ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে (Brahmaputrer Pare) : 03
নির্মলা জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি যে বললে তপুকে আসতে বলবে। আসতে বলেছো?’
নির্মলার মোবাইলটা নূপুরকে দিয়েছে ব্যবহারের জন্য। তপুকে ফোন করার কথা অনেকবার ভেবেছে নূপুর। ভেবেছেই কেবল। ফোন আর করা হয়নি। ঘড়িতে সময় দেখছে নূপুর। তপুর কখন সকাল হবে, কখন দুপুর, কখন ক্লাস, লেকচার, ব্যস্ততা, লাঞ্চ ইত্যাদির হিসেব করে। হয়তো সন্ধের দিকটায় একটু অবসর পাবে। কিন্তু তখন যদি এর কোনও জরুরি মিটিং থাকে। নূপুর চায়না তপুর ভীষণ কোনও ব্যস্ততার মধ্যে একটা উটকো ফোন যাক। নূপুর অত কিছু বোঝে না, তার একটাই প্রশ্ন, কেন তপু আজ যমুনার পাশে থাকবে না! তপু কি জানে না যমুনা না বাঁচালে তপু বলে কিছু এই জগতে থাকতো না। তপুকে যমুনার জন্য নয়, তপুর জন্যই আসতে বলবে অন্তত একটু হলেও তো মুখখানা দেখতে পাবে! শেষবারের মতো। আর নূপুরও দেখতে পাবে তপুকে। সেই তপু বেরিয়ে গিয়েছিল দেশ থেকে দেড় বছর বয়সে। সেই সময়ের কথা তপুর কিছু মনে নেই। বাবা কোথায় বাবা কী এসব প্রশ্নও সে কখনও যমুনাকে করেনি যখন বড় হচ্ছিল। বাবা বলে কাউকে কোনোদিন ডাকেওনি। বাবা নামের কোনও পুরুষের জন্য তপুকে কেউ উতলা হতে দেখেনি। যমুনা এমনই ভাবে মহা দুর্যোগের সময়ও বুঝতে দেয়নি দুর্যোগ। যমুনাকে লোকেরা সবাই বলেছে, ও মোটেও সংসারী মেয়ে নয়,দিন রাত বই নিয়ে পড়ে থাকে, স্বামীর সঙ্গে থাকলো না, পুরুষদের সঙ্গে বসে মদ খায়, রাত বিরেতে আড্ডা দেয়, সার্ট প্যান্ট পরে, ছেলেদের মতো চুল, ঠোঁটে লিপস্টিক পরে না, নখে নেলপালিশ দেয় না, চোখে কাজল পরে না, কানে নাকে গলায় হাতে কোনও গয়না পরে না, দেখতে কেমন ছেলে ছেলে, এর দ্বারা বাচ্চা মানুষ করা হবে না। বরং নূপুরকেই বলেছে সবাই, নূপুর শান্ত শিষ্ট লক্ষ্মী মেয়ে, শাড়ি পরে, সাজে, কোমর পর্যন্ত চুল, স্বামীর সঙ্গে মানিয়ে চলে, ওর ছেলেকে ও জজ ব্যারিস্টার বানাবে, কেউ একজন বলেছিল, চাঁদে পাঠাবে। হ্যাঁ চাঁদেই গিয়েছে বটে, পৃথিবীর সীমানা পার হয়ে অনেক দূরে। নূপুর অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। দু’একটা তারা মিটমিট করে জ্বলছে। কে যেন বলেছিল, মরে গেলে মানুষ আকাশের তারা হয়ে যায়।
নির্মলাকে বলে নূপুর, করবে সে ফোন তপুকে।
তপুকে আর কতদিনই বা দেখেছে নূপুর। তপুর বড় হওয়া তার দেখা হয়নি। বরং নির্মলা দেখেছে নূপুরের চেয়ে বেশি। নির্মলার কাছেই নূপুর অনেক গল্প শোনে তপুর। তপু দিল্লির জওহরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটিতে পড়তো, কলকাতায় আসতো ছুটিছাটায়। যতদিন থাকতো মা মেয়ে বন্ধুর মতো কথা বলতো, রাতে দু’জন একঘরে ঘুমোতো। প্রায় সারারাতই দুজন গল্প করতো। দু’জনের যে কত কথা ছিল। নির্মলা বলে মাঝে মাঝে মনে হতো ওদের কথা দু’শ বছরেও ফুরোবে না। ইউনিভার্স, গ্যালাক্সি, নতুন নতুন গ্রহের নতুন নতুন চাঁদ, নানারকম থিওরি, এসবের ছাই বোঝে নির্মলা। সে অন্য ঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো। আবার যখন মেয়েদের সমস্যা নিয়ে, দারিদ্র্য, নারীপাচার, পতিতাবৃত্তি, ডমেস্টিক ভায়োলেন্স, ধর্ষণ, গণধর্ষণ, যৌন হেনস্থা ইত্যাদি নিয়ে কথা হত, বসে বসে শুনতো।
নির্মলার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে যখন বলে, ‘দু’জনে দুনিয়ার এত কিছু কী করে জানতো কে জানে! দু’জনেই মন দিয়ে দু’জনের কথা শুনতো। মনে হত, একজন আরেকজনের কাছ থেকে শিখছে, দুজনই ছাত্রী, আবার দুজনই শিক্ষিকা। যমুনা তপুর সঙ্গে যত গভীরভাবে সব বিষয়ে আলোচনা করতো, অন্য কারও সঙ্গে অত গভীরভাবে করতো না।’ নির্মলার অন্তত এরকমই মনে হয়েছে দেখে।
এমন সম্পর্ক নির্মলা কোনোদিন কোনও মা আর মেয়ের মধ্যে দেখেনি। হয়তো বাবা আর ছেলের সম্পর্ক এমন হয়। খুব অভিজাত শিক্ষিত পরিবারে হয়তো আছে, কিন্তু এমন মধ্যবিত্ত সংসারে কমই দেখা যায়। এ দেশে মেয়ে মা’য়ে কথা হলে খাওয়া দাওয়া, শাড়ি কাপড়, কসমেটিক্স, সাজগোজ, কেনাকাটা, সংসার, রান্না বাড়া, স্বামী সন্তান এসব নিয়েই কথা হয়। দুনিয়ার এত কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে হয় না। ওরা দেশি আবার দেশিও নয়।
নির্মলার কথা শুনে নূপুর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, —’আসলে কী জানো নির্মলা। আমার কপালটা পোড়া। আমি ভাবতাম দিদির কপাল বুঝি পোড়া। কিন্তু কে জানতো আমিই আসলে হতভাগী। দিদির কষ্ট ছিল। কষ্ট তো ছিলই। আর আমি ভাবতাম আমি বুঝি খুব লাকি, খুব সুখী, কত কিছু বুঝি বলে ভাবতাম। কিন্তু কী বুঝেছি বলো? একটা ছেলে ছিল। ছেলেটাকে মানুষ করতে পারিনি। মা ছেলেতে তো ওরকম সুন্দর সম্পর্কটা হতে পারতো, পারতো না, বলো?’
নির্মলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নূপুরের বাঁ চোখের কোণ বেয়ে একটা জলের ধারা নামে।
—আর কী করতো ওরা?
—কত কিছু!
—তপু এলে আর কী করতো বুবু? তোমার যমুনাদি কী করতো? তুমি কী করতে?
—একটু বেশিদিনের জন্য হলেই তিনজনই চলে যেতাম পাহাড়ে বেড়াতে। কখনও রিশপ, কখনও ডুয়ার্স, দার্জিলিং, শিমলা, মানালি, লাদাক। পাহাড় যমুনাকে টানতো খুব।
নির্মলার এই শেষ কথাটুকু নিয়ে মনে মনে খেলা করে নূপুর। পাহাড় যমুনাকে টানতো খুব। পাহাড় কি নূপুরকে টানতো না? কিন্তু নূপুর তো তার সোনার সংসার নিয়ে ছিল। পাহাড়ে কখন যাবে? যমুনা অনেকদিন বলেছে, চলে আয়, আমার সঙ্গে কিছুদিন থাকবি। পাহাড়ে চল। পাহাড়ে মন ভালো হয়ে যায়।
নূপুর বলতো আমার কি মন খারাপ নাকি যে মন ভালো করতে কোথাও যেতে হবে? আমি বেশ আছি।
যমুনা চুপ হয়ে যেত।
আজ নিজেকে বড় অসহায় লাগে নূপুরের। তার কোথাও যাওয়া হয়নি। কোনও পাহাড় দেখেনি, কোনো সমুদ্র দেখেনি। অথচ জীবন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এক এক করে প্রিয় মানুষগুলো চলে গেল। চারপাশটা ভীষণ শূন্য। কোথায় গিয়ে আর কী উপভোগ করবে নূপুর! একা একা কিছু কি ভালো লাগে পাশে একজন ভালো লাগার মানুষ যদি না থাকে? নূপুর যদি জানতো তার জগতটা হঠাৎ করে একটা ধুধু কবরখানা হয়ে উঠবে, তাহলে হয়তো যা যা করতে ভালো লাগে, যা যা বাকি আছে জীবনে, সেগুলো সে করতো।
—নির্মলা, তোমরা পাহাড়ে কী করতে? খুব আনন্দ হত বুঝি?
নির্মলা ফুলদানিতে বাগানের তাজা গোলাপ আর তাজা লিলি রাখতে রাখতে বলে — ‘আসলে আনন্দ একেক জনের কাছে একেক রকম। আমরা যেভাবে আনন্দ পেতাম, হয়তো অন্য অনেকেই ওভাবে পাবে না। আমাদের আনন্দ তো বারে গিয়ে মদ খাওয়ায়, বা ডিসকো নাচায় নয়, আমাদের আনন্দ চুপচাপ বসে পাহাড় দেখায় ছিল। না, কোনও স্পিরিচুয়ালিটির ব্যাপার ছিল না কিন্তু, শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্যটা উপভোগ করা। সমুদ্রতেও গেছে যমুনা। শেষবার তো আমি যাইনি, তপুকে নিয়ে কাঠমুণ্ডু গেছিল, ওখান থেকে ফিরে গোয়া গেল। তপু’ কবে আসবে তা জেনেই যমুনা টিকিট করে রাখতো। তপুরও নেশা হয়ে গিয়েছিল বেড়ানোর। এখন মেয়ে ইওরোপ আমেরিকা দেখবে ঘুরে ঘুরে। যমুনার পক্ষে অত তো সম্ভব ছিল না। ফাঁক পেলে ভারতে কোথাও বেড়িয়ে আসা আর বিদেশ বিভুঁই বেড়াতে যাওয়া, দুটোর মধ্যে পার্থক্য অনেক। তোমাকে দেখতে যেত বা অফিসের কাজে যেত, সে আলাদা। তপু তার মার কাছ থেকে বেড়ানো শিখেছে, বেড়াবে। যা শিখেছে মা’র কাছ থেকেই শিখেছে। মাকে বই পড়তে দেখেছে, বই পড়েছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের কথা বলতে শুনেছে, ওগুলোয় আগ্রহ বেড়েছে। লেখাপড়া নিয়ে থেকেছে। যমুনার গাইডেন্সে বড় না হলে তপুকে হারভার্ড যেতে হত না, নূপুর। ও কলকাতায় কোনও নাপিতের দোকানে চুল কাটতো, নয়তো কোনো অফিসে কোনও ছাপোষা কেরানি হত’।
কিছুক্ষণ থেমে নির্মলা আবার বলে — ‘পাহাড় সামনে রেখে তিনজনই আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেছি। তপু ট্রেক করতে যেত, আমি আর যমুনা ওর জন্য অপেক্ষা করতাম। ওসব ট্রেকিং ফেকিং আমার ভালো লাগতো না। যমুনারও না’।
—’আর কী কী করতে তোমরা ওই সব পাহাড়ে?’
—’ধরো, এক রিশপেই তো যমুনা বেশ কবার গেছে। বলেছিলাম এ কি তোমার বাপের বাড়ি নাকি যে এত বারবার যাচ্ছো? যমুনা হাসতো। বলতো অনেকটা বাপের বাড়িই’।
নির্মলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নির্মলার দীর্ঘশ্বাস দেখেই নূপুর বোঝে, নির্মলা জানে বাপের বাড়ি যে যমুনাকে ত্যাজ্য করেছিল, সেই যৌবন থেকেই বাপের বাড়ি যমুনার কিছুই মেনে নেয়নি। হুমায়ুনকে তালাক দেওয়া, পাশার সঙ্গে সম্পর্ক করা, বিয়ে ছাড়া বাচ্চা নেওয়া। কিন্তু বললেই কি কেটে বাদ দেওয়া যায় একটা সম্পর্ক? যমুনা যত সম্মান আর ভালোবাসা পেয়েছে নিজের জীবনে, তা বাপের বাড়ির ক’টা মানুষ পেয়েছে! অথচ অপয়া অসতী মুখ দেখানো যায় না, এমন মেয়ে থাকার চেয়ে না থাকা ভালো, কী লজ্জা কী লজ্জা এসব কথা কম হয়েছে নিজেদের মধ্যে!
যমুনার খবরাখবর নূপুরই দিত বাবা মা’কে। নূপুর তপুর সেবাযত্ন করতে যাচ্ছে, যমুনার বাড়িতে থাকছে, এ বাপের বাড়ির কারও অজান্তে ঘটেনি। যতবারই নূপুর ঢাকায় যেত, এককালের বিদুষী মমতা বানু, নূপুর-যমুনার মা, ছোট বড় কনটেইনারে প্রচুর রান্না করা খাবার দিয়ে দিত। নূপুর এত বেশি খাবার দেখে বলতো, ‘এত কেন দিচ্ছ!’ মমতা বানু বলতো, ‘তোর জন্য দিচ্ছি, পথে ক্ষিধে পেলে খাবি’। নূপুর বুঝতো পথে অত কিলো কিলো খাবার কেউ খেতে পারে না। ট্রেনের কামরায় বসে বক্সগুলোর ঢাকনা খুলে দেখে নিতো কী খাবার দেওয়া হয়েছে। সব যমুনার প্রিয় খাবার। নূপুরের মা বাবা দুজনেই বলতো, ‘ওই মেয়ে যেন এই বাড়িতে কোনোদিন পা দেওয়ার চেষ্টা না করে। ওর ছায়াও সহ্য করবো না’। কথায় আর কাজে কী ভীষণ পার্থক্য! বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার দায় নূপুর যমুনাকেই দেয়। একবারও তো যমুনা বাপের বাড়ি গিয়ে বলেনি, ‘ভুল করেছি ক্ষমা করে দাও’, অথবা ‘যা করেছি বেশ করেছি’, যা করেছে কেন করেছে, তা যুক্তি দিয়ে বলতো একবার। একবার বলতো! কে বলেছে তার মা তাকে আদর করে বুকে টেনে নিত না, বা তার বাবা তাকে কাছে ডেকে আগের মতো গল্প করতো না। যমুনা তার বাবা মাকে এই সুযোগটা দেয়নি। অদ্ভুত একটা অহংকার নিয়ে তিনজনই বসে ছিল যার যার জায়গায়। বাবা মা দুজনেই এক এক করে মারা গেল। যমুনার ঠিক কেমন লেগেছিল খবর শোনার পর, নূপুর আজও জানে না।
—’নির্মলা, যেদিন বাবা মারা গেল, আমি খবরটা জানালাম। বিশেষ কোনো কথা হল না। শুধু খবরটা জানিয়ে আমি ফোন রেখে দিয়েছিলাম। আমার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। যমুনাদি কী করছিল? মনে আছে তোমার?’
নির্মলা বলে সেদিন যমুনা তাকে বলেনি। পরদিন সকালে যখন গান গাইছিল নির্মলা, যমুনা বললো ওই গানটা করো, ‘তুমি আমাদের পিতা, তোমায় পিতা বলে যেন জানি…’, পরে গাইতে বললো, ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’। চুপচাপ বারান্দায় বসে গান শুনছিল আর চোখের জল মুছছিল। অনেকবার নির্মলা জিজ্ঞেস করেছে, কী হয়েছে তোমার। কিন্তু উত্তর দেয়নি। বিকেলে বলেছে।
নির্মলা দুঃখ-দুঃখ-কণ্ঠে বলে,— যমুনার দুঃখগুলো বোঝার উপায় ছিল না।
নূপুর আর জিজ্ঞেস করেনি তার মা মারা যাওয়ার দিন যমুনা কী করেছিল। মা মারা যাওয়ার খবরটা দিতে দিতে নূপুরের সাত দিন দেরি হয়েছিল। সাত দিন পরেই যমুনা জেনেছে তার মা নেই। তপুকে কোনোদিন দেখেনি যমুনার বাবা মা। জয়কে দেখেছে। জয় জন্মানোর পর প্রতিবছর নূপুর আসতো দেশে, বাবা মা জয়কে নিয়ে অনেক সময় কাটিয়েছে, এতে তপুকে না দেখার কষ্টও বোধহয় পরোক্ষে লাঘব হয়েছে। কোনোদিনই তপুর কোনও ছবিও কেউ দেখতে চায়নি।
ঘেন্নায় ফেলে দেওয়া ছুড়ে ফেলা তপু আজ হারভার্ডে। নূপুরের কাছে সবকিছু জাদুর মতো মনে হয়। তবে হারভার্ডের কারণে মাকে একবার শেষ দেখা দেখতে আসবে না, এ কেমন কথা! নূপুর মানতে পারে না।
নির্মলা কলিং বেলের শব্দ শুনে উঠে যায়। সবসময় বাড়িতে যমুনার বন্ধু বান্ধব বা চেনা পরিচিত কেউ না কেউ আসছে। সবাই চোখের জল ফেলে ফেলে দুঃখ করে যাচ্ছে। নূপুরের সঙ্গে দেখা করে, চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, যমুনা কী চমৎকার মানুষ ছিল। দেখে নূপুরের কী যে ভালো লাগে! কলকাতায় না এলে সে এই দৃশ্য দেখতে পেত না। যমুনার জন্য গর্বে বুক ভরে ওঠে। এই দৃশ্য যদি তপুও দেখতো! তপু হয়তো জানে তার মা’কে কত মানুষ ভালোবাসে। কত কত মেয়ে আসছে, বলছে যমুনা তাদের কলিগ ছিল, বা বন্ধু ছিল, কেউ বলছে যমুনার সাহায্য ছাড়া বিয়েটা হত না বা ডিভোর্সটা হত না বা চাকরিটা হত না। নানারকম কৃতজ্ঞতা। আবার স্রেফ মিস করা। মানুষ হিসেবে নাকি অসাধারণ ছিল। এমন অসাম্প্রদায়িক, এমন অমায়িক, এমন অসম সাহসী, এমন অসাধারণ, এমন অসম্ভব ব্যক্তিত্ব নাকি তারা খুব কমই দেখেছে। আসলে বাইরের মানুষের চোখ আর ঘরের মানুষের চোখ আলাদা। তারা দু’রকম করে দেখে একজন মানুষকে। ঘরের মানুষের অনেক কিছু চোখে পড়ে না। বাইরের মানুষেরা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে তবে চোখে পড়ে। যমুনার অনেক গুণ অন্যরা বলার পর লক্ষ্য করেছে নূপুর। তাহলে ঘরের মানুষই বোধহয় বাইরের মানুষ, বাইরের মানুষই ঘরের মানুষ। আসলে যারা ভালোবাসে, যারা বোঝে মানুষটাকে, তারাই সত্যিকারের ঘরের মানুষ।
নির্মলার পেছন পেছন এক যুবক বড় একটা কাগজের বাক্স নিয়ে দোতলায় এল। বাক্স খুলে বড় বড় বাঁধানো ছবি বের করলো। ছবিগুলো যে ভালো বাঁধাই হয়েছে তাও খুলে খুলে দেখালো। নির্মলা তার আগেই ঘর থেকে টাকা আনতে চলে গেল। নূপুরই দেখলো শুধু ছবিগুলো। টাকা পেয়ে যুবক চলে গেল। নূপুর পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। নির্মলা বললো, যমুনা দু’ সপ্তাহ আগে এই ছবিগুলো বাঁধাতে দিয়েছিল। বাড়িতেই পৌঁছে দেবার কথা ছিল বাঁধাই হয়ে গেলে। ছবিগুলো দেখে নিয়েছে নূপুর, বারোটা ছবিই। বারোটাই তপু আর নূপুরের ছবি। নূপুরের কোলে তপু। নূপুর তপুকে খাওয়াচ্ছে, গোসল করাচ্ছে, তপুকে নিয়ে খেলছে, তপু ঘুমোচ্ছে, পাশে নূপুর। এসব।
নির্মলাও ছবিগুলো দেখতে দেখতে বলে যে সে জানতো না এই ছবিগুলো যমুনা ছবি-বাঁধাই-এর দোকানে দিয়েছে। ফোন করে বাড়িতে আনিয়েছিল বাঁধাইওয়ালাকে। ছবি বড় করা, বাঁধাই করা এসব কাজ যখন করতে দিয়েছে, হয় নির্মলা তখন বাড়িতে ছিল না, থাকলেও দেখেনি কোন ছবিগুলো দিচ্ছে যমুনা।
—’সব তোমার আর তপুর ছবি’।
নূপুর কোনও কথা বলে না।
—’এই ছবিগুলো আমাকে অনেকবার দেখিয়েছে।’ নির্মলা বলে।
নূপুর দীর্ঘ সময় নিয়ে স্নান করে। যমুনার ব্যবহার করা তোয়ালে, সাবান শ্যাম্পু চানঘরে। ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে নূপুর। চারদিকটা কেমন খালি খালি লাগে, মানুষটা ছিল, মানুষটা নেই। মানুষটা হাসতো, হাঁটতো, কথা বলতো, স্নান করতো, মানুষটা হাসবে না, হাঁটবে না, কথা বলবে না, স্নান করবে না। যেন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
স্নাত স্নিগ্ধ শরীরে নতুন একটা শাড়ি পরে কপালে একটা লাল টিপ পরে নূপুর। সুগন্ধী লাগায় গায়ে। আমেরিকার জীবনে টিপ পরা হয়নি। টিপ পরে সেই আবার পুরোনো জীবনে চলে যায়, যমুনা আর নূপুর দুজনে শাড়ি পরতো, টিপ পরতো, শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে হাতে চুড়ি পরতো, কানে দুল পরতো, গানের অনুষ্ঠানে যেত, নয়ত নাটক দেখতে যেত। ময়মনসিংহে দুজনের একটা আশ্চর্য সুন্দর জীবন ছিল এক সময়।
নূপুরের স্নান করায় নির্মলা খুশি হয়। দু’জনে খায় খাবার টেবিলে বসে। মাছ নূপুরের প্রিয়। নির্মলা শুধু ডাল আর শাক দিয়ে খাচ্ছে। মাছ নিচ্ছে না কেন জিজ্ঞেস করলে বললো কটা দিন সে মাছ মাংস খাবে না। কারণ জিজ্ঞেস করলে কিছু বললো না, মাথা নিচু করে চুপচাপ খেয়ে গেল, যেন শোনেনি। নূপুর অনুমান করে, যমুনার মারা যাওয়ায় সে নিজের মতো করে কোনও ব্রত করছে। ওই পুজোটাও যেমন। নির্মলা কথায় বলায় চলায় আধুনিক হলেও নিভৃতে একটা কুসংস্কার পোষে। হাতেও দুটো পাথরের আঙটি।
নূপুর ছবিগুলো বিছানায় বিছিয়ে দেয়। নিজেও ছবিগুলোর পাশে শুয়ে দেখতে থাকে ছবিগুলো। দেখা শেষ হয় না। ঠিক কখন তোলা, কবে, কোন ঘরে, কে তুলেছে এসব এখনও চোখের সামনে ভাসে। যেন এই সেদিনের ঘটনা। অ্যালবামটা নিয়ে এসেছিল যমুনা যখন দেশ ছাড়ে। না নিয়ে এলে এতদিনে এগুলো নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত। বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়, ওই ছবি থেকে নূপুর নড়ে না। নির্মলা দু’বার এসে তাড়া দেয়। একবার নির্মলার এক আত্মীয়া এলো, আরেকবার যমুনার অফিসের কেউ একজন এলো, এসব নির্মলাই সামলায়। নূপুর শুয়ে শুয়ে পুরোনো ছবিতে। তার এবার প্রশ্ন জাগে, কেন তপুর সঙ্গে নূপুরের ছবিগুলো যমুনা বাঁধিয়েছে? তপুর ছোটবেলায় কত মানুষের কোলে তপুর ছবি আছে। তপুর ওই অ্যালবামে যমুনার সঙ্গে তপুর ছবিই বেশি। তবে বারোটা ছবিই কেন বেছে বেছে তপু আর নূপুর! কেন যমুনা আর তপু নয়, বা তপু একা নয়! এর কোনও উত্তর খুঁজে পায় না নূপুর। নির্মলাকে আর সে জিজ্ঞেস করে না। নির্মলা নির্ঘাত বলবে সে জানে না, যমুনা তাকে এ ব্যাপারে কিছু বলেনি।
তপুর তখন সকাল, নূপুর ফোন করে। নূপুর একটাই কথা বারবার করে বলে, ‘চলে এসো, নিজের মাকে একবার চলে এসো দেখতে, এ-ই তো শেষ দেখা। আর কখনও চাইলেও তো দেখতে পারবে না। পারলে আজই চলে এসো। মর্গের ফ্রিজারে রাখা হয়েছে, বোধহয় একটা সময় সীমা আছে। বেশিদিন রাখা সম্ভব নয়। কথা দাও তুমি আসছো’।
তপু ওদিক থেকে পুরোনো কথাই বলে, মায়ের মৃত মুখ সে তার মায়ের শেষ স্মৃতি হিসেবে রাখতে চাইছে না।
নূপুর তাকে এসব স্মৃতি ট্রিতির রোমান্টিকতা বাদ দিয়ে রিয়ালিটির সামনে দাঁড়াতে বলে। রিয়ালিটির সামনে দাঁড়াতে বলাটাই, তপু বলে, একধরনের রোমান্টিকতা। তপু জানে তার মা নেই। সে জানে, না থাকাটা মানে কী, কোনোদিন তার মার সঙ্গে কোথাও তার দেখা হবে না। কলকাতায় সে যেতেই পারে, বস্টন থেকে ফ্লাইট, দিল্লিতে নয়তো ঢাকায় একটা স্টপ। কিন্তু লাভ কী গিয়ে? মৃত্যুর পর ভাসমান আত্মায় যেহেতু সে বিশ্বাস করে না, বিদেহী আত্মার শান্তি কামনাতেও বিশ্বাস করে না!
—তাহলে আমি, আমি কি বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করতে এসেছি তপু? আমি কি ওসব আত্মা টাত্মায় বিশ্বাস করি!
—’তুমি যদি না করো, তাহলে তো ভালই। একজন কেউ আত্মীয় ওরা চাইছিল নূপু-খালা। দেখওনি তো অনেক বছর নিজের দিদিকে। শেষ দেখাটা তুমিই দেখ’।
তপু দ্রুত ফোন রেখে দেয়। ওর বাংলা উচ্চারণ অদ্ভুত। না ঢাকার, না কলকাতার।
জগতে একজন মানুষের সঙ্গেই ছিল তপুর বন্ধন। সেই বন্ধন তার নেই এখন। বাইরের জগতকেই নিজের করে নিতে হবে। যমুনার না থাকা তপুর জন্য ঠিক কী, তা ভেবে নূপুরের বুকে ব্যথা শুরু হয়। মুখ মাথা ঢেকে শুয়ে পড়ে নূপুর। নির্মলা লক্ষ্য করে নূপুর ভালো বোধ করছে না। পাশে শুয়ে চুলে মিনিট কুড়ি হাত বুলিয়ে নিঃশব্দে উঠে যায়। নির্মলা অনেকটা এ বাড়িতে মায়ের মত। হয়তো এভাবেই সে যত্ন করতো যমুনার।
নূপুর একটা এসএমএস করে দেয় তপুকে, তুমি বললে আমি তোমার জন্য ফ্লাইট টিকিট বুক করতে পারি। কখনও তো তোমাকে কিছু দিইনি, আজ এই গিফটা দিতে চাইছি।
এসএমএসএর উত্তর আসে। ইউ আর সো সুইট নূপুখালা। হোয়াই ডিডন্ট আই স্পেণ্ড মোর টাইমস উইথ ইউ! আই ফিল সাফোকেটেড। মাই মা ইজ নো মোর। ইটস লাইক আই অ্যাম নো মোর। ইফ আই গো দেয়ার, আই উইল ডু অনলি টু মীট আপ ইউথ ইউ।
কতবার যে পড়ে তপুর ওইটুকু লেখা।
যমুনার শরীরটা এখনও আছে, একবার এ শরীর দেখুক মেয়ে। যে মেয়েটার জন্ম হয়েছে যমুনা তাকে জন্ম দিয়েছিল বলে। যে মেয়েটা বেঁচে আছে যমুনা তাকে বাঁচিয়েছিল বলে। এই মেয়েটার বেঁচে থাকার জন্য একটা দানবকে হত্যা করতে হয়েছে, একটা দেশ হারাতে হয়েছে, সমাজ সংসার, আত্মীয় স্বজন, পরিবার পরিজন সবকিছু হারাতে হয়েছে যমুনাকে। এই মেয়ে দেখুক আরেকবার সেই প্রাণদাত্রীকে, প্রাণভরে দেখুক, শেষবার।
‘পিসহেভেনে অনেক টাকা যাচ্ছে। আর কতদিন রাখবে এভাবে?’ নির্মলা প্রশ্ন করে।
নূপুর বলে, ‘এত অশান্ত হওয়ার কী আছে। ব্রজকে বলে দিও। আর ক’টা দিন অপেক্ষা করতে’।
নির্মলা বলে, —’ক’টা দিন? এক দিনের টাকা কিন্তু কম নয়’।
—সে যাক। টাকার কথা চিন্তা করো না। টাকা আমি দেব।
—সে দাও তোমার টাকা কি টাকা নয়? কষ্ট করে রোজগার করোনি?
একটু থেমে নির্মলা অদ্ভুত চোখে চারদিকে তাকায়। মিহি সুরে বলতে থাকে, —’এভাবে হিমঘরে একটা মানুষ কী করে পড়ে থাকবে। যমুনাদি অত ঠাণ্ডা সহ্য করতে পারতো না। একটু ঠাণ্ডা পড়লেই লেপ কম্বল জড়ো করতো। একবার দিল্লি গিয়েছিল শীতের সময়। ঠাণ্ডায় নাকি জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। এসে তো গল্প করলো তীরের মতো নাকি ফুটছিল গায়ে। আর এই হিমঘরে কী করে পড়ে আছে কে জানে!’
নূপুর ভেবেছিল হিমঘর নিয়ে নির্মলা রসিকতা করছে। কিন্তু দেখে নির্মলার চোখে জল। নির্মলা সত্যিই এই ভেবে কষ্ট পাচ্ছে যে যমুনা ঠাণ্ডা ঘরে শুয়ে আছে। কাঁথা নেই, কম্বল নেই। লেপ নেই, তোশক নেই। বাড়ি থেকে নিয়ে যাবে এসব, সেও মানবে না ওরা। নির্মলা এবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। কাঁদা ব্যাপারটা হয়তো সংক্রামক। নূপুরের চোখেও জল।
পরাবাস্তব একটা দৃশ্য।
দৃশ্যটা অনেকক্ষণ স্থির হয়ে থাকে।
সব স্থিরতা ভেঙে নূপুর বলে, ‘তপু আসছে নির্মলা। ও শুধু একবার ওর মাকে দেখতে আসছে। এই তো শেষবার। আর তো দেখা হবে না। আর তো ওরা দুজন বন্ধুর মতো রাত জেগে গল্প করবে না। আর তো পাহাড়ে বেড়াতে যাবে না। এই তো শেষ’।
জয়-এর মৃত্যুর পর যমুনার মৃত্যু নূপুরের কাছে এক বীভৎসতা ছাড়া কিছু নয়। জয় ছিল প্রাণের ধন। যমুনা ছিল তার বোনের আদর, তার মায়ের কোল, দুঃসময় এলে সেই কোলে এসে মাথাটা রাখবে, যমুনাই সব দুঃসময় এক ফুঁয়ে বিদেয় করে জাদুবলে সুসময় নিয়ে আসবে। যমুনা কী ছিল না নূপুরের!
নূপুর ভাবতে থাকে সে বাঁচিয়েছে যমুনা আর তার মেয়েকে দেশ থেকে তড়িঘড়ি বের করে দিয়ে। পাশার লোকেরা হয়তো প্রাণে বাঁচতে দিত না দুজনের কাউকেই। অথবা খুনের দায়ে ফাঁসাতো যমুনাকে। ঘাঁটাঘাটি করবে না পাশার প্রেমিকা নিয়ে, এরকম ভেবেছিল, কিন্তু যদি মত পাল্টাতো! যমুনা নূপুরের উপদেশ শুনেছিল। কিন্তু নূপুর যদি যমুনার উপদেশ শুনতো, যদি টেনে হিঁচড়ে জয়কে রিহ্যাবে রেখে আসতো, বাঁচতো জয়, নতুন জীবন পেতো। অন্যরকম হতো নূপুরের জীবন। জয় মারা যাওয়ার পর যমুনার সঙ্গে নূপুরের কথা হয়েছে ফোনে, চিঠিতে, কিন্তু দেখা হয়নি। সেই যে নিজেকে জগতের সবকিছু থেকে সরিয়ে একা করে ফেলেছিল নূপুর, কাউকে তার দেয়ালে টোকা দিতে দেয়নি, যমুনাকে দিয়েছে, তবে খুব কমই দিয়েছে। মনে মনে ক্ষমা চায় সে যমুনার কাছে। যমুনা বেঁচে থাকতে নূপুর একবারও ক্ষমা চায়নি। যা নয় তা বলে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া সব সহ্য করেছে যমুনা তারপরও রাগ করেনি নূপুরের ওপর। যমুনার জায়গায় হলে, নূপুর অনুমান করে, জন্মের মতো সম্পর্ক সব সে ঘুচিয়ে দিত। কী দিয়ে গড়া ছিল যমুনা!
নির্মলা, কী দিয়ে গড়া ছিল তোমার যমুনাদি? মনে মনে বলে সে। নির্মলাকে আর জিজ্ঞেস করা হয় না।
তপু আসবে এই খবরটুকু নূপুরকে সুখ দিতে থাকে। জয় মারা যাওয়ার পর এই প্রথম তার মনে কোনও কিছুর জন্য সুখ হচ্ছে। তপু আসছে, নূপুরের মনে হচ্ছে যেন জয় আসছে। যেন জয় হারভার্ডে পড়তে গেছে, যেন নূপুর আজ মারা গেছে, খবর পেয়ে জয় আসছে নূপুরকে দেখতে, শেষকৃত্য করতে। যমুনা নয়, হিমঘরে শুয়ে আছে নূপুর, জয় মরেনি, জয় আসছে। আর নূপুর যমুনা। জয়কে তুলতে সে বিমানবন্দরে যাবে, কত কাল পর জয়কে দেখবে যমুনা! বুকে জড়িয়ে আদর করবে। খালার আদর আর মায়ের আদরে পার্থক্য আছে নাকি?
নূপুর নিজের মৌনতা আর মগ্নতা ভেঙে জিজ্ঞেস করে, মা আর মাসিতে তফাৎ কিছু আছে কি, নির্মলা?
—তফাৎ তো আছেই। মাসি মাসি। মা মা।
—সে তো জানি। কিন্তু আদরে?
নির্মলা দুজনের জন্য চা করে আনে। যমুনার ভীষণ চা খাওয়ার অভ্যেস ছিল। নির্মলার তাই ঘন ঘন চা বানানোর অভ্যেস হয়ে গেছে। দার্জিলিং থেকে কিলো কিলো চা আসতো। যমুনার এক বন্ধু পাঠাতো। নূপুর যে যমুনা নয়, নূপুরের যে যমুনার মতো সারাদিনে তিরিশ কাপ চা খাওয়ার অভ্যেস নেই, তা নির্মলা জানে না। একটা কাপ নূপুরের হাতে দিয়ে চেয়ারে বসে খাটে পা দু’টো তুলে দিয়ে নিজের চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নির্মলা বলে, ‘মায়ের মতো তো কেউ হয় না নূপুর। মা মা-ই। চেষ্টা করলে কেউ কাকা হতে পারে, মামা হতে পারে, ভাই হতে পারে, বোন হতে পারে, চেষ্টা করলে হয়তো বাবাও হতে পারে, কিন্তু হাজারো চেষ্টা করেও মা হওয়া যায় না’।
নূপুর চুপসে যায়। একবার ভাবে জিজ্ঞেস করবে, কবে এমন বিশেষজ্ঞ হলে মা নিয়ে? নিজে তো বিয়েও করেনি। বাচ্চা কাচ্চাও নেই তোমার! কোনও বাচ্চাকে বড়ও করোনি।
না, তপুর মা হওয়ার চেষ্টা নূপুর করছে না। তপুর সঙ্গে দেখাই বা হয়েছে ক’দিন নূপুরের! তপু কেমন দেখতে এখন, কী রকম ওর জীবন যাপন, কী খেতে পছন্দ করে, কী করতে, কী পড়তে, কী পরতে, তা নূপুরের চেয়েও বেশি জানে নির্মলা, যে নির্মলার সঙ্গে তপুর কোনও রক্তের সম্পর্ক নেই।
নির্মলা আবার একটা পরাবাস্তব দৃশ্য রচনা করে, মিহি স্বরে আবার বলতে থাকে, — ‘একটা মানুষ হিমঘরে শুয়ে আছে, শুয়ে থাকার একটা সীমা আছে। তপু একবার দেখে যাক, তারপর আর দেরি করোনা’।
নূপুর ম্লান হেসে বলে,— ‘নির্মলা, যতক্ষণ বুবু হিমঘরে আছে, একটা সান্ত্বনা আছে। মানুষটা আছে, যখন ইচ্ছে ওর নাক চোখ মুখ, ওর হাত পা, ওর আঙুলগুলো, সেই আঙুলগুলো দেখতে পাবো, ওখান থেকে চলে গেলেই তো সব শেষ। কিছু তো আর দিদির আস্ত থাকবে না’।
নির্মলা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, —তা থাকবে না। আসলে আমাদের মধ্যে এই এতদিন রাখার চলটা নেই। তোমাদের মধ্যে দেখেছি ব্যাপারটা চলে, অনেকদিন রেখে দাও।
এবার আগুনে খড়কুটোর ঝুড়ি উপুড় করে ঢেলে দিল কেউ। নূপুর হঠাৎ উঠে গিয়ে বাইরে রাখা তার কাপড় তার হাতব্যাগ তার চিরুনি তার ময়শ্চারাইজার জড়ো করে সুটকেসে ঢোকাতে থাকে আর বলতে থাকে,—তোমাকে এর আগেও শুনেছি আমাদের মধ্যে আর তোমাদের মধ্যে বলে কথা বলো তুমি। আমাদের তোমাদের মানেটা কী শুনি। তুমি যমুনাদির সঙ্গে এতবছর থেকেও আমাদের তোমাদের শব্দগুলো বাদ দাওনি! এখনও তোমার মধ্যে এই হিন্দু মুসলমানকে আলাদা করার অভ্যেস? যমুনাদি কী করে আপাদমস্তক নাস্তিক হয়ে তোমার মতো আস্তিক নিয়ে ঘর করতো কে জানে। যমুনাদির কিছু জিনিস আজও আমি বুঝিনা। তুমি খুব অ্যাডোরেবল, খুব ভালো মানুষ, খুব দয়ার সাগর, গুণবতী রূপবতী সবই তুমি। কিন্তু যমুনার সঙ্গে মিলতো কোথায় তোমার? সে বিজ্ঞানী, সোজা কথার লোক, হাবিজাবি ধর্ম আর ফালতু কুসংস্কারকে সহ্যই করতে পারতো না, আর দিব্যি কি না..’
নির্মলা স্তব্ধ হয়ে যায় নূপুরের এই চিৎকারে।
—’আমার নিজের দিদি। ওকে আমি তোমার চেয়ে বেশি ভালো চিনি। হাড়ে হাড়ে চিনি। তোমার মতো পুজো করা মানুষের সঙ্গে যমুনাকে মেলাতে পারি না। কী নিয়ে কথা বলতে তোমরা? টপিক কী শুনি? রান্নাবান্না নাকি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড’।
নূপুর থামতে চাইছে না।
—’আমার দিদি সারাজীবন অ্যাডভেঞ্চার করে এসেছে। একটা দেড় বছরের বাচ্চাকে কোলে নিয়ে এসে একটা ভিন দেশে একা একা ক’দিনেই কেমন দাঁড়িয়ে গেল। ভালো চাকরিও পেয়ে গেল। বাচ্চাকে ভালো ইস্কুলে পড়ানো, বাচ্চাকে শিক্ষিত করা, মানুষ করা, কী না করেছে? দিদির জায়গায় আমি হলে রাস্তায় হোমলেস হয়ে পড়ে থেকে আমার বাকি জীবন কাটাতে হত। ভিক্ষে করতে হত। বাচ্চাটাকেও বাঁচাতে পারতাম না। দিদির মতো ক’জন পারবে? চ্যালেঞ্জ করেছে এ দেশে টিকে থাকবে, এ দেশে টিকে ছিল। ভালো ভাবেই টিকে ছিল। কলকাতায় ক’টা উইমেনস অরগানাইজেশন ছিল, বলোতো! সম্ভবত অত বড় একটা সংগঠন দিদিই প্রথম করেছে। পাঁচ হাজার সদস্য, চাট্টিখানি কথা? একটা আপাদমস্তক সাকসেসফুল পারসন। তুমি কেন যমুনাদির সঙ্গে, তুমি কে? লেখাপড়া কতটা করেছো? কলেজ পাশ করেছো, বোঝো যমুনার কিছু, নির্মলা? তোমার কাজটা কী, বলো? সত্যি কথাটা বলো, বলো, লেসবিয়ান ছিল যমুনাদি, বলো। মরেই তো গেছে, এখন লুকোনার কী আছে? বেঁচে থাকতেই তো ও কিছুই লুকোয়নি’।
বলতে বলতে চোখের জল মুছতে থাকে নূপুর। নির্মলা নিঃশব্দে উঠে যায়, বারান্দায় উদাস দাঁড়িয়ে থাকে।
নূপুর শুয়ে থাকে। যমুনার বিছানার পাশের টেবিলে অনেকগুলো বই আর ম্যাগাজিন উঁচু করে রাখা। শেষের দিনগুলোতে এগুলোই হয়তো পড়ছিল, নূপুর ওগুলোই নাড়ে চাড়ে, পড়ে, বাঁধানো ছবিগুলো দেখে।
নির্মলা কোথাও বেরোয়। নূপুরকে বলে বোরোয় না। দরজা খোলা আর বন্ধ হওয়ার শব্দ শুনে টের পায় নূপুর। নির্মলা আবার একেবারে চলে যাচ্ছে না তো! খুব অপমান বোধ করেছে। নির্মলার জায়গায় নূপুর হলেও হয়তো একই জিনিস করতো, বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেত। নূপুর ঠিক বুঝতে পারে না সে এমন ব্যবহার নির্মলার সঙ্গে করলো কেন। ঈর্ষা নাকি অন্য কিছু? নির্মলার ওই আমার-তোমার বলে কথা আর সহ্য করতে পারছিল না নূপুর। রাগটা বেরিয়ে এলো, থাকিস দিদির বাড়িতে, খাস দিদির পয়সায়, যে মানুষটা তোকে ভালোবেসে তোর ধর্ম কর্ম নিয়ে আপত্তি করেনি, আর তুই কি না আমাদের মধ্যে-তোমাদের মধ্যে বলে তার সঙ্গে কথা বলেছিস। নিশ্চয়ই দিদির সঙ্গে ওভাবেই কথা বলেছিস। বলেছিস বলেই আজ আমার সঙ্গে মুখ ফসকে তোর ওসব বেরোয়। তুই এখনও ভাবিস যমুনার চেয়ে তুই আলাদা। আমি আর তুই আলাদা। তোর মানুষ পরিচয়টার চেয়ে তোর হিন্দু পরিচয়টাই যদি বড় হয়, তবে যা না হিন্দুদের মধ্যে গিয়ে থাক। যমুনাকে মুসলমান বলে ট্রিট করেছিস, আর এতকাল যমুনা তোর ইডিয়টিক ব্যবহার সহ্য করে গেছে। কোনোদিন দেখেছিস যমুনাকে নামাজ পড়তে, রোজা করতে, বোরখা পরতে? তোর পুজোটা তো ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছিস। কেউ কেউ ধর্মকে আঁকড়ে ধরে থাকে। আবার কেউ কেউ ধর্ম থেকে মুক্ত করে নেয় নিজেকে। অনুগ্রহ করে তাদের গায়ে আর হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, ইহুদি ইত্যাদির লেবেল লাগাস না। নূপুরের ভেতরের এক রাগী নূপুর নির্মলাকে ওভাবেই নিঃশব্দে গালাগালি করে।
যমুনা নেই অথচ যমুনার সংসার একটুও হেলে পড়েনি। নির্মলা নিপূণ হাতে সব সামলাচ্ছে। প্রচুর বাজার করে ঘরে ফেরে নির্মলা। তপু আসবে বলেই হয়তো মাছ মাংস প্রচুর কিনেছে। নূপুর দূর থেকে দেখে তার দিদি আর তার দিদির বান্ধবীর সংসার। কার বেশি অধিকার এ বাড়িতে? নূপুরের না নির্মলার!
বিমান বন্দরে তপুকে নূপুর চেনার আগেই চিনেছে নির্মলা। নূপুর পেছনে দাড়িয়ে ছিল। তপু নির্মলাকে প্রথম জড়িয়ে ধরে দু’ গালে চুমু খেল, নূপুরকেও তাই করলো। নূপুরকে যখন তপু জড়িয়ে ধরেছে বলতে বলতে ‘ও নূপুখালা, কতদিন পর দেখা হল তোমার সঙ্গে’। নূপুরের চোখ বেয়ে অঝোরে ঝরছে জল। তপুর পরণে সাদা একটা সার্ট, আর নীল জিনস। যমুনার মতোই ছোট চুল। দেখতে নাকি পাশার মতো তপু। আজ নূপুরের মনে হয়, দেখতে তপু অবিকল যমুনার মতো। সেই চোখ, সেই ঠোঁট। তপুর এখন যে বয়স, সে বয়স যখন যমুনার, নূপুর তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছে। এখনকার তপুর বয়সী তখনকার যমুনাকে। কত কিছু কাণ্ড করে ফেলতো তখন যমুনা। কী ভীষণ সাহসী আর তীক্ষ্মবুদ্ধির মেয়ে ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করলো। সবাই তার লেখাপড়ায় ভালো করা, ভালো চাকরি পাওয়া নিয়ে বলতো, ‘যমুনা তো মেয়ে নয়, যেন ছেলে’! যমুনা এমন মন্তব্য শুনতে মোটেই পছন্দ করতো না। সে মেয়ে এবং সে সাকসেসফুল। সাকসেসের সঙ্গে পুংলিঙ্গের যোগ কেন করা হবে, একেবারেই বাজে মেন্টালিটি, যমুনা বলত। সংসারে যমুনাই একমাত্র, যাকে নিয়ে গর্ব করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহস দেখাচ্ছে, মুগ্ধ হয়ে তাকে দেখছে সবাই, কিন্তু ব্যক্তিজীবনে যেই না যমুনা সাহসের পরিচয় দিল, অমনি ওই সাহসটাকে আর কারও পছন্দ হল না। যমুনা একা হয়ে গেল। একাই সামলালো সব নিন্দা, সব অপমান। এক নূপুরই ছায়ার মতো ছিল পাশে। যমুনার অসম্ভব ভালোবাসা পেয়েছে নূপুর, কিন্তু বিনিময়ে কিছুই হয়তো দিতে পারেনি। কিছুই কি দেয়নি? দিয়েছে। ভালোবাসা দিয়েছে নূপুর, কিন্তু কোথাও কৃপণতা ছিল। নূপুর বোঝে, যে, ছিল।
নূপুরের একটা হাত তপু ধরেই রাখে। নূপুরের মনে হয় হাতটা তপু যমুনাকে ধরেছে। ঠিক এভাবেই হয়তো ধরে রাখতো নিজের মায়ের হাত যখন দেখা হত।
—’তোমার মনে আছে ঢাকার কথা, কলাবাগানের বাড়িতে তোমার মা অফিসে চলে যেত, তুমি আমার কাছে থাকতে, কত গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে তোমাকে ঘুম পাড়াতাম, খাওয়াতাম’! নূপুর মিষ্টি হেসে বলার পর তপু হেসে বলেছে, —’মা সব বলেছে। আর তুমিও তো আগে বলেছো। আমার তো সেই দিনগুলোর কথা মনে নেই। কত ছোট ছিলাম, তাই না’!
—’হ্যাঁ খুব ছোট ছিলে। তোমাকে দেখার তো কেউ ছিল না, তাই আমিই ছিলাম। তোমার মাকে খুব ভালোবাসতাম তো। চাইল্ড কেয়ার তোমাকে দিয়ে শুরু। আমি তো অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। সে কারণে জয়-এর সময় কোনও অসুবিধে হয়নি। জয়কে মনে আছে তোমার?’
তপু জোরে হেসে ওঠে। বলে—’মনে থাকবে না কেন? আমরা একসঙ্গে সাইকেল চালিয়েছিলাম নিউইয়র্কের রাস্তায়। ও খুব ফাস্ট চালাতে পারতো। জয় এখন কী পড়ছে? ও ট্রাই করলে হারভার্ডে পড়তে পারে কিন্তু। আমি হেল্প করতে পারি, যদি ও চায়। ওর ফেইসবুকে আমি ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলাম, অ্যাকসেপ্ট করেনি’।
নূপুর চুপ করে থাকে। অনেকক্ষণ কথা বলে না। জয় মারা গেছে এই খবরটা যমুনা কেন দেয়নি তপুকে? কী কারণ ছিল এর পেছনে, সে যমুনাই জানে। যা জানায়নি যমুনা, তা আর যেচে জানাতে যায় না নূপুর। তার চেয়ে না জানাই থাকুক। একটা মৃত্যুর শোকই করুক। দু’দুটোর প্রয়োজন নেই।
বাড়ি এসে নূপুর অস্থির হয়ে পড়ে তপুকে কী খাওয়াবে, কোথায় বসাবে, কোথায় শোওয়াবে। পারলে নূপুর সেই ছোটবেলার মতো গা মেজে স্নান করিয়ে দেয়। নূপুর এক মুহূর্ত কাছ ছাড়তে চায় না তপুর। বাড়িতে তপুর এঘর ওঘর হাঁটা, বাগানে ফুলগাছগুলোয় জল দেওয়া, গান গাইতে গাইতে স্নানঘরে ঢোকা—দেখে নূপুরের খেয়াল হয় এ বাড়ি যমুনার শুধু নয়, এ বাড়ি তপুরও। তপুর নিজের ঘরটিতেই প্রচুর কাপড় চোপড়। সুটকেসে পরার কাপড় কিছু আনেনি, এনেছে পড়ার কিছু বই, নির্মলা আর নূপুরের জন্য কিছু উপহার, কিছু ছোটখাটো এটা সেটা। রান্নাবান্নার কাজ করছিল নির্মলাই। এবার নূপুর ঢোকে। তপুর জন্য সে স্পেশাল খাবার তৈরি করবে। নির্মলা বলে তপু বাঙালি খাবারই পছন্দ করে। তপু রান্নাঘরে ঢুকে বলে, ‘আজ কোনও রান্না করতে হবে না, চল রেস্টুরেন্টে খাবো। আসলে এ বাড়িতে মা নেই, এটা কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে। বাড়ি থেকে বাইরে বেরোতে হবে একটু দম নেওয়ার জন্য’।
কলকাতা শহর ভালো চেনে তপু। তপুই নিয়ে গেল নির্মলা আর নূপুরকে রেস্টুরেন্টে। গড়িয়াহাটের ভজহরি মান্নায়।
তপু যতক্ষণ আছে, নূপুরের সঙ্গেই সময়টা কাটাতে চাইছে। সঙ্গে ল্যাপটপ আছে, তবে ও নিয়ে একেবারে বসছেই না, খুব প্রয়োজন না হলে যন্ত্রটা সে খুলবেই না। সে এসেইছে নূপুরের জন্য। রাতে তপু নূপুরের সঙ্গে শুলো। খাটের যে পাশটায় তপু শুতো, সে পাশটায়। আর যে পাশটায় যমুনা শুতো, সে পাশটায় আজ নূপুর। দু’জনে গল্প করলো প্রায় সারারাত। ভোর হয় হয়, তখন ঘুমোলো। নূপুর একটা হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করে রাখলো তপুকে। যেন এই তপুই আজ যমুনা, আর একই সঙ্গে এই তপুই জয়।
পরদিন নূপুর আর নির্মলা তৈরি হয়ে তপুকে ডাকছে, চল যমুনাকে দেখবে। তপু সোজা জানিয়ে দিল, সে দেখবে না। ওই ইচ্ছে তার একেবারেই নেই। তপু উপুড় হয়ে শুয়ে রইলো, কারওরই আদুরে গলার উপদেশে বা কড়া আদেশে কোনও নড়চড় হল না। একেই বলে জেদ, যমুনারও এরকম ছিল, যেটা করবে, সেটা করবেই। নূপুর বলে, এত দূর থেকে এতগুলো টাকা খরচ করে এলে নিজের মা’কে শেষবার দেখবে, আর তুমি কি না আসার পর বলছো দেখবে না, কী লাভ হল তাহলে এসে?
—আমি একবারও বলিনি আমি মাকে দেখবো। আমি বলেছি যদি যাই তোমার জন্যই যাবো।
—সে বলেছো। কিন্তু এখন যেহেতু এসে গেছো, এখন মা’র মুখখানা একবার দেখ।
তপু মাথা নেড়ে বলে, ‘না, আমি সেই মাকে দেখতে চাই না যে মা আমাকে আদর করবে না, আমাকে চুমু খাবে না, আমার সঙ্গে কথা বলবে না, আমার দিকে তাকাবে না। এ মা নয়। এ শুধু মা’র শরীর। আমি দেখবো না’।
—’তাহলে আসার কী দরকার ছিল এত দূর। আটলান্টিক পার হয়ে?’
নূপুরের রাগ হয়। নূপুর চেঁচায়।
—’তোমাকে দেখতে এলাম। এ ছাড়া আর কি কোনও সুযোগ হত নিজের মাসিকে দেখার?’
তপুকে কিছুতেই ওঠাতে পারলো না দুজন। নির্মলা বললো যেন তপু নূপুরের জন্যই যমুনাকে দেখতে যায়, নূপুর এত আশা করে ছিল। না নূপুরের জন্যও সে এ কাজ করবে না।
নির্মলা আর নূপুরই গেল হিমঘরে, তপু ঘরে রইলো। আজই ব্রজকে তাহলে বলে দিতে হবে বডি নিয়ে যেতে। আর সময় নষ্ট করা যায় না। ব্রজকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। পথে যেতে যেতে জরুরি এসএমএস করা হল কয়েকবার। ‘খুব জরুরি, ফোন করো। আজ বিকেলে লাশ নিয়ে যেতে পারো। কী করবে জানিও’। তিনটে এসএমএসের উত্তর আসেনি তিন ঘণ্টায়। নির্মলা উদ্বিগ্ন। যমুনার শীতল শরীর আরো একবার দেখা হল নূপুরের। যমুনার বরফ-ঠাণ্ডা গায়ে নির্মলা সিঁদুর লাগিয়ে এলো একগাদা। সেই যে শুরু হয়েছে নির্মলার সাদা শাড়ি পরা, এখনও তাই পরছে। নির্মলাকে ওরকম অপমানজনক কথা বলার পর নূপুর নয়, নির্মলাই এগিয়ে এসে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। নির্মলাই নূপুরকে গান শুনিয়েছে, খাবার তৈরি করে এনেছে, চা দিয়েছে।
তপু কথায় কথায় বলে নির্মলার সঙ্গে একমাত্র যমুনাকে সে দেখেছে সুখী। আর কোথাও কারও সঙ্গে, বিশেষ করে কোনও পুরুষের সঙ্গে যমুনা খুব সুখী ছিল না। অবশ্য ক’জনের সঙ্গেই বা সে দেখেছে যমুনাকে। নিজের বাবার কথা মনে আছে? তপু ঠোঁট উল্টে বলে, না। পাশা দেখতে কেমন ছিল, সেও তপু জানে না। তাকে কেউ পাশার কোনো ছবিও দেখায়নি। দেখার নাকি তার কোনও ইচ্ছে নেই। নূপুরের খুব জানতে ইচ্ছে করে, যমুনা যখন নিজের জীবনের সব কথাই সব ঘটনাই জানিয়েছে তপুকে, তখন পাশাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলার ঘটনাও কি জানিয়েছে! নূপুর কী করে জিজ্ঞেস করবে ঠিক বুঝতে পারে না। অনেকক্ষণ সে সাজায় প্রশ্নটা, ‘তোমার বাবার কথা কিছু জানো? উনি তো মারা গেছেন অনেক আগে। তুমি তখন ছোট। কী করে মারা গেছেন, জানো?’ ‘বুবু কি তোমাকে তোমার বাবার কথা কিছু বলেছেন? কী করে ওর মৃত্যু হল, বলেছে?’ ‘তোমার বাবা মানে পাশা ভাইকে তো বিষ খাইয়ে মারা হয়েছিল, জানো কেন মারা হয়েছিল, কে মেরেছিল?’ ‘তপু, তুমি বড় হয়েছো, অনেক বোঝো, তোমাকে বাঁচাতে গিয়ে তোমার মা জীবনের কত বড় ঝুঁকি নিয়েছিল, কিছু জানো?’ ‘তুমি যে বেঁচে আছো আজ, সে তোমার মা একটা বড় রকম ক্রাইম করেছিল বলে। কেউ কেউ এটাকে ক্রাইম বলবে, কেউ কেউ বলবে না। এ অনেকটা আইন নিজের হাতে নেওয়া। বিপ্লবীরা তো নেন, আমরা তাঁদের সম্মান করি। তুমি যেন তোমার মা’কে কখনো ভুল বুঝো না’। ‘বুবু যদি ওই ঘটনাটা না ঘটাতো, তোমাকে আমরা পেতাম না। বুবু তোমার বাবাকে বিষ খাইয়েছিল। কারণ তোমার বাবা তোমাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। ঘরের কাজের লোককে টাকা দিয়ে কাজটা করাতে চেয়েছিল। হয়নি। তাই নিজেই মারার প্ল্যান করেছিল। তোমাকে হিট করেছিল। পাশাকে না সরালে সে তোমাকে মেরে ফেলতোই। আজ তোমাকে আমি বললাম এই ঘটনার কথা, পরে যেন কখনো জানতে পেরে বুবুকে খুনী বলে ভেবোনা’।
নূপুর যখন খাবার টেবিলে বসে বসে চা খেতে খেতে আপন মনে ভেবে চলেছে কী করে প্রশ্নটা সাজাবে, তপু পেছন থেকে দু হাতে জড়িয়ে মাথায় আর ঘাড়ে নাক ঘসতে ঘসতে বলে, ‘তোমার শরীরের ঘ্রাণটা একবারে মায়ের শরীরের ঘ্রাণের মতো। তোমাদের মা’য়ের উইটেরাস থেকেই তোমরা এই স্মেল নিয়ে জন্মেছো’। তপু হাসতে থাকে।
তপু কোনওদিন তার নানা নানিকে দেখেনি। বেঁচে ছিল তাঁরা, একই শহরে ছিল, কিন্তু দেখা হয়নি। নূপুর এক হাতে তপুকে টেনে পাশে বসায়। ‘নানি কেমন ছিল, তোমার নানা কেমন ছিল, ছবি দেখেছো? বুবু দেখিয়েছে ছবি আমাদের বাবা মা’র?’
তপু হেসে মাথা নাড়ে, না।
—কী রকম মনে হয়, দেখতে কেমন ছিল। মানুষ কেমন ছিল?
তপু বলে, আমি কল্পনা করে নিই। আমার কল্পনায় ওঁরা খুব চমৎকার মানুষ। আমার সঙ্গে দেখা হলে ওঁরা হয়তো খুব ভালোবাসতেন আমাকে। মা’র ওপর ওঁদের রাগ ছিল, মা বলেছে। কিন্তু আমার সঙ্গে দেখা হলে কী আর রাগ পুষে রাখতে পারতেন, সব জল হয়ে যেত। আমার এরকমই বিশ্বাস। আমার মা’র মতো মানুষকে যাঁরা জন্ম দিয়েছেন, তাঁরা কি খুব ইর্যাশনাল হতে পারেন নাকি? আমার কিন্তু মনে হয় না? বলো কেমন ছিলেন ওঁরা? খুব রাগী?
নূপুর মাথা নাড়ে, না।
ইগো প্রবলেম? তপু জিজ্ঞেস করে।
নূপুর বলে, হ্যাঁ তাই।
—জয় দেখেছে নানা নানিকে? জয়টা খুব লাকি।
—দেখেছে। জয়কে খুব ভালোবাসতো দুজনই। ভীষণ ভালোবাসতো। যতবারই এসেছে দেশে, বাবা মা ঢাকা এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে আসতো। তোমার আদর যা পাওনা ছিল, তা জয়ই পেয়েছে। জয়কে ওরা অতিরিক্ত দিয়েছে, তোমাকে দিতে পারেনি বলেই হয়তো বেশি করে দিয়েছে। তোমার একটা ছোটবেলার ছবি দিয়েছিলাম ওঁদের। বলিনি তোমার, কিন্তু বুঝেছিল যে তোমার। আমার বাবা তোমার সেই ছবি বাঁধিয়ে রেখেছিল নিজের বেডরুমে। কেউ যদি জিজ্ঞেস করতো, কার ছবি। বাবা বলতো, যমুনার ছোটবেলার ছবি’।
তপুর চোখ চিকচিক করে বিন্দু বিন্দু জলে। —চল বারান্দায় গিয়ে বসি, নির্মলা মাসি গান গাইবে। কতদিন গান শুনিনা।
নির্মলা গান গায়, তপুকে প্রায় কোলে বসিয়ে। নূপুর খানিকটা দূর থেকে তপু আর নির্মলার আন্তরিক সম্পর্কটা দেখে। যমুনা আর নির্মলার সম্পর্কের কথা তপু কতটুকু জানে, কী জানে, তপু জানে না।
একটা টিশার্ট আর শর্টস পরে আছে তপু। যেন একটা বাচ্চা ছেলে। আদুরে আদুরে গলা। যমুনার জন্য চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে না, কিন্তু যেন যমুনার জন্য যারা কাঁদছে, সেই মানুষগুলোর চোখের জল মুছিয়ে দিতে ও এসেছে। যেন যমুনাই এসেছে অল্প বয়সী মেয়ের রূপে, যেন যমুনাই। জীবনের দিকে তাকাতে বলছে, সামনের দিকে। আমরা সবাই যাবো। তুমিও, আমিও। ধরো যমুনা আছে, ওর যা ভালো লাগবে, চল সবাই মিলে তাই করি। তপু বলছে না, কিন্তু তপুর ব্যবহারে তা যেন স্পষ্ট হচ্ছে। মনে মনে নূপুর বলে, যার যার জীবন শুরুই তো হবে আজ নয়তো কাল। অন্তত ক’টা দিন তাকে স্মরণ করি, তার জন্য কাঁদি। আপনজনের মৃত্যুতে এটুকুও যদি না কাঁদি এখন, তবে কাঁদবো কখন! শুধু কি ভবিষ্যৎ, শুধু কি সামনে চলা, শুধু কি নিজের সুখ, শুধু কি নিজের ভালো থাকা! একটু না হয় ক’দিন খারাপ থাকিই! কী এমন হয় ক’দিন ভালো না খেলে, ক’দিন কাঁদলে, এ তো নিশ্চয়ই মরে যাওয়ার মতো ভয়ংকর কিছু নয়। তপুর সঙ্গে এসব কথা তার মনে মনেই হয়। শেষ অবদি নূপুর লক্ষ্য করেছে, তপুকে পাশার মৃত্যু নিয়েই প্রশ্ন করতে কোথাও যেন আটকাচ্ছে নূপুরের। কিছু জিনিস হয়তো না জানাই থাকা ভালো। দু’দিনের জীবন, কী দরকার অত কিছু জেনে। সব ফেলে তো সেই চলেই যেতে হয়।
নূপুর নিজের হাতে তপুকে যত্ন করে, ওর গায়ে নিজে লোশন মাখিয়ে দেয়, একটুও নাকি তপু নিজের শরীরের যত্ন করে না। ঠিক এভাবে নূপুর তার ছেলে জয়কেও করতো। তপু যা যা খেতে পছন্দ করে, নির্মলার কাছে জেনে নূপুর নিজে হাতে সেসব তৈরি করে। নূপুর যে তপুকে ভালোবাসে, সেটা আর অন্যভাবে সে বোঝাতে পারে না, পছন্দের খাবার তৈরি করেই সে ভালোবাসে তপুকে, বোঝায়। তপুকে সে এতকাল দূরে সরিয়ে রাখলেও আর দূরে সরিয়ে রাখতে চায় না। আজ তার কেউ নেই, মা নেই বাবা নেই, স্বামী নেই, ছেলে নেই, দিদি নেই, দাদা থেকেও নেই। আছে শুধু দিদির মেয়েটি।
তপুও হয়তো তাই বোঝায় অত দূর থেকে সুদূর অতলান্তিক পাড়ি দিয়ে নূপুরের জন্য এসে। বাড়িতে ঝামেলা না করে রেস্তোরাঁয় খাওয়ার প্রস্তাব করছে প্রতিবেলা তপু। কিন্তু নূপুর আপত্তি করেছে, কী না, তপুকে ঘরের খাবার খেতে হবে।
—বিদেশ বিভূঁইয়ে তো এই জিনিসটাই মিস করবে, মা!
নূপুর বলে। মা বলে ঠিক এরকম ভাবে বলতো যমুনা। তপু চমকে ওঠে। তাহলে মা বলে অন্য কেউও ডাকতে পারে, নিজের মা ছাড়া। যমুনা তপুকে বলেছিল, মা আর খালাতে খুব একটা পার্থক্য নেই।
—’তোকে তোর খালার কাছে রেখে নিশ্চিন্তে অফিস করতে পারতাম, জানতাম আমি যেভাবে তোকে দেখবো, তোর খালাও সেভাবে দেখবে। খালারা তো অনেকটা মায়ের মতোই’।
যমুনার কাছে তপু নূপুরের গল্প শুনেছে অনেক। যমুনা তো তাই করতো, অনেকের জীবনের গল্প শোনাতো, নিজের জীবনের সব কথা তো বলতোই। নিজে যেমনভাবে জীবন দেখেছে, যে অভিজ্ঞতা হয়েছে নিজের, সব বলতো। তপু তার মেয়ে কিন্তু তপুর সঙ্গে বন্ধুর মতো কথা বলতো, একটা বয়সের পর তপুকে আর বাচ্চা বা বালিকা মনে করতো না। তপুও তাই, তার জগত ছিল যমুনা। যমুনা তার মা, তার শিক্ষিকা, তার প্রেরণা, তার আদর্শ।
যমুনার কলকাতার বাড়িতে শুধু নাওয়া, খাওয়া, আড্ডা আলোচনা, গান গল্পই হয়না, জরুরি কিছু কাজের কথাও হয়। যমুনার ব্যাংকের টাকা পয়সা, বাড়ি গাড়ি, বাড়ির ভেতর অগুনতি জিনিসপত্র, এসবের কী হবে? নূপুরের উপদেশ, তপু যেন যমুনার কলকাতার ব্যাংকের টাকাগুলো তার বিদেশের ব্যাংকে ট্রান্সফার করে, বাড়িটা বিক্রি করার জন্য যা যা করতে হয় করে, গাড়ি বিক্রির বিজ্ঞাপন দিলেই চলবে। খুব দ্রুতই কাজগুলো করা যায়। তপুকে ডেকে আনার পেছনে নূপুরের এই উদ্দেশ্যটাও ছিল।
তপুর বক্তব্য, লাখ পঁচিশ টাকা আছে ব্যাংকে, এ টাকা তার দরকার না হলে সে নেবে না। গাড়িটা বিক্রি করা হয়তো উচিত। কারণ গাড়ি সামলানোর জন্য যমুনা নেই। নির্মলাকে জিজ্ঞেস করতে হবে গাড়ির তার দরকার আছে কী না। যদি নির্মলা মনে করে গাড়িটা তার দরকার, তবে নির্মলার জন্য গাড়িটা থাকবে। বাড়িটাও থাকবে। নির্মলা এ বাড়ি কেনার শুরু থেকেই আছে যমুনার সঙ্গে। তারও তো তিনকূলে প্রায় কেউই নেই। বাকিটা জীবন এ বাড়িতেই থাকুক। সিস্টারহুডটা চালানোর দায়িত্ব নির্মলার। টাকা তো ওই সংগঠন থেকে আসে, নির্মলার খরচ ওই টাকায় নিশ্চয়ই হয়ে যাবে। আর ব্যাংকের টাকা রইল, প্রয়োজনে নির্মলাও নিতে পারে। আর এ বাড়িতে তপু ছুটি ছাটায় আসবে। মায়ের স্মৃতির কাছে আসবে। নিজেরও তো স্মৃতি কম নেই এ বাড়িতে! এ বাড়ি বিক্রি করার প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু ক’দিনই বা তপু আসবে এ বাড়িতে বেড়াতে। তপু বললো, হয়তো দুতিন বছরে একবার আসার সুযোগ হবে, অথবা হবে না। কিন্তু জানবো তো কোথাও কোনও আশ্রয় আছে আমার। আমার মা’র বাড়ি। যেখানে মা না থাকলেও মা’কে ভালোবাসতো এমন একজন আছে। এই ভাবনাটি বড় শান্তি দেবে।
নূপুর কখনো ভাবেনি তপু কলকাতার বাড়ি বিক্রি করতে বাধা দেবে। এ বাড়ি বিক্রি করলে কয়েক কোটি টাকা হবে। এ ছেড়ে দেওয়ার মানে হয় না। টাকা তোমার প্রয়োজন হবে তপু। তুমি বিদেশে লেখাপড়া করছো। কখন কী বিপদে পড়, বলা যায় না। টাকা পয়সা তুমি কী করে পাবে, মা। নিজের কথা তো ভাবতে হবে? তোমার তো অনেক খরচ ওখানে। নির্মলার একার জন্য এত বড় বাড়ির তো দরকার নেই। নূপুর বড় কাতর স্বরে বলে তপুকে। তপু বলে এ নিয়ে ভাবনার কিছু নেই। সে স্কলারশিপ পাচ্ছে। আর বই লেখার জন্য অ্যাডভান্সড রয়্যালটিও পেয়েছে। শিক্ষকতা শুরু করলে অঢেল টাকাও হাতে আসবে।
নূপুর বড় গম্ভীর কণ্ঠে বলে, —’আর কোথাও কোনো বাড়ি বা আশ্রয়ের কথা যদি ভাবো তাহলে ব্রহ্মপুত্রর পাড়ে ময়সনিসংহে যে তোমার নানার বাড়ি, সে তো আছে। সেই বাড়িটা এখন আমার। আমি কিনে নিয়েছি। ওটাকেই নিজের বাড়ি ভেবো’।
তপু হেসে বলে, —’ওটাকে কি নিজের বাড়ি বলে মনে হবে কখনো? আমি তো যাইনি কোনোদিন ও বাড়িতে। মায়ের ও বাড়িতে স্মৃতি আছে। কিন্তু আমার তো নেই’।
তপু নূপুরকে উত্তেজিত হতে বা উদ্বিগ্ন হতে বারণ করে। বুঝিয়ে বলে বাড়ির দলিল পত্র সব তার কাছেই রইলো। নির্মলা থাকুক। নির্মলা যখন আর থাকবে না, তখন না হয় বিক্রি করার কথা ভাবা যাবে। তবে নির্মলা যতদিন এ বাড়িতে আছে ততদিন নয়।
নূপুর হাঁ হয়ে শোনে তপু যা বলে, সব।
— নূপুখালা, নির্মলা মাসির সঙ্গে, তুমি জানো না হয়তো মা’র একটা লাভ রিলেশন ছিল। দে ওয়ের লেসবিয়ানস। ভেরি লাভিং এণ্ড কেয়ারিং। দে ওয়ার টুগেদার অলমস্টো ফর ফিফটিন ইয়ারস। মা নেই বলে তার পার্টনারকে আমরা ঘর থেকে বের করে দেব? আই কান্ট ডু দ্যাট। ব্যাংকের টাকা থেকে নির্মলা মাসির সংসার খরচা যা দরকার তা নেবে।
অনেকক্ষণ নূপুর কোনো কথা বলতে পারে না। তার মনে হতে থাকে, যা ঘটছে তার চোখের সামনে তা আসলে ঘটছে না, যা শুনছে সে নিজের কানে সে আসলে শুনছে না। নূপুর এক কাপ চা হাতে বাইরের সিঁড়িতে কিছুক্ষণ বসে থাকে। উঠোনে আম গাছ, আতা গাছ, কাঁঠালিচাপার গাছগুলো দেখে, শিউলি ফুলের গাছ, গন্ধরাজ, জবা ফুলের গাছ —একবার দেখেই গাছগুলো নূপুর চিনতে পারে, এই গাছগুলো তাদের ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের বাড়িতে ছিল। যমুনা কি গাছগুলো লাগিয়েছিল অতীতের কথা ভেবে! এমনকী টবে যে ফুলগাছ আছে, একটিও নেই এমন, যেটি নেই বা ছিল না তার বাপের বাড়িতে। নির্মলা বলেছে গাছ টাছ সব যমুনা শখ করে লাগিয়েছে।
নূপুরের মাথার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে আছে। নির্মলা যেন পাথরের মতো দাড়িয়ে আছে তপু আর নূপুরের মাঝখানে। তপুর এত ভালোবাসা নির্মলার জন্য! নির্মলা যমুনার সঙ্গী ছিল বলে। আর নূপুর যে বোন ছিল, আদরের ছোট বোন! নূপুর চায় তপুর যেন জীবনে কোনো অসুবিধে না হয়। টাকা পয়সার অভাব হতেই পারে। স্কলারশিপ পেয়েছে হারভার্ডে, পিএইচডি করছে বা রিসার্চ করছে হারভার্ডে মানে এই নয় যে সে এক্ষুণি লাখ ডলারের চাকরি পেয়ে গেছে।
নূপুরের রাগটা গিয়ে পড়ে নির্মলার ওপর, ও তো খুব দূরে ছিল না। রান্নাঘরে ছিল। সবার জন্য চা বানাচ্ছিল। কেন এগিয়ে এসে বললো না, —’তপু তুমি টাকা নাও, বাড়িটা বিক্রি করো, আমার জীবন তো প্রায় শেষ হচ্ছে, তোমার জীবনের সবে শুরু’।
নির্মলা নিঃশব্দে হাতে হাতে চায়ের কাপ দিয়েছে, মুড়ি ভাজা দিয়েছে। নূপুরের জন্য বেশি হয়ে যাচ্ছে এই চাপ। প্রেমিকা ছিল যমুনার,যমুনাই পুষেছে তাকে, এখন যমুনা না থাকা অবস্থাতেও তাকে পুষে যেতে হবে কেন! যমুনা তো কোথাও লিখে যায়নি, বলে যায়নি যে নির্মলাকে আমার টাকা দিয়ে পুষো।
যমুনার কলকাতার এই বাড়িটাতে এই প্রথম নুপুর এসেছে। যমুনার কাছে শুনেছিল বাড়িটা কেমন। যমুনা বলেছিল ঠিক ময়মনসিংহের বাড়ির মতো একটা বাড়ি চাই ওর। ছাদে দাঁড়ালে বিশাল আকাশটা পাবে, বাড়িটার আঙিনায় দাঁড়ালে দেখতে পাবে নদী, চারদিক ছেয়ে থাকবে গাছে , ভেতরটায় শীতল শান্তি। উঁচু সিলিং। বড় বড় জানালা দরজা। এ বাড়িটার আঙিনায় দাঁড়ালে কোনো নদী চোখে পড়ে না, উঁচু সিলিংও নেই। শুধু গাছগাছালিতে সাদৃশ্য আছে, আর আছে ছাদে দাঁড়ালে বিশাল একটা আকাশ পাওয়া। যে বাড়িতে ওর শৈশব কৈশোর কেটেছে, সে বাড়ি যমুনাকে যে এত আচ্ছ্বন্ন করে রাখতো সংসারের কেউ কি জানতো! ওই বাড়িতে যমুনা’র পা রাখা নিষিদ্ধ ছিল বলেই কি যমুনার আকর্ষণ বেড়েছিল বাড়িটার ওপর? যখন নূপুর যেত বাড়িটায় বা ঘুরে আসতো বাড়িটা থেকে, যমুনা জিজ্ঞেস করতো, জানালাগুলো এখনো খোলা থাকে তো, কাঁচগুলো মোছে কেউ, নাকি ধুলো জমছে, দোতলার জানালা থেকে সুপুরি গাছটার নাগাল পাওয়া যায়? আর ওই গোলাপের বাগানটা আছে? মা কি এখন আর চাল কুমড়ো লাগায় না, পায়রা পোষে না? আমার ঘরটায় কে থাকে এখন? আলমারিটায় আমার অনেক চিঠিপত্তর আছে, বই আছে, ম্যাগাজিন আছে, ওগুলো কেউ নষ্ট করেনি তো, আমার ঘরের জানালা দিয়ে আকাশটা খুব ভালো দেখা যেত, এখনও যায়, নাকি কোনো গাছ টাছ এসে ঢেকে দিয়েছে? ঝাড়বাতিটা? ছাদ থেকে আকাশটা?
নূপুর সারাদিন উত্তর দিয়ে যেত যমুনার। বিজ্ঞান নিয়ে দিনরাত মাথা ঘামালেও, প্রকৃতি আর স্মৃতির কাছে যমুনা মাথা নত করতো। বাড়িটার প্রতিটি ঘর, প্রতিটা আনাচ কানাচ, উঠোনটা, মাঠটা, উঠোনের ওই আতা গাছটা, ওই পেয়ারা গাছটা, ওই আম গাছটা, ওই কাঁঠাল গাছটা, ওই কাঁঠালিচাপা, ওই গন্ধরাজ, শিউলি গাছটার কথা বলতে হত। বাবা মা’র কথা জিজ্ঞেস করতো না। অভিমান ছিল হয়তো। কিন্তু বাড়ির ওপর অভিমান ছিল না। মাঝে মাঝে নূপুরের মনে হত, বাড়িটার জন্য নয়, আসলে ওর নিজের শৈশব, কৈশোর, আর যৌবনের জন্য ভালোবাসা। সেদিকে বার বার ফিরে চাওয়া। নিজেকে দেখা। নার্সিসিজম! নূপুর বুঝে পেত না কেন যমুনা এত বাড়ি বাড়ি করতো, নস্টালজিয়া, নার্সিসিজম, নাকি না পাওয়ার কান্না—যে কারণেই হোক যমুনা বাড়ি-পাগল ছিল। মাঝে মাঝে এত বুদ্ধিমতী যুক্তিবাদী, পদার্থ বিজ্ঞানে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া মেয়েও অযৌক্তিক কাণ্ড করতো, একবার বললো বাড়ির উঠোনের একটু মাটি এনে দিস তো। মাটি মাটি করে পাগল হল, নূপুর মাটি এনে দিল, সেই মাটি ঢাকার ফ্ল্যাটের টবে রেখে তবে একটা বেলি ফুলের চারা লাগালো। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের বাড়ির উঠোনের সেই মাটি ছাড়া নাকি ফুল ফুটবে না। আসলে যমুনা জন্ম থেকেই ফুল আর ফুল গাছগুলো দেখছে, দেখতে দেখতে আর এসবের মধ্যে বড় বড় হতে হতে এদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ওর। যতদূরেই যাক না কেন পরে, সম্পর্কটা রয়ে যায়, ভেতরে কোথাও রয়ে যায়। বাড়ি ছেড়ে তো নূপুর, নাইম, যমুনা তিন ভাই বোনই বেরিয়েছে, বাড়ির প্রতি এমন তীব্র আকর্ষণ আর তো কেউ অনূভব করেনি যমুনার মতো! যমুনা যখন ইস্কুলে পড়তো তখনই বাড়িতে তার মা’র সঙ্গে সঙ্গে বসে গোলাপ, চন্দ্রমল্লিকা, বেলি, লিলি, মাধবী লতা, গন্ধরাজ আর নানা রকম গাছ তো লাগাতোই, ফুলকপি, বাধা কপি, টমেটো, কাঁচা লঙ্কা, লাউ, সিম, আলু, ধনেপাতা, নানা কিছুর গাছও লাগাতো, তখনই কি মাটির সঙ্গে সম্পর্ক জন্ম নেয় যমুনার। যমুনার মা বলতো যমুনা বড় হয়ে বোটানিস্ট হবে। তাই সবাই ভাবতো, বড় একটা বোটানিস্ট হয়ে বড় কিছু আবিষ্কার করবে, শুধু আবিষ্কারে মন ছিল। কোনো একটা গাছ মরে যাচ্ছে তো গবেষণা শুরু করে দিল। লাইব্রেরি থেকে লতা পাতার রোগ শোকের বই নিয়ে এসে দুদিনে বই শেষ করে পণ্ডিত মতো কিছু একটা হয়ে উঠতো। বাড়িতে রাজমিস্ত্রি কোনও কাজে এলে যমুনাও রাজমিস্ত্রির সঙ্গে কাজে লেগে যেত। পৃথিবীর নানা কিছুর প্রতি আকর্ষণ তার বাচ্চা-বয়স থেকেই। কোনোদিন চুপ করে কোথাও বসে থাকতে পারতো না। যখন আট বছর বয়স, নূপুরকে বললো, মনে হচ্ছে বাড়িটার তলায় হয়তো ডায়নোসোরের হাড়গোড় পাওয়া যাবে, অথবা অচেনা অজানা কিছু, চল খুঁড়ে খুঁড়ে দেখি কোনও খনির নাগাল পাওয়া যায় কি না। নূপুর দু’দিনে হাল ছেড়ে দিয়েছিল, কুন্তু মাসখানেক খুঁড়েছে যমুনা দিয়ে, ডায়নোসরের হাঁড় পায়নি, তবে তবে নানা রঙ্গের নানা রকম ছোটখাটো জিনিসপত্র পেয়েছ। রঙ্গিন কাচ, মার্বেল, পুরোনা পয়সা, চশমা, ঘড়ি, ছোটছোট পাথর আর তামা বা পিতলের হাতি ঘোড়া, বাঘ ভালুক। সব একটা কাচের বয়ামে রেখে দিত যমুনা আর বলতো এই হাতি ঘোড়াগুলো হয়তো পাঁচ হাজার বছর আগে কেউ বানিয়েছিল। পুরোনো কোনো সভ্যতা ঠিক এই মাটির তলায়। নূপুর হাঁ হয়ে শুনতো। শুধু বাড়িতেই নয়, পাড়ায় অত ছোট বয়সেই একটা বিজ্ঞান মেলায় যোগ দিয়ে চুম্বক দিয়ে বিজ্ঞানের কিছু একটা দেখিয়ে কী একটা পুরস্কারও পেয়ে গিয়েছিল যমুনা। যমুনার পাঁচ বছরের ছোট নূপুর। ছোট্ট নূপুরকে নিয়ে যমুনা প্রতিবছর এ পাড়ার, ও পাড়ার, বা ইস্কুলের বিজ্ঞান মেলায় যেত। এসবে তাকে উৎসাহ দিত তার বাবা। সেই বাবা আর মেয়ের সম্পর্কটা কী করে কবে নষ্ট হয়ে গেল। শুধু একটা বিয়ের জন্য! বিয়ে না করে বাচ্চা না নেওয়ার জন্য। বিয়ে, নূপুর জানে এখন হাড়ে মজ্জায়, একটা কাগজ ছাড়া কিছু নয়। শওকতকে ছেড়ে চলে আসার পর শওকতের ছ’মাসও লাগেনি নতুন বিয়ে করতে।
নূপুর পেছনের দিকে তাকায় আর অবিশ্বাস্য মনে হয় সব ঘটনা। বাড়িতে যমুনা সবচেয়ে বেশি আদর পেতো। বাবা মা, আত্মীয় স্বজন সবার আদর। কারও বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান হচ্ছে, যমুনার ডাক পড়তো, যমুনা কুইজ করো,বিজ্ঞানের খেলা দেখাও, কবিতা বলো। যমুনার পেছন পেছন যেত নূপুর। যমুনার জন্য হাততালি দেখতো, যমুনাকে আদর করা দেখতো। দেখতে দেখতে যমুনাকে যতটা ভালোবাসতো নূপুর, তার চেয়েও বেশি ভালবাসতে শুরু করেছিল। যমুনার সঙ্গে বড়রাও পারতো না। কেউ কোনও জাদু দেখালে, পয়সা দিয়ে আর তাস দিয়ে, যমুনা ধরে ফেলতো ওইসব হাতের চালাকি। যে জিনিসগুলো সবার মাথায় আসে না, যমুনার মাথায় কী করে আসতো ওসব! সে সব কতদিনকার আগের কথা। নূপুর শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে সামনে।
কার সঙ্গে সেইসব দুরন্ত শৈশব নিয়ে কথা বলবে নূপুর এখন আর! কথা বলার তো কেউ রইলো না। নূপুরের যে সাহস আর যে শক্তি হারিয়ে গিয়েছিল, তা সে ফিরে পেয়েছে। কিন্তু কী করবে এই শক্তি দিয়ে একা একা, ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের বাড়িটি কেনার পর সে ভেবেছিল বাড়িটি সুন্দর সাজিয়ে গুছিয়ে যমুনাকে নিয়ে আসবে, বাড়ি এখন অন্য কারওর নয়, বাড়ি নূপুরের। নূপুর কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে একটা বাড়ি কিনেছে, বাড়ি নয়, আসলে, এক বাড়ি স্মৃতি কিনেছে। টাকা যদি যমুনা না দিত, তবে কাড়ি কাড়ি টাকা রোজগারের কোনও ক্ষমতা নূপুরের ছিল না। শওকতের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর নূপুরকে সাহায্য করার কোনও প্রাণী ছিল না। ওই ছোটখাটো চাকরি আর নয়, নূপুর মনে অসম সাহস নিয়ে ভাবলো সে রেস্তোরাঁর ব্যবসা করবে। যমুনার দেওয়া এক লাখ ডলার নিয়ে সে শুরু করলো, যে আত্মবিশ্বাস তার কোনোদিন ছিল না, এলো। জ্যাকসন হাইটসের জনপ্রিয় দোকান’হাটবাজার’-এর মালিক ময়মনসিংহের ছেলে, অঞ্জন, নূপুরের অনেক কালের চেনা। তার উপদেশ আর সহযোগিতা নিয়ে যমুনার টাকায় নূপুর দিয়েছিল বাঙালি খাবার দোকান, ‘মাছ ভাত’। হাটবাজারের ব্যবসা মার খেয়ে গেল, মাছ ভাত এমন জনপ্রিয় হয়েছিল। এক লাখ ডলার খাটিয়ে পাঁচ বছরের মধ্যে নূপুর বেশ কয়েক লাখ ডলারের মালিক হয়ে গেল। আর টাকার দরকার নেই তার। যমুনার দেওয়া টাকাটা যমুনাকে ফেরত দিয়েও অনেক টাকা হাতে। যমুনা ব্যাংক থেকে লোন নিয়েছিল টাকাটা। সুদ নিজের পকেট থেকেই দিয়েছে। নূপুর সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়, বাকিটা জীবন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ের বাড়িটায় স্মৃতির দোলনায় দুলে দুলে কাটাবে। ব্রহ্মপুত্র তো আছেই, যমুনাও কাছে আছে।
কিন্তু যে যমুনাকে নিজের জীবনে একটি কাজের সাফল্য দেখাবে বলেই নূপুরের উত্তেজনা, সেই যমুনাই যদি দেখতে না পায় শখের বাড়ি, সেই ঘর দোর, যমুনাই যদি বাড়িটার উঠোনে খালি পায়ে না হাঁটে, তবে কী লাভ ওই বাড়িতে! দু’বোনে মিলে যদি ওই বাড়িতে আর গল্পই না হল, হেঁটে হেঁটে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বেরিয়ে বাড়ি ফেরাই না হল, তবে কী লাভ ওই বাড়িটায়! কী লাভ ইট পাথরে!
নূপুরের জীবন আগাগোড়াই ব্যর্থ। যমুনাকে সত্যিকার সার্থকতা বলতে যা বোঝায় কিছুই দেখাতে পারেনি এতকাল। না একটা ভালো চাকরি জোটানো, না জয়কে মানুষ করতে পারা, না স্বামীর ভালোবাসা পাওয়া, কিছুই হয়নি নূপুরের দ্বারা। শুধু একটা জিনিসই হয়েছিল। এতদিন আমেরিকায় গাধার খাটনি খেটে সে যা রোজগার করেছে, তা দিয়ে ব্রহ্মপুত্রর পাড়ে এই বাড়িটা কিনতে পেরেছে। যে বাড়িতে যমুনার প্রবেশ নিষেধ ছিল, সে-ই বাড়িতে যমুনাকে প্রবেশ করিয়ে নূপুর দেখাতে চেয়েছিল যমুনাকে, যে, নূপুরের সারা জীবনটাই ব্যর্থ নয়। অন্তত শেষে এসে কিছুটা মুখ বাঁচাতে পেরেছে। নূপুর কল্পনা করেছে যমুনার খুশি হওয়া। কী রকম করে বাচ্চা মেয়ের মতো লাফাবে যমুনা, কী রকম করে সেই সব দিনের কথা বলবে যে সব দিনের কথা বলতে গিয়ে যমুনার কখনো দিন শেষ হত না। যমুনাকে চমক দিতে চেয়েছিল নূপুর।
নূপুর চোখ বুজলে চোখের সামনে সেই দিনগুলো দেখতে পায়। দুজনে খেলছে মাঠে, দৌড়ে দোতালায় উঠছে, দোতলার ছাদে উঠছে। সাইকেলে চড়ে পাড়াটা চক্কর দিচ্ছে। পেছনে নূপুর। সাঁতার কাটতে চলে যাচ্ছে পুকুরে, সঙ্গে নূপুর। ব্রহ্মপুত্রে নৌকা চালাবে, ডিঙ্গি নৌকায় কে বসে গান শোনাবে? নূপুর। ওই দিনগুলো বুকের মধ্যে নিয়ে যমুনা বাঁচতো। জীবনে এত কিছু ছিল তার, তারপরও ওই দস্যিপনাটুকু, রোমাঞ্চটুকু, কখনও ভুলে যায়নি। ওই স্মৃতি না থাকলে যমুনার আর তার, নূপুর কি বেশি দাম দিয়ে বাড়িটা কিনতো? তার যদি আমেরিকা ছেড়ে দেশে বাস করার ইচ্ছে, ঢাকায় কোনও একটা ফ্ল্যাট সে কিনতে পারতো, কেন ময়সনসিংহে, কেন ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে? সেই দৌড়ে দৌড়ে সারাবছর নদীর পাড়ে যাওয়া যদি কৈশোর জুড়ে না থাকতো, নূপুরের কোনও আগ্রহ জন্মাতো না বাড়ি কেনার। নিজেকেই সে জিজ্ঞেস করে কী কারণে সে বাড়িটা কিনেছে। কিনতেই যদি হত, এই বাড়ি কেন? আর বাড়ি কি ছিল না? এর চেয়েও আধুনিক, এর চেয়েও মজবুত? আসলে থোকা থোকা স্মৃতি কিনেছে নূপুর, মা বাবার স্নেহের স্মৃতি, বুবুর ভালোবাসার স্মৃতি। টাকা দিয়ে হারিয়ে যাওয়া দিন কিনেছে। মুছে যাওয়া পায়ের ছাপ কিনেছে, ধুয়ে যাওয়া একাদোক্কার দাগ কিনেছে। নূপুর যমুনার কলকাতার বাড়ির উঠোনে খালি পায়ে হাঁটছিল, গাছগুলো দেখছিল আর পুরোনো সেইসব দিনের কথা ভাবছিল।
তপু তখন ডাকে দোতলা থেকে। দোতলার বারান্দায় ওর অর্ধেক শরীর মুগ্ধ চোখে দেখে নূপুর। যেন তপু নয়, যমুনা ডাকছে তাকে।
— নূপুখালা। ব্রজ আঙ্কল সই নিতে এসেছে। তোমাকে ডাকছে।
নূপুর উঠে এলো দোতলায়। ব্রজ কাগজ এগিয়ে দেয়। ‘এসএমএসের উত্তর দেওয়া হয়নি। ফোন সঙ্গে নিয়ে বেরোইনি কাল। কলকাতার বাইরে গিয়েছিলাম। অনেকদিন হয়ে গেল, দেখি আজই বডি নিয়ে যাবো’।
—আজই?
নূপুর চমকে ওঠে।
—হ্যাঁ আজই। যে কারণে ওয়েট করতে বলেছিলেন, সে তো হল। মেয়ে আমেরিকা থেকে এসেছে। বডি দেখা হয়ে গেছে। আর দেরি করা যায় না।
—কিন্তু..
—তাড়া তো দিচ্ছিলেন আপনারাই। এখন আবার কী হল!
নির্মলা একটা কলম এগিয়ে দেয়। বাঁ হাতে কাগজ, ডান হাতে কলম। কাগজের লেখা মন দিয়ে পড়তে থাকে নূপুর। সামনে নির্মলা, তপু, ব্রজ আর ব্রজর সঙ্গের লোক কথা বলতে থাকে কোন মেডিক্যালের শব ব্যবচ্ছেদ কক্ষে দেওয়া হবে শরীর, কারা কারা দিয়েছে এ পর্যন্ত মরণোত্তর দেহ, কোন কোন বিখ্যাত লোক, মাসে ক’টা বডি ওরা পায়।
হঠাৎ নূপুর বলে, —’দরকার নেই এসবের। মেডিক্যালে বডির অভাব নেই। এসব দেশে দিনে হাজার হাজার লোক মারা যাচ্ছে, অনেক বেওয়ারিশ লাশ চারদিকে। বুবুর ডেডবডি না হলে এমন কোনো ক্ষতি হবে না কারও, মেডিক্যাল রিসার্চও আটকে থাকবে না, ডিসেকসন রুমেও ছাত্রদের লাশের অভাব হবে না, কাঁটাছেড়া করে ডাক্তারি বিদ্যা শেখার। আমি বুবুকে আমাদের দেশের বাড়ি নিয়ে যাবো। ব্রহ্মুপুত্রের পাড়ে। বাড়িটা খুব ভালোবাসতো বুবু। ওই বাড়িতে বুবু মানে যমুনাদি বড় হয়েছে। যমুনাদি যমুনাদি হয়েছে, যে যমুনাদিকে আমরা ভালোবাসি, সেই যমুনাদি। ওই বাড়িতেই বুবু বেড়ে উঠেছিল সবার চেয়ে অন্যরকম হয়ে। ওখানকার গাছ গাছালি খুব ভালোবাসতো বুবু। ওখানকার আলো হাওয়াও। ব্রহ্মপুত্র থেকে যে হাওয়া আসতো, সেই হাওয়া। ওই মাঠটা খা খা করছে এখন, বুবু খেলতো একসময় যে মাঠটায়। সেটায় শুইয়ে দেবো। মাথার কাছে শিউলি ফুলের গাছ। শিউলি ফুল বুবু খুব ভালোবাসতো। আমাকে বরং কী যেন কিনতে হয়, কফিন টফিন, ওসব কিনতে সাহায্য করো। আসলে সত্যি কথা বলতে কী,প্রচুর টাকা থাকলে আজ কাল খুব ধনী লোকেরা যা করে, বরফে ডুবিয়ে রাখে, তাই করতাম। ভবিষ্যতে আবার যেন বাঁচিয়ে তোলা যায়, যখন বরফে রাখা ডেডবডিতে লাইফ আনা যাবে, এরকম কিছু আবিষ্কার হবে। আমি যতদিন বাঁচি, বুবুকে সঙ্গে নিয়েই বাঁচবো। এরপর কী হবে, যা হয় হবে, সব তো আমার হাতে নেই’!
সবাই চুপ। সবার চোখ নূপুরের দিকে, নূপুর আরও কিছু বলে কিনা’র দিকে। কিন্তু ওটুকু বলেই হাতের কাগজ আর কলম রেখে দিলো টেবিলে। কোথাও সই করেনি। নির্মলা, তপু, ব্রজ, ব্রজর সঙ্গের চশমা পরা দার্শনিক গোছের লোক, কারও মুখে কোনও কথা নেই।