৬. ডালটনগঞ্জ থেকে রয়ানা
আগামীকাল রাতে ডালটনগঞ্জ থেকে রয়ানা দেবেন ঘণ্টেবাবু। সেজোবাবুকে লেখা চিঠির কোনো উত্তর আসেনি আজ অবধিও। অথচ কুরিয়ার আসে কলকাতা থেকে রোজ-ই। তাড়া তাড়া চিঠি, ব্যাঙ্কের বিলটি, চেক, টাকা আসে রোজ অথচ তাঁর নামেই কোনো চিঠি এল না।
মন বলছে, কোনো সাংঘাতিক গড়বড়-টড়বড় হয়ে গেছে। ওঁরা হয়তো আগামী বৃহস্পতিবারও আসবেন না। আর তাঁদের না আসার অর্থ তাঁর এক্সটেনশনও না-পাওয়া। আর ওঁরা না-এলে, সুনীতির কাছে, ঝিঁঝির কাছে, মনোয়া-মিলন’-এর প্রত্যেকের কাছেই তো তিনি চিরজীবনের-ই মতো খেলো, সস্তা হয়ে যাবেন, আর কি মুখ দেখাতে পারবেন কোনোদিনও?
অথচ, রামকৃষ্ণদেবের দিব্যি; ঝিঁঝির সঙ্গে নীলোৎপলের সম্বন্ধটা যখন করেন তখন কিন্তু সুমন ব্যানার্জির কাছে তাঁর গভীর ঋণ, পাত্রী এবং পাত্র হিসেবে ঝিঁঝি এবং নীলোৎপলেরও ‘ভালোত্ব’ই সত্যি সত্যিই তাঁকে চালিত করেছিল।
অন্য কোনো উদ্দেশ্য তখন আদৌ ছিল না।
সুনীতি নিজেও জানেন না আজ অবধিও যে, ঘণ্টেবাবু ডালটনগঞ্জে বাড়িটি বানাবার সময়ে এবং তাঁর বিয়ের সময়েও তাঁর মালিকেরা একটি পয়সা দিয়েও সাহায্য করেননি। সব টাকাই দিয়েছিলেন সুনীতির স্বামী সুমন ব্যানার্জিই। চাইতেও হয়নি। নিজেই ঘণ্টেবাবুকে যেচে দিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ স্বার্থহীন, গোপন দান। ব্যানার্জিসাহেবের ডান হাত দান করলে, বাঁ-হাত কখনো জানেনি।
তারপরেও উনি কত কী করেছেন। পাগলা এবং ছুটকির মুখেভাতে পাঁচ হাজার করে টাকা দিয়ে ওদের নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে দিতে বলেছিলেন। তখন টাকার মূল্যও অনেক-ই ছিল। কে করে? তার বদলে কী এবং কতটুকুই বা করেছেন ঘণ্টেবাবু ব্যানার্জিসাহেবের জন্যে এ-জীবনে? তবে হ্যাঁ, অসততা করেননি। মনোয়া-মিলনের ব্যানার্জিসাহেবের ‘মহুয়া’ বাড়িটি নিজে ছুটি নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থেকে তৈরি করিয়েছেন। সব খরচ-ই হয়েছিল তাঁর-ই হাত দিয়ে। একটি পয়সাও এদিক-ওদিক করেননি। সেই চলে যাওয়া মানুষটির-ই, কালো যদিও, কিন্তু সপ্রতিভ, সুরুচিসম্পন্না, সচ্চরিত্র-মেয়ের ভালো হোক, এইটেই তিনি স্বাভাবিকভাবে চেয়েছিলেন মনে-প্রাণে।
মাথাতে এক্সটেনশনের চিন্তাটা এসেছিল অনেক-ই পরে। এই সম্বন্ধ উত্থাপনও প্রথমবার করেন বছর তিনেক আগে সেজোবাবুর কাছে। তা ছাড়া, নীলোৎপল তাঁর মালিক হলেও সম্পূর্ণই অন্য ধরনের মালিক। তার বাবা-কাকার সঙ্গে কোনোই মিল নেই তার চরিত্রের। সম্ভবত সে-তার মায়ের চরিত্রই পেয়েছে। মাতৃমুখী সন্তানও। উদার, নম্র, যদিও প্রচন্ড বদরাগি; রেগে গেলে চিৎকার করে কথা বলে; কিন্তু ক্ষতিকারক নয় কারোর-ই। ওর বাবা কাকারা কোনোদিনও গলা উঁচু করে কথা কারো সঙ্গেই বলেননি কোনোদিনও কিন্তু যাঁদের তাঁরা অপছন্দ করেন বা যাঁরা মুখের ওপরে ন্যায্য কথা বলেছেন তাঁদের, সেইসব মানুষদের কোনোরকম ক্ষতি করতেই বাধেনি তাঁদের।
তাঁদের মুখের ভাব বদলায় না। রাগ অথবা খুশি কিছুই বোঝা যায় না তাঁদের মুখের দিকে। চেয়ে। পাথরের মতো শক্ত, শীতকালের মাটির মতো ঠাণ্ডা, অজগরের চাউনির মতো ভয়াবহ চাউনি তাঁদের। চোখে চেয়ে থাকা যায় না বেশিক্ষণ।
নীলোৎপল অন্য প্রজন্মের মানুষ। শিক্ষিত, উদার; খোলামেলা। ঝিঁঝি মায়ের সঙ্গে ওকে মানাত খুব-ই আর ব্যানার্জিসাহেবের মেয়ে শুধু ভালো স্বামীই পেত না, ফিরে পেত হারিয়ে যাওয়া সব জাগতিক স্বাচ্ছন্দ্যও। সুখী হত সর্বার্থেই। এইজন্যেই ঘণ্টেবাবুর এত মাথা-ব্যথা। সকলের ভালোই করতে চেয়েছিলেন উনি। সেই ভালো করার সঙ্গে সঙ্গে যদি, তাঁর নিজেরও একটু ভালো হত, যে-ভালোর ওপরে তাঁর স্ত্রী-ছেলে-মেয়ের পুরো ভবিষ্যৎটাই নির্ভরশীল; তাহলে তাতে অন্যায়ই বা কী ছিল। প্রাথমিক স্তরে তাঁর নিজের ভালোর কথাটা সত্যিই একবারও ভাবেননি উনি। তখন মালিকেরা যদি, তাঁকে অমন নীচ বলে মনে করেন, তাহলে তাঁর আর কী করণীয় থাকতে পারে।
সুমন ব্যানার্জি তাঁদের কর্মচারীকে আর্থিক সাহায্য করেছেন একাধিকবার, যখন তাঁরা নিজেরা তা করতে অপরাগ বলে জানিয়ে দিয়েছেন, এই কারণেও ব্যানার্জিসাহেবের ওপরে রাগ ছিল ওঁদের। কর্মচারী’ হচ্ছে মালিকের প্রজার-ই মতো। তাঁদের-ই গরিব প্রজাকে অঢেল অর্থসাহায্য করে ‘বড়োলোকি’ দেখানোর অপরাধে চিরদিন-ই ব্যানার্জিসাহেবকে দোষী করে রেখেছিলেন ওঁরা। বদলাও হয়তো কিছু নিতেন কিন্তু তার সুযোগ না দিয়ে পরপারে পার হয়ে গিয়েছিলেন ব্যানার্জিসাহেব।
গরিবের, অভাগার, অভাবীর উপকার করাটাও কারো কারো চোখে ‘অহংকার’-এর প্রকাশ বলে ঠেকে। ঠেকে, এইজন্যেই যে, শুধুমাত্র টাকা ছাড়া সেইসব মানুষদের ‘অহং’-এর আর কিছুমাত্রই থাকে না বলে। এই সংসারে যে, যেমন মানুষ সে, সমস্ত সংসারকে তেমন চোখেই দেখে। যে মহৎ বা উদার, সে সকলের মধ্যের ভালোটুকুই দেখে আর যে নীচ, কুটিল, বক্র তার দৃষ্টিও ঠিক সেইরকম-ই হয়। সে প্রত্যেককেই নীচ, কুটিল বা বক্র বলে জানে। এই সর্বমান্য নিয়মকে অগ্রাহ্য করেন এমন উপায় তো নিরুপায় ঘণ্টেবাবুর নেই।
.
গতকাল বাজার থেকে একটা লাউ কিনে এনেছিলেন ঘণ্টেবাবু। ধনেপাতা ও বড়ি দিয়ে লাউয়ের হেঁচকি খেতে ভালোবাসেন উনি। শেফালি কাঁচা কলাই-এর ডাল বেঁধেছেন। বেগুন দিয়ে তেঁতুলের টক করেছেন আগেই। নিম-বেগুন ভাজা। এখন লাউ-এর হেঁচকিটা বসিয়েছেন। হঠাৎ-ই গরম পড়ে গেছে গতকাল থেকে ডালটনগঞ্জে। এই সময়ে এমনটা হওয়ার কথা নয়। হয়তো ঝড়-বৃষ্টি হবে। হলে, বাঁচা যায়। দশটা বেজে গেলেই হাওয়াটাতে ‘লু’ ‘লু’ ভাব আসে। উঠোনময় শুকনো পাতা গড়াতে গড়াতে ছড়াতে থাকে হাওয়াটা। সঙ্গে ধুলো।
মোড়াটা রান্নাঘরের বাইরে এনে বসলেন একটু শেফালি। আঁচল দিয়ে মুখ, গলা, ঘাড় ও বুকের ঘাম মুছলেন। বাড়িতে এখন কেউই নেই। পাগলা ও ছুটকি স্কুলে। ঘণ্টেবাবু বিড়ি কোম্পানিতে, যখন একা থাকেন তখন-ই বুকের মধ্যে একটা চাপা কষ্ট বোধ করেন শেফালি। বিশেষ করে সেদিনের পর থেকে।
ঠোঁটের ব্যথা চলে গেছে তবে ঘা শুকুতে দেরি হবে মনে হয়। আর মনের ঘা? সে কি আদৌ শুকুবে? কে জানে?
দাঁড়কাকটা আবারও এসে বসল। কী যে দেখে, চোখের মণিটা ঘুরিয়ে, চকচকে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে, তা ও-ই জানে। কাকের চোখের মণি যে, এমন করে ঘোরে, তা উনি ছেলেবেলা থেকে অগণ্য কাক দেখলেও কখনোই লক্ষ করেননি। তাঁর মেয়ে ছুটকির-ই আবিষ্কার এটা। আসলে, প্রতিদিন কত জিনিস-ই তো আমাদের চোখে পড়ে, ভাবছিলেন শেফালি; ‘চোখে-পড়া’ আর ‘দেখা’ বোধ হয় এক কথা নয়। চোখ’ তো সকলের-ই থাকে কিন্তু দেখার চোখ বোধ হয় কম মানুষেরই থাকে। কে, কী দেখে এবং কেমন করে দেখে; তার ওপরেই সবকিছু নির্ভর করে। জিতেন যেমন দেখেছিল শেফালিকে। এবং শেফালি দেখেছিলেন জিতেনকে।
‘দেখেছিল’ শব্দটা মনের মধ্যে আপনি গড়ে উঠেই ভেঙে গেল। দেখে, এখনও দেখে; বলল না মন। বলবার সাহস হল না। কেন?
জিতেন কি সত্যিই আর আসবে না তাঁর কাছে? যদি না আসে, তবে কী নিয়ে, কেমন করে বাঁচবেন শেফালি?
তাঁর স্বামীকে তো তিনি সব-ই দেন, যা-কিছুতেই তাঁর প্রয়োজন। যাতে তাঁর প্রয়োজন নেই, যেমন শেফালির একান্ত অবকাশ অথবা শেফালির শেফালি-ফুলের-ই মতো শরীর; তা তো তিনি জিতেনকে দিতে পারেন। দিলে, কী এমন ক্ষতি? অব্যবহারে যা-কিছুই মৃত তা, ব্যবহারে যদি নতুন জীবন পায় তাতে কার ক্ষতি? কে জানে! ক্ষতি হয়তো আছেও।
ঘণ্টেবাবু বুড়ো হয়ে যেতে পারেন, যদিও আজকাল ষাটবছরে কেউ-ই বুড়ো হয় না; ঘণ্টেবাবুর জীবনযাত্রা এবং মানসিকতাই তাঁকে ‘বুড়ো করে দিয়েছে, কিন্তু শেফালি তো এখনও বুড়ো হননি। আরও দশবছর তিনি ঋতুমতী হবেন। এখনও উর্বর আছেন তিনি। এখনও একজন পুরুষকে শুধু, শরীরী সুখ-ই নয়, সন্তান পর্যন্ত দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন।
আর মন? তাঁর মনটা যে, শুকিয়ে টাঁড় হয়ে গেছে। প্রায় মরুভূমি। তাঁর স্বামী কোনোদিন ই মনের কারবারি ছিলেন না। হয়তো অধিকাংশ পুরুষ-ই তাই। এবং প্রত্যেক বিবাহিতা নারীর-ই দাম্পত্যর ঘরের লাগোয়া যে, একফালি বারান্দা আছে এবং থাকে, তাতে যদি জিতেন মাঝেমধ্যে এসে দাঁড়াত, শীতের রোদ, গ্রীষ্মের চাঁদের আলো, বর্ষাদিনের কদমফুলের সুবাস হয়ে, তাতে কী খোয়া যেত তাঁর স্বামীর? কী ক্ষতি হত এই ব্যস্ত, স্বার্থপর পৃথিবীর?
তবে যা হয়েছে, বোধ হয় ভালোই হয়েছে। ওঁর আর জিতেনের সুন্দর, সুস্থ, মনের ভালোবাসাটা ক্রমশই দু-জনের অজানিতেই শরীরের ভালোবাসার দিকে হয়তো গুটি গুটি লোভী বেড়ালের মতো এগিয়ে যাচ্ছিল।
কিছু কিছু সম্পর্ক থাকে, সেসবের পরিণতি অমোঘ; অপ্রতিরোধ্য। ফাঁকা বাড়িতে একজন শারীরিক-ব্যাপারে অনভিজ্ঞ, কল্পনা-বিলাসী বত্রিশ বছরের টগবগে যুবক আর অভিজ্ঞা, মা হওয়া, পঁয়ত্রিশ বছরের পুরোপুরি সেক্স-স্টার্ভড এক যুবতী কোনো দাঁড়কাক-ডাকা গ্রীষ্মদুপুরে হঠাৎ-ই কখন যে, একে অন্যের অঙ্গাঙ্গি হয়ে পড়তেন তা একমাত্র মদনদেব-ই বলতে পারেন। ব্যাপারটা ঘটবার আগে অনেক মাস-বছরের প্রস্তাবনা থাকে। অনেক হাসি, গল্প, সাহিত্য ও তত্ত্বের নিষ্পাপ আলোচনা। কিন্তু যখন ঘটে যায়, তখন কয়েক মিনিটেই বহুবছরের রোমান্টিকতা, ফুল ও চকোলেট, কবিতা, গান, শিল্পচর্চা হঠাৎ-ই উৎসাহিত দু-টি শরীরের আঁচড়ে, কামড়ে, ঘামে, আলিঙ্গনে, অস্ফুট এবং স্ফুট প্রেমময় এবং কপট-কলহর স্বগতোক্তিতে মাখামাখি হয়ে গিয়ে রমণীর মসৃণ তলপেটের রোমশ কাঠবিড়ালিটি দলিত মথিত হতে পারে দু-জনেরই তাৎক্ষণিক ইচ্ছায়। আর কোন শুভ বা অশুভ ক্ষণে যে, সেই ঘটনা ঘটবে, তা পূর্বমুহূর্তেও কেউ জানতে পারেন না। পরমপবিত্র দৈবী-প্রেমের মুখোশের আড়ালেও নিতান্ত জান্তব–কাম গোপনে থাকেই; বাঘের নরম থাবার মধ্যে লুকোনো প্রখর নখের-ই মতো।
প্রেমিকা পুরুষ ও প্রেমিকা নারীর এই অবধারিত গন্তব্য। বিধাতা-নির্দেশিত এই পরিণতি ঠেকাবার কোনো উপায়-ই নেই তাদের কারোরই।
জিতেন কি আর সত্যিই আসবে না?
দাঁড়কাকটা বলল, ক্ক-খব-ক্ক-আ-আ’।
হঠাৎ পেঁপেগাছের দিকে উদাস উদ্দেশ্যহীন চোখে চেয়ে-থাকা শেফালির কানে সেই ‘ক আ-আ আওয়াজটাকে হঠাৎ-ই ন্ব-আ-আ’ বলে মনে হল। ন্ব-আ-আ করে।
তাঁর দুটি চোখ জলে ভরে গেল।
মনে মনে নিরুচ্চারে বললেন, শেফালি, সেই নিষ্ঠুর-গ্রীষ্ম-সকালকে উদ্দেশ করে– জিতেন! জিতু! তুমি ছাড়া আমার এই জীবনে, এই অভ্যাসের, এই দৈনন্দিনতার, এই দারিদ্রর, এই আনন্দহীন জীবনে যে, আর কেউই নেই! কিছুমাত্রই নেই! তোমার জন্যে আমি স্বামী-ছেলে-মেয়ে সংসার সব ত্যাগ করে যেতে পারি। চলো, আমরা কোথাও পালাই। পালিয়ে যাই দু-জনে। নতুন করে ঘর পাতি। পাগলা ও ছুটকি আমার কে? পাগলা বড় হবে, আর দশজন শিক্ষিত বঙ্গসন্তানের-ই মতো কোনো মাড়োয়ারি, গুজরাটি পাঞ্জাবির চাকর হবে। তারপর বিয়ে করবে। বউ নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে। যাবেই। ছুটকির বিয়ে হয়ে সেও চলে যাবে শ্বশুরবাড়ি। কারণ সে, পড়াশুনোতে ভালো হওয়া সত্ত্বেও তাকে আর পড়াতে পারবেন না ঘণ্টেবাবু। সেও, তার চেয়ে বয়সে অনেক বড়ো কাউকে বিয়ে করবে, দায়ে ঠেকে। এবং শেফালির-ই মতো রান্না করবে, সন্তান উৎপাদন করবে এবং স্বামী-সন্তানের জন্যে নিজের জীবনের সব, সুখ-আহ্লাদ-আনন্দ তিল তিল করে গলা টিপে মেরে শেফালির ই মতো হঠাৎ আবিষ্কার করবে একদিন যে, জীবনটা, মাত্র একটামাত্র জীবন–এমনি করে না-বুঝে, না-জেনে মিছিমিছি নিঃশেষে নষ্ট করে বসে আছে। তার মাও যেমন করেছিলেন একদিন। বিয়ে যে, কেন করতেই হবে, স্বামী-পুত্র-কন্যা নিয়ে, যুগযুগান্ত ধরে, এই ধরা-বাঁধা ছক-এর মধ্যে নিজেকে ফেলে অন্য চিন্তা ভাবনার শক্তি অথবা ইচ্ছাধীন অগণ্য মূর্খরা যা চিরদিন-ই করে এসেছে তার নিপুণ অনুকরণপ্রিয়তা কেন যে, মাছি-মারা-কেরানির-ই মতো করতেই হবে প্রত্যেক মেয়ের-ই, তা শেফালি কিছুতেই ভেবে পান না, আজকাল। বিশেষ করে জিতেন তাঁর জীবনে আসার পরে।
এতদিন এই তাঁর ‘ভাগ্য’ বলে এই জীবনকেই বিনা-প্রতিবাদে বিনা-অনুকরণে মেনে নিয়েছিলেন। না। ছুটকিকে তিনি লেখাপড়া শিখিয়ে স্বাবলম্বী করবেন। স্বয়ম্ভর। বিয়ে দেবেন না। বিয়ে না-করেও জীবন অবশ্যই পুরোপুরি উপভোগ করা যায়, যদি স্বাবলম্বী হওয়া যায়। তাঁরা ভুল করেছেন, তেমন ভুল ছুটকিদের করতে দেবেন না শেফালি!
না জিতু। তুমি ওরকম নিষ্ঠুর হোয়য়া না। এসো, কথা শোনো, অনেকদিন পরে পরে হলেও, এসো। আমার লক্ষ্মীসোনা।
এমন সময় গন্ধ বেরোল একটা। হঠাৎ।
কীসের গন্ধ? তাঁর প্রেম-পোড়া গন্ধ কি?
না, না।
কিন্তু ইশ, লাউটা ধরে গেল! গেছে, এক্কেবারে! রান্না চড়িয়ে, নিজে যে, কোন অন্য দিগন্তে চরতে-চরতে গেছিলেন মনে মনে! হবে না এমন!
ইশ! ভাবলেন শেফালি; মানুষটা যে, ধনেপাতা-দেওয়া লাউ-চচ্চড়ি খেতে খুব-ই ভালোবাসেন। ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত হয়ে আসবেন মানুষটা রোদে এতখানি হেঁটে। এখনও সাইকেল চালাতে পারেন না পায়ের জন্যে। নিজে হাতে শখ করে লাউটা এনেছিলেন কাল বিকেলের হাট থেকে।
ইশ। আগের মুহূর্তেই বিদ্রোহের কথা ভাবছিলেন কিন্তু এই মুহূর্তে তাঁর স্বামী এবং তাঁর পছন্দের লাউ ছাড়া আর কিছুই তাঁর মস্তিষ্কে রইল না।
মানুষ বড়ো আশ্চর্য জীব। ঝিঁঝি বসেছিল জানলার পাশে। এখন বেলা সাড়ে দশটা। হাওয়াটা জোর হয়েছে মনোয়া-মিলনে। গরমটা এবারে খুব তাড়াতাড়ি পড়ল। পাহাড়তলিটা পুরোটাই দেখা যায় এখান থেকে।
ঝিঁঝির প্রিয় জানালা এটি। চেয়ারে বা খাটে বসে, পাহাড়তলির দিকে চেয়ে কাটিয়ে দেয় ও ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
‘এবং পত্রিকাতে, লিটল ম্যাগাজিনে, অনেকদিন আগে শিরীষের একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল। দিয়ে গিয়েছিল শিরীষ নিজেই। কবিতাটির নাম ‘তোমাকে। সেই পত্রিকার কপিটিই বই-পত্র গুছিয়ে রাখার সময়ে আজ হঠাৎ-ই বেরিয়ে পড়ল। আবারও পড়ল কবিতাটি। ‘তোমাকে’র ‘তুমি যে কে, তা জানতে বাকি নেই ঝিঁঝির। অনেকদিন হলই ও জেনে গেছে, যা জানার। অথচ ওর কিছুই করার নেই। ও যদি একা হত তবে শিরীষ ছাড়া অন্য কারোকে নিয়ে ঘর-বাঁধার কথা ভাবতেই পারত না। কিন্তু মা! মা যে, অনেক-ই কষ্ট করে বাবা চলে যাওয়ার পর থেকে ওকে বুকে জড়িয়ে বড়ো করেছেন। ওর বিয়েটা, ওর একার সুখের বা ইচ্ছের ওপরে যে, নির্ভরশীল নয়! মায়ের নিরাপত্তা, মায়ের ভবিষ্যৎও যে, মস্ত বড়ো কথা! যে-পুরুষ তার এবং সুনীতির দু-জনের-ই নিরাপত্তার অঙ্গীকার করবে ও শুধু তাকেই বিয়ে করতে পারে।
শিরীষ, মানুষ হিসেবে চমৎকার। সত্যি বলতে কী, এমন মানুষ হয় না। কিন্তু সাচ্ছল্য? প্রতিমুহূর্তেই কত চমৎকার মানুষ যে, সচ্ছল’ মানুষদের কাছে জীবনের কতশত পরীক্ষাতে হেরে যাচ্ছেন, তার হিসেব আর কে রাখে।
তবে ‘বাস্তববাদী’ না হলেও চলে না। বাবার মৃত্যু না হলে, এই পৃথিবীর স্বরূপ ঝিঁঝিরা হয়তো বুঝতে পারত না। পৃথিবীর বাস্তব দিক সম্বন্ধে এখন ঝিঁঝির আর কোনোই সংশয় নেই। কবিতা, প্রেম, সব-ই শুকিয়ে যায় অর্থের অভাবে। দারিদ্র্য, মানুষের মধ্যের অনেক ভালো জিনিসকেই গলা টিপে মেরে ফেলে। মহৎ নীচ হয়ে যায়। হাসিখুশি মানুষ, রামগডুরের ছানা। আশাবাদী মানুষ, নিরাশ। নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়েই এইসব জেনেছে তাই বাস্তব দিকটা না দেখে ওর যে, কোনোই উপায় নেই।
নিরুপায় ঝিঁঝি।
তবে ঝিঁঝি একথাও জানে, যাকেই ও বিয়ে করুক-না-কেন, যেখানেই ও চলে যাক-না কেন বিয়ে হয়ে; মাকে নিয়ে; শিরীষ, ওর প্রথম-ই হয়তো, হয়তো ওর শেষপ্রেম হবে। অধিকাংশ মানুষের জীবনেই, প্রথম এবং যে-প্রেম বিয়েতে ‘প্রোথিত হয় না, সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতি হয়ে থেকে যায় তাঁদের মনে। শিরীষের জায়গাতে অন্য কারোকেই বসাতে পারবে না, আর এ-জীবনে।
কখনো আবার এ-ও ভাবে যে, এই হয়তো ভালো। পূরিত হবে না বলেই, দৈনন্দিনতার ছোঁয়া লাগবে না বলেই হয়তো এই প্রেম, চিরজীবন প্রেম-ই থাকবে। ম্লান হবে না কোনোদিনও।
শিরীষটা বড়োই ছেলেমানুষ! ঝিঁঝির সন্দেহ আছে, ওর ভালোবাসাটা ও বোঝে কি না আদৌ। এবং বুঝলেও, তার গভীরতা সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণামাত্রও শিরীষের আছে কি না!
দামাল হাওয়াটা পাহাড়তলির মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়ে পাহাড়ে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে আরও বড়ো মুঠিতে ঝরা ও মরা পাতা, আরও ফুল, আরও লাল ধুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে উড়িয়ে আবারও ধেয়ে আসছে এদিক পানে। তার ছোটাছুটির এই এলোমেলোমির জন্যে ছোটো ছোটো ঘূর্ণির সৃষ্টি হচ্ছে। শুকনো পাতা আর ধুলো দলা পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরে উঠছে ফণা তোলা সাপের মতো। কিছুক্ষণ স্তম্ভাকারে থাকছে। তারপরেই মাথায় গুলি-লাগা সাপের-ই মতো আবার লুটিয়ে পড়ছে মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে।
পাহাড়তলির এবং পাহাড়ের সবকটি কুসুম গাছে এখন নতুন পাতা এসেছে। কী আশ্চর্য উজ্জ্বল ফিকে বাদামি-লাল দেখাচ্ছে পাতাগুলোকে। মনে হচ্ছে যেন, ফুল-ই ফুটেছে গাছময়।
শিরীষ এইরকম-ই এক চৈত্রদিনে এইরকম-ই একটি মস্ত কুসুমগাছতলায় দাঁড়িয়ে ঝিঁঝিকে বলেছিল, বাসনাকুসুম।
কেন বলেছিল কে জানে?
এইসব শিরীষ-ই তাকে চিনিয়েছিল। গাছের নাম, ফুলের নাম, পাখির নাম, প্রজাপতির নাম। কুসুম ছাড়াও ওইরকম-ই লাল লাল চিকন নতুন পাতা এসেছে আসন আর বহেড়া গাছেও। বহেড়া গাছগুলো মস্ত মস্ত হয়। প্রত্যেকটা ডাল-ই প্রায় পঁয়তাল্লিশ-ডিগ্রিতে তড়িঘড়ি উঠে গেছে ঊর্ধ্বমুখী। যেন, মাটিকে একটুও পছন্দ নয় ওদের। আর মহুয়ারা যেন, ঠিক এদের উলটো। প্রতিটি ডাল-ই যেন, মাটির সঙ্গে কোলাকুলি করবে বলে, নীচে নেমে এসেছে। জমির সঙ্গে বড়ো ভাব-ভালোবাসা মহুয়াদের। এসবও শিরীষ-ই দেখিয়েছিল। ওর দেখার চোখ আছে।
মহুয়ার আর করৌঞ্জের গন্ধে এখন ভারী হয়ে আছে হাওয়া। সারারাত গন্ধে ম ম করে, মাথার মধ্যে ঝিলিক তুলে ডেকে যায় ব্রেইনফিভার, ইয়ালো-ওয়াট্রেলড ল্যাপউইঙ্গ, আর কুকু। কপারস্মিথ পাখি ডাকে–দুই দোসরে, দূরে দূরে থেকে থেকে। যেন, ঝিঁঝি আর শিরীষ। এ ডাকে, আর ও সাড়া দেয়।
একটা পাখি খুব মজার। তারা শুধু রাতের বেলাতেই ডাকে। ঝাণ্ডুরা তাকে বলে ‘উল্লু। পাখিটার চেহারা কোনোদিনও দেখেনি কারণ তারা শুধু রাতের অন্ধকারেই ডাকে। হয়তো চেহারাও দেখেছে কখনো দিনমানে কিন্তু কোন পাখি যে, সেই পাখি তা জানে না বলেই চিনে রাখতে পারেনি। পাখিগুলো ডাকে ‘ওঁক-ওঁক-ওঁক’; এইরকম শব্দ করে। এবং সারারাত স্বল্পসময়ের ব্যবধানে ডেকেই চলে। বিশেষ করে, চাঁদের রাতে। পাহাড়তলির রাতের মোহময়তা এইসব পাখির ডাকে বহুগুণ বেড়ে যায়।
এমন এমন রাতে হঠাৎ-ই শিরীষকে কাছে পেতে খুব ইচ্ছে করে ঝিঁঝির। খুব-ই কাছে। বোকাটা জানেই না যে, কত কষ্ট পায় ঝিঁঝি তার জন্যে। বোকা একটা। মিষ্টি, দুষ্টু, রুখু ছেলে।
নীলডোংরি পাহাড়ের নীলটোংড়ির নীল পাখি দুটো কি এ-বছরে আসবে? কে জানে! এলে খুব-ই ভালো হত! ঝিঁঝির তো হতই, অন্য অনেকেরই হত।
শিরীষ কি সারাটা জীবন চিরাঞ্জিলাল মাড়োয়ারির গদিতে খাতা লিখেই কাটিয়ে দেবে? এত গুণ নিয়ে? বাঙালি ছেলেরা নিজেরা কি কোনোদিনও বড়ো ব্যবসাদার বা শিল্পপতি হয়ে উঠতে পারবে না? চিরদিন-ই শুধু ‘চাই! চাই’ আর ‘চলবে না। করাটাই কি তাদের জীবনের একমাত্র অন্বিষ্ট হবে? আজীবন গ্রহীতা না হয়ে, দাতার ভূমিকাতে কি তাদের দেখা যাবে না কখনোই? তারা কি বলতে পারবে না? ‘নাও নাও, চলবে চলবে। যুগযুগান্ত ধরে কি তারা বিভিন্ন শ্রেণির চাকর আর শ্রমিক হয়েই থাকবে, ধুরন্ধর, অসৎ, খল, ধূর্ত, ভন্ড ট্রেড ইউনিয়নিস্টদের বলি হয়ে? কুঁড়ে হয়ে ঝুঁকি নিতে ভীতু হয়ে? আত্মসম্মানজ্ঞানহীন, পরিশ্রমবিমুখ; অনিয়মানুবর্তী হয়ে? চিরদিন?
অদেখা নীলোৎপলের প্রতি মনে মনে অনবধানে এইজন্যেই একধরনের দুর্বলতা জন্মেছে। ঝিঁঝির। সে, অন্তত কারো চাকর নয়, দয়ার ভিখিরি নয় কারো। ও নিজেই মালিক। উলটে ও দয়া করে দান করে, নেয় না কারো কাছ থেকেই।
ঝিঁঝি ভাবছিল, নীলোৎপলের যদি, ঝিঁঝিকে পছন্দ হয় এবং ঝিঁঝিরও নীলোৎপলকে; তবেও এ-বিয়ে নাও হতে পারে। সুনীতির ব্যাপারে ঝিঁঝিকে পরিষ্কার করে কথা বলে নিতে হবে নীলোৎপলের সঙ্গে। ইংল্যাণ্ডে, ইউরোপে এবং স্টেটসেও বয়স্কা ও অপারগ হলে শাশুড়ি-মায়েরা যেমন, মেয়ে-জামাই-এর সঙ্গেই থাকেন, সুনীতি তেমন-ই থাকবেন। এই শর্ত মেনে নিতে না পারলে, তাকে বিয়ে তো করতে পারবে না ঝিঁঝি। অবশ্য নীলোৎপলের তাকে পছন্দ নাও হতে পারে। আর যদি না হয় তো তবে কী করবে ও? কেমন করে মুখ দেখাবে শিরীষের কাছে?
ঝিঁঝি সত্যি সত্যিই কাউকেই বিয়ে করতেও চায় না শিরীষ ছাড়া। যদি শিরীষ করতে পারত কিছু একটা। কোনো ব্যবসা বা সেরকম কিছু। যদি আর্থিক সামর্থ্য বাড়াতে পারত ও, কিছুটাও অন্তত। অর্থ যে, এতখানি প্রয়োজনীয় বস্তু তা না-বুঝতে হলেই ভালো হত হয়তো।
কিন্তু না-বুঝে উপায়ও যে, নেই!
ঝিঁঝি প্রায়-ই ভাবে, ওরা দুজনে মিলে কিছু একটা করে। কোনো ব্যবসা। ঘণ্টেমামা নাকি রিটায়ার করবেন। কেন্দুপাতার ব্যবসাটা কেমন? ওঁর তো জানাশোনাও কম নেই। এত বছরের অভিজ্ঞতা! ঘণ্টেমামা এলে এই বিষয়ে সিরিয়াসলি কথা বলবে ঝিঁঝি। শিরীষের সঙ্গেও বলবে। নীলোৎপল যদি, ওকে বিয়ে সত্যি সত্যিই করে তবেও শিরীষ আর ঘণ্টেমামা পার্টনারশিপে কোনো ব্যবসা আরম্ভ করে নীলোৎপলদের কোম্পানিতেই কেন্দুপাতা বা অন্য কিছুও সাপ্লাই-টাপ্লাই দিয়ে শুরু করতে পারে। বাণিজ্যে বসতেঃ লক্ষ্মী।
সব প্রেম, সব বিয়ে, সংসারেই সাচ্ছল্যর ভূমিকা অনেকখানি। কবিতা-লেখা, প্রেমিক। বাঙালিরা এই সত্যটা আজও কেন, হৃদয়ংগম করতে পারল না, কে জানে।
.
ডালটনগঞ্জ থেকে বেতলা যাওয়ার পথের ঠিক ওপরেই, রেড়মার পরে একটি ফ্যাক্টরির এক্সটেনশন-এর কাজ হচ্ছিল। Sisal Hemp থেকে দড়ি তৈরি হয় এই ফ্যাক্টরিতে।
Sisalকে এই অঞ্চলে বলে ‘মোরব্বা’। আনারসের মতো দেখতে হয় গাছগুলো তবে আনারসের চেয়ে অনেক-ই বড়ো হয়। আর মধ্যে একটি স্তম্ভের মতো থাকে। তাতে, বছরের এই সময়ে ফুলও আসে। অনেক লম্বা হয়ে ওপরে ওঠে স্তম্ভগুলো। প্রায় দেড় দু-মানুষ সমান উঁচু হয়। তার ফুল ফোটে তাদের মাথায়।
Sisal Hemp থেকে দড়ি ইত্যাদি তৈরি হয়।
ফ্যাক্টরি-বিল্ডিংটার ছাদ ঢালাই হচ্ছিল আজ। জিতেন একটা শিশুগাছের নীচে ছায়া খুঁজে চেয়ার পেতে বসে ঢালাই-এর কাজের তদারকি করছিল। আকাশে সকাল থেকেই মেঘ জমছে। ঝড়-বৃষ্টি আসতে পারে। এবারে পালামৌতে অবস্থা অত্যন্ত খারাপ। যতটুকু বৃষ্টি হয় তার ছিটেফোঁটাও হয়নি গতবছরে। ফলে এ-বছরে অবস্থা শোচনীয়। এমনিতেই তো বিহারের এই জেলা ঊষর। জায়গাতে জায়গাতে মরুভূমির-ই মতো। এবারে সারাজেলাতেই এই চৈত্রেই মরুভূমির মতো অবস্থা হয়েছে। সবে তো চৈত্রমাস। পরে যে, কী হবে!
বেতলা টাইগার-প্রোজেক্টের হাতিরা সব, ওই অঞ্চল ছেড়ে ‘বাড়েষাঁনের দিকে চলে গেছে। হয়তো কিছু আছে মারুমার’ এবং ‘কুজরুম’-এ। কিছু গেছে মধ্যপ্রদেশেও। শম্বর, গাউর, হরিণ এবং বাঘেদের জন্যে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট জঙ্গলের ভেতরে ভেতরে ডিপ টিউবওয়েল খুঁড়িয়ে জেনারেটর দিয়ে পাম্প চালিয়ে জল তুলে তাদের পানীয় জলের জোগান কোনোক্রমে রাখার চেষ্টা করছেন যাতে তারা পিপাসাতে না মরে। বেতলার কমলদহে হাতিরা বরাবর-ই থাকে গরমের সময়ে। এবারে সেখানেও একটুও জল নেই। ডালটনগঞ্জ শহরে এই চৈত্ৰতেই জলকষ্ট শুরু হয়ে গেছে। গরম চলবে জুলাই-এর প্রথম সপ্তাহ অবধি। তারপরে যদি বর্ষা আসে। পুরো জেলার অনেক কুয়েতে জল নেই। ভরসা, ডিপ-টিউবওয়েল আর হাত-টিউবওয়েল। এখন-ই এমন! তবে মে-জুন-এ যে-কী হবে, ভাবতেও আতঙ্কিত হচ্ছে সকলে।
পিপাসা, বড়োই পিপাসা।
ডালটনগঞ্জ শহরে তবু তো বৃষ্টি এলে, বর্ষা নামলে পিপাসা মিটবে, আশা করা যায়। কিন্তু জিতেনের মনের পিপাসা? তা কি মিটবে?
শেফালিকে যে, ঠিক অতখানি ভালোবেসে ফেলেছিল লুডো খেলতে খেলতে, গল্প করতে করতে, চা খেতে খেতে, গান শুনতে শুনতে, কোনো সদ্যপ্রকাশিত বাংলা উপন্যাস বা কোনো পত্রিকার ‘রবিবাসরীয়’তে প্রকাশিত ছোটোগল্পর আলোচনা করতে করতে; তা আগে বোঝেনি জিতেন। যা এতদিন শুধু খেলাই ছিল, তা-ই অত্যন্ত বিপদ হয়ে উঠেছে। তার ভালোবাসার পুরস্কার যে, শেফালিকে অমনভাবে পেতে হবে, তার স্বামীর হাতে, ওই আধবুড়ো; পৃথিবী ও সংসার সম্বন্ধে সাধারণার্থে পরম-উদাসীন ঘণ্টেদার হাতে, তার বিন্দুমাত্র আশঙ্কাও করেনি জিতেন আগে। মানুষমাত্রই বড়ো পজেসিভ। যা সে, তার নিজের বলে একবার জেনেছে, তাকে সে নিজের পদাধিকারে সহজেই পরম-অবহেলা করতে পারে। এবং যখন করে, তখন ভাবে যে, সেই হেলাফেলাটাও তার স্বাভাবিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। নিজের কতখানি যে, যোগ্যতা আছে কোনো প্রাপ্তির-ই পেছনে এবং সেই প্রাপ্তিকে জিইয়ে রাখার জন্যেও; তা খুব কম মানুষ-ই নৈর্ব্যক্তিকভাবে বিচার করে দেখার মানসিকতা রাখেন। রাখলে, ঘণ্টো অমন নৃশংস হতে পারতেন না। ঘণ্টোর মধ্যে যে, এই ঘণ্টেদা আদৌ থাকতে পারেন তা দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি জিতেন, যে-ঘণ্টেদা শেফালিকে মেরেছিলেন তিনি এবং যিনি মারার পর তার কাছে ডাক্তার ডাকার অনুরোধ নিয়ে দৌড়ে এসেছিলেন, তিনিও একই মানুষ?
সেদিন জিতেন তার নিজের ব্যবহারেও এবং তার ঠাণ্ডা-মাথার কারণেও নিজেই চমৎকৃত হয়ে গেছে। চমৎকৃত হয়েছে ঘণ্টেদার প্রায় তাৎক্ষণিক অনুশোচনাতেও। যদিও মারাধরের রকমের জন্যে পুলিশ-কেস হতে পারত, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে বেইজ্জতিও হতে পারত ঘণ্টেদা, জিতেন বুদ্ধি না খাটালে; তবু বলতেই হয় যে, মানুষটি অন্যায় করামাত্রই সেটা যে, অন্যায় তা বুঝতে পেরে, যাঁর ওপরে তাঁর সবচেয়ে বেশি ক্রুদ্ধ হওয়ার কথা, ঠিক তাঁর-ই কাছে দৌড়ে এসেছিলেন শেফালির ভালোর জন্যে। শেফালির প্রতি ওঁর ভালোবাসার গভীরতার আশ্চর্য প্রকাশ বলেই মনে হয়েছে ব্যাপারটা জিতেনের। জিতেন তাঁকে অপমান করতে পারত, তাঁকে উলটে প্রহার করতে পারত তা ভালো করে জেনেও ঘণ্টেদা যেন, সেই সম্ভাব্য শাস্তি গ্রহণ করবেন বলেই, নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার অভিপ্রায়েই যেন দৌড়ে গেছেন তাঁর স্ত্রীর প্রেমিকের-ই কাছে।
এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা কোনো নাটক-নভেলেও পড়েনি এর আগে।
যতি দিল, একটু জিতেন তার ভাবনাতে। ঢালাইও থেমেছে।
ভাবল, ও কি শেফালির প্রেমিক? এ প্রেম নয়তো কী? এই কি পরকীয়া? শুধুই মনের ভালোবাসাও।
ও কি সত্যিই শেফালির প্রেমিক? ভাবছিল জিতেন। যদি প্রেমিক-ই হবে তবে, শেফালি যে-নরকে বাস করে, যে-দমবন্ধ ঘেরাটোপের মধ্যে, আলো-বাতাসহীন, আনন্দহীন, বৈচিত্র্যহীন দৈনন্দিনতার মধ্যে; তা থেকে তাঁকে ক্ষণকালের জন্যেও মুক্তি দিতে না পারার সিদ্ধান্ত নিয়ে কি ও যথার্থ কাজ করেছে? যা করেছে, সেটা কি অন্যায়?
না গিয়ে কি পারবে জিতেন? শেফালি যে, অনুক্ষণ তার-ই পথ চেয়ে থাকবেন। রান্নাঘরের গরমে অলক লেপটে থাকবে ঘামে, শেফালির গালে; তাঁর অতিসুন্দর স্তনসন্ধি ঘামে ভিজে চকচক করবে আর সেখানে দুলতে থাকবে তাঁর গলার, সরু সোনার হারের ছোট্ট সাদামাটা লকেটটি। ও না গেলে আর কে দেখবে সেই সাধারণ কিন্তু অসাধারণ দৃশ্য?
কী সুন্দর যে, দেখে জিতেন শেফালিকে! রান্নাঘরেও সুন্দর দেখে, সমান সুন্দর দেখে অন্য জায়গাতেও।
মনে পড়ে গেল। অনেকদিন আগের এক বর্ষা-দুপুরের কথা। শেফালি একদিন, ওকে বসিয়ে রেখে স্নান করতে গিয়েছিলেন। ফিরে এসে দু-জনে মিলে একসঙ্গে খাবেন বলে। ওদের বাড়ির বাথরুমের দরজাটাতে অনেক ফাঁক-ফোঁকর। বাজে কাঠ দিয়ে বানানো হয়েছিল। অনেক জায়গাতে চিড় খেয়ে গেছে। জিতেনের ভারি ইচ্ছে করেছিল, নিঃশব্দে গিয়ে, সেই ফাঁক-ফোকরের একটিতে চোখ লাগিয়ে শেফালির নিরাবরণ রূপটি দেখে। চমৎকার শরীরের গড়ন শেফালির। বাঁধনও চমৎকার। সুন্দর বুদ্ধিদীপ্ত মুখটি। বড়ো বড়ো আনত-পল্লবের স্বপ্নিল চোখ দু-খানি। চমৎকার।
ইচ্ছেটা মনের মধ্যে জাগতেই নিজেকে বকেছিল খুব।
যদি শেফালি নিজের ইচ্ছেতে কখনো দেখান জিতেনকে তাঁর নিরাবরণ রূপ, তবেই দেখবে। তস্কর হতে যাবে কেন? সেই সুন্দর দিনটির জন্যে অপেক্ষা করে থাকবে জিতেন, যতদিন অপেক্ষা করতে হয়।
কী যে করে ও! শেফালির মতো যে, ওর আর কারোকেই অত ভালো লাগে না। অগণ্য নারীকেই তো সে জানে। কেন যে, এই বিবাহিতা নারীর প্রেমেই এমন করে পড়ল! মাঝে মাঝেই মনে হয়, ওর জীবন অভিশপ্ত। শেফালিকে জীবনে ওর একার করে না পেলে, বেঁচে থাকার কোনো মানে নেই আর ওর কাছে। শেফালির কোনো বিকল্প নেই ওর কাছে। হবেও না। তিনি অদ্বিতীয়া।
স্বামীর অন্ন কিন্তু কখনো তাঁর প্রেমিককে খাওয়াননি একদিনও শেফালি। জিতেনও খায়নি। যেদিন নিজেই হাতে করে কিছু নিয়ে গেছে, সেদিন-ই শুধু শেফালি বলেছেন, এখুনি রাঁধছি, দুটো খেয়ে নাও। অথবা পরে একদিন আসতে বলেছেন খেতে।
মাঝে মাঝেই দেরাদুন-চাল, ছাড়ানো-মুরগি, ব্রয়লার নয়; ব্রয়লার একদম ভালোবাসেন না শেফালি; ক্কচিৎ মাছ, আইস-বক্স-এ করে কোলাঘাটের ইলিশ, বছরের প্রথম এঁচড়, ফুলকপি, রাংকা বা গাড়োয়া বা লাতেহার থেকে বহুকষ্টে জোগাড় করা খাঁটি গাওয়া ঘি; বাজারের নয়। কসাই রসিদ আলিকে বলে অনেক যত্নর সঙ্গে জোগাড়-করা কচি-পাঁঠার মাংস; এইসব। শেফালি লাতেহারের পন্ডিতের দোকানের, কাছারির উলটোদিকের ‘কালাজামুন’ আর নিমকি খেতে খুব ভালোবাসেন। যখন-ই লাতেহারে যায় জিতেন তখন-ই নিয়ে আসে শেফালির জন্যে। পাগলা আর ছুটকির জন্যে নিয়ে আসে ‘কালাকাঁদ। আর ঘণ্টেদা খেতে ভালোবাসেন সাদা রসগোল্লা। বলেন, বাগবাজার-এর ছেলে বাঘবাজার-এ এসে নর্থ-ক্যালকাটার মিষ্টির স্বাদ-ই ভুলে গেছি।
তাই তাঁর জন্যে অবশ্যই আনে সাদা রসগোল্লা। যেদিন মিষ্টি আনে।
কত কথাই যে, মনে পড়ছে আজ জিতেনের। ঢালাই-করা কুলি-কামিনদের শোরগোল। কংক্রিট মিক্সচার মেশিনের ঘড়ঘড়, বিরক্তিকর সব আওয়াজ, ভ্যাপসা গরম এসবের কোনো কিছুই জিতেনকে শেফালির চিন্তা থেকে এক লহমার জন্যেও নড়াতে পারছে না। আজ কাজে আসার আদৌ ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ঢালাই-এর দিন। নিজে না-দাঁড়িয়ে থাকলেই সিমেন্টের ভাগ কম দেবে, কুলি-কামিন বেশি করে লেখাবে। নিজেরা যে, এমন চোরের জাত হয়ে উঠল তা ভেবেও লজ্জা করে।
বলে তো এসেছে শেফালিকে যে, আর কখনো যাবে না! কিন্তু যদি শেফালিও আর না ডাকেন? তবে? কী যে, করবে ও, ও নিজেই জানে না।
পাগলা আর ছুটকিও খুব-ই পছন্দ করে ওকে। জেনুইনলি। হাতে করে নানা জিনিস নিয়ে যায় বলেই শুধু নয়, ওর নিজের নিজস্বতার জন্যেই ভালোবাসে।
মানুষটিও ভালো, তাই ভালোবাসে।
আর যখন পড়াতে যাবে না ছুটকিকে, তখন ছুটকিকে কী বলবেন শেফালি? ‘জিতুকাকু আর কোনোদিন আসবে না বলেছেন।
তাই বলবেন?
ভাবছিল, জিতেন।
তার উত্তরে যদি ছুটকি জানতে চায় কেন? তবে?
রামখেলাওন পাঁড়ে ‘ভরর-র-র-র’ শব্দ করে এসে নামল। রেড়মাতেই থাকে।
‘ফাকসা’ আলাপ করবে এখন কিছুক্ষণ। ভ্যাগাবণ্ড মানুষদের যা কাজ। অনেক-ই জমি জমা আছে। ভোগতা, মুণ্ডা, দোসাদ, চামার এদের দিয়ে চাষ করায়। নিজে পায়ের ওপর পা তুলে বসে খায়। রাংকার দিকে ওর ভান্ডারও আছে। গরিব-হরিজন ও আদিবাসীদের ওপরে বিহারের এইসব ব্রাহ্মণ শ্রেণির অত্যাচার-ই আজকে নকশাল এবং ঝাড়খন্ডি আন্দোলনের এক প্রধান কারণ। ধৈর্য ধরে ধরে তারা ক্লান্ত হয়ে গেছে।
যে, যতই বড়োলোক হোক-না-কেন, যে-মানুষেরা বসে খায়, বাপ-ঠাকুরদার সঞ্চয়ে, বা তাঁদের জমি-জমার রোজগারে, বিনা-মেহনতে; সেই মানুষগুলোকে মনের গভীর থেকে মনে মনে ঘেন্না করে জিতেন। তাদের নিজেদের প্রয়োজন না থাকলেও কোনো মিশনে বা মঠে যোগ দিয়ে গরিবের বা আতাঁর বা কুষ্ঠরোগীদের সেবাও তো করতে পারে এই রামখেলাওনেরা! কী করে সুস্থদেহের কোনো মানুষ কিছুই না করে দিন কাটায়, দিন, মাস, বছর, যুগ তা ভাবতেও জিতেনের অবাক লাগে।
রামখেলাওন পাঁড়ে দ্রুত এগিয়ে আসছে। রাসকেল!
শেফালির মুখটা দ্রুত, অতিদ্রুত মুছে যাচ্ছে জিতেনের চোখের মণি থেকে।
দ্রুত রামখেলাওন পাঁড়ের কাড়য়া-তেলমাখা, ঘি-দুধে অতিপুষ্ট লাল গোলাকৃতি মুখটা ঢেকে দিচ্ছে সুন্দর গড়নের, সুন্দর বাঁধনের শেফালির ছবি, তাঁর মুখ, তাঁর চোখ; তাঁর শরীর মনের সব সৌন্দর্য; স্নিগ্ধতা।
হারামজাদা।
মনে মনে বলল, জিতেন।
সব ঠিকে না হ্যায়?
বলল, রামখেলাওন।
জিতেন, উত্তর না দিয়ে; মনোযোগ সহকারে ঢালাই দেখতে লাগল।
মনে মনে বলল, যা-না ইডিয়ট। ভাগ এখান থেকে।
আমার আজ মন ভালো নেই।
.
প্রচন্ড একটা আঁধি এল। মেঘ, ফুল, ঝরাপাতা আর ধুলোর এলোচুল উড়িয়ে দিগবিদিক ঢেকে। তবে হঠাৎ নয়। আকাশ সাজছিল সকাল থেকেই।
ঘণ্টেবাবু, শিরীষ, ঝাণ্ডু এবং তার দু-জন শাগরেদ মনোয়া-মিলনের ছোট্টস্টেশনের বারান্দাটাতে ঠাঁই নিয়েছিল আরও তিন-চারজন স্থানীয় আদিবাসী মানুষদের সঙ্গে। ঝড়ের দাপট এমন-ই যে, মনে হচ্ছিল ওদের-ই উড়িয়ে নেবে।
ঝড়টা হঠাৎ-ই ঘণ্টেবাবু ধুতির কাছা খুলে দিল। অনেক ঝড় দেখেছে শিরীষ এ-পর্যন্ত কিন্তু এইরকম কাছা-খোলানো’ মিচকে-ঝড় দেখেনি।
ঘণ্টেবাবুর সামনের দু-খানি দাঁত পড়ে গিয়েছিল। ডেঞ্চার একটা করা যেত না, তা নয়; তাঁর নিজের-ই এক বোনপো আছে দাঁতের ডাক্তার, রাঁচিতে, নাম ঘতু। সে বুদ্ধি দিয়েছে, বলেছে, মামা, সবগুলো একে একে পড়ুক তারপর সুন্দর করে বাঁধিয়ে দেব। ভুবনমোহিনী স্টাইলে।
সেটা কী বস্তু?
ঘণ্টেবাবু শুধিয়েছিলেন।
মানে, হাসলে, পৃথিবী মোহিত হয়ে যাবে। ‘ভুবনমোহিনী’ মানে বুঝলে-না?
একটা নতুন মেটেরিয়াল তৈরি হচ্ছে, প্লাস্টিকের-ই রকমফের আর কী! রংও একেবারে ম্যাচ করে দেব। যদি-না বুড়ো বয়সে মারামারি করে সেই ডেঞ্চার ভাঙো তবে যাবার দিনে, ওই দাঁত পরেই স্ট্রেট ডালটনগঞ্জের কোয়েলের ধারের চানোয়ারি ঘাটের ধারে নিয়ে যাবে তোমার বিড়ি-কোম্পানির লোকেরা, রাম নাম সত হায়’ করতে করতে। যাবার সময়ে অচেনা লোক বলবে, ইয়ং ম্যান, আনটাইমলি চলে গেল।
ঘতুটা রসিক আছে।
ভেবেছিলেন, ঘণ্টেবাবু।
কথাতে বলে ‘নরাণাং মাতুলক্রমঃ’। কিন্তু একমাত্র মামা হলেও ঘণ্টেবাবুকে ‘রসিক বড়ো’ এমন বদনাম এ-পর্যন্ত কেউই দিতে পারেনি। ঘতু রসিক হয়েছে, সম্ভবত ঘণ্টেবাবুর ভগ্নীপতি ফচকের-ই জন্যে।
রস-কষ পছন্দ নয় ঘণ্টেবাবুর। শিশুকাল থেকে নিজের জীবনে রস-রসিকতার কোনো সুযোগও আসেনি। তাই, কেউ রসিকতা করলে সচরাচর রেগে যান। তাঁকে নিয়ে করলে তো কথাই নেই। তবে ভাগনে বলেই, সেদিন ঘতুর ওপরে রাগতে পারেননি। কিন্তু একটু কৌশল, কষ্ট করে এই রসিক-ঝড় তাঁর কাছা খুলে দেওয়াতে ঝাণ্ডু লাফিয়ে উঠে দু-হাতে তালি দিয়ে, লে লটকা! দেখিয়ে শিষবাবু মামাবাবুকো! …’ বলেই অট্টহাস্য করে উঠতেই ঘণ্টেবাবু For a change নিজেও হাপিস-দাঁতে হেসে উঠলেন। এবং তাঁর হাসির সঙ্গে সঙ্গেই স্টেশনের জমির সমান্তরাল প্ল্যাটফর্মের ওপরে পোঁতা একটা চিলবিল গাছ মড়াৎ করে উপড়ে গেল। গেল তো গেল, পড়ল এসে প্রায় স্টেশনের-ই ছাদের ওপরে হুড়মুড় করে। ভাগ্যিস লাইনের ওপরেই পড়েনি! তাহলে, নীলোৎপলদের ঝামেলা হত!
ওরা সকলেই আতঙ্কে প্রায় বোবা হয়ে গিয়েছিল।
ঘণ্টেমামাই সর্বপ্রথমে কথা বললেন।
বললেন, এইজন্যেই তো হাসি না। আমি হাসলেই এমন অঘটন ঘটে।
এবারে শিরীষ হেসে উঠল, ঘণ্টেবাবুর কথাতে।
বলল, আমি হাসলে সুঘটন ঘটে, ফুল ফোটে, বনে গন্ধ ছোটে; বিয়ে হয়। তা আজকে আপনার ‘নীলোৎপল অ্যাণ্ড কোম্পানি’ আসছে তো, নাকি আজকেও ‘ফেরাইড-রাইস আর চিলি-চিকেনওয়া’ ফেলা যাবে?
ঘণ্টেমামা বললেন, আ-কতা কু-কতা বোললানি।
একটু থেমে বললেন, তবে আজকে আর বউদি ওই অপয়া মেনু রাখেননি। হলদে-রঙা মিষ্টি-পোলাও, কচি-পাঁঠার মাংস, আলুবখরার চাটনি আর লাহোরের কালাকাঁদ।
কথাগুলো ভালো শোনা গেল না। অর্ধেক কথা ঝড়ে উড়িয়ে নিল। আন্দাজে কথাগুলো ঝড়ের খপ্পর থেকে উদ্ধার করে কুড়িয়ে নিল শিরীষ।
কালাকাঁদের জন্যে লাতেহারে লোক পাঠিয়েছিলেন নাকি কাকিমা? নাকি, আপনিই এবারে বাসে এলেন? ট্রেন তো অতক্ষণ থামে না লাতেহার স্টেশানে। তা ছাড়া ভালো দোকানগুলোও তো স্টেশান থেকে অনেক দূরে।
আরে না, না। জিতু পাঠিয়েছিল গতকাল ডালটনগঞ্জে আমাদের বাড়িতে। ওকে কোন ‘মেট’ না ‘সর্দার’ স্পেশাল করে অর্ডার দিয়ে বানিয়ে এনে দিয়েছিল লাতেহার থেকে। আমিও তোমার মামিমার ও ছেলে-মেয়েদের জব্বর খপ্পর থেকে ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নিয়ে সটান স্টেশনে। ওরা তো প্রায়-ই খায় এটা-ওটা, জিতুর দয়াতে। তোমরা, নীলোৎপলরাও একদিন খাও।
জিতু কে? ঘটেমামা?
জিতু! আ! তোমাকে বলিনি বুজি আগে?
না তো! না!
অ! তোমার তো জানার কতাও নয়। দারুণ ছেলেটি। ডালটনগঞ্জের মদন ডাক্তারের নাম শুনেছো? ধন্বন্তরি ডাক্তার ছিলেন হে। খুব ভালো পসার ছেল। শহরেই তিন-তিনটে বাড়ি, নিজের গাড়ি ছেল, অস্টিন-সমারসেট। কুচকুচে কালো রঙের। অনেক জমি-জিরেত, পুকুর।
জিতু কে? শিরীষ আবার বলল।
আহা শোনোই না। তাড়া কীসের? আগে মদন ডাক্তারকে শেষ করি। তারপর জিতুতে আসছি। তবে, পয়সা রোজগার করেছিলেন যদিও অঢেল, কসাই ছিলেন না। প্রতিদিন দু ঘণ্টা বিনি-পয়সাতে রুগি দেখতেন। কত দূর-দূরান্ত থেকে পাহাড়-জঙ্গল থেকে আত্মীয় স্বজনের কাঁধে চেপে, ডুলিতে চেপে, চৌপাইয়ে শুয়ে যে-রুগিরা আসত! বাড়ির হাতা গোরুর-গাড়ি, মোষের-গাড়িতেও ভরে যেত। যদিও এদিকে পাহাড়ি এলাকা বলে গোরু-মোষের গাড়ির তেমন ব্যবহার নেই। মানে, খুব কম দেখা যায়, তবুও।
শিরীষ বিরক্ত হয়ে বলল, ঘণ্টেমামা! আমি আপনাকে শুধিয়েছিলাম জিতু কে?
ওহো! দেখেছ! একেই বলে ভীমরতি! কথার কোনোই খেই থাকে না আজকাল। আসলে এত বছরে, এত কথা, এত অভিজ্ঞতা ভেতরে জমে গেছে যে, বলতে গেলে হেড-টেল ঠিক থাকে না। তা ছাড়া, আমার কথা যে, শোনাই এমন একজন মানুষ পাই না বলেও কথা বলতে শুরু করলে, কী যে, বলতে চাইছিলাম তাই ভুলে যাই। হ্যাঁ। জিতু হচ্ছে আমাদের মদন ডাক্তারের একমাত্র ছেলে। শুধু ছেলেই নয়, একমাত্র সন্তান!
উনিও ডাক্তার?
অ্যাঁ? না, না, ও ডাক্তার নয়। ঠিকাদার। অগাধ সম্পত্তি। কিন্তু বসে খায় না।
ইঞ্জিনিয়ার?
না, তাও নয়। পাশ করা নয়। ওভারসিয়ারি’তে ডিপ্লোমা কি না, তাও জানি না। মফসসলে ঠিকাদারি করতে আবার ইঞ্জিনিয়ার হতে হয় নাকি? ওই তো আমাদের বজরঙ্গ পান্ডে, সরকারি ভেটিরিনারি ডিপার্টের ডাক্তার ছেল, ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে ঠিকাদারি করছে। হায়। হায়। লে রুপিয়া লে রুপিয়া! এখন নামি গভর্নমেন্ট কনট্রাক্টর। অফিসারদের সঙ্গে পুরো লাইন করে নিয়েছে। তার বড়োলোক শ্বশুরের বি-কম-ফেল ছেলেকে পার্টনারও করে নিয়েছে। কী রমরমা। জিপ, মারুতি, ভ্যান, এমনি মারুতি, সেটা আবার এয়ার-কণ্ডিশাণ্ড। শুনতে পাচ্ছি, এবারে একটা লাল-টুকটুকে মারুতি ওয়ান-থাউজ্যাণ্ড না, কী গাড়ি আছে না একটা, মোহন বিশ্বাসের ছেল একটা; সামনেটা নীচু, কুয়াশা-কুয়াশা হেডলাইট; সেই গাড়িও কিনবে।
একটু পরে স্টেশন মাস্টার নিজের থেকেই অপেক্ষমান জনগণকে কৃতার্থ করে; বাইরে এসে চিলবিল গাছটি পড়ে যাওয়ায় ক্ষয়-ক্ষতি অ্যাসেস করলেন।
তারপর দয়া করে জগদারের আইনি-ভাষায় ‘সুও-মুট’ ঘোষণা করলেন ‘সওয়া-ঘণ্টা লেট হ্যায় টিরেন।
আচ্ছা মাস্টারসাব, আপনি কি মনে করতে পারেন, গত তিনবছরে এই ট্রেন কোনদিনটিতে রাইট-টাইমে এসেছে?
ঘণ্টেবাবু ফ্রন্টাল অ্যাটাক করলেন স্টেশন মাস্টারকে।
নেহি। মগর ইসমে হামারা ক্যা কসুর? অ্যাভি ক্যা? আনেওয়ালি টাইমমে দেখিয়ে গা। সবহি টেরেন ঔর কিতনা জাদা লেট হোতি হ্যায়।
ঔর জাদা লেট? লেহ লটকা!
ঝাণ্ডু বলে উঠল, মালিকদের কথার মধ্যে কথা; প্রোটোকল ভেঙে।
মগর কাহে?
আঃ। ভাড়া বাড় গ্যায়া ই হপ্তেমেই দশ পার্সিন্ট? জাফফর শরিফ সাহাবকি শানদার অকলদারি সে।
ভাড়া বাড়ালে তো ট্রেনের সার্ভিস আরও ভালো হওয়াই উচিত।
ঘণ্টেবাবু বললেন।
থোড়ি হবে। বিনা-টিকিটের যাত্রী আরও বাড়বে। যেখানে-সেখানে চেনা টানবে তারা। ফাস্ট-ক্লাস এ.সি, এ.সি. স্লিপার, এমনি ফাস্ট-ক্লাসে দেশের শিক্ষিত’ ‘ভদ্রলোকেরা, বড়োলোকেরা’ কনডাক্টার-গার্ডকে ঘুস দিয়ে বিনি-পয়সায় ট্রাভেল করবে। রেলে যেমন, রামরাজত্ব এমন রাজত্বের কল্পনা কেউ-ই কোনোদিনও করতে পারেনি।
স্টেশন মাস্টার মইনুদ্দিন সাব চকিতে অ্যাবাউট-টার্ন করে বললেন, ইয়ে দেশ নেহি হ্যায়, জানোয়ারকি দেশ হো গ্যায়া। ঔর হোনেকাভি নেহি হ্যায় হিয়া কুছভি। বরবাদি পুরি হো গ্যায়ি। যিতনা আদমি অলরেডি প্যায়দা হো চুকে হ্যায় ইস দেশমে, রাম ইয়া খুদাহ কোই নেহি বাঁচানে শাকেগা ইস দেশকি।
স্টেশন মাস্টারের কথার অবিসংবাদী হিমেল সত্যটি হিমেল হাওয়ার চেয়ে, বেশি হিমেল এক ভাবনায় ছেয়ে দিল নিরুপায় ঘণ্টেবাবু আর শিরীষকে। নীরব অসহায় সাক্ষী যারা, এই দেশের স্বেচ্ছামৃত্যুর।
আঁধির সঙ্গে সঙ্গে, এখন জল পড়াও শুরু হয়েছে। বহুদিন থেকে তৃষিত মাটিতে, পাথরে, গাছে, পাতায় প্রায় পড়ে-যাওয়া ঘাসে ঘাসে প্রায় দেড় বছর পরে প্রথম বৃষ্টি পড়াতে পোড়া পোড়া গন্ধ উঠছে। বৃষ্টিটার জন্ম হতেই হাওয়াটার মৃত্যু হয়েছে। তাই সেই গন্ধ উড়ছে না। থম মেরে আছে। ঊর্ধ্বপানে উঠছে মাটি থেকে। এদিকে-ওদিকে চাড়িয়ে যেতে পারছে না হাওয়ার অভাবে।
শিরীষ ভাবছিল, তার ভালোবাসার দেশ থেকেও, তার জন্মভূমি থেকেও এখন সম্ভবত এমন-ইপোড়া-পোড়া গন্ধ বেরুচ্ছে। কর্তব্যহীনতা, লজ্জাহীনতা, বিবেকহীনতা, অসততা, ধূর্তামি, ধাষ্টামি এইসব-ই চিতায় তুলেছে দেশকে। পুড়ছে এই দেশ। শিরীষ যখন লিখবে, গদ্য; তখন এইসব নিয়েও লিখবে। সাহিত্য মানে অনেক গভীর ব্যাপার। সমসময়, সমকাল, স্বদেশ যে-সাহিত্যে অনুপস্থিত তা সাহিত্য-পদবাচ্যই নয় বোধ হয়।
জিতুর সঙ্গে তোমার কাকিমার অনেক-ই মিল আছে। বুয়ে।
চমকে উঠল শিরীষ। ঘণ্টেবাবু হঠাৎ প্রসঙ্গান্তরে চলে যাওয়ায়।
বলল, তাই বুঝি?
হ্যাঁ। দু-জনেই পড়াশুনোতে ভালো ছিলেন তো। আমি তো লাড্ডমার্কা। সাহিত্য, গান বাজনা ইত্যাদি ইত্যাদি নানা বিষয়ে নিয়ে ওদের আলোচনা হয়। সেসব অন্য একটা জগৎ। বুঝলে বায়া। সে-জগতের ভাষা একেবারেই অন্য। আমি শালা ঘণ্টে মিত্তির, অশিক্ষিত, সারাজীবন কেন্দুপাতার ফেরে চাতরা, হাজারিবাগ, চাঁদোয়া, সীমারিয়া, লাতেহার, বারোয়াড়ি, কুটকু, কুটর্মর জঙ্গলে জঙ্গলেই ঘুরে বেড়িয়ে কোনোক্রমে বিয়ে-করা বউ আর সন্তানদের ভরণ-পোষণের প্রায় ব্যর্থ-চেষ্টাতেই কাটিয়ে দিলাম। আর্ট-কালচার-সাহিত্য এসব করি, তার সময় কোতায় ছেল আমার। বলো?
বাঃ ঘণ্টেমামা। মামিমার কথা শুনে খুব-ই ভালো লাগল। আপনি তো আর আলাপ করিয়ে দিলেন না কোনোদিন, মামিমার হাতের রান্নাও খাওয়ালেন না। আমাকেও ভালো লাগতে পারত মামিমার, আলাপ হলে; কে বলতে পারত?
বলেই বলল, তবে একটা কথা বলব মামাবাবু। কেন্দুপাতার জঙ্গলে থেকে জীবিকানির্বাহ করার সঙ্গে কিন্তু আর্ট-কালচার-সাহিত্যের বা গান-বাজনার কোনোই ঝগড়া নেই।
ঝগড়া নেই? তুমিও তো দেখি জিতুর মতোই কথা বলো হে! যখন ঘাড়ে সংসার পড়বে, ঘাড়টি যখন ফিট করে মটকে যাবে, তখন দেকব কোতায় থাকে বড়ো বড়ো কথা!
