Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

স্থির দৃষ্টিতে ছবিখানির দিকে

ক.

স্থির দৃষ্টিতে ছবিখানির দিকে তাকিয়ে ছিলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ। ক্ষীণতম ভাষার স্পন্দন তাতে থাকলে তাকে শুনবার চেষ্টা করছিলেন, ইঙ্গিত থাকলে বুঝতে চেষ্টা করছিলেন। সুমতির মিষ্ট কোমল প্রতিমূর্তির মধ্যে কোথাও ফুটে রয়েছে অসন্তোষ অভিযোগের ছায়া?

—তুমি আজ কোর্টের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে?

জ্ঞানেন্দ্রনাথ ফিরে তাকালেন।

চা নিয়ে সুরমা এসে দাঁড়িয়েছেন। নিজেই নিয়ে এসেছেন বেয়ারাকে আনেন নি সঙ্গে।

—অসুস্থ হয়ে পড়েছিলে? মাথা ঘুরে গিয়েছিল?

–কে বললে?

–আরদালি বললে। পাবলিক প্রসিকিউটারের সওয়ালের সময় তোমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল; তুমি উঠে খাস কামরায় গিয়ে মাথা ধুয়েছ–?

–হ্যাঁ। একটু হাসলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ। বিচিত্র সে হাসি। বিষণ্ণতার মধ্যে যে এমন প্রসন্নতা থাকতে পারে, এ সুরমা কখনও দেখেন নি।

অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন তিনি।

পাবলিক প্রসিকিউটার আসামির উকিলের সওয়ালের পর তার জবাব দিচ্ছিলেন। তিনি গভীর আত্মমগ্নতার মধ্যে ড়ুবে ছিলেন। নিস্পন্দ পাথরের মূর্তির মত বসে ছিলেন তিনি, চোখের তারা দুটি পর্যন্ত স্থির; কাচের চোখের মত মনে হচ্ছিল। ইলেকট্রিক ফ্যানের বাতাসে শুধু তাঁর গাউনের প্রান্তগুলি কাঁপছিল, দুলছিল। তিনি মনে মনে অনুভব করছিলেন ওই শ্বাসরোধী অবস্থার স্বরূপ। আঙ্কিক নিয়মে অন্ধ বস্তুশক্তির নিপীড়ন। অঙ্কের নিয়মে একদিকে তার শক্তি ঘনীভূত হয়, অন্যদিকে জীবনের সগ্রাম-শক্তি সহ্যশক্তি ক্ষীণ ক্ষীণতর হয়ে আসে। তার শেষ মুহূর্তের অব্যবহিত পূর্বে সে চরম মুহূর্ত—শেষ চেষ্টা তখন তার, পুঞ্জ পুঞ্জ শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া, নির্মল প্ৰাণদায়িনী বায়ুর অভাবে হৃৎপিণ্ড ফেটে যায়। সকল স্মৃতি, ধারণা, বিচারবুদ্ধি অস্পষ্ট হয়ে মিলিয়ে আসে। অকস্মাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে যেমন আলোর শিখা বেড়ে উঠে লণ্ঠনের ফানুসে কালির প্রলেপ লেপে দেয়, তার জ্যোতির চৈতন্যকে আচ্ছন্ন করে দিয়ে নিজেও নিভে যায়—ঠিক তেমনি। ঠিক সেই মুহূর্তে খসে পড়ে জ্বলন্ত খড়ের রাশি, একসঙ্গে শত বন্ধনে বাঁধা একটা নিরেট অগ্নিপ্রাচীরের মত। আসামি ঠিক বলেছে, সেসময়ের মনের কথা স্মরণ করা যায় না। প্রকৃতির নিয়ম। হতভাগ্য আসামি জলের মধ্যে ড়ুবে যাচ্ছিল, নিষ্ঠুর বন্ধনে বেঁধেছিল তার ভাই। ঘন জলের মধ্যে গভীরে নেমে যাচ্ছিল, শ্বাসবায়ু রুদ্ধ হয়ে ফেটে যাচ্ছিল বুক, সে সেই যন্ত্রণার মধ্যে চলছিল পিছনের দিকে আদিমতম জীবন-চেতনার দিকে।

অকস্মাৎ তাঁর কানে এল অবিনাশবাবুর কথা।

খ.

পাবলিক প্রসিকিউটার বলছিলেন সেকশন এইট্টি-ওয়ানের অনুল্লিখিত অংশটির কথা। আমি খগেনের গলা টিপে ধরে তাকে আঘাত করেছে, শ্বাস রোধ করে মৃত্যুর কারণ ঘটিয়েছে, খগেনকে মেরে নিজেই বেঁচেছে, খগেনকে বাঁচবার অবকাশ দেয় নি।

