বিশাখাপত্তনম এ মন্দাকিনী – 27
ভাবলাম, সকালের ট্রেন ধরতে তো গাড়ির দরকার। তাহলে এখন ই বুক করে রাখা দরকার। তাই বললাম মেশোমশায়কে। ——— সকালের জন্য গাড়ি বুক করে রাখি কেমন? মেশোমশায় বললেন—-ঐ তো ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এর পাশেই ওর চেম্বার। যাও তুমি, ততক্ষণ আমরা বসছি। এখন ও অনেক লোক বসে আছে সমুদ্র সৈকতের বাঁধানো বসার জায়গায়। মন্দাও লক্ষী মেয়ের মতো বাবা মায়ের সাথেই বসল। আমার সাথে যাওয়ার বায়না করেনি এই ভেবেই খুশি হলাম। ভবতোষ মুখুজ্জ্যে স্ত্রী কে নিয়ে বসলেন মেয়ের থেকে একটু ফারাকে। বাবা মা একটু ফারাকে হলেও মন্দা সব কথা শুনতে পাচ্ছে। কানে এল বাবার মা কে বলা কথা। ——– কি গো, কেমন লাগছে কেষ্টাকে?কেমন যত্ন করল তোমাকে! ——–কেন, নতুন দেখছি কি? ——– আরে তোমাকে কেমন যত্ন করল? ——– তা হঠাৎই ওর কথা কেন? ——- মায়া, জামাই হিসাবে কেমন হবে? ——– কার কথা বলছো? কেষ্টা হবে জামাই? বলিহারি তোমাকে। মেয়েটার জীবন নষ্ট করবে? ———- আমি মেয়ের ক্ষতি করছি ,না তুমি করছো। চোখ খোল মায়া। অন্ধের ভান করোনা।মেয়ের দিকে ভাল করে দেখ মায়া। স্বামীর কথার উত্তরে বললেন। ——— আজকাল বিয়ের আগে একটু আধটু অমন হয় সবার। বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে। না না ,ঐ বাউন্ডুলে ছেলের সাথে বিয়ে দেব না আমি। বাবা মায়ের কথার গোপনতা আর রইল না। বাতাসে ভর করে সব কথাই মন্দাকিনীর কানে এল। কথাতো নয় যেন গরম সীমা কানে ঢুকছে। মা ও তাহলে শ্রীমতীর মতো গেম টাকে পছন্দ করে!! বাঃ বাঃ। বেশ বেশ। কিন্তু আমি অন্য কারোকে বিয়ে করবো না। তার থেকে আমার মরণ ও ভাল। যেমন কৃষ্ণ দা,ঠিক তেমনই আমার মা। কথা না বলেই নিঃশব্দে সমুদ্রের বালিয়ারি তে নামতে লাগল মন্দাকিনীর। কোন দিকে দৃষ্টি নেই। শুনবে না কারো কথা।ওকে নিয়ে যখন এত সমস্যা ,তখন শুনবে না কারও কথা।ভাববে না কারও কথা। শেষ করে দেবে নিজেকে। একটু পরেই ভবতোষ বাবু স্ত্রী কে বললেন। ——–কৈ গো, মন্দাকে দেখছি না যে। কোথায় গেল?তোমার কথা শোনেনি তো? চারদিকে নজর দিলেন। না ধারেকাছে কোথাও দেখা যাচ্ছে না মন্দাকিনীকে। ভয় পেয়ে গেলেন। না বলে তো যাবার মেয়ে নয়! স্ত্রী কে বললেন—–কৈ গো, সমুদ্রের কাছে যায় নি তো? চার দিক নজর চালাতে চোখে পড়ল কেষ্টা আসছে। কেষ্টার কাছে ছুটে গেলেন। ভবতোষ বাবু বললেন ——– মন্দাকে দেখতে পাচ্ছি না।কোথায় গেল কেষ্টা?সমুদ্রে যায় নি তো রাগ করে?যতো দোষ তোমার মাসীমার!বিয়ের কথায় যত ঝামেলা—-। বুঝলাম, আমার অবর্তমানে এমন কথা হয়তো হয়েছিল। যেটাতে মেয়ের সায় ছিল না। তাই মন্দাকিনীর কষ্ট টা বেড়েছিল। তাকালাম সমুদ্রের দিকে চারদিক আলোয় ঝলমল করলেও বিচ্ এ কারোকে দেখা যাচ্ছে না। দূর থেকে একটা অবয়ব নজর কাড়ল। আমার বুকের রক্ত ছল ছলাৎ করে উঠল। হাতের প্যাকেট টা মাসীমার হাতে দিয়ে বললাম——একটু আসছি। যাতে ওঁরা ভয় না পায় তাই কিছুই বললাম না। বিচ্ এর দিকে নেমে ছুটতে লাগলাম। আমার লক্ষ্য ভুল নয় তাও বুঝলাম। কোন কথা না বলে ছুটলাম সেদিকে। অনেক টা ভেতরের দিকে এগিয়ে গেছে। পেছন থেকেই জাপ্টে ধরলাম। মন্দাকিনীর তখন ঘোর লাগা দৃষ্টি। মন তখন ওর অন্য কোথাও। কয়েক টা ঝাঁকি দিলাম ওকে বর্তমানে ফেরাতে। আমার উপস্থিতি বোঝাতে। বুঝলাম, আমরা দ্রষ্টব্যের মধ্যেই পড়ে গেছি। দু একজন যারা ছিল তারা দূরে সরে গেল। আমার কিছুই করার নেই। তবুও লোক জনের বড়াই না করে বুকের মাঝে টেনে নিলাম ওকে। এবার একটু ধাতস্ত মনে হচ্ছে মন্দাকিনীকে। আমার চোখের সাথে চোখ মেলালো। তখন বললাম—— সবাই চেয়ে আছে আমাদের দিকে। এত রাতে জলের গভীরে এসেছ কেন? মন্দাকিনী দর্শকদের দিক থেকে আমার দিকে চোখ ফেরাল। এতক্ষণে মন্দাকিনী কথা বলল। ——— কে পাঠাল তোমাকে?বাবা মা? বললাম—— তারা জানেনা যে তাদের মেয়ে সমুদ্রে জল কেলী করতে এতো রাতে সমুদ্রে এসেছে। দাঁড়িয়ে আছে অপেক্ষায় । কখন তার প্রেমিক এসে তাকে জল থেকে তুলবে। তাই না গো? ইচ্ছা করেই ওর মনটা ঘোরাতে চাই। কী ঘটনা যে ঘটতে চলেছিল তা ভেবেই আমি ওকে জড়িয়ে ধরি। অনুভব করলাম ওর শরীরের কম্পন। বুঝলাম ঐ মেয়ে কেঁদে হাল্কা হচ্ছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলি— ——,আমায় কতো কষ্ট দিতে ! তা তুমি জান?আমি মন্দাকিনী ছাড়া বাঁচার কথা ভাবতেই পারিনা। তাকাও আমার দিকে। নজর মিলতেই দেখলাম,”কান্না হাসির দোল দোলানো পৌষ ফাগুনের পালা”। কান্নার পর এক ঝলক হাসি বেড়িয়ে এল সেই মুখ থেকে। বললাম—-নেকলেস টা কোথায় জান? মন্দাকিনী বলল—কোথায়? বললাম—–তোমার বালিশের কভারের ভেতরে। এত ভুললে তো আমায় ভুলে যাবে একদিন। চোখ মুছে উত্তরে বলল—–কখখোনো না। বললাম—–তাহলে আমার জন্য যে পোস্ট টা বাধা আছে তাতে সম্মতি জানিয়ে দেই। কি বল? এখন ও আমার জন্য স্যার রেখেছেন। মন্দাকিনী উত্তর না দিলেও উত্তর ওর চোখে মুখে লেখা ছিল। ওর নজর দেখেই বুঝলাম ওর মনের কথা। আমাদের দেখে মাসীমা মন্দাকিনীকে বললেন-। ————তুই সমুদ্রে গিয়েছিলি? আমি আগ বাড়িয়ে বললাম—–আজই শেষ সমুদ্র দেখা তো তাই ওকে আমি সমুদ্রে নিয়ে গিয়েছিলাম। মাসীমার নজরে সন্দেহ। সে দৃষ্টি আমায় কুনজরে দেখেনি। মন্দাকিনীর নত চাউনি দেখে ভবতোষ বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন। ——— আর নয়। ওদের ঠান্ডা লেগে যাবে। ওঠো এবার মায়া। ঘরে ফিরে যদি বা মাসীমা মন্দাকে কিছু বলতেন তা পারেন নি ,কারণ স্বামীর গুরু গম্ভীর ভাব। যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন ওঁরা। সব চুপচাপ। কারো মুখে কথা নেই। শেষ টা এমন কেন হল! রাত কাটল ঘুমে জাগরণে। কারণ ভোরে উঠতে হবে। ফলকনামায় যেতে হবে কোলকাতা। যথা সময়েই উঠে পড়লাম ঘুম থেকে। আজ মন্দাকিনীর পরনে নীল শাড়ির সঙ্গে আমার দেওয়া সেই ঝুঠো পাথরের নেকলেস চমক ফেলছে। ঝুঠো পাথরের চমক সাচ্চা পাথরকে আজ হার খাইয়েছে। মুগ্ধ হলেও নজর মেলাতে পারলাম না। কারণ মাসীমার নজর আমাকে বেড় দিয়ে রেখেছে। তাই দৃষ্টি ঘোরাতেই মোটঘাট নিয়ে ছুটলাম গাড়ির দিকে। সমুদ্র কে বাঁয়ে রেখে বাই বাই করলাম স্টেশনের দিকে। ওরা বসতেই গাড়ি ছুটল স্টেশনের উদ্দেশ্যে। ভোর রাত তাই রাস্তায় গাড়ি নেই বলা যায়। স্টেশনের চত্বরে পা দিয়ে ই দেখলাম ফলকনামা এক্সপ্রেস দাঁড়িয়ে আছে। ট্রেন এ ওঠার আগে এক খানা খবরের কাগজ কিনে নিলাম। এটাই আমায় মাসীমার নজর থেকে বাঁচাবে। তাঁর মেয়ের মন আমার জন্য পুড়লে ক্ষতি নেই কিন্তু আমার মন তাঁর মেয়ের জন্য পুড়লে আমাকে গাল শুনতে হবে। এ যেন যত দোষ নন্দ ঘোষ। আলাদা বসার ব্যবস্থা হলে কোন অসুবিধা ছিল না। কিন্তু এবার তা হয় নি।একেবারেই মুখোমুখি নইলে পাশাপাশি। একটায় অঙ্গ সুখ, অপরটায় দৃষ্টি সুখ। আমার সব সুখেই মাসীমার আপত্তি। ট্রেন ছেড়ে দিতেই মেশোমশায় আর মাসীমা একটু কাত হলেন। আর কেউ নেই তাই এটা সম্ভব হল। আমি শুধুই দেখছি মন্দাকিনীর গালে লালের ছোঁওয়া। ঠোঁটের কম্পন কখনও কমছে, কখনও বাড়ছে। আমি চোখ ফিরিয়ে নিলেই কম্পন কমছে। কথা বললাম না পাছে মাসীমা মেশোমশায়ের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। একটা আলো ঠিকরে পড়ল মন্দাকিনীর নেকলেস থেকে। বুঝলাম আমার দিকে নজর না দিয়েই ও বুঝতে পারছে আমি কোন দিকে তাকাচ্ছি। তাই আলোর বিচ্ছুরণ দেখার পর আমার দৃষ্টি অনুসরন করল মন্দাকিনী। ইশারায় বললাম——- অপূর্ব, নেকলেস ধারিনী আর নেকলেস। আমার ঐ ভাবে, চলকে পড়ল মন্দাকিনীর হাসি। গালের ছটা হল দেখার মত। তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখতে লাগলাম সেই রুপ। মনে ভাবলাম প্রফেসর সোম বার বার বলেছেন, কেষ্টাচরণ তোমার অ্যাপয়েন্টমন্ট লেটার চাপা দিয়ে রেখেছি। তুমি একটা স্কলার। লেখা ছেড়ে জয়েন করো ইউনিভার্সিটিতে। লোকে পায় না। আর তুমি হেলায় হারাচ্ছো! এবার ভাবনাটা ফিরে এল মন্দাকিনীর আঁখি পল্লবে। না এই মেয়েকে আর কষ্ট দেবেনা সে। আজ বাবা থাকলে এই মেয়েকে সাদরে ঘরে নিয়ে যেত। আবার সেই চোখে চোখ আটকে গেল আমার। এবার মেশোমশায়কে বলতেই হবে মন্দাকিনীকে আমার চাই। মাসীমা আর মেশোমশায় জেগে যেতে আবার পেপার পড়া শুরু হল। দু একবার মেশোমশায়ের অনুযোগে মুখের ঢাকা সরাতে হয়েছে। কিন্তু কিছু সময়ের জন্য। যেমন ভাবে ছোট থেকে বড় হয়ে গেলাম। কবে বড় হলাম বুঝতে পারলাম না। ঠিক তেমনি করেই ট্রেন এ করে বেড়ানোটা ও শেষ হয়ে গেল। মনে হল এইতো মেশোমশায়ের ফোন পেলাম!! হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে মনে হল ওগুলো কি স্বপ্ন ছিল?আমি কি বিশাখাপত্তনমের স্বপ্ন দেখছিলাম! আর সেই বাকদান! অ্যাপয়েন্টমন্ট লেটার ইউনিভার্সিটির হেড অফ দা ডিপার্টমেন্ট এর ফাইলে জমা রয়েছে? কবি হবার নেশায় সংসার করব বলে ভাবিনি! আজই ইউনিভার্সিটিতে জয়েনিং লেটার সাবমিট করব। মাসীমা আর মন্দাকিনীকে ট্রেন থেকে নামতে বললাম। মন্দাকিনীর আঁধার করা মুখ দেখে বুঝলাম কারণ টা। চোখের তারায় ঢেউ খেলিয়ে বোঝালাম যে “আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ”।
চোখের সামনে মনে হচ্ছে দৃশ্য গুলো ফুটে উঠছে, খুবই ভালো লাগলো দিদি।
Excellent!