Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বৃত্তের বাইরে || Bani Basu » Page 2

বৃত্তের বাইরে || Bani Basu

ডান-পাশে বসা বসাক বলল—‘এরই মধ্যে?’

মুখে হাত-চাপা দিয়ে ছোট্ট একটা হাই তুললেন মিসেস রায়— ‘ভী-ষণ ঘুম পাচ্ছে। দু নাইট পর পর। আর পারা যাচ্ছে না।’

—‘কাল আসছ তো?’ রাজেশ পাইন বলল।

—‘কাল তো আবার মিড নাইট?’

—‘আরে তাতে অসুবিধে কোথায়?

মিসেস রায়ের মুখে একটা দুর্বোধ্য হাসি। জীবনকে নানা ভাবে উপভোগ করার এই জীবনদর্শন ভাল। খুব ভাল। কিন্তু এই পাইন-বসাকগুলো বুঝবে না পর পর তিনটে রাত জাগলে চেহারায় ওপর কী জাতীয় ধস নামতে পারে। তনুশ্রী যে গান-বাজনা দারুণ একটা ভালবাসেন তা নয়। তাঁর আসল পছন্দের জিনিস হল নাচ। শেখার ইচ্ছে ছিল একসময়ে। বাবা মা কেউই সে ইচ্ছেটাকে আমল দেন নি। নাচ দেখতে দেখতে এখনও ভেতরটা ধা-ধিন-ধিন ধা করতে থাকে তনুশ্রীর। কিন্তু নাচ এসব কনফারেন্সে প্রথম দিকেই হয়ে যায়। তারপর দীর্ঘ সময় ধরে খেয়াল বা সেতার-টেতার শোনবার খুব একটা ধৈর্য থাকে না তনুশ্রীর। গায়ক বা বাদক যখন তবলার সঙ্গে মেতে ওঠে, তবলা যখন বাজনাকে ছাপিয়ে যায়। বা দু পক্ষই তাল ঠুকে হুহুঙ্কার দিতে থাকে, সে সময়টার উত্তেজনাটা উপভোগ করেন তিনি। কিন্তু অন্য কোনও বিশেষ প্রোগ্রাম না থাকলে এ সব কনফারেন্সে তাঁকে আসতেই হয়। তিনি পেট্রন। না এলে মান থাকে না। অনেক গাইয়ে-বাজিয়ে-নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়। তাঁর ইচ্ছে বিরজু কি কেলুচরণের মতো কাউকে কিছুদিন বাড়িতে অতিথি রাখা। ব্যাপারটা শিগগির করতে হবে। ভারতবর্ষের সংগীত-নৃত্যের বিস্তৃত ভূগোলে মিসেস রায় তাঁর সল্ট লেকের বাড়ি সমেত একটু জায়গা পেতে চান।

খেয়ালটা থেমেছে। এইবেলা চট করে বেরিয়ে যেতে হবে। রাজেশ পাইন উঠে পড়ে এগোচ্ছে। পেছন পেছন নিজেকে যতদূর সম্ভব মুছে ফেলে বেরিয়ে যেতে হবে। কালো শালটা দিয়ে মাথায় ভাল করে ঘোমটা দিয়ে নিলেন মিসেস রায়। তাঁর বিরাট কানবালা দুটো ঘোমটার বাইরে এসে মৃদু মৃদু দুলতে লাগল।

বাইরে বেরিয়ে বোঝা গেল রাত আর নেই। বেশ পাখি ডাকতে শুরু করেছে। ভোরের পাতলা সর শেষ রাতের গায়ে। লেকের জল স্থির। লোক জমতে আরম্ভ করেছে। স্বাস্থ্য শিকারিরা শর্টস আর কেডস পরে প্রস্তুত। গাড়ি অনেক দূর। উদ্যোক্তারা কেউ কেউ বেরিয়ে এসেছিল।

—‘চললেন তনুশ্রীদি? শরীর খারাপ নাকি?’

—‘না না, আসলে, সকালে মানে বারোটা নাগাদ একটা জরুরি মিটিং আছে ভাই। আই মাস্ট গেট সাম স্লিপ।’

—‘এবার যেন তেমন জমল না, না?’

—‘আরে বাবা আর্টিস্টরাও তো মানুষ’ বসাক খসখসে ভারী গলায় বলল। ওর এই গলাটার জন্যেই মিসেস রায় বিশেষ করে ওকে পাত্তা দেন। গলাটা তাঁকে কেমন চেতিয়ে তোলে। সামহাউ। পাইনের কথা আলাদা। পাইন খুব করিতকর্মা। অনুগত। অনুগত বসাকও। কিন্তু পাইনের মতো করিতকর্মা নয়। মিসেস রায় সমানে পাইনকে তালি দিয়ে দিয়ে বসাককে বাজিয়ে চলেছেন। অথচ দুজনে এমনিতে খুব বন্ধু। বসাকই পাইনকে তাঁর বৃত্তে আনে।

—‘কী? হোম সুইট হোম?’ রাজেশ হেসে জিজ্ঞেস করল।

—‘আবার কী?’ মিসেস রায় ভ্রূভঙ্গি করে জানালেন।

বসাক পেছনে ঠ্যাং ছড়িয়ে বসে আছে। মাথাটা সিটের ওপর কাত। মিসেস রায় আড়চোখে দেখে ভাবলেন ইস্‌স্‌ আকাটটা বসেছে দেখো! মুখটা সুদ্ধু হাঁ করে ফেলেছে, এবার বোধহয় নাক ডাকবে। তাঁর ভেতরটা চট করে নিবে গেল। বসাকের জন্য। রাজেশের জন্য এখনও ভেতরটা জ্বলছে। তার সুপুষ্ট আঙুলগুলো স্টিয়ারিং আঁকড়ে ধরে আছে। আঙুলে হিরের আংটি। বেশ বড়। হঠাৎ মিসেস রায়ের মনে হল তিনি যদি এখন বসাকের মতন বসতে পারতেন! ওহ্‌ কেন পারেন না? কেন পারবেন না? চলাফেরা কথা বলা খাওয়া শোয়া সব কিছু ভেতর থেকে নিয়ন্ত্রিত করে কে? কেন এই অনুশাসন? ভেতর থেকে? না বাইরে থেকে? বুকের ভেতরে না মাথার ভেতরে যেন একটা তর্জনী সব সময়ে উঁচিয়ে আছে। এভাবে নয়, ওভাবে। ওটা ঠিক হল না। এইটে ঠিক। তর্জনীটা এক কোপে কেটে ফেলতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। কিন্তু তর্জনীর পেছনে আছে একটা আরও ভয়াবহ বুড়ো আঙুল। বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ।

ভোরবেলার গাড়ি তরতর করে ভেসে চলেছে। পালে হাওয়া লাগছে। কানের পাশ দিয়ে শনশন হাওয়া। মিসেস রায় জানেন না কখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। বাড়ির ড্রাইভ-ওয়ে দিয়ে ঢোকবার সময়ে তলার নুড়িতে কড়কড় মড়মড় শব্দ। চটকাটা ভেঙে গেল তখনই। দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে বসাক। চোখে ঘুম। বাড়ির দরজা খোলা। এখন থেকে খোলাই থাকে। শিথিল শরীরটাকে এক ঝটকায় টান টান করে নেমে দাঁড়ালেন মিসেস রায়। —‘থ্যাংঙ্কস।’

সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময়ে একবার যেন বদনের শ্রীমুখখানা দেখতে পেলেন। ঘরের কাছাকাছি আসতে প্রমীলা। হাত থেকে শালটা নিয়ে গুছিয়ে রাখল। ব্যাগটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে, শাড়ি-টাড়িগুলো টেনে টেনে খুলতে লাগলেন মিসেস রায়। প্রমীলা বেরিয়ে যাচ্ছে। —‘চা দেবো?’

—‘না।’

—‘অন্য কিছু?’

—‘এখন কিছু না।’

ভীষণ ঘুম পাচ্ছে। এখন কিছু না, কেউ না। আলগা হয়ে শিথিল ঘুম শুধু। তর্জনী নেই। বুড়ো আঙুল নেই। বসাক, রাজেশ, অম্বুজ, তিমিরকান্তি, মিসেস দস্তুর, তানিয়া ঘোষাল…কেউ নেই। অনু ডালমিয়া, প্রীতা সোম সব ঘুমের তলায় তলিয়ে গেছে। ঘুম! ঘুম! ঘুম!

প্রথম পর্যায়ে নিশ্ছিদ্র বিস্মরণের অন্ধকার। দ্বিতীয় পর্যায়ে অন্ধকার কাটতে থাকে। আস্তে আস্তে একটা জলপ্রপাতের ওপর ভর দিয়ে শাঁ করে নেমে আসতে থাকে দুটো পা। ছড়ানো দুদিকে। জিনস পরা। পায়ের ওপর কোমর। খোলা। তার ওপর পেট, খোলা। নাভি অর্ধেক দেখা যাচ্ছে। তার একটু ওপরে পাঁজরার ঠিক তলায় একটা শক্ত গিট। লাল নাকি নীল তা তো ঠিক… আবছা ধূসর ধূসর, না গোলাপি বোধহয় টপটা। বেবি পিঙ্ক। ঝুঁকে আছে সোজা সোজা চুল, শেষগুলো ভেতর দিকে একটু পাকিয়ে গেছে। তার মধ্যে মুখ একটা। অনু ডালমিয়ার? ব্রুক শিল্ডস? না জুলিয়া রবার্টস? ভাল করে যতই দেখতে যান ততই মুখটা চুলের ঝাপটায় লুকিয়ে লুকিয়ে যায়। উঁহুঃ ও বোধহয় কামসূত্রর সেই অ্যাড-গার্লটা না? কী যেন নাম…না তো! ও তো তনুশ্রী! তনুশ্রী স্লিপ খেয়ে নেমে আসছে। আবার নামছে। আবার নামছে। টিভিতে ছবিটা তলার দিকে সমানে রোল করে যাচ্ছে। একটা পেটমোটা হাঁস উড়ছে। উড়ছে না তো! থপথপ করে কেমন পেছন দুলিয়ে হেঁটে হাসছে। হঠাৎ কে যেন তনুশ্রীকে প্রচণ্ড জোরে ছুঁড়ে ফেলছে। জলপ্রপাতটা এতক্ষণ ছিল নিস্পাপ স্লাইড একটা। এখন ফুঁসে উঠেছে। হাবুডুবু খেতে খেতে তনুশ্রী শেষ কুটোটুকু আঁকড়ে ধরার মতো করে চেতনাকে ধরেছেন। একটা কুটো ক্রমশ শেকড় হয়ে যায়। শক্তপোক্ত সেই শেকড়টা ধরে মিসেস রায় হাঁকপাঁক করছেন।

শেকড়টা আস্তে আস্তে তিতির মুখ হয়ে যাচ্ছে। —‘মা, মা, ওঠো। প্রমীলাদি কী বলছে শোনো।’ তিতি মাকে নির্মমভাবে ঝাঁকাচ্ছে।

তনুশ্রী চোখ দুটো আধো খুলে তিতির মুখটা জলের মধ্যে শক্ত গাছের শেকড়ের মতো ভাসতে দেখেছিলেন। তিতি…তিতি..কে যেন তিতি..মেয়ে…ও তাঁরই মেয়ে…বেড়াতে গিয়েছিল না? কোথায়? কে জানে! কবে ফেরার কথা ছিল? ফিরেছে তাহলে? বেশ তো, ফিরেছে তো এখানে কেন? এখন, এখানে তাঁকে এভাবে ঝাঁকাবার মানে কী? ভুরু কুঁচকোচ্ছে যে!

হাজার চেষ্টা করেও মুখে কথা আনতে পারছেন না মিসেস রায়। জিভটা অসাড় হয়ে গেছে যেন।

—‘মা, এখন দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট। বাবা সকাল থেকে বাড়ি নেই।’ অনেক কষ্টে জিভটা নেড়ে তনুশ্রী বললেন, ‘নেই তো কী! আসবে!’

—‘প্রমীলাদি বলছে সকালে চা দিতে গিয়ে ঘর খালি দেখেছে। বাবা ঠিক সাড়ে পাঁচটায় চা চায়। রাতে বিছানায় শোয়নি। ঘরে ছিল না বোধহয়।’

এবার তনুশ্রী এপাশ ওপাশ করে দু হাতে ভর দিয়ে কোনওক্রমে উঠে বসলেন। ভুরু কুঁচকে গেছে।

—‘তোমার বাবা কোনদিনও এ সময়ে বাড়ি থাকে?’ সদ্য ঘুম ভাঙা গলাটা ভারী, ভাঙা-ভাঙা, ‘হয়ত সকালে কোনও বিশেষ কাজ আছে। কেউ বাড়ি ছিল না, তাই বলে যেতে পারেনি।’

প্রমীলা দরজার ওদিকে ছিল, কাছিয়ে এল।

—‘মেমসায়েব, সায়েব কালকে কেন জানি বড্ড রাগ করেছিলেন। খাবার…ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।’

তনুশ্রী খুব আশ্চর্য হলেন এবার। তাঁর স্বামী বিজু রায় খুব ঠাণ্ডা মাথার লোক। প্রমীলার রান্নাও একেবারে স্ট্যান্ডার্ড। এদিক-ওদিক হয় না। তা ছাড়া বিজু রায়ের জন্য কীই বা রান্না! ব্লাড শুগার আর উচ্চ রক্তচাপের জন্যে মাপা বাঁধা-ধরা খাওয়া ইদানীং। খাবার ছুঁড়ে ফেলার কোনও কারণ থাকার কথা নয়।

—‘আমায় জিজ্ঞেস করলেন মেমসায়েব ছেলেমেয়ে কোথায়…’ প্রমীলা আর একটু সাহস করে বলল।

—‘তুমি কী বললে?’

—‘আপনি গান শুনতে গেছেন, দিদি বেড়াতে গেছে বললুম, দাদার কথা জানি না, তাই বলতে পারিনি।’

—‘সাহেব তাতে কী বললেন?’

—‘কিছু না। অনেক রাত হয়ে যাচ্ছে দেখে খেতে ডাকলুম, এলেন, দিলুম, তারপর সব খাবার ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে উঠে গেলেন।’

তনুশ্রী এবার সম্পূর্ণ হতভম্ব চোখে তিতির দিকে তাকালেন। তিতিও মায়ের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিছু বলছে না। —‘চিন্টু চিন্টু কোথায়! সেই বা এখনও ফেরেনি কেন? চিন্টু রাতে ফেরেনি? প্রমীলা!’

প্রমীলা খুব অপরাধী গলায় বলল, ‘না।’

—‘এ কথা আগে বলনি কেন? তনুশ্রী হঠাৎ কঠোর গলায় বললেন। চিন্টুর ফেরা না ফেরার দায় যেন সম্পূর্ণই প্রমীলার।

প্রমীলা আরও ভয়ে ভয়ে বলল, ‘দাদা তো মাঝে মাঝেই অমন রাতে ফেরে না। আমি কী করে জানব আপনি জানেন না!’

‘আচ্ছা। এখান থেকে যাও এখন!’

হঠাৎ তনুশ্রীর খেয়াল হল প্রমীলা একটা কাজের লোক। বড্ড বেশিক্ষণ পারিবারিক কথাবার্তার মধ্যে রয়েছে। এটা ঠিক না।

প্রমীলা চলে গেলে মেয়ের দিকে চেয়ে বললেন, ‘হঠাৎ এত রাগের কী হল?’

তিতি অসন্তুষ্ট গলায় বলল, ‘কোথায় যাচ্ছ, কেন যাচ্ছ বলে গেলেও তো পারো।’

—‘তুমি কি বলে গিয়েছিলে?’ তনুশ্রী মেয়ের সঙ্গে তৎক্ষণাৎ মাঠে নেমে পড়েন।

—‘আমি তোমাকে বলে গেছি। তুমি বাবাকে বলবে এটাই আমার ধারণা। চিরকাল এরকমই হয়ে এসেছে।’

—‘তোমার দাদা? সে বলে গেছে?’

দাদার জবাবদিহি দাদার কাছে চেয়ো। আমি কী বলব?’

—‘বলে যাওয়ার কথা তুলছ তাই বলছি।’

তিতি কিছু বলল না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তনুশ্রী উঠে পড়লেন। চানে ঢুকতে হবে এবার। অনেকক্ষণ সময় নেবেন আজকে। ইতিমধ্যে কোনও একটা খবর আসবে। ফোন হোক, মেসেঞ্জার হোক। বিজু রায় নিজেই চলে আসতে পারেন। এত ভোরে হঠাৎ কী কাজ পড়ল এটাই কৌতূহলের বিষয়। তিতি বা প্রমীলার যে তর্জনীসংকেত অর্থাৎ কিনা বিজু রায় প্রধানত তাঁর ওপর রাগ করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছেন, এই ধারণাটাকে এক মুহূর্তের জন্যেও প্রশ্রয় দিচ্ছেন না তিনি। অল রাবিশ! বিজু রায় তাঁর ব্যবসার সুবাদে কখন কোথায় যান, কেন যান, সেটা যেমন তনুশ্রী জানেন না, তনুশ্রী তাঁর সামাজিক কাজকর্মের সুবাদে কখন কোথায় যান বিজু রায়েরও তেমনি জানার কথা নয়। তিতি তাঁর মেয়ে। কিন্তু ওর রকমসকম একেবারে ভাল লাগে না তাঁর। কথাবার্তা বলার খুব একটা সুযোগ হয় না। কিন্তু যখন বলে কেমন একটা সমালোচনার সুর, একটা জবাবদিহির ভঙ্গি থাকে। চাউনি-টাউনিগুলোও কেমন যেন! কে যে বয়সে বড় বোঝা দায়। চিন্টুকে তিনি খানিকটা বুঝতে পারেন। তিতিকে পারেন না। ওর বন্ধুবান্ধবদেরও না।

অনেকক্ষণ ধরে চান করেও মাথাটা তেমন পরিষ্কার হল না। চোখ দুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। ঘুমের বিকল্প আসলে কিছু নেই। পাঁচ সাড়ে পাঁচ থেকে বারোটা একটা পর্যন্ত একটা নিশ্চিন্ত ঘুম ঘুমোতে পারলে ক্লান্তিটা কেটে যেত। কিচেনের দিকে গেলেন তনুশ্রী। বদনেতে প্রমীলাতে গল্প জুড়েছে ‘কেউ নেই গো, না ছেলে, মেয়ে, না বউ, একে মা গিয়ে থেকে মানুষটা থম মেরে আছে! আমি তো মুখ দেখে ভয়ে মরি!’

তনুশ্রী কড়া গলায় বললেন, ‘প্রমীলা আমায় কড়া করে কফি দিয়ো।’

রান্নাঘরের ভেতরের কথাবার্তা চট করে থেমে গেল। তনুশ্রী পার্লারে এসে বসলেন। মুখটা থমথম করছে। তিন চারটে কাগজ ম্যাগাজিন হোল্ডারের ওপর থাক করা। একটা আলতোভাবে তুলে নিয়ে চোখ বুলোতে লাগলেন। কিন্তু ভেতরে ঢুকছে না। একটা চিটচিটে রাগে ভেতরটা জ্বলছে। একটু পরে বদন ট্রেতে করে তাঁর ব্রেকফাস্ট নামিয়ে দিয়ে গেল। ফলের রসে একটা চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখলেন তনুশ্রী। ‘প্রমীলা!’ রাগী গলায় ডাকলেন। ঝাড়নে হাত মুছতে মুছতে এসে দাঁড়াল প্রমীলা।

—‘জুস তেতো হয়ে গেছে, নিয়ে যাও।’

বিনা বাক্যব্যয়ে জুসটা তুলে নিয়ে গেল প্রমীলা। ওদিকে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে পেছন ফিরে বলল, ‘চিন্টুদাদা ফিরেছে। ঘুমাচ্ছে ঘরে।’

—‘কৃতার্থ হলুম’, মনে মনে বললেন তনুশ্রী। যত জ্বালা আমার। কেন রে বাবা! স্বাধীনতা যে যখন ইচ্ছে কাউকে জিজ্ঞাসাবাদের বালাই ছাড়াই নিয়েছ, কী ছেলে, কী মেয়ে, কী তাদের বাবা! তাদের ফেরা-না-ফেরার দায় আমায় নিতে হয় কেন? আমাকে কথা শুনতে হয় কেন ঝি-চাকরের কাছ থেকে? এই সব জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা এক ধরনের পরাধীনতার লক্ষণ। ষোলো বছরের বড় ব্যবসায়ী বরকে এইজন্যে বিয়ে করা হয়নি। কৈফিয়ত চাইবে না বলে, যত খুশি খরচ করবার অনুমতি কিংবা বিনা অনুমতিতে চলবার অলিখিত কাগজে সই করে দেবে বলেই আরও যুবক, আরও কোয়ালিফায়েড পাত্র প্রত্যাখ্যান করে একে নির্বাচন করা!

ব্রেকফাস্ট শেষ করেও অনেক, অনেকক্ষণ একই জায়গায় বসে কাগজ পড়ার বৃথা চেষ্টা করতে লাগলেন তনুশ্রী। আজকে সন্ধেবেলায় পার্টি আছে। লাঞ্চ স্কিপ। এখন তিনি প্রতি মুহূর্তেই বিজু রায়কে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসতে দেখছেন। এভাবেই বারোটা বেজে গেল। তিতি ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। চুলের ওপর তোয়ালে জড়ানো —‘মা, খাবে নাকি? দাদাকে ডেকে তুলব।’

—‘আমি এ বেলা খাচ্ছি না।’

কেন? জিজ্ঞেস করার জন্য মুখটা খুলেছিল তিতি। গিলে নিল প্রশ্নটা। তনুশ্রী লক্ষ করলেন। এবং লক্ষ করে বিরক্ত হলেন। নিজের মাকে একটা প্রশ্ন করবে তারও কত ধানাইপানাই! দাদার ঘর থেকে গম্ভীর মুখে ফিরে আসছে তিতি। দাদাকে তুলতে পারেনি তাহলে! তনুশ্রী ভেতরে ভেতরে এত রেগে গেছেন যে কোনও কথা জিজ্ঞেস করবার দরকার মনে করছেন না। এখান থেকে খাবার টেবিলের একটা দিক দেখা যায়। বাঁ চোখের কোণ দিয়ে। তিতি খাচ্ছে। উঠে গেল। হাত ধুচ্ছে। সামনে দিয়ে খাবার সময়ে বলে গেল, ‘মা, দাদা নিঃসাড়ে ঘুমোছে। তুলতে পারলুম না। আমি কলেজ যাচ্ছি। লাইব্রেরি হয়ে ফিরতে পাঁচটা বেজে যেতে পারে।’ দেখাচ্ছে। আসলে দেখাচ্ছে ওর কত দায়িত্ববোধ। কত শৃঙ্খলাবোধ। মাকে বলে যাচ্ছে। একেবারে সময়টা পর্যন্ত বলে যাচ্ছে! কখন ফিরবে, কোথায় কোথায় যাচ্ছে! হুঁ!

তনুশ্রী টেলিফোনটা তুললেন। বিজু রায়ের অফিসে ডায়াল করলেন তনুশ্রী। বেজে যাচ্ছে বেজে যাচ্ছে। কেউ ধরছে না। আর একটা নম্বর রয়েছে। ডায়াল করলেন।

এবার ধরেছে। ‘হ্যাললো।’

—‘মিঃ রায় আছেন?

—‘না। উনি এখনও আসেননি। ওঁর অফিসঘর বন্ধ।’

—‘কে বলছেন? সাধনবাবু?’

—‘হ্যাঁ আমি সাধন বিশ্বাস। বউদি নাকি?’

বি বি রায়ের অফিসের একমাত্র এই সাধন বিশ্বাসই তনুশ্রীকে বউদি বলে ডেকে থাকেন। তনুশ্রী সেটা মেনে নেন। বহুদিনের লোক। তনুশ্রী বললেন— ‘শুনুন সাধনবাবু, সাহেব এলেই আমাকে ফোন করতে বলবেন। বাড়ির নম্বরে না পেলে আরেকটা নম্বর দিচ্ছি, সেইখানে।’ নম্বরটা বললেন তনুশ্রী।

সাধন বিশ্বাস তাড়াতাড়ি বললেন—‘আজ সাহেবের এত দেরি কেন? বুঝতে পারছি না তো! কখন বেরিয়েছেন বাড়ি থেকে? অনেকগুলো দরকারি কাজ আছে…’

বোতাম টিপে কানেকশনটা অফ্‌ করে দিলেন তনুশ্রী। বিজু রায় যে শেষ রাত থেকে বাড়ি নেই এ কথাটা অফিসে জানানো ঠিক হবে কিনা তিনি বুঝতে পারছেন না। তবে এখনও, ফোনটা রেখে দেবার পরও তিনি প্রত্যাশা করছিলেন বিজু রায় সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসবেন। বা কোনও ফোন আসবে তাঁর।

তবে গিয়ে একবার আয়নার সামনে দাঁড়ালেন তনুশ্রী। ওপরের জোরালো আলোটা জ্বেলে দিলেন। চোখের তলায় বেশ কালি। মুখটাও যেন চুপসে আছে। দু রাত্তির পর পর জাগা! সয় নাকি! মুখে-গলায় ভাল করে নারিশিং ক্রিম মেখে তিনি বিছানার ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন। আরেকটা ঘুম দরকার। অ্যালার্মটা সাড়ে তিনটেয় সেট করে দিলেন। কী মনে হল, একবার প্রমীলাকেই ডাকলেন আবার।

—‘সাহেব এলে আমায় জাগিয়ে দিয়ো। সাহেবের ফোন এলেও।’

—‘সাহেব কি আপিসে আছেন? বউদি!’ প্রমীলা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল।

—‘না, কাজে, অন্য কোথাও গেছেন।’ কাঠ-কাঠ গলায় বলে তনুশ্রী আবার মুখটা বালিশের ওপর রাখলেন। প্রমীলার মুখ থেকে দুশ্চিন্তা এবং অবিশ্বাসের ছায়া গেল না। সে আড় চোখে একবার মেমসাহেবের শায়িত শরীরটার দিকে বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে চেয়ে সেখান থেকে চলে গেল। এই মেমসাহেবকে সামনাসামনি সে ভয় করে। পেছন ফিরলে একটুও না। বরং একটা তাচ্ছিল্য, একটু ঘেন্না মেশানো থাকে তার দৃষ্টিভঙ্গিতে। এই মেয়েছেলেটার পুরো সংসার তার হাতে। সে-ই চালাচ্ছে সব। সে আর বদনই প্রধান। সকাল পাঁচটা বাজলেই দারোয়ান দরজা খুলে দিয়ে ঘুমোত চলে যাবে। সকালের দারোয়ান এসে বসবে। বদন আরও একটা ঠিকে তোক নিয়ে সমস্ত বাড়ি ঝকঝকে করে পরিষ্কার করবে। টাটকা ফুল তুলে আনবে, তখন প্রমীলা ফুলদানগুলোয় ফুল ভরে ডিনার-টেবিলের ওপর রাখবে। বদন সেগুলো সব জায়গামতো বসাবে। ব্রেকফাস্ট তৈরি করা, সারা দিনে কোন সময়ে কী খাওয়া হবে সে-সব মেনু ঠিক করা—সবই প্রমীলার হাতে। একমাত্র লোক-টোক খেলে এরা হয় বাইরে থেকে পুরো খাবার-দাবার আনায়, নয় কিছুটা বাইরে থেকে আসে। আর কিছুটার জন্য প্রমীলার ওপর খবরদারি করে মেমসায়েব। নিজের রান্নাঘরে কোথায় কী আছে যে জানে না, যার সোয়ামি-পুত্তুরকে অন্য লোকে খাবার বেড়ে দেয়, উপরন্তু যার ঘরের ওপর কোনও আঁট নেই, দিবারাত্তির বেরিয়ে যাচ্ছে আর একেক সময়ে একেক রকম সেজে বাড়ি আসছে আর আয়না দেখছে তেমন মেয়েমানুষের ওপর কোনও শ্রদ্ধা নেই প্রমীলার। সে ইচ্ছে করলেই এ সংসার থেকে অজস্র অপর্যাপ্ত চুরি করতে পারে। করেও। টাকা পয়সা পারে না, কিন্তু অন্যান্য জিনিস, যথেচ্ছ।

যে মানুষটাকে বাইরে ভেতরে উভয়তই ভয় করত সে মানুষটা সাহেবের মা। তিনতলার ঘরে একরকম শোয়াই। নামলেন একেবারে কাঁধে চড়ে। তার আগে একবার উঁকি দিয়ে দেখতেও নীচে নামতেন না। কিন্তু চোখে চোখ রাখতে ভরসা পেত না প্রমীলা। একদিন বদনকে দিয়ে প্রচুর চাল ডাল মশলা বাইরে পাচার করবার পর ওপরে মায়ের খাবার নিয়ে গেছে। মা চোখে চোখ রেখে বললেন —‘প্রমীলা, আমার ছেলে-বউ দুজনেই নানা কাজে ব্যস্ত, সংসার দেখতে পারে না। নাই- পারল। তুই তো রয়েছিস। এদের জিনিস-পত্তর বুক দিয়ে আগলে রাখবি, দেখভাল করবি, আমার ছেলে তোকে ঠকাবে না।’

মা কি ধরে ফেলেছিল সে কী করেছে? অন্তর্যামী নাকি? হতেও পারে। ঘরে সব সময়ে ধূপের গন্ধ, সন্ধে হতেই তুলসীতলায় পিদিম, ঠাকুরের ছবির গলায় ফুলের মালা। সব সময়ে জপ করছে। তো সে মানুষ অন্তর্যামী হলেও হতে পারে। তারপর থেকেই সে একটু সাবধান হয়ে যায়। আর সত্যি কথাই। সাহেব কাউকে ঠকাবার মানুষ না। তার মাইনে বেড়ে-বেড়ে এখন নশো টাকা হয়েছে। সে বেওয়া মানুষ, ছেলে-পুলে নেই। এখানে সে কত সুখে আছে, সেটা থেমে গেলেই টের পায়। দু-এক দিনের বেশি টিকতে পারে না। সেবার তার পেটের একটা বড় অপারেশন হল, তা সরকারের পি. জি হাসপাতালে রেখে কী চিকিৎসাটাই করালে সাহেব। হাসপাতাল থেকে বাড়ি আসার পরও একমাস নিজের ঘরে স্রেফ শুয়ে বসে থেকেছে আর খেয়েছে। তখন আর একটা ঠিকে লোক রেখে বদনই কাজ চালাত। তা সে-ই সাহেব মানুষটা রাত্তিরে কাউকে না বলে কোথা গেল গো? বউ-ছেলেমেয়ে কারুরই তো কোনও গা নেই! কিছু একটা মেমসায়েব তার কাছ থেকে লুকোচ্ছে। রকম দেখলেই সে বুঝতে পারে। ব্যাটাছেলেরা যতই যাই হোক, নিজের পরিবারের কাছ থেকে একটু যত্ন-আত্তি আশা করে। দিনের পর দিন এতটা আছেদ্দা! লোকটা শেষ পর্যন্ত বিবাগী হয়ে গেল গা! এভাবেই প্রমীলা মনে মনে দুই প্রতিপক্ষ খাড়া করে সাহেবের পক্ষ নিয়ে নেয়।

ঠিক চারটের সময়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তনুশ্রী। রাত্রের পার্টির জন্যে তৈরি হতে তিন সাড়ে তিন ঘণ্টা তো লাগবেই। এই বিউটি-সেলুনের ফোন নম্বরটাই সাধন বিশ্বাসকে দিয়ে এসেছেন তনুশ্রী। বিজু রায় এখানে ফোন করলেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবেন। পার্টিটা দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। বিজু রায়ই বলে দিয়েছেন। পুরনো স্টিভেডোর ফ্যামিলির মেয়ের বিয়ে হচ্ছে বিজনেস ম্যাগনেট কে শর্মার ছেলের সঙ্গে। মেয়ের পরিবারের কানেকশন্‌স্‌ অসাধারণ। প্রভাবশালী এমন কেউ নেই যাদের সঙ্গে ওদের দোস্তি নেই। বিখ্যাত উইমেনস ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ার পার্সন মেয়ের মা। তাঁর সঙ্গে জমিয়ে একটা মেম্বারশিপ আদায় করে নিতে পারলেই, প্রতি বছর কনফারেন্সে কনভেনশনে উড়ে বেড়ানোর একটা সুযোগ খুলে যেতে পারে তাঁর জন্যে। আর তাঁর স্বামীর যে কী সুবিধে হবে, ভাবতে গেলে তনুশ্রী রায় কূল পান না। বাঁকুড়ায় বিশাল একটা জায়গা নিয়ে কী নাকি কারখানা খুলবে। বড় বড় হাউজের সঙ্গে টক্কর লাগিয়েছে বিজু রায়। এই পার্টিতে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ডি. এম সবাই আসছে। তার ওপর শর্মার সঙ্গে বিজু রায়ের বিশেষ খাতির। শর্মা ওকে সাহায্য করছে। এই ব্যাপারটা করতে পারলে ও বোধহয় ঠিকঠাক শিল্পপতি নামের যোগ্য হবে। ইনডাসট্রিয়ালিস্ট! টপ-নচার! বি. বি. রায় গ্রুপ অফ ইনডাসট্রিজ! ভাবলেও গায়ে কাঁটা দেয়। সেই তনুশ্রী, হ্যাঁ? দুপুরবেলা মর্নিং কলেজ থেকে ফিরে ডেঙর ডাঁটার চচ্চড়ি আর চিংড়ি-পোস্ত দিয়ে ভাত খেতে বসত মায়ের সঙ্গে! বাবা ফিরলেই সন্ধেবেলা সামনে বসে বসে রাজ্যের শার্টে পাঞ্জাবিতে বোতাম বসাও, মোজা রিফু করো, সারাদিন কী করেছ তার ফিরিস্তি দাও। পাঁচ পাঁচখানা মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক কেমন খ্যাপা-পাগলা মতন হয়ে গিয়েছিলেন। উঠতে-বসতে বলতেন ‘রূপেগুণে পার হও, রূপেগুণে পার হও, আর আমার কিছু নেই। কিস্যুটি নেই। রূপেগুণে পার হও।’ ময়লা জামা-কাপড় পরে থাকলে, চুল না বাঁধলে কী বিরক্তই না হতেন। ‘টিপ দাওনি কেন কপালে? পাটভাঙা কাপড় পরবে সব সময়ে। গলার যে হারখানা গড়িয়ে দিয়েছিলুম, পরোনি কেন? আমার ছেরাদ্দের খরচে লাগবে বলে তো আর দিইনি। মেয়েদের সাজসজ্জা অলঙ্কারেই শ্ৰী। কখনও শ্রীহীন থাকতে যেন না দেখি!’

মা একেক সময় বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘তোমার এক বাই হয়েছে। মেয়েদের ব্যাপারে তোমার অত নজর কেন! এ কেমন ব্যাটাছেলে রে বাবা!’

‘সাধে হয়নি, একদিনে হয়নি’, বাবা বলতেন, ‘তুমি সব হিসট্রিটাই জানো। তবু বলবে বাই?’

সম্বন্ধটা যখন এল, ঘটক বলেছিল, ‘বয়সে একটু বড় ঠিকই। কিন্তু এসট্যাবলিশ্‌ড পাত্র পেতে গেলে বয়সের দিকে তাকালে তো চলবে না। দেখলে বুঝতেই পারবেন না। একমাথা চুল, দোহারা চেহারা, খাটিয়ে লোক, এইবারে বিয়ে করে থিতু হতে চাইছে, মানে বেশ ভালই জমিয়ে নিয়েছে। দায়িত্বঅলা লোকেদের রকম-সকমই আলাদা।’

বিজু রায়কে তনুশ্রী প্রথম দেখেন মামার বাড়ির এক নেমন্তন্নে। এল স্যুট-টাই পরা সাহেব। একটা হাজার টাকার গিফ্‌ট্‌ চেক উপহার দিয়ে কোল্ড ড্রিঙ্কস খেয়ে চলে গেল। গ্ল্যামারাস। এক দেখায় পছন্দ হয়ে গেল। তখন সুবিমলের সঙ্গে জোর প্রেম চলছে। সুবিমল মার্চেন্ট অফিসে কাজ করে, টাই-ফাই হাঁকাক আর যাই করুক অ্যাসিস্ট্যান্ট মানে কেরানিই। বাড়িতে বেশ কিছু পোষ্য। এক ভারাক্রান্ত সংসার থেকে আরেক ভারাক্রান্ত সংসারে যেতে মনে মনে ইতস্তত করতে শুরু করেছে তনুশ্রী। জীবনে অ্যাডভেঞ্চার চাই। সুবিমল ভিতু-ভিতু, ক্লান্ত, যেন এখন থেকেই হেরে বসে আছে। বি. বি. রায়ের পাশে সুবিমল যেন রেসের ঘোড়ার পাশে ছ্যাকরাগাড়ির ঘোড়া। একদিন ছুতো করে খুব ঝগড়া করল তনুশ্রী, কাপুরুষ, অকালবৃদ্ধ, ন্যাকাচণ্ডী। সুবিমল রাগ করে সম্পর্ক ছেদ করল। এটাই চাওয়ার ছিল। মাস তিনেকের মাথায় বিজু রায়ের সঙ্গে বিবাহ এবং আন্দামান আইল্যান্ডস্‌-এ হনিমুন। সেই প্রথম তনুশ্রী বারমুডা পরল, সুইমিং কসটিউম পরল। তা তারপর থেকে কোনও জিনিস চেয়ে পায়নি এমন হয়নি। নাকটা বোঁচা ছিল, ঠিকঠাক করিয়ে নিয়েছে, তিনটে ল্যাংঙ্গোয়েজ কোর্স করেছে, ইংরিজি ছাড়া আর দুটোই অবশ্য আধা-খামচা, বিউটিশিয়ানস কোর্স, কুকিং এসবও হয়েছে। তা এখন সে সব দিন গত। এখন উৎসাহ অন্য খাতে। অ্যাডভেঞ্চারের জৌলুস আর কুকিং-ফুকিং-এ ল্যাংঙ্গোয়েজ-টেজ-এ পাওয়া যায় না।

বিউটি-সেলুনে ফেসিয়াল, ওয়্যাক্সিং, ম্যানিকিওর, পেডিকিওর সব করার পর চুল-টুল সেট করে আপাদমস্তক সাজগোজ শেষ হয়ে গেলে ওদের চারদিকের আয়নায় নিজের ভায়োলেট জামেয়ার শাড়ি-পরা চেহারাটা দেখে নিজেই চমকৃত হয়ে গেলেন মিসেস রায়।

সাড়ে সাতটা নাগাদ সাজগোজ শেষ হলে তাঁর খেয়াল হল প্রত্যাশিত ফোনটা আসেনি। সেলুন বন্ধ হবার মুখে, চিনে মেয়েগুলো বিরাট বিরাট হাঁ করে হাই তুলছে, তনুশ্রী টিপ টিপ করে ফোন করলেন— ‘কী বললেন? নেই? কখন বেরিয়েছেন? সে কী? সেই সকাল থেকেই আসেননি? সমর কোথায়?’ ঘড়ি দেখতে দেখতে সমরের জন্যে অপেক্ষা শুরু হল। ‘আমি সমর বলছি মেমসাহেব, সকাল থেকে গাড়ি নিয়ে প্রথমে বাড়িতে তার পরে অফিসে এসে অপেক্ষা করছি, সায়েব এলেন না।’ সমরের গলায় উৎকণ্ঠা। ফোনটা রেখে দিলেন তনুশ্রী। আর অপেক্ষা করবার সময় নেই। বিজুকে ছাড়া পার্টিতে যাওয়া একটু অকওয়ার্ড। কিন্তু বিজু রায় যে কারণেই ভোরবেলা থেকে নিরুদ্দিষ্ট হয়ে থাকুন। এই পার্টিতে তাঁর টিকি বাঁধা আছে। এখানে তাঁকে আজ আসতেই হবে। এখন একাই যেতে হবে। বাহানা কিছু বানাতে হবে একটা। এতক্ষণ সময় এবং টাকা খরচ করে এই ভুবনভোলানো মেকাপ হল…এরপর…। মুহূর্তে মনঃস্থির করে তনুশ্রী বেরিয়ে এসে গাড়িতে বসলেন। ড্রাইভারকে বললেন— ‘চলো গুরুসদয়।’

গেটের কাছেই শর্মা। দুরকম রঙের গাঁদাফুল দিয়ে আজকাল গেট সাজায়। পুরো গেটটাই ফুলে ফুল। হলুদ আর কমলা। সবুজের ওপর হলুদের নক্‌শা। ডেকোরেটররা বানায় আজকাল সব একরকম। মিসেস শর্মা অবধারিতভাবে জিজ্ঞেস করলেন—‘কী ব্যাপার? মিঃ রায় কি পরে আসছেন?’

তনুশ্রী অনেকক্ষণ ধরে একটা উত্তর ভেবে রেখেছিলেন। ‘ভীষণ জ্বর এসেছে বুঝলেন? একেবারে হঠাৎ! তো আমরা ঠিক করলাম কেউ একজন না এলে…’

কিন্তু আসল পরিস্থিতিটার মুখোমুখি হলে বুদ্ধির চর্চা যারা করে তাদের বুদ্ধি অনেক বেশি খুলে যায়। সত্যি কথা বলতে কি বিত্তবানদের জ্বর-ফর হয় না। হয় হার্ট অ্যাটাক, সিরোসিস অফ দা লিভার, বড় জোর হাই ব্লাড সুগার, প্রেশার। এই পর্যন্ত। জ্বর-ফর এলেবেলে ব্যাপার। তনুশ্রী নিজেকে বলতে শুনলেন— ‘আর বলবেন না, আমাকে সাতটায় ফোন করল, কী নাকি ভীষণ জরুরি কাজে আটকে গেছে। বলল “তুমি এখুনি চলে যাও। আমি একটু পরে, কাজটা সেরে যাচ্ছি।” তো এত তাড়াতাড়ি কথা বলেই ফোনটা রেখে দিল আমি জিজ্ঞাসা করতেও সময় পেলাম না, কী কাজ, কোথায় কতক্ষণে আসবে।’

মিসেস শর্মার প্রশ্নের ফলেই এই জবাবটা তৈরি হয়ে গেল। ধন্যবাদ মিসেস শর্মা। যদিও তোমাকে হাড়গিল্লে ঠাকুরানি বলি আমরা কজন আড়ালে। যদিও তুমি প্রচণ্ড জেলাস!

মিঃ শর্মা বললেন, ‘সে কী? রায় আটকে গেল?’ সঙ্গত কারণেই তিনি খুব চিন্তিত। বাঁকুড়ার ব্যাপারটা বোধ হয় রায়-শর্মা গোছের কিছু। তনুশ্রী বিশদ জানেন না।

মিসেস শর্মা বললেন ‘এসো তনুশ্রী আমার বউমার সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই।’

জায়গাটা বিরাট। খোলা আকাশ ওপরে। মাঝে মাঝে শামিয়ানা-ঘেরা নানান আয়োজন। খোলা জায়গাটায় ফুলের টব, গাছগুলোতে টুনি জ্বলছে। লম্বা লম্বা হ্যালোজেন বাতি। মিসেস শর্মার বউমা হাতে টোম্যাটো জুস নিয়ে আরও কয়েকজন প্রায় সমবয়সী মেয়ের সঙ্গে কথা বলছিল।

‘এই যে প্রমা, দিস ইজ দা গ্ল্যামার-কুইন অফ আওয়ার সেট তনুশ্রী রায়। তোমাকে আগেই বলেছিলাম!’

জুসটা সঙ্গে সঙ্গে কাছের টেবিলে রেখে খুব পাতলা লম্বা দুটো হাত জোড় করে নমস্কার করল প্রমা, নতুন বউ। এত ফর্সা আর এত রোগা যে নীল শিরাগুলো যেন দেখা যাচ্ছে, গালে হাতে। ফুটে ওঠেনি এখনও। একটা নীলচে ছায়া মতন। একটা গরদ-রঙের ভারী সিল্কের শাড়ি পরেছে। পাড়টা বিরাট চওড়া ঢালা সোনালি জরিতে আর একটা অদ্ভুত হলুদে। অনেক সোজা চুল মেয়েটির। কোমর পর্যন্ত। খোলা। চলার তালে সাটিনের ঝিলিক মেরে ঢেউ খায়। কানে হীরের কান। গলায় একটা সরু হীরের হার ঝিকঝিক করছে। ডান হাতে দু-চার গাছি সোনার চুড়ি। আর সিঁথিতে সিঁদুর। একটা টিপ নেই। লিপস্টিক নেই, কোনও প্রসাধন নেই। অদ্ভুত! সাদা শাড়ি পরা, নির্গহনা, বা এত কম গহনা, সব কিছুতে ম্যাচিং নেই, এরকম বউ তনুশ্রী কখনও দেখেননি। নতুন বউ বলে বোঝাই যাচ্ছে না। বেশ নিচু গলায় নমস্কারটা বলল। অত নিচু গলা অথচ বেশ স্পষ্ট, পরিষ্কার শোনা গেল। পাশে দাঁড়িয়ে নিজেকে বড্ড বেশি প্রসাধিত, ভীষণ উচ্চকিত লাগছে তনুশ্রীর। যদিও প্রমার বা অন্য কারও দৃষ্টিতে সেরকম কোনও ইঙ্গিত নেই। তনুশ্রী একটুখানি দাঁড়িয়ে কথা বললেন, ভীষণ অস্বস্তি লাগছিল বলে যত তাড়াতাড়ি পারেন চেনা অন্য এক মহিলার শরণ নিলেন। মিসেস চৌবে। তারপর কে যেন কখন তাঁকে আইসক্রিম পার্লারে ঢুকিয়ে নিল। সেইখানে নিজের বৃত্তের সঙ্গে ফেমিনিজমের বিষয়ে আলোচনায় অনেকক্ষণ মত্ত হয়ে রইলেন তনুশ্রী রায়। প্রমার মায়ের সঙ্গে এখানেই আলাপ হল। দেখে আশ্বস্ত হলেন তনুশ্রী, ইনি মেয়ের চেয়ে বেশি সেজেছেন। অত্যাচারিত মেয়েদের নিয়ে এঁর সঙ্গে তনুশ্রী অনেকটা সময় আলোচনা করলেন। প্রমার মা রাধা চ্যাটার্জির কাছ থেকে তাঁদের অ্যাসোসিয়েশনের পরবর্তী অধিবেশনে নিমন্ত্রণের একটা প্রতিশ্রুতি আদায় হয়ে গেল। সেমিনার হবে বিভিন্ন বিষয়ে। মিসেস চ্যাটার্জি বললেন কার্ড পাঠাবেন। তনুশ্রী যেন অবশ্যই আসেন। ইতিমধ্যে ললিতা বিশ্বাসের সঙ্গে প্রমাকে নিয়েও খানিকটা মনোজ্ঞ আলোচনা হয়ে গেল।

—‘জানো না? ও মা! ও তো সাদা ছাড়া পরে না।’

—‘কারণ কী?’

—‘ওর ওটাই স্টাইল, তবে মন্দ লোকে অন্য কথা বলে।’

—‘যেমন!’

—‘কাউকে বোলো না। কাজিনের সঙ্গে বাল্য প্রেম। কাজিন মারা গেছে বছর পাঁচেক হল। ব্লাড ক্যানসার। সেই থেকে সাদা।’

—‘এদিকে বিয়ে করছে। ওদিকে সাদা!’

—‘ওই তো বলে কে?’

—‘ফার্স্ট কাজিন নাকি?’

—‘তবে? যত বড় ঘর তত কেচ্ছা!’ ললিত বিশ্বাস কথাটা কেমন আক্ষেপের সুরে বললেন। আক্ষেপের হাওয়া তনুশ্রীর মনেও লাগল। ইস্‌স্‌, তাঁর বাড়িতে কোনও কেচ্ছা নেই, কেচ্ছা না থাকলে উচ্চ কোটির লোক বলে গণ্য হওয়া মুশকিল বোধহয়। হঠাৎ মনে হল কেচ্ছা ছিল না, কিন্তু শুরু হয়েছে একটা। বোধ হয়। বিজু রায়ের সহসা নিরুদ্দেশ হওয়াটা…। কোনও মহিলাঘটিত ব্যাপার যদি হয়? সোজা কথায় ঢেঁকির পাড় পড়ল তনুশ্রীর বুকের মধ্যে। সে ক্ষেত্রে তো জীবনের ভিতটাই ধসে যাবে! বিজু রায় তাঁর আছেন বলে তিনি তনুশ্রী রায়। তিনি এই তিনি সেই। যে মুহূর্তে বিজু অন্যের হয়ে যাবেন, যত সহানুভূতিই তাঁর জন্যে লোকে দেখাক, তার আয়ু বেশিদিন থাকবে না। উপরন্তু বিজু রায় যেখানে যাবেন তাঁর বিত্ত, তাঁর সামাজিক সুযোগ সুবিধাও যাবে সেইদিকে। তাঁর স্বামী আটান্ন ঊনষাট হতে পারে। দেখায় না। এরকম বয়সে যাকে বলে ভিন্ন মেয়ের চক্করে কি আর লোকে পড়ে না? পড়েই থাকে পুরুষরা।

বসাক ব্যস্ত হয়ে ঢুকে বলল— ‘আরে ও কী ভাবী তুমি এখানে! ওদিকে রায় তো এখনও এল না, শর্মাজি বলছেন মিনিস্টারের সঙ্গে তোমাকেই আলাপ করতে হবে। কাম অন, কুইক!’

খোলা আকাশের নীচে গার্ডেন চেয়ার পাতা রয়েছে। কাছাকাছি গাছ থেকে আলোর ছটা স্নিগ্ধ হয়ে পড়ছে। হাতে হাতে ঘুরছে গেলাস। এখানটাতেই সবচেয়ে মধু আছে মনে হচ্ছে। থিকথিকে লোক। সকলেই অবশ্য পরস্পরের মধ্যে ভদ্র দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মিনিস্টার, প্রতিমন্ত্রী, ব্যুরোক্র্যাটরা এখানে। শর্মাজি, বসাক, পাইন এবং আরও কিছু ভীষণ মোটা, রাশভারী চেহারার শিল্পপতিকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন তনুশ্রী। মিসেস শর্মাই আপ্যায়ন করছিলেন এঁদের। তনুশ্রীকে দেখে তাড়াতাড়ি মিনিস্টারের সঙ্গে আলাপ করালেন। হঠাৎ তনুশ্রী দেখলেন মিনিস্টারের চোখ আটকে গেছে। মিসেস শর্মার ইঙ্গিতে তিনি মিনিস্টার আর তাঁর ডিরেক্টরের মাঝখানে বসলেন। মিনিস্টার তাঁকে তাঁর হবি-টবির কথা জিজ্ঞেস করছেন। তনুশ্রী জানাচ্ছেন উচ্চাঙ্গসঙ্গীত। হ্যাঁ হ্যাঁ কনফারেন্সে গিয়েছিলেন বই কি! আজকেরটাই শর্মাজির ছেলের জন্য স্যাক্রিফাইস করেছেন। কণ্ঠসঙ্গীতের মান নেমে গেছে মিনিস্টার তাঁর সঙ্গে একমত। মিনিস্টার বলছেন সে সব গান তাঁর শোনবার কথা নয়, যদি শোনাতে পারতেন। তনুশ্রী জানাচ্ছেন তিনি শুনেছেন খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি উচ্চাঙ্গের ভক্ত। বাড়িতে ট্র্যাডিশন? ছিল বই কি! বাবা তো ভীষণ ভাল সেতার বাজাতেন। মা শ্যামাসঙ্গীত। না তিনি কোকিল বংশে কাক। উঁহুঃ, পিয়ানো বাজান। সে তেমন কিছু নয়। তনুশ্রী কথাবার্তার মাঝে মাঝে কিছু ফরাসি ঢুকিয়েছেন। মিনিস্টার স্বভাবতই সেগুলো বুঝতে পারেননি। কিন্তু বিস্মিত মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর নিজের স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দেবেন বলছেন। ছোট্ট পার্টি, মিনিস্টার, তাঁর স্ত্রী। ডিরেক্টর, তাঁর স্ত্রী, তনুশ্রীরা হাজব্যান্ড-ওয়াইফ এবং শর্মারা। মিনিস্টার বললেন তাঁর স্ত্রী আসতে পারবেন কি না বলা যাচ্ছে না, কারণ তিনি সম্প্রতি গুরু নিয়ে ভীষণ মেতেছেন। গুরুদের সম্পর্কে তনুশ্রীর কী মত। তিনি গুরু করেছেন কি না জানতে চাইছেন মিনিস্টার, কৌতূহলের জন্য ক্ষমা চেয়ে। তনুশ্রী সামান্য একটু শ্রাগ করে গুরু সম্পর্কে তাঁর মত বোঝালেন। না গুরু তিনি করেননি। রামকৃষ্ণ কিংবা অরবিন্দ বেঁচে থাকলে করে ফেলতেন সন্দেহ নেই। সকলেই খুব তারিফের হাসি হাসল। এইভাবে নরম পানীয়র গ্লাস হাতে একবার এদিকে ঘাড় হেলিয়ে আর একবার ওদিকে ঘাড় হেলিয়ে বকতে বকতে তিনি সম্পূর্ণ ভুলে গিয়েছিলেন বিজু রায়ের জন্য উদ্বেগটা। ডিনারের জন্য এঁরা সবাই উঠতে শর্মাজি চোখের ইশারায় ডাকলেন, অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, বিজু রয় ক্যান বি থ্যাঙ্কফুল যে তাঁর কাজটা তাঁর ওয়াইফই অর্ধেক করে দিয়েছেন। দুম করে কথাটা আবার মনে পড়ে গেল তনুশ্রীর।

—‘আচ্ছা, ও এখনও আসেনি?’

হতাশ গলায় শর্মা বললেন, ‘কই! দেখছি না তো!’

রাত সাড়ে নটা। তিনি বাড়িতে একটা ফোন করলেন।

—‘মা? তুমি কোথা থেকে বলছ?’

—‘শর্মাজির ছেলের বিয়ের পার্টি। তোমার বাবা জানে। তার আসা ভীষণ জরুরি ছিল। ইন ফ্যাক্ট আমি ভাবছিলাম এখানেই ও টার্ন আপ করবে।’

—‘বাবার দেখা নেই। অফিস থেকেও অনেকবার ফোন এসেছে। সাধনকাকা বলছেন খুব জরুরি সব সিদ্ধান্ত নেবার ছিল।’

—‘আশ্চর্য! তোমার দাদা কোথায়?’

—‘এইমাত্র ফিরল।’

—‘জানে?’

—‘সকালে বোধহয় প্রমীলাদির কাছ থেকে শুনে থাকবে। এখন আমাকে জিজ্ঞেস করছিল। মা তুমি তাড়াতাড়ি এসো, এবার আমাদের কিছু একটা ঠিক করতে হয়।’

ফোন ছেড়ে তনুশ্রী দেখলেন তাঁর শীত শীত করছে। দু চোখে উৎকণ্ঠা নিয়ে তিনি সুবেশ পুরুষ-সমুদ্রের মধ্যে আর একবার বিজু রায়কে খুঁজলেন। না, আসেনি। ডিনারে প্রায় কিছুই তেমন উপভোগ করতে পারলেন না। যদিও মিসেস শর্মা নিজে তাঁর সঙ্গে বসেছিলেন।

রাত এগারোটা নাগাদ অনেক কষ্টে মিনিস্টারের কবল ছাড়িয়ে বাড়ির পথ ধরতে পারলেন তনুশ্রী। বাইরে কিছু দূরে প্রচুর বিসদৃশ ময়লা জড়ো হয়েছে। বেশ কিছু ভিখারি বাচ্চা। সেই সঙ্গে ঘেয়ো কুকুর, তাড়ালেও যাচ্ছে না। আতিপাতি করে জঞ্জালের পাহাড় খুঁজছে।

বাড়িটা থমথম করছে। সর্বাঙ্গে আলো। রাত বারোটার কাছাকাছি এইরকম আলোময় বাড়ি, অথচ মনে হচ্ছে ভূতের বাড়ি। বারান্দায় মেয়েকে যেন বসা দেখতে পেলেন তনুশ্রী। দরজা খুলে দিল বদন। খুটখুট করে দোতলায় উঠতে উঠতে নিজের জুতোর শব্দে নিজেরই কেমন গা ছমছম করতে লাগল। পেছনে প্রমীলা আসছে। পার্লারে পৌঁছে দেখলেন তিতি এসে বসে আছে। চিন্টুর ঘর থেকে মৃদু স্বরে রক মিউজিক আসছে ভেসে। চিন্টুও এসে দাঁড়াল। ছেলেকে বোধহয় দেড়দিন পর দেখছেন। এত ঘুমিয়েছে যে মুখচোখ কী রকম অস্বাভাবিক ফুলে গেছে। থমথমে মতন হয়ে রয়েছে মুখটা।

তনুশ্রী বসতে তিতি বলল, ‘সমরদাকে ডাকতে পাঠিয়েছি।’

চিন্টু তার দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। অপ্রাসঙ্গিকভাবে তনুশ্রী বললেন, ‘খেয়েছ তোমরা?’

—‘হ্যাঁ’ তিতি জবাব দিল।

তনুশ্রী বললেন, ‘চিন্টু কাল রাতে ফেরোনি কেন? কোথায় ছিলে?’

—‘সেইটা কি খুব জরুরি? এখন এই সিচুয়েশনে?’ চিন্টুর গলায় যথাসম্ভব বিরক্তি।

—‘হ্যাঁ জরুরি। একজন কাল রাতে বা আজ ভোরে কাউকে না বলে কোথাও গেছেন, ফিরছেন না। এটা তোমার ক্ষেত্রেও হতে পারত। কী করতাম আমরা?’

—‘চিন্টু বলল, যদি নিয়ে কথা হচ্ছে না। আমি ফিরেছি। বস ফিরছে না। বস ফিরছে না বলে কি আমার ওপর রিভেঞ্জ নেবে না কি?’ সে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল।

সমর এসে গেছে। বলল, ‘কোনও খবর পাওয়া গেল সাহেবের?’

—‘সেটা তো আমরাও তোমায় জিজ্ঞেস করতে পারি’, তনুশ্রী বললেন।

তনুশ্রীর বলার ভঙ্গিতে একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল সমর। সে বলল, ‘আমি তো সকাল নটা চল্লিশে যেমন আসি এসে গেছি। নীচে অপেক্ষা করছি। বারোটা বাজল দেখে বদনকে জিজ্ঞেস করলুম তো বলল সাহেব আগেই চলে গেছেন। গাড়ি নিয়ে আমি অফিসে গিয়ে বসে আছি তখন থেকে। চ্যাটার্জিসাবের অফিস থেকে একটা প্যাকেট আনতে বলে রেখেছিলেন কালকে। সেটা এনে আবার অফিসে। বিশ্বেসবাবু বারবার আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন আমি কিছু বলতে পারিনি।’ তনুশ্রী বললেন, ‘প্যাকেট? কী প্যাকেট?’

—‘আছে গাড়িতে। দেখবেন?’ কিছু একটা করতে পেরে সমর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

একটু পরে প্যাকেটটা এনে দিতে তাড়াতাড়ি সেটা খুললেন তনুশ্রী। চিন্টু আবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। প্যাকেটের মধ্যে একটা ওয়াইনের বোতল দমপেরিওঁ, সাতশো পঞ্চাশ মিলিলিটারের। একটা শ্যানেল নং ফাইভ সঙ্গে। প্রচুর কুচো কাগজ দিয়ে প্যাক করা জিনিসগুলো।

তিতি মায়ের মুখের দিকে তাকাল। মেকাপের তলায় ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে তনুশ্রীর মুখ। সে প্রমীলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রাতে বাবা খাওয়া ছেড়ে উঠে গেল, তারপর কী হল? কোথায় গেল? বলো তো ভাল করে।’

—‘তেতলায় উঠে গেলেন।’

—‘তেতলায়? আগে বলোনি তো!’ তনুশ্রী বললেন।

—‘সারারাত তেতলাতেই ছিল?’ তিতি বলল।

—‘তা আমি কী করে জানব? চিন্টুদাদার জন্যে আরও খানিক সবুর করে আমি নীচে শুতে চলে গেছি। যতক্ষণ ছিলুম ওপরে খুটখাট আওয়াজ শুনেছি। এখন বুঝতে পারছি খুব রেগে গেসলেন রাত্তিরে। ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। আমি তো ভয়ে মরি।’

চিন্টু বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা তুমি এবার যাও। তোমরা যাও বদন, সমর যাও।’

যাবার ইচ্ছে ছিল না কারুরই। কিন্তু আদেশ জারি হয়ে গেছে। আর থাকা চলে না। অনিচ্ছুকভাবে চলে গেল তিনজনে।

চিন্টু বলল, ‘ইটস ডেফিনিটলি আ কেস অব কিডন্যাপিং।’

তনুশ্রী ফ্যাকাশে মুখে বললেন, ‘কী করে জানলে?’

—‘বুঝতে পারছ না? একটা হিউজ অ্যামাউন্ট ক্যাশ চেয়েছিল বসের থেকে, বস সেটা দিতে চায়নি। লাইফ-রিস্ক নিয়েছে। আমাদের একটা হিন্ট দেবার কথা ভেবেছিল। কাউকে বাড়িতে পায়নি। তাই রেগে গেছিল। তেতলায় সেফটির জন্যেই উঠেছিল। এখন গ্যাঙের লোকেরা আগে থেকে সেখানে ছিল কি না। বসকে ক্লোরোফর্ম করে, শেষ রাতের দিকে বিরজু ঘুমোলে নিয়ে গেছে কি না কে বলবে। হয়ত শিগগিরই আমাদের কাছে র‍্যানসম চেয়ে চিঠি আসবে।’

তিতি আর থাকতে পারল না, বলল, ‘এই ফোর্থ ক্লাস থ্রিলারটাই কি একটু আগে চিত হয়ে পড়ছিলি?’

চিন্টু বলল, ‘ফোর্থ ক্লাস থ্রিলার? দিস ইজ হোয়াটস হ্যাপনিং অ্যারাউন্ড। পেপার পড়িস? আর তা নয়ত বি. বি. রায়ের মতো একটা টু হানড্রেড পার্সেন্ট সলভেন্ট লোক উইথ সো মেনি আয়রন্‌স্‌ ইন দা ফায়ার, হঠাৎ ওয়ান ফাইন মর্নিং গেটস আপ অ্যান্ড ডিসাইডস হি উড ওয়াক আউট? কোনও সেন্স আছে এ গল্পটার? তিতি বলল, ‘কে বলতে পারে বাবার মনের মধ্যে কী ছিল?’ বলেই সে হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে বুঝতে পারল তার মুখ থেকে একটা ভীষণ সত্যি কথা বেরিয়ে গেছে। সে আস্তে আস্তে বলল, ‘আমরা কেউই বোধহয় জানি না, বাবা…বাবা কী ভাবত, কী ছিল বাবার মনের মধ্যে। আচ্ছা মা, তুমি বলতে পার বাবার স্পিরিচুয়াল লীনিংস ছিল কি না!’

তনুশ্রীর মনে পড়ল লালাবাবু বলে কে একজন হঠাৎ সংসার ত্যাগ করে বেরিয়ে যান। একটা এই জাতীয় পদ্য পড়েছিলেন কোনও সময়ে। কিন্তু স্পিরিচুয়াল লীনিংস বিজু রায়ের! মাস কয়েক আগে একজন বাবা এসেছিলেন এদিকে। দলে দলে লোক তাঁকে দেখতে, তাঁর কীর্তন শুনতে যাচ্ছিল। তনুশ্রীদের দলের অনেকেই যায়। তনুশ্রী বিজুকে বলেছিলেন দুজনে যাবার কথা। বিজু রায় বলেন, ‘বাবা ফাবা ওসব বুজরুকের জন্যে আমার সময় নেই। তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যাও না, কে বারণ করেছে! তবে মজে যেয়ো না, এসব বাবারা ডেঞ্জারাস হয়।’

তনুশ্রী বললেন, ‘না।’

—‘কিন্তু মা, ঠাম্মা কীরকম রিলিজিয়াস ছিল, বাবা তো ঠাম্মার সঙ্গে রোজ নিয়ম করে খানিকটা সময় কাটাত। কী করত তখন? তাছাড়া একটা কথা আমাদের মনে হয়নি, ঠাম্মা মারা গেছে অক্টোবর মাসে আর এটা ডিসেম্বর।’

—‘তো কী?’ চিন্টু বলে উঠল, ‘সেঞ্চুরি করতে আর কটা বছর বাকি ছিল ঠাম্মার? মারা যাবে না তো কি চিরদিন বসে থাকবে?’

তনুশ্রী বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘তুমি থামো। তোমার ঠাম্মাকে তোমার বাবা ভীষণ ভালবাসত। তিতি ঠিকই বলেছে।’

—‘বস ভালবাসত? ঠাম্মাকে? কী করে বুঝলে?’ ঠাট্টার হাসি চিন্টুর গলায়। ‘হি ওয়াজ আ মানি-স্পিনিং মেশিন। কীভাবে আরও টাকা, আরও আরও কামানো যায় সব সময়ে তাই-ই ভাবত। অ্যান্ড হি ওয়াজ মেড আপ অব ডিউটিজ, ফর্ম্যালিটিজ। রোজ বাঁধা আধ ঘণ্টা সময় দিত ঠাম্মাকে। ছোটতে মনে আছে কী একটা বানাচ্ছিলাম, মাঝে মাঝে হেলপ করছিল। হঠাৎ ঘড়ি দেখে উঠে পড়ল। আমি বললাম কোথায় যাচ্ছ ড্যাড, বোসো না! বলল, ‘তোমার জন্য নির্দিষ্ট সময় ছিল পঁয়তাল্লিশ মিনিট, পার হয়ে গেছে মাই বয়।’ উঠে পড়ল। এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। হুঁঃ!’

তিতি বলল, ‘মা একবার ওপরে গেলে হয় না?’

তনুশ্রী উঠে পড়ে বললেন, ‘চলো। চিন্টু তুমিও চলো। ওদের কাউকে ডাকব? বিরজু, সমর?’

‘তুমি কি এখনও দাদার গল্পটার ঘোরে রয়েছ?’ তিতি জিজ্ঞেস করল।

ঘরে ঢুকতেই শাশুড়ির নতুন করা ফটোগ্রাফটা যেন সকৌতুকে তাকাল তনুশ্রীর দিকে। এটা অনেক আগেকার ছবি। এই বাড়িতে নতুন আসার পর তোলানো বোধহয়। তারপর থেকে আর ফটো তোলবার কোনও সুযোগ হয়নি। তনুশ্রীর সব কিছু মেনে নিতে পারতেন না ভদ্রমহিলা। একটু টিকটিক করতেন। বিরক্তিকর। কিন্তু কোনও দিন জোর করে কিছু চাপাননি। বা খুব অশান্তি টশান্তি করেননি। ক্রমশ ক্রমশ ওপরে বন্দী হয়ে গেলেন, আর নীচে নামতেন না। ওপরে যাবার সময়ে পেড়ে শাড়ি পরে, মাথায় ভাল করে সিঁদুর দিয়ে, হাতে লোহা গলিয়ে যেতে হত। শখের গয়না পরলে বলতেন—‘কেন বউমা, বিজু যে তোমায় সবসময়ে ব্যবহারের জন্যে পাঁচ ভরির মটরমালা গড়িয়ে দিল? গলায় ও সব পুঁতি টুতি পরেছ কেন? এয়োস্ত্রী মানুষকে কি ওসব মানায়?’ আস্তে আস্তে নিয়ম করে ওপরে যাবার অভ্যাস চলে গেল তনুশ্রীর। উনি কিছু বলতেন না। তিন চার দিন পরে পরে হয়ত একবার ওপরে যাবার সময় হল, মন হল। চুল কেটে ফেলার পর, ভাল করে ঘোমটা দিয়ে যেতেন। প্রথম প্রথম বুঝতে পারেননি। একদিন দমকা হাওয়ায় অসাবধানে ঘোমটা খসে যেতে অনেকক্ষণ চেয়ে ছিলেন। চুলের দিকে। কিছু বলেননি।

ছাতের দিক থেকে দমকে দমকে ফুলের মিশ্র গন্ধ ঢুকতে লাগল। চিন্টু ছোটবেলায় ঠিক যে মাত্রায় ঠাম্মা ভক্ত ছিল বড় হতে হতে ঠিক সেই মাত্রায় উদাসীন হয়ে গিয়েছিল। খালি উপদেশ দেবে, নাতি বড় হয়ে গেছে বুঝতে চাইবে না। ও মেয়েটা কে দাদু? তোমার সঙ্গে বাড়ি ঢুকল! তোমার বন্ধু! বাবা-মা জানে? দুপুরে তো বাবা-মা কেউ ছিল না! কেউ না থাকলে মেয়ে-বন্ধু বাড়ি এনো না! একদিন চিন্টু রেগে বলেছিল, ‘আমার ঘরে তোমায় পাঁজাকোলা করে নিয়ে যাব নাকি? দেখে ফ্ল্যাট হয়ে যাবে।’

—‘ফ্ল্যাট হয়ে যাবার মতন আবার কী রেখেছ ঘরে?’

—‘সে গেলেই দেখতে পাবে!’

—‘তোমার বাবা-মা দেখেছে তো? তাহলেই হল। আমার আর দেখে কাজ নেই।’

—‘ওল্ড হ্যাগ’—মনে মনে বলত চিন্টু।

এ ঘরে নিচু খাট ঢোকাতে চেয়েছিলেন বিজু। মা রাজি হননি। তাঁর পুরনো পালঙ্ক সুজনি ঢাকা পড়ে আছে। আলমারিতে চাবি নেই। তিতি একটু হাত দিতেই খুলে গেল। পুরনো দিনের পেল্লাই আলমারি।

তিতি বলল, ‘মা এটা কিন্তু খোলা।’

তনুশ্রী বললেন, ‘কী হাতি ঘোড়া থাকবে ওর মধ্যে?’ তাঁর অধৈর্য লাগছে। কোনও কাজের কাজ হচ্ছে না, এরা শুধু ছেলেমানুষি করছে। আলমারির দুটো তাক ভর্তি ঠাম্মার জামাকাপড়। আর একটাতে ঠাসা গরম জামা। ঠাম্মা খুব শীতকাতুরে ছিল। ড্রয়ারগুলো টেনে টেনে দেখছে তিতি।

—‘মা এ চাবিটা কী?’

—‘সিন্দুকের চাবি,’ ক্লান্তভাবে বলে শাশুড়ির বিছানায় ধুপ করে বসে পড়লেন তনুশ্রী।

—‘সিন্দুক! খোল তিতি!’ চিন্টু উত্তেজিতভাবে বলে উঠল।

কয়েকবার চেষ্টার পর তিতি খুলে ফেলল সিন্দুকটা। দুটো তাক। ওপর নিচ একদম খালি।

‘চিন্টু বলল, ‘মা। হিয়ার অ্যাট লাস্ট ইজ সাম ক্লু।’

তনুশ্রী সিন্দুকের শূন্য গহ্বরটা দেখছিলেন। বললেন, ‘কী থাকবে ওর মধ্যে? কিছু ছিল না।’

ফাঁকা সিন্দুক এভাবে কেউ চাবি দিয়ে রাখে না। বাবা নিশ্চয় এর মধ্যে আনডিক্লেয়ার্ড মানি, সোনার বিস্কিট ফিস্কিট রাখত।’

তিতি বলল, ‘মা, ওদিকে একটা সুটকেস ছিল। নেই।’

‘—কী সুটকেস?’ তনুশ্রী বললেন।

—‘একটা ডাকব্যাকের সুটকেস। আমার ছিল ওটা। ঠাম্মার ঘরে রেখে দিয়েছিলাম।’

—‘বুঝতে পারছ এতক্ষণে যা বলেছি ঠিক বলেছি কি না?’ চিন্টু বলল, ‘বাবা সিন্দুক থেকে সমস্ত টাকা বার করে ওই সুটকেসটাতে ভরেছে, তারপর গ্যাঙের নির্দেশমতো দিতে গেছে। ওরা বাবাকে ধরে নিয়ে যায়নি। বাবাই ওদের টাকাটা দিতে গেছে।’

তনুশ্রী বললেন, ‘বারবার এক কথা বোলো না। ওই সিন্দুকে ওসব কিছু থাকত না। তোমার বাবা অত কাঁচা কাজ করবার লোক নয়।’

—‘কিন্তু সুটকেসটা ছিল, এখন নেই মা,’ তিতি বলল।

—‘এর থেকে প্রমাণ হয় সুটকেসটা তোমার বাবা নিয়ে গেছে। যেখানেই গিয়ে থাক। আর কিছু না।’

চিন্টু বলল, ‘বাবার কি ভাল লাগেজ নেই, যে একটা পুরনো ব্যাগ ওভাবে নিয়ে যাবে? আসলে এটা হালকা, নোট ভরার পর শুধু কাগজের ওয়েটটা বাড়বে তাই…।’

তিতি বলল, ‘যাই হয়ে থাক, এবার আমাদের পুলিশে খবর দিতে হয়।’

—‘না, না’ তনুশ্রী বলে উঠলেন, ‘পুলিশ কেন? একটা বিশ্রী স্ক্যান্ডাল হবে। ওয়েট করো। দেখো কালকেই হয়ত এসে পড়বে।’

এত ক্লান্ত তবু বিছানায় শুয়ে একফোঁটাও ঘুম এল না তনুশ্রীর। তিনি প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে গেছেন। বিজু রায় দুটো তিনটে সূত্র ফেলে গেছেন। তিনি যে স্বেচ্ছায় বাড়ি থেকে চলে গেছেন এটা বোঝাই যাচ্ছে। ওপরে হালকা সুটকেসটা নেই। নীচে বিজু রায়ের ঘরে একটা মাঝারি সুটকেসে সব সময়ে কিছু জামাকাপড় গোছানো থাকত, সেটাও নেই। বেরিয়েছেন একটা চাপে পড়ে। মহিলাটি চাপ দিচ্ছিল। বিজু আরও অনেক পুরুষের মতোই হয়ত যেভাবে দীর্ঘদিন দু নৌকোয় পা দিয়ে চলছিলেন সেভাবেই চলতে চাইছিলেন। কিন্তু মহিলাটি তা হতে দেবে কেন? মায়ের মৃত্যুর পর থেকে ক্রমাগত চাপ দিয়ে চলেছে। বিজু রায় হয়ত কাল রাতে তাঁকে বলে একটা ফয়সালা করতে চেয়েছিলেন। সেটা সম্ভব নয় দেখে আপাতত যা হাতের কাছে পেয়েছেন, নিয়ে চলে গেছেন। এখন একটা হনিমুন পর্ব চলবে। চিঠি-পত্র, কোর্ট-কেস এসব পরে। কিছুদিন পরে। ওই দমপেরিওঁ আর শ্যানেল নং ফাইভ বিজুকে ধরিয়ে দিয়েছে। শ্যাম্পেনটা যদি একা হত আলাদা কথা ছিল কিন্তু তার সঙ্গে পারফ্যুম মিলে বুঝিয়ে দিয়েছে উপহারটা কেমন মানুষের প্রতি উদ্দিষ্ট। বয় কাট, লম্বা ফিনফিনে, সিগারেট খায়, মদও যেমন খায়। জিনস পরা, শীতে হয়ত একটা পুরুষদের পোলো নেক সোয়েটার পরে। কানে বড় বড় রিং। আঙুলে মস্ত পাথর। খুব সম্ভব বিজুরই দেওয়া। মুখটা খালি তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। দেখতে পাচ্ছেন নিজের মুখ আয়নায়। কখন উঠে বসেছেন, রাত-আলোর ভুতুড়ে আভার আয়নার সামনে টুলে এসে বসেছেন নিজেই জানেন না। ভাল করে মেকাপ তোলা হয়নি আজ। গ্রে রঙের ওপর গোলাপি লেস দেওয়া রাত জামার ওপর থেকে ঝাঁকড়া চুলঅলা মাথাটা ভেসে আছে এবং মুখের ওপর জলের দাগ। চোখের জল।

তেইশ বছরের মতো হল না তাদের বিবাহিত জীবন? আর দু বছর বাদেই রজত জয়ন্তী। শর্মাজি, বসাক, পাইন সকলেই বলে রেখেছে পার্টির কথা রায় দম্পতিকে ভাবতে হবে না। ওরাই সব ব্যবস্থা করবে। দুলিচাঁদ বলেছিল তরল জিনিসের খরচ ওর। তেইশ বছর একসঙ্গে বাস করে তনুশ্রী বিজু রায়ের এই গোপন জীবনের সংবাদ জানে না। কবে থেকে আরম্ভ হয়েছিল এটা? তনুশ্রীর ভেতরটা শিউরে উঠল ভেবে সে বোধ হয় একেবারে নির্দিষ্ট একটা দিন দেখতে পাচ্ছে।

এই বাড়ির গৃহপ্রবেশ আর তনুশ্রীর বিয়ে ঠিক সাতদিনের আড়াআড়ি হয়েছিল। ঝকঝকে নতুন প্রাসাদ। দামি আসবাব, লোকজন, অষ্টমঙ্গলায় ঘুরে এসে এইরকমটাই দেখেছিল তনুশ্রী। খালি পাশাপাশি দুটো আলাদা ঘর দেখে সে ভুরু কুঁচকেছিল, দাঁত দিয়ে তলার ঠোঁটটা কামড়ে ধরেছিল। বিজু বললেন, ‘কী? পছন্দ হল? ঘর?’

স্ত্রী জবাব দিচ্ছে না দেখে মুখটা ভাল করে দেখতে দেখতে বিজু বললেন, কী হল? কান্না কান্নাভাব দেখছি যেন!’

—‘আমার সঙ্গ এর মধ্যেই ভাল লাগছে না?’

—‘সে কী? কেন?’

—‘আলাদা ঘর এখন থেকেই?’

—‘ওঃ হো!’ হেসে উঠেছিলেন বিজু। মাঝখানের দরজাটা খুলে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই তো একটা ঘর হয়ে গেল। গেল না? দুজনেরই প্রাইভেসি রইল। আবার… তা ছাড়া এটাই চলে। আমাদের সোসাইটিতে এরকমই হয়।’

সত্যিই পরে তনুশ্রী দেখেছে বসাকদের, শর্মাদের সবারই স্বামী-স্ত্রীর ঘর আলাদা। ব্যাপারটা নিয়ে শাশুড়িরও কম আপত্তি ছিল না। ঠারে-ঠোরে নানান কথা জানতে চাইতেন। অবশেষে কয়েক মাসের মধ্যেই চিন্টু পেটে আসতে নিশ্চিন্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ বাপু, যতই হ্যাট কোট পরে বেড়াক, ছোট খোকা বেশি বয়সে থিতু হল। যত তাড়াতাড়ি ছেলেপিলে হয় ততই ভাল। মানুষ করতে হবে তো?’

এই উচ্চকোটির প্রাইভেসি। এই জিনিসটা অতিশয় সন্দেহজনক। সারাদিনই তো কাজের ঘোরে আলাদা আলাদা ঘুরছ। রাত্রেও স্ত্রীর সঙ্গে খোলামেলা হতে পারো না? অবশ্য, সত্যি কথা বলতে কি তনুশ্রীর নিজের তাতে সুবিধেই হয়েছে। তার অনেক রকম নার্সিসীয় পাগলামি আছে। কোনওদিন নিজের পা, কোনওদিন হাতের আঙুল, কোনওদিন পেট এসব দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যায় তনুশ্রী। আরে আঙুলগুলো একটু থ্যাবড়া থ্যাবড়া লাগছে কেন আজ? ইস্‌স্‌ কী সমান পেট, কেউ বলবে দুই সন্তানের মা তনুশ্রী! পায়ের সৌন্দর্য এ জীবনে আর কাউকে দেখানো যাবে না। সেই হনিমুনে আন্দামান আইল্যান্ডস-এ বিজু রায় দেখেছিলেন। তারপরে আর…। অথচ এই তিতি তিতির বন্ধুরা কেমন স্বচ্ছন্দে পা দেখিয়ে দেখিয়ে বিচরণ করছে! এ ছাড়াও একলা ঘরের হাওয়ায় ভাবনাগুলোকে যত সহজে রঙিন বেলুন করে দেওয়া যায়, পাশে আর একজন ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোলে সেটা করা যায় কি? কত রকমের বর্ণালি, স্বপ্ন, তার ঘোরে তনুশ্রী আপনমনে হাসে, ভ্রূকুটি করে, কথা বলে—সে সব কি অপরের কানে শোনবার? না, দেখবার? তেইশ বছরের বিবাহিত জীবন একটা লম্বা আনন্দের দিন। বিজুর এজন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য। এই আমোদের উপকরণ সে জুগিয়ে গেছে অকাতরে। কিন্তু নিজে? নিজে যেন থেকে গেছে বাইরের মহলেই। বরাবর। লোকটা মনে-প্রাণে কাজ-পাগল ছিল। কিন্তু যা কিছু করণীয় সেগুলো ঘড়ির কাঁটার মতো নির্ভুলভাবে করে গেছে। চিন্টু বলছিল ডিউটিজ-এর কথা। নাকি পঁয়তাল্লিশ মিনিটের বেশি সময় তাকে দিতে পারেনি। ওইটুকুই তার জন্য নির্ধারিত ছিল। তনুশ্রী নিজেও অনেক সভাসমিতি করে। সে বোঝে চূড়ান্ত রকমের অর্গানাইজড ছিল লোকটা, ব্যবস্থিত। না হলে ওইভাবে উন্নতি করা যায় না। আর সব সময়ে ঠাণ্ডা, কু-ল। কিন্তু কাজের বাইরে বিজু রায়ের অন্য একটা জীবন ছিল না সে কথা এখন গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাচ্ছে না। তনুশ্রীর সঙ্গে তেইশ বছরের সম্পর্কে বিজু রায়কে সে কখনও উত্তাল-উদ্দাম হতে দেখেনি। সেই প্রথম ক সপ্তাহ ছাড়া। অথচ সে তনুশ্রী বিজু রায়ের থেকে যোল বছরের ছোট, বলতে গেলে স্বামীর তুলনায় তরুণী। আরও তরুণী, আকর্ষক রেখেছে সে নিজেকে। কিন্তু…। বিজু রায় কেন যেন কোনওদিনই তেমন আকৃষ্ট হলেন না। মাঝের দরজাটা রাতে খুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে সম্ভবত বছর তিনেক। তার আগে কমছিল। কিন্তু একদম বন্ধ বছর তিনেক। তনুশ্রী বেঁচেই গিয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এই তিন কি বড় জোর চার বছরই হল বিজু রায়ের জীবনে নতুন নারীর, নতুন গল্পের আয়ু।

গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে তনুশ্রীর। সে উঠে বসে জল খেল ঢকঢক করে অনেকটা। কান জ্বালা করছে। হাতের পাতা জ্বালা করছে। তনুশ্রী টয়লেটে গিয়ে হাতে কানে জল দিয়ে এল। কেচ্ছা! স্ক্যান্ডাল! যে স্ক্যান্ডালের কথা আজকেই আলোচনা হচ্ছিল সেই স্ক্যান্ডাল এখন তনুশ্রীর নিজের ঘরে। কে ভেবেছিল স্ক্যান্ডাল শুধু ফ্যাশানেবল মোটেই নয়, বরং জ্বালায়! তনুশ্রীর চোখ দিয়ে এত জল পড়ছে কেন? এটা যদি কোর্টে ওঠে, তনুশ্রী কিছুতেই বিজু রায়কে ডিভোর্স দেবে না। কিছুতেই না। সব কিছুই তার পক্ষে। ছেলে, মেয়ে, বন্ধুবান্ধব, সোসাইটি। লড়ুক না কেন বি. বি. রায়। যত পারে লড়ুক। ডিভোর্স হলেও কী পরিমাণ অ্যালিমনি বিজু রায়কে দিতে হবে তা তার কল্পনার বাইরে। স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে এই বাড়ি এবং অস্থাবরের মধ্যে লিকুইড ক্যাশ সমস্ত নিয়ে নেবে তনুশ্রী। সমস্ত। কিন্তু তারপর? তাতেও হবে তো! সন্তুষ্ট হতে পারবে? না। কক্ষনো না। স্বয়ং বিজু রায়কেই চাই। এই বাড়িতে তার অভ্যস্ত চলাফেরার চেনা শব্দ। একত্রে পার্টিতে যাওয়া। বাড়িতে কোনও উৎসব হলে একটু আধটুও আলোচনা। এটুকুই। এটুকু চলে গেলে তনুশ্রীর জীবনের ভিত ধসে যাবে। সে তখন আর কোনও অত্যাচারিত মহিলা সমিতির প্রেসিডেন্ট নয়। একজন সাধারণ পরিত্যক্ত গৃহবধু। সে কারওর জীবন সম্পর্কে সভা বসিয়ে সবার মতামত নিচ্ছে না। তার জীবন নিয়েই সভাটা বসেছে। প্রেসিডেন্টের আসন খালি। প্রেসিডেন্ট মিসেস তনুশ্রী রায়, ডিভোর্সড হতে যাচ্ছেন, পরিত্যক্ত, ন্যাচারেলি তাঁর স্বামীর দ্বারা। কেন? দুজনের মতান্তর? মনান্তর? বিজু রায় বাঘের মতো নাক ডাকেন? বা শারীরিক অত্যাচার করেন মদ খেয়ে যা আর সত্য করা যায় না বলে মিসেস তনুশ্রী রায় ডিভোর্স নিতে বাধ্য হচ্ছেন? না, তা নয়। চুপ চুপ। ফিসফিস। বিজু রায়, বি. বি. রায় দা গ্রেট ইজ অ্যাট লং লাস্ট ইন লভ উইথ আ গার্ল, লেডি, উওম্যান? কে। কে সে? অবশেষে। বেচারা বিজু রায়। স্ত্রীটি তো সাজানো পুতুল। হৃদয় মন বলে কিছু ছিল না। স্বার্থপর, আত্মকেন্দ্রিক। চার বছর ধরে অ্যাফেয়ার চলছে, জানত না পর্যন্ত, এত বোকা? না, না, শি ডাজন’ট কেয়ার। তা ছাড়া ওর নিজের নেই? একটা ছেড়ে, দশটা…।

কিছুদিন হল বসাক আর পাইনকে বড্ড প্রশ্রয় দেওয়া হয়ে গেছে। মিউজিক কনফারেন্স, থিয়েটারে, ফিলম ফেস্টিভ্যালে যেতে হলে, যেতে হয়ই, এ ছাড়া উপায়ও নেই। কেন না বিজু যাবেন না। বিজুর অত সময় নেই। বসাক পাইনের এসব ঝোঁক আছে। ওরা যায়। ওদের স্ত্রীদের নেই। বিজু রায়ের নেই। কাজেই এই জাতীয় জুটি। এসব বিজু জানেন। কোনও ব্যাপারই নয়। কিন্তু ইদানীং এটা শুধু গান-পাগলামি বা থিয়েটার-ফিলমের ঝোঁকের মধ্যে নেই। বসাক আর পাইনের মধ্যে তাঁকে নিয়ে একটা সূক্ষ্ম দ্বন্দ্বযুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। এটা তিনি ঘটতে দিয়েছেন। ফ্লার্ট করতে বরাবরই ভাল পারে তনুশ্রী। সেই স্কুলের ফ্রক পরার বয়স থেকে। এ একটা নেশা। এখনও এ নেশার জের কাটাতে পারে না তনুশ্রী। বিশেষ করে শাশুড়ি মারা যাবার পর বোধহয় একটু বেশি রকমের বেহিসেবি হয়ে পড়েছে। কিন্তু সবটাই বিজু রায়, তার স্বামী পেছনে আছে বলে, একটা শক্ত মাটি পায়ের তলায়, মাথার ওপর একটা দৃঢ় ছায়া। আশ্রয়। বিজু কি কিছু টের পেলেন? কানাঘুসো? তাঁদের সোসাইটি অত ঠুনকো নয় যে দু এক দিন তনুশ্রী রায়কে বসাক বা পাইনের সঙ্গে দেখলে একেবারে মুচ্ছো যাবে। রাজেশ পাইনের সঙ্গে দু দিন সুন্দরবন ট্যুর করে এলেন কদিন আগে। বিজু রায়কে বলেই যাওয়া। তবে একা রাজেশ যাচ্ছে এটা খুলে বলা হয়নি। একেবারে লাস্ট মিনিটে টিকিট করা, তাদের লঞ্চে কেবিন পাওয়া গেল না। সজনেখালি ট্যুরিস্ট লজে রাত কাটাবার জন্যে নামিয়ে দিল। এক বিঘত করে ঘর। টেকা যায় না এত ছোট। সাদা ফুলের মতো বিদেশি নাইটির ওপর কালো শাল জড়িয়ে অতএব তনুশ্রী বেরিয়ে এল বাইরের কাঠের বারান্দায়। ইলেকট্রিক আলো নেই। দরজার সামনে একটা করে হারিকেন-লণ্ঠন বসানো। কী অদ্ভুত ঝকঝকে একটা জড়োয়া সেটের মতো আকাশ! আর তাতে জমকালো পোশাক পরা মানুষের মতো সব নক্ষত্র। যেন জীবন্ত জোড়া জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে, তোমার দিকে, বলছে গল্প কর। বেরিয়ে এস। দেখ। দেখাও। তখন আর নিজেকে সীমাবদ্ধ মানুষী বলে মনে হয় না। রাজেশ যখন সেই নির্জন রাতের বারান্দায় চারদিকে সুন্দরবন, জল, আর মাথার ওপর জ্যান্ত আকাশের তলায় তাকে অর্কিডের গুচ্ছের মতো জড়িয়ে ধরল, যখন তারপর দুজনে দুজনের শরীরের স্বাদ নিতে নিতে বাঘ আর বাঘিনী হয়ে গিয়েছিল, তখন কোনও অপরাধবোধ তো হয়ইনি, বরং মনে হয়েছিল এতদিনে এই প্রথম জানল কী ছিল ভেতরে, কী প্রবল আবেগ, কী শক্তি। রাজেশ তনুশ্রীর চেয়ে কয়েক বছরের ছোটই হবে। বলেছিল, ‘আই অ্যাম ফিলিং লাইক আই ওয়াজ আ ভার্জিন বিফোর দিস।’ সেই এক অনুভূতি তনুশ্রীরও। কিন্তু সে অনেক সতর্ক, সাবধান। রাজেশ পরে যতই এখানে সেখানে যাবার প্রস্তাব দিক। কর্ণপাত করেনি। ঠিকসময় সঠিক সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তনুশ্রী অত সস্তা না। সিংহেরা সিংহীরা না বারো বছরে একবার? ইতিমধ্যে বসাক তাদের দুজনের মধ্যে একটা গোপন বৈদ্যুতিক আঁতাতের আঁচ পায়। ও-ও তো তালে আছে। কিন্তু ওই আঁচ পাওয়া পর্যন্তই। প্রমাণ কিছু নেই। কিছু নেই কি? পুলিসি তদন্ত হলে, প্যাসেঞ্জার লিস্টে দেখা যাবে না রাজেশ পাইন আর তনুশ্রী রায়? কোনও মিসেস পাইন নেই! আচ্ছা রাজেশই তো বুক করেছিল ঠিকঠাক পাইন আর রায় নামেই বুক করেছিল তো? তার জানবার কথা নয়। সর্বনাশ! জনা পঞ্চাশেক লোক ছিল লঞ্চে। এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। যদিও তার চোখে ছিল প্রায় মুখ-ঢাকা গগ্‌লস্! চুল সেট করানো ছিল এমনভাবে যে মুখের অর্ধেকটা প্রায় ঢাকা। জিনস আর শার্ট পরেছিল। দুটি বেলজিয়ান ছেলে ছিল। ভ্যাগাবন্ডের মতো দেখতে, রং জ্বলা তাপ্পি দেওয়া শর্টস পরা, তলায় সুতো ঝুলছে, আসলে য়ুনিভার্সিটির ছাত্র কিন্তু, ভারত দর্শনে বেরিয়েছে। ওদের সঙ্গেই এক টেবিলে বসে লাঞ্চ খেয়েছে। কথা বলেছে। আর একজন ছিল এক দিল্লিওয়ালা বুড়ো! মজবুত গাঁট্টাগোট্টা বুড়ো অবশ্য। সে বাঘের পাগ-মার্ক, আর হরিণের খুরের গর্ত দেখিয়েছিল নেতি ধোপানিতে। এর সঙ্গেও অনেক সময় কাটানো হয়েছে। লঞ্চের কেউ তাকে আদৌ বাঙালি বলে বুঝতে পেরেছে কি না সন্দেহ। অন্যান্য যাত্রীরা বেশির ভাগই ফ্যামিলি নিয়ে এসেছে। মিনিটে মিনিটে বাচ্চাদের পোশাক বদলাচ্ছে, মেয়েরা নিজেদের কার্ডিগান, শাল পালটাচ্ছে আর হরেকরকমের ড্রাই ফুড বার করছে। যে যার গ্রুপে জমে ছিল। লক্ষ করবার মতো কেউ ছিল না। সে লক্ষ করেনি। কিন্তু কেউ যদি তাকে লক্ষ করে থাকে, কেচ্ছার গন্ধ পেয়ে থাকে… বিজু রায়কে কেউ কিছু বলে থাকে। বলবেই বা কী? রাত্তিরবেলা সেই নিশ্ছিদ্র অন্ধকারে সজনেখালির টুরিস্ট লজে নিশ্চয়ই কোনও চোখ ছিল না। বিজু রায় তো জানতেনই, তনুশ্রী রাজেশের সঙ্গে সুন্দরবন যাচ্ছে। তবে?

তনুশ্রীর বড্ড গা শিরশির করতে লাগল। বারবার বাথরুম পাচ্ছে। তিনি, তাঁরা শর্মা বা বসাকদের মতো তিন পুরুষে বড়লোক তো নন। এই সেদিন পর্যন্ত শাশুড়ি ওপরে যখের মতো পুরনো সব মূল্যবোধ আঁকড়ে শুয়ে থাকতেন। এ সবের তো একটা প্রভাব আছেই। দু জোড়া চোখ। এক জোড়া কোটরাগত, প্রশ্নে ভরা কিন্তু কেমন একটা তীক্ষ্ম কৌতুক সে চোখে, শাশুড়ির চোখ। আর এক জোড়া বিজু রায়ের, অন্যমনস্ক। সব সময়ে কিছুতে যেন মগ্ন হয়ে আছে লোকটা। মা বলল—‘বারান্দা দিয়ে দেখে আয়, বর এসেছে, বুড়ো-বুড়ো করছিস, কেমন বুড়ো বর তোর।’ আগেই দেখেছিল তনুশ্রী, সে কথা ভাঙা হয় নি। বারান্দা দিয়ে দেখল, স্বাস্থ্যবান, জোড়-টোড় পরে চমৎকার মানিয়েছে, মাথায় চুলগুলো দেখবার মতো, বেশ পুলক জাগাবার মতো। কিন্তু বিজু রায় কিরকম যান্ত্রিক ধরনের মানুষ ছিলেন। কোনও যেন রসকষ নেই। যদিও অত্যন্ত কর্তব্যপরায়ণ। আসলে মানুষের ধাত। যে মানুষের যা। বলবার কিছু নেই। তনুশ্রীর নিজেরও খুব একটা ভাবাবেগ-টেগ ছিল না। তার একটা দিক ছিল প্রচণ্ড হিসেবি। এখনও আছে। এই যে রাজেশকে ঠেকিয়ে রেখেছে এটাও সেই হিসেবি মন থেকে এসেছে। তখন ছিল সীমাহীন উচ্চাকাঙক্ষা। যা কোনও দিন স্বপ্নেও আশা করেনি সেই বিত্ত, সেই মান পেয়ে তনুশ্রী উচ্চাকাঙ্ক্ষার লাগাম ছেড়ে দিয়েছিল। দারুণ দারুণ সেজে পার্টিতে যাব। ফ্যাশন-ম্যাগাজিনের জীবন। বহু বহু পুরুষ তাকে ঘিরে। সে মাতালের মতো দুলছে, দুলে দুলে হাসছে। পাশে বিজু রায়। ঘুরছে, ফিরছে, অদর্শন হচ্ছে আবার কাছে চলে আসছে। মিসেস তনুশ্রী রায়ের স্বামী। ‘স্বামী’, ‘কর্তা’ প্রভুত্ববাচক বলে তাঁদের সংস্থা আজকাল শব্দগুলো ব্যবহার করতে দ্বিধা করছে। কিন্তু লোকটা পাশে থাকলে গর্বে বুক ফুলে যেত। নির্ভরযোগ্য পুরুষ বটে। স্বামী। ঠিকই। কিন্তু বিজু কোনও দিনও প্রভূত্ব খাটায়নি। অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছে। একদম ভোরের দিকে তনুশ্রী ঘুমিয়ে পড়লেন।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress