Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয় || Vishnubahoner Digbijay by Sukumar Ray

বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয় || Vishnubahoner Digbijay by Sukumar Ray

বিষ্ণুবাহন খাসা ছেলে। তাহার নামটি যেমন জমকালো, তার কথাবার্তা চাল-চলনও তেমনি। বড় বড় গম্ভীর কথা তাহার মুখে যেমন শোনাইত, এমন আর কাহারও মুখে শুনি নাই। সে যখন টেবিলের উপর দাঁড়াইয়া হাত পা নাড়িয়া ‘দুঃশাসনের রক্তপান’ অভিনয় করিত, তখন আমরা সবাই উৎসাহে হাততালি দিয়া উঠিতাম, কেবল দু-একজন হিংসুটে ছেলে নাক সিঁট্‌কাইয়া বলিত, “ওরকম ঢের ঢের দেখা আছে।” ভূতো এই হিংসুটে দলের সর্দার, সে বিষ্ণুবাহনকে ডাকিত ‘খগা’। কারণ জিজ্ঞাসা করিলে বলিত, “বিষ্ণুবাহন মানে গরুড়, আর গরুড় হচ্ছেন খগরাজ— খগরাজ পায় লাজ নাসিকা অতুল— তাই বিষ্ণুবাহন হলেন খগা।” বিষ্ণুবাহন বলিল, “ওরা আমার নামটাকে পর্যন্ত হিংসে করে।”
বিষ্ণুবাহনের কে এক মামা ‘চন্দ্রদ্বীপের দিগ্বিজয়’ ব’লে একখানা নতুন নাটক লিখিয়াছেন। বিষ্ণুবাহন একদিন সেটা আমাদের পড়িয়া শোনাইল। শুনিয়া আমরা সকলেই বলিলাম, “চমৎকার!” বিশেষত, যে জায়গায় চন্দ্রদ্বীপ “আয় আয় কাপুরুষ আয় শত্রু আয় রে” বলিয়া নিষাদরাজার সিংহদরজায় তলোয়ার মারিতেছেন, সেই জায়গাটা পড়িতে পড়িতে বিষ্ণুবাহন যখন হঠাৎ “আয় শত্রু আয়” বলিয়া ভূতোর ঘাড়ে ছাতার বাড়ি মারিল, তখন আমাদের এমন উৎসাহ হইয়াছিল যে আর একটু হইলেই একটা মারামারি বাঁধিয়া যাইত। আমরা তখনই ঠিক করিলাম যে ওটা ‘অ্যাক্‌টিং’ করিতে হইবে।
ছুটির দিনে আমাদের অভিনয় হইবে, তাহার জন্য ভিতরে ভিতরে সব আয়োজন চলিতে লাগিল। রোজ টিফিনের সময় আর ছুটির পরে আমাদের তর্জন-গর্জনে পাড়াশুদ্ধ লোক বুঝিতে পারিত যে, একটা কিছু কাণ্ড হইতেছে। বিষ্ণুবাহন চন্দ্রদ্বীপ সাজিবে, সেই আমাদের কথাবার্তা শিখাইত আর অঙ্গভঙ্গী লম্ফ ঝম্ফ সব নিজে করিয়া দেখাইত। ভূতোর দল প্রথমটা খুব ঠাট্টা বিদ্রূপ করিয়াছিল, কিন্তু যেদিন বিষ্ণুবাহন কোথা হইতে এক রাশ নকল গোঁফ-দাড়ি, কতকগুলা তীর ধনুক, আর রূপালি কাগজ মোড়া কাঠের তলোয়ার আনিয়া হাজির করিল, সেইদিন তাহারা হঠাৎ কেমন মুষ্‌ড়াইয়া গেল। ভূতোর কথাবার্তা ও ব্যবহার বদলাইয়া আশ্চর্যরকম নরম হইয়া আসিল এবং বিষ্ণুবাহনের সঙ্গে ভাব পাতাইবার জন্য সে হঠাৎ এমন ব্যাকুল হইয়া উঠিল যে ব্যাপার দেখিয়া আমরা সকলেই অবাক হইয়া রহিলাম। তার পরদিনই টিফিনের সময় সে একটি ছেলেকে দিয়া বলিয়া পাঠাইল যে, ‘দূত হোক, পেয়াদা হোক, তাহাকে যাহা কিছু সাজিতে দেওয়া যাইবে, সে তাহাই সাজিতে রাজী আছে।’ শেষ দৃশ্যে রণস্থলে মৃতদেহ দেখিয়া নিষাদরাজের কাঁদিবার কথা— আমরা কেহ কেহ বলিলাম, “আচ্ছা, ওকে মৃতদেহ সাজতে দাও।” বিষ্ণুবাহন কিন্তু রাজী হইল না। সে ছেলেটাকে বলিল, “জিজ্ঞাসা করে আয়, সে তামাক সাজতে পারে কিনা।” শুনিয়া আমরা হো হো করিয়া খুব হাসিলাম, আর বলিলাম, “এইবার ভূতোর মুখে জুতো।”
তারপর একদিন আমরা হরিদাসকে দিয়ে একটা বিজ্ঞাপন লেখাইলাম। হরিদাস ছবি আঁকিতে জানে, তার হাতের লেখাও খুব ভাল; সে বড় বড় অক্ষরে একটা সাইনবোর্ড লিখিয়া দিল—
“চন্দ্রদ্বীপের দিগ্বিজয়” ১৪ই আশ্বিন, সন্ধ্যা ৬।। ঘটিকা
আমরা মহা উৎসাহ করিয়া সেইটা স্কুলের বড় বারান্দায় টাঙ্গাইয়া দিলাম। কিন্তু পরের দিন আসিয়া দেখি কে যেন ‘চন্দ্রদ্বীপ’ কথাটাকে কাটিয়া মোটা মোটা অক্ষরে লিখিয়া দিয়াছে— “বিষ্ণুবাহন”— বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়! ইহার উপর ভূতো আবার গায়ে পড়িয়া বিষ্ণুবাহনকে শুনাইয়া গেল, “কিরে খগা, খুব দিগ্বিজয় করছিস যে!”
এমনি করিয়া শেষে ছুটির দিন আসিয়া পড়িল। সেদিন আমাদের উৎসাহ যেন ফাটিয়া পড়িতে লাগিল, আমরা পর্দা ঘেরিয়া তক্তা ফেলিয়া মস্ত স্টেজ বাঁধিয়া ফেলিলাম। অভিনয় দেখিবার জন্য দুনিয়াশুদ্ধ লোককে খবর দেওয়া হইয়াছে, ছয়টা না বাজিতেই লোক আসিতে আরম্ভ করিয়াছে। আমরা সকলে তাড়াহুড়া করিয়া পোশাক পরিতেছি, বিষ্ণুবাহন ছুটাছুটি করিয়া ধমক-ধামক দিয়া সকলকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া উপদেশ দিতেছে। দেখিতে দেখিতে সমস্ত যখন ঠিকঠাক হইল, তারপর ঘণ্টা দিতেই স্টেজের পর্দা সর্‌সর্‌ করিয়া উঠিয়া গেল, আর চারিদিকে খুব হাততালি খুব হাততালি পড়িতে লাগিল।
প্রথম দৃশ্যেই আছে, চন্দ্রদ্বীপ তাহার ভাই বজ্রদ্বীপের খোঁজে আসিয়া নিষাদরাজার দরজায় উপস্থিত হইয়াছেন, এবং খুব আড়ম্বর করিয়া নিষাদরাজাকে “আয় শত্রু আয়” বলিয়া যুদ্ধে ডাকিতেছেন। যখন তলোয়ার দিয়া দরজায় মারা হইবে তখন নিষাদের দল হুঙ্কার দিয়া বাহির হইবে, আর, এক্তা ভয়ানক যুদ্ধ বাধিবে। দুঃখের বিষয়, বিষ্ণুবাহনের বক্তৃতাটা আরম্ভ না হইতেই সে অতিরিক্ত উৎসাহে ভুলিয়া খটাং করিয়া দরজায় হঠাৎ এক ঘা মারিয়া বসিল। আর কোথা যায়! অমনি নিষাদের দল “মার মার” করিয়া আমাদের এমন ভীষণ আক্রমণ করিল যে, নাটকে যদিও আমাদের জিতিবার কথা, তবু আমরা বক্তৃতা-টক্তৃতা ভুলিয়া যে যার মত পিট্‌টান দিলাম। বাহিরে আসিয়া বিষ্ণুবাহন রাগে গজ্‌রাইতে লাগিল। আমরা বলিলাম, “আসল নাটকে কি আছে কেউ ত তা জানে না— না হয়, চন্দ্রদ্বীপ হেরেই গেল।” কিন্তু বিষ্ণুবাহন কি সে কথা শোনে? সে লাফাইয়া ধমকাইয়া হাত পা নাড়িয়া শেষটায় নাটকের বইয়ের উপর এক কালির বোতল উল্টাইয়া ফেলিল, এবং তাড়াতাড়ি রুমাল বাহির করিয়া কালি মুছিতে লাগিল। ততক্ষণে এদিকে দ্বিতীয় দৃশ্যের ঘণ্টা পড়িয়াছে।
বিষ্ণুবাহন ব্যস্ত-সমস্ত হইয়া আবার আসরে নামিতে গিয়াই পা হড়্‌কাইয়া প্রকাণ্ড এক আছাড় খাইল। দেখিয়া লোকেরা কেহ হাসিল, কেহ ‘আহা আহা’ করিল, আর সব গোলমালের উপর সকলের চাইতে পরিষ্কার শোনা গেল ভূতোর চড়া গলার চীৎকার— “বাহবা বিষ্ণুবাহন।” বিষ্ণুবাহন বেচারা এমন অপ্রস্তুত হইয়া গেল যে সেখানে যাহা বলিবার তাহা বেমালুম ভুলিয়া “সেনাপতি! এই কি সে রত্নগিরিপুর” বলিয়া একেবারে চতুর্থ দৃশ্যের কথা আরম্ভ করিল। আমি কানে কানে বলিলাম, “ওটা নয়,” তাহাতে সে আরো ঘাবরাইয়া গেল। তাহার মুখে দরদর করিয়া ঘাম দেখা দিল, সে কয়েকবার ঢোক গিলিয়া, তারপর রুমাল দিয়া মুখ মুছিতে লাগিল। রুমালটি আগে হইতেই কালিমাখা হইয়াছিল, সুতরাং তাহার মুখখানার চেহারা এমন অপরূপ হইল যে আমাদেরই হাসি চাপিয়া রাখা মুস্কিল হইল। ইহার উপর সে যখন ঐ চেহারা লইয়া, ভাঙা ভাঙা গলায় “কোথায় পালাবে তারা শৃগালের প্রায়” বলিয়া বিকট আস্ফালন করিতে লাগিল, তখন ঘরশুদ্ধ লোক হাসিয়া গড়াগড়ি দিবার জোগাড় করিল। বিষ্ণুবাহন বেচারা কিছুই জানে না, সে ভাবিল, শ্রোতাদের কোথাও একটা কিছু ঘটিয়াছে, তাই সকলে হাসিতেছে। সুতরাং সে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করিবার জন্য আরও উৎসাহে হাত-পা ছুঁড়িয়া ভীষণ রকম তর্জন-গর্জন করিয়া স্টেজের উপর ঘুরিতে লাগিল। ইহাতেও হাসি ক্রমাগত বাড়িতেছে দেখিয়া তাহার মনে কি যেন সন্দেহ হইল, সে হঠাৎ আমাদের দিকে ফিরিয়া দেখে আমরাও প্রাণপণে হাসিতেছি— এবং তাহাকে লক্ষ্য করিয়াই হাসিতেছি! তখন রাগে একেবারে দিগ্বিদিক ভুলিয়া সে তাহার ‘তলোয়ার’ দিয়া বিশুর পিঠে সপাং করিয়া এক বাড়ি মারিল। বিশু চন্দ্রদ্বীপের মন্ত্রী, তাহার মার খাইবার কথাই নয়, সুতরাং সে ছাড়িবে কেন? সে ঠাস্‌ ঠাস্‌ করিয়া বিষ্ণুবাহনের গালে দুই চড় বসাইয়া দিল। তখন সে স্টেজের উপরেই সকলের সামনে দুজনের মধ্যে একটা ভয়ানক হুড়োহুড়ি কিলাকিলি বাধিয়া গেল। প্রথমে, প্রায় সকলেই ভাবিয়াছিল ওটা অভিনয়ের লড়াই; সুতরাং অনেকে খুব হাততালি দিয়া উৎসাহ দিতে লাগিল। কিন্তু বিষ্ণুবাহন যখন দস্তুরমত মার খাইয়া “দেখুন দেখি সার্‌, মিছামিছি মারছে কেন” বলিয়া কাঁদ-কাঁদ গলায় হেডমাস্টার মহাশয়ের কাছে নালিশ জানাইতে লাগিল, তখন ব্যাপারখানা বুঝিতে আর কাহারও বাকী রহিল না।
ইহার পর, সে দিন যে আর অভিনয় হইতেই পারে নাই, একথা বুঝাইয়া বলিবার আর দরকার নাই। ছুটি হইবার তিনদিন পরেই বিষ্ণুবাহন তাহার মামার বাড়ি চলিয়া গেল। ঐ তিনদিন সে বাড়ি হইতে বাহির হয় নাই, কারণ তাহাকে দেখিলেই ছেলেরা চেঁচায়, “বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়!” স্কুলের গায়ে রাস্তার ধারে প্ল্যাকার্ড মারা “বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়”— এমনকি বিষ্ণুবাহনের বাড়ির দরজায় খড়ি দিয়া বড় বড় অক্ষরে লেখা— “বিষ্ণুবাহনের দিগ্বিজয়”।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *