Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বেণীসংহার – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 2

বেণীসংহার – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

বেণীমাধব চক্রবর্তী সরকারি সামরিক বিভাগে কন্ট্রাক্টবি কাজ করে বিপুল অর্থ উপার্জন করেছিলেন। দক্ষিণ কলকাতায় সদর রাস্তার ওপর তাঁর প্রকাণ্ড তিনতলা বাড়িটা সেই অর্থের যৎকিঞ্চিৎ নিদর্শন।

বেণীমাধব সতর্কবুদ্ধির মানুষ ছিলেন। দীর্ঘকাল ঠিকেদারি করার ফলে মনুষ্য জাতির সততায় তিনি বিশ্বাস হারিয়েছিলেন। কিন্তু সেজন্যে তাঁর হৃদয়ধর্ম সংকুচিত হয়নি। সংসারের এবং সেইসঙ্গে নিজের দোষত্রুটি তিনি হাসিমুখে গ্রহণ করেছিলেন।

বেণীমাধবের পোষ্য বেশি ছিল না। যৌবন উত্তীর্ণ হবার পরই তিনি বিপত্নীক হয়েছিলেন; পত্নী রেখে যান একটি পুত্র ও একটি কন্যা। তারা বড় হলে বেণীমাধব তাদের বিয়ে দিলেন। ছেলে অজয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি আস্ত অকর্মার ধাড়ি; ব্যবসা-বাণিজ্যের চেষ্টা করে বাপের কিছু টাকা নষ্ট করে পিতৃস্কন্ধে আরোহণ করেছিল; বেণীমাধব আর তাকে কাজে নিযুক্ত করবার চেষ্টা করেননি। তিনি বেশির ভাগ সময় বাইরে বাইরে থাকতেন‌, বাড়ির দ্বিতলে অজয় বাস করত তার স্ত্রী আরতি এবং পুত্রকন্যা মকরন্দ ও লাবণিকে নিয়ে। বেণীমাধব তার সংসারের খরচ দিতেন।

মেয়ের বিয়ে বেণীমাধব ভালই দিয়েছিলেন; জামাই গঙ্গাধরের পৈতৃক বিষয়-সম্পত্তি ছিল। কিন্তু বড়মানুষ শ্বশুর পেয়ে তার মেজাজ চড়ে গেল‌, সে রেস খেলে যথাসর্বস্ব উড়িয়ে দিল। মেয়ে গায়ত্রী বাপের কাছে এসে কেঁদে পড়ল। বেণীমাধব মেয়ে জামাই এবং দৌহিত্রী ঝিল্পীকে নিজের বাড়িতে তুললেন; ছেলেকে যেমন মাসহারা দিচ্ছেন মেয়ের জন্যেও তেমনি মাসহারা বরাদ্দ হলো।

বেণীমাধবের বাড়িটা তিনতলা‌, আগেই বলেছি। তেতলায় মাত্র তিনটি ঘর‌, বাকি জায়গায় বিস্তীর্ণ ছাদ। এই তেতলাটা বেণীমাধব নিজের জন্যে রেখেছিলেন‌, তিনি না থাকলে তেতিলা তালাবন্ধ থাকত। দোতলায় আটটি ঘর‌, সামনে টানা বারান্দা; এই তলায় বেণীমাধব তাঁর ছেলে অজয় ও মেয়ে গায়ত্রীকে পাশাপাশি থাকবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তাদের হাঁড়ি হেঁশেল অবশ্য আলাদা। দুই সংসারে মনের মিল ছিল না; কিন্তু প্রকাশ্যে ঝগড়া করবার সাহসও কারুর ছিল না। ছেলেমেয়ের প্রতি বেণীমাধবের স্নেহ ছিল; কিন্তু তিনি রাশভারী লোক ছিলেন‌, কড়া হতে জানতেন।

নীচের তলায় প্রকাণ্ড একটা হলঘর বিলিতি আসবাব দিয়ে ড্রয়িং-ক্লামের মত সাজানো; মাঝখানে নীচু গোল টেবিল‌, তাকে ঘিরে দুটো সোফা এবং গোটা কয়েক গদি-মোড়া ভারী চেয়ার‌, তাছাড়া আরো কয়েকটি কেঠো চেয়ার দেওয়ালের গায়ে সারি দিয়ে রাখা। কিন্তু ঘরটি বড় একটা ব্যবহার হয় না‌, কদাচিৎ কেউ দেখা করতে এলে অতিথিকে বসানো হয়। বাকি পাঁচখানা ঘর আগন্তুক অভ্যাগতদের জন্যে নির্দিষ্ট থাকলেও অধিকাংশ সময় তালাবন্ধ থাকত।

কিন্তু বেশি দিন তালাবন্ধ রইল না। বেণীমাধবের দুই মামাতো ছোট বোন ছিল‌, বহুদিন মারা গেছে; তাদের দুই ছেলে সনৎ গাঙ্গুলি ও নিখিল হালদার-পরম্পর মাসতুতো ভাই-কলকাতায় চাকরি করত; তাদের ভাল বাসা ছিল না‌, তাই বেণীমাধব তাদের নিজের বাড়িতে এনে রাখলেন। নীচের দু’টি ঘর নিয়ে তারা রইল।

দেখা যাচ্ছে‌, বেণীমাধবের ছেলে মেয়ে নাতি নাতনী এবং দুই ভাগনে মিলে সাতজন পোষ্য। বাড়িতে চাকর নেই‌, দুটো দাসী দিনের বেলা কাজ করে দিয়ে সন্ধ্যের সময় চলে যায়।

নিতান্তাই বৈচিত্র্যহীন পারিবেশ। শালা-ভগিনীপতির বয়স প্রায় সমান‌, তেতাল্লিশ চুয়াল্লিশ; কিন্তু তাদের মধ্যে মানসিক ঘনিষ্ঠতা নেই‌, দু’জনের আকৃতি প্রকৃতি দুরকম। অজয় সুশ্ৰী ও শৌখিন গোছের মানুষ‌, গিলে-করা ধুতি-পাঞ্জাবি ও পালিশ-করা পাম্প-শু ছাড়া সে বাড়ির বার হয় না। রোজ সকালে গড়িয়াহাটে বাজার করতে যাওয়াতে তার ঘোর আপত্তি্‌্‌, অধিকাংশ দিন তার স্ত্রী আরতিই বাজারে যায়। অজয় সন্ধ্যের পর ক্লাবে যায়; শখের থিয়েটারের প্রতি তার গাঢ় অনুরাগ। অভিনয় ভালই লাগে। ক্লাবটা শখের থিয়েটারেরই ক্লাব‌, প্রতি বছর তারা চার-পাঁচখানা নাটক অভিনয় করে।

গঙ্গাধরের চেহারাটা কাপালিক ধরনের; মুখে এবং দেহে মাংস কম‌, হাড় বেশি। চোখের দৃষ্টি খর। নিজের বিষয়সম্পত্তি উড়িয়ে দিয়ে শ্বশুরের স্কন্ধে আরোহণ করার পর সে অত্যন্ত গম্ভীর এবং মিতভাষী হয়ে উঠেছে। সারা দিন বাড়ি থেকে বেরোয় না‌, সন্ধ্যের পর লাঠি হাতে নিয়ে বেড়াতে বেরোয়। ঘন্টা দেড়েক পরে যখন ফিরে আসে তখন তার মুখ থেকে ভ্রূর ভুর করে মদের গন্ধ বের হয়।

ননন্দ-ভাজের মধ্যে প্রকাশ্যত সদ্ভাব ছিল‌, যাওয়া-আসা গল্পগুজবও চলত; কিন্তু সুবিধে পেলে কেউ কাউকে চিমটি কাটতে ছাড়িত না। গায়ত্রী হয়তো পাশের ফ্ল্যাটে গিয়ে বলল–’বৌদি‌, আজাকি রান্নাবান্না করলে?’

আরতি রান্নার ফর্দ দিয়ে বলত—’তুমি কি রাঁধলে ভাই?’

গায়ত্রী বলল–’রান্না আর হলো কই। ভাতের ফ্যান গেলে মাংস চড়াতে গিয়ে দেখি গরম মশলা নেই! জানো তো তোমার নন্দাই শাক-ভাত খেতে পারেন না! ওঁর মাছ না হলেও চলে কিন্তু রোজ মাংস চাই। তাই খোঁজ নিতে এলুম তোমার ভাঁড়ারে গরম মশলা আছে কিনা। নইলে আবার বিকে বাজারে পাঠাতে হবে।’

আরতি বলল–’আছে বৈকি‌, এই যে দিচ্ছি।’

গরম মশলা এনে দিয়ে আরতি হাসি-হাসি মুখে বলল–’নন্দাই মাংস ভালবাসেন তাতে দোষ নেই‌, কিন্তু ভাই‌, ও জিনিসটা না খেলেই পারেন।’

গায়ত্রীর দৃষ্টি অমনি কড়া হয়ে উঠল—’কোন জিনিস?’

আরতি ভালমানুষের মত মুখ করে বলল–’তোমার দাদা বলছিলেন সেদিন সন্ধ্যের পর নন্দাই-এর মুখোমুখি দেখা হয়েছিল‌, তা নন্দাই-এর মুখ থেকে ভক করে মদের গন্ধ বেরুল। নন্দাই-এর বোধহয় পুরনো অভ্যোস‌, ছাড়তে পারেন না‌, কিন্তু কথাটা যদি বাবার কানে ওঠে—‘

গায়ত্রীর কঠিন দৃষ্টি কুটিল হয়ে উঠল‌, সে মুখে একটা বাঁকা হাসি টেনে এনে বলল–’বাবার কানে যদি কথা ওঠে তাহলে তোমরাই তুলবে বৌদি। কিন্তু সেটা কি ভাল হবে? তোমার মেয়ের জন্য নাচের মাস্টার রেখেছ তাতে দোষ নেই কিন্তু লাবনি রাত দুপুর পর্যন্ত মাস্টারের সঙ্গে সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরে সেটা কি ভাল? লাব্রণি কচি খুকি নয়‌, যদি একটা কেলেঙ্কারি করে বসে তাতে কি বাবা খুশি হবেন? গায়ত্রী আচল ঘুরিয়ে চলে গেল।

সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি।

লাবণি মেয়েটি দেখতে ভাল; ছিপছিপে লম্বা গড়ন‌, নাচের উপযোগী চেহারা। একটু চপল প্রকৃতি‌, লেখাপড়া স্কুলের সীমানা পার হবার আগেই শেষ হয়েছে; নৃত্যকলার প্রতি তার দুরন্ত অক্টেরাগ। অজয় মেয়ের মনের প্রবণতা দেখে তার জন্যে নাচের মাস্টার রেখেছিল। মাস্টারটি বয়সে তরুণ‌, সম্পন্ন ঘরের ছেলে‌, নাম পরাগ লাহা; হাপ্তায় দুদিন লাবণিকে নাচ শেখাতে আসত। বাপ-মায়ের চোখের সামনে লাব্রণি নাচের মহলা দিত। কদাচিৎ পরাগ বলত—’একটা নাচ-গানের বিলিতি ছবি এসেছে‌, দুটো টিকিট কিনেছি। রাত্রির শোতে। লাবণিকে নিয়ে যাব? ছবিটা দেখলে ও অনেক শিখতে পারবে।’

গোড়ার দিকে আরতি রাজী হতো না। পরাগ বলত–’থাক‌, আমি অন্য কোনো ছাত্রীকে নিয়ে যাব।’

ক্রমে আপত্তি শিথিল হয়ে আসে‌, লাব্রণি পর্যাগের সঙ্গে ছবি দেখতে যায়; দুপুর রাত্রে পরাগ লাবণিকে বাড়ি পৌঁছে দেয়।

কালধৰ্মে সবই গা-সওয়া হয়ে যায়।

লাবণির দাদা মকরন্দ কলেজে পড়ে। কিন্তু পড়া নামমাত্র; কলেজে নাম লেখানো আছে। এই পর্যন্ত। তার মনের দিগন্ত জুড়ে আছে রাজনৈতিক দলাদলি‌, দলগত প্রয়োজনে যদি কলেজে যাওয়া প্রয়োজন হয় তবেই কলেজে যায়। তার চেহারা ভাল‌, কিন্তু মুখে চোখে একটা উগ্র ক্ষুধিত অসন্তোষ। সে বাড়িতে বেশি থাকে না; বাড়ির সঙ্গে কেবল খাওয়া আর শোয়ার সম্পর্ক। মাঝে মাঝে আরতির সংসার-খরচের টাকা অদৃশ্য হয়; আরতি বুঝতে পারে কে টাকা নিয়েছে‌, কিন্তু অশান্তির ভয়ে চুপ করে থাকে। মকরুন্দ তার থিয়েটার-বিলাসী বাপকে বিদ্বেষ করে‌, অজয়ও ছেলের চালচলন পছন্দ করে না; দু’জনে পরস্পরকে এড়িয়ে চলে। মকরন্দ যেন তার বাপ-মায়ের সংসারে অবাঞ্ছিত অতিথি।

পাশের ফ্ল্যাটে সংসার ছোট; কেবল একটি মেয়ে ঝিল্লী। ঝিল্লী লাবণির সমবয়সী‌, লাবণর মত সুন্দরী নয়‌, কিন্তু পড়াশোনায় ভাল। চাপা প্রকৃতির মেয়ে‌, কলেজে ভর্তি হয়েছে‌, নিয়মিত কলেজে যায়‌, লেখাপড়া করে‌, অবসর পেলে মাকে সংসারের কাজে সাহায্য করে। তার শান্ত মুখ দেখে মনের খবর পাওয়া যায় না।

এই গেল দোতলার মোটামুটি খবর।

নীচের তলার দু’টি ঘরে সনৎ আর নিখিল থাকে। সনতের বয়স ত্ৰিশের ওপর‌, নিখিলের ত্ৰিশের নীচে। চেহারার দিক থেকে দু’জনকেই সুপুরুষ বলা চলে। কিন্তু চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। সনৎ সংবৃতিচিত্ত ও মিতবাক‌, বিবেচনা না করে কথা বলে না। নিখিলের মুখে খৈ ফোটে‌, সে চটুল ও রঙ্গপ্রিয়। দু’জনেই সাংবাদিকের কাজ করে। সনৎ প্রেস-ফটোগ্রাফার। নিখিল খবরের কাগজের সংবাদ সম্পাদন বিভাগে নিম্নতর নিউজ এডিটর-এর কাজ করে। সে নিশাচর প্রাণী। —দেবতা ঘুমালে আমাদের দিন‌, দেবতা জাগিলে মোদের রাতি। ঋষ্যশৃঙ্গকে যারা প্রলুব্ধ করেছিল তাদেরই সমগোত্রীয়।

এরা কেউ বিয়ে করেনি। নিখিলের বিয়ে না করার কারণ‌, সে যা উপার্জন করে তাতে সংসার পাতা চলে না; কিন্তু সনতের সেরকম কোনো কারণ নেই। সে ভাল উপার্জন করে; মাতুলগৃহে তার বাস করার কারণ অর্থাভাব নয়‌, ভাল বাসার অভাব। তার বিবাহে অরুচির মূল অনুসন্ধান করতে হলে তার একটি গোপনীয় অ্যালবামের শরণ নিতে হয়। অ্যালবামে অনেকগুলি কুহকিনী যুবতীর সরস ফটো আছে। ফটোগুলি দেখে সন্দেহ করা যেতে পারে যে‌, সনৎ অবিবাহিত হলেও ব্রহ্মচারী নয়। কিন্তু সে অত্যন্ত সাবধানী লোক। সে যদি বিবাহের বদলে মধুকরবৃত্তি অবলম্বন করে থাকে‌, তাহলে তা সকলের অজান্তে।

এই সাতটি মানুষ বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা। বেণীমাধব নামাসে ছ’মাসে আসেন‌, দুদিন থেকে আবার দিল্লী চলে যান। দিল্পীই তাঁর কর্মক্ষেত্রের কেন্দ্রবিন্দু।

হঠাৎ সাতষট্টি বছর বয়সে বেণীমাধবের স্বাস্থ্যভঙ্গ হলো। তাঁর শরীর বেশ ভালই ছিল। অসম্ভব পরিশ্রম করতে পারতেন। কিন্তু তাঁর প্রিয় ভূত্য এবং দীর্ঘদিনের অনুচর রামভজনের মৃত্যুর পর তিনি আর বেশি দিন খাড়া থাকতে পারলেন না। তিন মাসের মধ্যে তিনি ব্যবসা গুটিয়ে ফেললেন। তাঁর টাকার দরকার ছিল না‌, বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত কাজের ঝোঁকেই কাজ করে যাচ্ছিলেন। এখন দিল্লীর অফিস তুলে দিয়ে তিনি কলকাতায় ফিরে এলেন। সঙ্গে এল নতুন চাকর মেঘরাজ।

রামভজনের মৃত্যুর পর বেণীমাধব মেঘরাজকে খাস চাকর রেখেছিলেন। মেঘরাজ ভারতীয় সেনাদলের একজন সিপাহী ছিল; চীন-ভারত যুদ্ধে আহত হয়ে তার একটা পা হাঁটু পর্যন্ত কাটা যায়। ভারতীয় সেনাবিভাগের পক্ষ থেকে তাকে কৃত্রিম পা দেওয়া হয়েছিল এবং সামান্য পেনসন দিয়ে বিদায় করা হয়েছিল। সে বেণীমাধবের দিল্লীর অফিসে দরোয়ানের কাজ পেয়ে গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করেছিল; রামভজনের মৃত্যুর পর বেণীমাধব তাকে খাস চাকরের কাজ দিলেন। মেঘরাজ অত্যন্ত বিশ্বাসী এবং কড়া প্রকৃতির মানুষ; সে বেণীমাধবের একক সংসারের সমস্ত কাজ নিজের হাতে তুলে নিল; তাঁর দাড়ি কামানো থেকে জুতো বুরুশ পর্যন্ত সব কাজ করে। তার বয়স আন্দাজ চল্লিশ; বলিষ্ঠ চেহারা। কৃত্রিম পায়ের জন্য একটু খুঁড়িয়ে চলে।

যাহোক‌, বেণীমাধব এসে কলকাতার বাড়িতে অধিষ্ঠিত হলেন। তেতলার অংশে নিত্য ব্যবহারের সব ব্যবস্থাই ছিল‌, কেবল ফ্রিজ আর টেলিফোন ছিল না। দুচার দিনের মধ্যে ফ্রিজ এবং টেলিফোনের সংযোগ স্থাপিত হলো। ইতিমধ্যে মেয়ে গায়ত্রী এসে আবদার ধরেছিল–’বাবা‌, এবার আমি তোমার খাবার ব্যবস্থা করব। আগে তুমি যখনই আসতে দাদার কাছে খেতে। আমরা কি কেউ নই?’

বেণীমাধব বলেছিলেন—’আমি তো একলা নাই‌, মেঘরাজ আছে।’

‘মেঘরাজ বুঝি নতুন চাকরের নাম? আহা‌, বুড়ো রামভজন মরে গেল। তা মেঘরাজকেও আমি খাওয়াব।’

বেণীমাধব বিবেচনা করে বললেন–’বেশ‌, কিন্তু তাতে তোমার খরচ বাড়বে। আমি তোমার মাসিক বরাদ্দ আরো দেড়শো টাকা বাড়িয়ে দিলাম।’

গায়ত্রী হেসে বলল–’সে তোমার যেমন ইচ্ছে।’ তার বোধহয় মনে মনে এই মতলবই ছিল; সে মাসে সাড়ে সাতশো টাকা পেত‌, এখন না শো টাকায় দাঁড়াল।

কলকাতায় এসেই বেণীমাধব তার পুরনো বন্ধু ডাক্তার অবিনাশ সেনকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। ডাক্তার অবিনাশ সেন নামকরা ডাক্তার‌, বয়সে বেণীমাধবের চেয়ে কয়েক বছরের ছোট। তিনি একদিন বেণীমাধবকে নিজের ক্লিনিকে নিয়ে গিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করলেন; এক্স-রে‌, ই সি জি প্রভৃতি যান্ত্রিক পরীক্ষা হলো। তারপর ডাক্তার সেন বললেন—’দেখুন‌, আপনার শরীরে সিরিয়াস কোনো ব্যাধি নেই‌, যা হয়েছে তা হলো বার্ধক্যের স্বাভাবিক সবাঙ্গীন অবক্ষয়। আমি আপনাকে ওষুধ-বিষুধ কিছু দেব না‌, কেবল শরীরের গ্রন্থিগুলোকে তাজা রাখবার জন্যে মাসে একটা করে ইনজেকশন দেব। আসলে আপনি বয়সের তুলনায় বড় বেশি পরিশ্রম করেছিলেন। এখন থেকে পরিপূর্ণ বিশ্রাম; বই পড়ুন‌, রেডিও শুনুন‌, রোজ বিকেলে একটু বেড়ান। এখনো অনেক দিন বাঁচবেন।’

বেণীমাধব ইনজেকশন নিয়ে সানন্দে বাড়ি ফিরে এলেন।

তারপর দিন কাটতে লাগল। গায়ত্রী নিজের হাতে থালা সাজিয়ে এনে ব্যাপকে খাইয়ে যায়। অন্য সকলে আসা-যাওয়া করে। মকরুন্দ বড় একটা আসে না‌, এলেও দু’ মিনিট থেকে চলে যায়। নাতনীরা থাকে‌, বেণীমাধবের সঙ্গে গল্প করে। ঝিল্লী পড়াশুনায় ভালো জেনে বৃদ্ধ সুখী হন; লাব্রণি নাচ শিখছে শুনেও তিনি অপ্রীত হন না। তিনি বয়সে প্রবীণ হলেও প্রাচীনপন্থী নন। সব মেয়েই যখন নাচছে তখন তাঁর নাতনী নাচবে না কেন?

দিন কুড়ি-পঁচিশ কাটবার পর হঠাৎ একদিন বেণীমাধবের শরীর খারাপ হলো; উদরাময়‌, পেটের যন্ত্রণা। ডাক্তার সেন এলেন‌, পরীক্ষা করে বললেন–খাওয়ার অত্যাচার হয়েছে‌, খাওয়া সম্বন্ধে ধরা-বাঁধার মধ্যে থাকতে হবে।’

বাড়ির সকলেই উপস্থিত ছিল। গায়ন্ত্রী শুকনো মুখে বলল–’কিন্তু ডাক্তারবাবু্‌, আমি তো বাবাকে এমন কিছু খেতে দিইনি। যাতে ওঁর শরীর খারাপ হতে পারে।’

ডাক্তার কোনো কথা বললেন না‌, ওষুধের প্রেসক্রিপশন ও পথ্যের নির্দেশ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন–’কেমন থাকেন আমি টেলিফোন করে খবর নেব।’

ডাক্তার চলে যাবার পর বেণীমাধব‌, আরতির পানে চেয়ে বললেন—’বৌমা‌, আমার পথ্য তৈরি করার ভার তোমার ওপর রইল।’

আরতি বিজয়োল্লাস চেপে বলল–’হ্যাঁ বাবা।’

তিন চার দিনের মধ্যে বেণীমাধব সেরে উঠলেন‌, তাঁর পেট ধাতস্থ হলো। পথ্য ছেড়ে তিনি স্বাভাবিক খাদ্য খেতে লাগলেন। আরতিই তাঁর জন্যে রান্না করে চলল।

কিন্তু বেণীমাধবের মন শান্ত নয়। চিরদিন নানা লোকের সঙ্গে নানা কাজে দিন কাটিয়েছেন‌, এখন তাঁর জীবন বৈচিত্র্যহীন। সকালে মেঘরাজ তাঁর দাড়ি কামিয়ে দেয়‌, তিনি স্নানাদি করে চা খেয়ে খবরের কাগজ নিয়ে বসেন। তাতে ঘন্টাখানেক কাটে। তারপর রেডিও চালিয়ে খানিকক্ষণ গান শোনেন। গান বেশিক্ষণ ভাল লাগে না‌, রেডিও বন্ধ করে বই এবং সাময়িক পত্রিকার পাতা ওলটান।

একদিন কলকাতার পুরনো বন্ধুদের কথা মনে পড়ে যায়। টেলিফোন ডিরেকটরি খুঁজে তাঁদের নাম বার করেন‌, টেলিফোন করে কাউকে পান না কাউকে পান; কিছুক্ষণ পুরনো কালের গল্প হয়। এগারোটার পর আরতি ভাতের থালা নিয়ে আসে। আহারের পর তিনি ঘন্টাখানেক বিছানায় শুয়ে দিবানিদ্রায় কাটান।

বিকেলবেলা ঝিল্লী কিংবা লাব্রণি আসে‌, তাদের সঙ্গে খানিক গল্প করেন। লাবণিকে বলেন–’কেমন নাচতে শিখেছিস দেখা।’

লাবনি বলে—’আমি এখনো ভাল শিখিনি দাদু‌, ভাল শিখলে তোমাকে দেখাব।’

বেণীমাধব বলেন–’তোর মাস্টার ভাল শেখাতে পারে?’

লাবণি গদগদ হয়ে বলে—’খুব ভাল শেখাতে পারেন। এত ভাল যে—? লজ্জা পেয়ে সে অর্ধপথে থেমে যায়।

বেণীমাধব প্রশ্ন করলেন–’কত বয়স মাস্টারের?’

‘তা কি জানি! হবে ছব্বিশ সাতাশ। যাই‌, মা ডাকছে।’ লাবনি তাড়াতাড়ি চলে যায়। সূৰ্য্যস্তের পর বেণীমাধব খোলা ছাদে অনেকক্ষণ পায়চারি করেন। ইচ্ছে হয় রবীন্দ্র সরোবরে গিয়ে লোকজনের মধ্যে খানিক বেড়িয়ে আসেন; কিন্তু তিনতলা সিঁড়ি ভাঙা তাঁর পক্ষে কষ্টকর‌, তাই ছাদে বেড়িয়েই তাঁর ব্যায়াম সম্পন্ন হয়।

রাত্ৰি ন’টার সময় আহার সমাপন করে তিনি শয়ন করেন। এই তাঁর দিনচযা। মেঘরাজ হামোহাল তাঁর কাছে হাজির থাকে; কখনো ঘরের মধ্যে কখনো দোরের বাইরে। তিনি শয়ন করলে মেঘরাজ নীচে গিয়ে আহার সেরে আসে; বেণীমাধবের দরজা ভেজিয়ে দিয়ে দরজার বাইরে আগড় হয়ে বিছানা পেতে শোয়।

এইভাবে দিন কাটছে। একদিন এক অধ্যাপক বন্ধুকে টেলিফোন করে বেণীমাধবের মুখ গভীর হলো। টেলিফোন রেখে তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন‌, তারপর মেঘরাজকে ডেকে বললেন—’তুমি নীচে গিয়ে মকরন্দকে ডেকে আনো।’

কয়েক মিনিট পরে মকরন্দ এসে দাঁড়াল। চাকরের মুখে তলব পেয়ে সে খুশি হয়নি‌, অপ্রসন্ন মুখে প্রশ্ন নিয়ে পিতামহের মুখের পানে চাইল। বেণীমাধব কিছুক্ষণ তার উষ্ণখুষ্ক চেহারার পানে তাকিয়ে রইলেন‌, তারপর জিজ্ঞেস করলেন–’তুমি কলেজে ঢুকেছ‌, লেখাপড়া কেমন হচ্ছে?’

মকরুন্দর মুখ ভ্রূকুটি-গভীর হলো—’হচ্ছে এক রকম।’

বেণীমাধব বললেন—’শুনলাম তুমি ক্লাসে যাও না‌, দল পাকিয়ে পলিটিক্স করে বেড়াও‌, এ কথা সত্যি?’

উদ্ধত স্বরে মকরন্দা বলল-‘কে বলেছে?’

মাধব কড়া সুরে বললেন-কে বলেছে সে কথায় তোমার দরকার নেই। কথাটা সত্যি কিনা?

‘হ্যাঁ সত্যি।’ মকরন্দ চোখ লাল করে ঠাকুরদার পানে চেয়ে রইল।

‘বটে!’ বেণীমাধবের চোখেও রাগের ফুলকি ছিটকে পড়ল–’তুমি বেয়াদবি করতে শিখেছি।–মেঘরাজ!’

মেঘরাজ দোরের বাইরে ছিল‌, ঘরে ঢুকল। বেণীমাধবী আঙুল দেখিয়ে বললেন—’এই ছোঁড়ার কান ধরে গালে একটা থাবড়া মারো‌, তারপর ঘাড় ধরে বার করে দাও।’

মেঘরাজ সিপাহী ছিল‌, সে হুকুমের চাকর। যথারীতি মকরন্দর কান ধরে গালে চড় মারল। মকরন্দর মনে যতই ধৃষ্টতা থাক, মেঘরাজের সঙ্গে হাতাহাতি করবার সাহস বা দৈহিক শক্তি তার নেই‌, সে ধাক্কা খেতে খেতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

কথাটা আর চাপা রইল না। অজয় আর আরতি ছুটে এসে বেণীমাধবের কাছে ক্ষমা চাইল। বেণীমাধব গভীর হয়ে রইলেন‌, শেষে বললেন–‘বংশে একটা মাত্র ছেলে‌, সে বেল্লিক বেয়াদব হয়ে উঠেছে। দোষ তোমাদের‌, তোমারা ছেলে শাসন করতে জানো না।’

ব্যাপারটা আর বেশিদূর গড়াল না।

তারপর একদিন বিকেলবেলা সনৎ এল মামার সঙ্গে দেখা করতে। সনৎ আর নিখিল মাঝে মাঝে এসে মামার কাছে বসে‌, সসন্ত্রমে মামার কুশল প্রশ্ন করে চলে যায়। আজ সনৎ তার ক্যামেরা নিয়ে এসেছে‌, বলল–’মামা‌, আপনার একটা ছবি তুলব।’

বেণীমাধব হেসে বললেন—’আমি বুড়ো মানুষ‌, আমার ছবি তুলে কি হবে।’

সনৎ বলল–’আমার অ্যালবামে রাখব।’

‘কিন্তু এখন আলো কমে গেছে‌, এ আলোতে ছবি তোলা যাবে?’

‘যাবে। আমি ফ্ল্যাশ বালব এনেছি।’

‘বেশ‌, তোলো।’ বেণীমাধব একটি হেলান দেওয়া চেয়ারে বসলেন।

সনৎ ছবি তোলার উপক্রম করছে এমন সময় নিখিল এসে দাঁড়াল। সনৎ এদিক ওদিক ঘুরে শেষে একটা বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে ছবি তুলল; বালবটা একবার জ্বলে উঠেই নিভে গেল। নিখিল বলল-সনৎদা‌, ছবি তৈরি হলে আমাকে একখানা দিও‌, আমি কাগজে ছাপাব। মামা কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন‌, কলকাতায় এসে স্থায়ীভাবে আছেন‌, খবরটা প্রকাশ করা দরকার।’

বেণীমাধব মনে মনে ভাগনেদের ওপর খুশি হলেন।

পরদিন সনৎ ছবি এনে বেণীমাধবকে দেখাল। ছবিটি ভাল হয়েছে; বেণীমাধবের জরাক্রান্ত মুখ শিল্পীর নৈপুণ্যে শান্ত কোমল ভােব ধারণ করেছে। সনৎ যে কৌশলী শিল্পী তাতে সন্দেহ নেই।

বেণীমাধব বললেন—’বেশ হয়েছে। এটাকে বাঁধিয়ে কোথাও টাঙিয়ে রাখলেই হবে।’

সনৎ বলল–’আমি এনলার্জ করে ফ্রেমে বাঁধিয়ে এনে দেব। নিখিলকে এক কপি দিয়েছি‌, সে কাগজে ছাপবে।’

অতঃপর বেণীমাধবের কর্মহীন মন্থর দিনগুলি কাটছে। সনৎ বড় ছবি ফ্রেমে বাঁধিয়ে ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে দিয়ে গেছে। কাগজে তাঁর ছবি ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় বেরিয়েছে। এরকম অবস্থায় বৃদ্ধ বয়সে মানুষ শান্তি ও স্বচ্ছন্দতা লাভ করে। কিন্তু বেণীমাধবের মনে শান্তি স্বচ্ছন্দতা আসছে না। ছেলে ও মেয়ের পরিবারের সঙ্গে একটানা সান্নিধ্য তিনি উপভোগ করতে পারছেন। না। পারিবারিক জীবনের স্বাদ ভুলে গিয়ে যাঁরা দীর্ঘকাল একলা পথে চলেছে তাঁদের বোধহয় এমনিই হয়।

ওদিকে ছেলে এবং মেয়ের পরিবারেও সুখ নেই; গায়ত্রীর মেজাজ সর্বদাই তিরিক্ষি হয়ে থাকে। গঙ্গাধর সারা দিন বসে একা একা তাস খেলে‌, সলিটেয়ার খেলা; সন্ধ্যের সময় চুপি চুপি বেরিয়ে যায়‌, আবার বেশি রাত্রি হবার আগেই ফিরে আসে। অজয় ক্লাবে গিয়ে অনেক রাত্রি পর্যন্ত আডা জমাত কিংবা রিহাসেল দিতা; এটা ছিল তার জীবনের প্রধান বিলাস। এখন তাকে রাত্রি ন’টার মধ্যে বাড়ি ফিরতে হয়‌, কারণ কর্তার হুকুম-নাটার পর সদর দরজা খোলা থাকবে না। ন’টার পর বাড়ি ফিরে দোর ঠেলাঠেলি করলে তেতলায় শব্দ যাবে‌, সেটা বাঞ্ছনীয় নয়। সকলেরই একটা চোখ এবং একটা কান তেতলার দিকে সতর্ক হয়ে থাকে। আরতি যদিও সর্বদাই শ্বশুরকে খুশি করবার চেষ্টা করছে‌, তবু নিশ্চিন্ত হতে পারছে না।

নিশ্চিন্ত আছে কেবল দোতলায় দু’টি মেয়ে‌, লাব্রণি আর ঝিল্লী্‌্‌, এবং নীচের তলায় সনৎ ও নিখিল। ঝিল্লী আর লাবণির বয়স মাত্র আঠারো‌, বিষয়বুদ্ধি এখানো পরিপক্ক হয়নি। সনৎ আর নিখিলের বেলায় পরিস্থিতি অন্যরকম; মামা তাদের বাড়িতে থাকতে দিয়েছেন বট, কিন্তু তারা মামার কাছে অর্থ-প্রত্যাশী নয়। সনতের গোপন নৈশাভিসারের কথা বেণীমাধব জানতে পারবেন। এমন কোনো সম্ভাবনা নেই। নিখিলের ওসব দোষ নেই‌, উপরন্তু কয়েক মাস থেকে সে এক নতুন ব্যাপারে মশগুল হয়ে আছে।

বেণীমাধব কলকাতায় এসে বসবার আগে একদিন নিখিল হঠাৎ ডাকে একটা চিঠি পেল‌, খামের চিঠি। তাকে চিঠি লেখবার লোক কেউ নেই‌, সে একটু আশ্চর্য হয়ে চিঠি খুলল। এক পাতা কাগজের ওর দু’ছত্র লেখা আছে—

আমি একটি মেয়ে। তোমাকে ভালবাসি।–

চিঠির নীচে লেখিকার নাম নেই।

নিখিল কিছুক্ষণ বোকার মত চেয়ে রইল। তারপর তার মুখে গদগদ হাসি ফুটে উঠল। একটা মেয়ে তাকে ভালবাসে! বা রে! ভারি মজা তো!

কিন্তু কে মেয়েটা?

নিখিল খামের ওপর পোস্ট অফিসের সীলমোহর পরীক্ষা করল; সীলমোহরের ছাপ জেবড়ে গেছে‌, তবু কলকাতায় চিঠি ডাকে দেওয়া হয়েছে এটুকু বোঝা যায়। কলকাতার মেয়ে। কে হতে পারে? চিঠিই বা লিখলি কেন? ভালবাসা জানাবার আরো তো অনেক সোজা উপায় আছে। মুখে বলতে লজ্জা হয়েছে তাই চিঠি! কিন্তু নিজের নাম লেখেনি কেন?

নিখিল অনেক মেয়েকে চেনে। তার অফিসেই তো গোটা দশেক আইবুড়ো মেয়ে কাজ করে। তাছাড়া বন্ধুবান্ধবের বোনেরা আছে। মেয়েরা তার চটুল রঙ্গপ্রিয় স্বভাবের জন্যে তার প্রতি অনুরক্ত‌, তাকে দেখলেই তাদের মুখে হাসি ফোটে। কিন্তু কেউ তাকে চুপিচুপি ভালবাসে বলেও তো মনে হয় না। আর এত লজ্জাবতীও কেউ নয়।

হাতে চিঠি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিখিল এইসব ভাবছে এমন সময় পিছন দিক থেকে লাবণর গলা শুনতে পেল–’কি নিখিল কাকা‌, কার চিঠি পড়ছ?’

নিখিল ফিরে দাঁড়াল। ঝিল্লী আর লাব্রণি কখন দোতলা থেকে নেমে এসেছে; তাদের হাতে কয়েকখানা বই। তারা একসঙ্গে লাইব্রেরিতে যায় বই বদল করতে।

নিখিল হাত উঁচুতে তুলে নাড়তে নাড়তে বলল—’কার চিঠি! একটি যুবতী আমাকে চিঠি লিখেছে।’ বলে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াল।

লাবনি বলল—’যুবতী লিখেছে! কী লিখেছে?’

নিখিল বলল—’হুঁ হুঁ, দারুণ ব্যাপার‌, গুরুতর ব্যাপার। লিখেছে সে আমাকে ভালবাসে।’

লাবণি আর ঝিল্লী অবাক হয়ে পরস্পরের পানে তাকাল‌, তারপর হেসে উঠল। লাবণি বলল–’কোন গুল মারছ নিখিল কাকা। তোমাকে আবার কোন যুবতী ভালবাসবে?’

নিখিল চোখ পাকিয়ে বলল–’কেন‌, আমাকে কোনো যুবতী ভালবাসতে পারে না! দেখেছিস আমার চেহারাখানা।’

‘দেখেছি। এখন বলো কার চিঠি।’

‘বললাম না যুবতীর চিঠি!’

ঝিল্লী প্রশ্ন করল–’যুবতীর নাম কি?’

নিখিল মাথা চুলকে বলল–’নাম! জানি না। চিঠিতে নাম নেই।’

বিল্লী আর লাব্রণি আবার হেসে উঠল। লাব্রণি বলল–’তোমার একটা কথাও আমরা বিশ্বাস করি না। নিশ্চয় পাওনাদারের চিঠি।’

‘পাওনাদারের চিঠি! তবে এই দ্যাখ।।’ নিখিল চিঠিখানা তাদের নাকের সামনে ধরল।

দু’জনে চিঠি পড়ল। লাব্রণি বলল—’হঁ। কিন্তু চিঠি পড়েও বিশ্বাস হচ্ছে না যে‌, একটা মেয়ে তোমাকে প্রেম নিবেদন করেছে। আমার মনে হয়। কেউ তোমার ঠ্যাং ধরে টেনেছে‌, মানে লেগ-পুলিং।’

নিখিল একটু গরম হয়ে বলল–’যা যা‌, তোরা এসব কী বুঝবি! এসব গভীর ব্যাপার। প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে‌, শুনেছিস কখনো?’

‘শুনেছি।’ ঝিল্লী আর লাব্রণি মুখ টিপে হাসতে হাসতে চলে গেল।

এর পর থেকে যখনি কোনো মেয়ের সঙ্গে দেখা হয় নিখিল উৎসুক চোখে তার পানে তাকায় কিন্তু কোনো সাড়া পায় না। তার মন আরো ব্যগ্র হয়ে ওঠে। কে মেয়েটা? নিশ্চয় তার পরিচিত। তবে এমন লুকোচুরি খেলছে। কেন?

মাসখানেক পরে দ্বিতীয় চিঠি এল। এবার একটু বড়—

আমি একটি মেয়ে। তোমাকে ভালবাসি। আমাকে চিনতে পারলে না?

চিঠি পেয়ে নিখিলের মন উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। লাব্রণি আর ঝিল্লী হাতের কাছে নেই‌, কিন্তু কাউকে না বলেও থাকা যায় না‌, তাই সে ঝোঁকের মাথায় সনতের ঘরে গেল।

সনতের ঘরটি বেশ বড়; এই একটি ঘরের মধ্যে তার একক জীবনের সমস্ত প্রয়োজনীয় সামগ্ৰী সঞ্চিত আছে। এক পাশে খাটের ওপর পুরু গদির বিছানা পাতা; খাটের শিথানের কাঠের ওপর বিচিত্র জাফরির কারুকার্য। ঘরের অন) পাশে জানালার সামনে দেরাজযুক্ত টেবিল‌, তার ওপর ফটোগ্রাফির নানা সরঞ্জাম সাজানো; তিনটি হাতে-তোলা ক্যামেরা‌, তার মধ্যে একটি সিনো-ক্যামেরা। ঘরে একটি আয়নার ব্লকবাটযুও আলমারিও আছে। ঘরটি ছিমছাম ফিটফাঁট‌, দেখে বোঝা যায়। সনৎ গোছালো এবং শৌখিন মানুষ।

নিখিল যখন ঘরে ঢুকাল তখন সনৎ টেবিলের সামনে চেয়ারে বসে একটা ক্যামেরার যন্ত্রপাতি খুলে পরীক্ষা করছিল‌, চোখ তুলে চেয়ে আবার কাজে মন দিল। নিখিল গম্ভীর মুখে বলল–’সনৎদা‌, গুরুতর ব্যাপার।’

সনৎ একবার চকিতে চোখ তুলাল‌, বলল–’তোমার জীবনে গুরুতর ব্যাপার কী ঘটতে পারে! আমাশা হয়েছে?’

নিখিল বলল–’আমাশা নয়‌, একটা মেয়ে আমার প্রেমে পড়েছে।’

এবার সনৎ বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে রইল। শেষে বলল–’আমাশা নয়‌, দেখছি তোমার মাথার ব্যারাম হয়েছে। বাংলা দেশে এমন মেয়ে নেই যে তোমার প্রেমে পড়বে।’

নিখিল বলল–’বিশ্বাস হচ্ছে না? এই দেখা চিঠি। মাসখানেক আগে আর একটা পেয়েছি।’

চিঠি নিয়ে সনৎ একবার চোখ বুলিয়ে ফেরত দিল‌, প্রশ্ন করল—’মেয়েটাকে চেনো না?’

‘না‌, সেই তো হয়েছে মুশকিল।’

সনৎ একটু চুপ করে রইল‌, তারপর বলল—’বুঝেছি! তোমার চেনা-শোনার মধ্যে কোনো কালো কুচ্ছিত মেয়ে আছে?’

নিখিল হেসে বলল—’বেশির ভাগই কালো কুচ্ছিত সনৎদা।’

সনৎ বলল–’তাহলে ওই কালো কুচ্ছিত মেয়েদের মধ্যেই একজন বেনামী চিঠি লিখে রহস্য সৃষ্টি করছে। তোমাকে তাতাবার চেষ্টা করছে। তোমার ঘটে যদি বুদ্ধি থাকে ওদের এড়িয়ে চলবে।’

কিন্তু এড়িয়ে চলার ক্ষমতা নিখিলের নেই। তাছাড়া কালো কুচ্ছিত মেয়ের প্রতি তার বিরাগ নেই। তার বিশ্বাস কালো কুচ্ছিত মেয়েরা ভালো বৌ হয়। সে চতুৰ্থণ আগ্রহে অনামা প্রেমিকাকে খুঁজে বেড়াতে লাগল।

তারপর বেণীমাধব এলেন‌, বাড়ির আবহাওয়া বদলে গেল। কিন্তু নিখিলের কাছে নিয়মিত চিঠি আসতে লাগল। তৃতীয় চিঠিতে লেখা হয়েছে—

আমি তোমাকে ভালবাসি। আমাকে চিনতে পারলে না? আমি কিন্তু সুন্দর মেয়ে নই।

নিখিল ভাবল‌, সনৎদা ঠিক ধরেছে। কিন্তু সে দমল না। তার জীবনে এক অভাবিত রোমান্স এসেছে; একে তুচ্ছ করার সাধ্য তার নেই।

ওদিকে বেণীমাধব হগুপ্ত তিনেক পুত্রবধূর হাতের রান্না খেয়ে বেশ ভালই রইলেন। তারপর একদা গভীর রাত্রে ওঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল; পেটে দারুণ যন্ত্রণা। যাতনায় ছটফট করতে করতে মেঘরাজকে ডাকলেন। বেণীমাধব দুহাতে পেট চেপে ধরে বসেছিলেন‌, বললেন—’মেঘরাজ‌, শীগগির ডাক্তার সেনকে ফোন করো‌, বলো আমি পেটের যন্ত্রণায় মরে যাচ্ছি‌, এখনি যেন আসেন।’

মেঘরাজ ফোন করল‌, আধা ঘণ্টার মধ্যে ডাক্তার সেন এলেন। জিজ্ঞাসাবাদ করে চিকিৎসা আরম্ভ করলেন। পেটের প্রদাহ। কিন্তু সহজে উপশম হলো না; রাত্ৰি পাঁচটা পর্যন্ত ধস্তাধস্তির পর ব্যথা শান্ত হলো। বেণীমাধব নিজীব দেহে বিছানায় শুয়ে বিস্ফারিত চোখে ডাক্তারের পানে চাইলেন—’ডাক্তার‌, কেন এমন হলো বলতে পার?’

ডাক্তার গম্ভীর মুখে ক্ষণেক চুপ মেরে রইলেন‌, তারপর অনিচ্ছাভরে বললেন-‘নিঃসংশয়ে কলামুক্ত। অ্যালারজি হতে পারে‌, শূল ব্যথা হতে পারে‌, কিংবা-’

‘কিংবা-?’

‘কিংবা বিষের ক্রিয়া। —আমি বলি কি‌, আপনি কিছুদিন আমার নার্সিং হোমে থাকবেন। চলুন। চিকিৎসা পথ্য দুইই হবে।’

বেণীমাধবের কিন্তু নার্সিং হোমে বিশ্বাস নেই; তাঁর ধারণা যারা একবার নার্সিং হোমে ঢুকেছে। তারা আর ফিরে আসে না। তিনি যথাসম্ভব দৃঢ়স্বরে বললেন—’না ডাক্তার‌, আমি বাড়িতেই থাকব।’

ডাক্তার উঠলেন–’আচ্ছা‌, এখন চলি। যদি আবার কোনো গণ্ডগোল হয় তৎক্ষণাৎ খবর দেবেন। কাল আর পরশু স্রেফ দই খেয়ে থাকবেন।’

মেঘরাজ ডাক্তারের সঙ্গে নীচে পর্যন্ত গিয়ে সদর দরজা খুলে দিল‌, ডাক্তার চলে গেলেন। মেঘরাজ দরজা বন্ধ করে আবার ওপরে উঠে এল। বাড়ির অন্য মানুষগুলো তখনো ঘুমোচ্ছে‌, ডাক্তারের আসা-যাওয়া জানতে পারল না।

বিছানায় শুয়ে বেণীমাধব তখন শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে চিন্তা করছিলেন। দুরূহ দুৰ্গম চিন্তা। পুত্ৰাদপি ধনভাজাং ভীতি। একবার নয়‌, দু-দু’বার এই ব্যাপার হলো…ছেলে আর মেয়ে অপেক্ষা করে আছে। আমি কবে মরব…আমি মরছি না দেখে অধীর হয়ে উঠেছে! কিন্তু ছেলে মেয়ে জামাই পুত্রবধূ এমন কাজ করতে পারে? কেন করবে না‌, সংসারে টাকাই খাঁটি জিনিস‌, আর যা-কিছু সব ভুয়ো। ডাক্তারের মনেও সন্দেহ ঢুকেছে..

সকাল সাতটার সময় বেণীমাধব বিছানায় উঠে বসলেন‌, মেঘরাজ তাঁর দাড়ি কামিয়ে দিল। তারপর তিনি তার হাতে টাকা দিয়ে বললেন-যাও‌, বাজার থেকে দই কিনে নিয়ে এসো। এক সের ভাল দই।‘

টাকা নিয়ে মেঘরাজ চলে গেল। সে সৈনিক‌, হুকুম তামিল করে‌, কথা বলে না। তার মুখ দেখেও কিছু বোঝা যায় না।

সাড়ে সাতটার সময় আরতি এল‌, তার সঙ্গে বিগ্ন ট্রের ওপর চা ও প্রাতরাশ নিয়ে এসেছে। ঘরে ঢুকেই আরতি চমকে উঠল; বেণীমাধব বিছানায় বসে একদৃষ্টি তার পানে চেয়ে আছেন। সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল—’বাবা–’

বেণীমাধব ধীর স্বরে বললেন–বৌমা‌, খাবার ফিরিয়ে নিয়ে যাও; আজ থেকে আমার খাবার ব্যবস্থা আমি নিজেই করব।’

আরতির মুখে ভয়ের ছায়া পড়ল—’কোন বাবা?

বেণীমাধব গত রাত্রির ঘটনা বললেন। আরতি শুনে মুখ কালি করে চলে গেল।

কথাটা ঝিয়ের মুখে অচিরাৎ প্রচারিত হলো। শুনে গায়ত্রী ছুটতে ছুটতে বাপের কাছে এল—’বাবা‌, বৌদির রান্না তোমার সহ্য হবে না। আমি জানতুম। আজ থেকে আমি আবার রাঁধব।’

বেণীমাধব মেয়েকে আপাদমস্তক দেখে কড়া সুরে বললেন—’না-’

বেলা তিনটের সময় তিনি কর্তব্য স্থির করে বিছানায় উঠে বসে ডাকলেন-‘মেঘরাজ!’

মেঘরাজ এসে দাঁড়াল–’জি।’

বেণীমাধব প্রশ্ন করলেন—’তোমার বৌ আছে?’

মেঘরাজ ভ্রূ তুলে খানিক চেয়ে রইল‌, যেন প্রশ্নের তাৎপর্য বোঝবার চেষ্টা করছে-‘জি‌, আছে।’

‘ছেলেপুলে?’

‘জি‌, না। ‘

‘স্ত্রী নিশ্চয় রসুই করতে জানে?’

‘জি‌, জানে।’

‘বেশ। এখন আমার প্রস্তাব শোনো। তুমি দেশে গিয়ে তোমার ঔরৎকে নিয়ে এসো। নীচের তলায় খালি ঘর আছে‌, তার একটাতে তোমরা থাকবে। তোমার ঔরৎ আমার রসুই করবে। আমি তোমার মাইনে ডবল করে দিলাম। তুমি কাল সকালে প্লেনে দিল্লী চলে যাও‌, বৌকে নিয়ে যত শীগগির পর ফিরে আসবে; প্লেনের ভাড়া ইত্যাদি সব খরচ আমি দেবো। কেমন?’

‘জি’

‘বেশ; নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু তুমি যতদিন ফিরে না। আসছ ততদিনের জন্যে আমার রসদ দরকার। এই নাও টাকা‌, বাজারে গিয়ে আরো সের দুই দই‌, কড়া পাকের সন্দেশ‌, গোটা দুই বড় পাউরুটি‌, মাখন‌, মারমালোড‌, টিনের দুধ‌, আঙুর‌, আপেল-এই সব কিনে নিয়ে এসো‌, ফ্রিজে থাকবে। তুমি বাজারে যাও, আমি ইতিমধ্যে টেলিফোনে তোমার এয়ার-টিকিটের ব্যবস্থা করছি।‘–

পরদিন মেঘরাজ চলে গেল। বেণীমাধব একলা রইলেন। দই এবং অন্যান্য সাত্ত্বিক আহারের ফলে দু-তিন দিনের মধ্যেই তাঁর পেট সুস্থ হলো। তিনি অবসর বিনোদনের জন্য ডাক্তার সেন ও অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে টেলিফোনে গল্প করেন। ঘরের মধ্যে কারুর যাওয়া-আসা নেই। দরজা সর্বদা বন্ধ থাকে।

চতুর্থ দিন মেঘরাজ ফিরে এল। সঙ্গে বৌ।

বৌ-এর পরনে রঙিন শাড়ি‌, মুখে ঘোমটা। মেঘরাজ বেণীমাধবের ঘরে গিয়ে বৌ-এর মুখ থেকে ঘোমটা সরিয়ে দিল। বেণীমাধব দেখলেন‌, একটি মিষ্টি হাসি-হাসি মুখ। রঙ ময়লা‌, কাজল-পরা চোখে যৌবনের মাদকতা। মেঘরাজের অনুপাতে বয়স অনেক কম‌, কুড়ি-বাইশের বেশি নয়। বৌ দু’হাত দিয়ে বেণীমাধবের পা ছুঁয়ে নিজের মাথায় ঠেকাল।

বেণীমাধব প্রসন্ন হয়ে বললেন–বেশ বেশ। কি নাম তোমার?’

বৌ বলল-‘মেদিনী।’

অতঃপর বেণীমাধবের স্বাধীন সংসারযাত্রা আরম্ভ হয়ে গেল। নীচের তলায় কোণের একটা ঘরে মেঘরাজ ও মেদিনীর বাসস্থান নির্দিষ্ট হলো। তেতিলায় একটা ঘর রান্নাঘরে পরিণত হয়েছে‌, বাসন-কোসন এসেছে; সকালবেলা মেদিনী নীচের ঘর থেকে ওপরে উঠে এসে বেণীমাধবের চা টেস্ট তৈরি করে দেয়। ইতিমধ্যে মেঘরাজ গড়িয়াহাট থেকে বাজার করে আনে। রান্না আরম্ভ হয়; তিনজনের রান্না। খাওয়াদাওয়া শেষ হলে মেদিনী নীচে নিজের ঘরে চলে যায়‌, মেঘরাজ ওপরে পাহারায় থাকে। বিকেলবেলা থেকে আবার চা ও রান্নার পর্ব আরম্ভ হয়; রাত্রি আটটার সময় সকলের নৈশাহার শেষ হলে মেদিনী রাত্রির মত নীচে চলে যায়; বেণীমাধব তুষ্ট মনে শয্যা

এই হলো তাদের দিনচর্যা।

মেদিনীর দুপুরবেলা কোনো কোজ নেই‌, সেই অবসরে সে বাড়ির অন্য সকলের সঙ্গে পরিচিত হয়েছে। সকলেই তার প্রতি আকৃষ্ট; বিশেষত পুরুষেরা। তার আচরণে শালীনতা আছে সংকোচ নেই; তার কথায় সরসতা আছে প্রগলভতা নেই। সকলেই তার কাছে স্বচ্ছন্দতা অনুভব করে। সে আসার পর থেকে বাড়িতে যেন নতুন সজীবতা দেখা দিয়েছে। গায়ত্রী এবং আরতির মন আগে থাকতে মেদিনীর প্রতি বিমুখ ছিল‌, কিন্তু ক্রমশ তাদের বিমুখতা অনেকটা দূর হয়েছে। কেবল মকরন্দ মেদিনীর সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন; মেদিনীর যখন অবসর মকরন্দ তখন বাড়িতে থাকে না।

বাড়িতে আস্তে আস্তে সহজ ভাব ফিরে এল। বেণীমাধব এখন নিজেকে অনেকটা নিরাপদ বোধ করছেন। তবু তাঁর মনের ওপর যে ধাক্কা লেগেছে তার জের এখনো কাটেনি। গভীর রাত্রে তাঁর ঘুম ভেঙে যায়। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে তিনি ভাবেন-আমার নিজের ছেলে নিজের মেয়ে আমার মৃত্যু কামনা করে। এ কি সম্ভব‌, না। আমার অলীক সন্দেহ? অনেকক্ষণ জেগে থেকে তিনি নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে ওঠেন‌, নিঃশব্দে ভেজানো দরজা একটু ফাঁক করে দেখেন‌, বাইরে মেঘরাজ দরজা আগলে ঘুমোচ্ছে। আশ্বস্ত মনে তিনি বিছানায় ফিরে যান।

মেদিনী আসার পর আর একটা সুবিধা হয়েছে। কলকাতার রেওয়াজ অনুযায়ী সদর দরজা সব সময়েই বন্ধ থাকে‌, কেবল যাতায়াতের সময় খোলা হয়। আগে বাইরে থেকে কেউ এলে দোর-ঠেলা ঠেলি হাঁকা হাঁকি করতে হতো‌, এখন তা করতে হয় না। মেদিনীর ঘর সদর দরজার ঠিক পাশেই‌, রাত্ৰিবেলা বাইরে থেকে কেউ দরজায় টোকা দিলেই মেদিনী এসে দরজা খুলে দেয়।

মহাকবি কালিদাস লিখেছেন-হ্রদের প্রসন্ন উপরিভাগ দেখে বোঝা যায় না। তার গভীর তলদেশে হিংস্ব জলজন্তু ঘুরে বেড়াচ্ছে।

মাসখানেক কাটল। ইতিমধ্যে বাড়িতে ছোটখাটো কয়েকটা ঘটনা ঘটেছিল যা উল্লেখযোগ্য—

নিখিল আবার অদৃশ্য নায়িকার চিঠি পেয়েছে—আমি তোমাকে ভালবাসি। তুমি হাসতে জানো‌, হাসাতে জানো। আমাদের বাড়িতে কেউ হাসে না। তুমি আমাকে বিয়ে করবে?

চিঠি পেয়ে নিখিল আহ্বাদে প্রায় দড়ি-ছেড়া হয়ে উঠল; চিঠি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নিজের ঘরে পাগলের মত দাপাদাপি করল‌, তারপর সনতের ঘরে গেল। নিখিলের ঘরটা আকারে-প্রকারে সনতের অনুরূপ‌, কিন্তু অত্যন্ত অগোছালো। তক্তপোশের ওপর বিছানাটা তাল পাকিয়ে আছে‌, টেবিলের ওপর ধুলোর পুরু প্রলেপ। দেখে বোঝা যায়—এ ঘরে গৃহিণীর করম্পর্শের প্রয়োজন আছে।

সনৎ তখন ক্যামেরা নিয়ে বেরুচ্ছিল। নিখিল বলল–’এ কি সনৎদা‌, সাজিত-গুজ্জিত হয়ে চলেছ কোথায়?’

সনৎ বলল–’গ্র্যান্ড হোটেলে পার্টি আছে। হাতে ওটা কি?’

নিখিল চিঠি তুলে ধরে বলল–’আবার চিঠি পেয়েছি‌, পড়ে দেখ। এ মেয়ে কালো কুচ্ছিত হোক‌, কানা খোঁড়া হোক‌, একেই আমি বিয়ে করব।’

সনৎ চিঠি পড়ে বলল–’হুঁ, কানা-খোঁড়াই মনে হচ্ছে। তা বিয়ে করতে চাও কর না‌, কে তোমাকে আটকাচ্ছে। কিন্তু তার আগে মেয়েটাকে খুঁজে বার করতে হবে তো।’

সনৎ নিজের ঘরে তালা বন্ধ করল। মেঘরাজের ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখল মেদিনী ঘরে রয়েছে। সনৎ একবার দাঁড়িয়ে বলল–’মেদিনী‌, আজ আমার ফিরতে দেরি হবে। একটা পার্টিতে ফটো তুলতে যাব‌, কখন ফিরব ঠিক নেই। আমি দোরে টোকা দিলে দোর খুলে দিও।‘

মেদিনী নিজের দোরের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে এখন বাংলা ভাষা বেশ বুঝতে পারে‌, কিন্তু বলতে পারে না। চোখ নীচু করে সে নম্রস্বরে বলল—’জি।’

সনৎ বেরিয়ে যাওয়ার পর নিখিল মেদিনীর কাছে এসে দাঁড়াল‌, বলল—’মেদিনী‌, তুম জানতা হ্যায়‌, একঠো লেড়কি হামকে ভালবাসামে গির গিয়া। হাম উসকে শান্দি করেগা।’

মেদিনীর চোখে কৌতুক নেচে উঠল‌, সে আচল দিয়ে হাসি চাপা দিতে দিতে দোর ভেজিয়ে দিল।

মেদিনী আসার পর থেকে গঙ্গাধরের চিত্ত চঞ্চল হয়েছে। বয়সটা খারাপ; যৌবন বিদায় নেবার আগে মরণ-কামড় দিয়ে যাচ্ছে। গঙ্গাধর যখন বিকেলবেলা বাইরে যায় তখন মেদিনীর দোরের দিকে তাকাতে তাকাতে যায়‌, কদাচ মেদিনীর সঙ্গে চোখাচৌখি হলে চোখ সরিয়ে নেয় না‌, একদৃষ্টি চেয়ে থাকে; মেদিনী চৌকাঠে ঠেস দিয়ে চোখ নীচু করে তার দৃষ্টিপ্রসাদ গ্রহণ করে। পুরুষের লুব্ধ দৃষ্টিতে সে অভ্যস্ত।

অজয়ের ভাবভঙ্গী একটু অন্যরকম। সে যেন মেদিনীকে দেখে বাৎসল্য স্নেহ অনুভব করে; তার সঙ্গে পাটিচটি গল্প করে‌, তার দেশের খবর নেয়। মেদিনী সরলভাবে কথা বলে‌, মনে মনে হাসে।

মকরন্দ প্রথমদিকে কিছুদিন মেদিনীকে দেখেনি। একবার তিন-চারদিন সে বাড়ি ফিরল না; জানা গেল পুলিস ভ্যান লক্ষ্য করে ইট ছোঁড়ার জন্যে পুলিসে ধরে নিয়ে গেছে। চতুর্থ দিন সে মুক্তি পেয়ে রাত্রি সাড়ে দশটার সময় এসে বাড়ির সদর দরজায় ধাক্কা দিল। মেদিনী গিয়ে দোর খুলল। মকরন্দর চেহারা শুকনো‌, জামা ছেড়া‌, চুল উষ্ণখুষ্ক; সে তীব্র দৃষ্টিতে মেদিনীর পানে চেয়ে রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন করল—’তুমি কে?’

‘আমি মেদিনী।’

‘অ-মেঘরাজের বৌ।’ কুটিলভাবে মুখ বিকৃত করে সে মেদিনীকে আপাদমস্তক দেখল‌, তারপর সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গেল। মেদিনী জানত মকরুন্দ কে‌, সে মুখ টিপে হেসে নিজের ঘরে ফিরে গেল।–

তিন মাস কেটে যাবার পরও যখন বেণীমাধবের পেটের আর কোনো গণ্ডগোল হলো না তখন তিনি নিঃসংশয়ে বুঝলেন তাঁর পেটের কোনো দোষ নেই‌, হজম করার শক্তি অক্ষুন্ন আছে। পুত্রবধূ এবং মেয়ের প্রতি তাঁর সন্দেহ নিশ্চয়তায় পরিণত হলো। তারপর একদা গভীর রাত্রে বিভীষিকাময় স্বপ্ন দেখে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল। কে যেন ছুরি দিয়ে পেঁচিয়ে পেচিয়ে তার গলা কাটছে।

তারপর তিনি আর ঘুমোতে পারলেন না। বাকি রাত্রিটা চিন্তা করে কাটালেন। মৃত্যুভয়ে জড়িত। ঐহিক চিন্তা।

পরদিন বেলা সাড়ে দশটার সময় তিনি তাঁর সলিসিটারকে টেলিফোন করলেন—’সুধাংশুবাবু্‌, আমি উইল করতে চাই। বেশি নড়াচড়ার ক্ষমতা নেই‌, আপনি একবার আসবেন?

বেণীমাধব পুরনো মক্কেল‌, মালদার লোক। সুধাংশুবাবু বললেন—’বিকেলবেলা যাব।’

বিকেলবেলা সুধাংশুবাবু এলেন। দোর বন্ধ করে দু’জনে প্রায় দেড় ঘন্ট উইলের শতাদি আলোচনা করলেন; সুধাংশুবাবু অনেক নোট করলেন। শেষে বললেন—‘পরশু আমি উইল তৈরি করে নিয়ে আসব‌, আপনি উইল পড়ে দস্তখত করে দেবেন। দু’জন সাক্ষীও আমি সঙ্গে আনব।’–

সন্ধ্যের পর সনৎ আর নিখিল বেণীমাধবের কাছে এসে বসল‌, কুশল প্রশ্ন করল। মেদিনী পাশের ঘরে রান্না করছিল; বেণীমাধব ভাগনেদের চা ও আলুভাজা খাওয়ালেন।

ওরা চলে যাবার পর বেণীমাধব মেঘরাজকে ডেকে বললেন-‘‘দোতলা থেকে সকলকে ডেকে নিয়ে এসে।’

দোতলায় মকরন্দ ছাড়া আর সকলেই ছিল‌, সমান পেয়ে ছুটে এল। ঝিল্লী আর লাবণিও এল। বেণীমাধব খাটের ধারে বসেছিলেন‌, দুই নাতনীকে ডেকে নিজের দু’ পাশে বসলেন‌, তারপর ছেলে-বৌ মেয়ে-জামাই-এর পানে চেয়ে গম্ভীর গলায় বললেন–’আমি উইল করতে দিয়েছি। উইলের ব্যবস্থা আগে থাকতে তোমাদের জানিয়ে দিতে চাই।’

সকলে সশঙ্ক মুখে চেয়ে রইল। বেণীমাধব ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন—’আমার মৃত্যুর পর আমার নগদ সম্পত্তি তোমরা হতে পাবে না। অ্যানুইটির ব্যবস্থা করেছি; তোমরা এখন যেমন মাসহারা পাচ্ছ তেমনি পাবে। কোনো অবস্থাতেই যাতে তোমাদের অর্থকষ্ট না হয় সেদিকে দৃষ্টি রেখে মাসহারার টাকার অঙ্ক ধার্য করেছি। বাড়িটা যতদিন তোমরা বেঁচে থাকবে ততদিন সমান ভাগ করে ভোগ করবে‌, বিক্রি করতে পারবে না।’

চারজনে মুখ অন্ধকার করে দাঁড়িয়ে রইল। বেণীমাধব দুই নাতনীর কাঁধে হাত রেখে বললেন–’ঝিল্লী আর লাবণির জন্যে আমি আগে থেকেই মেয়াদী বীমা করে রেখেছি‌, একুশ বছর বয়স পূর্ণ হলে ওরা প্রত্যেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা পাবে। তাছাড়া আমি ঠিক করেছি। ওদের বিয়ে দিয়ে যাব। তোমাদের মেয়ের বিয়ের ভাবনা ভাবতে হবে না। লাবণির জন্যে একটি ভাল পাত্র আছে; ছেলেটি মিলিটারিতে লেফটেনেন্ট! ঝিল্লীর জন্যে মনের মত পাত্র এখনো পাইনি‌, পেলেই একসঙ্গে দু’জনের বিয়ে দেব।’ তাঁর মুখে একটু প্রসন্নতার ভাব এসেছিল‌, আবার তা মুছে গেল; তিনি ভ্রূকুটি করে বললেন—’মকরুন্দকেও আলাদা পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে যাব ভেবেছিলাম‌, কিন্তু সে বড় অসভ্য বেয়াদব হয়ে দাঁড়িয়েছে‌, তাকে কিছু দেব না।’

বেণীমাধব চুপ করলেন‌, তাঁর শ্রোতারাও চুপ করে রইল; কারুর মুখে কথা নেই। শেষে গঙ্গাধর একটু কেশে অস্পষ্টভাবে বলল—’আপনার সম্পত্তি আপনি যেমন ইচ্ছে ব্যবস্থা করুন‌, আমাদের বলবার কিছু নেই। তবে টাকার দর‌, আজ এক রকম কাল এক রকম–’

গায়ত্রী স্বামীর কথায় বাধা দিয়ে ভারী গলায় বলল–’বাবা‌, তুমি যা দেবে তাই মাথা পেতে নেব। উইল কি সই হয়ে গেছে?’

বেণীমাধব কারুর দিকে তাকালেন না‌, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন–উকিলকে উইল তৈরি করতে দিয়েছি‌, কাল পরশু সই দস্তখত হবে। হ্যাঁ‌, একটা শর্তের কথা তোমাদের বলা হয়নি। উইলের শর্ত থাকবে‌, যদি আমার অপঘাত মৃত্যু হয় তাহলে তোমরা কেউ আমার এক পয়সা পাবে না‌, সব সম্পত্তি পাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।’

এই কথা শুনে সকলে কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইল‌, তারপর আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

রাত্রি হলো। যথাসময়ে বেণীমাধব নৈশাহার সম্পন্ন করে শয্যা নিলেন। মেঘরাজ ও মেদিনী পাশের ঘরে খাওয়াদাওয়া করল; মেঘরাজ সামনের দরজা ভেজিয়ে দরজা আগলে বিছানা পাতল‌, মেদিনী নিজের ঘরে গেল।

ওদিকে দোতলায়। থমথমে ভাব। লাবণির নাচের মাস্টার এসেছিল‌, কিন্তু বাড়িতে কারুর নাচের প্রতি রুচি নেই। পরাগ আর লাব্রণি আড়ালে কথা বলল‌, তারপর চুপিচুপি নিঃশব্দে সিনেমা দেখতে চলে গেল। কেউ তাদের যাওয়া লক্ষ্য করল। কিনা সন্দেহ।

নিখিল সন্ধ্যের পরই কাজে চলে গিয়েছিল; সে নিশাচর মানুষ‌, সারা রাত কাজ করে‌, সকালবেলা ফিরে আসে।

রাত্রি আন্দাজ ন’টার সময় সনৎ ক্যামেরা নিয়ে বেরুল‌, মেদিনীর দোরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল—’মেদিনী‌, আমি বর্ধমানে যাচ্ছি‌, কাল সকালে সেখানে একটা নাচগানের মজলিশ আছে। কাল বিকেলের দিকে কোনো সময় ফিরব। আমার জন্যে আজ রাত্রে তোমাকে দোর খুলতে হবে না।’ বলে একটু হাসল।

মেদিনী ক্ষণকাল তার চোখে চোখ রেখে বলল–’জি।’

সনৎ চলে গেল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে মকরন্দ এল‌, মেদিনীকে কড়া সুরে বলল–’দোর বন্ধ করে দাও। রাত্রে কেউ যদি বাইরে থেকে এসে আমার খোঁজ করে‌, বলবে আমি বাড়ি নেই।’ উত্তরের অপেক্ষা না করে সে ওপরে চলে গেল। মেদিনী সদর দরজায় খিল লাগাল।

তারপর বাড়ির ওপর রাত্রির রহস্যময় যবনিকা নেমে এল।

পরদিন ভোরবেলা মেদিনী সদর দরজা খুলতে গিয়ে দেখল, কবাট ভেজানো আছে কিন্তু খিল খোলা। সে ভুরু কুঁচকে একটু ভাবল‌, তারপর কবাট একটু ফাঁক করল; বাইরে নিখিলকে দেখা গেল‌, সে কাজ শেষ করে ফিরছে। মেদিনীর সঙ্গে চোখাচে্যুখি হতেই সে হেসে বলল–’তোমরা কাম শুরু হুয়া হামারা কাম শেষ হুয়া। এবার খুব ঘুমায়গা।’

নিখিল নিজের ঘরে চলে গেল। মেদিনী দরজা ফাঁক করে রাখল‌, কারণ দোতলায় বি কাজ করতে আসবে। তারপর সে কর্তার চা তৈরি করার জন্যে সিঁড়ি ভেঙে তেতলায় চলল।

মিনিটখানেক কাটতে না কাটতে তিনতলা থেকে স্ত্রীকণ্ঠের তীব্র আর্তনাদ এল‌, তারপর ধাপ করে শব্দ। নিখিল তার ঘরে গায়ের জামা খুলে গেঞ্জি খোলবার উপক্রম করছিল‌, তীব্র চীৎকার শুনে সেই অবস্থাতেই ওপরে ছুটিল। দোতলা থেকেও সকলে বেরিয়ে এসেছিল‌, সকলে প্ৰায় একসঙ্গে তেতলায় গিয়ে পৌঁছল। তারপর বেণীমাধবের দোরের সামনে ভয়াবহ দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

মেঘরাজ বিছানার ওপর ঊর্ধ্বমুখে পড়ে আছে‌, তার গলা এদিক থেকে ওদিক পর্যন্ত কাঁটা; বালিশ এবং বিছানার ওপর পুরু হয়ে রক্ত জমেছে। মেদিনী তার পায়ের দিকে অজ্ঞান হয়ে লুটিয়ে পড়েছে।

কিছুক্ষণ কারুর মুখ দিয়ে কথা সরল না‌, তারপর নিখিল চেচিয়ে উঠল–’মামা-মামা বেঁচে আছেন তো?’

গায়ত্রী, আরতি এবং ঝিল্লী কেঁদে উঠল‌, অজয় এবং গঙ্গাধর মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইল; কারুর যেন নড়বার শক্তি নেই। নিখিল তখন মেঘরাজকে ডিঙিয়ে বন্ধ দোরে ঠেলা দিল। দোর খুলে গেল; খোলা দোর দিয়ে দেখা গেল‌, বেণীমাধব খাটের ওপর শুয়ে আছেন‌, তাঁর গলায় নীচে গাঢ় রক্তের চাপ জমা হয়ে আছে। মেঘরাজকে যেভাবে যে-অস্ত্র দিয়ে গলা কাটা হয়েছে বেণীমাধবকে ঠিক সেইভাবে সেই অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

কান্নার একটা কলরোল উঠল। নিখিল ক্ষণিকের জন্য জড়বৎ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের মধ্যে ছুটে গিয়ে টেলিফোন তুলে নিল। প্রথমে নিজের সংবাদপত্রের অপিসে ফোন করল‌, তারপর থানায়।

Pages: 1 2 3

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress