( ১ )
ফুরাল বঙ্গের লীলা মাহাত্ম্য সকলি,—
হরিল বিদ্যাসাগরে কাল মহাবলী
হারালে মা বঙ্গভূমি, পুত্ররত্নে আজ,
বিশীর্ণ, বিমর্ষ দুঃখে বঙ্গের সমাজ !
কি মহা পরাণ ল’য়ে জন্মেছিল ধীর,
কিবা বিদ্যা— বুদ্ধি প্রভা – করুণা গভীর !
বিদ্যার সাগর খ্যাতি, –আরো মনোহর
বিশাল উদার চিত্ত দয়ার সাগর !—
তেমন সন্তান, মাগো, কে আর তোমার ?
(২ )
কাঁদিছে, হের গো, তাঁরে করিয়া স্মরণ,
দরিদ্র কাঙ্গাল দুঃখী কত শত জন :–
“কেবা অন্ন দিবে আর—কে ঘুচাবে দুখ,
দরিদ্র দুঃখীরে হেরে কে চাহিবে মুখ !
কত রাজা রাণী আছে এ রাজ্য ভিতর—
কাঙ্গালে করিবে আর কেবা সে আদর !”
মানব দেহেতে সেই দয়া মূর্ত্তিমান,
সার্থক তাঁহারই জন্ম যশঃ কীর্ত্তিমান,–
প্রাতে নিত্য স্মরণীয় যাঁর গুণগান !
( ৩ )
আপনার বেশ ভূষা সামান্য আকার,
দেখিলে পরের দুঃখ নেত্রে জলভার !
সমাজ-পীড়িত দুঃখ করিতে মোচন
জীবন উত্সর্গ নিজ করিল যে জন,
সমাজ পীড়িত জনে করিতে উদ্ধার
আপনি সহিলা নিন্দা কত তিরস্কার ;
ঋণে বদ্ধ অবশেষে — তবু দৃঢ় পণ,
সংকল্প সাধন কিম্বা শরীর পতন !—
অ হেন পুরুষ-সিংহ জন্মে মা, ক’জন ?
( ৪ )
অদ্বিতীয় বাঙ্গালা-ভাষার শিক্ষাগুরু—
বর্ণমালা হতে বঙ্গ-সাহিত্যের তরু
স্বহস্ত অর্জ্জিত যাঁর,—যাঁর প্রতিভায়
উজ্জ্বল বাঙ্গালা আজ প্রখর প্রভায় !
বালক বৃদ্ধের মুখে নাম ঘরে ঘরে,
জীবন্ত সুচির কীর্ত্তি রবে যাঁর পরে !
উপাধি উল্লেখে যাঁর নাম পরিচয় ;
ধন্য, বঙ্গমাতা, গর্ভে ধর এ তনয় !—
কর-চিহ্ন কার এত কাল-বক্ষময় ?
( ৫ )
স্বাধীন স্বতন্ত্র চিত্ত কাহার তেমন ?
দর্প, নির্ভীকতা, বীর্য্য —যে কিছু লক্ষণ
তেজীয়ান্ পুরুষের—সবই ছিল তাঁর |
তৃণজ্ঞান পদ-মান অবজ্ঞা যেথায়,
শ্বেতাঙ্গ প্রসাদ ( ও ) গর্ব্বে ঠেলিত হেলায় !
হেন পুত্র, হায় মাতঃ, হারালে কোথায় ?—
হারালে কোথায় পুত্র হেন পুণ্যতম,
আত্ম যাঁর সত্য আর সাধুতা আশ্রম,–
হৃদয় যাঁহার দয়া— সাগরের সম |
( ৬ )
প্রচণ্ড উত্তাপ-দগ্ধ ভারত গগন,
সকলি অসাড় স্তব্ধ নিঃস্পন্দ যেমন
দুর্জ্জয় কলির দর্পে,— ধন উপার্জ্জন |
আর পদ-অন্বেষণ, শুধুই এখন
কার্য্য ভূ-ভারত মাঝে ! —তবুও যে আজ
তাহার ভিতর দীপ্ত করিছে সমাজ
মহাপ্রাণ —দুই এক,—বিদ্যুৎ যেমন
চকিতে চমকি দিক্ করায় দর্শন ;—
হে বিধাতঃ, সে কি, ওহে, ভাবী সুলক্ষণ ?
( ৭ )
এ হেন অদিনে জন্মি অতি দুঃখীকুলে,
আপনার কীর্ত্তিধ্বজা নিজ হস্তে তুলে,
পবিত্র করিয়া তায় জগৎ-পূজায়,
স্থাপিলে শিখর পরে সমাজ-চূড়ায়,
অসামান্য দ্বিজবর ! — তব দেবদেহ
মরণেও বঙ্গবাসী ভুলিবে না কেহ |
অমর তোমার সেই খর্ব্ব দেহ-ঠাঠ,
সেই দয়াপূর্ণনেত্র —বিশাল ললাট
বঙ্গের হৃদয়ে নিত্য করুণার পট |
দরিদ্র সন্তান হ’য়ে জিনিলে সম্রাট |