বিংশ-শতাব্দীর ল্যাটিন-আমেরিকান গদ্য-সাহিত্য
[ রবের্তো গন্সালেস এচেবাররিয়া একজন কিউবান-আমেরিকান সাহিত্য গবেষক ও লেখক। ১৯৭০ সালে প্রখ্যাত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি খেতাব লাভ করেন।
এচেবাররিয়া বর্তমানে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক । স্পানঞা এবং লাতিন আমেরিকার সাহিত্য নিয়ে গবেষণালব্ধ অনেক প্রবন্ধ-গ্রন্থের রচয়িতা।
তার গবেষনার মূল ক্ষেত্র লাতিন আমেরিকান সাহিত্য (আধুনিক এবং ঔপনিবেশিক) এবং ১৬শ ও ১৭শ শতকে স্পানঞার স্বর্ণযুগের সাহিত্য।
সের্বান্তেস এবং কিউবার আলেহো কার্পেন্তিয়ের-কে নিয়ে বই লিখেছেন। তার লিখিত ‘মডার্ন ল্যাটিন আমেরিকান লিটারেচার’ বইটি ২০১২ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। নীচের রচনাটি সেই বইয়ের অংশ-বিশেষ অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন যুবায়ের মাহবুব. বি.স. ]
বিশ শতকের লাতিন আমেরিকান গদ্যসাহিত্য – আঞ্চলিকতাবাদ থেকে বিশ(২০) শতাব্দীর প্রথমভাগে (ল্যাটিন আমেরিকার শিল্প ও সাহিত্য) বিবর্তনের পথ ধরে আধুনিকতার দিকে মোড় নেয়। কিন্তু ছোটগল্প ছাড়া অন্যান্য গদ্যধর্মী সাহিত্য এই বিবর্তনের পথে কবিতার চেয়ে অনেকটা পিছিয়ে পরে। চল্লিশের দশকের আগে পর্যন্ত পাবলো নেরুদা, সেসার ভাইয়েহো বা গাব্রিয়েলা মিস্ত্রালের মতো মহান কবিদের সমকক্ষ কোন গদ্য-সাহিত্য অঙ্গনে আসেননি।
স্বকীয় সাফল্যে উজ্জ্বল একদল আঞ্চলিক ঔপন্যাসিক ছিলেন বটে। কিন্তু তাদের উপস্থিতি স্বত্ত্বেও আধুনিক লাতিন আমেরিকান সাহিত্য তখন পর্যন্ত মূলত কবিতা-নির্ভর বলেই পরিচিত ছিল। নেরুদা এবং মিস্ত্রাল ততদিনে আন্তর্জাতিক মহলে খ্যাতি অর্জন করেছেন – স্পেন, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। বোদ্ধাদের আগ্রহও প্রধানত এই দুজনের উপরই নিবদ্ধ ছিল।
ষাটের দশকে একদল দুঃসাহসিক ঔপন্যাসিক এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটান। তাদের সামষ্টিগত অভ্যুত্থানকে ‘বুম’ (Latin American Boom) বলা হয়ে থাকে। ‘বুম’ কি কারণে সম্ভব হয়েছিল? প্রধান কারণ ছিল, ষাটের দশকে কবিতার মতো উপন্যাসেও ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অগ্রগতি হয়। আধুনিক ধারার বর্ণনার কৌশলগুলো ল্যাটিন ঔপন্যাসিকরা সফলভাবে আয়ত্ত করতে পারেন।
‘বুম’ শব্দটি আচমকা বিস্ফোরণের ইঙ্গিত বহন করলেও বাস্তবে এই উন্নতি একদিনে সম্ভব হয়নি। বরং ক্রমবিকাশ হয়েছিল ধারাবাহকভাবে , শুরু হয়েছিল অনেক আগে, ত্রিশ এবং চল্লিশের দশকে।
প্রথমে খাপছাড়া ভাবে, পঞ্চাশের দশকে এসে তা আরো সংহত ও বেগবান হয়, অবশেষে ষাটের দশকে এসে তা পূর্ণতা পায়। এই পর্যায়ে এসে লাতিন আমেরিকান লেখকরা আধুনিক উপন্যাসের উপাদানে মৌলিক কিছু অবদান রাখতে সক্ষম হন।
কারণ – প্রুস্ত, কাফকা, জয়েস এবং ফকনারের মতো লেখকদের হাতে গড়া কলা-কৌশলের বাস্তবায়নের ফলেই সেটা সম্ভব হয়েছে।
একুশ শতকে গদ্যসাহিত্য পশ্চিমের অন্যান্য সাহিত্যে ধারার সাথে সম্পূর্ণ তাল মিলিয়ে চলছে। শিল্প-সাহিত্যের যে বিশ্বব্যাপী আদান-প্রদান, তাতেও রয়েছে ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যের ঈর্ষণীয় অংশগ্রহণ।
ওরাসিও কিরোগার জঙ্গলের উন্মাদনা
রুবেন দারিও এবং মোদের্নিস্মোর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে লাতিন আমেরিকার ছোটগল্পের বেশ সময় লেগেছিল। বিশ শতকের শুরুর দিকে সেই প্রভাব তখনও জোরালো। সেকালের তরুণ গল্পকাররা ছোটগল্পের বিন্যাস বা কাঠামো নিয়ে বিশেষভাবে ভাবিত ছিলেন, এবং সেই উদ্বেগ ও যত্ন তাদের উত্তর প্রজন্মের লেখকদের ভিতরেও দেখা যায়। কবিতার মতো ছোটগল্পের পরিসর সীমিত, দৈর্ঘ্য নিয়ন্ত্রিত।
অতএব লেখকের কাছে ছোটগল্প দাবী করে দক্ষ কৌশলের সুচারু প্রয়োগ। ছোটগল্প রচয়িতাদের ভেতর কেউ কেউ কবিও ছিলেন , যেমন আর্হেন্তিনার লেওপোল্দো লুগোনেস (১৮৭৪-১৯৩৮)।
তবে সেই যুগের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী এবং সফল গল্পকারের নাম ওরাসিও কিরোগা (১৮৭৮-১৯৩৭)। কিরোগা ছিলেন উরুগুয়াইয়ের নাগরিক। ১৯১৭ সালে কিছুটা খেলাচ্ছলেই তিনি লিখে রাখেন ছোটগল্প রচয়িতার জন্যে নিখুঁত দশ আদেশনামা , পরবর্তীকালে যা বহুল আলোচিত হয়।
বিকৃত ভ্রষ্টতা, নারকীয় পৈশাচিকতা, শরীর-মনের অবক্ষয় ও অসুস্থতা – এসবই কিরোগার গদ্যের চিরন্তন আবহ। অতিপ্রাকৃত সাহিত্যের অন্যতম জনক মার্কিন লেখক এডগার অ্যালান পো’র ছায়া কিরোগার লেখায় সর্বত্র বিরজমান।
কিরোগার ব্যক্তিজীবনে বারবার সহিংসতার দ্বারা আহত হেনেছিল। তাঁর বাবা শিকারে গিয়ে এক দুর্ঘটনায় মারা যান। তাঁর সৎ-পিতা আত্মহত্যা করেন, কিরোগার স্ত্রীও স্বহস্তে মৃত্যুবরণ করেন। অবশেষে কিরোগা নিজে যখন প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন , যখন তাঁর অন্তিম অবস্থা তখন তিনিও সায়েনাইড বিষ পান করে আত্মহননের পথ বেছে নেন।
লাতিন সাহিত্যিকদের জন্যে যা ‘প্রায়-বাধ্যতামূলক’ প্যারিসে বসবাস করা।
অল্প কয়েক মাস সে সময় সেখানে কাটিয়েছিলেন কিরোগা। কিন্তু তাঁর ভাল লাগেনি। আশাহত হয়ে ফিরে আসেন নিজ দেশে, বাসা বাঁধেন আর্হেন্তিনার উত্তরে মিসিওনেস প্রদেশের ক্রান্তীয় বুনো জঙ্গলে।
কিরোগার লেখায় তরল আবেগ বা তার পরিপার্শ্বের বর্ণময়তার লেশমাত্র নেই। বিষয়ের বৈচিত্র্যে আর লেখনীর দক্ষতায় তাঁর গল্পগুলো হয়ে উঠেছে কঠোর, কঠিন, বেদনাদায়ক, মর্মান্তিক।
১৯১৭ সালে তিনি প্রকাশ করেন প্রেম, উন্মাদনা এবং মৃত্যুর গল্প (কুয়েন্তোস দে আমোর দে লোকুরা ই দে মুয়ের্তে)। তার পরের বছরই প্রকাশিত হয় জঙ্গলের গল্প (কুয়েন্তোস দে লা সেলভা)। মোদের্নিস্মোর স্নিগ্ধ নান্দনিকতা ছুঁড়ে ফেলে কিরোগা তাঁর গল্পগুচ্ছে লাতিন আমেরিকার হিংস্র উন্মাদ উত্তাল প্রকৃতি ও সামাজিক বাস্তবতার মুখোমুখি হন। তাঁর সাহসী মোকাবিলার ফলে বিস্ময়কর কিছু ছোটগল্প লেখা হয় তাঁর কলমে, হীরের মতোই কঠিন এবং উজ্জ্বল। আজ পর্যন্ত লাতিন আমেরিকান গল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কারিগর হিসেবে কিরোগার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে। পরবর্তী প্রজন্মের লেখকেরা তাঁর ছোটগল্পের মুগ্ধ প্রশংসা করেছেন যেমন, অনুকরণও করেছেন তেমন।
‘মাটির উপন্যাস’ এবং ‘আত্মপরিচয়ের সন্ধানে’ বিংশ শতার্দীর প্রথমার্ধ্বে বিশাল, উচ্চাভিলাষ-সম্পন্ন কিছু উপন্যাস লাতিন আমেরিকান গদ্যের উপর প্রভাব বিস্তার করে। মহাদেশের আর্থ-সামাজিক এবং প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাসগুলোর মধ্যে কেউ কেউ কিরোগার প্রভাব খুঁজে পান। কিন্তু বাস্তবে এদের শিল্পরুচির (এস্থেটিক্স) সাথে কিরোগার গল্পের শিল্পরুচির খুব একটা মিল নেই। মূলত উনিশ শতকের ইউরোপীয় রিয়ালিস্ট বা বাস্তববাদী ধারার অনুসারী ছিলেন এইসব লেখকরা। আধুনিকতাবাদের সাথে সংঘর্ষের ফলে উপন্যাসের সৌষ্ঠবে যে ব্যাপক পরিবর্তন আসে, তা তাদের সনাতনী ধাঁচের কাহিনীগুলোতে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। বরং তাদের লেখার প্রেরণার উৎস অন্যত্র, বিষয়বস্তুও একেবারেই আলাদা।
লাতিন আমেরিকার প্রতিটি দেশের নিজস্ব প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য সে দেশকে এনে দিয়েছে এক স্বতন্ত্র পরিচয়। সেই স্বাতন্ত্র্যের উদঘাটন এই উপন্যাসগুলোর প্রধান উপজীব্য।
এক একটি দেশের ভৌগলিক চরিত্র কি? প্রাকৃতিক সম্পদ কিভাবে প্রতিটি দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে? এর ফলে সমাজ ও অর্থনীতিতে কি রূপান্তর ঘটছে?
এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন এই ধারার লেখকরা। অলিখিতভাবে ধরে নেয়া হয় যে প্রতিটি দেশের চরিত্রের মুখ্য নির্ণায়ক তার ‘মাটি’। অর্থাৎ, প্রকৃতিই হলো সমাজ ও রাজনীতির ভাগ্য নির্ধারণের গোপন চাবিকাঠি। এই কারণে উপন্যাসগুলিকে সমষ্টিগতভাবে নাম দেয়া হয় ‘মাটির গল্প’ (‘নভেলাস দে লা তিয়েরা’)।
এক অর্থে এর রচয়িতাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল নৃতাত্ত্বিক। একেকটি দেশের লোকগাঁথা, ভাষাবৈচিত্র্য, ধর্মবিশ্বাস, রূপকথা-পুরাণ, এমনকি লোকমুখে প্রচলিত কবিতা ও গান – এই সমস্ত উপাদানের নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে জাতীয় সংস্কৃতির বিশ্লেষণ-সংশ্লেষণ করা, জাতীয় কৃষ্টির একটি সামগ্রিক রূপরেখা দাঁড় করানোই ছিল এদের প্রধান লক্ষ্য। মাটির গল্পের লেখকবৃন্দ নিজেরা সাধারনতঃ নগরকেন্দ্রিক ছিলেন, রাজধানী শহরের বাসিন্দা। উনিশ শতকের পূর্বসুরী কোস্তুম্ব্রিস্তা লেখকদের মতো তারাও গ্রামাঞ্চলে গিয়ে লোকজ জীবনধারা অনুসন্ধান করতেন। তবে বিশ শতকে তাদের সহায় হয় সমাজ-বিজ্ঞানের ক্রমবিকাশমান শাখাগুলোর শক্তিশালী সব কলাকৌশল।
সমগ্র লাতিন আমেরিকান সাহিত্যে তখন নতুন জোয়ার এসেছে। বিভিন্ন দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়, তথা গোটা মহাদেশের আত্মপরিচয় খোঁজার শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টায় নেমেছেন শিল্পী সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবিরা। ‘মাটির উপন্যাস’ যেন গদ্যক্ষেত্রে সেই জোয়ারেরই একটি ঢেউ।
সার্মিয়েন্তোর মৃত্যুর পরবর্তী দশকগুলোতে আন্দোলনটি প্রসার লাভ করে। বিশেষ করে হোসে এনরিকে রোদো (১৮৭১-১৯১৭) এবং তাঁর প্রবন্ধ-গ্রন্থ ‘আরিয়েল’ এতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখে। ১৯০০ সালে প্রকাশিত সুদীর্ঘ এই প্রবন্ধটি বোদ্ধামহলে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। অল্প সময়ের ভেতর একই ধাঁচের আরো অনেকগুলো প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। লাতিন আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় চিন্তাবিদরা আত্মপরিচয়মূলক প্রবন্ধ রচনায় অগ্রসর হন, যেমন দোমিনিকার নামকরা সমালোচক ও প্রাবন্ধিক পেদ্রো এনরিকেস উরেনঞা (১৮৮৪-১৯৪৬), পেরুর মার্কসবাদী লেখক হোসে কার্লোস মারিয়াতেগি (১৮৯৪-১৯৩০), মেহিকোর দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী সামুয়েল রামোস (১৮৯৭-১৯৫৯), এবং আরও অনেকে।
প্রবন্ধ রচনার এই ধারা উৎকর্ষের শীর্ষে পৌঁছায় পঞ্চাশের দশকে। ১৯৫০ সালে মেহিকানো কবি অক্টাভিও পাস তাঁর বিখ্যাত সংকলন একাকীত্বের গোলকধাঁধা (এল লাবেরিন্তো দে লা সোলেদাদ) প্রকাশ করেন, আর তার সাত বছর পরেই বের হয় কিউবান কবি হোসে লেজামা লিমার প্রবন্ধের বই আমেরিকার অভিব্যক্তি (লা এক্সপ্রেসিওন আমেরিকানা, ১৯৫৭)। অক্টাভিও পাস তাঁর বিশ্লেষণে ফ্রয়েডীয় সাইকো-অ্যানালাইসিসের শরণাপন্ন হন।
দিগ্বিজয়ী স্পেনীয় সেনাপতি হের্নান কর্তেসকে তিনি মেহিকোর ক্রুদ্ধ পিতার ভূমিকায় দেখেন, আর অত্যাচারিতা মায়ের ভূমিকায় রাখেন কর্তেসের আদিবাসী উপপত্নী এবং দোভাষী মালিঞ্চে-কে। পাসের এই বিশ্লেষণ বিপুল প্রশংসা লাভ করে এবং মহাদেশের বুদ্ধিজীবিদের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে।
প্রবন্ধসহ সাহিত্যের অন্যান্য শাখার মূল বিষয়বস্তু হিসেবে ‘জাতীয় পরিচয়ের’ যে দাপট ছিল, আজ তা অনেকটাই স্তিমিত। তবে বিশ শতকের প্রথমভাগে এটিই ছিল লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের প্রধান আলোচ্য, বিশেষ করে উপন্যাসের ক্ষেত্রে। মাটির উপন্যাসের অতিকায় দীর্ঘ বিশ্লেষণ পড়ে পাঠকের মনে হতে পারে যে এগুলো লেখকের প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণের ফসল, নৃবিজ্ঞানীদের মাঠ-পর্যায়ে গবেষনার মতো। কিন্তু সত্যি কথা হলো ঔপন্যাসিকেরা আপন ঘর ছেড়ে মাঝেসাঝে মাটির-টানে গ্রামে যেতেন!
গুইরাল্দেস, রিভেরা, গাইয়েগোস –
মাটির উপন্যাসের এই তিন প্রতিভু।
সেই সময়ে এমন একটা ধারণা চালু ছিল যে নীতিভ্রষ্ট নগরীর সমুদয় ত্রুটি-বিচ্যুতিকে ধুয়ে-মুছে ফেলতে পারে গ্রামীন জীবনে থেকে আহরিত শিক্ষা। প্রাচীন রোমান ও গ্রীক সভ্যতায় পল্লীজীবনকে ‘আদর্শ’ হিসেবে প্রতীয়মান করার যে একটা প্রবণতা ছিল, এই দৃষ্টিভঙ্গি যেন তারই ভিন্নরূপ। মাটির উপন্যাসের বিপুল জনপ্রিয়তা টিকে ছিল অনেকদিন, লাতিন আমেরিকার সমস্ত দেশেই এই ঘরানার সাহিত্য প্রচুর লেখা হয়েছিল। উক্ত ধারার অগ্রভাগে ছিলেন তিনজন লেখক – আর্হেন্তিনার রিকার্দো গুইরাল্দেস (১৮৮৬-১৯২৭), কলোম্বিয়ার হোসে এউস্তাসিও রিবেরা (১৮৮৮-১৯২৮), এবং বেনেসুয়েলার রোমুলো গাইয়েগোস (১৮৮৪-১৯৬৯)।
বনেদী পরিবারের সন্তান রিকার্দো গুইরাল্দেস তাঁর শৈশব কাটান ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে। কথিত আছে যে তিনি স্পানঞল ভাষা শেখার আগে ফরাসী বলতে পারতেন। আভোঁ-গার্দ (avant-garde) আন্দোলনের সাথে তাঁর যোগসূত্র ছিল। শিল্প-সাহিত্যে অত্যাধুনিক এই ধারাকে অগ্রসর করতে তিনি দুটো পত্রিকা প্রকাশ করেন – ‘মার্তিন ফিয়েরো’ এবং ‘প্রোওয়া’।
তবে সাহিত্যাঙ্গনে গুইরাল্দেসের খ্যাতি সুপ্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৬ সালে, তাঁর উপন্যাস দন সেগুন্দো সোম্ব্রা প্রকাশের পর। এই কাহিনীর মাধ্যমে তিনি আর্হিন্তিনীয় সাহিত্যে নতুন এক কিংবদন্তী চরিত্রের অবতারণা করেন – বুড়ো গাউচো।
আর্হেন্তিনার গরুর মাংসের বিশ্বজোড়া কদর নতুন কোন ঘটনা নয়। বিশ শতকের প্রথমভাগে এর উৎপাদন ও রপ্তানী দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছিল, গোটা দেশের অর্থনীতিতে এনে দিচ্ছিল সমৃদ্ধি। গুইরাল্দেসের নিজের পরিবারের বিপুল ধনসম্পদের উৎসও ছিলএই গরুর খামার। লেখক তাঁর উপন্যাসে – এই জীবনধারার বন্দনা গান গেয়েছেন – গোটা বইটি যেন এক গৌরব-গাথা। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বৃদ্ধ গাউচো দন সেগুন্দো। গ্রামীন জীবনের সমস্ত প্রাজ্ঞতা যেন তাঁর চরিত্রে মূর্ত হয়েছে, যুগ যুগ ধরে কাউবয়ের কঠিন জীবনলব্ধ জ্ঞান তিনি সমর্পণ করবেন শহর থেকে আগত এক যুবকের কাছে।
দন সেগুন্দো সোম্ব্রা একটি বিল্ডুঙসরোমান – এক যুবকের বেড়ে ওঠার গল্প, জীবনের শিক্ষায় শিক্ষিত হবার গল্প। পাশাপাশি এটি একটি এলিজি বা শোক-গাথাও। আবার আরেক অর্থে হোসে হের্নান্দেস-এর গাউচো মহাকাব্য মার্তিন ফিয়েরো-র পুনর্পাঠ – আর্হেন্তিনার জাতীয় চরিত্র নিয়ে সেই এপিক কবিতাটি যে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল, তার ভেতর একটি সুচিন্তিত হস্তক্ষেপ। উপন্যাসের অন্তিম দৃশ্যে দন সেগুন্দো তাঁর ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে চলে যাচ্ছেন, পাহাড় টপকে। তাঁকে চলে যেতে দেখছে গল্পের বক্তা সেই যুবক, আজ তার বাবার মতো সেও রাঞ্চের মালিক। দন সেগুন্দোর প্রস্থানের দৃশ্য যেন তার বুকে রক্তক্ষরণের সৃষ্টি করে। যাবার আগে দন সেগুন্দো তাঁর নবীশ গাউচোকে উপদেশ দিয়েছিলেন – ‘বাছা, তোমাকে শক্ত হতে হবে’। পাম্পাস প্রান্তরের কঠোর পরিশ্রম আর্হেন্তিনীয় চরিত্রকে করে তোলে সুদৃঢ়-সুকঠিন। গাউচো-জীবনের এটিই পরম শিক্ষা।
তবে দন সেগুন্দো সোম্ব্রা-র খ্যাতি আর্জেন্টিনার সীমানা ছাপিয়ে অন্যত্র ছড়িয়ে পরে মূলতঃ দু’টি কারণে। প্রথমত লাতিন আমেরিকান পাঠকরা দন সেগুন্দোর লোকজ্ঞান এবং নির্বিকার সহ্যক্ষমতার সাথে একাত্ম বোধ করতে পেরেছিলেন, আর দ্বিতীয়ত উপন্যাসটির অসংখ্য শৈল্পিক গুণাবলী তাদের আকৃষ্ট করেছিল। গুইরাল্দেসের গদ্যের কাব্যময়তা এই গুণগুলোর অন্যতম।
হোসে এউস্তাসিও রিভেরা ছিলেন বাউন্ডুলে বোহেমিয়ান কবি, দুর্ভাগ্যবশতঃ মোদের্নিস্মোর অবক্ষয়ী অন্ধকার দিকের কবলে পরে গিয়েছিলেন। একের পর এক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা তাঁর খন্ডিত জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। মাত্র্র ৪০ বছর বয়সে এই তীব্র আবেগী মানুষটির জীবনাবসান ঘটে। ঘূর্ণি (লা ভোরাহিনে) শিরোনামে একটি উপন্যাস তিনি প্রকাশ করেন ১৯২৪ সালে, কিন্তু সমালোচক আর পাঠকদের স্বীকৃতির অভাব তাঁকে তাড়িত করতো। আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা করার ফলে তিনি আইনজীবী হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছিলেন। ১৯২২ সালে বেনেসুয়েলা এবং কলোম্বিয়ার মাঝামাঝি সীমান্ত বিরোধ নিরসনের লক্ষ্যে গঠিত একটি কমিশনে তাঁকে মনোনীত করা হয়। অবস্থা সরেজমিনে পরিদর্শন করতে গিয়ে তিনি জঙ্গল পরিবেষ্টিত সীমান্তে যাত্রা করেন। সেখানে গিয়ে রাবার বাগানের শ্রমিকদের অমানবিক জীবনদশা চাক্ষুষ প্রত্যক্ষ করেন – এই অভিজ্ঞতাটি তাঁকে প্রচন্ডভাবে নাড়া দেয়।
ঘূর্ণি বইটি লেখার পেছনে ‘রিবেরা’-র বেশ কয়েকটি অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল। তাঁর নিজ চোখে দেখা সীমান্তের বাস্তবতা তো ছিলই, তার সাথে সম্ভবতঃ যুক্ত হয়েছিল ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের স্মৃতিকথা পড়ার অভিজ্ঞতা। এমনকি কঙ্গোর জঙ্গলে বেলজিয়ামের রাজার নারকীয় শোষণ ও অত্যাচার নিয়ে লেখা জোসেফ কনরাডের বিখ্যাত উপন্যাস ‘হার্ট অফ ডার্কনেস’-এর সম্ভাব্য প্রভাবও এখানে উপেক্ষা করা যায় না। ‘ঘূর্ণি’ উপন্যাসের নায়ক আর্তুরো কোভা তার প্রেমিকাকে নিয়ে জঙ্গলে পালিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে গিয়ে তারা খুঁজে পায় রোগব্যাধি সর্বস্ব আর হিংসা-যুক্ত এক পৃথিবীই শুধু । নেশাচ্ছন্ন ঘোরের কবলে আর্তুরো তার দিনপঞ্জিতে যা লিখে রাখে, সেটাই আদতে এই উপন্যাসের টেক্সট। গল্পের কাহিনী তাকে ক্রমশঃ টেনে নিয়ে যায় এক ক্রান্তীয় নরকের ভেতরে, গভীরে আরো গভীরে, যেখান থেকে পালাবার আর কোন পথ খোলা নেই। অবশেষে, উপন্যাসের বিখ্যাত শেষ লাইন অনুযায়ী, ‘জঙ্গল তাদের গ্রাস করে ফেলে’।
রিবেরা তাঁর উর্বর কল্পনাশক্তি দিয়ে সীমান্তের নিষ্ঠুর প্রাকৃতিক জগতের অপরূপ বর্ণনা রেখে গেছেন। গল্পের চরিত্রদের নির্দয় রাক্ষুসে সম্পর্কও তুলে ধরেছেন – বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এক লাস্যময়ী নারী, নানা ছলনা আর উদ্দাম শরীরী আবেদন দিয়ে সে কোভাকে প্রলুব্ধ করে। কোভা টের পায়, নৈতিক অবক্ষয় আর মানসিক ভারসাম্যহীনতার পঙ্কিল পথ বেয়ে সে পিছলে যাচ্ছে। এমন পথ যার শেষে সকল মূল্যবোধ হারিয়ে যায়। ‘ঘূর্ণি’ অত্যন্ত নির্মম একটি উপন্যাস, দন সেগুন্দো সোম্ব্রা-র আদর্শবাদিতার চিহ্নমাত্র এখানে নেই। বরং আছে সমকালীন সমাজ ও রাজনীতির বিরুদ্ধে রিবেরার প্রবল প্রতিবাদ। মাটির উপন্যাসের গন্ডি পেরিয়ে ঘূর্ণি জন্ম দেয় আরেকটি উপধারার – ‘নভেলা দে লা সেলভা’ বা ‘জঙ্গলের উপন্যাস’।
দনঞা বার্বারা – সভ্যতা আর বর্বরতার সংঘাত
রোমুলো গাইয়েগোস-এর উপন্যাস দনঞা বার্বারা (Doña Barbara) প্রকাশিত হয় ১৯২৯ সালে। সমালোচকদের মতে এই বইটি মাটির উপন্যাসের সেরা নমুনা বা আদর্শরূপ। এই উপন্যাসের মাধ্যমে গাইয়েগোস লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের অতীতধারার সাথে সংযোগ স্থাপন করেন। আর ভবিষ্যতের সাহিত্যচর্চার উপরেও সবচেয়ে বেশী প্রভাব ফেলে ‘দনঞা বার্বারা (Doña Barbara)’।
গল্পের প্রধান চরিত্র – শিরোনামের বার্বারা – লাতিন সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টি। ইতিহাসে তার ছায়া যেন গুইরাল্দেসের দন সেগুন্দোর চেয়েও দীর্ঘ। গাইয়েগোসের আগে মহাদেশের অন্য কোন ঔপন্যাসিকের ভাগ্যে আন্তর্জাতিক খ্যাতি জোটেনি। এই উপন্যাসের কারণে লেখক সেই সম্মানও অর্জন করেন। রাজনৈতিক বিশ্বাসে উদারপন্থী গাইয়েগোস পেশায় ছিলেন শিক্ষক। গণ-শিক্ষা কার্যক্রমের প্রতি তার জোরালো সমর্থন ছিল, আর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছিল সোচ্চার কন্ঠ। বেনেসুয়েলার একনায়ক হুয়ান বিসেন্তে গোমেস ১৯০৯ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ বছর কঠোর হাতে দেশ শাসন করেছিলেন। তার বিরোধিতা করার ফলে গাইয়েগোসের ভাগ্যে জোটে নির্বাসন – নিউ ইয়র্ক, মেহিকোসহ আরো বিভিন্ন জায়গায়।
১৯৪৭-৪৮ সালে খুব অল্প সময়ের জন্যে বেনেসুয়েলায় গণতান্ত্রিক শাসন এসেছিল।
সাতচল্লিশের নির্বাচনে গাইয়েগোস বিপুল ভোটের ব্যবধানে রাষ্ট্রপতির পদ জয় করেন। কিন্তু মাত্র নয় মাস তিনি সেই পদে আসীন ছিলেন, আটচল্লিশের শেষ দিকে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি পদচ্যুত হন। এই ক্যু’র পরিনামে ক্ষমতায় আসেন আরেক সামরিক শাসক ‘মার্কোস পেরেজ হিমেনেস’। হুয়ান ভিসেন্তে গোমেসের মত তিনিও শক্ত হাতে দেশ পরিচালনা করেন, ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। গাইয়েগোস পুনরায় নির্বাসনে চলে যান – হিমেনেসের শাসনকাল তিনি অতিবাহিত করেন কিউবা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মেহিকোয়। প্রতিটি দেশেই প্রচুর গুনমুগ্ধ ভক্ত ছিল তাঁর। ১৯৪৩ সালে ‘দনঞা বার্বারা’ অবলম্বনে একটি চলচ্চিত্র নির্মিত হয় মেহিকোতে, নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন সে দেশের বিখ্যাত সিনে তারকা মারিয়া ফেলিক্স।
‘দনঞা বার্বারা’ একটি দীর্ঘ উপন্যাস। লাতিন আমেরিকান সংস্কৃতির মর্মমূলে সভ্যতা ও বর্বরতার যে সংঘাতের প্রস্তাবনা করেছিলেন সার্মিয়েন্তো তার ‘ফাকুন্দো’ গ্রন্থে, সেই সংঘাতই নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করেছেন গাইয়েগোস এই উপন্যাসে। দনিয়া বার্বারার নামের মধ্যেই ইঙ্গিত রয়েছে যে গল্পটি প্রতীকী – বার্বারা, বা বার্বারিজ্ম, বা বর্বরতা। অপরদিকে তার প্রেমিকের নাম সান্তোস লুজার্দো – স্পানঞল ভাষায় লুজ (luz) শব্দের অর্থ ‘আলো’, আর ‘সান্তো’ শব্দের অর্থ ‘সন্ত’ বা ‘পবিত্র’ – দুটিই বোঝানো যায়।
বেনেসুয়েলার বিস্তীর্ণ ইয়ানো (llano) প্রান্তরে দনঞা বার্বারার বিশাল খামার। ছলে-বলে নানা অবৈধ উপায়ে তিনি বছরের পর বছর এই খামারের আয়তন বৃদ্ধি করে চলেছেন। প্রয়োজনে তার আগ্রাসী যৌন আবেদনকেও কাজে লাগিয়েছেন – তার প্রচলিত ডাকনাম পুরুষ-খেকো রমনী (‘লা দেবোরাদোরা দে অম্ব্রেস’)। কিন্তু সান্তোস এই জমির আইনী স্বত্ত্বাধিকারী। এতদিন রাজধানী কারাকাসে আইনজ্ঞ হিসেবে কাজ করছিলো, এখন ফিরে এসেছে স্বীয় সম্পত্তির মালিকানা বুঝে নিতে। উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে বার্বারা আর লুজার্দোর পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে ঘিরে, যা পরবর্তীতে ভালোবাসায় রূপ নেয়।
সান্তোসের ইচ্ছা ইয়ানো প্রান্তরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। কাঁটাতারের বেড়া টাঙিয়ে জমির সীমারেখা সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করতে চায় সে। অবৈধভাবে পরের গরুর গায়ে নিজের ব্র্যান্ড পুড়িয়ে নিজের গরু বলে দাবী করার যে দুরাচার চলে আসছে যুগ যুগ ধরে, সেটা বন্ধ করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চায়। সর্বোপরি বার্বারার জবরদখল করা জমির ন্যায্য হিস্যা সে ফেরত চায়। বার্বারার গুন্ডারা তাকে বিশেষ আমল দেয় না প্রথমে, ভাবে শহরের পরিপাটি নতুন বাবু এসেছে বোকার মত ঝামেলা পাকাতে। কিন্তু সান্তোস তাদের ভুল প্রমাণ করে – ঘোড়সওয়ার হিসেবে নিজের দক্ষতার প্রমান দেখিয়ে প্রাপ্য সম্মান আদায় করে নেয়। অবশেষে জয় হয় সান্তোসেরই।
কিন্তু দনঞা বার্বারার চরিত্রে মূর্ত ‘বর্বরতার’ আবেদন এত প্রবল যে সান্তোসের আলোকিত সব ধ্যান-ধারণাও তার কাছে ম্লান হয়ে যায়। (সান্তোস চরিত্রের মাধ্যমে লেখকের নিজের ধ্যান-ধারনাও বটে!) উপন্যাসের কাহিনী কিছুটা গতানুগতিক সন্দেহ নেই – তারপরেও প্রধান দুই চরিত্রের দ্বন্দ্ব প্রায় একটি মিথের রূপ নেয়। বোবা পশুর গায়ে দগদগে লোহা দিয়ে ব্র্যান্ডিং করাই কি আইনের শাসন? খোলা জমিনের বুকে কাঁটাতার পেতে খন্ড-বিখন্ড করাই কি ন্যায়বিচার? আইনী শক্তির অন্তর্নিহিত জুলুমই কি সেই আইনের ভিতকে নড়িয়ে দেয় না?
এইসব জটিল প্রশ্নের কারণে দনঞা বার্বারা পাঠকদের কাছে অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী এবং মূল্যবান একটি উপন্যাস। গাইয়েগোসের ঠিক পরের প্রজন্মের লেখকরা – বইটিকে প্রত্যাখ্যান করলেও পরবর্তীতে অন্যান্যরা আবার বইটিকে পুনরুদ্ধার করেন এবং সাদরে গ্রহণ করে নেন। গাইয়েগোস নিজেও হয়তো তার উপন্যাসের সমস্ত অন্তর্নিহিত ধ্বনি-প্রতিধ্বনি টের পাননি। তবে পরে তিনি আরো কয়েকটি উপন্যাস লেখেন, দনঞা বার্বারা-র মতোই শক্তিশালী সেগুলো।
মেহিকানো বিপ্লবের উপন্যাস – আসুয়েলার লস দে আবাহো।
মাটির উপন্যাসের পাশাপাশি লাতিন সাহিত্যের আরেকটি শাখা প্রসারিত হয় – মেহিকানো বিপ্লবের উপন্যাস। দীর্ঘ এক দশক (১৯১০-১৯২০) ধরে চলমান এই বিপ্লবের ধাক্কা মহাদেশের আনাচে কানাচে অনুভূত হয়। বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে ম্যুরাল বা দেয়ালচিত্র অংকনের নতুন ধারা বিকশিত হয়, পরবর্তীতে লাতিন শিল্পকলার উপর এর বিরাট প্রভাব পরে। একই কথা বিপ্লবের উপন্যাসের ব্যাপারেও প্রযোজ্য। বিপ্লব চলাকালীন সময়েই প্রথম উপন্যাসগুলো লেখা হতে শুরু করে, তারপর চল্লিশ, পঞ্চাশ, এমনকি ষাটের দশকেও এই ধারার উপন্যাস প্রকাশিত হতে থাকে।
মাটির উপন্যাসের মত বিপ্লবের উপন্যাসও উনিশ শতকের রিয়ালিজম বা বাস্তববাদের ছক মেনে চলে, কিন্তু অনিবার্যভাবেই এর সাথে যুক্ত হয় যুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট একটি এপিক উপাদান। মেহিকোর মার্তিন লুইস গুজমান (১৮৮৭-১৯৭৬) বিপ্লব এবং বিপ্লবোত্তর রাজনৈতিক অস্থিরতাকে সম্বল করে বেশ কিছু উপাখ্যান-জাতীয় অতিকায় দৈর্ঘ্যের উপন্যাস লিখেছিলেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘ঈগল ও সাপ’ (এল আগিলা ই লা সের্পিয়েন্তে, ১৯২৮) এবং ‘স্বৈরাচারীর ছায়া’ (লা সোম্ব্রা দেল কাউদিইয়ো, ১৯২৯)।
তবে মেহিকানো বিপ্লবের সেরা ঔপন্যাসিক নিঃসন্দেহে মারিয়ানো আসুয়েলা (১৮৭৩-১৯৫২)। তার ১৯১৫ সালের উপন্যাস ‘নিম্ন বর্গের’ (লস দে আবাহো) লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের ক্লাসিক হিসেবে আজ স্বীকৃত।
আসুয়েলার প্রথম পেশা ছিল ডাক্তারী। বিপ্লবী সামরিক নেতা হুলিয়ান মেদিনার ফৌজের সাথে তিনি যুক্ত হন এবং যুদ্ধের ময়দানে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেন। পরবর্তীতে তাকে নির্বাসনে পাঠানো হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গ-রাজ্যে। টেক্সাসের এল পাসো শহরে বসেই তিনি ‘নিম্ন বর্গের’ উপন্যাসটি লেখেন। উপন্যাসের মুখ্যচরিত্র দেমেত্রিও মাসিয়াস একজন কৃষক। বিপ্লবী যোদ্ধাদের একটি দলে সে যোগ দেয়, লড়াই করে বিক্তোরিয়ানো হুয়ের্তার প্রতিবিপ্লবী ফেদেরালেস বাহিনীর বিরুদ্ধে। হুয়ের্তা বাহিনী নারকীয় তান্ডব চালায় – কৃষকদের সম্পত্তি লুন্ঠন করে বা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয়, তাদের স্ত্রীদের হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে তাদের অত্যাচার করে, নির্বিচারে গণহত্যাও করে।
কিন্তু মাসিয়াসের বিপ্লবী ফৌজও ফেদেরালেসের তুলনায় খুব একটা ভালো নয়। যখন তা’রা কোন গ্রাম বা টাউন দখল করে, তারাও নির্দ্বিধায় লুটপাট করে, মানুষও খুন করে। বিপ্লবী আদর্শের ধার ধারে না কেউ। অবশেষে মাসিয়াস উপলব্ধি করে যে সে কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই লড়ে যাচ্ছে এদের সঙ্গে – উপন্যাসের একটি স্মরণীয় দৃশ্যে মাসিয়াস গভীর গিরিখাদের ভেতর একটি পাথর ছুঁড়ে মারে। দেয়ালের গায়ে ধাক্কা খেতে খেতে অতল গহবরে তলিয়ে যায় পাথরটি, মাসিয়াস তার সাথে যেন নিজের তুলনা খুঁজে পায়।
কাহিনী চিত্রণে আসুয়েলা অত্যন্ত কুশলী ছিলেন। লেখক হিসেবে তার শ্রেষ্ঠ গুণ হলো তার বর্ণনাশৈলী (একাধারে কঠিন ও নির্লিপ্ত) এবং অ্যাকশনের দৃশ্য অংকন দক্ষতা। মেহিকোয় প্রত্যাবর্তনের পর ধীরে ধীরে তিনি পরিচিতি লাভ করেন, মহান লেখক হিসেবে স্বীকৃতি পান এবং চল্লিশের দশকে একাধিক সাহিত্য পুরস্কারে ভুষিত হন। স্রেফ গল্প বলার পারদর্শিতায় আজ পর্যন্ত কোন মেহিকানো লেখক আসুয়েলাকে টপকাতে পারেননি। বোদ্ধাদের মতে ‘নিম্ন বর্গের’ এবং হুয়ান রুলফোর পেদ্রো পারামো সর্বকালের সেরা দুটি মেহিকানো উপন্যাস, এবং লাতিন আমেরিকার শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর অন্যতম।
বাঙলা সংস্কৃতির সাথে লাতিন আমেরিকার সম্পর্কের একটা দীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। কম করে হলেও এই ইতিহাস একশ বছরের চেয়ে বেশীই হবে।
মারিয়া হেলেনা বাররেরা আগারওয়াল জানিয়েছেন : আজ অব্দি লাতিন আমেরিকান পাঠকদের বাংলা ভাষায় রচিত অনেক দুর্দান্ত রচনা পড়ার সুযোগ হয়নি।
আবার গার্সিয়া মার্কেস সম্পর্কে সালমান রুশদি জানিয়েছেন : তাঁর জগতই আমার জগত। মার্কেসের মৃত্যুর পর রুশদির এই লেখাটি লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় – লেখাটিতে তিনি মার্কেসের সাহিত্যের মূল্যায়ন এবং তার যাদুবাস্তবতা নামক শিল্পকৌশলের সাথে নিজের সাহিত্যের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা উল্লেখ করেছেন।
[ সংগৃহীত ও সম্পাদিত ]
——————————————–
[ ঋণ স্বীকার – যুবায়ের মাহবুব ]