Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ভাঙা তারা || Bhanga Tara by Sukumar Ray

ভাঙা তারা || Bhanga Tara by Sukumar Ray

মাতারিকি আকাশের পরী। আকাশের পরী যারা, তাদের একটি করে তারা থাকে। মাতারিকি তার তারাটিকে রোজ সকালে শিশির দিয়ে ধুয়ে মেজে এমনি চকচক ক’রে সাজিয়ে রাখত যে, রাত্রিবেলা সবার আগে তার উপরেই লোকের চোখ পড়ত— আর সবাই বলত— “কী সুন্দর!” তাই শুনে শুনে আর সব আকাশ-পরীদের ভারি হিংসা হ’ত।
তানে হচ্ছেন গাছের দেবতা। তিনি গাছে গাছে রস যোগাতেন, ডালে ডালে ফুল ফোটাতেন আর গাছের সবুজ তাজা পাতার দিকে অবাক হ’য়ে ভাবতেন— ‘এ জিনিস দেখলে আর কিছুর পানে লোকে ফিরেও চাইবে না।’ কিন্তু লোকেরা গাছের উপর বার বার কেবল মাতারিকির তারা দেখত, আর কেবল তার কথাই বলত। তানের বড় রাগ হ’ল। সে বলল, “আচ্ছা, তারার আলো আর কতদিন? দুদিন বাদেই ঝাপসা হয়ে আসবে।” কিন্তু যতদিন যায় তারা উজ্জ্বল আর সুন্দর হয়, আর সবাই তার দিকে ততই বেশি ক’রে তাকায়। একদিন অন্ধকার রাত্রে যখন সবাই ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন দেখছে, তখন তানে চুপি চুপি দুজন আকাশ-পরীর কানে কানে বলল, “এস ভাই, আমরা সবাই মিলে মাতারিকিকে মেরে তারাটাকে পেড়ে আনি।” পরীরা বলল, “চুপ চুপ, মাতারিকি জেগে আছেন। পূর্ণিমার জোছনা রাতে আলোয় শুয়ে মাতারিকি চোখ যখন আপনা হ’তে ঢুলে আসবে, সেই সময়ে আবার এস।”
এসব কথা কেউ শুনল না, শুনল খালি জলের রাজার ছোট্ট একটি মেয়ে। রাজার মেয়ে রাত্রি হলেই, সেই তারাটির ছায়া নিয়ে খেলতে খেলতে জলের নীচে ঘুমিয়ে পড়ত আর মাতারিকির স্বপ্ন দেখত। দুষ্ট পরীর কথা শুনে তার দু’ চোখ ভ’রে জল আসল।
এমন সময় দখিন হাওয়া আপন মনে গুনগুনিয়ে জলের ধারে এসে পড়ল। রাজার মেয়ে আস্তে আস্তে ডাকতে লাগল, “দখিন হাওয়া শুনেছ? ওরা মাতারিকিকে মারতে চায়।” শুনে দখিন হাওয়া ‘হায়’ ‘হায়’ ক’রে কেঁদে উঠল। রাজার মেয়ে বলল, “চুপ চুপ, এখন উপায় কি বল ত?” তখন তারা দুজনে পরামর্শ করল যে, মাতারিকিকে জানাতে হবে— সে যেন পূর্ণিমার রাতে জেগে থাকে।
ভোর না হ’তে দখিন হাওয়া রাজার মেয়ের ঘুম ভাঙিয়ে বলল, “এখন যেতে হবে।” সূর্য তখন স্নানটি সেরে সিঁদুর মেখে সোনার সাজে পুবের দিকে দেখা দিচ্ছেন। রাজার মেয়ে তার কাছে আবদার করল, “আমি আকাশের দেশে বেরাতে যাব।” সূর্য তাঁর একখানি সোনালি কিরণ ছড়িয়ে দিলেন। সেই কিরণ বেয়ে বেয়ে রাজার মেয়ে উঠতে লাগল। সকাল বেলার কুয়াশা দিয়ে দক্ষিণ হাওয়া তাকে ঘিরে চারদিকেতে ঢেকে রাখল। এমনি করে রাজার মেয়ে মাতারিকির বাড়িতে গিয়ে, সব খবর বলে আসল। মাতারিকি কি করবে? সে বলল, “আমি আর কোথায় যাব? পূর্ণিমার রাতে এইখানেই পাহারা দিব— তারপর যা হয় হবে।”
রাজার মেয়ে ঝাপ্‌সা মেঘের আড়াল দিয়ে বৃষ্টি বেয়ে নেমে আসলেন।
তারপর পূর্ণিমার রাতে তানে আর সেই দুষ্টু পরীরা ছুটে বেরুল মাতারিকির তারা ধরতে। মাতারিকি দু’হাত দিয়ে তারাটিকে আঁকড়ে ধ’রে, প্রাণের ভয়ে ছুটতে লাগল। ছুট্‌ ছুট্‌ ছুট্‌! আকাশের আলোর নীচে, ছায়াপথের ছায়ায় ছায়ায় নিঃশব্দে ছুটাছুটি আর লকোচুরি। দখিন হাওয়া স্তব্ধ হ’য়ে দেখতে লাগল, রাজার মেয়ে রাত্রি জেগে অবাক হ’য়ে তাকিয়ে রইল। তারায় তারায় আকাশ-পরী, কিন্তু মাতারিকি যার কাছেই যায়, সেই তাকে দূর দূর ক’রে তাড়িয়ে দেয়।
ছুটতে ছুটতে মাতারিকি হাঁপিয়ে পড়ল- আর সে ছুটতে পারে না। তখন তার মনে হ’ল, ‘জলের দেশে রাজার মেয়ে আমায় বড় ভালোবাসে— তার কাছে লুকিয়ে থাকি।’ মাতারিকি ঝুপ ক’রে জলে পড়েই ডুব, ডুব, ডুব— একেবারে জলের তলায় ঠাণ্ডা কালো ছায়ার নীচে লুকিয়ে রইল। রাজার মেয়ে অমনি তাকে শেওলায় ঢেকে আড়াল করল।
সবাই তখন খুঁজে সারা— “কোথায় গেল, কোথায় গেল?” একজন পরী ব’লে উঠল, “ঐ ওখানে— জলের নীচে।” তানে বললেন, “বটে! মাতারিকিকে লুকিয়ে রেখেছ কে?” রাজার মেয়ের বুকের মধ্যে দুর দুর ক’রে কেঁপে উঠল— কিন্তু সে কোন কথা বলল না। তখন তানে বলল, “আচ্ছা দাঁড়াও। আমি এর উপায় করছি।” তখন সে জলের ধারে নেমে এসে, হাজার গাছের শিকড় মেলে শোঁ শোঁ করে জল টানতে লাগল।
মাতারিকি জল ঝেড়ে উঠে আসল। জলের নীচে আরামে শুয়ে তার পরিশ্রম দূর হ’য়েছে, এখন তাকে ধরবে কে? আকাশময় ছুটে ছুটে কাহিল হ’য়ে সবাই বলছে, “আর হলো না।” তানে তখন রেগে বলল, “হতেই হবে।” এই ব’লে হঠাৎ সে পথের পাশের একটা মস্ত তারা কুড়িয়ে নিয়ে, মাতারিকির হাতের দিকে ছুড়ে মারল।
ঝন্‌ ঝন্‌ ক’রে শব্দ হল, মাতারিকি হায় হায় ক’রে কেঁদে উঠল, তার এতদিনের সাধের তারা সাত টুকরো হ’য়ে ভেঙে পড়ল। তানে তখন দৌড়ে এসে সেগুলোকে দুহাতে ক’রে ছিটিয়ে দিলেন আর বললেন, “এখন থেকে দেখুক সবাই— আমার গাছের কত বাহার।” দুষ্টু পরীরা হো হো করে হাসতে লাগল।
এখনও যদি দখিন হাওয়ার দেশে যাও, দেখবে সেই ভাঙা তারার সাতটি টুকরো আকাশের নীচে একই জায়গায় ঝিকমিক করে জ্বলছে। ঘুমের আগে রাজার মেয়ে এখনও তার ছায়ার সঙ্গে খেলা করে। আর জোছনা রাতে দখিন হাওয়ায় মাতারিকির দীর্ঘশ্বাস শোনা যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *