কেন চলে যাচ্ছি
কেন চলে যাচ্ছি, জানতে চেওনা। খুঁজবারও চেষ্টা করোনা আমাকে কোথাও। পাবে না। তবে তোমাকে যতই ভয় দেখিয়ে থাকি না কেন, তোমার জীবন থেকে হারিয়ে যাবো না কোনদিনও। তোমার ওপর এই বিশ্বাস নিয়েই পথে নামলাম। একদিন এই পথ হয়তো তোমার কাছে আবার আমাকে পৌঁছিয়ে দেবে।
কাল তুমি আসবে। অনেক ভেবেছি, এ ভাবে তোমাকে আঘাত দেওয়ার কি অধিকার আছে আমার? কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, আঘাত যদি সইতে না পারবে, তা হলে কিসের অহংকার তোমার ভালবাসার। কিসের জোরে ফিরিয়ে দিতে পার তুমি তপতীদির আত্ম নিবেদন, অশ্রুকণার বেদনা ভরা একনিষ্ঠতা, আর সব থেকে নিষ্ঠুর ভাবে ফিরিয়ে দিতে পারো না বলা আত্ম নিবেদিত সেলিনাকে। অথচ সেই তুমি কি মরমীস্পর্শে আমার সব অবহেলাকে সরিয়ে রেখে বুকে তুলে নিলে আমার বিষণ্ণতাকে। কেমন করে পারর, ওদের অত ভালবাসাকে নিজের ক্ষুদ্র সাজিতে ভরে নিতে।
একদিন না একদিন কোন মনোমালিন্য হতেই পারে। আমিও মানুষ। কোন দেবী নই, নই কোন পরী। সেদিন ওদের ওই আত্মত্যাগ অনেক বড় হয়ে তোমাকে যখন আমার বিরুদ্ধে বলতে কিছু বাধ্য করবে, যে ঈশ্বর রূপে তোমাকে কল্পনা করেছি তার যে মৃত্যু হবে। পিরবো কেন তা সইতে।
আর পারবো না বলেই, পূর্বাকাশ লাল হয়ে ওঠার আগে বেরিয়ে পড়ব। একটু আগে প্রস্তুতি শেষ করেছি। যাওয়ার আগে ভীষণ ভীষণ ভাবে তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। প্রান্তিক। শুধু একবার তোমার মুখ থেকে শুনতে ইচ্ছে করছে, তুমি যেওনা রেহানা। আমার জীবনে রেহানা ছাড়া যে আর কেউ নেই এই বিশ্বাসটুকু রাখ।
হায়রে নারীমন। মৃত্যুতেও তোর শান্তি নেই। রাত যত শেষ হয়ে আসছে, ততই দুর্বলতা আমাকে গ্রাস করে ফেলতে চাইছে। শুনেছি যেকোন বিপদে, ভক্ত তার ঈশ্বরকে ডাকে। আমিও তো বারবার আকুল ভাবে প্রার্থনা জানাচ্ছি আমার ঈশ্বরের কাছে, তুমি আমায় দুর্বল করে দিওনা, তুমি আমায় শক্তি দাও।
তোমার মাধ্যমে একটা আবেদন রেখে যাচ্ছি মিনতি পিসির কাছে, একবার যেন মা বলে ডাকার অধিকার দেন। কতটুকুইবা পরিচয় তার সঙ্গে, তবু কেন যে বারবার তাকে মা বলে ডাকতে মন চায়। কিন্তু কেন? জানিনা প্রান্তিক কিছুই জানিনা। সময় শেষ হয়ে আসছে। কালের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। ভেবো না আমার জন্য। প্রার্থনা করি, আমার অংক নাই বা মিলুক তোমার উত্তর যেন মিলে যায়, রেহানা।
মিনতি সেনের হাত থেকে চিঠিটা খসে পড়ল। ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, ওরে পাগলি মেয়ে, তোর মুখের মা ডাক শোনার জন্য কি অপরিসীম তৃষ্ণা ছিল আমার। একবারও বুঝলি না। চোখ দিয়ে জল অবিরল গড়িয়ে পড়তে লাগলো ওই প্রখর ব্যক্তিত্বময়ী, প্রভাবশালী নারীর। এক সম্পর্কহীন বিধর্মী মেয়ের মুখে মা ডাক শোনার জন্য কি অধীর প্রতীক্ষা।
বুক যেন ব্যথায় আটকে যেতে চাইল। ডাঃ পাল বললেন, এ ভাবে ভেঙে পড়বেন মিস সেন। আপনি চিন্তা করবেন না আমরা যেখান থেকে পারি ওকে খুঁজে এনে আপনার কাছে তুলে দেব। পুলিশকে আমরা প্রাইমারী ইনফরমেশান দিয়েছি। ডিটেইল দিতে গেলে যে মিস রহমান কি লিখেছেন ওটাও দরকার। মিনতি সেন বললেন, কোন দরকার নেই ডাঃ পাল। এত সব করে ওর শান্তিকে বিঘ্নিত করে লাভ নেই। একদিন ও ফিরে আসবে, আসতেই হবে। সে দিন মিটিয়ে নেব আমাদের মান অভিমান আর দেনা পাওনার হিসাব। আপনাদের তরফ থেকে আর কোন চেষ্টাই করতে হবে না।
তারপর নিজের আঁচলে চোখের জল মুছে নিয়ে বললেন, এখন কি করবে প্রান্তিক। আমি বললাম, তুমি বলে দাও আমি কি করবো। আমি বলে দেব? তুমি ছাড়া কে বলবে মা? মা। এ তুই কি বলছিস, প্রান্তিক। কেন, কোনদিনই কি চাওনি রেহানার মত আমিও তোমাকে মা বলে ডাকি। আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন ওরে পাগল ছেলে, কি করে বোঝাব তোদের? তোদের মা ডাক শোনার জন্য আমার আকাঙ্খর কথা। আমি বললাম, জানি। আজ সেটা ওর চিঠিতে স্পষ্ট হয়ে গেল। তুমিতো এগিয়ে এসেছিলে আমাদের বুকে তুলে নিতে। ভুল আমাদেরই। আজ সেই ভুল বুঝতে পেরে কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। কাছে টেনে নেবে না? মিনতি সেন বললেন মায়ের কাছে সন্তানের ভুল কোন ভুলই নয়। প্রান্তিক চল এবার আমার সাথে। কোথায়? বাঃ এতবড় দুঃসংবাদটা একবার দিতে হবে না ওদের। থানা থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ম্যানেজমেন্ট আমাকে বলেছে। ওরা হয়তো এখনি এসে যাবে। কিন্তু এদের সামনে কি করে মুখ দেখাব, বলবই বা কি? তোকে কিছু বলতে হবে না। যা বলবার ম্যানেজমেন্ট বলবে। তারপর ওদের যা করণীয় করবে। এতে কি ওদের দূরে সরিয়ে দেওয়া হবে না? ওরা যদি দুরে সরে না গিয়ে কাছে আসতে চায়, টেনে নেবো কাছে। মায়ের বুক ভরা ভালবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দেব ওদের ক্ষত। চল নিচে গিয়ে বসবি ততক্ষণ। একবার নীলাঞ্জনা পিসির সঙ্গে দেখা করতে হবে। আমি ফোন করে দেব, উনি যেন আসেন একবার আমাদের বাড়ীতে।
আফরোজ বেগম আসেন নি, এসেছেন নীলাঞ্জনা পিসি ও সেলিনা। সেলিনা কেঁদে উঠে বলল, প্রান্তিক ভাই এ আমারই দোষ, সব দোষ আমার। রেহানা নেই, একদিন নিশ্চয়ই তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে, কিন্তু তাতে আমার অপরাধের মুক্তি হবে কি করে? ক্ষমা আমার ওর কাছ থে•ে পাওয়া দরকার। কিন্তু কোথায় পাব তাকে বলে দিননা প্রান্তিক ভাই। এই প্রথম আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ও কেঁদে ফেলল। পারলাম না ওকে আমার বুক থেকে সরিয়ে দিতে। আস্তে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললাম, ছিঃ সেলিনা আমিতো তোমাকে জানি, পৃথিবীর কারো কাছে কোন অন্যায় তুমি করতে পার না। এ মিথ্যে দিয়ে আমাকে ভুলাবেন না প্রান্তিক ভাই। ও যদি থাকতো, ওর কাছে মাথা নীচু করে আমি ক্ষমা চাইতাম। সেতো নেই, তাই আপনার পায়েব কাছে আমার প্রণতি জানিয়ে বলছি, প্রান্তিক ভাই তার হয়ে আপনি আমায় ক্ষমা করুন। সত্যি সে ওর মাথাটা নামিয়ে নিয়ে এলো আমার পায়ের পরে। বললাম, একি করছ সেলিনা, ওকে তুলে নিয়ে পাশের চেয়ারটায় বসিয়ে দিয়ে বললাম, তোমার মতো মেয়ের এ পাগলামি সাজেনা ভাই। কেউ তোমাকে বুঝবে কি না আমি জানিনা, কিন্তু আমি যে তোমাকে বুঝি, তা তুমি ভুলে যাও কেন? বোঝেন যদি তবে রেহানাকে আটকাতে পারলেন না কেন? ওর উত্তরতো আজ দিতে পারবো না ভাই। তবে এও তোমার ভুল, যে ভাবে তুমি নিজেকে দায়ী করছ রেহানার চলে যাওয়ার জন্য। আমি যে শান্তি পাচ্ছিনা প্রান্তিক ভাই, আমি কি করব। আমায় পথ বলেদিন বলে আবার ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল, সেলিনা।
এ এক নতুন সেলিনা। জীবনের বাঁক গুলো আঘাতে আঘাতে কি ভাবে পরিবর্তন হয়, তাই শুধু ভাবছিলাম। না, নীলাঞ্জনা পিসি, না মিনতি সেন কেউ সেলিনার আবেগকে বাঁধা দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসেননি। মিনতি সেন বুঝি কিছু বলতে চাইছিলেন, নীলাঞ্জনা বললেন, থাক মিস সেন, ভিতরের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দিন ওকে, তাতে ও হাল্কা হবে, ওটা ওর ভীষণ প্রয়োজন।
এক সময় জবার মা এসে বলল, সকাল থেকে তো কিছু খাওয়া হয়নি দিদিমনি, কিছু মুখে দিয়ে নিন, ওদেরও কিছু মুখে দিতে বলুন। তারপর আপন মনে বলল, কেন যে রেহানাদি একাজ করলেন, কে জানে।
নীলাঞ্জনা পিসি বললেন, ঠিকই বলেছেন আপনি, ওদের কিছু মুখে দেওয়া দরকার। চলুন আমি যাচ্ছি রান্না ঘরে, দেখি এদের জন্য কিছু করা যায় কিনা।
সময়ের থেকে বড় ওষুধ আব কিছু নেই। যে ক্ষতকে মনে হয়েছিল, তা কখনো শুকাবেনা, যে আঘাতকে মনে হয়েছিল আব বুঝি ওঠা যাবে না, সময়ের হস্তক্ষেপে, একদিন তা স্বাভাবিক হয়ে এলো। মিনতি সেকে মেনে নিয়েছেন নীলাঞ্জনা পিসিও। অদেখা সম্পর্ক দীর্ঘ মেলামেশায় তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নেয় একদিন। আস্তে আস্তে স্বাভাবিকতা নেমে আসে প্রায় সকলের মধ্যে। ব্যতিক্রম কেবল আফরোজ বেগম। কোন ভাবেই ক্ষমা করতে পারেননি তিনি আমাকে। পরিবারের সমস্ত দুর্যোগের মুলে যে আমি এ বিশ্বাস থেকে তাকে টলানো যায়নি।
একদিন সেলিনা বলেছিল, জানি প্রান্তিক ভাই, মা ইদানীং যে ভাবে বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন আর বিষোগার করছেন, তাতে আপনাকে কিছু বলার আমার মুখ নেই। কিন্তু কি করব বলুন, মা তো। আমার অবস্থা একটু বুঝুন। বড় একা হয়ে যাচ্ছি। কতকিছু ঝড় যে আসে চারপাশ থেকে, অতিষ্ট হয়ে যাই। আগে তবু আসতেন মাঝে মাঝে। হয়তো কোন কিছুর সমাধান হতো না। কিন্তু মনে জোর পেতাম। ইদানীং তাও যান না, কি যে নিঃসঙ্গ লাগে, কাকেও কিছু বলতে পারি না। তারপর বলল, জানি আপনি কেন যান না। কিন্তু আমি কি করব বলুনতো? আমি যে আর পারছি না প্রান্তিক ভাই। বুঝতে পারি কত অসহায় আজ সেলিনা, তাইতো তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি যে তোমার মনের অবস্থা বুঝি, আমারও তোমাদের ওখানে যেতে ইচ্ছে করে না, তা নয়, রেহানাকে ঘিরে কত স্মৃতিইনা তোমাদের ওখানে আছে। আছো তুমি। নিজে এক নগণ্য মানুষ আমি, তবু তোমার সঙ্গে কথা বলে রেহানার স্পর্শ পাই যেন, আমিও যে বড় নিঃসঙ্গ আর একাকী। কি ভাষায় তোমায় সান্ত্বনা দেব। আর কেমন করেই বা দেব বল। সেলিনা বলল জানি, বুঝি না যে তাও নয় প্রান্তিক ভাই, তবু আছে আপনার বাইরের দুনিয়া, আছেন নীলাঞ্জনা পিসি, মিনতি পিসি, অশ্ৰুদি, তপতীদি আছে অগণিত বন্ধু বান্ধব। কিন্তু আমার কে আছে বলুন? কি জানি কেন, সেই নির্জন কৃষ্ণচূড়ার নীচে বসে ওর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, এরা তো তোমারও আপনার। তুমি আসতে পার না এদের কাছে? কি করে আসব বলুন। মা যে একদম ঘর থেকে বের হতে দেননা। মাঝে মাঝে ভেবেছি, মাঝের এই স্মৃতিটুকু ভুলে গিয়ে ফিরে যাব বক্সিং এর দুনিয়ায়। ওখানে গেলে অন্তত এই ব্যক্তিগত দুঃখ মান অভিমান ভুলে গিয়ে একটা জেদ তৈরি হয় চ্যালেঞ্জ নেওয়ার। কিন্তু তাওতো পারিনা। মায়ের সেই এক কথা অনেক হারিয়েছি। আর হারাতে চাইনে। আমি একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, চল ওঠা যাক। হ্যাঁ চলুন। ওর হাতটা ছেড়ে দিলাম। ও বলল, আবার সেই নিঃসঙ্গ একাকীত্ব আর বন্ধ ঘর, সঙ্গে মায়ের সেই অভিযোগের পর অভিযোগ, দেখবেন প্রান্তিক ভাই, আমিও একদিন হারিয়ে যার ঠিক রেহানার মতন। আমি বললাম ছিঃ সেলিনা এভাবে বলতে নেই। তোমাকে ভালবাসারতো লোকের অভাব নেই। সেই জন্যইতো আর পারছি না। ভীষণ ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করে নীলাঞ্জনা পিসিকে, মিনতি পিসিকে আরো আরো অনেককে, কিন্তু যে কঠিন শাসনে নিজেকে বেঁধে ফেলেছি, মানে বাঁধতে হয়েছে, সেই যন্ত্রণাটুকু আপনি বোঝেন কি প্রান্তিক ভাই? আমি ধীরে ধীরে বললাম বুঝি সেলিনা বুঝি। বোঝেন? হ্যাঁ বুঝি। বোঝেন যদি, তবে এ থেকে এই কঠিন শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাবার একটা পথ বলে দিতে পারেন না? ওর আকুল তৃষ্ণাকে উপলব্ধি করে বললাম, আমাদের অপেক্ষা করতে হবে, কারণ কেবল মাত্র সময়ই পারে এর থেকে মুক্তি দিতে। জানি বিভিন্ন দিক থেকে বাঁধা আসবে, তবু ফিরে যাও সেলিনা তোমার অতীত জীবনে। বক্সিংএর রিং এ নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হও, ফিরে যাও তোমার চঞ্চলতায়, তোমার স্বাভাবিকতায়। ওইটেই তোমার স্বাভাবিক জীবন। স্বাভাবিকতার মধ্যেই নিজেকে ঠিক মত চেনা যায় সেলিনা। তারপর জানতে চাইলাম, কেন পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়েছে, কেন পরীক্ষা দেবে না বলে ঠিক করেছো? এটা ঠিক নয় সেলিনা, একটা কথা মনে রেখো সব সময় হতাশার মাঝেমুক্তি নেই। হতাশা আরো হতাশাকে ডেকে নিয়ে আসে। নিজে যা সত্য বলে মনে করবে তাতে প্রত্যয়ী হও। নতুন স্বপ্ন দেখতে শেখ। ভেঙে পড়োনা। আঘাতে জর্জরিত না হয়ে দুহাতে আঘাতকে সরিয়ে দিয়ে এগিয়ে চল সামনের দিকে। একদিন জয় আসবেই সেলিনা। আসতেই হবে। ওর দিকে তাকিয়ে দেখি মুগ্ধ শ্রোতার মতো ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
কি জানি কি নেশায় পেয়েছিল ওকে এত কথা বলার। তবে কি এর মাঝ দিয়ে আমি আমার নিজের হতাশা কাটাতে চেয়েছি? হবে হয়তো।
নীলাঞ্জনা পিসি, কাল বলেছেন, তোমাকে এত দুর্বল কোনদিন ভাবিনি প্রান্তিক। কলেজেতো যাওয়া ছেড়েই দিয়েছে। অবশ্য এখন ক্লাশ নেই, কিন্তু বইয়ের সঙ্গেও তো সম্পর্ক নেই তোমার দীর্ঘদিন। এসব ভালো নয় প্রান্তিক। মনে হচ্ছে তোমার ভালবাসার একনিষ্ঠতায় কোথায় যেন ছিদ্র আছে, তা না হলে, এ ভাবে নিজেকে তুমি নিঃশেষে শেষ করে দিতে চাইছো কেন? আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, কি করব পিসি? কি করবে, সে কথা তোমাকে বলে দিতে হবে? তোমার মনের সেই জোর কোথায় গেল? যে জোরের মধ্যে দিয়ে একদিন দুর্বলকে দেখিয়েছো বাঁচার স্বপ্ন। অতীতের ব্যর্থ স্মৃতিকে ভুলে গিয়ে নতুন স্বপ্ন দেখাতে অনুপ্রাণিত করেছে। সেই জোরটাকি তোমার মরে গেছে প্রান্তিক? আরো বললেন তোমার সেই মনের জোরটাইতো একদিন আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে। তোমার সেই উদ্যম সেই প্রাণবন্ত জীবন কোথায় আজ? অবশেষে বললেন, জীবনে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ কবো। তুমি কৃতি পুরুষ। দুর্বল নারী নও। ভালবাসা থাকুক তোমার অন্তরের সম্পদ হয়ে। আর পৌরুষকার হোক তোমার বিশ্বের দ্বার। কার অপেক্ষায় বসে আছো ঘরের মধ্যে? এখানেতো কেউ নেই অপেক্ষা করে যে তোমাকে অনুপ্রাণিত করবে। বেরিয়ে এস প্রান্তিক ঘরের দমবন্ধ করা আবহাওয়া থেকে। দাঁড়াও এসেরাজ পথে। খোলা আকাশের নীচ দিয়ে চলে গেছে যে রাজপথ সেটাই কিন্তু এক মাত্র পথ নয়। আরো হাজারো পথ তোমায় বরণ করে নেওয়ার অপেক্ষায়। হয়তো সে সব পথের কোন একটাতেই পেয়ে যাবে তোমার স্বপ্নের বাস্তবতা। তাই আলসেমি নয় প্রান্তিক। নিজেকে প্রস্তুত করো ভবিষ্যতকে বরণ করে নেওয়ার জন্য।
না, এভাবে নীলাঞ্জনা পিসি আমায় কোন দিন উদ্বোধিত করেনি। আর তার সেই উন্মাদনার রশ্মিচ্ছটা বুঝি আজ ছড়িয়ে দিতে চাইলাম সেলিনার অবসন্নতায়। চুপ করে রইল ও, বলল, চেষ্টা করব প্রান্তিক ভাই। কিন্তু আপনাকেও একটা কথা দিতে হবে। কি? বলুন দেবেন? না শুনে বলি কি করে? ও অভিমানে বলল, রেহানাকেও কি এই একই উত্তর দিতেন? আবার সেই রেহানা। বললাম, দেব। ও চুপ করে রইল। আমি বললাম, কই বল। ও বলল, আপনাকেও নতুন করে চ্যালেঞ্জ নিতে হবে প্রান্তিক ভাই। আপনাকে সার্থক ভাবে প্রস্তুত করতে হবে আগামী পরীক্ষার জন্য। রেহানার স্বপ্নকে সঠিক ভাবে পূর্ণ করতে হবে আপনাকেই। পারবেন না? আমি আবারও ওর হাতটা নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বললাম, পিরবো সেলিনা, আমাকে পারতেই হবে। আনন্দে চিকচিক করে ওঠেওর দুটি চোখ। তারপর বলল, আপনার নির্দেশিত পথে চলতে আমিও পারবো প্রান্তিক ভাই। প্রমিজ করছি, নিজে যেমন হারব না, আপনাকেও হারতে দেব না।
সেলিনা এবারেও বক্সিংএ ক্লাব প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি অক্ষুণ্ণ রেখেছে। একাডেমিক পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেছে। আর তারই জন্য শ্রদ্ধা জানাতে আফরোজ বেগমের সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে অস্বীকার করে ও এসেছে অনেক দিন পরে নীলাঞ্জনা পিসির বাড়ীতে। পিসি ওকে দুহাতে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরে দিলেন তার কপাল। তারপর বললেন বোস মেয়ে আমি আসছি। তুমি কোথায় যাবে? বোসনা। নীলাঞ্জনা পিসি ঝড়ের মত বেরিয়ে গেলেন। আমি আর সেলিনা একাকী। হাসতে হাসতে বললাম বহুদিন পরে মা মেয়েতে দেখা। আমার দিকে তাকাবার সময়ই নেই। তা নাইবা থাকলো, আমি কিন্তু ভীষণ ভীষণ খুশি হয়েছি, আর এই খুশির দিনে তোমাকে কি দিয়ে আমার খুশিকে প্রকাশ করি বলত। আমি যা চাইবো তাই দেবেন? হ্যাঁ তাই দেব, যত কঠিনই হোক তুমি চাইতে পারলে আমি তোমাকে তাই দেব। ও হাসল মৃদু ভাবে তারপর বলল, না প্রান্তিক ভাই, আজ কিছু নিতে আসিনি, এসেছি দিতে। দিতে? হ্যাঁ দিতে বলতে বলতে আস্তে আস্তে ও এগিয়ে আসে আমার কাছে, একেবারে কাছে তারপর মাথা নীচু করে ও আমার পায়ে হাত রেখে বলল, আপনার আর্শীবাদ চাইছি প্রান্তিক ভাই। আমি ওকে দু হাতে তুলে দিতেই দেখি বাইরের দরজায় কখন যেন নীলাঞ্জনা এসে দাঁড়িয়েছেন, তাকে যেন দেখতে পাইনি, এমনি ভাবেই বললাম, পাগলি মেয়ের কাণ্ড দেখ। আরে বোকা মেয়ে আমার আশীবাদে কি কিছু হয়? আশীর্বাদ নিতে হলে মায়ের কাছ থেকেই নিতে হয়। মা! হারে পাগলি মা। হঠাৎ যেন নীলাঞ্জনাকে দেখতে পেলাম, তাই আনন্দের আতিশয্যে বলে উঠলাম এই দেখ পিসি তোমার পাগলি মেয়ের কাণ্ড ও চাইছে আমার কাছে আশীর্বাদ। মা যেখানে দুহাতে ওকে বুকের মধ্যে তুলে নিয়েছেন, সেখানে আমার আশীর্বাদ তো তুচ্ছ, তাতে কাজের কাজ কিছু হবে কেন? নীলাঞ্জনা মৃদু হেসে বললেন, হবেরে হবে। মাতো ওকে মন প্রাণ দিয়ে আর্শীবাদ করেছেন, তার সঙ্গে তোমারও আশীর্বাদ ওর খুব প্রয়োজন প্রান্তিক। কি জানি কেন আকারণ আমার চোখে জল এসে গেল। বললাম, এই দেখ মা-মেয়ের এক কথা। নিজের অশ্রুকে গোপন করতে বুঝি পালিয়ে গেলাম নিজের ঘরে। কেন যে এমন হয় কিছুতেই বুঝতে পারি না।
মিনতি সেন ফোন করে জানিয়েছেন, তিনি ভিতর থেকে সংবাদ নিয়েছেন, স্নাতক পরীক্ষায় আমি দ্বিতীয় হয়েছি। যিনি প্রথম হয়েছেন, তিনি আমার থেকে মাত্র এক নাম্বার বেশী পেয়েছেন। নীলাঞ্জনা পিসিকে বলেছেন, আমিই আসছি তোমাদের ওখানে। ওকে সংবাদ দিতে হবে না। ওকে বরং বলে দাও, ও যেন অশ্রুকণা ও সেলিনাকে যেভাবে পারে তোমাদের ওখানে আসতে বলে। ফোনটা ছেড়ে দেন মিনতি সেন।
অশ্রুকণার বাড়ীতে গিয়ে সংবাদটা দিলাম আর ওকে বললাম, তুমি সেলিনাকে সংবাদটা দিতে পারবে তো? কেন, তুমি পারবে না? তারপর নিজেই বলল, আমার যেতে কোন অসুবিধা নেই, কিন্তু প্রান্তিক, ওর মা যাইই করুক, ও বড় আঘাত পাবে। যত অসুবিধাই হোক তোমার যাওয়া উচিৎ। আমি বললাম। ঠিক আছে তাই হবে।
অশ্রুকণা ও সেলিনা এসেছে একটু আগে। মিনতি সেন এলেন গাড়ী করে এক হাড়ি মিষ্টি আর দুই সেট ফুলের ডালা নিয়ে। এই দ্বিতীয় বার এলেন মিনতি সেন এ বাড়ীতে। ফুলের ডালা আমার আর অশ্ৰকশার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, আমার আশীর্বাদ তোমাদের কৃতকার্যতায়। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওনার দিকে। উনি শুধু হাসছেন, কিছুই বলছেন না। আমরাও বুঝতে পারছি না। ফুলের ডালা ধরে দাঁড়িয়েই আছি। কি করব বুঝতে পারছি না। নীলাঞ্জনা পিসি ফুলের ডালা দুটো আমাদের হাত থেকে তুলে নিয়ে বললেন, উনি ফোনে জানিয়েছিলেন যে, উনি আসা পর্যন্ত যেন সংবাদটা তোমাদের না দেওয়া হয়। আমবা আরো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি পিসির দিকে। পিসি বললেন অশ্রু, তুমি স্নাতকে প্রথম শ্রেণী পেয়েছে। আর প্রান্তিক তুমি শুধু প্রথম শ্রেণী পাওনি, তোমার উপরে মাত্র ১ মার্ক বেশী পেয়ে একজন প্রথম হয়েছেন, তুমি হয়েছে দ্বিতীয়। আনন্দ না বেদনা জানিনা, কান্না এসে গেল চোখে। মাথা নীচু করে প্রণাম করলাম মিনতি সেন ও পিসিকে। অশ্রুকণাও তাই করল। আমাদের দুজনকেই তার বুকের মধ্যে টেনে নিলেন মিনতি সেন। একটা ঘরে কেটে গেল সারাটা বিকেল। শুধু বুকের মাঝখানটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল রেহানার জন্য। জানিনা কোথায় আছে ও। বেঁচে আছে কি না তাও জানিনা। শুধু মনে মনে বললাম, তুমি যেখানেই থাক রেহানা, আমার এ কৃতিত্ব তোমাকেই দিলাম।
জীবনে কোন পরীক্ষায় ব্যর্থ হইনি, কিন্তু এমন সাকসেস। মাত্র ১ মার্কের জন্য প্রথম হতে পারা, এ যে অকল্পনীয়। মিনতি সেন বললেন, ভবিষ্যতে কি করবে তোমরা ঠিক করেছ। অশ্রুকণা প্রথম শ্রেণী পেয়েছে এ যেন সে ভাবতেও পারছেনা। কিন্তু আমার জন্য ওর যে কি আনন্দ হচ্ছে, সে, ওর চোখের ভাষা দেখে বুঝতে পারছি। আর সেলিনা। আমি জানি, আমার এই সাকসেসের সর্বশ্রেষ্ঠ দাবীদারতো ও। তবু কোন কথা সে বলছে না কেন? তবে কি একেবারে প্রথম না হওয়ার জন্য একটু খানি দুঃখ রয়ে গেছে তার। ওকি চেয়েছিল আমাকে প্রথম হতে হবে? যদি সে তাইই চেয়ে থাকে, তাহলে বলবো এটা তার একটু বেশীই চাওয়া।
মিনতি সেন বললেন, এবার উঠতে হবে। চল তোমাদের যার যার বাড়ীতে নামিয়ে দিয়ে যাব। সেলিনা বলল, তুমি যাও পিসি, এটুকু পথ আমি হেঁটেই চলে যাবো। নীলাঞ্জনা বলল, ও থাকুক মিস সেন, আপনি বরং অশ্রুকে নামিয়ে দিয়ে আসুন, পরে না হয় প্রান্তিক এটুকু পথ ওকে হেঁটেই এগিয়ে দিয়ে আসবে। মিনতি সেন বললেন, তাই তোক। এরপর মিনতি সেন যখন বেরিয়ে যাবেন, সেলিনা বলল, একটু দাঁড়াও পিসি। কেন রে? বলে দাঁড়ালেন। সেলিনা ওকে প্রনাম করতে মিনতি সেন বললেন হঠাৎ প্রণাম করলি যে মেয়ে। ইচ্ছে হল তাই, বলেই পালিয়ে গেল।
আফরোজ বেগমের অবস্থা ধীরে ধীরে আরো খারাপের দিকে এগিয়ে চলেছে। মিনতি সেন বললেন, ওর তো চিকিৎসার দরকার, তুমি ওকে সব থেকে বড় ডাক্তার দেখাও। বললাম তা সম্ভব নয়। কেন? উনি একদম আমাকেই শুধু নয় আমার সম্পর্কিত কাউকে সহ্য করতে পারছেন না। অবাক মিনতি সেন প্রশ্ন করে জানতে চান কেন? তুমি কি কিছুই জানো? জানলে তোর কাছে জানতে চাইব কেন? আমি বললাম, রেহানার হারিয়ে যাওয়া সহ ওদের পরিবারের যাবতীয় দুর্যোগের জন্য উনি আমাকে দায়ী করেন। বেচারা। তারপর মিনতি সেন বল্লেন, হতেই পারে, মায়ের মতো। তাই বলে তুই এড়িয়ে গেলে রেহানা তোকে ক্ষমা করবে কেন? আমি অআিনী কঠে বললাম, আর রেহানা। সেতো এমনিতেই আমায় ক্ষমা করেনি, আর নতুন করে কি ক্ষমা করবে। মিনতি সেন বললেন, পাগলামি করিসনে প্রান্তিক। মনে বিশ্বাস রাখ একদিন ওকে ফিরে আসতেই হবে। আসবে। সেদিন যখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তোর কাছে কৈফিয়ৎ চাইবে, কি উত্তর দিবি? আমি আর কোন কথা না বাড়িয়ে বললাম, কি করব তা হলে। আমি কলকাতার মেডিসিনের সব থেকে বড় ডাক্তার ডাঃ মুস্তাফিকে পাঠাচ্ছি। তুই ওকে নিয়ে যা। আর সেলিনাকে বলবি, আমার আদেশ, ডাঃ মুস্তাফি যা বলবেন, তা যেন অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হয়।
যখন মুস্তাফিকে নিয়ে ওদের বাড়ী গেলাম, তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাড়ীতে অনেক লোক। একটা জটলার মতন। আমি যেতেই, একটা স্বস্তির ভাব যেন দেখা দিল ওদের মধ্যে। সেলিনা দরজা খুলে দিতেই বললাম, মিনতি সেন পাঠিয়েছেন, ডাঃ মুস্তাফিকে। ওকে নিয়ে যাও মায়ের কাছে। সেলিনা ওকে পথ দেখিয়ে আফরোজ বেগমের কাছে পৌঁছে দিয়ে আবার ফিরে এল। তুমি ফিরে এলে যে, ডাক্তার বাবু যদি কিছু জানতে চান। অসুবিধা হবে না। কিন্তু আপনি কোথায় গিয়েছিলেন। সারাদিন আপনাকে খুঁজছি। কেন? জানিনা, মা দুপুর থেকে শুধু আপনাকেই খুঁজছেন। আমাকে? হঠাৎ? তাতো জানিনা প্রান্তিক ভাই। ওখানে আমার যারা রক্তের সম্পর্কিত আপন তার সবাই আছেন, যান না একবার প্রান্তিক ভাই। যাব? যদি আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। হোলেনই বা, কিন্তু যখন খুঁজেছেন তখন একবার যান না। আমি বললাম, বেশ চল। ডাঃ মুস্তাফির তখন রোগী দেখা শেষ। গম্ভীর মুখে উঠে পড়লেন। তারপর আমাকে সামনে পেয়ে বললেন। আপনি আসুন আমার সঙ্গে। আমি ওনার সঙ্গে বাইরে এলাম। অনেক দেরি হয়ে গেছে। তবু কালকের মধ্যে যদি আমার নার্সিং হোমে নিয়ে আসেন, আমি শেষ চেষ্টা করতে পারি।
ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকালেন আফরোজ বেগম। আফরোজের ছোট বোন রসিদা বললেন, আপা কিছু বলবি? বলে ওর মুখের উপর ঝুঁকে পড়লেন। আফরোজ বেগম অস্পষ্ট হলেও শোনা যায় এমন ভাবে বললেন। সেলিনা ওকি এসেছে? সেলিনা তার মায়ের মুখের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, কার কথা বলছ মা। বিড় বিড় করে বললেন, তার মানে আসেনি। পারল না আমাকে ক্ষমা করতে। সেলিনা আবারও বলল, কার কথা বলছ মা। আফরোজ বেগম ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে বললেন, আরো একবার যা সেলিনা, যেখান থেকে পারিস ওকে ধরে নিয়ে আয়। ওর সঙ্গে দেখা না করে যে আমি কোন শান্তি পাচ্ছি না। সেলিনা বলল, প্রান্তিক ভাই আপনি আসুন না। আফরোজ বেগমের যে পাশে সেলিনা আছে, আমি তার অন্য পাশে বসে, আফরোজ বেগমের মুখের কাছে মুখ এনে বললাম, আপনি আমায় ডেকেছিলেন মাসিমা? যেন দূর থেকে ভেসে আসছে কণ্ঠস্বর–বললেন কে? আমি প্রান্তিক? ও তুমি এসেছো? হা এসেছি মাসিমা। জানতাম তুমি আসবে। তারপর বললেন, তুমিতো আমার মতন ছোট নও ছেলে, তুমি অনেক বড়। আমি বাধা দিয়ে বললাম, ওসব কথা থাক মাসিমা। ডাক্তার মুস্তাফি এসেছিলেন, তিনি বলেছেন এমন কিছু নয়। ওর নার্সিং হোমে কয়েকদিন থাকলেই সুস্থ হয়ে যাবেন। ম্লান হাসলেন আফরোজ বেগম। বড় করুশ সে হাসি। বললেন তোমাদের সঙ্গে আরো কয়েকটি দিন কাটিয়ে যেতে ভীষণ ইচ্ছে করছে। কিন্তু রোজ কেয়ামতে আমার জন্য যে জায়গা নিদিষ্ট হয়ে গেছে বাপ। তাই স্বার্থপরের মতে তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছি। সেলিনার চোখে জল ভরে উঠল। তবু চুপ করে রইল। আমার একটা হাত তার শীর্ণ হাতের মধ্যে নিয়ে বললেন, আমার পাপের কোন ক্ষমা নেই ছেলে। রোজ কেয়ামতে আমার কি বিচার হবে তাও জানিনা, কিন্তু বাবা আমাকে যে একটা কথা দিতে হবে? বলুন। উনি শীর্ণ হাতে সেলিনার একটা হাত তুলে নিয়ে আমার হাতের পরে রেখে বললেন, আমি যখন থাকবনা, একে তুমি দেখবে কথা দাও। সেলিনা চিৎকার করে উঠল মা। আমি বললাম মাসিমা। উনি স্পষ্ট কণ্ঠে বললেন, ভয় নেই বাবা। যে পাপ করেছি তারই শেষ নেই, তাইতো আবার নতুন পাপে তোমাকে জড়াতে চাইনা। তোমার জীবনে রেহানার যে জায়গা, ওকে আমি সেই জায়গায় তোমাকে গ্রহণ করতে বলিনি বাবা। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল তা হলে? যতদিন না ও নিজের পথ খুঁজে পায় ততদিন তুমি ওকে দেখ। এই আমার শেষ অনুরোধ। আমি বললাম ওর মা আছেন, তিনি ওকে বুকে তুলে নেবেন। আপনি চিন্তা করবেন না। তারপর বললাম আপনি এত ভেঙে পড়ছেন কেন? আপনাকে তো বাঁচতে হবে। জলও যেন শুকিয়ে গেছে আফরোজ বেগমের চোখ থেকে। বললেন, জানি তোমার পিসি ওকে মেয়ের মতন ভালবাসেন। আমি বললাম মেয়ের মতন নয় মেয়ে হিসেবেই ভালবাসেন। কথা জড়িয়ে আসতে লাগল, আফরোজ বেগম বহুকষ্টে তবু বললেন, তাই যেন হয়। তবু আমি তোমার হাতেই দিয়ে যাচ্ছি ওকে। তুমি শুধু কথা দাও ওকে তুমি দেখবে? কথা দিলাম। উঃ খোদা রহমানে রহিম, আমি নিশ্চিন্ত। আর কোন পিছুটান রইলনা। এবার হে খোদাতাল্লা, কখন আসবে তোমার ডাক। আমি যে তারই প্রতীক্ষায় আছি। চোখ বন্ধ করলেন আফরোজ বেগম। রসিদা কান্নায় ভেঙে পড়ে বললেন, আপা, আমরা কি তোমার কেউ নই? সেলিনা তাকে তুলে দিয়ে বলে খালা, চুপ করো। সেলিনাকে বুকের পবে টেনে নিয়ে বললেন আমাদের উপর তোমার এতটুকু বিশ্বাস নেই? কেন বিশ্বাস থাকবেনা খালা আমিতো তোমাদেরই মেয়ে। আফরোজ বেগম আর চোখ মেলে তাকাননি। ভোর রাতের দিকে তিনি আরেকবার চোখ মেললেন, দেখলেন, আমি সেলিনা আর ডাক্তার সরকার ছাড়া আর কেউ নেই। রশিদা বেগম, ঘন্টা খানেক আগে ঘুমাতে গেছেন। আফরোজ বেগম যেন স্বাভাবিক। ডাক্তার। সরকারকে বললেন, ডাক্তার ভাই। বলুন দিদি আমাদের সমাজকে তো জানেন, কষ্ট করে একটা কাগজ কলম নিয়ে আসবেন? সেলিনা কাগজ আর কলম নিয়ে এলে আফরোজ বেগম বললেন, আমি বলছি আপনি লিখে নিন। বলুন। আমার অবর্তমানে সেলিনা আর জীবনের অন্য কোন পথ খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত ওকে আমি প্রান্তিকের কাছে রেখে গেলাম। ওর পিসি নীলাঞ্জনা, ওর মায়ের মত। সেলিনা যদি স্বেচ্ছায় ওদের অবাধ্য না হয় তাহলে ওর জীবন সম্পর্কে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নীলাঞ্জনা দেবী ও প্রান্তিকের। লেখা হলে আফরোজ বেগম বললেন। দিন আমি সই করে দিচ্ছি। আপনি সাক্ষী থাকুন। ডাক্তার সরকার বললেন, আমি অরাজী নই কিন্তু আপনার কোন আত্মীয় স্বজন সাক্ষী থাকলে ভাল হয় ভাবী। আফরোজ বেগম সেলিনাকে বললেন, একবার খালাকে ডাকতো মা। রশিদা এলে, তাকে পড়ে শোনান হয়। প্রথমে গররাজি হলেও পরে উনি সই করে দেন। তারপর আফরোজ বেগম বল্লেন এটা আপনাকেই দিয়ে যাচ্ছি ডাক্তার ভাই, দেখবেন মেয়েটা যেন ভেসে না যায়।
যে স্বাভাবিকতায় তিনি কথা বলছিলেন, তাতে মনে হয়েছিল হয়তো আবার সুস্থ জীবনে ফিরে আসবেন উনি। কিন্তু একি হলো সমস্ত কাজ শেষ হয়ে গেলে থর থর করে কাঁপতে থাকেন আফরোজ বেগম। এমন করে কাঁপছেন কেন উনি। ডাক্তার সরকার ত্বরিত পরীক্ষা করলেন। কয়েকটা হিক্কা উঠলো। শুধু শোনা গেল হায় আল্লাহ। ধীরে ধীরে নিথর হয়ে গেল শরীরটা। ডাক্তার সরকার আবার পরীক্ষা করতেই সব শেষ। সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হল আফরোজ বেগমের দেহ। কায়ায় আছড়ে পড়ল সেলিনা আফরোজ বেগমের বুকের উপরে। আমি ওকে কিছু বলতে গেলে ডাঃ সরকার ইঙ্গিতে না করলেন।
প্রথমে কিছু বাধা এলেও সেলিনা চলে এসেছে নীলাঞ্জনা পিসির কাছে। নীলাঞ্জনা পিসিরও দীর্ঘ দিনের শুন্য মাতৃত্ব যেন, কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। সেলিনার জীবনেও এসেছে অনেক পরিবর্তন, আগের মত সে আমাকে আর ঠাট্টা করে না। রেহানার কথা আজকাল বেশী ওঠে না। ধীরে ধীরে রেহানা যেন কেবল আমার হয়ে গেছে। আমার একার। না নীলাঞ্জনা পিসি না মিনতি সেন, কারও মুখ দিয়েই ঐ হতভাগ্য মেয়ের নামটা যেন আর উচ্চারিত হয় না। জানিনা কেন?
দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়িয়ে আসে নতুন বছর। আজ রেহানার জন্মদিন। সেই কবে গোপনে রেহানার একটা ছবি তুলেছিলাম। কেউ জানেনা। আজ তাকেই ড় করে বাঁধিয়ে নিয়ে এসে টাঙিয়ে দিলাম, আমার পড়ার ঘরের দেওয়ালে। ধুপ কাঠি জ্বেলে, ফুলদানিতে ফুল সাজিয়ে রাখলাম রেহানার ছবির নীচে।
মনটা ভারাক্রান্ত। কি দ্রুত গতিতে ভুলে যাই আমরা অতীতকে। নীলাঞ্জনা বা মিনতি সেন হয়তো তার জন্মদিন নাও জানতে পারেন। কিন্তু সেলিনাতো জানে। কই সকাল থেকে একবারও তো তার মুখ দিয়ে রেহানার জন্মদিনের কথা, বা রেহানার কথা কিছুই উচ্চারিত হলো না। আমার ঘরে পারত পক্ষেও সেলিনা আসে না আজকাল। নীলাঞ্জনা পিসি। একান্ত প্রয়োজন না হলে এ ঘরে তারও পদার্পণ ঘটেনা।
মনে মনে ভাবি এ একদিক দিয়ে ভালই হয়েছে। রেহানাকে আরো বেশী করে ভাববার অরকাশ পেয়েছি। তবু আমি তো মানুষ। সেলিনা এবং নীলাঞ্জনার এই ভাবে আমাকে এড়িয়ে চলাকে কেমন যেন উপেক্ষা বলেই মনে হয়। নীলাঞ্জনার মাতৃত্বের অভাব যেমন মিটেছে তেমনি সেলিনারও মিটেছে নতুন করে মা কে খুঁজে পাওয়া। আমার আর দরকারটা কোথায়?
হঠাৎ দরজায় খটখট শব্দে তাকিয়ে দেখি ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকছে সেলিনা। সকালে স্নান করেছে। পরেছে একটা আনকোরা নতুন শাড়ি। বেনীতে জড়িয়েছে যুঁই ফুলের মালা। হাতে মিষ্টির থালা। আমি অবাক হয়ে বলি, কি ব্যাপার? এত সকালে সেজে গুঁজে কোথায় চললে? আমার কোন কথায় আজকাল আর রাগেনা সেলিনা। হঠাৎ ওর চোখটা আটকে যায় দেওয়ালে। এনলার্জ করা রেহানার ছবি। তার মানে তার জন্মদিনটা পর্যন্ত ভোলেনি প্রান্তিক ভাই। বলল, আপনাকে ওর জন্মদিনে একটা প্রণাম করতে এসেছিলাম। ভেবেছিলম অবাক করে দেব। কিন্তু আপনি নিজেই যে আমাকে অবাক করে দিয়েছেন। বললাম, আজকাল কোন ব্যাপারে কি আর অবাক হও সেলিনা? না হইনা। কারণ নিজের জীবনের পরিবর্তনগুলো যে মেনে নিয়েছি। তাতে যখন অবাক হইনা, তখন আর অন্য ব্যাপারে অবাক হওয়ার সময় কোথায়? যাক নিজেকে সঠিক ভাবে বুঝতে পেরেছে বলে খুব ভাল লাগছে সেলিনা। সেলিনা বলল, আমারও ভাল লাগছে আপনাকে দেখে। তারপর নিজের থালা থেকে একটি মিষ্টি তুলে দিয়ে বলল, ভাববেন না, আমি এনেছি। পিসি, সকালে বাজার থেকে মিষ্টি, এই মালা এসব এনে বললেন, আজ তো রেহানার জন্মদিন তাইনা? যাতে একবার প্রান্তিকের ঘরে। দেখ ও কি করছে? আমি অবাক হয়ে বললাম, পিসি বলেছে আজ রেহানার জন্মদিন? সত্যি ভীষণ ভীষণ অবাক হচ্ছি আমি। সেলিনা বলল, সব ব্যপারে অবাক হতে নেই প্রান্তিক ভাই। তারপর হঠাৎ একটা প্রণাম করে বলল, কেন প্রণাম করলাম জানতে চেয়ে ঠাট্টা করবেন না।
তারপর একটু থেমে আবারও বলল, পিসি বলছিলেন বহুদিন আপনি গ্রামের বাড়ীতে যান না। আমাকে বলেছেন আপনার যদি অসুবিধা না থাকে, তাহলে আগামী শনিবার পিসি যেতে চান। বললাম, বেশতো চল। আমারও মনটা চাইছে। বহুদিন যাই না। একবার পরিচিত সকলের সঙ্গে দেখা হলে ভালই লাগবে।
শুনে মিনতি সেন বললেন, আমিও ঘুরে আসি তোমাদের সাথে কি বল প্রান্তিক? তুমি যাবে? কি যে আনন্দ হচ্ছে তা বোঝাবার নয়। বললাম, শনিবার ৪টেয় ট্রেন শিয়ালদা স্টেশন থেকে। নীলাঞ্জনা পিসিকে মিনতি সেনের কথা বলতে, তারও খুব আনন্দ হয়। বললেন সত্যি যাবেন উনি? তাইতো বললেন।
আমরা যখন গ্রামের বাড়ীতে পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা হতে অল্প বাকি। প্রথমেই পড়ে নীলাঞ্জনা পিসিদের বাড়ী। ওখানে থেকে আমাদের বাড়ী বেশী দূরে নয়, তবু যেতে সঙ্কোচ হতে থাকে, পিসি কিছু ভাবেন কি না। নীলাঞ্জনা বললেন, তুমি মিস সেনকে নিয়ে আগে বাড়ীর সকলের সাথে দেখা করে এস, আমি পরে সেলিনাকে নিয়ে আসছি। আমি বললাম আজ যদি যান, তা হলে তো এক সঙ্গে যাওয়া যেতে পারে। উনি মৃদু হেসে বললেন, বেশতো তোমার যখন তাইই ইচ্ছে তাহলে চল আজই যাওয়া যাক। অবশেষে আমরা সকলে এক সঙ্গে এলাম আমাদের বাড়ীতে।
শুধু বাড়ীটা নয়, গোটা গ্রামটা যেন উৎসবের সাজে সেজে উঠেছে। উপলক্ষ আমার ভাল রেজাল্ট। কয়েকদিন হৈ হৈ করে কেটে গেল। ফিরে আসার আগে হেডমাষ্টার মশাইকে প্রণাম করতে গেলাম। তিনি আশীর্বাদ করে বললেন, তোমাকে কয়েকটা কথা বলব প্রান্তিক? নিশ্চয়ই বলবেন। বলুন কি বলবেন? উনি ধীরে ধীরে বললেন, আমি জানিনা তোমাকে বলা ঠিক হবে কি না, তবু বলছি! কেন স্যার এ কথা কেন বলছেন আমাকে বলা ঠিক হবে কিনা। আমাকে কি আপনি সন্দেহ করছেন? কারণ আছে বাবা। থাক তা হলে মাষ্টারমশাই। কি দরকার অস্বস্তি বাড়িয়ে? হেড মাষ্টারমশায় বললেন, হয়তো কথার খেলাপ হয়ে যাবে, তবু তোমাকে বলা প্রয়োজন বলে আমি মনে করছি। আমি উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছি উনি কী বলেন তা শোনার জন্য। উনি বললেন কিন্তু একটা কথা দিতে হবে প্রান্তিক আমি না বলা পর্যন্ত আমার একথা তুমি কাউকে বলবেনা। আমি বললাম তাই হবে মাষ্টার মশাই। কিন্তু অবাক হলাম ভীষণ, কী এমন গোপন কথা বলতে চান তিনি আমাকে।
উনি বললেন, গেজেটে তোমার পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছে। তোমার কৃতকাৰ্য্যতায় সারা গ্রাম উৎসব মুখর। ঠিক সেই সময়ে একটি মেয়ে, হ্যাঁ তোমার বয়সী হবে, একেবারে আটপৌরে পোষাকে পায়ে পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমার একটা প্রণাম করে বলল, আপনিতো হেডস্যার তাইনা? কথায় কোন জড়তা নেই। নেই কোন অস্পষ্টতা। আমি বাধা দিয়ে বললাম তার কথা শুনে আমার কি লাভ মাষ্টারমশাই? লাভ লোকসানের হিসাব জানিনা প্রান্তিক, তোমাকে বলা প্রয়োজন বলে বলছি, শোনা না শোনা তোমার ব্যাপার। মেয়েটির প্রশ্নের, উত্তরে বললাম হ্যাঁ আমি প্রধানশিক্ষক কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম, মেয়েটি যখন আমার কাছে জানতে চাইল, আপনি কি স্যার বলতে পারবেন, প্রান্তিকদের বাড়ী এখানে কোনটা। আমি চমকে উঠে বললাম। প্রান্তিক? তাদের বাড়ীতে তোমার কি দরকার? মেয়েটি একটু হাসল, তারপর বলল, ঠিক এই ভয়েই এখানকার কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করিনি পাছে, অনেক অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। আপনি প্রধানশিক্ষক, একটি অসহায় মেয়ের মর্যাদা আপনিই রক্ষা করবেন এই বিশ্বাসে, আপনাকে নিঃসঙ্কোচে সব কথা বলা যায়। মনে হল মেয়েটিকে বিশ্বাস করা যায়। বললাম তুমি প্রন্তিকদের বাড়ী যেতে চাও? ওকে তুমি চেন? হ্যাঁ চিনি? তা হলে ওকে নিয়ে এলেনা কেন? বলল, সে সব অনেক কথা। আপনি একবার নিয়ে যাবেন ওদের বাড়ীতে? কি পরিচয় দেব। যা তোক একটা পরিচয় দেবেন? আপনার যেমন সুবিধা, আমি কিছু মনে করবনা। কি যে হল প্রান্তিক কিছুই বুঝতে পারলাম না। শুধু মনে হতে লাগল এ মেয়ে নিশ্চয়ই তোমার পরিচিত। হয়তো কোন চরম অভিমানে তোমার কাছ থেকে সরে এসেছে। আমি ওকে বললাম বাড়ী চল। তোমার কথা সব শুনবো। তারপর নিয়ে যাবো ওদের বাড়ীতে। ওকে বাড়ীতে নিয়ে এলাম।
এই অবসরে মেয়েটি বলে গেল তার কাহিনী। তোমার সঙ্গে ওর সম্পর্কের কথা। কেন চলে এলো, কেন চরম আঘাত দিতে তোমাকে বাধ্য হল, এই সব কথা। আমি ওর নাম জিজ্ঞেস করাতে ও বলল, যে কোন নামে আপনি আমায় ডাকতে পারেন মাষ্টারমশাই। সেদিন আর যাওয়া হল না কিন্তু পরের দিন তোমাদের বাড়ীতে নিয়ে গেলাম ওকে। তোমার মাসিমাও ছিলেন। তোমার বাবা মাকে ও প্রণাম করলে, আমার কাছে জানতে চাইলেন, কে এই মেয়েটি। আমাকে একটা মিথ্যে পরিচয় দিতে হল ওর অনুরোধে। আমি জানিনা প্রান্তিক, কেন সে তার সত্য পরিচয় গোপন করতে চেয়েছিল। ২ দিন ছিল আমার এখানে। তৃতীয় দিন যাওয়ার সময় প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে আমার কাছ থেকে কথা আদায় করে নিল, আমি যেন তার কোন কথা কাউকে কোনদিন না বলি। আর বিনিময়ে আমিও তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিলাম, আরেক বার যেন সে আসে আমার কাছে। আরো বললাম, মা তুমিতো সবই বললে শুধু তোমার নামটা ছাড়া, নামটা কি একেবারেই বলা যাবেনা। হাসল মেয়েটি। বলল বলব, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভুলে যাবেন। বেশ তাই হবে, এবার বল। ও বলল আমি রেহানা। নামটা উচ্চরণ করেই দ্রুত মিলিয়ে গেল ও। ট্রেনের কোন কামরায় যে উঠলো, আর খুঁজে পেলাম না। দেখা হলো না আর। গাড়ীটা তখন দ্রুত বেগে ছুটে চলেছে। আমি তো অবাক!
রেহানা এখানে? এই আমাদের গ্রামের বাড়ীতে? অনেক দিনের স্বপ্ন তার গ্রামে আসার। সেই তো এলে, তবু আমাকে কাঁদালে কেন? আমি মাষ্টারমশাইকে বললাম আপনি, ঠিক বলছেন তো। থর থর করে কাঁপতে লাগলাম আমি। প্রান্তিক কি হয়েছে তোমার এমন করছ কেন? কে এই রেহানা? আমি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলে বললাম, ও আমার সব মাষ্টারমশাই ও আমার সব। ও আমার সুখ, আমার আনন্দ, আমার দুঃখ, আমার বেদনা, আমার মান, আমার অভিমান, আমার ব্যর্থতা, আমার সার্থকতা, আমার দ্বেষ, হিংসা আর উজ্জ্বলতা। আমার বিষণ্ণতা এবং পূর্ণতা, আমার প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি, আমার হাহাকার, আমার জীবনের ঝংকার। একবার বলুন মাষ্টারমশাই ও কেমন আছে?
মাষ্টারমশাই বললেন তোমার প্রশ্নের উত্তর তো আমার জানা নেই। ও যখন দ্রুত মিলিয়ে গেল, এমনি একটা কিছু সন্দেহ করেছিলাম প্রান্তিক। কিন্তু আর তো তাকে খুঁজে পেলামনা। আমি বললাম, সেদিন সে কেমন ছিল। সেদিন তার শরীর ভাল ছিল তো। ঠিক মতো হাঁটতে পারছিল তো। তারপর মাষ্টারমশায়ের হাত ধরে বললাম। কোথায় ওকে খুঁজে পাব বলতে পারেন মাষ্টারমশাই। তুমি শান্ত হও প্রান্তিক ও কথা দিয়ে গেছে, ও আরেক দিন আসবে। সেদিন তোমাকে জানাতে ভুল করবো না।
আধো অচেতন মনের মধ্যে যে মেয়ে বেঁচেছিল, সে যে কেমন করে এক ঝটিকায় এমন ভাবে চেতনাকে নাড়া দিয়ে হৃদয়কে হাহাকারে ভরে দিয়ে গেল কি করে তার ব্যখ্যা করব। মাকে বললাম, একটা মেয়ে তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তোমরা তো আমাকে বলোনি? মা অবাক হয়ে বললেন, কে দেখা করতে এসেছিল? কই কিছু মনে পড়ছে না তো! বাবা ছিলেন কাছে, বললেন, তুমি আমার ঘরে এস। আস্তে আস্তে পায়ে পায়ে বাবা যে ঘরে থাকেন সে ঘরে গেলাম। বললাম বল। তুমি কার কথা বলছ? কে দেখা করতে এসেছিল? মাষ্টারমশাইয়ের সঙ্গে কেউ আসেনি বাড়ীতে? হ্যাঁ এসেছিল তার কথাতো কিছু বললেনা। কি জানতে চাও তার কথা। সে কে? কেন এসেছিল? কিছু বলে গেছে কি না তোমাদের এই সব। বাবা বললেন মাষ্টারমশাইয়ের আত্মীয়া। সেখানে এসেছিল, ওরা নিয়ে এসেছিল আমাদের বাড়ীতে। এসব কথা তোমাকে বলার কি আছে?
আমি ছল ছল চোখে বললাম, হয়তো তোমার কথাই ঠিক বাবা, কিন্তু আমার কাছে ঐ মেয়েটি যে অনেক বড়। তাই যদি হয় তাহলে, তার সাথে কি এমন হয়েছে যার জন্য তোমাকে ছেড়ে তার চলে যেতে হল। কিছুই হয়নি। তুমি ঠিক বলছ না প্রান্তিক। তারপর বললেন হ্যাঁ একটি মেয়ে এসেছিল। প্রথম দিন ওনাদের সঙ্গেই এসেছিল। পরের দিন একাই এসেছিল। আমাকে বলল, আমি একা এসেছি বলে অবাক হচ্ছেন নাতো? অবাক হব কেন? কাল এসেছিলে তুমি, আজতো চেনা বাড়ীতে এসেছে। এটা গ্রাম, এখানে মানুষ অনেক সহজ সরল, অবাক হওয়ার প্রশ্ন নেই। হয়তো সময় কাটছেনা, তাই চলে এসেছে। কিন্তু মা, তোমার যেন কিছু বলার আছে মনে হচ্ছে? না না কিছু বলার নেই। আমি বললাম তোমার মাসিমাকে ডাকি। ও বলল, না থাক, সময় মত আমিই যাব ওনার কাছে, আমি কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বললাম, আমার মতো বৃদ্ধের সাথে আর কতক্ষণ কথা বলবে মা বরং আমার ভাইঝি ইতিকে ডাকি। ওঠিক তোমার বয়সী নয়, তবে ওই এবাড়ীর এক মাত্র মেয়ে, তোমার থেকে কয়েক বছরের ছোট হবে। ও বলল, দরকার নেই বাবা, ওর হঠাৎ বাবা ডাক শুনে আমি অবাক হয়ে বললাম, কি বললে মা। বাবা। তারপর বলল, আপত্তি থাকলে ডাকব না, কি জানি কেন আপনাকে দেখে আমার বাবা ডাকতে ইচ্ছে হল। তারপরে বলল, বাবাতো নেই তাই হঠাৎ মুখ দিয়ে ওই ডাকটা মনে এল। এ সময় তোমার মা এসে বললেন, মেয়েটির সাথে তখন থেকে এত কি কথা বলছ, ওকে তো কিছু খেতে দেওয়ার কথা বলবে? মেয়েটি লজ্জা পেয়ে বলল না মা, আমার খিদে নেই। এই তো দুপুরে খেয়েছি। তোমার মা বললেন, সেতো দুপুর আর এখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে বেশী বাকি নেই। তুমি বস মা, আমি তোমার জন্য নারকেল, গুড় আর মুড়ি নিয়ে আসছি। আমাদের এখানে এর থেকেতো বেশী কিছু পাওয়া যাবে না। মিষ্টি পেতে গেলে হাটে যেতে হবে, সে তো অনেক দূর। মেয়েটি আমার দিকে তাকাল তোমার মাকে বললাম, তুমি এঘরেই পাঠিয়ে দাও। তারপর আমি ও যেখানে কথা শেষ করেছিল, সেখান থেকে আরম্ভ করে বললাম খুব দুঃখের মা। আমাকে তুমি বাবা বলেই ডেকো। ও ছলছল চোখে অকারণে আমাকে একটা প্রণাম করে বলল, মনে রাখবেন কিন্তু, আমাকে আপনি মেয়ে বলে মেনে নিয়েছেন। হ্যাঁ তাতে নিয়েছি। কিন্তু মেয়ে কি বাবাকে আপনি করে বলে? বলে না বুঝি? ওর কথা শুনে কি যে হল প্রান্তিক, আর ওর কণ্ঠস্বরে কি যে ছিল আমি জানিনা। মনে মনে ভেবেছিলাম, মেয়েটির পরিচয়, মাষ্টারমশাইয়ের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে, তারপর ভেবে দেখব আমার ইচ্ছে পূরণ করা যায় কি না। আমি বললাম, তারপর? আরো দুই একটি কথা বলে, মেয়েটি উঠে যাওয়ার সময়ে আবারও প্রণাম করে বলল, আপনি কিন্তু আমাকে মেয়ে হিসাবে মেনে নিয়েছেন, অস্বীকার করবেন না কিন্তু। আমি হাসতে হাসতে বললাম মেয়েকে কি কোন বাবা অস্বীকার করে। ও একটু হাসল তারপর চলে গেলো। কিন্তু যাওয়ার আগে আমার মনটাকে যে প্রচণ্ড নাড়া দিয়ে গেল তাতে কোন সন্দেহ নেই।
পরের দিন মাষ্টারমশাইয়ের বাড়ীতে গেলাম। কি যে মায়ায় বেঁধে গেল মেয়েটি। কিন্তু ওখানে গিয়ে শুনলাম, ও চলে গেছে। আমি বললাম তাতে কি। ও আবার কবে আসবে, আমি একবার ওদের বাড়ী যেতে চাই। মাষ্টারমশাই বললেন আমিতো ওদের বাড়ী চিনি না সীতাংশু বাবু। আশ্চর্য হয়ে বললাম সেকি মাষ্টারমশাই, আপনি যে বললেন, আপনার আত্মীয়া। হ্যাঁ বলেছিলাম। কিন্তু আর কিছু জানতে চাইবেন না। তারপর বললেন মেয়েটি স্বপ্নের মত এসেছিল, আমাদের এখানে, আবার হারিয়েও গেল স্বপ্নের মত। তবে ও কথা। দিয়ে গেছে সীতাংশু বাবু আবার ও আসবে। আসলে আপনার কাছে নিয়ে যাব।
আমি আর কি বলব। কেন সে এসেছিল, কেন সে এমনি ভাবে নিজেকে গোপন করে আবার চলেও গেল কোন উত্তরই জানিনা। ভেবেছিলাম সেলিনা, মিনতি সেন বা নীলাঞ্জনা পিসি কে বলব। কিন্তু ভাল লাগলনা। বলতে ইচ্ছেও করলনা। ফিরে এলাম কলকাতায়। সেলিনাকে একবার ভেবেছিলাম জিজ্ঞাসা করি, কেমন লাগল আমাদের গ্রাম। তাও করা হল না।
আবার দৈনন্দিন জীবন যাত্রায় নিজেকে মানিয়ে নিলাম। মনে বিশ্বাস, কোথাও না কোথায় রেহানার সাথে আবার আমার দেখা হবে। শ্রুতিকণা বলল, আজ বাবা আসছেন। যাবে আমাদের বাড়ীতে? আমি রাজী হয়ে ওদের বাড়ী যখন গেলাম তখন রাত হয়েছে। ওর বাবা প্রমথ বাবু, শ্রুতিকণাব বিয়ের ব্যাপারে বেশ কিছুদিনেব ছুটি নিয়ে এসেছেন।
আজ ওকে দেখতে এসেছেন সজল রায়, প্রতিষ্ঠিত ইঞ্জিনিয়ার। যাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছেন তাকে দেখে অবাক হয়ে বললাম, কেমন আছেন? ভদ্রলোক যেন হাতড়িয়ে ফিরছেন কে আমি? তারপর চিনতে পেরে বললেন, হ্যালো ইয়ংম্যান, তোমার গবেষণার কি হলো? ভীষণ ইন্টারেস্টিং একটা ব্যাপার নিয়ে তুমি গবেষণা করছিলে। তোমার ইনটারভিউ নেওয়া শেষ? এত তাড়াতাড়ি কি শেষ হয়? তবে প্রায় শেষ করে নিয়ে এসেছি। খুব ভাল। তোমার থিসিস্ জমা দেওয়ার আগে আমাকে একবার দেখিও তো। অবশ্য যদি তোমার আপত্তি না থাকে। নিশ্চয়ই দেখাব। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম সজল বাবু কি আপনার ওখানে কাজ করেন? হ্যাঁ। খুব ব্লিলিয়ান্ট ছেলে।
স্নেহময়ী দেবী আমায় ডেকে পাঠালেন। আমি ওঘরে গেলে শ্রুতিকণা বলল, ভদ্রলোককে তুমি চেন নাকি? হ্যাঁ চিনি, তবে সজল বাবুকে চিনিনা। কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে, ইউ আর এ ভেরি লাকি উওম্যান। ও কথায় ঠেশ দিয়ে বলল, বেহানার থেকেও। আমি বললাম, রেহানা এক হতভাগ্য মেয়ে, কেন তাকে বারবার টেনে নিয়ে আস কণা। আমার একদম ভাল লাগে না। যথেষ্ট অনুতপ্ত কণ্ঠে অশ্রুকণা বলল, আমি ঠিক ওভাবে বলিনি, বিশ্বাস কর। স্নেহময়ী দেবী বললেন, সত্যিইতো অশ্রু কেন ওকে তোরা আঘাত দিস। ওকে তোদের একটু বোঝা উচিৎ।
এরপর সজলবাবুদের মেয়ে দেখার পালা সাঙ্গ হল। ওদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে। সজলবাবুর তরফে প্রতীমবাবু বললেন, একদিন আসুন আপনারা আমার ওখানে। ওর মা বাবা নেই। বলতে গেলে আমিই ওর অভিভাবক। প্রমথবাবু বললেন, আমি যখন মেয়ের বাবা, তখন যেখানে যেতে বলবেন সেখানে আমাকে যেতেই হবে। আমার কোন অমত নেই। আর যেহেতু ওর বাবা মা নেই, তখন তো পাকা কথা আমরা এখনি বলে নিতে পারি। প্রতীমবাবু বললেন, তা হয় না প্রমথ বাবু। আমার ওখানে যেতে আপত্তি থাকলে ওর ওখানেই যাবেন। বিয়ে বলে কথা, একবারতো দেখা দরকার, ও কি চাকরী করে, কোথায় থাকে? আপনার মেয়ের যোগ্য সমাদর সে করতে পারবে কি না। অবশেষে ঠিক হয় আগামী রবিবার ওখানে যাওয়া হবে। প্রমথবাবু বল্লেন, তুমি কিন্তু আমাদের সঙ্গে যাবে প্রান্তিক।
কিন্তু যাওয়া আর হল না। কারণ অশ্রুকণা বেঁকে বসেছে, তার এক কথা সে এখন বিয়ে করবে না। তাকে অনেক বোঝানো হয়েছে, কিন্তু তার সিদ্ধান্ত থেকে তাকে নড়ানো গেল না। স্নেহময়ী দেবী একদিন আমাকে ডেকে পাঠিয়ে তাকে বোঝতে বলেন। আমি বললাম মাসিমা, আপনারা যেখানে বুঝিয়েছেন সেখানে আমি আর নতুন কথা তাকে কি বলব। তবুও তিনি বল্লেন যে, তোমার উপর তার আস্থা আছে, তুমি একটু বোঝাও না। আমি তাকে বললাম, সজলবাবুতো অত্যন্ত ব্রিলিয়ান্ট ছেলে, কেন তুমি অমত করছ কশা। তুমি আমাকে কণা নামে ডাকবে না, আমার সারা শরীর জ্বালা করে। জ্বালা করলেও আমার কিছু করার নেই। কারণ আমি অন্য নামে তোমায় ডাকতে পারবো না। কেন পারবে না। আমার নামতো কণা নয় অশ্রুকণা। জানি। তবে প্রত্যেকের কাছে এক একটা নাম এমন হয়ে যায় যে, তার অন্যথা করার কোন উপায় নেই। তুমি আমাকে কণা বলে ডাক কেন? ঐ নামে তুমি আমায় ডাকতে বলেছিলে। তারতো মৃত্যু হয়ে গেছে। গেছে বুঝি। জানিনা তো! তাহলে?
আমি বললাম দেখ কণা আমি তোমার সঙ্গে ঝগড়া করতে আসিনি। তবে কেন এসেছো? সেতো তুমি জান কেন এসেছি? কেন এমন ছেলেমানুষি করছ কণা। আমি ছেলেমানুষি করছি না ছেলেমানুষি করছ তোমরা? কি অধিকার আছে আমার জীবন নিয়ে তোমাদের ছিনিমিনি খেলার? আমি তো বলেছি, আমি এখন বিয়ে করতে পারব না। কিন্তু কেন পারবেনা তার কারণ বলনি। দেখ কণা সব বাবা মায়ের স্বপ্ন থাকে। তাদের সেই স্বপ্নকে এই ভাবে ভেঙে দেওয়ার কোন অধিকার তোমার নেই। সজলবাবুকে যদি তোমার পছন্দ না হয় তাহলে সে কথাতো বলতে পারো। দেখ প্রান্তিক বেশী জ্ঞান দিওনা। বাবা মায়ের স্বপ্ন থাকে আর আমার কোন স্বপ্ন থাকতে পারে না? ওরা হয়তো বোঝে না কিন্তু তুমিও কি বোঝ না? যদি না বোঝ আমার কাছ থেকে চলে যাও, আর কোনদিন এসো না। নিজেকে এত শ্ৰেষ্ট ভাব কেন তুমি? কিসের অহংকার তোমার?
আমি অবাক হয়ে বললাম, সত্যি কণা আমি তোমাদের বুঝি না। আর যখন চাওনা তখন কথা দিচ্ছি আমি আর কোন দিন আসবনা তোমার কাছে। নিজের জীবন নিয়ে নিজের মত করেই স্বপ্ন দেখ। আমি আর কিছুটি বলতে আসবো না। হ্যাঁ তাই দেখবো। এসোনা আর কোনদিন। তুমিতো একটা দুর্বল মানুষ। তোমার কথা শুনতে হবে এমন দিব্যিতো আমি দিইনি।
জানিনা অশ্রুকণার কি হয়েছে, সে কেন এমন করে কথা বলছে কিছুই জানিনা। শুধু মনে হচ্ছে বিচিত্র এই নারী হৃদয়। কেন যে এত মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম। স্নেহময়ী দেবীকে বললাম, না মাসিমা, আমি ওকে রাজী করাতে পারলাম না। মিথ্যেই আমার উপর আপনাদের বিশ্বাস স্থাপন। প্রমথবাবু বললেন, বুঝতে পারছি তোমার অবস্থা বাবা। কিন্তু এখন কি করি বলত। ও যদি স্পষ্ট করে বলতে কেন সে বিয়ে করবেনা তা হলে এই অপমানের মধ্যে পড়তে হতো না। এখন আমি যে কি করি। আর ওদেরই বা কি বলব। বললাম আমাকে যদি কিছু করতে হয় নির্দ্বিধায় বলতে পারেন। ওদের তো একটা সংবাদ দিতে হয়। কি ভাবে যে দেবো তাইতো ভাবছি। বললাম, চিন্তা করবেন না। সংবাদ দেওয়ার দায়িত্বটা না হয় আমার পরে ছেড়ে দিন। তাই দিলাম, যা ভালো হয় তুমি করো। আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না।
নির্দিষ্ট দিনের ২ দিন আগে প্রতীমবাবুর অফিসে গিয়ে উপস্থিত হলাম। উনি বললেন প্রান্তিক ২ দিন আগে যে হ্যাঁ আসতে হল। কি ব্যাপার? তোমার গবেষণার জন্য আবার কিছু জানতে চাও নাকি? না। তবে? আমি বললাম, একদিন আপনি আপনার জীবনের অনেক কথা বলেছিলেন আজ ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে সেই জীবনের স্বপ্নগুলোকে, আবার কি ফিরে পেতে ইচ্ছে করে না? হঠাৎ থমকে গিয়ে তাকালেন আমার দিকে তারপর বললেন করলেই কি আর হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন গুলোকে ফিরে পাওয়া যায়? জানিনা যায় কি না। তবে চেষ্টা করতে আপত্তি কোথায়? তুমি কি বলতে চাইছে। না কিছু বলছিনা। গবেষণা করতে গিয়ে মনে হল জীবনে এত যার সাকসেস তিনি কেন তার একান্ত জীবনে এত ব্যর্থ। উনি হাসি মুখে বললেন, হয়তো ব্যর্থ বলেই কর্মজীবনে তা সার্থক হয়ে উঠেছে। আমি বললাম তাহলে কি বলতে চান যা হারিয়ে গেছে তা যদি ফিরে পান, তাহলে কর্ম জীবনের এই যে শিখর চুড়ায় আরোহণ তা ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে সে জন্যই অতীতকে আর ফিরে পেতে চান না? তাকিয়ে দেখি চঞ্চল হয়ে উঠেছেন উনি।
আমার কথা শোনার পরে খুবই চিন্তিত মনে হল প্রতীমবাবুকে। ধীর, শান্ত ভাবে বললেন, হয়তো তোমার কথা ঠিক অথবা ঠিক নয়। আসলে ঐ ভাবে কিছু ভাবিনি প্রান্তিক আর তাছাড়া আমার কথা তোমাকে বোঝাতে পারব না। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জানতে চাইলাম অবসর সময়ে পরিচিতদের বাড়ীতে বেড়াতে যান না? কেন বলত। না এমনি জিজ্ঞাসা করছি? হ্যাঁ তা যাব না কেন তবে আসুন না একদিন আমাদের বাড়ীতে। এই অফিসের চৌহদ্দিতে আপনাকে তো ঠিক মত পাওয়া যায় না। উনি বললেন ঠিক আছে যাব একদিন। সত্যি? কেন? তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি? না না বিশ্বাস হবে না কেন। তাহলে কবে যাবেন বলুন। তুমিই বল কবে যাব। আচ্ছা আগামী রবিবার। আগামী রবিবার? কিন্তু ওদিনতো তোমাদের আসার কথা। আমার যেন হঠাৎ মনে পড়ে গেছে এই ভাবে বললাম দেখুন তো নিজের গবেষণা নিয়ে এত ব্যস্ত যে আসল কথাটাই ভুলে গেছি। উনি বললেন কি কথা? ওই দিন আমদের আসা হচ্ছে না। উনি অবাক হয়ে বললেন কেন? আমি ধীরে ধীরে বললাম, দেখুন, অনেক সময় মনে হয় এটা না হওয়ার কোন কারণ নেই। আপনার জীবন নিয়েই ধরুন না, আপনি কি ভেবেছিলেন এমন একটা ঘটনা ঘটে যেতে পারে? কিন্তু ঘটনাকে তো আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। এ ক্ষেত্রেও তেমনি কিছু ধরুণ না, যার উপর আপনার আমার কারো হাত নেই। উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, বুঝলাম। ঠিক আছে তাই হবে। আমি বললাম, তা হলে ঐ কথাই রইল। আগামী রবিবার আপনি আসছেন আমাদের বাসায়। তোমাদের ওখানে আর কে কে আছেন? আমি আমার পিসি এবং তার মেয়ে সেলিনা। সেলিনা? হ্যাঁ সেলিনা, কিন্তু অবাক হচ্ছেন যে। না অবাক নয়। এবার নিয়ে পর পর দুবার এই নামের একটি মেয়ে ক্লাব বক্সিংএ প্রথম হয়েছে না? হ্যাঁ, সেলিনা রহমান। আমার পিসি নীলাঞ্জনার মেয়ে। কি যেন ভাবলেন প্রতীমবাবু, তারপর বললেন, সেলিনা রহমান অথচ তোমার পিসি নীলাঞ্জনার মেয়ে ঠিক বুঝতে পারছি না। এখানে বসেই সব যদি বুঝবেন তা হলে ওখানে গিয়ে কি বুঝবেন। হেসে ফেললেন প্রতীমবাবু। বললেন, তোমার এই কথার পিঠে কথা আমাকে ভীষণ অবাক করে দেয়। ঠিক আছে আমি যাব। সে দিন কি আর কেউ আসবেন? না এমনি কাউকে তো বলিনি, তবে হঠাৎ করে যদি কেউ এসে পড়েন আলাদা কথা। তা হলে উঠি। উঠবে? কেন কিছু বলবেন? না বলব না। তবে তোমাকে না জানিয়ে আমি লাঞ্চের অর্ডার দিয়েছি। বললাম খুব ভাল করেছেন। সত্যি খুব খিদে পেয়েছে।
নীলাঞ্জনা পিসি রবিবারে মিনতি সেনকে নিমন্ত্রণ করেন। আমার ইচ্ছা ছিল অশ্রুকণাকেও বলা হোক। যদি খোলামেলা কিছু আলোচনার ভিতর দিয়ে তার মনের কোন পরিবর্তন হয়। কিন্তু কোন দিক থেকে তার নাম না ওঠায় আমিও বেশী কিছু বলিনি।
প্রতীম চৌধুরী এলেন সন্ধ্যার একটু আগে। মিনতি সেন তখনো আসেন নি। সেলিনা বয়োজ্যেষ্ঠের সম্মানে তাকে প্রণাম করলে নীলাঞ্জনা বলেন, আমার মেয়ে। ও তুমি সেলিনা। তুমিতো বিখ্যাত লোক। খুব ভাল লাগছে তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে। ও একটু লাজুক হেসে বলল, কেন লজ্জা দিচ্ছেন, আমিতো সামান্য একটা মেয়ে আমার যা কিছু কৃতিত্ব তা আমার মা আর প্রান্তিক ভাইয়ের। নীলাঞ্জনা হাসি হাসি মুখে তাকালেন ওর দিকে। প্রতীমবাবু বললেন, আন্তর্দেশীয় প্রতিযোগিতায় নামবে না? ভাবছি, বলল সেলিনা। ভাবছি কেন? অবশ্যই আন্তর্দেশীয় প্রতিযোগিতায় নামবে। আমি বললাম, ও চাইছেনা আর আমাদের ওপর নির্ভর করে কোন কিছু করতে? কেন? তোমরা তো ওর আপনার লোক, তোমাদের উপর নির্ভর করতে ওর লজ্জা কোথায়? কলিং বেল বেজে উঠলো।
তার মানে মিনতি সেন এসেছেন? সেলিনা এগিয়ে যেতে চাইলে, আমি বললাম, তুমি কথা বল আমি দেখছি। আমি দরজা খুলেই বললাম, এত দেরি হল যে। আমার জন্য খুব চিন্তা করছিলি? তা তোর পিসি বারবার করে বললেন, আজ যেন অবশ্য একবার আসি, তা তোদের এখানে কি কোন উৎসব অনুষ্ঠান আছে নাকি? কই নাতো। তারপর বললাম, এস ভিতরে এস।
ভিতরে এক পা দিয়েই থমকে দাঁড়ালেন মিনতি সেন। ভদ্রলোককে ভীষণ চেনা চেনা মনে হচ্ছে কে ইনি? আমি বললাম, তুমি ভিতরে এস বলছি। মিনতি সেন অন্য ঘরের দরজা দিয়ে ভিতরের ঘরে চলে গেলেন। নীলাঞ্জনা সে ঘরের দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন। কি ব্যাপার? আপনি ওঘরে না গিয়ে এ ঘরে এলেন যে। না এমনি, বললেন মিনতি সেন, তারপর বললেন উনি কে? ভীষণ চেনা চেনা মনে হচ্ছে। নীলাঞ্জনা বললেন আসুননা ও ঘরে। কি জানি কেন, মনে হল মিনতি সেন যেন হাফাচ্ছেন, তিনি যে প্রতীমবাবুকে চিনতে পারেননি তা নয়, কিন্তু উনি এখানে কি ভাবে? আর কেনই বা এ ব্যাপারে তাকে অন্ধকারে রাখা হল।
কতবছর হয়ে গেছে। মনের অবচেতনায় কখনো তাকে ভুলে যেতে পারেননি মিনতি সেন। জুলপির কাছে পাক ধরেছে। সুন্দর ভাবে গোফ দাড়ি কামানো। সুঠাম সুন্দর শরীর। ব্যক্তিত্ব যেন ঠিকরে পড়ছে সমস্ত অবয়ব থেকে। আর আমি? ওর আকুলতাকে দু হাতে ঠেলে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম, আর কোন দিন আসবেন না আপনি। বলেছিলেন, আসবো না মিস সেন। শুধু যদি জানতাম কি আমার অপরাধ? বলেছিলাম, অপরাধ ভাগ্যের তবু আপনি আসবেন না। বিনা কারণে আমাকে এই ভাবে দূরে সরিয়ে দিয়ে শান্তি পাবেন কি মিস সেন? পারবেন এক নিরাপরাধ যুবককে এই ভাবে দূরে সরিয়ে রাখতে? কখনো কি মনে হবে না কি অপরাধ আমার? কেন ওকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি? আমার কিছু বলার নেই মিঃ চৌধুরী। তবু আপনি আসবেন না। তা আসব না, কিন্তু অপেক্ষা করব, যতদিন না আমাকে আপনার গ্রহণ করার মানসিকতা জন্মায়। তারপর ঐ ছোট্ট চিঠি। আজো তা বয়ে নিয়ে চলেছি। কিন্তু কেন? এখনো কি মনের অবচেতনায় বেঁচে আছে প্রতীম নামে ঐ সৌম্য চেহারার মানুষটি। কিন্তু আজ কিছুই তো জানিনা ওর সম্পর্কে। মনে মনে তাকে খুঁজেছি কিনা তাও জানিনা। কিন্তু এ কথাতো অস্বীকার করতে পারবোনা যে মানুষটিকে আমি আজো ভুলতে পারিনি।
আমি বললাম, যাবে না মা ও ঘরে, উনি একা বসে আছেন। হ্যাঁ যাই, কিন্তু একে তুই খুঁজে পেলি কোথায়? আর পেলিই যদি আমাকে কেন আগে বললিনা। সেটা হয়তো আমার অন্যায় হয়েছে, কিন্তু এখন যা তুমি করছ তাতে তো আমার নিজেকে অপমানিত মনে হচ্ছে? চলনা ও ঘরে।
মিনতি সেন এলেন আমার সঙ্গে। বললাম, আমার মা, মিনতি সেন। উনি যে ভীষণ অবাক হয়েছেন, তা ওর চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে? নমস্কার করে বললেন, তোমার মা? হ্যাঁ, আপনার বিশ্বাস হচ্ছে না? বিশ্বাস না হওয়ার কথা নয় প্রান্তিক, তুমি বলনি কেন তাই ভাবছি। আমি বললাম তোমরা কথা বল মা; আমি আসছি। প্রতীম চৌধুরী বললেন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন বসুন। মিনতি সেন বসলেন। প্রতীমবাবু বললেন, বহু দিন পরে আপনার সঙ্গে দেখা। কেমন আছেন? ভালো, আপনি? ভালো, তা আপনি একা কেন? প্রান্তিকের বাবা কোথায়? তাকে নিয়ে এলেন না। ভীষন লজ্জিত হলেন, মিনতি সেন। বললেন উনি নেই। সরি অকারণে আঘাত দেওয়ার জন্য। আপনার সঙ্গে যে এ ভাবে আবার দেখ হবে ভাবিনি। প্রান্তিককে আপনি আগে চিনতেন? আগে চিনতাম কি না, হ্যাঁ তা চিনতাম বৈকি? ও কি একটা গবেষণা করবে বলে আমার অফিসে একদিন গিয়েছিল। দ্বিতীয় বার দেখা হয় ওর বোধ হয় বন্ধু হবে, অশ্রুকণা নামে একটি মেয়েকে দেখতে গিয়েছিলাম আমার অফিসের এক সহকর্মীর জন্য। ছেলেটি খুব ব্রিলিয়ান্ট নাম সজল রায়। খুব ভাল। অশ্রুকণাও খুব ভাল মেয়ে, প্রথম শ্রেণীর স্নাতক। তাতে কি হবে, ওতো এ বিয়েতে রাজী নয়। কেন? এত ভাল ছেলে, রাজী নয় কেন? তাতো বলতে পারবোনা। এই সংবাদ দেওয়ার জন্য প্রান্তিক গত পরশু দিন। আমার অফিসে গিয়েছিল। ও নিমন্ত্রণ করল তাই চলে এলাম। কিন্তু আমার একটা জিনিষ খুব অবাক লাগছে। আপনি ওর মা, অথচ ও আছে ওর পিসির কাছে। হিসাব মেলাতে পারছি না। মিনতি সেন বললেন সব হিসাব মেলেনা মিঃ চৌধুরী। এতো সেই সিঁড়ি ভাঙা অংক। মনে হয় যেন মিলে যাবে, কিন্তু সামান্য ভুলে আরো কয়েকটি সিঁড়ি তৈরি করে দেয় মাত্র। যাকগে সে সব কথা আপনি একা এলেন কেন? এটাই ভাগ্য। কিন্তু ওসব কথা থাক খুব ভাল লাগছে আপনাকে দেখে। প্রান্তিকের মত এক উজ্জ্বল রত্নের আপনি মা এটা যে কত বড় গর্বের তা আপনাকে বোঝাতে পারবো না।
ওদের কথার মাঝে, সেলিনা এলো কফি এবং কিছু টিফিন নিয়ে–মিনতি সেন বললেন, তুই বোস মা, আমি দেখি, তোর মা কি করছে। ও বলল তুমিই বোসনা। আমি মাকে একটু সাহায্য করছি। ও চলে গেল। প্রতীম চৌধুরী বললেন, ভীষণ ভাল মেয়ে এই সেলিনা। আপনি ওকে আগে চিনতেন নাকি। নামে চিনতাম। আজই প্রথম পরিচয়। তা আপনার বাবা কেমন আছেন? উনি নেই। উনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, সরি, ভেরি সরি। তারপর বলেন দেখুন না যে কটা কথাই জানতে চাইলাম তার উত্তরে সরি না বলে উপায় নেই। খুব খারাপ লাগছে।
প্রতিম চৌধুরী যেন কথা হারিয়ে ফেললেন, আর কি বলবেন। তার এতদিনের স্বপ্ন যা তিনি একান্ত গোপনে লালন করে এসেছেন তা যেন মুহূর্তে ভেঙে খান খান হয়ে গেল। যার জন্য তিনি এই দীর্ঘ দিন প্রতীক্ষায় ছিলেন, তিনি থেকেও নেই, তার স্বপ্নে না তার কল্পনায়। আর প্রান্তিক কখনই বলেনি কে তার মা, কে তার বাবা। হঠাৎ কেন যেন প্রতিমের মনে হয় প্রান্তিক জানে তার মায়ের কথা এবং আমাকেও জানে। কেন যে নীলাঞ্জনা এসে বল্লেন, তুমি যাও মিনতি সেলিনা তোমাকে ডাকছে?