ইয়োর অনার, তা ছাড়া আরও একটি কথা আছে। আমার পণ্ডিত বন্ধু সেকশন এইট্টিওয়ানের একটি নজিরের অর্ধাংশের উল্লেখ করেছেন মাত্র। সে অর্ধাংশের কথা আমি বলেছি। এই সেকশন এইটি-ওয়ানেই আর-একটি নজিরের উল্লেখ আমি করব। ভগ্নপোত তিন জন নাবিক, অকূল সমুদ্রে ভেলায় ভাসছিল। দুই জন প্রৌঢ়, এক জন কিশোর। অকূল দিগন্তহীন সমুদ্র, তার উপর ক্ষুধা। ক্ষুধা সেই নিষ্করুণ নিষ্ঠুরতম রূপ নিয়ে দেখা দিল, যে-রূপকে আমরা সেই আদিম উন্মাদিনী শক্তি মনে করি। যা দেবী সর্বভূতেষু ক্ষুধারূপেণ সংস্থিতা যার কাছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জীবন মাথা নত করে। সেই অবস্থায় তারা লটারি করে এই কিশোরটিকে হত্যা করে তার মাংস খেয়ে বাঁচে। তারা উদ্ধার পায়। পরে বিচার হয়। সে-বিচারে আসামিদের উকিল জীবনের এই আদিম আইনের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, বিচারককে মনে রাখতে হবে, তারা তখন মানুষের সভ্যতার আইনের চেয়েও প্রবলতর আইনের দ্বারা পরিচালিত!

কিন্তু সেখানে বিচারক বলছেন, আত্মরক্ষা যেমন সহজ প্রবৃত্তি, সাধারণ ধর্ম—তেমনি আত্মত্যাগ, পরার্থে আত্মবিসর্জন মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি, মহত্তর ধৰ্ম। ইয়োর অনার, যে-প্রকৃতি বস্তুজগতে অন্ধ নিয়মে পরিচালিত, জন্তু-জীবনে বর্বর, হিংস্ৰ, কুটিল, আত্মপরতন্ত্রতায় যার। প্রকাশ, মানুষের জীবনে তারই প্রকাশ দয়াধর্মে, প্রেমধর্মে, আত্মবলিদানের মহৎ এবং বিচিত্র। প্রেরণায়। জন্তুর মা সন্তানকে ভক্ষণ করে। মানুষের মা আক্রমণোদ্যত সাপের মুখ থেকে সন্তানকে বাঁচাতে সে-দংশন নিজে বুক পেতে নেয়। কোথায় থাকে তার আত্মরক্ষার ওই জান্তব দীনতা হীনতা? মা যদি সন্তানকে হত্যা করে নিজের প্রাণের জন্য, পিতা যদি পুত্রকে হত্যা করে নিজের প্রাণের জন্য, বড় ভাই যদি অসহায় দুর্বল ছোট ভাইকে হত্যা করে নিজের প্রাণরক্ষা করে মহত্তর মানবধর্ম বিসর্জন দেয়, সবল যদি দুর্বলকে রক্ষা না করে, তবে এই মানুষের সমাজে আর পশুর সমাজে প্রভেদ কোথায়? মানুষের সমাজ আদি যুগ থেকে এই ঘটনার দিন পর্যন্ত অনেক অনেক কাল ধরে অনেক অনেক দীর্ঘ পথ চলে এসেছে অন্ধতমসাচ্ছন্নতা থেকে আলোকিত জীবনের পথে; এই ধর্ম এই প্রবৃত্তি আজ আর সাধনাসাপেক্ষ নয়, এই ধর্ম এই প্রবৃত্তি আজ রক্তের ধারার সঙ্গে মিশে রয়েছে; তার প্রকৃতির স্বভাবধর্মের অঙ্গীভূত হয়ে গিয়েছে। আমাদের পুরাণে আছে, মহর্ষি মাণ্ডব্য বাল্যকালে একটি ফড়িংকে তৃণাঞ্জুর ফুটিয়ে খেলা করেছিলেন। পরিণত বয়সে তাকে বিনা অপরাধে রাজকর্মচারীদের ভ্ৰমে শূলে বিদ্ধ হতে হয়েছিল। তিনি ধর্মকে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, কোন অপরাধে এই দণ্ড তাকে নিতে হল। তখন ধর্ম এই বাল্যবয়সের ঘটনার কথাটি উল্লেখ করে বলেছিলেন, আঘাতের প্রতিঘাতের ধারাতেই চলে ধর্মের বিচার, ক্রিয়ার প্রতিক্রিয়ার মত অমোঘ অনিবার্য। এ থেকে কারও পরিত্রাণ নাই। ইয়োর অনার, এই মানুষের ধর্ম সম্পর্কে কল্পনা এদেশে–

ঠিক এই মুহূর্তে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।

সমস্ত কোর্টরুমটা যেন পাক খেতে শুরু করেছিল। তার মধ্যে মনে পড়েছিল—দীর্ঘদিন আগেকার কথা। তিনি হাসপাতালে পড়ে আছেন, বুকে পিঠে ব্যান্ডেজ বাঁধ; নিদারুণ যন্ত্ৰণা দেহে মনে! সুরমার বাবা তাকে বলেছিলেন-কী করতে তুমি? কী করতে পারতে? হয়ত সুমতির সঙ্গে একসঙ্গে পুড়ে মরতে পারতে? কী হত তাতে?

আজ আসামিকে লক্ষ্য করে অবিনাশবাবু যখন এই কথাগুলি বলে গেলেন, তখন তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত শরীরে শিরায় শিরায় স্নায়ুতে স্নায়ুতে তীক্ষ্ণ সূচীমুখ হিমানী-স্পর্শের প্রতিক্রিয়ায় যেন একটা অদ্ভুত কম্পন বয়ে গেল সর্বাঙ্গে। আজ আকাশে মেঘ নাই; রোদ উঠেছে; স্কাইলাইটের ভিতর দিয়ে সেই আলোর প্রতিফলনে আসামির পায়ের কাছে একটা ঘন। কালো ছায়া পুঞ্জীভূত হয়ে যেন বসে রয়েছে। তিনি টেবিলের উপর মাথা রেখে যেন নুয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সে এক মিনিটের জন্য, বোধ করি তারও চেয়ে কম সময়ের জন্য। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মাথা তুলে বলেছিলেন মিঃ মিট্রা, একটু অপেক্ষা করুন, আমি আসছি। ফাইভ মিনি প্লিজ।

তিনি খাস কামরায় চলে গিয়ে বাথরুমে কলের নিচে মাথা পেতে দিয়ে কল খুলে দিয়েছিলেন। চার মিনিট পরেই আবার এসে আসন গ্রহণ করে বলেছিলেন, ইয়েস, গো অন প্লিজ!

ধর্ম সম্বন্ধে মানুষের কল্পনার কাহিনীগুলি যতই অবাস্তব হোক তার অন্তর্নিহিত উপলব্ধি, তার ভিত্তিগত সত্য অভ্রান্ত, অমোঘ। রাষ্ট্র সমাজ সেই নিয়ম ও নীতিকেই জয়যুক্ত করে। বর্তমান ক্ষেত্রে—

অবিনাশবাবু আশ্চর্য ধীমত্তার সঙ্গে তাঁর সওয়াল করেছেন। সমস্ত আদালত অভিভূত হয়ে ছিল। সওয়াল শেষের পরও মিনিটখানেক কোর্টরুমে সূচীপতন-শব্দ শোনা যাবার মত স্তব্ধতা থমথম করছিল।

আসামি চোখ বুজে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

সেই স্তব্ধতার মধ্যেও সকলের মনে ধ্বনিত হচ্ছিল,বর্তমান ক্ষেত্রে আমি যদি একটি নারীর প্রেমে উন্মত্ত হয়ে স্নেহ-মমতা, তার সুদীর্ঘ দিনের সন্ন্যাসধর্ম বিসর্জন দিতে উদ্যত না হত, তবে আমি নিশ্চয় বলতে পারি যে, আত্মরক্ষার আকুলতায় ওই ছোট ভাইয়ের গলা টিপে ধরেও সে ছেড়ে দিত, তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করত। সেক্ষেত্রে যদি এমন কাণ্ডও ঘটত তবে আমি বলতাম যে—জলের মধ্যে সে যখন ছোট ভাইয়ের গলা টিপে ধরেছিল, তখন শুধুমাত্র জান্তব আত্মরক্ষার প্রেরণাতেই সে এ-কাজ করেছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে আসামি এবং হত ব্যক্তি ভাই হয়েও প্রণয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী, যে-দ্বন্দ্বের তীব্রতায় বিষয়ভাগে উদ্যত হয়েছিল। এক্ষেত্রে আক্রোশ। অহরহই বর্তমান ছিল তার প্রণয়ের প্রতিদ্বন্দ্বীর উপর এবং যথাসময়ে সুযোগের মধ্যে সে-আক্রোশ যথারীতি কাজ করে গেছে। বাল্যজীবনে চতুষ্পদ হত্যা করার চাতুর্য তার সবলতর হাতে মুহূর্তে কার্য সমাধা করেছে–ইয়োর অনার–

অবিনাশবাবুর কথাগুলি এখনও ধ্বনিত হচ্ছে-আইনই শেষ কথা নয়। পৃথিবীতে প্রকৃতির। নিয়ম যেমন অমোঘ, মানুষের চৈতন্যের মহৎ প্রেরণাও তেমনই অমোঘ। তার চেয়েও সে বলবতী, তেজশক্তিতে প্রদীপ্ত, জান্তব প্রকৃতির তমসাকে নাশ করতেই তার সৃষ্টি! ভাই ভাইকে, বড়ভাই ছোটভাইকে রক্ষা করবার জন্য চেষ্টা করে নি, নিজের প্রাণরক্ষার জন্য তাকে হত্যা করেছে। এ-হত্যা কলঙ্কজনক; নিষ্ঠুরতম পাপ মানুষের সমাজে।

গ.

জুরীরা একবাক্যে আসামিকে দোষী ঘোষণা করেছেন।

আসামিও বোধহয় অবিনাশবাবুর বক্তৃতায় অভিভূত হয়ে গিয়েছিল, নতুবা বিচিত্র তার মন। তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এসেছিল। অকস্মাৎ কাঠগড়ার রেলিঙের উপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেছিল।

তার দিকে তাকাবার তখন তার অবকাশ ছিল না। তিনি তখন সামনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রায় ঘোষণা করেছিলেন–জুরীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি এবং আসামির অপরাধ সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে–

আবার তিনি মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়েছিলেন। হঠাৎ চোখ পড়েছিল সামনের দেওয়ালে–আসামির সেই ছায়াটা আধখানা মেঝে আধখানা দেওয়ালে এঁকেবেঁকে মসীময় একটা বিরাট প্রশ্নচিহ্নের মত দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু মুহূর্তেই আত্মসংবরণ করেছেন তিনি।

রায় দিয়েছেন, যাবজ্জীবন নির্বাসন। ট্রান্সপোর্টেশন ফর লাইফ। সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ ধারা অনুযায়ী এই অস্বাভাবিক আসামির প্রাণান্তকর অবস্থার মধ্যে সংঘটনের উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতির করুণা পাবার বিবেচনার জন্য সুপারিশ করেছেন।

কোর্ট থেকে এসে সরাসরি ঘরে ঢুকে আপিসে বসে ছিলেন। দেওয়ালে-পড়া সেই প্রশ্নচিহ্নটা কাল ছিল আবছা, আজ স্পষ্ট ঘন কালো কালিতে লেখা প্রশ্নের মত দাঁড়িয়েছে।

সুমতির কাছে তার অপরাধ আছে? আছে? আছে? না থাকলে ছবিখানা ঢাকা থাকে কেন? কেন? কেন?

আজ দীর্ঘকাল পর অকস্মাৎ তিনি পলাতক আত্মগোপনকারী দুর্বিষহ অবস্থা অনুভব করেছেন।

তাই বাড়ি ফিরে সরাসরি এসে সুমতির ছবির কাছে গিয়ে পরদাটা সরিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন। বল তোমার অভিযোগ! কোথায় তোমার ভয়? বল! বল! বল!

চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ, তারই মধ্যে মিলিয়ে গেল তাঁর মুখের সেই বিচিত্ৰ, একাধারে বিষণ্ণ এবং প্রসন্ন হাসিটুকু। সুরমা তাঁর বুকের উপর হাতখানি রেখে গাঢ়স্বরে বললেন– ডাক্তারকে ডাকি?

–না।

–মাথা ঘুরে গিয়েছিল স্বীকার করছ, তবু ডাক্তার ডাকবার কথায় না বলছ?

–বলছি। শরীর আমার খারাপ হয় নি। তুমি জান, আমি মিথ্যা কথা বলি না। ওই সুমতি; সুমতি হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল আমার। মাথাটা ঘুরে গেল।

চায়ের কাপটা টেবিলের উপর নামিয়ে দিয়ে জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঘরের মধ্যে মাথা হেঁট করে ঘুরতে লাগলেন। সুরমা মাটির পুতুলের মতই টেবিলের কোণটির উপর হাতের ভর রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন।

হঠাৎ একসময় জ্ঞানেন্দ্রনাথের বোধ করি খেয়াল হল——ঘরে সুরমা এখনও রয়েছে। বললেন–এখনও দাঁড়িয়ে আছ? না। থেকো না দাঁড়িয়ে যাও; বাইরে যাও; খোলা হাওয়ায়; আমাকে আজকের মত ছুটি দাও। আজকের মত।

সুরমা সাধারণ মেয়ে হলে কান্না চাপতে চাপতে ছুটে বেরিয়ে যেতেন। কিন্তু সুরমা অরবিন্দ চ্যাটার্জির মেয়ে, জ্ঞানেন্দ্রনাথের স্ত্রী। নীরবে ধীর পদক্ষেপেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। লনে এসে কম্পাউন্ডের ছোট পঁচিলের উপর ভর দিয়ে পশ্চিম দিকে অস্তমান সূর্যের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন; দুটি নিঃশব্দ অশ্রুধারা গড়িয়ে যেতে শুরু হল সূর্যকে সাক্ষী রেখে। তারও জীবনের আলো কি ওই সূর‍্যাস্তের সঙ্গেই অস্ত যাবে? চিরদিনের মত অস্ত যাবে?

–বয়! জ্ঞানেন্দ্রনাথের কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

ঘ.

জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঘুরছিলেন অবিশ্রান্তভাবে। মনের মধ্যে বিচিত্রভাবে কয়েকটা কথা ঘুরছে।

মাণ্ডব্য ধর্মের বিধানের পরিবর্তন করে এসেছিলেন।

পশু পশুকে হত্যা করে খায়। শুধু হিংসার জন্যও অকারণে হত্যা করে। সে তার স্ব-ধৰ্ম। তামসী তার ধর্মের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা। মানুষ যে ধর্মকে আবিষ্কার করেছে—সে সেখানে ভবিষ্যতের গর্ভে—সেখানে সে জন্মায় নি, সেখানে কোনো দেবতার শাস্তিবিধানের অধিকার নাই। এমনকি, অনুতাপের সূচীমুখেও এতটুকু অনুশোচনা জাগবার অবকাশ নাই সেখানে। মানুষের জীবনেই এই তমসার মধ্যে প্রথম চৈতন্যের আলো জ্বলেছে। শৈশব বাল্য অতিক্রম করে সেই চৈতন্যে উপনীত হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সে সকল নিয়মের অতীত। মাণ্ডব্য বলেছিলেন—যম, সেই অমোঘ সত্য অনুযায়ী আমি তোমার বিধান সংশোধন করছি। পাঁচ বৎসর পর্যন্ত মানুষ অপরাধ ও শাস্তির অতীত।

সে-বিধান ধর্ম নাকি মেনে নিয়েছিলেন।

আধুনিক যুগে সে বিধান আবার সংশোধন করেছে মানুষ।

রাষ্ট্ৰীয় দণ্ডবিধির নির্দেশ, সাত বৎসর পর্যন্ত মানুষের অপরাধবোধ জাগ্রত হয় না; সুতরাং ততদিন সে দণ্ডবিধির বাইরে। রাষ্ট্রবিধাতাদের বিবেচনায় পাঁচ বৎসর বেড়ে সাত বৎসর হয়েছে। মানুষ মহামসার শক্তির প্রচণ্ডতা নির্ণয় করে শিউরে উঠে তাকে সসম্ভ্ৰমে স্বীকার করেছে। তাতে ভুল করে নি মানুষ। কায়ার সঙ্গে ছায়ার মত তার অস্তিত্ব। তাকে কি লঙ্ঘন করা। করা যায়? কিন্তু এখনও কি?

এখনও মানুষের চৈতন্য কি সাত বছর বয়সের গণ্ডি অতিক্রম করে নি?

এখনও কি আদিম প্রকৃতির অন্ধ নিয়মের প্রভাবের কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণের দুর্বলতা কাটাবার মত বল সঞ্চয় করে নি? প্রাগৈতিহাসিক মস্তিষ্কের গঠনের সঙ্গে আজকের মানুষের কত প্রভেদ!

গুলিবিদ্ধ হয়ে মরণোন্মুখ মানুষ আজ অক্রোধের মধ্যে রাম নাম উচ্চারণ করতে পেরেছে। যুদ্ধে আহত মরণোন্মুখ মানুষ নিজের মুখের জল অপরের মুখে তুলে দিয়েছে তোমার প্রয়োজন বেশি। Thy necessity is greater than mine.

নিষ্ঠুরতম অত্যাচারেও মানুষ অন্যায়ের কাছে নত হয় নি; ন্যায়ের জন্য হাসিমুখে মৃত্যুবরণ করেছে। দুর্বল বিপন্নকে রক্ষা করতে সবল ঝাঁপ দিয়েছে বিপদের মুখে, নিজে মৃত্যুবরণ করে দুর্বলকে রক্ষা করেছে। বিবেচনা করতে সময়ের প্রয়োজন হয় নি। চৈতন্যের নির্দেশ প্রস্তুত ছিল। চৈতন্য জীবপ্রকৃতির অন্ধ নিয়মকে অবশ্যই অতিক্রম করেছে।

তিনি নিজেও তো করেছেন। ক্ষেত্রটা একটু স্বতন্ত্র।

তিনি সুরমাকে ভালবেসেছিলেন, কিন্তু সুমতির প্রতি কোনো বিশ্বাসঘাতকতা করেন নি। সুমতি বেঁচে থাকতে বারেকের জন্য সুরমাকে মুখে বলেন নি, তোমাকে আমি ভালবাসি। মনে না-পাওয়ার বেদনা ছিল, সে বেদনাও তিনি বুকের মধ্যে নিরুদ্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু পাওয়ার আকাঙ্খাকে গোপনতম অন্তরেও আত্মপ্রকাশ করতে দেন নি। কোনোদিন বারেকের জন্য থামেন নি। জীবনে তমসার সীমারেখা অনেক পিছনে ফেলে এসেছেন।

চোখ দুটির দৃষ্টি তাঁর অস্বাভাবিক উজ্জ্বল।

আবার এসে দাঁড়ালেন সুমতির ছবির সামনে। ভাল আলো এসে পড়ছে না, দেখা যাচ্ছে। না ভাল, তিনি ডাকলেন–বয়।

–নামা ছবিখানাকে। রাখ ওই চেয়ারের উপর।

সুমতির ছবির চোখেও যেন অভিযোগ ফুটে রয়েছে, যার জন্য ছবিখানাকে ঢেকে রাখার আদেশ দিয়েছেন। আজ ছবিখানাকে অত্যন্ত কাছে এনে, সত্যকারের সুমতির মত সামনে এনে, তার সঙ্গে বোঝাপড়া শেষ করবেন।

পরিপূর্ণ আলোর সামনে রেখে ছবির চোখে চোখ রেখেই স্থিরভাবে দাঁড়ালেন জ্ঞানেন্দ্রনাথ।

ক্লান্ত চিন্তাপ্রখর মস্তিষ্কের মধ্যে ঝড় বয়ে যাচ্ছে যেন। অন্যদিকে হৃদয়ের মধ্যে একটা কম্পন অনুভব করছেন। প্রাণপণে নিজেকে সংযত স্থির করে রাখতে চাইলেন তিনি। সমুদ্রে ঝড়ে বিপন্ন জাহাজের হালের নাবিকের মত। সব বিলুপ্ত হয়ে গেছে, আছেন শুধু তিনি আর সুমতির ছবি। ছবি নয়—ওই ছবিখানা আজ আর ছবি নয় তার কাছে, সে যেন জীবনময়ী হয়ে উঠেছে। স্থির নীল আকাশ অকস্মাৎ যেমন মেঘপুঞ্জের আবর্তনে, বায়ুবেগে প্রশান্ত বিদ্যুতে, গৰ্জনে বাজয় মুখর হয়ে ওঠে তেমনিভাবে মুখর হয়ে উঠেছে। এসবই তাঁর চিত্রলোকের প্রতিফলন তিনি জানেন। আকাশ মেঘ নয়, আকাশে মেঘ এসে জমে, তেমনিভাবে ছবিখানায় নিষ্ঠুর অভিযোগের প্রখর মুখরতা এসে জমা হয়েছে।

বার বার ছবিখানার সামনে এসে দাঁড়ালেন, আবার ঘরখানার মধ্যে ঘুরলেন। দেওয়ালের ক্লকটায় পেণ্ডুলামের অবিরাম টক-টক টক-টক শব্দ ছাড়া আর শব্দ নাই। সময় চলেছে রাত্রি অগ্রসর হয়ে চলেছে তারই মধ্যে।

উত্তর তাকে দিতে হবে এই অভিযোগের। এই নিষ্ঠুর অভিযোগ-মুখরতাকে স্তব্ধ করতে হবে তার উত্তরে। তাঁর নিজেরই অন্তরলোকে যেন লক্ষ লক্ষ লোক উদ্গ্রীব হয়ে রয়েছে তার উত্তর শুনবার জন্য। তাদের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি নিজে।

–বল, বল, সুমতি, বল তোমার অভিযোগ!

ছবির সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন। বল!

ওঃ, কী গভীর বেদনা সুমতির মুখে চোখে!—এত দুঃখ পেয়েছ? কিন্তু কী করব? দুঃখ তো আমি দিই নি সুমতি; নিজের দুঃখকে তুমি নিজে তৈরি করেছ। গুটিপোকার মত নিজে দুঃখের জাল বুনে নিজেকে তারই মধ্যে আবদ্ধ করলে!

কী বলছ? আমি তোমায় ভালবাসলে তোমার অমন হত না? আমার মন, আমার হৃদয়, আমার ভালবাসা পেলে তুমি প্রজাপতির মত অপরূপা হয়ে সর্ব বন্ধন কেটে বের হতে? মন হৃদয় ভালবাসা না দেওয়ার অপরাধে আমি অপরাধী?

–না। স্বীকার করি না! মন হৃদয় ভালবাসা দিতে আমি চেয়েছিলাম তুমি নিতে পার নি, তোমার হাতে ধরে নি। এ সংসারে যার যতটুকু শক্তি তার এক তিল বেশি কেউ পায় না।

সে তার প্রাপ্য নয়। ঈশ্বরের দোহাই দিলেও হয় না। ধর্ম মন্ত্র শপথ কোনো কিছুর বলেই তা হয় না। হাতে তুলে দিলে হাত দিয়ে গলে পড়ে যায়, অ্যাঁচলে বেঁধে দিলে নিজেই সে অ্যাঁচলের গিঁট খুলে হারায়, আঁচল ছিঁড়ে ফেলে। হ্যাঁ, পারে, একটা জিনিস প্রাপ্য না হলেও মানুষে দিতে পারে, দান-দয়া। তাও দিয়েছিলাম। তাও তুমি নাও নি!

ছবির সামনে দাঁড়িয়ে জ্ঞানেন্দ্রনাথ সত্যই কথা বলেছিলেন। চোখের দৃষ্টি তার স্বাভাবিক, উজ্জ্বল। ছবি যেন তার সামনে কথা বলছে। অশরীরী আবির্ভাব তিনি যেন প্রত্যক্ষ করছেন। শব্দহীন কথা যেন শুনতে পাচ্ছেন। তিনি যেন বিশ্বজগতের সকল মানুষের জনতার মধ্যে সুমতির সঙ্গে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন।

—কি বললে? সুরমাকে তো ভালবাসতে পেরেছিলাম?

—না পেরে তো আমার উপায় ছিল না সুমতি। তার নেবার শক্তি ছিল, সে নিতে পেরেছিল, নিয়েছিল। তাই বা কেন? তুমি নিজে না নিয়ে ছুঁড়ে তার হাতে ফেলে দিয়েছিলে, তুলে দিয়েছিলে। তুমিই অকারণ সন্দেহে মানুষের সঙ্গে মানুষের প্রীতিকে অভিশাপ দিতে গিয়ে বিচিত্র নিয়মে আশীর্বাদে সার্থক প্ৰেমে পরিণত করেছিলে। প্রীতিকে তুমি বিষ দিয়ে মারতে গেলে, প্রীতি সে বিষ খেয়ে নীলকণ্ঠের মত অমর প্রেম হয়ে উঠল।

—কী বলছ? বিবাহের সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম আমি?

–দিয়েছিলাম। সে-প্রতিশ্রুতি আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি! সুরমাকে ভালবেসেও তুমি জীবিত থাকতে কোনোদিন তা বাক্যে প্রকাশ করি নি, অন্তরে প্রশ্রয় দিই নি, মনে কল্পনা করি নি। তুমি আমার ধৈর্যকে আঘাত করে ভাঙতে চেয়েছ। আমি বুক দিয়ে সয়েছি, ভাঙতে দিই নি। শেষে তুমি আগুন ধরিয়ে দিলে। সে-আগুন ঘরে লাগল। সেই আগুনে তুমি নিজে পুড়ে ছাই হয়ে গেলে! আমি পড়লাম। কোনো রকমে বেঁচেছি, কিন্তু আমি নির্দোষ।

–কী?

অকস্মাৎ চোখ দুটি তার বিস্ফারিত হয়ে উঠল। এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে বিস্ফারিত চোখের নিম্পলক দৃষ্টিতে ছবির দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর চাপা গলায় প্রশ্ন করলেন–

–কী?

–কী বলছ?

—সেই চরম মুহূর্তটিতে আমি তোমার হাত থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিলাম? আমি যে তোমাকে বিপদে-আপদে আঘাতে-অকল্যাণে রক্ষা করতে ঈশ্বর সাক্ষী করে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, সে প্রতিজ্ঞা–।

–হ্যাঁ। হ্যাঁ। ছিলাম। সে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে পারি নি। স্বীকার করছি। স্বীকার করছি। কিন্তু কী করব? নিজের জীবন তো আমি বিপন্ন করেছিলাম, তবু পারি নি। কী করব? তোমার নিজের হাতে ভাঙা কাচের টুকরো–।

–কী? কী? সেটা বের করে তোমাকে বুকে তুলে নিয়ে বের হবার শেষ চেষ্টা করি নি? না, না করি নি! তোমার জীবন বাঁচাতে নিজের জীবন বিসর্জন দিতে পারতাম,দেওয়া উচিত ছিল, তা আমি পারি নি। আমি দিই নি। আমি স্বীকার করছি।

–কী? পৃথিবীতে মানুষের চৈতন্য অনেকদিন সাত বছর পার হয়েছে? হ্যাঁ হয়েছে। হয়েছে। নিশ্চয় হয়েছে! অপরাধ আমি স্বীকার করছি।

অবসন্নভাবে তিনি যেন ভেঙে পড়লেন, দাঁড়িয়ে থাকবার শক্তি আর ছিল না। একখানা চেয়ারে বসে মাথাটি নুইয়ে টেবিলের উপর রাখলেন। অদৃশ্য পৃথিবীর জনতার সামনে তিনি যেন নতজানু হয়ে বসতে চাইলেন। আবার মাথা তুললেন; সুমতি যেন এখনও কী বলছে।

–কী? কী বলছ?

–আরও সূক্ষ্মভাবে বিচার করতে বলছ?

—বলছ, নিয়তি আগুনের বেড়াকে ছিদ্ৰহীন করে তোমাকে ঘিরে ধরেছিল, শুধু একটি ছিদ্রপথ ছিল আমার হাতখানির আশ্রয়? আকুল আগ্রহে, পরম বিশ্বাসে সেই পথে হাত বাড়িয়ে ধরেছিলে, আমি হাত ছাড়িয়ে সেই পথটুকুও বন্ধ করে দিয়েছি।

—দিয়েছি! দিয়েছি! দিয়েছি। আমি অপরাধী। হ্যাঁ, আমি অপরাধী।

চেতনা যেন তার বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। প্রাণপণে নিজেকে সচেতন রাখতে চেষ্টা করলেন। নিজের চৈতন্যকে তিনি অভিভূত হতে দেবেন না। সকল আবেগ সকল গ্লানির পীড়নকে সহ্য করে তিনি স্থির থাকবেন।

কতক্ষণ সময় পার হয়ে গেছে, তার হিসাব তাঁর ছিল না। ঘড়িটা টক-টক শব্দে চলেছেইচলেছেই; সেদিকেও তিনি তাকালেন না। শুধু এইটুকু মনে আছে—সুরমা এসে ফিরে গেছে; বয়ও কয়েকবার দরজার ওপাশ থেকে বোধ করি শব্দ করে তার মনোেযোগ আকর্ষণ করতে চেয়েছে। কিন্তু তিনি মাথা তোলেন নি। শুধু নিজেকে স্থির চৈতন্যে অধিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করেছেন। তপস্যা করেছেন।

মাথা তুললেন তিনি। মুখে চোখে প্রশান্ত স্থিরতা, বিচারবুদ্ধি অবিচলিত, মস্তিষ্ক স্থির, চৈতন্য তাঁর অবিচল স্থৈর্যে অকম্পিত শিখার মত দীর্ঘ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে জ্বলছে। আদিঅন্তহীন মনের আকাশ শরতের পূর্ণচন্দ্রের দীপ্তির মত দীপ্তিতে প্রসন্ন উজ্জ্বল। চারিপাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য আলোকবিন্দুর মত যেন কাদের মুখ ভেসে উঠেছে। কাদের?

যাদের বিচার করেছেন—তারা?

বিচার দেখতে এসেছে তারা ডিভাইন জাস্টিস! ডিভাইন জাজমেন্ট।

কোনো সমাজের কোনো রাষ্ট্রের দণ্ডবিধি অনুসারে নয়, এ-দণ্ডবিধি সকল দেশের সকল সমাজের অতীত দণ্ডবিধি। সূক্ষ্মতম, পবিত্রতম, ডিভাইন!

আত্মসমর্পণ করবেন তিনি। কাল তিনি সব প্রকাশ করে আইনের কাছে আত্মসমর্পণ করবেন। অবশ্য তার কোনো মূল্যই নেই; কারণ তিনি জানেন কোনো দেশের প্রচলিত দণ্ডবিধিতেই এ-অপরাধ অপরাধ বলে গণ্য নয়, কোনো মানুষ-বিচারক এর বিচারও জানে না। তিনি নিজেও বিচারক, তিনি জানেন নাকী এর বিচার-বিধি, কী এর শাস্তি!

বিচার করতে পারেন ঈশ্বর। ঈশ্বর ছাড়া এর বিচারক নাই। ঈশ্বরকে আজ স্বীকার করেছেন তিনি। তবুও প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণ করবেন। তার আগে–।

সুরমা!

কই সুরমা? হয়ত পাথর হয়ে গেছে সুরমা। দীর্ঘনিশ্বাস একটি আপনি বেরিয়ে এল বুক চিরে। ধীর পদক্ষেপে বেরিয়ে এলেন তিনি। সুরমার সন্ধানেই চ ছিলেন। কিন্তু বারান্দায় এসে থমকে দাঁড়ালেন। মনে হল বিচারসভা যেন বসে গেছে।

মধ্যরাত্রির পৃথিবী ধ্যানমগ্নার মত স্থির স্তব্ধ। আকাশে চাঁদ মধ্যগগনে, মহাবিরাটের ললাট-জ্যোতির মত দীপ্যমান। কাটা কাটা মেঘের মধ্যে বর্ষণধৌত গাঢ়নীল আকাশখণ্ড নিরপেক্ষ মহাবিচারকের ললাটের মত প্রসন্ন। বিচারক যেন আসন গ্রহণ করে অপেক্ষা করছেন।

ধীরে ধীরে অভিভূতের মত নেমে প্রাঙ্গণের ঠিক মাঝখানে দাঁড়ালেন তিনি। সূক্ষ্মতম বিচারে নিজের অপরাধ-স্বীকৃতির মধ্য থেকে এক বৈরাগ্যময় আত্মসমর্পণের প্রসন্নতা তার অন্তরের মধ্যে মেঘমুক্ত আকাশের মত প্রকাশিত হচ্ছে। আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত অমলিন জ্যোত্সার জ্যোতিৰ্মানতা ও মহামৌনতার মধ্যে তিনি যেন এক চিত্ত-অভিভূতকরা মহাসত্তাকে অনুভব করলেন। অভিভূত হয়ে গেলেন তিনি। অথচ কয়েকটা দিন বর্ষণে বাতাসে কী দুর্যোগই না চলেছে।

সৃষ্টির সেই আদিকাল থেকে চলেছে এই তপস্যা। মহা-উত্তাপে ফুটন্ত, দাবদাহে দগ্ধ, প্ৰলয়ঝঞ্ঝায় বিক্ষুব্ধ বিপর্যস্ত, মহাবর্ষণে প্লাবিত বিধ্বস্ত পৃথিবী এই তপস্যার আশীর্বাদে আজ শস্য-শ্যামলতায় প্রসন্না, প্রাণস্পন্দিতা, চৈতন্যময়ী। সেই তপস্যারত মহাসত্তা এই মুহূর্তে যেন প্রত্যক্ষ হয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন জ্ঞানেন্দ্রনাথের অভিভূত সত্তার সম্মুখে। ধ্যাননিমীলিত নেত্র উন্মীলিত করে যেন তার বক্তব্যের প্রতীক্ষা করছেন।

জ্ঞানেন্দ্রনাথ আকাশের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন।

–বিচার কর আমার, শাস্তি দাও। তমসার সকল গ্লানির ঊর্ধ্বে উত্তীর্ণ কর আমাকে। মুক্তি দাও আমাকে!

পিছনে ভিজে ঘাসের উপর পায়ের শব্দ উঠছে। ক্লান্তিতে মন্থর। অন্তরের বেদনার বিষণ্ণতায় মৃদু। সুরমা আসছে। অশ্রুমুখী সুরমা।

তবুও তিনি মুখ ফেরালেন না।

আদিঅন্তহীন ব্যাপ্তির মধ্যে তপস্যারত জ্যোতিৰ্মান এই বিরাট সত্তার পাদমূলে প্রণতি রেখে তাঁর অন্তরাত্মা তখন স্থির শান্ত স্তব্ধ হয়ে আসছে। সুমতির ভ্ৰকুটি বিগলিত হয়ে মিশে যাচ্ছে। প্রসন্ন মহাসত্তার মধ্যে।

আজ যদি কোনোক্রমে সুরমা মরণ-আক্রমণে আক্রান্ত হয়—সুরমা কেন—যে-কেউ হয়, তবে নিজের জীবন দিয়ে তিনি তাকে রক্ষা করতে কাঁপিয়ে পড়বেন। মৃত্যুর মধ্যে অমৃত অসীম শূন্য আকাশের পূর্ণচন্দ্রের মত প্রত্যক্ষ। তাঁর অন্তরলোকে চৈতন্য শতদলের মত শেষ পাপড়িগুলি মেলেছে।

সুরমা এসে দাঁড়ালেন তার পাশে; শান্ত ক্লান্ত মুখখানির চারিপাশে চুলগুলি এলিয়ে পড়েছে, দুচোখের কোণ থেকে নেমে এসেছে দুটি বিশীর্ণ জলধারা, নিরাভরণা-বেদনার্তা-পরনে একখানি সাদা শাড়ি; তপস্বিনীর মত।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7
Pages ( 7 of 7 ): « পূর্ববর্তী1 ... 56 7

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress