Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বীতংস || Narayan Gangopadhyay

বীতংস || Narayan Gangopadhyay

সংসার-আশ্রমে থাকবার আর কোনো অর্থ হয় না।

সুন্দরলালের মোহ কেটে গিয়েছে অন্তত। আজ যে তোমার বন্ধু, সামান্য অর্থের জন্যে কাল সে তোমার গলা টিপে ধরতে পারে। বড়ো আদরের যে-সহোদর ভাইটিকে তুমি একদন্ড চোখের আড়াল করতে পার না, এক ছটাক জমির জন্যে কাল হয়তো সে তোমার নামে এক নম্বর ফৌজদারি রুজু করে দেবে। যে-রূপবতী স্ত্রীর পায়ে যথাসর্বস্ব পণ করে তুমি কাপড়ে গহনায় নৈবেদ্য সাজিয়ে দিচ্ছ, একদিন ভোর বেলা হয়তো দেখবে গাঁয়ের ছটু তেওয়ারির সঙ্গে সে রাতারাতি হাওয়া হয়ে মিলিয়ে গিয়েছে। সুতরাং, মোহমুদগুরের ভাষায় একদিন কা তব কান্তা কস্তে পুত্রঃ বলে বেরিয়ে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

এবং সুন্দরলাল বুদ্ধিমান লোক। তাই তিরিশ বছর না পেরোতেই সংসার ছেড়ে শুরু হয়েছে তার অগস্ত্যযাত্রা। কোনো বন্ধুই আজ আর তাকে পিছু টানে না। মহিষ চুরির ব্যাপার নিয়ে গাঁয়ের জমিদারের সঙ্গে এখন আর মামলা করতে হয় না। ছটু তেওয়ারির সন্দেহজনক গতিবিধি লক্ষ করবার জন্যে দিনরাত চোখ-কান খাড়া করে থাকবার দরকার নেই। পাথরের মতো নির্মম রাঙামাটিতে কঠিন পরিশ্রমে লাঙল ঠেলে যদি ভালো গমের ফলন না করা যায়, তা হলেও এখন আর সংবৎসরের ভাবনা ভাবতে হয় না।

এ জীবনের সঙ্গে তার তার কি তুলনা হয়? সামনে একখানা ছবির মতো নীল পাহাড়, তার সর্বাঙ্গে সাঁওতাল পরগনার অপূর্ব বনশ্রী। দুমকা যাওয়ার রাস্তাটা পাহাড়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে অনেক দূর দিয়ে বেরিয়ে গেছে, সেখান থেকে এতটুকুও পোড়া পেট্রোল গ্যাসের গন্ধ এসে এখানকার আকাশ-বাতাসকে আবিল করে দেয় না। হর্নের বিকট শব্দে ভয়ত্রস্ত গোরুর পাল এখানে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালায় না। লাল রঙের বড়ড়া বাসখানা থেকে এক টুকরো পোড়া সিগারেট বা রেশমি শাড়ির একটা চলতি ঝলক মুহূর্তের মধ্যে যে একটা চাঞ্চল্যকর জগতের সংবাদ দিয়ে যায়, তার প্রভাব থেকেও এ জায়গাটা একেবারেই মুক্ত।

এখানে জঙ্গলের মধ্যে ডুম ডুম করে টিকারা বাজে। হাওয়ায় হাওয়ায় স্বপ্নের মতো শালের ফুল উড়ে যায়। যখন মহুয়াবন আকুল হয়ে ওঠে, ছোটো ছোটো গোলাপজামের মতো মহুয়ার সাদা ফুলগুলি তিক্তমধুর রসে টসটস করতে থাকে, আর তার গন্ধে হরিয়ালের দল এসে ডালে পাতায় নাচানাচি করে, তখন সুন্দরলালের যেন নেশা ধরে যায়। সত্যিকারের আনন্দ তো এইখানেই। মোতিহারির আদালতে যারা ফৌজদারি মামলার তদবির করে, কিংবা সীতামারির চিনির কলে আখের দালালি করেই যারা দিন কাটিয়ে যাচ্ছে, তারা এর মর্ম কী বুঝবে?

তারা না-ই বুঝল, কিন্তু সুন্দরলাল বুঝেছে। এখানকার সাঁওতালদের মনের ওপর রীতিমতো আসন গেড়ে বসেছে সে। তারা তাকে শ্রদ্ধা করে, হয়তো বিশ্বাসও করে আজকাল। সুন্দরলাল গেরুয়া নেয়নি বটে, তবু সে সন্ন্যাসী। দন্ডী কিংবা ব্রহ্মচারী, এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে সাঁওতালেরা কখনো ব্যগ্র হয়ে ওঠে না। সুন্দরলাল হাত দেখতে জানে, যা বলে তা নাকি হুবহু মিলে যায় সব। শিকড়-বাকড় সম্বন্ধেও তার প্রচুর জ্ঞান, বহু কঠিন রোগে তার ওষুধ নাকি অব্যর্থ ক্রিয়া দেখিয়ে দিয়েছে।

সে শৈব না রামায়েত না গাণপত—এ নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু দেখা যায় তার কোনোটার ওপরেই বিদ্বেষ নেই। বোমভোলার নামে সে গাঁজার কলকিতে দম চড়িয়ে দেয়, সুর করে তুলসীদাসী রামায়ণ পড়ে। এখনও যারা বোঙার পুজোয় মুরগি বলি দেয়, তাদের পুজোর প্রসাদ নিতে তাকে কখনো আপত্তি করতে দেখা যায় না। সময় তো মোটে দু-মাস, কিন্তু এর মধ্যেই সাধু সুন্দরাল মহাপুরুষ সুন্দরলালে রূপন্তরিত হওয়ার উপক্রম করছে।