আমি ঘাড় না-পেতে দিলে সংসার ঘাড়ে পড়বে কী করে মামাবাবু? সংসারের জন্যেই কি জীবন? নাকি জীবনের জন্যেই সংসার? জীবিকা? জীবিকা প্রত্যেক মানুষের-ই একটা-না একটা থাকেই। আপনি আপনার মালিকের বিড়ি-কোম্পানির বিড়ির জন্যে জঙ্গলে কেন্দুপাতা সংগ্রহে কাটালেন সারাজীবন কারণ এইটেই আপনার জীবিকা। আমি এই মনোয়া-মিলনের মতো ছোট্ট জঙ্গুলে অখ্যাত জায়গাতে চিরাঞ্জিলাল মাড়োয়ারির গতিতে খাতা লিখি, এও আমার জীবিকা। জিতুবাবু না, কার কথা বললেন একটু আগে, উনি প্রয়োজন না থাকলেও নিজেকে নিয়োজিত রাখার জন্য ঠিকাদারি করেন। সেটা ওঁর জীবিকা। সাইকেল রিকশাওয়ালা রিকশা চালায়, পানের দোকানি পান-বিড়ি বেচে। সব-ই পেটের জন্যে। জীবিকা হিসেবে, কোনো ‘জীবিকা’ই ছোটো বা বড়ো নয়। যে-ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে মস্ত কোম্পানির এম. ডি. কে অফিসে নিয়ে যায় সেই ড্রাইভারের জীবিকা, ম্যানেজিং ডিরেক্টরের জীবিকা অথবা, যে, সাহিত্যিক অর্থাগমের জন্যেই লেখেন তাঁর জীবিকা থেকে কোনো অংশেই হীন নয়। কোনো জীবিকাই তাচ্ছিল্যের নয়। কিন্তু একটা কথা আপনাকে বুঝিয়ে বলা দরকার মামাবাবু, জানি না জিতুবাবু কেমন করে কথাটা আপনাকে বলেছেন; বা আদৌ বলেছেন কি না, তা হল এই যে, জীবিকার ভারে চাপা পড়ে যাওয়াটা কিন্তু আদৌ মনুষ্যজনোচিত ব্যাপার নয়। জীবিকাটার প্রয়োজন; জীবনের-ই জন্যে। আর মানুষের জীবনের মানেই বা কী থাকে যদি, মানুষের জীবনে সাহিত্য-গান-বাজনা বা শিল্পকলার চর্চাই না থাকল! সেইসব গুণপনার জন্যে গুণগ্রাহীতাই যদি জেগে না থাকল? জানোয়ারের সঙ্গে মানুষের তফাতটা তো শুধু এটুকুই মামাবাবু! তারাও দিনেরাতে ঘুরে-ঘারে খাবার সংগ্রহ করে, তারাও মানুষের-ই মতো খায়, ঘুমায়, রমণ করে অন্য-লিঙ্গর সমগোত্রীয় প্রাণীকে, পুরুষ যেমন রমণীকে করে, তাদেরও শাবক হয়, আমাদের সন্তানের মতো। তাদেরও ভয় আছে প্রাণে। ভয় আছে কিন্তু ভক্তি’ নেই। কাম আছে কিন্তু ‘প্রেম’ নেই। পেট-ভরাবার খিদে আছে কিন্তু মন-ভরাবার খিদে নেই। তাই তো ওরা জানোয়ার। আর আমরা মানুষ! আপনি মামিমাকে এবারে নতুন চোখে দেখতে শুরু করুন, বুঝতে শুরু করুন; তাঁর আনন্দর জগতের পার্টনার হয়ে উঠুন, দেখবেন, কত আনন্দ পাবেন।
না শিরীষ।
এক গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন ঘণ্টেমামা।
আমার আর আনন্দ দিয়ে কাজ নেই। অনেক আনন্দ হয়েছে জীবনে। এখন মানে মানে, লুঙ্গিটা ছেড়ে একটি নতুন ধুতি পরে ডালটনগঞ্জের কোয়েলের ধারের চানোয়ারিঘাটে ছাই হয়ে যেতে পারলেই বেঁচে যাই এ-জন্মের মতো।
কী যে বলেন মামাবাবু! মাত্র ষাটবছর-ই তো বয়স হয়েছে আপনার। আপনার জীবনের এই তো শুরু। বিদেশে, সত্তর-আশিতে বিয়ে করে মানুষে।
না বাই। আর কোনো সাধ-আহ্লাদ রাখি না। শুধু একটাই চিন্তা। ছেলে-মেয়ে দুটো এখনও ছোটোই। বুড়োবয়েসে বিয়ে করেছিলাম তো!
সে কী! সারাজীবন খাটলেন-খুটলেন, জীবন তো এখন-ই সবে উপভোগ করতে শুরু করবেন। মাছ ধরতে ইচ্ছে হলে মাছ ধরবেন। তাস খেলতে ইচ্ছে করলে, তাস খেলবেন। গ্যাঁজাতে ইচ্ছে করলে, পরনিন্দা-পরচর্চা করে আনন্দ পেলে, জমিয়ে বসে তাই করবেন। যাতেই আপনার আনন্দ তাই করবেন। মোদ্দা কথা। এখন নিজের জন্যে বাঁচার সময় তো এই সবে শুরু হল। যৌবনের প্রথম দিক থেকে তো পরের জন্যেই বেঁচে এসেছেন। বাবা মাকে দেখা, বিয়ের পর থেকে মামিমাকে দেখা, ছেলে-মেয়ে হওয়ার পর তাদের দেখা, তাদের ভবিষ্যৎ-চিন্তা, কখন, কী করে, তারা নিজের পায়ে দাঁড়াবে? আর পায়ে একবার দাঁড়ানো মাত্রই কী করে এবং কখন বাবার বুকে জোড়া-পায়ে লাথি মারবে তার অপেক্ষা করা। এবারে ছুটি দিন। অনেক-ই করেছেন এই কৃতঘ্ন সংসারের জন্যে। আর কেন? জগামামা বলেন, টং-টার’।
মানে?
মানে, সং-সার; সংসার।
শিরীষের মনে হল, ওর এইসব কথাতে ঘণ্টেমামার দুটি চোখ যেন হঠাৎ-ই ছলছল করে উঠল। ঘণ্টেমামা বললেন, আচে নাকি শিরীষ?
কী মামাবাবু?
নস্যি। দাও তো দেখি একটু বায়া! অধিটার পরে এই বৃষ্টি। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগচে। তোমার ঘড়িটা দ্যাখো তো, আর কত দেরি ট্রেন আসতে।
আমার তো হাত-ঘড়ি নেই মামাবাবু।
নেই? আশ্চর্য।
কেন? আশ্চর্য কেন? প্রত্যেকের-ই যে, ঘড়ি থাকতেই হবে তার কী মানে আছে? আমাদের দেশের ক-জন মানুষের হাতঘড়ি বা অন্য ঘড়ি আছে? সূর্যের সঙ্গে জীবন বাঁধা। বাবার একটা ছিল। পেয়েছিলাম উত্তরাধিকারসূত্রে, খুব-ই ভালো ঘড়ি, ওমেগা’। কিন্তু মায়ের অসুখের সময়ে মুঙ্গালালের দোকানে বন্ধক রেখে যখন, টাকা নিলাম তখন-ই সেটা যে চিরদিনের-ই মতো বেহাত হয়ে গেল তা বুঝেছিলাম।
বললেন, আমি যদি লটারি জিতি কোনোদিন নিজের জন্যে একটা ‘টাইটান’ ঘড়ি কিনব আর তোমাকেও কিনে দেব একটা।
লটারি, আমি-আপনি কোনোদিনও জিতব না মামাবাবু। বিনা-মেহনতে এক পয়সা কামাই এরও কপাল করে আসিনি আমরা।
হাসলেন, ঘণ্টেমামা।
তোমার সঙ্গে আমার অনেক-ই মিল দেকচি যে, হে! আমিও পেয়েছিলাম। …ঘড়ি একটা। তবে ওমেগা নয়, সস্তাতম মডেলের এইচ. এম. টি.। বিয়েতে আমার গরিব শ্বশুরমশাই গরিব জামাইকে দিয়েছিলেন। ‘জওয়ান’ নাম ছিল সম্ভবত। কালো ডায়ালের। রাতেই ঝকমক করত সবুজ রেডিয়াম। তা, সেটি আমাকেও বেচতে হয়েছিল আমার মেয়ে হওয়ার সময়ে। এমন-ই আটকে গেছিলাম যে, কী বলব! ইঞ্জেকশান কিনেছিলাম তোমার মামিমার জন্যে। তারপরে
কেনা হয়নি আর। নুন আনতে পান্তা ফুরোয় বাবা তার ঘড়ি কিনব কোন উদবৃত্ত দিয়ে? বলো? তা ছাড়া, সত্যিই কি খুব একটা দরকার আছে? আমার তো কোনোই অসুবিধে হয় না।
ঠিক-ই বলেছেন মামাবাবু। আমারও একটুও অসুবিধে হয় না কিন্তু যা-কিছুকেই আমরা এখন ‘প্রয়োজন বলে মনে করতে শুরু করেছি, যেমন ফ্রিজ, টি ভি, কালার টি ভি, ভি সি আর, গাড়ি, নিজস্ব বাড়ি এসবেরও কি সত্যিই খুবই প্রয়োজন? আমার তো মনে হয় যে, নেই। এসব না-থাকলেও দিব্যি চলে যায়। অথচ এইসব-ই স্ব-মালিকানায় আনার জন্যে প্রতিমুহূর্তেই চারপাশের কত অগণ্য মানুষ যে, অমানুষ হয়ে যাচ্ছে, চোখের সামনে তা দেখে, তা বুঝে; বড়ো মন খারাপ হয়ে যায়। এই ঘুসঘাস জালিয়াতি-জুয়াচুরি, মিথ্যাচার, অত্যাচার… শুধু এইসবের জন্যে? ভাবা যায় না।
শিরীষের প্লাস্টিকের নস্যির কৌটো থেকে বড়ো করে একটিপ নস্যি নিয়ে খুব ভালো করে রুমালে নাক ঝেড়ে নিয়ে, লাল হয়ে-যাওয়া জল-ভরা চোখে শিরীষের দিকে চেয়ে ঘণ্টেবাবু বললেন, আসলে ব্যাপারটা কী জানো শিরীষ। প্রত্যেকেই আজকাল ওপরের দিকেই তাকায়। আরে, আমি তোমার মামিমাকে সব সময়েই বলি, দ্যাকো, ওপরের দিকে চাইবার কি শেষ আছে কোনো? ওপর তো অসীম। কত উঁচু, তার খোঁজ কে রাকে? তার চে নাববার দিকে চাও, নিজের বাকুল-এর মধ্যে থাকো, দেখবে, সুখ গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। অন্যের যা-আচে তা আমার নেই কেন? তা ভেবে কাঁদতে বসলে, সে-কান্না জীবনেও থামবে না। তার চেয়ে ‘আমার যা আচে অন্যের তাও যে, নেই, সেই কতাটি মনে করলেই মন শান্তিতে কানায় কানায় ভরে যাবে। বলো বাবা! সুখ-শান্তি কি আর ধন-সম্পত্তি দিয়ে হয়? সে তো মনের-ই ব্যাপার।
তারপর নাকটা একবার টেনে নিয়ে বললেন, তবে হ্যাঁ। একটা কথা বলব, তোমার মামিমার কিন্তু কোনো পার্থিব জিনিসের প্রতিই বিন্দুমাত্র লোব নেই। অন্য চরিত্রের মেয়েচেলে হলে, আমাকে চোর-ডাকাত বানিয়ে ছাড়ত। ভোগবিলাসী ওরাইফেরা এদেশে যত, চোর ডাকাতের সৃষ্টি করেচে অমনটি বোধ হয় আর কোথাওই হয়নি।
বোধ হয় ঠিক-ই বলছেন আপনি।
চলো শিরীষ, পা যে, ধরে গেল দাঁইড়ে দাঁইড়ে। ওই চায়ের দোকানের সামনের বেঞ্চে চলো, গিয়ে বসি। ভিজে গেছে যদিও বেঞ্চিটা, তবু। এককাপ করে চা খাওয়া হোক। আমিই খাওয়াচ্ছি।
চলুন।
বলল শিরীষ।
চায়ের দোকানের দিকে যেতে যেতে ঘণ্টেমামা বললেন, তোমার ফিলসপি অফ লাইপ আর আমার ফিলসপি অফ লাইপের মধ্যে দেখছি বেশ মিল আছে শিরীষ। চমৎকার ছেলে তুমি। আমি বুঝি না, হাতের কাছে তুমি থাকতে, বউদি হিল্লি-দিল্লি-কলকাতা কেন করে বেড়াচ্ছেন ঝিঁঝির পাত্রের খোঁজে? যাকগে। আমার নিজের বিবেক’-এর প্রতি একটা কর্তব্য ছিল। করে দিলাম। সম্বন্ধ হলেই তো আর বিয়ে হয় না। কী বলে?
হ্যাঁ। তা তো ঠিক-ই। তবে আপনি কী যে, বলেন! কোথায় নীলোৎপলবাবু আর কোথায় আমি! শিবের সঙ্গে বাঁদরের তুলনা? তা ছাড়া, ঝিঁঝি আমার ছেলেবেলার বন্ধু। আমরা দু জনেই দু-জনকে পছন্দ করলেও স্ত্রী-পুরুষের মধ্যের সব সম্পর্কর পরিণতি কি বিয়েই হয়ে ওঠে মামাবাবু? না, হওয়াটা উচিত?
তা তো নয়ই! অবশ্যই নয়! তোমার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণই একমত। তুমি চেলেটি খুব-ই ইন্টেলিজেন্ট হে শিরীষ!
শিরীষ হেসে ফেলল, ঘণ্টেমামার এই হঠাৎ-দেওয়া কমপ্লিমেন্টে।
অপ্রস্তুত হয়ে বলল, থ্যাঙ্ক-ইউ।
.
কইরে, পাগলা! জানলা-দরজাগুলো সব বন্ধ কর তাড়াতাড়ি। কী আঁধিই উঠল রে! ছুটকি! করছিসটা কী? দাদাকে সাহায্য কর একটু। দৌড়ো। দৌড়ো। দুধ বসানো আছে আমার কড়াইয়ে, প্রায় ফুটে এসেছে। আমি উঠতে পারছি না।
ছুটকি বলল, আঁধিটা উঠেই মরে গেল। বৃষ্টি নামল মা! কী মজা! কী বড়ো বড়ো ফোঁটা, দেখ, দাদা দেখ। আঁধি মরে গেল। বৃষ্টি নামল, মা! বৃষ্টি!
বৃষ্টি? আঃ। তবু দরজা-জানলাগুলো ভালো করে বন্ধ কর। বৃষ্টি থামলেই খুলিস।
আমি বৃষ্টিতে ভিজব মা! গতবছর তো বৃষ্টি হয়ইনি!
ঢের হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে আর দরকার নেই। আজ বাদে কাল পরীক্ষায় বৃষ্টিতে ভিজবেন মেয়ে!
ছুটকি, পাগলাকে দরজা-জানালা বন্ধ করতে সাহায্য করার পরে রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়াল কপাটে হেলান দিয়ে, বাঁ-পায়ের হাঁটুর কাছে ডান পায়ের পাতাটি তুলে। এটাই ওর নিজস্ব ভঙ্গি দাঁড়াবার। যখন বাইরের কেউ না থাকে।
ও কি? আবারও অসভ্যতা। বলেছি না, বদভ্যেস হয়ে যাবে। অমন করে কখনোই দাঁড়াবে না। বড়ো হচ্ছ না তুমি ছুটকি? তোমার এখন যা-বয়েস তার ঠিক দু-বছর পরে আমার বিয়ে হয়েছিল, জান? অতটুকু মেয়ে। কোনোদিনও কলকাতার বাইরে না-যাওয়া মেয়ে। একা এই ‘কেকরা-মেকরা’ ভাষা বলা মানুষদের মধ্যে এসে যে, কী বিপদেই পড়েছিলাম! তবে এখানে আসার পথের দৃশ্যর কথা কখনো ভুলব না কোনোদিনই। সব দুঃখ ভুলে গেছিলাম সেই দৃশ্যে। কলকাতায় যেমন, অনেক কিছুই আছে, আবার নেইও অনেক কিছু। কুড়ি বছর বিয়ে হয়েছে অথচ, সেই যে, এসেছি তারপর ডালটনগঞ্জ থেকে একদিনের জন্যেও বাইরে বেরোইনি আর। মানুষের মা-বাবা থাকে, সচ্ছল দিদি-দাদা থাকে, ননদ নন্দাই, ভাসুর-জা। আদর করে যেতে-বলার একজনও মানুষ আমার কেউ-ই নেই। যাঁরা আছেন, তোর বাবার আর আমার তরফেও তাঁদের অবস্থাও তথৈবচ। তাঁরা যে, সপরিবারে টিকিট কেটে এখানেও চলে আসবেন বেড়াতে, তেমন সামর্থ্যও তাঁদের নেই, যেমন আমরাও পারি না কোনো জায়গাতে যেতে। কেউ এলেও এই একঘেয়েমি হয়তো সামান্য দিনের জন্যে হলেও কাটত!
কোন পথের দৃশ্যর কথা বলছিলে?
আরে কলকাতা থেকে ডালটনগঞ্জে আসার দৃশ্যর কথা। তখন তো সকালে-বিকেলে দু টিমাত্র ট্রেন ছিল। নাম ছিল চৌপান এক্সপ্রেস। হাওড়া থেকে বাড়কাকানার জন্যে, একটি বগি জুড়ে দিত দুন-এক্সপ্রেসে। গভীর রাতে সেই বগিটি দুন এক্সপ্রেস ‘গোমো স্টেশনে ফেলে রেখে চলে যেত দেরাদুন-এর দিকে।
দেরাদুন কোথায় মা?
যতদূর জানি, দিল্লি থেকে আরও আগে। তবে জিতুকাকুদের বাড়িতে ঠাকুমা যে, তোদের একদিন পোলাও খাইয়েছিলেন? সেই পোলাও বেঁধেছিলেন দেরাদুন-রাইস-এ। কেমন গন্ধ ছিল চালটাতে? কেন? জিতু তো আমাদেরও…
উঃ দারুণ।
পাগলা ঘর থেকে চেঁচিয়ে বোনকে শাসন করে বলল, দেরাদুন-রাইসের গল্প না করে, পড়া করো। আজ বাদে কাল পরীক্ষা। জিতুকাকু আজ এলেন না বলে, কি পড়তে হবে না তোমার?
তুই নিজের চরকাতে তেল দে। আমার চিন্তা তোর করতে হবে না। তোর চেয়েও ভালো রেজাল্ট যদি না করি তো দেখিস। নাকে খৎ দেব।
ওই নাকে আর খৎ-টৎ দিতে যাস না। একে তো, নাক না তো, মুগের ডালের ছোট্টবড়ি। ঘষে খয়ে গেলেই চিত্তির। লোকে ভাববে ডালটনগঞ্জ জঙ্গুলে জায়গা, ভাল্লুকেই বুঝি খুবলে নিয়েছে নাক!
চুপ কর তুই। নিজের পড়া কর।
বলেই বলল, তারপর বললো মা।
ওই লাইন দিয়েই বিহারের ও বাংলার যত কয়লা সব যেত তখন উত্তর ভারতে। চৌপান হয়ে। তাই ওই ট্রেনটির নাম ছিল চৌপান এক্সপ্রেস। সারাপথে খাবার-দাবার কিছুই পাওয়া যেত না। সকালে চা জলখাবার খেতে হত বাড়কাকানাতে এসে। সেখানে আটটা, সাড়ে আটটা নাগাদ আবার সেই ‘বগি’ কেটে রাখত গোমোতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
একটু চুপ করে থেকে বললেন, কিন্তু ভোর হতে-না-হতেই দু-দিকে যে কী সুন্দর দৃশ্য। আমার বিয়ে হয়েছিল ফেব্রুয়ারির শেষে উনিশে। পুরো মার্চ মাসে দু-তরফের আত্মীয়স্বজনদের বাড়ি নেমন্তন্ন খেয়েই বেড়ালাম। ওইভাবেই তখন নতুন বর-বউ-এর সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনদের আলাপ-পরিচয় হত ঘনিষ্ঠভাবে। জানি না, আজকাল মানুষের ব্যস্ততা অথবা সংগতির অভাবের কারণে কলকাতার এই রেওয়াজ উঠে গেছে কি না! তা, তোর বাবার জয়েন করার তারিখ ছিল সাতাশে এপ্রিল। এখনও মনে আছে তারিখটা।
তারপর? বলো।
ঘুম ভেঙে উঠেই সেকেণ্ড ক্লাস কামরায় জানলার পাশের সিটে বসে যেন, স্বর্গরাজ্যে ঢুকলাম বলে মনে হল। তোর বাবাকে বললাম, আপনি এতসুন্দর জায়গাতে থাকেন?
তোর বাবার রসকষ চিরদিন-ই কম। বললেন, এই পান্ডব-বর্জিত জঙ্গলের মধ্যে সুন্দরটা তুমি কী দেখলে! আশ্চর্য তো!
তুমি বাবাকে ‘আপনি’ বলতে নাকি?
প্রথমে প্রায় ছ-মাস তাই বলতাম। আমার চেয়ে উনি বয়সে এতই বড়ো ছিলেন যে, তুমি’ বলতে ভয় করত। চেহারাও তো তখন এমন ছিল না। একেবারে বাঘের-ই মতো ছিল। বিচ্ছিরি গন্ধের বিড়ি খেতেন। বড়োজামাইবাবু বাবাকে বলেছিলেনঃ “বাবা, আপনি কিন্তু শেফুকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিলেন!
তাতে দাদু কী বলেছিলেন?
বলেছিলেন, তোমারও তো মেয়ে হয়েছে। তুমিও একদিন বিয়ে দেবে তাকে। যদি কোনো বাবা তাঁর মেয়েকে হাত-পা বেঁধে কখনো জলে ফেলেন, তা যে, তিনি কত অসহায় হয়েই ফেলেন; তা যেন, তোমাকে কখনো জানতে না হয় কামু।
বড়োমেসোর নাম কি কামু নাকি?
নাম ছিল কামিনীবল্লভ। বাবা ডাকতেন কামু বলে। বলতেন, কী বিচ্ছির নাম। কামুদের পরিবারে কোনো শিক্ষা নেই। অবশ্য আমাকে যেখানে পাঠালেন তাঁদের-ই বা কী শিক্ষা। তবে তোর বাবা মানুষ খুব-ই ভালো। আমার শ্বশুর-শাশুড়িও খুব ভালো মানুষ ছিলেন বলে শুনেছি সকলের-ই কাছে। আজকাল অনেক-ই শিক্ষিত, যশস্বী সব মানুষ দেখতে পাই যাঁদের ‘অমানুষ’ বলেই মনে হয়।
বলেই বললেন, বৃষ্টি থামলে দরজা-জানলা সব খুলে দিবি দু-জনে মিলে আমায় যেন, বলতে না হয়। যা! এবারে পড়তে বোস গিয়ে। আর গল্প নয়।
রাতে কী রাঁধছ মা?
কী আর! এই দেরাদুন-চালের পোলাও, কচি-মাংসের কালিয়া, গলদা-চিংড়ির মালাইকারি। আর খাবি কী বল?
বলেই, হেসে ফেললেন। হয়তো কান্নাও মিশে ছিল সেই হাসিতে। সেটা দেখা গেল না, কিন্তু হাসিটাকে তা, একটু আড়াল করল মাত্র।
ছুটকি বলল, বাবা তো মনোয়া-মিলনে। বাবা তো খিচুড়ি একদম-ই পছন্দ করে না। আজ প্রথম বৃষ্টি হল, যদিও বর্ষার বৃষ্টি নয়; তবু, খিচুড়ি করবে, মা?
মুগের ডাল যে, নেই।
না থাকলে আর কী করবে? মুসুরির ডালের-ই করো।
মুসুরির ডালও নেই। অড়হর আর খেসারির ডাল আছে শুধু। ওইসব ডালে কি খিচুড়ি হয়?
হবে না কেন? তুমি রাঁধলে আর আমরা ভালোবেসে খেলেই হয়। ওই দু-ডালের যে, ডাল দিয়ে তোমার খুশি, করো।
পাগলাও যে, তোর বাবার-ই মতো! খিচুড়ি দু-চোখে দেখতে পারে না। অথচ কেন যে, তা কে জানে! তোর বাবার না-হয় জঙ্গলে খিচুড়ি খেয়ে খেয়ে মুখে অরুচি ধরে গেছে। পাগলার কী?
হয়তো লাইক ফাদার লাইক সান’ বলে।
বাঃ। বেশ তো কথাটা। আগে শুনিনি। স্কুলে শিখেছিস?
হ্যাঁ। তাহলে তো হতই। আমাদের স্কুলে আবার এসব শেখায় নাকি?
তবে?
জিতুকাকুই বলেছিল একদিন। আচ্ছা মা! জিতুকাকু আজ এল না কেন? আজ যে, বৃহস্পতিবার তা কি ভুলে গেল? কই এমন তো কখনো হয় না।
শেফালি প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার চেষ্টা করে বললেন, তা আমি কী করে বলব। এলে, খিচুড়িও খেয়ে যেতে পারত। খিচুড়ি খেতে খুব ভালোবাসে জিতুকাকু।
তুই কী করে জানলি?
আমি জানি। আমার সঙ্গে আজ দেখাও হল একঝলক।
কোথায়? প্রশ্নটা করেই, প্রশ্নর মধ্যে জিজ্ঞাসার আকুলতাটা বড়োবেশি তীব্র হয়ে গেল যে, তা বুঝতে পেরেই মেয়ের কাছে লজ্জিত হলেন শেফালি।
স্কুল থেকেই তো আসছিলাম আমি। আমাকে যেই দেখল, অমনি স্কুটারটা দাঁড় করিয়ে বলল, ছুটকি, ভালো করে পড়াশুনো কোরো। পরীক্ষা কিন্তু এসে গেছে তোমার। আজকে একটু অসুবিধে হয়ে গেছে। আসলে, এবার থেকে তুমি যদি, তোমার সুবিধেমতো আমাদের বাড়িতে আসো পড়তে তাহলে আমার সুবিধে হয়। মায়ের শরীরটা তো ভালো যাচ্ছে না। এমনিতে তো সারাদিন আমি বাইরে বাইরেই থাকি নিজের কাজে। ডালটনগঞ্জের বাইরেও যাই। তাই বাড়িতে থাকার সময় যতটুকু পাই ততটুকু বাড়িতেই থাকা উচিত। মায়ের হঠাৎ কিছু হলে? শেষ ই.সি.জি. রিপোর্টটা খুব ভালো বেরোয়নি। আর বাড়িতে তো কাজের লোকজন ছাড়া দ্বিতীয় প্রাণীও নেই।
তাই?
শেফালি বললেন।
তারপর বললেন, ও তো তোমাকে পড়ায় ভালোবেসেই। কোনোরকম জোর তো আমাদের নেই তোর জিতুকাকুর ওপরে। না আসতে পারলে আর কী করা যাবে?
শেফালির দু-চোখে দু-চোখ রেখে ছুটকি বলল, তুমি কিছু জান না? মানে, তোমাকে কিছু বলেনি জিতুকাকু? কেন আসবে না?
না তো। প্রয়োজনের চেয়ে অনেক-ই বেশি জোরের সঙ্গে বললেন শেফালি।
ওঁদের বাড়ি নানা লোকজন আসে সবসময়ে। তা ছাড়া দিদা ভীষণ জোরে টিভি চালান। বেশি বেশি। এলে কী হয়, আমাদের বাড়ি? আসবে না কেন? তা ছাড়া, আমাদের কি কোনোই দাবি নেই মা? আমরা যে, ওঁকে ভালোবাসি। তুমি…
জিতুকাকু কি তোর মাইনে-করা মাস্টারমশাই?
তাড়াতাড়ি কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে, বললেন, শেফালি। আমরা তো কিছুই দিই না ওকে, ও যা দেয় তার বদলে। আমাদের সাধ্য কতটুকু? টাকাপয়সার কথা বলছি না, অন্যকিছুর কথা বলছি, উপহার-টুপহার উলটে ওই তো, কত কী দিচ্ছে সবসময়, আমাদের সবাইকেই। আমাদের কী জোর আছে বল ওর ওপরে? ইচ্ছে করলে আসবে; ইচ্ছে না করলে আসবে না।
ছুটকি চুপ করে রইল কিছুক্ষণ।
তারপরই হঠাৎ বলল, ভালোবাসাটার’ বুঝি কিছু দাম নেই?
মুখ নীচু করে রইলেন শেফালি। জবাব দিলেন না কোনো।
ছুটকি বলল, আচ্ছা মা, বাবা কি জিতুকাকুকে কিছু বলেছে?
কীসের কিছু?
না, বিশেষ কিছু না, বাবা…মানে, বাবা তো হঠাৎ-হঠাৎ রেগে যায়…
তোমার বাবা রাগ করতে পারেন এমন কোনো কিছু তো জিতুকাকু করেননি। তবে হ্যাঁ, আমার জন্যে, তোমাদের জন্যে এতকিছু যে, জিতু কিনে আনে, দেয়; তা তো তোমার বাবার মনে, যেহেতু সামর্থ্য কম; একধরনের কষ্টের জন্ম দিতেও পারে। তোমার বাবার দিকটাও বোঝার চেষ্টা করো একটু। জানি না, উনি কিছু বলেছেন কি না! তবে আমার সামনে তো বলেননি।
তোমার সঙ্গে কিছু কি হয়েছে? মা? জিতুকাকুর?
শেফালি পাকা অভিনেত্রীর মত দুধের কড়াতে ডোবানো হাতা থেকে তর্জনীটি তুলে নিজের গালে চুঁইয়ে বললেন, পাগল। আমার সঙ্গে? কী হতে পারে? কী হতে পারে বলে, ভাবছিস তুই! আশ্চর্য!’
নারীমাত্রই জন্মসূত্রে পাকা অভিনেত্রী। ফাইভ ক্লাসে-পড়া ছুটকি তার মাকে এক গোল দিয়ে বলল, সত্যিই তো। তোমার সঙ্গে কীই বা হতে পারে। আমার-ই মাথা খারাপ! তবে জিতুকাকু না এলে ভালো লাগে না!
হঠাৎ-ই প্রমাদ গোনলেন শেফালি। ছুটকির শরীরেরও মনের গড়ন-বাঁধন একেবারেই শেফালির-ইমতো। ইতিমধ্যেই পাড়া-বেপাড়ার ছেলেরা তার সৌন্দর্যর জন্যে তাকে বিরক্ত করতে আরম্ভ করেছে। তবে প্রখর বুদ্ধিমতী এবং নিজের পড়াশুনো, কেরিয়ার সম্বন্ধে, স্বাবলম্বনের স্বপ্ন সম্বন্ধে যথেষ্ট সচেতন বলেই ওইসব স্বাভাবিক বিপদ-আপদ সে, সহজেই কাটিয়ে দেয়। ছুটকি জল-পাওয়া বোগোনভিলিয়ার মতো যেভাবে বেড়ে উঠেছে দৈর্ঘ্যে, সৌন্দর্যে, যৌবনে এবং মনের গভীরতাতেও, তাতে জিতুকে নিয়ে অন্য বিপদে না পড়তে হয় শেফালিকে। তাঁর সৌন্দর্যের কারণে, এবং তা দারিদ্র্যলালিত বলেই অনেক-ই ধরনের বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন এপর্যন্ত তিনি নিজে, যেসব বিপদের কথা মেয়ে-মাত্রই জানে। এবং আজও হন। শুধুমাত্র নিজের প্রখর বুদ্ধি দিয়েই তা থেকে পার পেয়ে এসেছেন। ঘণ্টেবাবুর এসব ব্যাপারে কোনোরকম বুদ্ধি-সুদ্ধিই নেই। অত্যন্তই ভোলে-ভালা, কাছাখোলা মানুষ তিনি। তবে মানুষটি ভালো। তাঁর যা-অভিজ্ঞতা তাতে উনি জানেন যে, পুরুষমানুষদের সম্বন্ধে ধারণাটা ওঁর আদৌ উচ্চ নয়। হয়তো জিতু একমাত্র ব্যতিক্রম। তাঁর চোখের ভাষা না পড়তে পারার মতো বোকা তাঁর নিজের মেয়ে ছুটকি আদৌ নয়।
শেফালি বললেন, যাও এবার পড়ো গিয়ে। দেখি, তোমার খিচুড়ির কী করতে পারি।
বৃষ্টিটা থেমে গেছে একটু আগে। স্নিগ্ধ হয়েছে শহর, কৃতজ্ঞ হয়েছে; এই বৃষ্টির কাছে।
ডালটনগঞ্জ শহরের মধ্যেও অনেক গাছগাছালি এখনও আছে। পথের পাশে মহুয়া, বাড়ির হাতাতে আম-কাঁঠাল, নানা সুগন্ধি ফুলের গাছ বা ঝোঁপ-ঝাড়। বৃষ্টি হওয়াতে কাঁকুড়ে লাল মাটি থেকেও ঝাঁঝালো একধরনের গন্ধ উঠছে। যেমন ঝাঁঝ–ছুটকির বয়সি মেয়েদের যৌবন থেকে ওঠে। কাঁঠালের মুচি ও আমের বোলের গন্ধ, শালফুলের মঞ্জরির গন্ধ, মহুয়ার গন্ধের সঙ্গে মিশে ভেসে আসছে ভেজা হাওয়ায়।
রোমান্টিক শেফালি বছরের এই সময়টাতে আর বর্ষাতে পাগল-পাগল বোধ করেন। গত কুড়িবছর ধরে বছরের এই দুই-সময়ে যে, কত কষ্টই পেয়েছেন তা উনিই জানেন! ঘণ্টেবাবু তাঁকে ঠাট্টা করে ডাকেন গন্ধগোকুল। বলেন, নাকে কিছু গন্ধও পাও তুমি বটে। পুলিশে জানলে, গন্ধ-শোঁকা কুকুরের পার্টনার হিসেবে তোমাকে চাকরিও দিয়ে দিতে পারে।
হেসেছেন শেফালি, ঘণ্টেবাবুর কথা শুনে।
যে-মানুষটা চিরদিন জঙ্গলে-জঙ্গলে কাটালেন তাঁকেই বিধাতা দেখার চোখ বা ঘ্রাণের নাক বা শোনার কান দিলেন না! ওঁর স্বামীর বড়োই মন্দভাগ্য! এ ছাড়া আর কীই বা বলতে হয়; ভাবেন, শেফালি।
খিচুড়ি চাপিয়ে দিয়েছেন অনেকক্ষণ। খেসারির ডালের খিচুড়ি ব্যাপারটা নিজের কান গ্রহণ করল না তাই আর এক অভাবনীয় খাদ্যবস্তু অড়হড়ডালের খিচুড়িই করছেন। আনাজ বলতে, আলু ছাড়া আর কিছুই নেই। আলুই ভাজবেন কড়া করে। আর শুকনো লঙ্কা ভাজা। কাল পাগলাকে একবার বাজারে পাঠাতেই হবে। কবে যে, কর্তা ফিরবেন ‘মনোয়া-মিলন’ থেকে তার ঠিক নেই কোনোই। মালিকেরা যতদিন থাকবেন, ততদিন-ই সেখানে থাকতে হবে তাঁর। এদিকে, দিয়ে গেছেন মাত্র পঁচিশটা টাকা। তা ছাড়া, ভাঁড়ারে যা আছে তা আছে।
শেফালিই জানেন, ভাঁড়ারে মা অন্নপূর্ণা! এ-নিয়ে বেশি ভেবে সময় এবং নিজের মনের প্রশান্তি ক্ষুণ্ণ করতে চান না উনি! যা-দিনকাল পড়েছে, যার স্বামীর-ই যেমন রোজগার থাকুক-না-কেন, প্রত্যেক গৃহিণীর পক্ষেই সংসার চালানো বড়োই দুরূহ হয়ে উঠেছে। ঘণ্টেবাবুর চেয়ে কম রোজগারও তো আছে বহুমানুষের! বোঝেন সব-ই। তবু, মাঝে মাঝে ছেলে-মেয়ে দুটোর মুখের দিকে চেয়ে বড়োই কষ্ট পান।
ভারি সুন্দর হয়ে উঠেছে আবহাওয়া এখন। খিচুড়ি ফোঁটার গন্ধের সঙ্গে বাইরের মিশ্র গন্ধ মাখামাখি হয়ে গেছে। হঠাৎ-ই বড়ো স্নিগ্ধ হয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশ।
বঁটিটা নিয়ে আলু কাটতে বসলেন শেফালি। রান্নাঘরের বাইরে, বারান্দাতে। মেঘ কেটে গিয়ে চাঁদ উঠেছে এখন। ঝকঝক করছে যেন, মলিন ডালটনগঞ্জ শহর।
দরজার শিকলে কে যেন, নাড়া দিল। হাওয়াটা মাতামাতি করছিল বাইরে। গাছপালার ডাল আন্দোলিত হচ্ছিল। তবে হয়তো বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরে সব জানালা দরজা এখনও খোলেনি ছেলে-মেয়েরা। ওরা তো শুনতে পেল না। কিন্তু শেফালির মনের দরজা খোলাই ছিল অনুক্ষণ। শেফালি কোনোদিনও বাইরের দরজা নিজে গিয়ে খোলেন না, বাড়িতে স্বামী অথবা ছেলে-মেয়েরা থাকলে; কিন্তু আজ ওর হৃৎপিন্ডে হঠাৎ দামামা বাজল। হঠাৎ-ই মনে হল, শিকলে নাড়া পড়ার শব্দ শোনার জন্যে ওঁর মন যেন, উন্মুখ হয়েছিল। কোনোক্রমে বঁটিটাকে সরিয়ে রেখে উঠে পড়ে, বুকের আঁচল সামলে প্রায়, নিঃশব্দ পায়ে দৌড়ে গিয়ে যথাসম্ভব কম শব্দ করে দরজার একটি কপাট খুললেন। যাতে পাগলা বা ছুটকি দরজা খোলার শব্দ শুনতে না পায়।
কেন যে, এমন চৌর্যবৃত্তি আশ্রয় করল তাঁকে, বুঝতে পারলেন না।
জিতেন সাইকেল-রিকশাতে বা হেঁটেই আসে। কখনোই স্কুটার নিয়ে আসে না। ও, চিরদিন-ই বিশ্বাস করে এসেছে যে, যেখানে ভালোবাসা আছে অথবা মৃত্যু; সেখানে শব্দ করে যেতে নেই! তা ছাড়া, তার যাওয়া-আসার হিসেব রাখার জন্যে ঘণ্টেদাদের পাড়া প্রতিবেশীরা, নখ-চঞ্চু-তীক্ষ-ঠোঁট-সম্পন্ন সামাজিক বাজপাখিরা; সবসময়েই তক্কেতক্কে থাকে। কারো একটু সুখ দেখলেই শকুনের মতো তারা দূর আকাশ থেকে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর পরম-আক্রোশ এবং নোংরামির সঙ্গে। প্রেম যেন, গলিত, দুর্গন্ধময় শব; যেন, আবর্জনা! যে-সমাজকে জিতেন চেনে-জানে, তার নব্বই ভাগ মানুষ-ই আনন্দ-হীন, প্রেম হীন, হয়তো তাই সেক্স-স্টার্ভড; হয়তো তাই, তাঁদের এই বিকৃত-রুচি; বিকৃত জীবন-দর্শন।
জিতেন মুখটা নামিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। ওদের দরজার পাশে শালগাছের পাতা-পিছলে বৃষ্টিভেজা চাঁদের আলো এসে তার মুখের একপাশে পড়েছিল। বৃষ্টি-ভেজা একরাশ গাছগাছালির আশীর্বাদ গায়ে-মাথায় মেখে, যেন, কোনো কাল্পনিক, স্বপ্নের বাগানে পৌঁছোনোর মোরামের মিষ্টি-ঝাঁঝের গন্ধ-ওঠা পথ বেয়েই জিতেন এল।
দরজা খুলে, শেফালি কিছু না বলে; তার দু-চোখে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। কিছুক্ষণ।
জিতেন-ই বলল, অপরাধীর গলায়, আবারও এলাম!
তারপর একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, কারণ…
কারণ কি জিজ্ঞেস করেছি?
না, তা নয়, তবে এলাম আবারও, কারণ; না-এসে পারলাম না, তাই-ই!
এসো, ভেতরো এসো।
শেফালি বললেন।
বলেই ভাবলেন যে, আজকের ভেতরে আসার ‘আমন্ত্রণ’টি কত ব্যাপ্ত, কত গভীর এবং হয়তো দ্ব্যর্থকও।
এমন করে, এর আগে; কোনোদিনও ডাকেননি উনি জিতেনকে।
ভয় করতে লাগল শেফালির। এই সম্পর্কে প্রীতি ছিল, আনন্দ ছিল, হয়তো প্রেমও ছিল; হয়তো কেন, নিশ্চয়ই ছিল। কিন্তু দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষার পরের বর্ষণের-ই দ্যোতক হয়ে জিতেন আজ এই স্নিগ্ধ-রাতে তাঁর দুয়ারে এই প্রথমবাব ভয়-পায়ে ঢুকল, কাঁকুরে-লাল, বৃষ্টিভেজা মাটি আর ঝড়ে-ওড়া ফুল-পাতার সঙ্গে।
খেলাটা আর এলেবেলে রইবে না আদৌ। এলোমেলো ঘূর্ণি উঠবে এবারে ওর জীবনে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে-থাকা বিষাক্ত সাপের-ই মতো এখন-অদৃশ্য, অ-প্রণিধানযোগ্য ঘুমিয়ে থাকা সেই ঘূর্ণির গন্ধ পেল নাকে।
তাই, খুব-ই ভয় করতে লাগল শেফালির।