Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » ব্যান্ড মাস্টার || Nimai Bhattacharya

ব্যান্ড মাস্টার || Nimai Bhattacharya

ব্যান্ড মাস্টার

ছেলেটির বেশ মিষ্টি চেহারা। প্রথম দিন দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। বড় ট্রে তে কাপডিশ তুলে একটা ময়লা কাপড় দিয়ে টেবিল পরিষ্কার করে চলে যেত। চলে যাবার সময় হয়তো বা একবার চাইত আমার দিকে। এক মুহূর্ত, তার বেশি না। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি গুটিয়ে নিয়ে জনতা কফি হাউসের মধ্যে হারিয়ে যেত। তারপর উর্দিপরা বেয়ারা আসত। অর্ডার দিলে কফি এনে দিত। কফি খাওয়া শেষ হবার পরও আমি আর মৃদুলা বসে বসে গল্প করতাম। ওরই এক ফাঁকে বেয়ারা এসে পয়সা নিয়ে যেত। দশবিশ পয়সা টিপস দিতাম। কোনোদিন জাপানী পুতুলের মত হাতটা একটু তুলতো, কোনোদিন তুলতো না। চলে যেতো। আমি আর মৃদুলা তখনও গল্প করতাম। উঠতাম না। আবার ঐ ছেলেটা আসত। ট্রেতে কাপডিশ তুলতে, টেবিল সাফ করে দিত। একটু সলজ্জ দৃষ্টিতে আমার দিকে চাইত, হয়তো বা মৃদুলার দিকেও। আমি ওকে একটু ভালো করে দেখার আগেই ও জনতা কফি হাউসের জনারণ্যে হারিয়ে যেত।

এসব বেশ অনেক কাল আগেকার কথা। মুসৌরীতে বেড়াতে গিয়ে মৃদুলার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। দিল্লিতে এসে ভাব হয়েছে। রোজ কফি হাউসে যাই, কনট প্লেসে ঘুরে বেড়াই। পাশাপাশি বসে সিনেমাথিয়েটার দেখি। একটু হাত চেপে ধরি, একটু অহেতুক হাসি। সন্ধ্যায় অন্ধকার নেমে এলে দুজনে দুদিকে চলে যাই। রাত্রির অন্ধকারেও কেমন যেন একটা সোনালি সকালের নেশায় বিভোর থাকি।

তারপর আস্তে আস্তে কফি হাউসে যাওয়া বন্ধ করলাম। অত ভীড়ের মধ্যে কথা বলে মৃদুলার মন ঠিক ভরত না। একটু নিবিড় হবার জন্য মৃদুলা নিয়ে যেতো ইন্ডিয়া গেটের আশেপাশের গাছতলায়, বুদ্ধ জয়ন্তী পার্কে অথবা অন্য কোথাও। কফি হাউসের ঐ মিষ্টি চেহারার ছেলেটার সঙ্গে আর দেখা হতো না, কিন্তু মাঝে মাঝেই আমার মনে পড়তো! মনে পড়ত ওর সলজ্জ মিষ্টি দৃষ্টির কথা।

আমার আর মৃদুলার দিনগুলি বেশ কাটছিল। আনন্দে, খুশিতে। বিভোর হয়ে যেতাম নিজেদের স্বপ্নে! আস্তে আস্তে ভুলে গেলাম ঐ সুন্দর মিষ্টি চেহারার ছেলেটাকে। কফি হাউসের সামনে দিয়ে যাবার সময়ও মনে পড়ত না ওর সলজ্জ দৃষ্টির কথা।

.

বছরখানেক পার হয়ে গেল।

সুরেশ তানিজার বিয়েতে গেছি আমরা দুজনেই। বিরাট আয়োজন। প্যান্ডেলের গেটের কাছে বেশ ভীড়। একটু দূরেই ব্যান্ড পার্টি। মাঝে মাঝে হিন্দি ফিল্মের গান বাজাচ্ছে। আমি আর মৃদুলা একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। নানা কথা। নিজেদের কথা। কবে এই রকম প্যান্ডেলের সামনে আমরা দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা করব, কবে আমরা দুজনে…

সেলাম সাব! ব্যান্ড পার্টির একটা লোক এসে হঠাৎ আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে সেলাম জানাতেই চমকে উঠলাম।

আমি আর মৃদুলা অবাক হয়ে ওর দিকে চাইলাম।

চিনতে পারছেন স্যার?

আমি আর মৃদুলা এক সঙ্গেই বললাম, নাতো।

মাথার লাল রংএর টুপিটা খুলে বলল, আমি কফি হাউসে…

এবার মনে পড়ল। কাপডিশ তুলে নিত, টেবিল সাফ করত, আর মুহূর্তের জন্য একবার আমাকে আর মৃদুলাকে দেখত।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে। এখন তুমি ব্যান্ড পার্টিতে জয়েন করেছ?

হ্যা সাব, বহুদিনের ইচ্ছা ছিল…

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

আরো দুচারটে কথাবার্তার পর ও একবার মৃদুলার দিকে তাকিয়েই দৃষ্টিটা নামিয়ে নিল। খুব চাপা গলায় বলল, আগে জানলে আপনাদের সাদির সময় আমাদের ব্যান্ড পার্টি নিয়ে যেতাম।

কনুই দিয়ে মৃদুলাকে একটু গুঁতো দিয়ে আমি হাসতে হাসতে বললাম, আমাদের এখনও বিয়ে হয়নি।

ও আমার কথা ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না। মৃদুলাকে জিজ্ঞেস করল, বাবুজি ঝুট বলছেন, তাই না বিবিজি?

মৃদুলাও হাসল। বাবুজি ঝুট বলবেন কেন? সত্যি কথাই বলছেন।

ছেলেটা যেন একটু নিশ্চিন্ত হল। দৌড়ে গিয়ে ব্যান্ড মাস্টারের কাছ থেকে একটা কার্ড এনে আমার হাতে দিয়ে বলল, সাদির ডেট ঠিক হলেই একটা খবর দেবেন।

মৃদুলাকে বিয়ে করার সময় অনেক কিছু করার পরিকল্পনা ছিল মনের মধ্যে। কিন্তু ব্যান্ড পার্টি আনার কোনো ইচ্ছা ছিল না। তবু তাকে তা বলতে পারলাম না। কার্ডটা নিয়ে বললাম, আচ্ছা।

একটা কার্ডে ও আমার ঠিকানাও লিখে নিল!

তারপর আবার সেলাম করল আমাদের। গরিব জয়দীপকে ভুলবেন না।

.

জয়দীপ কদাচিৎ কখনও আমার বাসায় আসত। বসত। গল্প করত, সাব, আপনি তো আর্টিস্ট। আমার একটা কাজ করে দেবেন?

কি কাজ?

মুখ নীচু করে জবাব দিল, আমার সাদীর সময় সুন্দর কার্ড তৈরি করে করে দেবেন?

দেব।

জয়দীপ খুব খুশি। ঐ সামান্য প্রতিশ্রুতির জন্য ও আমার আরো ভক্ত হয়ে উঠল।

পাঞ্জাবের ফিরোজপুর জেলার একটা ছোট্ট গ্রামে জয়দীপের বাড়ি। পাশের গামের এক ব্যান্ড মাস্টারের মেয়েকে ভালোবাসে। দারুণ ভালোবাসে। বিয়ে করবেই। জয়দীপের মা বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন ঐ ব্যান্ড মাস্টারের কাছে। রাজি হয়নি ব্যান্ড মাস্টার। বলেছে, ক্ষেত খামারি করা ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেবে না; বিয়ে দেবে বড় শহরের কোনো ব্যান্ড মাস্টারের সঙ্গে।

বড় শহরের ব্যান্ড মাস্টার! ফিরোজপুর, অমৃতসর, আম্বালা, লুধিয়ানার ব্যান্ড মাস্টারের সঙ্গে বিয়ে দেবে?

জয়দীপ চলে এসেছে দিল্লি। ফিরোজপুর, অমৃতসর, আম্বালা, লুধিয়ানা, জলন্ধরকে পেছনে ফেলে এসেছে দিল্লি। সারা হিন্দুস্থানের রাজধানী! প্রথমেই ব্যান্ড পার্টিতে চান্স পায়নি। কুছ পরোয়া নেই! কফি হাউসে নোংরা কাপডিশ তুলেছে, টেবিল সাফ করেছে, তারপর চান্স পেয়েছে ব্যান্ড পার্টিতে। রাষ্ট্রপতি ভবনের সৈন্যদের মত সোনালি রূপালি জরির লাল পোশাক পরে জয়দীপ ব্যান্ড পার্টিতে বাজনা বাজায়। আরো কিছুকাল বাজাবে! তারপর নিজের ব্যান্ড পার্টি তৈরি করবে। ব্যান্ড মাস্টার হবে। উঁচু প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে ক্লারিনেট বাজাবে! ওর ক্লারিওনেটের সুরে বেজে উঠবে আর সব বাজনা। বিয়েবাড়ির সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনবে সেই বাজনা আর চেয়ে দেখবে ব্যান্ড মাস্টারকে। জয়দীপকে।

তারপর মাকে আর একবার পাঠাবে পাশের গ্রামে।

আমি ঘরের মধ্যে ছবি আঁকতাম আর জয়দীপের কথা শুনতাম।

জানেন সাব, যেদিন লালকেল্লার সামনে লাজপত মার্কেটে জয়দীপ ব্যান্ডএর সাইন বোর্ড ঝুলবে, তারপর দিন মাকে পাঠাব।

আমি হাসতে হাসতে জিজ্ঞাসা করতাম, তোমার বিয়েতে আমাদের নেমন্তন্ন করবে তো?

সত্যি যাবেন বাবুজি?

যাব না কেন?

বিবিজিকেও নিয়ে যাবেন তো?

গেলে দুজনেই যাব।

আপনারা গেলে তো গ্রামের লোক চমকে যাবে!

কেন?

কেন আবার! আমাদের মতো সাধারণ গরিবের বিয়েতে কি আপনাদের মত লেখাপড়া জানা লোক যায়?


অনেককাল পরে দিল্লি এসেছি এশিয়া৭২ এর জন্য। সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হই। চলে আসি কনট প্লেসের কফি হাউসে। রোজ। চুপচাপ বসে বসে কফি খেতে খেতে মনে পড়ে পুরনো দিনের কথা।

সাব! আপনি বাঙালিবাবু আর্টিস্ট আছেন? কফির কাপটা আমার সামনে নামিয়ে রাখতে রাখতে জিজ্ঞাসা করল।

একটু অবাক হলাম। হ্যাঁ।

বহুকাল আর আপনাকে দেখি না তো?

আমি আর এখানে থাকি না।

কোথায় থাকেন?

কলকাতায়।

কনট প্লেসের কফি হাউসে নিত্য প্রতিনিয়ত কত হাজার হাজার লোক আসে। তবু এই বেয়ারা যে আমাকে চিনতে পেরেছে, তার জন্য সত্যি আশ্চর্য হলাম।

আমাকে আপনি চিনতে পারেননি, তাই না? একটু শুকনো হেসে বেয়ারাটা প্রশ্ন করল।

চিনতে পারিনি ঠিকই কিন্তু মুখে বললাম, এবার মনে পড়েছে।

বেয়ারাটা এবার সোজাসুজি বল, বাবুজী আমি জয়দীপ!

জয়দীপ! ব্যান্ড পার্টির জয়দীপ! ব্যান্ড মাস্টার হবার স্বপ্ন দেখত যে সে কফি হাউসের বেয়ারা হয়েছে?

তোমার ব্যান্ড পার্টি

কথাটা শেষ করতে হল না। জয়দীপ বলল, গরিব মানুষের কপালই খারাপ হয় বাবুজী

আমি অবাক হয়ে জয়দীপের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।

বাবুজী, বিবিজিকে নিয়ে এসেছেন?

বিবিজি? মৃদুলা?

তাড়াতাড়ি একটা কাগজে আমার হোটেলের ঠিকানা লিখে ওর হাতে দিয়ে বললাম, একটু রাত করে এসো। কথা হবে।

জয়দীপ এসেছিল। বলেছিল সব কথা। দুঃখের কথা, হতাশার কথা, ব্যর্থতার কথা।…লাজপত নগরের এক বিয়েবাড়িতে রিসেপশনে বাজাতে গিয়েছিল জয়দীপের ব্যান্ড পার্টি। প্যান্ডেলের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাজাচ্ছিল খুব সুন্দর একটা গান। হঠাৎ পাশ দিয়ে গ্রামের কুলদীপ সিংকে যেতে দেখে জয়দীপ ছুটে গেল। না গিয়ে পারল না….

জয়দীপের চোখে জল। গলার স্বরটাও কেমন পালটে গেছে। জানেন বাবুজী, যাকে বিয়ে করব ভেবেছিলাম, সে ঐ বাড়িতেই বৌ হয়ে এসেছিল।

জয়দীপের কথা শুনে আমি যেন ইলেকট্রিক শক খেলাম। বল কি?

হ্যা বাবুজী! আপনাকে কি মিথ্যে কথা বলব?

অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে রইলাম। তারপর জয়দীপ জিজ্ঞাসা করল, বিবিজি ভালো আছেন তো?

আমারও চোখের কোণায় একবিন্দু জল এসে গেল। খুব বড় এক সাহেবের সঙ্গে বিয়ে হবার পর ও বিলেতে চলে গেছে।

জয়দীপ প্রায় চিৎকার করে উঠল, বলেন কি বাবুজী?

অনেক কষ্টে আমি মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বললাম, জয়দীপ, আমিও ব্যান্ড মাস্টার হতে পারলাম না।

পরের দিন কফি হাউসে গেলাম। জয়দীপ কফি দিল, কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও পয়সা নিতে এলো না। অনেক খুঁজলাম, কিন্তু অত ভীড়ের মধ্যে কিছুতেই ওকে খুঁজে পেলাম না। কাউন্টারে পয়সা দিয়ে আমি কফি হাউস থেকে বেরিয়ে কনট প্লেসের ভীড়ে হারিয়ে গেলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *