যে দিয়ে। আমি তোমাকে পেয়েছি ত্যাগের মধ্যে দিয়ে। সে তোমার স্ত্রী হয়েও প্রতি মুহূর্তে তোমাকে হারাবার ভয় নিয়ে বেঁচে থাকবে। আমি জানব তুমি আমার কখনো হারাবার নয়। তুমি আমার মনোরাজ্যের অধীশ্বর। আর আমি? তোমার মানসী প্রেমিকা। আমাকে ভুলে যাওয়ার যেমন তোমার কোন উপায় নেই, তেমনি আমার ও উপায় নেই নতুন পথ খুঁজে নেওয়ার। তারপর বলল ওই দেখ পূব আকাশ লাল হয়ে উঠেছে, এখনি আলোর ঝরণা ধারায় ভেসে যাবে সমস্ত বনভুমি। আমার সিঁথির মত লাল ওই সূর্যকে সাক্ষী রেখে তুমি আমায় অন্তত একবারের মত তোমার বুকে টেনে নাও। আমি ওকে নিজের বুকের ওপরে টেনে নিয়ে বললাম কণা। আমি তোমারি শুধু তোমারি। ও বলল, নাগো, তোমার যে মনটা কেউ দেখতে পায় না, সকলের অগোচরে একা পথ চলে সেই মনটা শুধু আমার, আর জাগতিক সুখ-দুঃখ মান-অভিমান ভরা যে জীবন সে শুধু সেলিনার। এবার আমায় ছাড়। সাতটায় সত্যভূষণ গাড়ী নিয়ে আসবে। তার আগে প্রস্তুত হতে হবে। আর তাকে বলতে হবে, আমাদের যাওয়ার ঠিকানা একটু বদলে নিয়েছি আমরা। মানে? প্রান্তিক আমাদের পথের শেষ প্রতীমবাবু ও সেলিনার গতরাতের ঠিকানা নয়। আমরা যাব তপতীদির কাছে। আমি বললম কণা। হ্যাঁ প্রান্তিক। রেহানাকে বলতে চাই, সকলের ভাল করতে গিয়ে তুমিতো কারো ভাল করতে পারলে না। হেরে গেলে জীবনের সর্বক্ষেত্রে। এখনো সময় আছে, এস আমার সাথে। এস রেহানা আমরা পূর্ণতা ভাগ করে নিই আধা আধি করে। সেলিনাকে মুক্তি দাও। ওকে বাঁচার অধিকার দাও। আমার কণ্ঠে উচ্চারিত হল কণা, তোমার তুলনা শুধু তুমিই।
সকাল সাতটা। সত্যভূষণের বন্দোবস্তে গাড়ী হর্ণ দিয়ে চলেছে। অশ্রুকণা তার আটপৌরে সাজে বেরিয়ে এসেছে। আর পাঁচটা সাধারণ দিন থেকে আজ যেন আলাদ কোন বৈশিষ্ট্য নেই। তবু পিয়াসী মন চেয়েছিল, অন্তত কাল রাতের পোষাকে চলুক সে আমার সাথে। ব্যতিক্রমের মধ্যে উজ্জ্বল বক্তে রাঙানো লাল সিঁথি। যেন বিজয়িনীর আত্ম প্রকাশ। সত্যভূষণ শুধু একবার ওর দিকে তাকিয়ে চোখ নীচু করে নিলেন। যখন আমাদের গাড়ীটা ওর কোয়ার্টারের পাশ দিয়ে যাচ্ছে কনক এসে দাঁড়ালো সামনে। আমি বললাম, কিছু বলবি কুঁড়ি। বলল না, কি আর বলব, তারপর জানতে চাইল, আবার কবে আসবে প্রান্তিকা। হেসে বললাম আমিতো এখান থেকে এখনো যাইনি। এখানেই তো ফিরে আসবেন প্রতীম কাকু ও সেলিনা। কনক অবাক হয়ে বলল, সেলিনা কে? সেলিনাকে চিনিসনা? তারপর নিজেই বললাম, তোর বৌদি? এবার যেন ওর বিস্ময়ের অবধি নেই। বলল, আর তুমি অদি? গাড়ীটা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। অশ্রু বলল, আমি ওর অতীত ও ভবিষ্যত। কুঁড়ি গাড়ীর সাথে সাথে হাঁটতে হাঁটতে জানতে চাইল আর বর্তমান? শুধু সেলিনার বোন। গাড়ীটা হু হু করে এগিয়ে চলল। কুঁড়ির মনে হয়তো অনেক প্রশ্ন ছিল। কিন্তু কোন প্রশ্নই আর করতে পাবে না। গাড়ীটা তখন তার দৃষ্টির বাইরে।
গাড়ীটা যখন জন পদ ছেড়ে সবুজ ধান ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে, আমি বললাম, যে বিজয়িনীর বেশে তুমি চলেছে আসবার সময় ওই ঔদ্ধত ফিকে হয়ে যাবে নাতো। ও বলল প্রভাত সূর্যের রক্তিমাভা, আবির রাঙা গোধুলিতে পায় তার পূর্ণতা। যে রক্ত মিশে গেছে আমার শিরায় শিরায় জীবন থেকে কেমন করে মুছে যাবে তা। বললাম যে কোন বিষয়ে গর্ব থাকা ভাল, অহংকার ভাল নয়। যে অহংকারে তুমি আমায় অহংকারী করেছে গরবিনী অশ্রুকলার সাধ্য কি তাকে হেলায় হারায়। বললাম যদি ফিরতে হয় সেলিনার দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে কি বলবে। বলব এ আমার অনুরাগের রক্তে লাল, তোমার অহংকার দিয়ে এর বিচার করো না। আর প্রতীম কাকু? ভয় নেই প্রান্তিক, সমস্ত উত্তর যে তার জানা। ভাল, কিন্তু তপতী? দুঃখ পেওনা আমার জোরটুকুকে সে স্বাগত জানাবে। আর রেহানা। আমার পূর্ণতাকে সমান দুভাগে ভাগ করে নিতে চাই ওর সাথে, তারপর বলল আর কথা বাড়িওনা। আমার অনুভূতিটাকে আমার মতন করে উপলব্ধি করতে দাও।