আকাশে সন্ধ্যার রং। সাঁওতাল পরগনার পাহাড়ের অরণ্যমন্ডিত চুড়োয় চুড়োয় নিবিড় ছায়া সঞ্চারিত হতে লাগল। শালবন ঘেরা দূরের উপত্যকাটা থেকে যে ছোটো পথটা ঘুরে ঘুরে ওপারে অদৃশ্য হয়ে গেছে, তাকে দেখে মনে হয় যেন মৃত একটা বিশাল অক্টোপাসের প্রসারিত নিশ্চল বাহু; যেন মৃত্যুর আগে এক বার ওই পাহাড়টাকে মুখের ভেতরে টেনে আনবার শেষ চেষ্টা করেছিল।

পাহাড়ের গায়ে গায়ে ওই পথটা বেয়ে সুন্দরলালের ভুটানি খচ্চরটা নেমে এল। এটা ওর সন্ন্যাসের সঙ্গী-নাগাসন্ন্যাসীর লোটা-চিমটার মতোই অপরিহার্য। সন্ন্যাসী হলেও সুন্দরলাল একেবারে বাবা ভোলানাথের মতো ছাই মেখে নিরঙ্কুশ হয়ে বেরিয়ে পড়েনি, অশন-বসনের দায়টা সে মানে। তাই ডেরা তুলতে হলে তার ছোট্ট গাঁটরিটাকে খচ্চরের পিঠেই বেঁধে নিতে হয়। তা ছাড়া কেন কে জানে, অন্তত সপ্তাহে এক বার তাকে শহর থেকে ঘুরে আসতে হয়, শিষ্য-সামন্তদের দর্শন দেবার জন্যেই হয়তো। সে-কারণেও খচ্চরটাকে বাদ দিয়ে চলবার জো নেই।

ছোটো ছোটো পায়ে খট খট করে হাঁটতে হাঁটতে খচ্চরটা একেবারে সাঁওতাল পাড়ার মাঝখানে এসেই থামল। মাথার পাগড়িটা খুলে একপাশ দিয়ে লাফিয়ে পড়ল সুন্দরলাল। কাঁচা চামড়ায় তৈরি পুরোনো নাগরা জুতোটার কাঁটা লোহাগুলোতে একটা কর্কশ শব্দ বেজে উঠল, আর সেই শব্দটাকে ছাপিয়ে ময়লা চাপকানটার লম্বা পকেটে ঝনঝন করে সাড়া দিলে কয়েকটি ধাতুমুদ্রা।

বহুদূর থেকে আসতে হয়েছে। খচ্চরটারও পরিশ্রম হয়েছে খুব। ঘাড়ের ওপরকার ছোটো ছোটো খাড়া লোমগুলোর তলাটা ঘামে ভিজে গেছে, মুখের পাশে পাশে ফেনার আভাস। দড়ির লাগামটা ধরে তাকে ধীরে ধীরে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল সুন্দরলাল।

কোথা থেকে এলে বাবাঠাকুর?

প্রশ্ন শুনে সুন্দরলাল তাকাল। সামনে ঝড় সাঁওতাল। গ্রামের লোকে মোড়ল বলেই মান্য করে তাকে। পরনে বস্ত্রের বেশি বাহুল্য নেই, শুধু ছোটো একটি ফালি নেংটির মতো করে পরা। মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলোকে ঘিরে আর এক টুকরো কাপড়, তার একপাশে গোটা তিনেক পালক গোঁজা। হাতে বাঁশের ছিলা-দেওয়া কুচকুচে প্রকান্ড একটা ধনুক, আর সেইসঙ্গে গোটা কয়েক বাঁটল।

কে, মোড়ল? কী শিকার পেলি রে?

কিছু নয় বাবাঠাকুর। মহুয়াবনে গিয়েছিলুম হরিয়াল মারতে, কিন্তু বরাত খারাপ। তুমি কোথা থেকে এলে?

আমি? প্রশান্ত হাসিতে সমুজ্জ্বল হয়ে উঠল সুন্দরলালের মুখ। এ হাসিটাকে আধ্যাত্মিক মনে করলে দোষ হয় না। সাধনার পথে সে যে কতখানি এগিয়ে গেছে, এ হাসি দেখে তার কিছুটা অনুমান করা চলে।

আমি? আমি গিয়েছিলুম ওপারের ওই গাঁয়ে। ওখানে একজনকে ভূতে ধরেছিল কিনা, এসে বড় কান্নাকাটি করছিল। তাই এক বারটি ঝেড়ে দিয়ে আসতে হল।

প্রগাঢ় শ্রদ্ধায় ঝড় এক বার সর্বাঙ্গ নিরীক্ষণ করলে সুন্দরলালের। সত্যি কথা—সন্ন্যাসের কোনো লক্ষণ নেই সুন্দরলালের শরীরে। চুলটি দিব্যি করে আঁচড়ানো, চাপকানের পকেট থেকে পিতলের ডিবে বের করে তা থেকে মস্ত একটা খিলিপান মুখে পুরে দিল। জর্দার চমৎকার গন্ধটা দস্তুরমতো লোভনীয়। চলার সঙ্গে সঙ্গে পকেটের টাকাগুলো ঝনঝন করে বেজে উঠছে।

তবু সুন্দরলাল যে সাধু মোহান্ত, তাতে সন্দেহ করবার হেতু কী!

মুগ্ধবিস্ময়ে ঝড় বললে, ভূত ছাড়ল?

ছাড়বে না? চালাকি নাকি? এ কি যে-সে মন্ত্র! হিমালয়ের চুড়োয় পাঁচশো বছর ধরে ধ্যান করছেন নাঙ্গাবাবা। ইয়া লম্বা লম্বা সাদা দাড়ি, লুটিয়ে পড়েছে একেবারে পা পর্যন্ত। আর সে কী চেহারা, দাঁড়ালে তাল গাছের মাথায় গিয়ে ঠেকে। সে-বার আমি নেপালে পশুপতিনাথের মন্দিরে ধ্যান করছি বসে; মাঝরাত্রির, ঘুটঘুট করছে অন্ধকার, হঠাৎ যেন পূর্ণিমার চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। তাকিয়ে দেখি ওই মূর্তি! পেছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।

সূর্য অস্ত গেছে। পায়ের তলায় মড়মড় করছে শুকনো শালের পাতা। ঝড় মোড়লের সারা গা ভয়ে ছমছম করে উঠল।

তারপরে?

তারপরে আর কী! সুন্দরলালের কণ্ঠে গর্বের আভাস লাগল, নাঙ্গাবাবা বললেন, যা ব্যাটা, তোর হয়ে গেছে। আজ থেকে সিদ্ধিলাভ করলি তুই। ভূত-পিরেত-পিশাচ-দানো তোর ছায়া দেখলেও ছুটে পালাতে পথ পাবে না।

দু-পাশের বনজঙ্গলগুলি সন্ধ্যার সঙ্গে আরও ঘন করে ছায়া ছড়িয়ে দিয়েছে। সুন্দরলালের মুখ দেখা যায় না, তবু ঝড় এক বার সে-মুখখানাকে দেখবার চেষ্টা করলে। এমন একটা লোকের পাশে পাশে হেঁটে চলেছে, ভাবতেও সে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।

বনের পথটা পেরোতেই সামনে গ্রাম দেখা দিল। আকাশের এককোণে শুক্লা ত্রয়োদশীর চাঁদ এতক্ষণ কোথায় আত্মগোপন করেছিল কে জানে! জঙ্গলের আড়ালটা কেটে যেতেই কাঁকর-বিছানো পথটার ওপর তার আলো ঝিলমিল করে উঠল। সাঁওতাল পাড়ার মাদলের শব্দ। মহুয়ার গন্ধের সঙ্গে ওই শব্দটার চমৎকার একটা ছন্দগত ঐক্য আছে বোধ হয়।

ঝড় সবিনয়ে বললে, এক বার নাচ দেখতে যাবে না বাবাঠাকুর?

নাচ? আচ্ছা চল।

দু-দিকে মাটির দেওয়ালগাঁথা ছোটো ছোটো নীচু বাড়ি। মাঝখানে একটুখানি ফাঁকা জায়গায় বসেছে নাচের আসর। কষ্টিপাথরের মতো কালো চেহারার দুজন পুরুষ দুলে দুলে মাদলে ঘা দিচ্ছে, আর সেই মাদলের তালে তালে ঝুঁকে ঝুঁকে কয়েকটি মেয়ে নৃত্য করছে। পরস্পরের বাহুতে তারা আবদ্ধ, মুখে অস্ফুট গানের উচ্ছ্বাস। সে-গানের ভাষা বোঝবার জো নেই, কিন্তু তার ধ্বনিটা একটা বিচিত্র গুঞ্জনের মতো বাজছে।

সুন্দরলালকে আসতে দেখে মাদল আর নাচ দুই-ই থেমে গেল। মেয়েদের কালো চোখে দেখা দিল কৌতুকের উজ্জ্বল আভা, পুরুষদের কণ্ঠে উঠল ভক্তিমুগ্ধ কলরব। কেউ কেউ উঠে এসে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলে, কেউবা আবার কোথা থেকে কাঠের একটা চৌপাই টেনে নিয়ে এল।

যথোচিত মর্যাদা আর গাম্ভীর্য নিয়ে চৌপাইটাতে আসীন হল সুন্দরলাল। পুরুষেরা ঘিরে বসল তার চারপাশে। নাকের রুপোর আংটির ভেতরে আঙুল দিয়ে মেয়েরা তাকিয়ে রইল নির্বোধ দৃষ্টিতে।

সুন্দরলাল গম্ভীর হয়ে বললে, নাচ থামালি কেন? চলুক-না।

ঝড় মোড়লের কণ্ঠস্বর ব্যর্থ হয়ে উঠল, হাঁ হাঁ, নাচ চলুক। ভালো করে নাচ দেখিয়ে দে বাবাঠাকুরকে।

আবার মাদলে ঘা পড়ল। শালবনের ওপর দিয়ে চাঁদ তখন অনেকখানি উঠে এসেছে।

মেয়েদের উজ্জ্বল চোখগুলিতে, সুঠাম সম্পূর্ণ দেহশ্রীর ওপর দিয়ে জ্যোৎস্না গড়িয়ে পড়তে লাগল তরল লাবণ্যের মতো। সংসার-বিরক্ত সুন্দরলাল নিজের অজ্ঞাতেই খানিকটা সংসক্ত হয়ে উঠল হয়তো। হয়তো-বা রক্তের এই চাঞ্চল্যটা পুরোপুরি দার্শনিক ভাবেই অনুপ্রাণিত নয়।

দশ-বারোটি মেয়ে একসঙ্গে নাচছিল। তাদের ভেতর প্রায় প্রৌঢ়া থেকে নিতান্ত বালিকা পর্যন্ত সব স্তরের মেয়েই আছে। তবে যুবতির সংখ্যাই বেশি। অথবা অল্পেতেই এরা বুড়িয়ে যায় না বলেই হয়তো এদের যৌবন সবসময়ে বয়সের হাত ধরে চলে না। সুন্দরলালের সংসারাশ্রমের কথা মনে পড়ে। তার স্ত্রীর বয়স তো এখনও কুড়ি পার হয়নি, কিন্তু…।

চমক ভাঙল। এক ভাঁড় মহুয়ার মদ এসে গেছে। ঝড় বললে, পেসাদ করে দাও বাবাঠাকুর।

সুন্দরলাল আপত্তি করলে না। সন্ন্যাসের শেষ স্তরে উঠে সে নির্বেদ লাভ করেছে বলা চলে। মাটির পাত্রে করে উগ্রগন্ধী মহুয়ার মদে গলা ভিজিয়ে নিলে সুন্দরাল।

জ্যোৎস্নায় জোয়ার এসেছে ততক্ষণে। বাতাসে শাল ফুলের গন্ধ। এদেশের লোক ও গন্ধটাকে স্বাস্থ্যের অনুকূল মনে করে না, কিন্তু ওর সঙ্গে মহুয়ার তিক্ত মদিরতা মিশে গিয়ে আফিমের মতো একটা বিষাক্ত নেশায় যেন আচ্ছন্ন করছে চৈতন্যকে। কী কার্যকারণযোগে

ওপাশের একটি তরুণী মেয়ের আন্দোলিত দেহবল্লরির ওপর গিয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ল সুন্দরলালের দৃষ্টি। যেন মূৰ্ছিত হয়ে গেল বললেই ঠিক বলা হয়।

সর্বাঙ্গে স্বাস্থ্যপুষ্ট সম্পূর্ণতা। এমন মেয়ে এই অবাধ স্বাস্থ্যসৌন্দর্যের দেশেও বিরল। সুন্দরলালের চোখ জ্বলতে লাগল।

ওই মেয়েটা কে রে মোড়ল?

প্রশ্ন শুনে ঝড় সাঁওতাল কৃতার্থ হয়ে গেল যেন।

ওই ওর কথা বলছ? ও তো আমারি মেয়ে–বুধনি।

চাপকানের পকেটে হাত দিয়ে সুন্দরলাল টাকাপয়সাগুলোকে নাড়াচাড়া করতে লাগল। সে বৈরাগী, সে-হিসেবে ধাতব বস্তুর ওপরে তার যতটা অনাসক্তি থাকা উচিত তা নেই। সুন্দরলালের ভারি ভালো লাগে টাকা-বাজানোর শব্দটা। ঠিক যেন গানের মতো কানে বাজে।

বুধনি? বা, বেশ নাম তো! ডাক তো ওকে!

বুধনি এগিয়ে এল। কতকটা বিস্ময়, কিছুটা কৌতুক। ভয়ও একেবারে না-আছে তা নয়। সুন্দরলাল হাত দেখতে পারে, ভূত ছাড়াতে পারে, আরও কত কী জানে ঠিক নেই। তার সামনে এসে দাঁড়াতে বুক যে খানিকটা দুরদুর করবেই—এই তো স্বাভাবিক।

কয়েক মুহূর্ত বুধনির মুখের দিকে স্তব্ধ হয়ে রইল সুন্দরলালের দৃষ্টি। গায়ের কাপড়টা ভালো করে টেনে দিয়ে সংযত হওয়ার চেষ্টা করলে বুধনি।

জামার পকেট থেকে দুটো টাকা বের করে আনল সুন্দরলাল, এই নে, তোদের খেতে দিলুম। আর–আর…

মুহূর্তে কোথা থেকে কী হয়ে গেল। হয়তো মহুয়ার প্রভাবেই বিচিত্র রকমে গাঢ় ও গভীর হয়ে উঠেছে তার কণ্ঠস্বর, তুই কেন এখানে পড়ে আছিস বুধনি। তোর যে ভারি জোর বরাত। নাঙ্গাবাবার কথা যদি সত্যি হয়, তাহলে শহরে গিয়ে যে তোর কপাল ফিরে যাবে এ তো আমি চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি।

সুন্দরলাল যেন দৈববাণী করছে। এ যেন সে নয়, যেন তার সত্তার ভেতর থেকে আর একজন কে আবির্ভূত হয়ে এল। সাঁওতালেরা জানে, মাঝে মাঝে তার ওপর ঠাকুরদেবতার ভর হয়।

চলে যা, চলে যা তুই। দেবতার নাম করে বলছি, তুই চলে যা। শাড়ি, চুড়ি, তেল—যা চাস সব পাবি।

ভয়ে বিস্ময়ে সর্দারের চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বিস্ফারিত হয়ে বেরিয়ে আসবার উপক্রম করছে। দেবতার নামে যা বলবে অক্ষরে অক্ষরে ফলে যাবে সব। দেবতার একটি কুদৃষ্টিতে ঝাঁকে ঝাঁকে জ্যান্ত মানুষ মরে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে, গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে। ভীত চঞ্চল সাঁওতালেরা চারপাশে এসে ভিড় করে দাঁড়াল, এই সুযোগে নিজেদের ভাগ্যটাকে এক বার যাচাই করে নিলে হয়।

শহর! শাড়ি-চুড়ি-তেল! একটা অদ্ভুত স্বপ্নলোক। বুধনির চিন্তা আকস্মিকভাবে যেন খেই হারিয়ে ফেলছে।

সুন্দরলালের ওপর যেন এখন পুরোপুরি ঠাকুরের আবির্ভাব। বুড়োজ্যাঠা টুডুকে সে বাতলে দিচ্ছে হাঁপানির ওষুধ। দিগদিগন্ত উদ্ভাসিত করে নির্মল চাঁদের আলো অসীম প্রীতি আর বিশ্বাসের মতো ঝরে পড়ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে যেন রজনিগন্ধার অসংখ্য ছিন্ন পাঁপড়ি। মহুয়ার গন্ধে শাল ফুলের বিষাক্ত নিশ্বাস চাপা পড়ে গেল। শুধু অকারণে চঞ্চল হয়ে উঠেছে ভুটানি খচ্চরটা। কী-একটা অস্বস্তি অনুভব করে খট খট শব্দে সে মাটির ওপর পা ঠুকতে লাগল।

খুব ভোরে ওঠা সুন্দরলালের অভ্যাস।

সূর্য সামনের পাহাড়টাকে ভালো করে রাঙিয়ে তোলার আগেই সে ঘরের বাইরে দড়ির খাঁটিয়ায় এসে বসে। তারপর হয়তো সুর করে তুলসীদাস পড়া শুরু হয় তার :

ঘটহ বঢ়হ বিরহিণী দুখ দাই
গ্রসহ রাহু নিজ সন্ধিহি পাই,
কোক শোকপ্রদ পঙ্কজদ্রোহী,
অবগুণ বহুত চন্দ্রমা তোহি—

কিন্তু সীতার বিরহ নিয়ে বেশিক্ষণ সময় কাটাবার জো নেই। সাঁওতালেরা তাকে গুরু বলে মানতে শুরু করেছে আজকাল, সব কিছু কাজেই তার পরামর্শ ছাড়া এখন আর চলে না।

পাহাড় থেকে হরিণের পাল নেমে গম খেয়ে যাচ্ছে, তার কী প্রতিকার? বড়কা সাঁওতাল কী এক সাঁওতাল মেয়ের কপালে সিঁদুর লেপে দিয়েছে, অথচ সমাজের আইনে তাদের বিয়ে হতে পারে না, এর কী ব্যবস্থা করা যেতে পারে? অমুকের পায়ের ঘা আজ তিন মাস ধরে সারছে না, কেউ কি তার কোনো অনিষ্ট করল?

এমন অনেক প্রশ্নের মীমাংসাই করতে হয় সুন্দরলালকে। কিন্তু নাঙ্গাবাবার আশীর্বাদের জোর আছে তার ওপরে। পশুপতিনাথের মন্দির থেকে লাভ করা সিদ্ধি—সহজ কথা নয়। তিরিশ বছর বয়স পেরোনোর আগেই প্রাক্তন পুণ্যের বলে ইহলোক-পরলোকের সড়ক পাকা করে নিয়েছে সে।

আজও সকালে তিলক সাঁওতাল এসে দেখা দিলে।

তোমার সঙ্গে একটা জরুরি কথা আছে বাবাঠাকুর।

প্রকান্ড একটা ভাঙের গুলি মুখে পুরে দিয়ে সুন্দরলালের মনটা প্রসন্ন হয়ে উঠল। রামচরিত মানস একপাশে ঠেলে সরিয়ে রেখে প্রশ্ন করলে, কী কথা?

তিলক সাঁওতাল গলার আওয়াজ নীচু করে আনল, তুমি বাণ মারতে জান?

বাণ? একটা বিচিত্র হাসিতে সুন্দরলালের চোখ-মুখ সমুজ্জ্বল হয়ে উঠল। আমি বাণ মারতে জানিনে? আমি জানিনে তো কে জানে শুনি?

তিলক সাঁওতাল অপ্রতিভ হয়ে বললে, তাই বলছিলুম…

তাই বলছিলি? তাই আবার কী বলবি? সেবার আসামের চা-বাগানের এক সায়েবকে মেরে দিলুম না? তিনটা দিনও পেরোল না, মুখে রক্ত উঠে একেবারে… হুঁহুঁ…

কাবার হয়ে গেল?

বিলকুল। খালি বাণ? ইচ্ছে হলে পিশাচ চালান করতে পারি। তিলক রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। বাণ মারা! কী ভয়ানক! তুমি জানও না মাটিতে রেখা দিয়ে তোমার মূর্তি আঁকা হয়ে গেল, আর সেই মূর্তির বুকে মেরে দেওয়া হল মন্ত্রপূত তির। নিশ্চিন্ত মনে সারাদিন খেতে কাজ করে সন্ধে বেলায় তুমি বাড়ি ফিরেছ, হঠাৎ অসহ্য ব্যথা উঠল তোমার বুকে। তারপর কাশির সঙ্গে সঙ্গে তোমার ফুসফুস দুটো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে বেরিয়ে আসতে লাগল, সাতটা দিনের ভেতরেই তুমি পুরোপুরি নিকাশ হয়ে গেলে। আর পিশাচ! যে পিশাচসিদ্ধ তার অসাধ্য কী আছে? এই সাঁওতাল পরগনার পাহাড়ে পাহাড়ে কত অশরীরী প্রেতাত্মা ছায়ার মতো ঘুরে বেড়ায় কে বলতে পারে? সন্ধ্যার কালো আবরণের তলায় যখন শালের বনগুলো ভয়ংকর হয়ে ওঠে, তখন তাদের বড়ো বড়ো খসখসে পাতার মর্মরে সেই প্রেতাত্মারা নিশ্বাস ফেলে যায়। সে-নিশ্বাস যার গায়ে লাগে, গোড়াকাটা লতার মতো শুকোতে শুকোতে একদিন শেষ আয়ুর বিন্দুটি অবধি তার মিলিয়ে যায় বাষ্প হয়ে। যেদিন রাত্রে পাহাড়ের মাথায় মাথায় ঝড় ওঠে, মহুয়া গাছগুলো উপড়ে পড়ে, রাতচরা হরিণগুলো অবধি প্রাণের ভয়ে গমের খেতে নেমে আসে না, সে-রাত্রিতে তারা উৎসব করে। সে-সময় যদি কেউ এক বার ভুল করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে, তাহলে পরের দিন তার হাড়-মাংসের একটি টুকরোও কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এই সমস্ত প্রেতাত্মা, এই সমস্ত ভয়ংকর পিশাচেরা সব সুন্দরলালের হাতধরা।

কাকে মারতে হবে?

তিলক চমকে উঠল। সুন্দরলাল হাসছে। হাসিটা মনোরম নয়। কী-একটা অজ্ঞাত কারণে সমস্ত মনটাকে সংকুচিত, সন্ত্রস্ত করে আনে।

ব্যস্ত কণ্ঠে তিলক বললে, ও-গাঁয়ের ডোমন মাঝিকে। কিছুদিন থেকেই আমার পিছে লেগেছে। বললে বিশ্বাস করবে না বাবাঠাকুর, ওর তুকমন্তরের চোটেই গত মাসে আমার ছেলেটা মরে গেল। তাগড়া জোয়ান ছেলেটা। দেখতে দেখতে ছটফটিয়ে মরে গেল।

তিলকের চোখের কোণ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠল।

হুঁ! গম্ভীর হয়ে গেল সুন্দরলাল। তোর কাজটা করে দেব আমি, পিশাচ চালান দিয়ে দেব। পরশু শনিবার কয়েকটা ফুল আর সিঁদুর নিয়ে আসবি, আমি তিনটে নরমুন্ড জোগাড় করে রাখব। তাই দিয়ে পিশাচ পুজো করতে হবে। তাহলে কী হবে জানিস?

তিলক ঘাড় নাড়ল।

তাহলে রোজ রাত্তিরে সে যখন ঘুমিয়ে থাকবে, প্রকান্ড একটা কালো পিশাচ এসে চেপে বসবে তার গায়ের ওপর। তারপর সেই পিশাচটা তার মুখখানাকে নলের মতো ছুঁচোলো করে দিয়ে তার মাথার ভেতর থেকে চোঁ চোঁ করে রক্ত আর ঘিলু শুষে খাবে। তারপর…।

কথাটা অসমাপ্ত রেখে সুন্দরলাল হেসে উঠল। তার বলার ভঙ্গিতে এই সকালের আলোতেও তিলকের মাথার চুলগুলো খাড়া হয়ে উঠেছে আতঙ্কে। দৃশ্যটা সে মনের সামনে কল্পনা করতে লাগল।

যা মাঝি, পরশু আসিস। ফুল আর সিঁদুর যেন মনে থাকে। আর একটা কথা, এর পরে কিন্তু ক-দিন তোকে গাঁয়ের বাইরে আর-কোথাও গিয়ে থাকতে হবে। ডোমনের রক্ত খাওয়া শেষ হয়ে গেলে পিশাচটা আশেপাশে খুঁজে বেড়াবে তোকে। পেলে কিন্তু আর রক্ষা রাখবে না।

আর এক বার তিলকের আপাদমস্তক নিদারুণ বিভীষিকায় চমকে উঠল।

তিলক চলে যাওয়ার পর সুন্দরলাল অনেকক্ষণ বসে রইল নীরবে। সামনে রামচরিত মানস-এর ভোলা পাতাগুলো ফরফর করে উড়ে যাচ্ছে। উড়ন্ত একরাশ কালো কালো পলাতক হরফের মাঝখানে গন্ধমাদনধারী হনুমানের একখানা বীরমূর্তি। পলকের জন্যে উঁকি মেরে গেল রূঢ় খানিকটা রঙের প্রলেপ। দূর মাঠের ওপর চরছে একদল মহিষ, দুটির গলায় বাঁশের বড়ো বড়ো চোঙা বাঁধা। আর সব কিছুর ওপর দিয়েই সকালের রোদ প্রসন্ন একটা দীপ্তিমন্ডলের মতো উদ্ভাসিত।

তত্ত্বচিন্তায় বিভোর হয়ে উঠেছে সুন্দরলালের মন। এমন করে আর চলে না। দু-মাস, মাত্র দু-মাস সময়, অথচ এমন একটু একটু করে এগোতে গেলে গোটা বছরই যে কাবার হয়ে যাবে। ওদিকে সিজন টাইম পেরিয়ে গেলে এসবের কোনোটারই কোনো অর্থ হয় না।

চেনা হাসির আকস্মিক একটা বন্যা শুধু কান নয়—সমস্ত মনের ওপরেই যেন ভেঙে আছড়ে পড়ল। নদীর ঢেউয়ের মতো উচ্ছলিত চটুলতায় রাঙা কাঁকরের পথ বেয়ে একদল মেয়ে এগিয়ে আসছে। দিকে দিকে বসন্তের বিহ্বল মদিরতা, আর তার মাঝখানে এরা যেন পরিপূর্ণ পানপাত্র। হাতের ছোটো ছোটো ঝাঁপিগুলি ভরে মহুয়া কুড়িয়ে নিয়েছে, আর খোঁপায় জড়িয়েছে পত্রপল্লবে সমৃদ্ধ একগুচ্ছ নাগকেশরের ফুল।

সুন্দরলালকে দেখেই থমকে দাঁড়াল মেয়েরা। নিজেদের ভেতরে কিছুক্ষণ কী সতর্ক আলোচনা চলল তাদের। সুন্দরলালকে তারা ভয় করে, কিন্তু তার চারদিক দিয়ে অতীন্দ্রিয় রহস্যের যে ঘন একটা কুয়াশা-ঘেরা, তাদের কৌতূহলী মন মাঝে মাঝে সেই কুয়াশার ভেতরে প্রচ্ছন্ন জগৎটাকে আবিষ্কার করতে চায়।

বুধনি ইতস্তত করছে, কিছু যেন একটা বলবার আছে তার। অত্যন্ত বিপন্ন মুখে আঙুল দিয়ে গলার রুপোর হাঁসুলিটা খুঁটতে লাগল সে। একটি মেয়ে আলগাভাবে তাকে ধাক্কা দিলে, যেন তাদের সকলের কাছেই বুধনি কী-একটা কৌতুক এবং কৌতূহলের বস্তু হয়ে উঠেছে।

সুন্দরলালের চোখে-মুখে অতি প্রকট তীক্ষ্ণতা।

কী রে বুধনি?

কিন্তু বুধনিকে কিছু আর বলতে হল না। বাঁধ ভেঙে উচ্ছ্বসিত কলতরঙ্গে যেন বেরিয়ে এল জোয়ারের জল। হাসির দোলায় মেয়েদের পরিপূর্ণ অপরূপ তনুসৌষ্ঠব ছন্দময় হয়ে উঠল। সুন্দরলালের মনে হল–কামনায় যেন শানিত খানিকটা কালো আগুন দেহপ্রদীপগুলিতে উঠল শিখায়িত হয়ে।

এত হাসছিস যে? সুন্দরলালের চোখ দুটো নির্লজ্জভাবেই ঘুরতে লাগল বুধনির সর্বাঙ্গকে বিশ্লেষণ করে। এ দৃষ্টি হয়তো শরীরের কেবল বাইরেটাকেই দেখছে না, হয়তো তীক্ষ্ণএকটা

সন্ধানী আলো ফেলে বুধনির মনটাকেও দেখে ফিরছে। এ যোগীর দৃষ্টিভোগীর নয়।

বুধনির সাহসের যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, সুন্দরলালের দ্বিতীয় প্রশ্নে তাও যেন মিলিয়ে গেল নিঃশেষ হয়ে। মেয়েদের হাসি দ্বিগুণ হয়ে উঠল। পরক্ষণেই রূপের প্রখর বিদ্যুৎ ছড়িয়ে দিয়ে তারা পথের ওপর দিয়ে এক ঝলক দখিনা বাতাসের মতো বয়ে গেল। সুন্দরলাল হাঁ করে তাদের দিকে তাকিয়েই রইল।

দু-মাস মাত্র সময়, কিন্তু দুটি দিন মাত্র বেশি দেরি হয়ে গেলে সত্যিই কী আর ক্ষতি হবে। বাগানে অনেক মেয়ে আছে, কিন্তু বুধনির জুড়ি নেই। সুন্দরলালের দুটো চোখে যেন গোখরো সাপ উঁকি মারতে লাগল। সাহেব ভালোমানুষের কদর বোঝে, দু-দিন বিলম্ব তার কাছে। কিছুই নয়।

আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে সুন্দরলাল যে অনেকটা এগিয়ে গেছে, তাতে আর সন্দেহ কী?

সন্ন্যাসী মানুষ, ঘর ছেড়ে সেই কবে বেরিয়ে পড়েছে। বিষয়বাসনার কোনো প্রলোভনই নেই, সংসারে পরের উপকার ছাড়া আর কিছুই সে জানে না। ঝড় সাঁওতাল একথা বিশ্বাস করে, বুধনির সন্দেহমাত্র নেই, সুন্দরলালের মুখের দিকে তাকাতেও গা কেঁপে ওঠে তিলকের।

কিন্তু পশুপতিনাথের মন্দিরে পাওয়া সেই সিদ্ধমন্ত্র—তার বলে কী-না সম্ভব হয়। সুন্দরলাল টাকা তৈরি করতে পারে নিশ্চয়। কারও দরকার পড়লে অযাচিতভাবেই সে কাঁচা করকরে টাকা বের করে দেয়; নতুন টাকা, ঝকঝকে টাকা। হয়তো অনেকটা এই কারণেই সাঁওতালেরা এত বেশি করে তার কাছে মাথা বিকিয়ে বসে আছে। ইচ্ছে করলে সে নাকি নুড়ি পাথরগুলোকে অবধি তাল তাল সোনা বানিয়ে দিতে পারে। জিজ্ঞেস করলে কোনো জবাব দেয় না, রহস্যময়ভাবে হাসে।

আরও কয়েক দিন পরে।

বিলি সাঁওতালনির কী-একটা মানসিক। শালবনের মাঝখানে সিঁদুর-মাখানো ওই যে বড়ো কালো পাথরটা, ওখানে শিং বোঙার পুজো। উপচার মুরগি আর মহুয়ার মদ।

খচ্চরে চড়ে সুন্দরলাল এসে উপস্থিত হল।

তখন বলি শেষ হয়ে গেছে। পাথরটার চারপাশে ছিন্নকন্ঠ মুরগির রক্ত। শাল ফুলের গন্ধে বাতাসটা কেমন ভারী, যেন নিশ্বাস ফেলতেও কষ্ট হয়।

মাদল বাজছে, তার সঙ্গে চলেছে নাচ। কিন্তু জ্যোৎস্নারাতের মহুয়ামদির অসংযত নাচের দোলা এ নয়। সে-নাচে রক্তে রক্তে একটা তরল নেশা ঘনিয়ে আসে, আর এ নাচে যেন মনের ওপর অস্বস্তির আমেজ দেয়। পাহাড়ের কোলজুড়ে বহুদূর পর্যন্ত চলে গেছে নিবিড় নিবন্ধ শালের বন। বড়ো বড়ো পাতা স্তরে স্তরে সূর্যকে আড়াল করে সৃষ্টি করেছে প্রায়ান্ধকার একটা নিভৃতলোক। সেই নিভৃতলোকের মাঝখানে অশরীরী শিং বোঙা যেকোনো মুহূর্তেই হয়তো-বা দলবল নিয়ে সশরীরী হয়ে উঠতে পারে।

সুন্দরলাল আসতেই মদের পাত্র এগিয়ে এল। মহুয়ার সুরায় আকণ্ঠ পরিপূর্ণ করে নিলে সুন্দরলাল। শিং বোঙার কালো পাথরটার গায়ে রক্ত আর সিঁদুর লেপা। হঠাৎ দেখলে মনে হয় পাথরটা যেন কার একখানা প্রসারিত মুখ। সত্যি সত্যিই যেন রক্ত খেয়েছে; যেন আরও রক্ত খাওয়ার জন্যে তাকিয়ে আছে তৃষ্ণার্ত চোখে।

সুন্দরলাল হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠল। এক বার স্থির রক্তচোখ মেলে তাকাল সকলের দিকে। তারপর টলতে টলতে এগিয়ে গিয়ে সোজা পাথরটার সম্মুখে আছড়ে পড়ল। পায়ে লোহার নালতোলা কাঁচা চামড়ার জুতা আর কুর্তার পকেটের টাকাগুলোয় মিলে উঠল একটা চকিত যুগ্মধ্বনি।

কয়েক মুহূর্ত পরেই আবার উঠে দাঁড়াল সে। জামায় খানিকটা ধুলোর দাগ। একটু আগেই পান খেয়েছিল, মুখের দু-পাশে খানিকটা লাল লঙের গ্যাঁজলা বেরিয়ে রয়েছে বীভৎসভাবে। সকলের ওপর দিয়ে এক বার তীক্ষ্ণদৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে হঠাৎ সে তান্ডব তালে নাচতে শুরু করে দিলে।

সোৎসাহে মাদল বেজে উঠল, ডুম ডুম করে উল্লাস জানাল নাগাড়া টিকারা। সুন্দরলালের ওপর ভর হয়েছে—শিং বোঙার ভর। সাঁওতালদের চেতনার ওপর চাড়িয়ে পড়ল ভয় আর আনন্দের একটা বিচিত্র অনুভূতি।

হেলেদুলে সুন্দরলাল নাচতে লাগল। মুরগির খানিকটা রক্ত সে হাতে-মুখে মেখে নিয়েছে, এই মুহূর্তে তাকে পৈশাচিক বলে মনে হতে পারে। পায়ের কাঁচা চামড়ার জুতাটা দূরে ছিটকে পড়েছে, পকেটের টাকাগুলো সমান তালে বাজছে ঝনঝন করে।

আকস্মিকভাবে সুন্দরলাল থেমে দাঁড়াল।

অপ্রকৃতিস্থ চোখ দুটো যেন রক্তে ভিজিয়ে আনা। আর কণ্ঠে সেই দৈববাণীর সুর।

ঝড় সাঁওতাল, শুনছিস? আমি শিং বোঙা, তোদের ডাকছি—শুনছিস?

আরও জোরে জোরে টিকারা বাজতে লাগল, আকাশ চিরে উঠল মাদলের শব্দ। সাঁওতালেরা সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করলে। ঝড় সাঁওতাল কাঁপা গলায় বললে, কী হুকুম বাবা?

আমার কথা শোন। তোদের গাঁয়ে মড়ক লাগবে—হয়জার মড়ক! একটি প্রাণীও বাঁচবে, মরে সব শেষ হয়ে যাবে। করম দেবতার রাগ পড়েছে তোদের ওপর, তোদের কাউকে রাখবে না কাউকেই নয়।

চমকে মাদলের শব্দ থেমে গেল, হাত থেকে নাগাড়া টিকারা খসে পড়ল। শাল ফুলের গন্ধে বাতাসের গতি যেন স্তব্ধ হয়ে রয়েছে।

সাঁওতালেরা হাহাকার করে উঠল। মেয়েদের মুখ থেকে বেরিয়ে এল ভয়াতুর আর্তনাদ। একসঙ্গে কলরব উঠল, কী উপায় হবে আমাদের বাবাঠাকুর?

সুন্দরলালের কণ্ঠে দৈববাণীর সুর আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। ঝড় ওঠবার আগে থমথমে কালো মেঘে আবৃত ঈশান দিগন্তের মতো তার মুখ।

উপায় আছে। নাঙ্গাবাবার শিষ্য এই সাধু সুন্দরলালকে আঁকড়ে ধরা ও তোদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, ওর সঙ্গে তোরা উত্তরে চলে যা। সেখানে ঘর পাবি, জমি পাবি, এর চেয়ে অনেক সুখে থাকবি।

আপত্তির ক্ষীণ প্রতিবাদ তুলে ঝড় মোড়ল বললে, কিন্তু বাবা, ঘরবাড়ি সব ফেলে…

ঘরবাড়ি, ঘরবাড়ি! বিকৃত কুটিতে সুন্দরলালের রক্তমাখা কুটিল মুখখানা প্রেতের মতো দেখাতে লাগল। ঘরবাড়ি আঁকড়ে থেকে সব মরবি তাহলে। করমবাবা তোদের কাউকে আস্ত রাখবে ভেবেছিস? হাড়-মাংস চিবিয়ে খাবে—মনে রাখিস। কুকুর বেড়ালের মতো মরবি সব।

সুন্দরলালের চোখ দুটো রক্তে ভিজিয়ে আনা। সেই দুটো চোখের ভেতর সাঁওতালেরা যেন ভারী মহামারির প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল।

বনবাস ছেড়ে আবার সংসারের দিকে ফিরতেই হল সুন্দরলালকে। উপায় নেই! করম দেবতার কোপ থেকে এই নিরীহ সাঁওতালদের তাকে রক্ষা করতেই হবে। আর বিপন্নকে উদ্ধার না করলে তার কীসের সন্ন্যাস।

সকালের আলোয় সাঁওতাল পরগনার বনশ্রী অপরূপ হয়ে উঠেছে। পাহাড়ে পাহাড়ে বসন্ত যেন আনন্দের উল্লাসে তরঙ্গিত। ছোটো ছোটো গোলাপজামের মতো সাদা মহুয়ার ফুল তিক্ত মধুর রসে পরিপূর্ণ হয়ে টুপ টুপ করে খসে পড়ছে। ডালে ডালে সবুজের ছিট দেওয়া হরিয়ালের নাচ, ঘুঘুর একটানা করুণ ডাক।

গলার সামনে গাঁটরিবাঁধা সুন্দরলালের ভুটিয়া খচ্চরটা টুক টুক শব্দে খুদে খুদে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে। পেছনে মাদল বাজছে। একটা অস্ফুট গানের গুঞ্জন সাঁওতাল পুরুষেরা ঘর ছাড়ার দুঃখ ভোলবার জন্যেই কেউ হয়তো বাঁশিতে সুর দিয়েছে। মেয়েদের মুখে কোনো ক্ষোভের ইঙ্গিত নেই। পথ চলবার আনন্দে তারা লীলায়িত, মাদলের ধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে তাদের কালো চুলে সাদা ফুলের মঞ্জরিগুলি দুলে উঠছে। বুধনির চোখে স্বপ্ন। শহর, চুড়ি, তেল আর শাড়ি। দেবতার হুকুম পেয়েছে সে।

আসামের চা-বাগানে কুলি-জোগানো কী-যে অসম্ভব ব্যাপার, সেটা সাহেব জানে। কালাজ্বরে দলে দলে লোক মরছে, আশপাশ থেকে একটি কুলি আনবারও জো নেই। বুধনিকে বাদ দিয়ে—আড়কাঠি সুন্দরলাল হিসেব করতে লাগল, বুধনিকে বাদ দিলে বেয়াল্লিশ জন কুলিতে তার কমিশন পাওনা হয় কত?

সাঁওতাল পরগনার বিমুক্ত প্রকৃতিকে পরিপ্লাবিত করে দিয়েছে বসন্তের অকৃপণ আনন্দধারা। সকালের হাওয়া লেগে পাহাড়ি পথের ওপর কৃষ্ণচূড়ার একরাশ রাঙা পাঁপড়ি ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *