Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বিভিন্ন রকম গন্ধ || Humayun Azad

বিভিন্ন রকম গন্ধ || Humayun Azad

বহু দিন পর আমি এসে এইখানে দাঁড়ালাম, একশো বর্গকিলোমিটার
জুড়ে আমার সামনে এখন অখণ্ড উদ্দাম সবুজ; আমি একে চিনি,
এবং চিনতে পারি না। ক-বছর হলো এখানে দাঁড়াই নি আমি? দশ?
বারো? বিশ? না পঁচিশ? হিশেব করতে আমার ইচ্ছে হয় না।
উগ্র চৈত্রে আমি দাঁড়াই একটি অচেনা গাছের সবুজ ছায়ায়,
গাছটি চিনি না আমি, যখন ছিলাম আমি এ-পল্লীর
এ-গাছ ছিলো না; তবে তার ছায়া তার মতোই সবুজ, আমি ভালোবেসে
ফেলি তাকে; আমার সামনে একশো বর্গকিলোমিটার জুড়ে সবুজ ধানখেত।
আমার হৃদয়-নাকি মাংস-নাকি রক্ত ভরে ওঠে কোমল সবুজে।
আমি ঠিক বুঝতে পারি না আমার কেমন লাগছে,
যদি হতাম কৃষক এই প্রান্তরের হয়তো বুঝে উঠতে পারতাম
আদিগন্ত সবুজের অনুভূতি। যখন ছিলাম আমি এ-মাটির,
যখন ছিলাম আমি এ-জলের তখন নিবিড় সম্পর্ক ছিলো এসব জমির
সাথে এক বালকের। কতোবার সে-বালক দাঁড়িয়েছে
এইখানে, চোখ ভরে দেখেছে সুন্দর, বুক ভরে নিয়েছে সুগন্ধ।
আমার বাল্যকালে এ-প্রান্তর এরকম একটানা সবুজ ছিলো না।
কোথাও কালচে ছিলো, ফিকে সবুজ কোথাও,
কোথাওবা ছিলো ঝলমলে সবুজ যেনো মাটির ভেতর থেকে
গলগল করে উঠে আসছে সবুজের প্রচণ্ড প্রপাত, কোথাও বিবর্ণ,
আর কোথাও বিছিয়ে থাকতো রাশিরাশি অবর্ণনীয় সোনা।
আজ আমার চোখের সামনে আদিগন্ত ধানের সবুজ। আমি চিনি
এই ধান, এর নামও আমি জানি, আর যাকেই জিজ্ঞেস করি
সে-ই একটি অসুন্দর নাম বলে, তবে তাদের সবার চোখেমুখে
সুখ দেখে আমি সুখী হই। শুধু দুঃখ লাগে ওর কি কোনো
নাম হতে পারতো না রূপশালি আমন বা আউশের মতো হৃদয় ব্যাকুল
করা? তবে আমি সুখী, অজস্র রূপসী ধান আমার বাল্যকালকে
বাঁচাতে পারে নি ক্রুদ্ধ আকালের গ্রাস থেকে, দিকে দিকে আমি
দেখেছি ক্ষুধার আগুন, আমি সুখী এ-সবুজ নিভিয়েছে সেই
ভয়াবহ অগ্নির তাণ্ডব। আমি নেমে যাই ধানখেতে, হাঁটি আলপথে,
গন্ধ শুঁকি দুটি-একটি পাতা ছিঁড়ে। দিকে দিকে একই অভিন্ন গন্ধ আর রঙ
আমাকে বিবশ করে। তবু আমি হাঁটতে থাকি, হঠাৎ আমার
চোখের সামনে ঝলমল করে ওঠে তিরিশ বছর আগের
এই সব জমি, রঙে আর গন্ধে ভরে ওঠে আমার শরীর। এটা সরষের
খেত ছিলো, সরষের তীক্ষ্ণ গন্ধ ঢুকতে থাকে
আমার গেঞ্জি আর জিন্স ভেদ করে, আমি দু-হাতে জড়িয়ে
ধরতে থাকি সরষের সরু সরু গাছ, কেঁপে উঠি
স্পর্শে; এই খেতে তিল হতো, দেখতে পাই, ঘন কালচে
সবুজ পাতায় মেঘলা হয়ে আছে জমিগুলো। দেখতে পাই
হঠাৎ বর্ষা এসে গেছে, থইথই করছে চারদিক, তিল কাটা
হয় নি এখনো কেননা পাকতে তার আরো দু-একদিন
বাকি। এই খেতে পাট হতো, বিশাল বনের মতো এই খেতের ভেতরে
লুকিয়ে থেকেছি কতো দিন; পাটের পাতার গন্ধে
ভরে উঠেছে শরীর। এখানে তরমুজ হতো, এটা ছিলো ঘাসখেত,
ওইগুলো বোরোজমি, সোনার মতোই ধান বিছিয়ে থাকতো,
ওখানে বেগুন হতো, লাউ আর কুমড়ো পড়ে থাকতো
মাটির চাকার মতো; এই চৈত্রে মাঠে কেনো গরু নেই?
দেখতে পাই লাল কালো শাদা গরু, ষাঁড়, অণ্ডহীন অসংখ্য বলদে
ভরে উঠেছে দূরের ঘাসখেত। এই একটানা সবুজের মধ্যে আমি বসে পড়ি,
আমার ভেতরে ঢুকতে থাকে ধান, পাট, তিল, সরষে, মটর,
তরমুজ, বাঙি, আমন, আউশ আর বোরোর সুগন্ধ।
কে যেনো আমাকে ডাকে দূর থেকে আমার হারানো নাম ধরে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *