বিশাখা
মন ভালো নেই নিরিবিলি আবাসনের বিশাখার। দিন দুয়েক হলো কেমন যেন মনমরা ভাব,তাবলে তিনি যে নূতন এসেছেন এমন নয়! এই বৃদ্ধাশ্রমে বছর খানেক হলো তিনি এসেছেন, প্রথম প্রথম না হয় সবারই মনে টানাপোড়েন দ্বন্দ্ব- দ্বিধা, মায়া জড়ানো দোলাচল একটা থেকেই যায়। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে তিনি বরং ভালোই ছিলেন প্রথম থেকে। নিজেই যে শুধু আনন্দে ছিলেন তা নয় ফূর্তিতে মাতিয়ে রাখছিলেন অন্যান্যদেরকেও। বলতেন ‘এ তো আমাদের বলতে গেলে একরকম বাণপ্রস্থ! এখনকার ছেলেমেয়েদের বৃথা দোষারোপ করা কেন বাপু, এ জীবনটাই কী কম আনন্দের!’ এ হেন বিশাখাদির মনমরা উদাসীন ভাব দেখে তাই মহিলাদের অধিকাংশই মুষড়ে পড়েছেন ।
আজ সকাল থেকেই থম মেরে রয়েছেন।
সবার মনে একটাই প্রশ্ন, ‘হলো কী মানুষটার!’ গত দুদিন ধরে মানুষ টা যে দুচোখের পাতা এক করতে পারে নি সেটাও বুঝতে পেরেছে বিশাখাদির রুমমেট অণু লেখা। এভাবে চলতে থাকলে শেষমেশ কী যে হবে, সেই আলোচনাই চলছিল এতক্ষণ।আর বিশাখা দেবী……..
হাসিখুশীর মোড়কে মুড়ে রাখতে চাইলেও সব সময় তার যে সম্ভব হয়না এ কথাটা বিশাখার চেয়ে ভালো কে জানে! প্রতিবছর এই দিনটি তার জীবনে আসে বিষণ্ণতায় ভরে দিতে। আজ শ্রাবণের সাতাশ, ভালোবাসার অপমৃত্যু ঘটিয়ে আত্ম বলিদান দিয়েছিল বাড়ীর সকলের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে। আজকের দিনটা তাই তার কাছে বিবাহবার্ষিকী নয়, “আত্ম বলিদান দিবস”।
বাইরে ট্যাক্সি থামার শব্দ পেয়ে নূতন কেউ এলো ভেবে বেরিয়ে এসে সকলে দেখে টাক মাথা এক বয়স্ক ভদ্রলোক।
অফিসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা করার পর জলখাবার খেয়ে ভদ্রলোক আবাসিক দের সঙ্গে পরিচয়ে তৎপর হয়ে ওঠেন।
নবাগত কে স্বাগত জানাতে সবাই ততক্ষণে যথারীতি হলঘরে হাজির ।
সবাই হলঘরে এলেও বিশাখা তখনো আসেনি।
সকলের সঙ্গে পরিচয় করে বললেন,
” বাহঃ চমৎকার, আপনাদের সবার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব আনন্দ পেলাম।”
মনের কষ্ট আর বিষণ্ণতাকে বুকের মধ্যে চেপে রেখে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে হলঘরে এসে দাঁড়াতেই ভদ্রলোক বিশাখার দিকে তাকিয়ে থাকলেন একমুহুর্ত, তারপরেই কাছে এসে বলেন “আরে শিখা!কী আশ্চর্য, তুমি এখানে?”
হতভম্ব বিশাখা বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
চিনতে পারলে না তো! হো হো করে হেসে উঠে টাকে হাত বুলিয়ে ভদ্রলোক বলেন ‘ কী করেই বা চিনবে?
আমি মৃন্ময় শিখা, তোমার মৃন্ময় দা!’
মুহূর্তের মধ্যে বুঝতে পেরে মুখ লাল হয়ে ওঠে তার। এ কী কাণ্ড! মৃন্ময়দা, তার ভালোবাসার মানুষ আজ তারই সামনে!
এগিয়ে এসে শিখার হাত দুটো ধরে বলেন ‘আমায় ক্ষমা করে দিও শিখা, তোমাদের মানসম্মানের কথা ভেবে কাপুরুষের মতো সেদিন চলে গেছিলাম।আজ তো কোন বাধা নেই, আজ যখন তোমাকে পেয়েছি তখন আর কোন কিছুতেই পিছু হটবো না।কথায় বলে না,সব ভালো যার শেষ ভালো। ‘ বিশাখার চোখে তখন প্লাবন, দুহাত বাড়িয়ে বিশাখাকে বুকে টেনে নিতেই সব ভুলে মৃন্ময়ের বুকে মুখ গুঁজে ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে বিশাখা।