Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বামন পুরাণ || Prithviraj Sen » Page 5

বামন পুরাণ || Prithviraj Sen

নারদ পুলস্ত্যর কাছে জানতে চাইলেন, প্রহ্লাদ তীর্থে বেরিয়ে কোথায় কোথায় গেলেন? প্রহ্লাদ প্রথমে মন্দার পর্বতে গেলেন। তারপর মানস তীর্থে গিয়ে স্নান করে পিতৃপুরুষদের তর্পণ করে জগন্নাথের পূজা দিলেন। তারপর পাপনাশী কৌশিকীতীর্থে গিয়ে স্নান করে জগৎপতির পূজা করে ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা দিলেন। তারপর কৃষ্ণা নদীতে গিয়ে স্নান করে পিতৃপুরুষের তর্পণ করে হয়গ্রীবের পূজা করে হস্তিনাপুরে হাজির হলেন। এবং স্নান করে গোবিন্দের অর্চনা করলেন। অবশেষে যমুনা নদীতে স্নান করে ত্রিবিক্রমের দর্শন করলেন।

পুলস্ত্য এবার নারদকে পূর্বের কাহিনি বলতে আরম্ভ করলেন।

পুরাকালে কাশ্যপের ঔরসে দনুর গর্ভজাত ধনু নামে এক পরাক্রমশালী অসুর ছিল। সে ব্রহ্মার কাছে দেবগণের অবধ্য হবার বর চাইল। ব্রহ্মার বর লাভের পর সে স্বর্গে এসে হাজির হল। চতুর্থ কলির প্রারম্ভেই ধুন্দু ইন্দ্রকে পরাজিত করে স্বর্গরাজ্য শাসন করতে লাগল। হিরণ্যকশিপু ও কুন্দু একত্রে প্রমোদবিহারে মন্দরাচলে গেলেন। দেবগণেরা দৈত্যদের উৎপাতে ব্রহ্মালোকে গিয়ে বাস করতে লাগলো, ধন্ধুর কানে সে কথা যাবার সাথে সাথে ব্রহ্মালোক দখল করার অভিপ্রায় সে দৈত্যদের বলল। তারা বলল–সে ভীষণ দুর্গম পথ, সেখানে যাওয়া বড়ো কঠিন। এর সহস্ৰযোজন দূরে এক মহালোক আছে যেখানে বহু মুনি ঋষি বাস করে। তাদের দৃষ্টিতে দৈত্যর জন্ম হয়। তার কোটি যোজন দূরে জনলোকের ধাম। তাদের বধ করার কেউ নেই। এই লোকের প্রায় কোটি যোজন দূরে সত্যালোকের সর্বদা সহস্র সূর্যকিরণ জড়িত হয়, সেখানে ভগবান সত্য বাস করেন।

তাই ব্ৰহ্মলোকে যাওয়া অসম্ভব। অনুচরদের নিষেধেও ধুন্ধুর মন থেকে ইন্দ্রকে জয়ের ইচ্ছা গেল না। তখন সে শুক্রাচার্যকে জিজ্ঞেস করল–কি করলে আমি ব্রহ্মালোকে, যেতে পারবে?

শুক্রাচার্য তখন ইন্দ্রের বীরত্ব কাহিনি বলতে শুরু করল। পূর্বে ইন্দ্র একশো কোটি যজ্ঞ করার দরুণ ব্রহ্মসভায় স্থান পান। তখন ধুন্দুও দক্ষিণা দান করে অশ্বমেধ যজ্ঞ করবেন ঠিক করলেন। এই যজ্ঞের মহত্ত্বের কথা চিন্তা করে তিনি দৈত্যদের বললেন–নিধি, ব্রাহ্মণ ও গার্হস্থ্যদের ডেকে আনতে, তারা সকলে মিলে দেবিকা, নদীর তীরে যাবেন, সেই নদী সর্বসিদ্ধির বিধাত্রী কত্রী বলে প্রসিদ্ধ হবে।

শুক্র এই প্রস্তাবে রাজি হলে সকলে দেবিকাতীর্থে গেল। শুক্রর কথা মতো ভৃগু ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য শিষ্যরা ঋত্বিক হিসাবে ব্রতী হলেন। যজ্ঞের কাজ আরম্ভ হলে ঘোড়া ছেড়ে দেওয়া হল। মহাসুরগণ ওই ঘোড়াকে অনুসরণ করে চলল, যজ্ঞের ধোঁয়ায় দিক বিদিত ভরে উঠল। এই উগ্র গন্ধ ব্ৰহ্ম লোকে এসে পৌঁছল। দেবতারা সব বুঝলেন এবং তারা জনার্দনের শরণাপন্ন হলেন এবং বললেন–ধুন্ধু সমগ্র ত্রিলোক দমন করে নিয়েছে। পিণাকপানি ভিন্ন কেউ নেই যে দেবতাদের রক্ষা করে। এখন আমরা স্বর্গলোক ত্যাগ করে ব্রহ্মলোকে বাস করছি এবং এই স্থানও করায়ত্ত করার জন্য ধুন্ধু অশ্বমেধ যজ্ঞ করছে। আপনি তাকে দমন করে আমাদের চিন্তামুক্ত করুন।

জনার্দন দেবতাদের অভয় দিয়ে ধুন্ধুকে দমন করার ফন্দি করলেন। তিনি বামন রূপে দেবিকার জলে ভেসে চললেন এবং হাবুডুবু খেতে লাগলেন। ধুন্ধুও অন্যান্য, দৈত্য, ঋষিরা তখন তা দেখে তাকে উদ্ধার করতে যজ্ঞ ফেলে ছুটে গেলেন। সকলে তাকে তুলে এনে তার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বললেন–আমি জনক ব্রাহ্মণের কনিষ্ঠ পুত্র। তার দাদা নেপ্রাভ্যাস, পিতা কৌতুকবশে তার নাম রাখে গতিভ্যাস। পিতার মৃত্যুর পর দেহ সৎকার করে ঘরে ফিরে ঘরের ভাগ চাইলে দাদা তাকে বলে যে তার কোনো অধিকার নেই। কারণ ঘোড়া, ক্লীব, ঋতুকুষ্ঠ রোগী বা অন্ধরা সম্পত্তির ভাগ পায় না। শুধু মাত্র বাস ও গ্রাসাচ্ছাদন দেওয়া যেতে পারে। তিনি প্রতিবাদ করলে তার দাদা তাকে এই নদীর জলে ফেলে দেন। সাঁতার না জানার জন্য সে হাবুডুবু খাচ্ছিল। এই অবস্থার একবছর কাটার পর তারা তাকে উদ্ধার করেছেন। এবার সে জানতে চাইল ইন্দ্রের মতন দেখতে ব্যক্তিটি কে?

ব্রাহ্মণরা তখন বললেন–ইনি দানব পতি, ইনি দাতা, ভোস্তা ও ভর্তা হয়ে সম্প্রতি যজ্ঞকর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। ব্রাহ্মণরা ধুন্ধুকে বললেন–বালককে সুন্দর বাসভবন, প্রচুর ধনরত্ন ও দাসদাসী দান কর। দৈত্যপতি দিতে রাজি হলে বালক বললেন–যেখানে ভাই কিছু দিল না, সেখানে আমাকে অল্প দান করে কি লাভ? ব্রাহ্মণ বালক তখন ধুন্দুর কাছে তিন পা পরিমাণ ভূমি চাইল। বামন ওই ভূমি ছাড়া আর কিছু নিতে চাইলেন না তখন তার প্রার্থনা শুনে হাসতে হাসতে দৈত্যপতি তাকে তিন পা জমি দান করলেন। বামন তখন ত্রিবিক্রম দেহ ধারণ করলেন প্রথম পা সমুদ্র পর্বত পরিবেষ্টিত সমগ্র পৃথিবী, দ্বিতীয় পা অন্তরীক্ষ ও স্বর্গ দখল করে নিলেন। তৃতীয় পা ফেলার জায়গা পেলেন না ফলে তিনি রেগে গিয়ে দৈত্যপতির পিঠের উপর পা ফেলল। এর ফলে হাজার হাজার যোজন পরিমিত স্থান গর্ত হয়ে গেল। ভগবান শ্রীহরি ধুন্ধুকে দমন করার জন্য ত্রিবিক্রম মূর্তি ধারণ করেছিলেন। প্রহ্লাদ ঘুরতে ঘুরতে এই পবিত্র স্থানে এসে হাজির হলেন।

৪২

প্রহ্লাদ কালিন্দী নদীর জলে স্নান করে একরাত্রি উপবাস করে পরে লিঙ্গ পর্বতে গেলেন। সেখানেও একরাত্রি উপবাস করলেন। তারপর কেদার তীর্থে গেলেন। এই তীর্থে তিনি সাত রাত্রি কাটালেন। এরপর তিনি বদরিকাশ্রমে ও বরাহতীর্থে গেলেন। তিনি ভক্তি করে গুরুজি নারায়ণের আরাধনা করলেন। তারপর সেখানে গিয়ে তিনি ভগবান চন্দ্রকে পূজা করলেন। তারপর বিনাশতীর্থ দর্শন করে ইরাবতীতে গিয়ে জগন্নাথের দর্শন লাভ করলেন। সনাতন জগৎপতির আরাধনার ফলে প্রহ্লাদ ইরাবতী তীর্থে পুরুষোত্তম দিব্যরূপ লাভ করেছিলেন। ভৃগুও এই তীর্থে আরাধনা করে কুষ্ঠ রোগ থেকে মুক্ত হয়ে সন্তান লাভ করেন। নারদ জানতে চাইলেন পুরুষরা কিভাবে বিষ্ণুর উপাসনা করে নমনীয় রূপ লাভ করেন?

এই ঘটনা প্রাচীনকালে ত্রেতাযুগের প্রারম্ভের। এই কাহিনি শুনলে পাপ দূর হয়। মদ্র নামক দেশে প্রচুর ব্রাহ্মণ বাস করত। এখানে সকল নামক নগরে ধর্ম নামে এক বণিক বাস করত। একসময় সে সৌরাষ্ট্র যাবার পথে মরুভূমিতে রাত্রি হয়ে গেলে একদল দস্যু তাদের আক্রমণ করল। তারা সব লুঠ করে নিল। বণিক মনের দুঃখে একা মরুভূমিতে ঘুরতে লাগল দিকভ্রান্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে কালক্রমে বণিক এক অরণ্যে এসে উপস্থিত হল। সেই সময় প্রকাণ্ড শমীগাছ আপনা থেকে তার সামনে। আবির্ভূত হল। সেই গাছে কোনো পশুপাখি ছিল না। সে ওই গাছের নীচে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

দুপুরবেলা ঘুম ভাঙলে সে দেখল এক প্রেত নায়ক অপর এক প্রেত দ্বারা বাহিত হয়ে তার দিকে আসছে। প্রেত নায়ক তার পরিচয় জানতে চাইল। বণিক সংক্ষেপে সমস্ত কিছু বলল। তখন প্রেত নায়ক তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল–ভাগ্য প্রসন্ন হলে পুনরায় সে অনেক অর্থ উপার্জন করবে। প্রেতনায়ক তাকে এক অন্তরঙ্গ বন্ধু বলে স্বীকার করল। এমন সময় আকাশ থেকে এক দইমাখা ভাতের থালা এসে উপস্থিত হল আর এল এক জলপাত্র। প্রেতনায়ক তাকে আহ্নিকে আহ্বান করল এবং আহ্নিক শেষে খাবারের অধিকাংশ বণিককে ও বাকিটা প্রেতদের মধ্যে ভাগ করে দিল। বণিকের খাওয়া শেষ হলেই পাত্র আবার অদৃশ্য হয়ে গেল। তখন বণিক এর রহস্য জানতে চাইলেন। শমীগাছ কে? প্রেতনায়কের কাছে জানতে চাইলেন।

প্রেতপতি তখন বলল–পূর্বে সে অরণ্যে বাস করত। তার নামও বহুলা, তার প্রতিবেশি ছিল ধনবান বণিক সোমবা সে ধনবান হলেও ছিল কদর্য স্বভাবের। সোমবা প্রতিদিন দরিদ্রকে দান করত, কিন্তু সে যদি ভুলে ভালো খাবার খেত তবে কেউ তাকে তিন গাছা লাঠি দিয়ে মারত এবং দিন হবার আগেই সে রোগে আক্রান্ত হত। অতি কষ্টে তার সময় কাটত, কোনো মতে শাক খেয়ে বেঁচে ছিলো।

ভাদ্র দ্বাদশীতে প্রতিবেশী ইরাবতী নর্মদার সঙ্গমতীর্থে স্নান করতে গেলেন। ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা তাকে অনুসরণ করল। তিনি সত্তর বছর বেঁচে ছিলেন। তিনি জীবদ্দশায় কাপড়, ছাতা, জুতা, জলপাত্র, দই ভাত, মাটির থালা দান করার ফলে মৃত্যুর পরে প্রেত নায়ক হলেন। বাকিরা কিছু দান না করার ফলে প্রেত হল। তাই প্রতিদিন দুপুরে এই খাবার আপনা থেকেই উপস্থিত হয়। ছাতা দানের ফলে শমী গাছের উৎপত্তি, জুতা দানের জন্য প্রেত তার বাহন।

প্রেত এরপর বণিককে বলল–কি করলে উভয়েরই মঙ্গল হবে। বণিক যদি গয়াতে গিয়ে তার নামে পিণ্ড দেন, তাহলেই তিনি প্রেত দশা মুক্ত হবেন। এই পিণ্ড দানের উপযুক্ত সময় হল শ্রাবণ যুক্ত ভাদ্র মাসের শুক্ল পক্ষের দ্বাদশী, বণিককে একথা বলে সে গেল।

এরপর বণিক শূর সেন দেশে এলেন। এখানে অনেক অর্থ উপার্জন করে তিনি গয়াতীর্থে গেলেন। এইখানে এসে তিনি সকলের নামে পিণ্ড দান করলেন। পিণ্ড দানের ফলে সকলে প্রেতদশা মুক্ত হয়ে ব্রহ্মলোক লাভ করল। তারপর একসময় ঘরে ফেরার সময় বণিক মারা গেল এবং গন্ধর্ব লোকে স্থান লাভ করে দুর্লভ সুখভোগ করে। পরে পুনর্জন্ম লাভ করে সমগ্র পৃথিবীর সম্রাট পদে অধিষ্ঠিত হয়। পূর্বজন্মের কর্মফলে সে মৃত্যুর পর গুহ্যকলোক লাভ করে এবং যথেচ্ছ সুখ ভোগ করে–ক্ষত্রিয় রূপে মর্তে জন্মে শত্রুদের পরাজিত করে কালক্রমে তার দেহাবসান হলে ইন্দ্রোলোকে স্থান হয়। তার দীর্ঘকাল পরে অকাল নগরে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মায়। সে সুপণ্ডিত হলেও বিরাট ও কুৎসিত আকৃতি বিশিষ্ট হল। এক রূপবতী ব্রাহ্মণ কন্যার সঙ্গে তার বিবাহ হল। তার রূপের জন্য এর স্ত্রী তাকে অবজ্ঞা করত। ফলে সে সংসারে মোহ ত্যাগ করে ইরাবতী তীর্থে আশ্রম চলে গেল। প্রমাণ নক্ষত্র পুরুষ ব্রত পালন করে ও জলাশয়ের আরাধনা করে ব্রাহ্মণ সুন্দর চেহারা লাভ করে এবং পত্নীর সাথে সুখে কাল কাটতে লাগল। মৃত্যুর পর তিনি পুনরায় পুরুরবা রূপে আবির্ভূত হন।

৪৩

নারদ জানতে চাইলেন, পুরুরবা কিভাবে শ্রীপতির আরাধনা করেছিলেন। পুলস্ত্য তখন বললেন, মূলা নক্ষত্র ভগবানের চরণ যুগল, রোহিনী ও অশ্বিনী তার উরুযুগল, শ্লেষা নিতম্ব, ফাল্গুনী গুহ্য, কৃত্তিকা কোমর, অনুরাধা উরু, ধনিষ্ঠা পিঠ, বিশাখা ভুজযুগল, হস্তকরযুগল, পুনর্বাস গোড়ালি, পুষ্যা ঠোঁট, স্বাতী দাঁত, শতভিষা চোয়াল, চিত্রা নাক, প্রজাপতি চক্ষুযুগল, এবং ইন্দ্র মাথার চুল, এই হরির নক্ষত্রাঙ্গ। এবার সবাই ব্রতের নিয়ম চলতে লাগলেন।

যথাবিধি পূজা করলে ইঙ্গিত বস্তু দান করেন হরি। চৈত্রমাসের শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে চন্দ্রদেব মূলা নক্ষত্রে অবস্থান করলে হরির চরণ যুগল পূজা করতে হয় এবং ব্রাহ্মণদের ভোগ্যবস্তু দান করা উচিত। ভক্তি ভরে ভগবানের পূজা করে ব্রাহ্মণদের হবিষান্ন দান করতে হয়। অভিজ্ঞ ব্যক্তি সকল গুহ্যদেশ পূজা করবেন। গরুর দুধ নৈবেদ্য রূপে দিতে হয় এবং ব্রাহ্মণদের নানা রকম ভোজ্য দ্রব্য দান করতে হয়।

জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তি হরির কটি দেশ পূজা করবেন। ভাদ্রপদ নক্ষত্রে যথাবিধি ভগবানের শরীরের পার্শ্বদ্বয় পূজা করে তাকে সন্তুষ্ট করার জন্যে গুড়, মৌরি নৈবেদ্য দিতে হয়। রেবতী পেটের ডান ও বাম ভাগ পূজা ও মুগের মিঠাই-এর নৈবেদ্য দিতে হয়। অনুরাধা নক্ষত্রে বক্ষদেশের পূজা ও কেটে ধানের ভাতের নৈবেদ্য, ধনিষ্ঠায় পিঠের পূজা ও শালি ধানের ভাতের নৈবেদ্য, বিশাখায় ভুজ যুগলের পূজা ও পরমান্নের নৈবেদ্য দান করতে হয়। এভাবে হস্তা নক্ষত্রে দুই হাতের পূজায় যব, পুনর্বসু নক্ষত্রে পুজোয় তিল মেশানো মিঠাই, শ্রবণা নক্ষত্রে কানের পূজায় দই মাখা ভাত; পুষ্যা নক্ষত্রে মুখের পূজায় ঘি ও পায়েস, স্বাতী নক্ষত্রে দাঁতের পূজায় তিল, গন্ধদ্রব্য ও ব্রাহ্মণদের নানা ভোজ্যের, শতাভিষা নক্ষত্রে চোয়ালের পূজায় কামিনী ধানের ভাত, মঘা নক্ষত্রে নাকের পূজায় হরিণের মাংস, চিত্রা নক্ষত্রে কপালের পূজায় ও ভরণীতে মস্তক পূজায় উত্তম ভোজ্যবস্তু, আদ্রা নক্ষত্রে মাথার চুলের পূজায় গুড়ের মিঠাই নৈবেদ্য রূপে দান করবে।

যথাবিহিত পূজা সমাপ্ত করে দেবজ্ঞ ও শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা, ছাতা, পশু, ধান, সোনা, দুগ্ধবতী গাভী প্রভৃতি দান করতে হয়। এই নক্ষত্র পুরুষ ব্রত সব ব্রতের সেরা। পূর্বে ভৃগু এই পাপহারী ব্রত পালন করেছিলেন। ভগবানের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পূজা করলে পূজকের অঙ্গ প্রত্যঙ্গও সর্বাঙ্গ সুন্দর ও সুশ্রী হয়ে থাকে এবং ভগবান হদ্দির কলি সংসর্গ থেকে জাত পূজকের সাত জন্মের পুরুষ ও পিতামাতার কর্ম হেতু যাবতীয় পাপ দূর করে দেন।

এই ব্রতপালনকারী সমস্ত ইষ্ট বস্তুই লাভ করে থাকেন। জনার্দন পূজকের সমস্ত মনোবাসনাই পূরণ করে। অরুন্ধতী এই পূজা করে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। অদিতি নক্ষত্র পুরুষের পূজা করে স্বয়ং হরিকেই পুত্র রূপে লাভ করেন। রম্ভা তার পূজা করেন রূপ লাভ করে এবং পুরুরবা রাজ্য লাভ করেন। যথাযথ নিয়ম মেনে নক্ষত্র ব্রত পালন করলে কল্যাণ, পবিত্রতা, ফল ও আরোগ্য লাভ হয়ে থাকে।

প্রহ্লাদ ঋষি নন্দিনী তীর্থে গিয়ে চৈত্র মাসের অষ্টমী তিথিতে জনার্দনের পূজা করলেন এবং নক্ষত্র ব্রত পালন করে তিনি কুরুক্ষেত্রে গেলেন। ঐরাবত মন্ত্ৰচ্চারণ করে বেদবিধি অনুসারে চক্ৰতীর্থের পূজা করে স্নান করলেন এবং ভক্তি ভরে তিনি কারুধ্বজের পূজা করলেন। তারপর তিনি দেবিকা তীর্থে স্নান করে নৃসিংহ পূজা করলেন। পরে গোকর্ণ তীর্থে গেলেন এবং বিশ্বস্রষ্টার পূজা করলেন। বিষ্ণুর সাক্ষাৎ লাভের জন্য তিনি মহাসলিলে যান। এরপর তিনি পিতৃপুরুষদের তর্পণ করলেন এবং এই তীর্থে তিন রাত্রি বাস করলেন।

হংস পদে ভগবান হংসের দর্শন করে পয়োবতী তীর্থে গিয়ে অখণ্ড রূপী অচ্যুতের অর্চনা করলেন। এরপর তিনি বিতস্তায় গিয়ে কুমারিলের অর্চনা করেন। এই তীর্থ দর্শনের পর তিনি পাপহারী অ্যুত তীর্থে যান। জগত কল্যাণে নিজ কন্যা কল্যাণী কপিলাকে সৃষ্টি করেন। সেই দেবহ্রদে স্নান করে বিধাতার পূজা করলেন। এরপর মণিমান তীর্থে গিয়ে স্নান করে ব্রহ্মার দর্শন লাভ করলেন। এই তীর্থে ছয়রাত্রি বাস করলেন, তারপর তিনি মধুনন্দিনী তীর্থে হাজির হলেন। এখানে হর ও গোবিন্দের দর্শন লাভ করলেন।

নারদ জানতে চাইলেন, শম্ভু কেন সুদর্শন চক্র ও বাসুদেব কেন শূলধারণ করেছিলেন? পুলস্ত্য বললেন, কোনো এক সময়ে বিষ্ণু ধরাধামে অবতীর্ণ হবার কথা দেবতাদের বলেছিলেন। জলোদ্ভব নামে অসুর ব্রহ্মার আরাধনায় থেকে ঘোরতর তপস্যা আরম্ভ করে। ব্রহ্মা তাকে বর দিতে উদ্যত হন। ব্রহ্মার বরে জলোদ্ভব অসুর যুদ্ধে দেব দানবদের অজেয় হয়ে উঠল। অভিশাপেও তার অনিষ্ট করার ক্ষমতা কারো রইল না। এই মহাসুর ব্রহ্মার বলে অসীম প্রভাবশালী হয়ে সমস্ত দেবতা, মহর্ষি ও রাজাদের উপর অত্যাচার করতে লাগল। দানবের অত্যাচারে সকলের ক্রিয়াকর্মে লোপ পেতে বসল। দেবতারা ভূতলে চলে গেলেন। অবশেষে তারা হরির শরণাপন্ন হন। হরি তখন দেবতাদের সাথে নিয়ে হিমালয়ে ত্রিলোচন মহাদেবের কাছে গেলেন।

হরি ও হর দুজনে পরামর্শ করে দেবতা ও ঋষিদের কল্যাণ সাধনের জন্যে শত্রু নিধনে কৃত সংকল্প হলেন। তারা নানা স্থানে দানবের খোঁজ করতে লাগলেন। তখন জলোদ্ভব নামের মহাসুর হরি ও হরকে দেখে চি নদীর জলে লুকিয়ে পড়ল। তাঁরাও দানবকে অনুসরণ করে নদীর তীরে এসে অদৃশ্য হলেন। অসুর তখন হিমালয় পর্বতে আশ্রয় নিল? বিষ্ণু ও শিব তা বুঝে সেই দানবের দেহ চক্র ও শূল ধারণ করে ছিন্ন করল। চক্রাঘাতে ছিন্ন ভিন্ন সেই অসুর তখন পর্বতশৃঙ্গ থেকে ভূপতিত হল। এর কারণেই হরি ও হর চক্র ও শূল ধারণ করেছিলেন। প্রহ্লাদ এরপর বিশাল নদীর তীরে গিয়ে ভক্তিভরে স্তব করেন, পরে তিনি হরিহরের সাক্ষাৎ লাভ করার জন্য হিমালয়ে হাজির হন। সেখানে তিনি ব্রাহ্মণদের নানা দ্রব্য দান করেন। তারপর তিনি বিতস্তা ও হিমালয়ের মধ্যবর্তী ভৃগু পর্বতে যান, এখানেই শঙ্কর বিষ্ণুকে অন্যতম অস্ত্র চক্র দান করেন।

৪৪

নারদ জানতে চাইলেন, শঙ্কর কেন বিষ্ণুকে চক্র দান করেছিলেন? পুলস্ত্য তখন বললেন, পূর্বে বীতমুন্য নামে বেদবেদান্ত পারদর্শী গৃহাশ্রমী এক মহাব্রাহ্মণ ছিলেন। তার পত্নী আত্রেয়ী। বীতমনুর কোনো সন্তান ছিল না। তিনি এক সময় ঋতুকালে স্ত্রী সংসর্গ করলে তার একটি পুত্র সন্তান হয়। যার নাম উপমুন্য। গরীব ব্রাহ্মণী পিটুলী গোলা খাইয়ে তাকে পালন করতেন। বালক দুধের স্বাদ না পেয়ে পিটুলী গোলাকেই দুধ বলে মনে করত। সে একসময় এক ব্রাহ্মণের বাড়িতে দুধ ও ক্ষীর মেশানো ভাত । খেয়ে পরের দিন বাড়িতে নিয়ে বালক আর পিটুলী গোলা খেলেন না। ক্ষীরের জন্য কাঁদতে লাগল। মা তখন বলল–শঙ্কর দয়া না করলে দুধ কোথায় পারো? তাই নিতান্ত দুধ খেতে হলে শূলপানির আরাধন করতে হবে।

উপমন্যু তখন এই আরাধ্য ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলে তার মা তাকে বললেন–প্রাচীনকালে শ্রীদাম নামে প্রবল পরাক্রান্ত অসুররাজ ছিল। সে ত্রিলোককে আয়ত্ত্ব করা ফেলল। তারপর সে শ্রীবৎসকে হরণ করবে বলে মন স্থির করল। ভগবান বাসুদেব তাকে বধের জন্য মহেশ্বরের কাছে গেলেন। সে সময় হিমালয়ে অবস্থিত ছিলেন শঙ্কর যোগমূর্তি ধারণ করে ছিলেন। হরি আত্মা দিয়ে তাঁর আরাধনা করতে লাগলেন। তিনি পায়ের বুড়ো আঙুলের ওপর ভর দিয়ে হাজার বছর কাটিয়ে ছিলেন।

ভগবান প্রীত হয়ে তাঁকে দর্শন দিয়ে পরম দিব্য চক্র দান করলেন এবং বললেন–এই চক্র অন্য সমস্ত অস্ত্রের প্রতিবেধন। এর বারোটি নেমি ও দুটি নাভি আছে। সকল দেবতারা রাশি, মাস ও চক্রে সন্নিহিত শিষ্টদের রক্ষা করার জন্য দুটি ঋতুও এই চক্রের মধ্যেই অধিষ্ঠিত আছে। এর বারো নেমিতে অগ্নি, সোম, মিত্র, বরুণ, ইন্দ্র, বিশ্বদেব, গণ, প্রজাপতিগণ, বলবান বায়ু, দেবদৈব্য ধন্বন্তরি, তপস্যা ও তপ এই দেবতারা বিরাজ করছেন। এই অস্ত্রের সাহায্যে নিঃশঙ্ক চিত্তে দেবশত্ৰু সংহার করতে পারবে। চৈত্র থেকে ফাল্গুন পর্যন্ত সমস্ত মাসই এই চক্রে অধিষ্ঠিত।

এই চক্র শত্রু নিধনে অব্যর্থ। ইন্দ্রও এই চক্রের পূজা করেন, শম্ভুর কথা শুনে বিষ্ণু জানতে চাইলেন–এই শক্তি অব্যর্থ কিনা তা তিনি কি করে বুঝবেন? তাই তিনি চক্রের ক্ষমতা প্রমাণের জন্য শম্ভর ওপরেই তা প্রয়োগ করতে চাইলেন। এবং বিষ্ণুর চক্রের আঘাতেই শম্ভর দেহ তিন টুকরো হয়ে গেল।

হরি তখন মহাদেবের চরণে প্রণত হলেন। শম্ভ প্রীতচিত্তে বললো–আমি ব্রহ্মারূপী, বিকার প্রাকৃত, পরন্তু বিকৃত নয়। কারণ আমি অচ্ছেদ্য ও অসহ্য, ফলে তার তিন মন্ত্র থেকে হিরণ্যাক্ষ, সুবর্ণাক্ষ ও বিশ্বরূপাক্ষ প্রাদুর্ভূত হয়ে সমস্ত মানুষের কল্যাণ সাধন করবে। সুতরাং এবার তোমার শত্রু শ্রীদামকে গিয়ে বধ কর। মহাদেবের কথায় বিষ্ণু সুমেরু পর্বতে গিয়ে দানব শ্রীদামকে দেখতে পেলেন। তখন হরি সেই দৈত্যের দিকে চক্র নিক্ষেপ করলেন। মুহূর্তের মধ্যে চক্র দৈত্যের মাথা কেটে ফেলল। বিষ্ণু এরপর চক্র নিয়ে নিজ ভবনে চলে গেলেন। জননীর কাছে এই কাহিনি শুনে উপমন্যু ত্রিলোচনের আরাধনা করে প্রচুর পরিমাণে ক্ষীর খেতে পেল।

৪৫

প্রহ্লাদ এখানে স্নান করে ত্রিলোচন দেবের সাক্ষাৎ লাভ করে সুবর্ণপক্ষদেবের অর্চনা করলেন। তারপর নৈমিষ তীর্থে গেলেন। গোমতী ও কন্বিতনাক্ষী নদীর মধ্যবর্তী স্থানে ত্রিশ হাজার পরম পবিত্র তীর্থ ক্ষেত্র আছে। সেখানে স্নান করে প্রহাদ দেবদেবের যথাবিধি আরাধনা করলেন। পরে গোপতির দর্শন পাবার জন্য গয়াধামে গেলেন এবং স্নান করে পিতৃ পুরুষগণ, বাসুদেব ও গদাধর ও গোপ মহাদেবের আরাধনা করলেন। সরযূ নদীতে স্নান করে এক রাত বাস করলেন। রজস্তু তীর্থে গিয়ে পিতৃ পূজা ও পিণ্ড দান করে অজিতের দর্শন লাভ করে ছয় রাত্রি বাস করলেন। তারপর যাত্রা করলেন মহেন্দ্র পর্বতের দক্ষিণ দিকে গিয়ে শম্ভু ও গোপালের সাক্ষাৎ পেলেন। তারপর সোমতীর্থে গিয়ে স্নান করলেন।

মহাপর্বতে গিয়ে মহাসিন্ধুতে স্নান করে ভক্তিভরে বৈকুণ্ঠের অর্চনা করলেন এবং তর্পণ করলেন। তারপর তিনি পরিত্র পর্বতে ভগবান অপরাজিতের পূজা করে সেখান থেকে সুমেরু দেশে গেলেন এবং বিশ্বরূপের সাক্ষাৎলাভ করলেন। সেখানে শম্ভু প্রমথদের দ্বারা পূজিত হয়ে বিশ্বরূপ প্রকাশ করেছিলেন। সেই পুণ্য জলে স্নান করে মহাত্মা প্রহাদ মহাদেবের অর্চনা করেন। এরপর বিন্ধ্যাচলে চলে গেলেন। সেখানে বিশাখার জলে স্নান করে তিন রাত্রি বাস করলেন।

তারপর অবন্তী নগরে গিয়ে শিপ্রানদীর জলে স্নান করে বাসুদেবের পূজা করলেন। তারপর মহাদেবের সাক্ষাৎ লাভের আশায় যাত্রা করলেন। এইস্থানেই সর্বভূতহন্তা যমকে দগ্ধ করে রাজা শ্বেতকিকে রক্ষা করেছিলেন। এখানে দেবগণ সর্বদা মহাদেবের অর্চনা করেন। প্রমথগণ সর্বদা তাঁকে পরিবেষ্টিত করে রেখেছে। এই শ্মশানবাসী মহাদেবের পূজা করে প্রহ্লাদ নিধি অভিমুখে গেলেন। এখানে অমরেশ্বরের পূজা করলেন। সশ্রদ্ধচিত্তে কান্যকুজে তিনি হয়গ্রীবের দর্শন পেলেন এবং পাঞ্চাল দেশে গেলেন। এখানে পঞ্চালিখের দর্শন লাভ করে প্রয়াগ তীর্থে গেলেন।

প্রয়াগে রুদ্র ও মাধবের পূজা করে সমগ্র মাস সেখানে থাকলেন। তারপর তিনি বারাণসী ধামে গিয়ে বিভিন্ন তীর্থে স্নান করে পিতৃদেবগণের অর্চনা করলেন এবং সমগ্র নগর প্রদক্ষিণ করে মাধবের পূজা করলেন। তারপর স্বয়ম্ভুর আরাধনা করলেন। এরপর মধুবনে গেলেন এবং সেখান থেকে এলেন পুষ্করারণ্যে। এখানে দেবতা ও পিতৃ পুরুষের পূজা করলেন। পুলস্ত এই কাহিনি বর্ণনা করেছিলেন।

৪৬

পুলস্ত্য বললেন–প্রহ্লাদ তীর্থ পর্যটনে বেরোলে বলি কুরুক্ষেত্র দর্শন করার জন্য যাত্রা করলেন। ওই পুণ্যতীর্থে মহাব্রাহ্মণদের আহ্বান জানালেন শুক্রাচার্য। তাঁর আমন্ত্রণে অত্রি, গৌতম, কুশিক ও অঙ্গিরার বংশধর ও তত্ত্বদর্শী ব্রাহ্মণগণ কুরু জঙ্গলের উত্তর দিকে শতদ্রুর তীরে সমবেত হয়ে স্নান করে বিভাস তীর্থে হাজির হলেন, তারপর–এরা কিরণ, বেগবতী, ঈশ্বরী, দেবিকা ও পয়োন্বিত নদীর জলে স্নান করে ও পরে এসে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখে তারা বিস্মিত হলেন। তাঁরা স্নান করে পুস্করে ব্রহ্মার অর্চনা করে ত্রিলোক প্রসিদ্ধ সরস্বতী তীর্থে অবস্থিত কোটি তীর্থে গিয়ে বৃষধ্বজ রুদ্র কোটির দর্শন লাভ করলেন।

তখন নৈমিষ মগধ, সিন্ধু, ধর্মারণ্য, পুষ্কর, দণ্ডকারণ্য, মেনা, তারকাস্থ ও দেবিকা তীর্থে বাসকারী ব্রাহ্মণরা তার দর্শন পাবার জন্য সেখানে এলেন। এদের সংখ্যা সেইস্থানে দেবদেব এদের ব্যাকুলতা দেখে কোটি মূর্তি ধারণ করলেন এবং তাঁর নাম হল রুদ্রকোটি। প্রহাদ এই কোটি তীর্থে স্নান করে রুদ্রের আরাধনা করলেন। তারপর কুরু জঙ্গল তীর্থে গিয়ে সরস্বতী নদীতে জলমগ্ন স্থানুর দর্শন পেলেন। পরে দশাশ্বমেধে স্নান করে তিনি দেবতা ও পিতৃগণের অর্চনা করে সহস্র লিঙ্গের পূজা করলেন।

সোমতীর্থে পর্যটন করে তিনি ক্ষীরীপ বাসে হাজির হলেন। প্রহ্লাদ ক্ষীরীতরু প্রদক্ষিণ করে বরুণের পুজা করলেন; পদ্মাক্ষী নগরে গিয়ে মিত্রাবরুণ ও সূর্যের অর্চনা করলে; কুমার ধারায় বিষ্ণুকে দর্শন করে কপিল ধামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। এখানে কার্তিকেয়র অর্চনা করে নর্মদাতীর্থে বাসুদেবের আরাধনা করে কোকা তীর্থে গেলেন। সেখানে বিষ্ণুর বরাহমূর্তির পূজা করে মধুদেশে প্রস্থান করলেন। নারীহ্রদে স্নান করে শান্তিবরের আরাধনা করলেন। কালাপ্রজ্ঞর পর্বতে গিয়ে নীলকণ্ঠের সাক্ষাৎ লাভ করলেন।

এরপর তিনি নীল তীর্থের জলে স্নান করে শুচিশুদ্ধ হয়ে প্রভাসে তীর্থে এলেন। এই তীর্থে সরস্বতী ও সাগরসঙ্গমে স্নান করে লোকপতি সোমেশ্বর মহাদেবের দর্শন লাভ করলেন। শঙ্কর ও বিষ্ণুর–উপাসনা করলেন। তারপর ভীমের অর্চনা করে দারুবনে গেলেন। এবং স্ত্রীলিঙ্গ দর্পণ ও পূজা করলেন। ব্রাহ্মণ তীর্থে ইন্দ্রের উপাসনা করে প্রাঞ্জতীর্থে এলেন এবং ভাবিতভাবে স্ত্রীনিবাণের অর্চনা করলেন। কুন্তি তীর্থ দর্শন করে মগধারণ্যে এসে বিশ্বেশ্বরের পূজা করলেন।

ঝলমল তীর্থে ভদ্রকালীশ্বর বীরভদ্রের উপাসনা করে গিরিব্রজে গেলেন। গিরিব্রজে মহেশ্বরের আরাধনা করলেন। কামরূপতীর্থের উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন। সেখানে দেবী দুর্গা ও শংকরের উপাসনা করলেন। মহাতীর্থে মহাদেবের পূজা করে ত্রিকূট পর্বতে গিয়ে চক্রপানি বিষ্ণুর দর্শন পেলেন। প্রহ্লাদ এখানে তিন মাস বাস করলেন এবং ব্রাহ্মণদের সোনা দান করলেন।

তারপর দণ্ডকারণ্যে এলেন এবং পুণ্ডরীকাক্ষের সাক্ষাৎ লাভ করে তার তলায় তিন রাত বাস করে সারস্বত স্তব পাঠ করলেন। সেখানে থেকে প্রহ্লাদ কানন শিব তীর্থ বরে গিয়ে হরিদর্শন করে দুটি স্তব গান করলেন। শূকরের মূর্তিধারী ও দুটি স্তব পাঠ করেছিলেন। এর পর প্রহ্লাদ শালগ্রাম তীর্থে গেলেন। বিষ্ণু এখানে স্থাবর স্তম্ভ সমূহে বিরাজ করছেন। পুলস্ত্য বললেন–যে প্রাদের তীর্থ যাত্রার বিবরণ শুনলে অকাল মৃত্যু থেকে মুক্তি ঘটে।

৪৭

নারদ জানতে চাইলেন প্রহ্লাদ ভগবানের প্রতি যে গজেন্দ্র মোক্ষণাদি মন্ত্র জপ করেছিলেন তা প্রথমে পুলস্ত্য গজেন্দ্র মোক্ষণ স্তব করলেন। পরে সারমৃত স্তব বলবেন। রত্নরাজি খচিত শ্রিমান ত্রিকূট পর্বত আছে, এই পর্বত সূর্যের দ্যুতি সম্পন্ন সুমেরুর পুত্র। ক্ষীরোদ সাগরের তরঙ্গরাশি এই পর্বতে শিলাতলে আছড়ে পড়ছে। পার্বত্য পাদদেশে বিচরণ করছে এর গা বেয়ে ঝরণা নামছে। প্রমাণে বাস করে গন্ধর্ব, কিন্নর, যক্ষ, সিদ্ধ, চরণ, গুহ্যক, বিদ্যধির, সংযমী তপস্বী এবং বাঘ, নাগকেশর, কর্ণিকার, বেল, আমলকী, পাইন, কদম ও আম চন্দন, শিমূল, শাল, তাল, তমাল, দেবদারু, অর্জুন, চাপা বৃক্ষরাজি এ স্থানের শোভা বাড়িয়ে তুলেছে। এর পাদদেশে হরিণ, বানর, ঘুরে বেড়ায়। চকোর ও ময়ূর নিনাদে এ স্থানে সর্বদা মুখরিত। এর সোনালি সুর্ভেঙ্গ সূর্যদেব বিরাজিত, রূপালীতে চন্দ্রদেব।

তৃতীয় শৃঙ্গে ব্রহ্মাভবন অধিষ্ঠিত। পাপী লোকেরা এই শৃঙ্গ দেখতে পায় না, এর উপর সরোবর আছে যার জলে এক ভয়ংকর কুমীর বাস করত। একদিন এক হাতি জল খেতে এলে কুমীর তার পা কামড়ে ধরল, অন্য সঙ্গী হাতিরা আর্তনাদ করে উঠল, উভয়ের মধ্যে টানাপোড়েন শুরু হল। যা সহস্র বছর ধরে চলল।

বারুণ পাশে হাতির গতি রুদ্ধ হল এবং হাতি তখন বিপন্ন বিল্ম অবস্থায় হরিকে চিন্তা করতে লাগল। গজেন্দ্র বলল তিনি মূল প্রকৃতি, মহাত্মা, অজিত, অনাশ্রিত, নিস্পৃহ, আদি, অনন্ত এক ও অব্যক্ত গুহ্য গূঢ়, গুণ গুণবতী, অপ্রমেয় ও সতুল, শান্ত, নিশ্চিত, যশস্বী, সনাতন, পূর্ব-পুরুষ দেব, নির্গুণ ও গুণাতমা, গোবিন্দ, পদ্মনাভ সাংখ্য যেনোদ্ভব, বিশ্বেশ্বর, বিশ্বদেব, হরি, নারায়ণ, পরমাত্মা, বামন, অমিত বিক্রম, ধনুর্ধর অসিধারী, বাসুকী, নৃসিংহ, দেবশ্রেষ্ঠ, অম্বর, অচিন্ত্য সয্যাসারী, যোগেশ্বর ব্রহ্মারণ, ত্রিদানয়ন, লোকায়ন, আত্মহিনায়ন, নারায়ন, আত্মবিতান বা যোগেশ্বর, অজ্ঞেয় ক্ষেত্রজ্ঞ, বরেণ্য, স্বয়ম্ভু, বাসুদেব, অদৃশ্য, অচিন্ত্য, অব্যস্ত, অব্যয়, হিরণ্যনাৎ, মহাবল, জনার্দন বিষ্ণু, পীতাম্বরধারী আদিত্য, রুদ্র, বসু অশ্বিনীদ্বয়ের প্রভাবগন্ডি ত্রিলোকেশ, সহস্র শিরা? ও মহাযুকে প্রণাম।

পুলস্ত্য বললেন, এই স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে তৎক্ষণাৎ সরোবরে এলেন কেশব কুমীর ও গজেন্দ্রকে জল থেকে টেনে তুলে আনলেন। মধুসূদন চক্রাঘাতে কুমীরকে বধ করে গজেন্দ্রকে মুক্ত করে দিলেন। হু হু দেবের শাপে ইনি কুমীর হয়ে জন্মেছিল, সে শাপমুক্ত হয়ে স্বর্গত স্বর্গ লাভ করল। গজেন্দ্র বিষ্ণুর স্পর্শে দিব্যদেহ ধারণ করে পুরুর রূপে আবির্ভূত হল। তারা একসাথে ভক্তিভরে স্মরণাগত বিষ্ণুর আরাধনা করল।

ভগবান তখন গজেন্দ্রকে বললেন, যে ব্যক্তি আমাকে স্মরণ করবে তার দুঃসময় সুসময়ে পরিণত হবে। পাপ মুক্ত হবে। প্রভাতৎকালে উঠে মৎস্য, কূর্ম, বরাহ, নৃসিংহ, বামন অবতারকে ভক্তি ভরে স্মরণ করলে হৃষিকেশ গজ ও গন্ধর্বকে হাত দিয়ে স্পর্শ করলেন। ব্রহ্মা বললেন, যে এই গজেন্দ্রমোক্ষণ স্মরণ করবে যে সকল পাপ থেকে মুক্তি লাভ করবে এবং গজবন্ধনের মতো যাবতীয় বিপদ থেকে উদ্ধার পাবে।

৪৮

পুলস্ত্য নারদকে বললেন, জনৈক ব্রাহ্মণ বিদ্বেষী ক্ষত্রিয় ছিল। সে ছিল হিংস্র ও অত্যাচারী। ব্রাহ্মণদের শ্রদ্ধা ও দেবতার উপাসনা করত না। মৃত্যুর পর এক ভয়ংকর রাক্ষস হয়ে জন্মাল। এভাবে পাপ কাজে আসক্ত থেকে একশো বছর কেটে গেল। কোনো ভালো কাজেই তার অভিরুচি ছিল না। এরপর এর শরীরে বার্ধক্য দেখা দিল। সে এক তপস্বীকে নদীতীরে তপস্যা করতে দেখল। তিনি সতর্কভাবে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। চক্ৰপানি বিষ্ণু পূর্বদিক রক্ষা করুন। গদাপাণি বিষ্ণু দক্ষিণ দিক, খঙ্গধারী বিষ্ণু উত্তর দিকে, গাঙ্গধারী বিষ্ণু পশ্চিমদিক, ক্রোড়রূপী হরি ভূতলে। নরসিংহ অন্তরীক্ষে যেন তাকে রক্ষা করে। সুদর্শন চক্র প্রেত ও রাক্ষসদের সংহারক, শাঙ্গধনু মানুষ, প্রেত শত্ৰুদলকে বিনাশ করুক, খঙ্গাঘাতে আমার শত্রুরা নিস্তেজ হয়ে পড়ুক। নিষ্ঠুর মানুষ বিষ্ণুর শঙ্খচক্রে আহত হয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়ুক।

যে প্রমথগণ ভোগ সুখ নষ্ট করে দেয় বিষ্ণুর চক্রাঘাতে আহত হোক, বাসুদেবের নামে গানে বুদ্ধি মন ও ইন্দ্রিয় সুস্বাস্থ্য লাভ করুক, আমার পিছনে, সামনে, দক্ষিণে, উত্তরে জনার্দন হরি অবস্থান করুন, তার নাম সংকীর্তনে কেউ যেন ক্লান্ত হয় না। আত্মরক্ষার জন্য বিষ্ণুর আরাধনা করে তাপস তপস্যামগ্ন হলেন।

রাক্ষস তাকে আক্রমণ করার জন্য ছুটে গেল। কিন্তু তার রক্ষাকবচ রাক্ষসের গতিরোধ করল। সে নিশ্চল হয়ে চারমাস দাঁড়িয়ে রইল, চারমাস পরে তাপসের তপস্যা ভঙ্গ হলে সে রাক্ষসকে দেখল। রাক্ষস তখন বলহীন হয়েছে দেখে তাপস দয়া করে তার কারণ জানতে চাইলে রাক্ষস সব বলে নিজ কৃতকর্মের জন্য তার কাছে ক্ষমা চাইল এবং তার পূর্ব পাপের মুক্তি কামনা করল। রাক্ষসের কথায় ব্রাহ্মণ জানতে চাইল তার হঠাৎ ধর্মে মতি হল কিরূপে? তখন রাক্ষস বলল, ব্রাহ্মণ তাপসের সংসর্গেই তার মনে পরিবর্তন হয়েছে। তার মতো পাপীর মনেও অনুতাপ হচ্ছে। রাক্ষস পাপের জন্য মুক্তি কামনা করায় বহুক্ষণ চিন্তা করে তিনি বললেন, পাপরাশি থেকে যত শীঘ্র মুক্তি লাভ করা যায় ততই উপকার বা মঙ্গলের পথ প্রশস্ত হয়। অন্য কোনো ব্রাহ্মণের কাছে তুমি পাপ মুক্তির উপায় জেনে নাও, বলে তাপস প্রস্থান করল।

রাক্ষস খিদেয় কাতর হয়েও কোনো প্রাণীবধ করল না। বেঁচে থাকার জন্য কেবল একটি জন্তু বধ করে খেতে লাগল। একদিন দারুণ ক্ষুধার্ত হয়ে এক মুনিবালককে দেখে তাকে খাবার জন্য জাপটে ধরল। তখন মুনি বালক প্রাণের আশা ছেড়ে বলল, তোমার মঙ্গল হোক, রাক্ষস বলল, সে ভীষণ ক্ষুধার্ত তাই সে মুনি বালককে খেয়ে খিদে মেটাতে চায়।

মুনি বালক বলল, যে সে তার গুরুকে ফল দিয়ে ফিরে আসার পর যেন রাক্ষস তাকে খায়। রাক্ষস বলল, দিনের শেষে কেউ তার হাত থেকে অব্যহতি পায় না, কারণ এটাই তার জীবিকা। রাক্ষস এখন তার হাত থেকে মুক্তি পাবার উপায় স্বরূপ মুনি বালককে বললেন– বাল্যকাল থেকে তার মন পাপাসক্ত, ধর্মের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আসক্তি ছিল না। তাই বাল্যকাল থেকে সমস্ত পাপের মুক্তির উপায় বলে দিতে হবে–মুনিপুত্র চিন্তিত হয়ে পড়লেন। নিরুপায় হয়ে অগ্নির স্মরণাপন্ন হলেন এবং বললেন, তিনি পিতা-মাতা অপেক্ষা গুরুকে বেশি মানেন। ভগবান পাবক যেন তাকে রক্ষা করেন। তার প্রার্থনায় অগ্নির আদেশে দেবী সরস্বতী এসে বালককে বললেন, তিনি জিভের ডগায় অধিষ্ঠিত থেকে রাক্ষসের পাপ মুক্তির উপায় বলে দেবেন। একথা বলেই বেদী রাক্ষসকে দেখা না দিয়ে অন্তর্হিত হলেন। তখন বালক বললেন, খুব ভোরে উঠে জপ এবং দুপুর ও বিকালে জপ করলে শান্তি ও পুষ্টি লাভ হবে।

হরিকে স্মরণ করলে হরি পাপ হরণ করেন। যোগীরা যে বাসুদেবের ধ্যান করে থাকেন সেই স্বর্গগামী সর্বাধার পরব্রহ্মের স্মরণ নিলাম। যার সাক্ষাৎ লাভে রোগীদের পুনর্জন্ম হয় না। যাঁদের সুখ পরম্পরা থেকে পরম পুরুষের আর্বিভাব হয়েছিল, যে ধারা ধারণ করেছেন, দৈত্যরা যার হাতে নিহত হয়েছে, যে দেবতাদের বিপদে রক্ষা করেন, যিনি পাতাল ও ভূতলের সব কিছু সংহার করেন। সকল সুর, অসুর ও পিতৃগণ যক্ষ, গান্ধর্ব ও রাক্ষসরা যাঁর অংশ স্বয়ম্ভু যে মহেশ্বর দেহে সমস্তই বিরাজিত, যিনি সর্ব অব্যয় অশান্ত, সমস্ত পদচর‍্যা যার মূর্তি যিনি জ্ঞানগম্য তার কীর্তনে।

সেসব অবিলম্বে বিনিষ্ট হোক। পরপত্নী ও পরদ্রব্যের অভিলাষ, অপরের প্রতি হিংসা পরপীড়া, পানভোজন জনিত পাপ যেন লবণের মতো নিঃশব্দে বিলীন হয়ে যায়। হরির সংকীর্তনে যেন সকল পাপ বিনষ্ট হয়। যে ভাবী নরকের পরিত্রাতা যাঁর হাতে কংস নিহত হয়েছে, যিনি অরিষ্ট, চান্ধর প্রভৃতি দেব শত্রুদের বধ করেন, যে বলিকে দমন করেন, যে দশাননকে স্বয়ং নিধন করেন, যে পুতনাকে বধ করেন, তাঁর জপ করলে সাত জন্মের জমা পাপ জলমগ্ন কাঁচা কলসীর মতো বিনষ্ট হবে।

যে ব্যক্তি প্রতিদিন তিলপূর্ণ ষোলো পাত্র দান করে তার ব্রহ্মচর্য অক্ষুণ্ণ হয়। এই সত্য বলে বালকের সর্বাঙ্গ রাক্ষস গ্রাস থেকে মুক্ত হবে। বালক তখন তাকে পবিত্র পাপ নাশক বিষ্ণুস্তোত্র বললেন। সরস্বতী এই স্তোত্রের প্রণেতা। এই স্তোত্র পাঠ করলে সমস্ত পাপ মুক্তি ঘটে। রাক্ষস তখন ব্রাহ্মণকে প্রণাম করে তপস্যার জন্য সেখানে গিয়ে ঘোর তপস্যায় মগ্ন হল, সে পাপ মুক্ত হয়ে বিষ্ণু লোকে স্থান পেল। পুলস্ত্য তখন বললেন, যে এই স্তোত্র পাঠ করে সে সমস্ত দুঃখ ও পাপ থেকে মুক্তি পায়।

৪৯

পুলস্ত্য বললেন– হে জগৎপতি, বাসুদেব, বহুরূপ, একশৃঙ্গ, বৃষাকপি, শ্রীনিবাস ভূ-অভাবন, নারায়ণ, বৃষধ্বজ, যজ্ঞধ্বজ, তালধ্বজ, গরুড়ধ্বজ, বরণ্যে, বিষ্ণু, পুরুষোত্তম, জয়ন্ত, বিজয়, জয়, অনন্ত, বৃতাবর্ত, মহাবর্ত, মহাদেব, অনাদি, সৃষ্টি গর্ভ, হিরণ্যগর্ভ, পদ্মলোচন কালনেত্র, কালণাভ, মহানাভ, কৃষিওমূল মথমূল, মূলাবাস, ধর্মাবাস, জলাবাস, স্ত্রীনিবাস ধর্মধক্ষ্য, প্রজব্যিক্ষ, আবোধ্যক্ষস, সেনকি কালবিক্ষ, হে গদরিক শ্রুতিধর, ধক্রধর, বলমালবির, ধরণীধর, তথিতসেন, মহাসেন, পুরুকঠুত, মহাকল্প কল্পশামুখ, সপ্ত, বিভু, বিবিঞ্চিত, শ্বেত, কেশব, নীর, মহানীল, অনিরুদ্ধ, হরিকেশ মহাবেশ, গুড়াকেশ, মুক্তকেশ, ঋষিকেষ, স্কুল, মহাস্থূল, মহাসৃষ্ম, ভয়ংকর, শ্বেত, পীতাম্বর, নীলবাস, হে কুশোশায়, পদ্মশায়, জলেশায়, গোবিন্দ, হংস, শাঙ্গধবজ, ব্রহ্মাশীষ, সহস্ৰনেত্র, অর্থবশিরা, মহাশীষ, ধর্মনেত্র, যজ্ঞবরাহ, বিস্বাতমা, বিশ্বাত্মাফর।

সাগ্নিক ব্রহ্মরা তোমার মুখ, ক্ষত্রিয়রা বাহু, বৈশ্যরা পিঠের দু’পাশ দুই, ঊরু থেকে ক্ষুদ্র জাতি, চোখ থেকে সূর্য, দুই পা থেকে পৃথিবী, কান থেকে দিবস সমূহ, নাভি থেকে অন্তরীক্ষ, মন থেকে চাঁদ, প্রাণ থেকে বায়ু, কাম থেকে ব্রহ্ম, ক্রোধ থেকে রুদ্র, মাথা থেকে স্বর্গ, স্বর্গ, উৎপন্ন হয়েছে। তুমি ব্রহ্মেস, শব্দব্রহ্ম বিদ্যা, বেধ্যরূপ, বন্দনীয়, বুদ্ধি, বোধ ও যোদ্ধা, হোতা, হোম, হয্য, হুয়মান, হব্যবাই, পুত ও পরকীয়া, নেতা নীতি, রক্ত পত্র,। উলুখন, যজমান, স্তক্ত্য যাচ্চ, উগাতা, জ্ঞেয়, যাজচ, মোক্ষ, যোগান্ত ঈশান, সর্পগামী, উগাকাস, দক্ষিণ, দীক্ষা, গন্থ, ধাতা পরম, নর-নারায়ণ, মাথাজন ও চন্দ্রের মতো রূপালী, শুভ, ভূতাদি, মহাভূত, অচ্যুত, দ্বিজ, উধ্ববাহু, এই স্তব করলে কোনো পাপ থাকে না।

৫০

পুলস্ত্য নারদকে দ্বিতীয় স্তব সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন। দেবেশ সূর্যকে নমস্কার করেন ত্রিবিক্রম, হয়শীর্ষ, গরুড়বাহন, জয়েশ, নরসিংহ রূপ ধর, কুরুধ্বজ, কামপাল, অমণ্ড ও ব্রাহ্মণপ্রিয়, অজিত, বিশ্বকর্মা পুন্ডরীক, শিব, বিষ্ণু, পীতাম্বর, শঙমী, পাপকিরণ স্থানু, ব্রহ্মপদী ভূষণ, কপদী, সাশী, সূর্য, হংস, হাঘকেশ্বর, মহাযোগী, ঈশ্বর, শ্রীনিবাস, পুরুষোত্তম, লকুড়েশ্বর, কুন্দমালী, পঙ্কিজাসন, শশিভ, উপেদ্র, অগস্ত্য, গরুড়, কপিল, ব্রহ্মব্ৰহ্মত্য পর, সুহাংসু, তপোময়, ধর্মরাজ, সর্বভূত, গন্ধ, শান্ত নির্মল, পাপনালকে প্রণাম করি, এই পাপ হন্তা দেবের শরণাপন্ন হলাম, অগস্ত এই স্ত্রোত্র পাঠ করেছিলেন।

পুলস্ত্য বললেন, প্রহ্লাদ তীর্থস্থানে বেরোলে বলি কুরুক্ষেত্র দর্শনে যাত্রা করলেন। সেখানে শুক্রাচার্যের নিমন্ত্রণ গৌতম, কৌশিক, অঙ্গিরস, শাস্ত্রজ্ঞ ঋষিরা কুরুজঙ্গলের উত্তরে শতদ্রু নদীর উত্তর তীরে হাজির হয়ে স্নান করে দেবগণের পূজা করলেন। মহর্ষিরা কিরণ, ঐরাবতী, ঐশ্বরী, দেবিকা ও পয়েষ্ণীতে নেমে ওপারে উঠে নিজেদের প্রতিবিম্ব দেখে তার কারণ চিন্তা করে বিস্ময়ভরা মন নিয়ে চলে গেলেন।

দূরে এক বন খণ্ড তাদের নজরে পড়ল। যা নিবিড় মেঘের মত শ্যামল। সাদা ও লাল পদ্মে ভরা বন দেখে তারা আনন্দিত হলেন এবং বনে প্রবেশ করলেন। সেখানে তারা পুণ্যপদ্ম দেখতে পেলেন। যা-চার দিকপাল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। পূর্বদিকে অবস্থিত ধর্মাগ্রাম পলাশ গাছে আবৃত। পশ্চিমের অর্থাশ্রম চাপাগাছে, দক্ষিণের কল্যাশ্রম কদলী ও অশোক বৃক্ষে, উত্তরে যোজ্ঞাশ্রম, বিশুদ্ধ স্থানটি আবৃত, এ স্থানে গিয়ে তারা অখণ্ডদেবের প্রতি অনুরক্ত হলো। বিষ্ণু অখণ্ড নামে প্রসিদ্ধ, ঋষিরা তার উপাসনা করে থাকেন। মহর্ষিরা শত্রুর সাথে অসুরদের ভয়ে এখানে বাস করতে লাগলেন। তখন ভৃগু ব্রাহ্মণদের ওপর প্রাত্যহিক যজ্ঞের কাজ দিয়ে শুক্রবলির মহাযজ্ঞে নিযুক্ত হলেন। ধাল সাদা কাণ্ড, মালা ও চন্দনে ভূষিত হলেন। বলি পত্নী বিদ্যাবলীও দীক্ষিত হলেন। চৈত্র মাসে এক সাদা ঘোড়া পৃথিবী প্রদক্ষিণের জন্য শুক্র ছেড়ে দিলেন। এভাবে ঘোড়া উৎসর্গের পর তিন মাস পার হয়ে গেল।

নারায়ণ ভূমিষ্ঠ হল দেব জননী অদিতির গর্ভ থেকে। সাথে সাথে ব্রহ্মা মহর্ষিদের সাথে নিয়ে তার স্তব করতে লাগলেন। ব্রহ্মা বললেন, হে পাপ দাবানল ভীষণ। যশোদার জগমূর্তি পীতবাস, স্ত্রীকাণ্ড অর্ধগামী, অনন্য পুরুষ সর্ববীধী বয়িরী, ধাতা, বিধাতা, সংহাস, মহেশ্বর, যোগীকে নমস্কার করি।

জগন্নাথ হরি ব্রহ্মার স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে তার উপনয়ন সাধন করতে বললেন, সবাই বাহ্মণকে নানা দ্রব্য দান করলেন। পুলহ যজ্ঞোপীত, পুলস্ত্য দুটি সাদা কাপড়, অগস্ত্য হরিণ-চর্ম, ভরদ্বাজ মেখলা, ব্রহ্ম নন্দন মরীচি পালা দণ্ড, বারুণি জপমালা, অঙ্গিরা কুশাসন, দেবরাজ ছাতা, ভৃগু জুতা ও বৃহস্পতি কমুণ্ডল দান করেন। ভরদ্বাজ বামনকে সামবেদ পড়ালেন। তিনি জ্ঞান সাগর হয়ে লোকাঁচার করলেন। সে তারপর কুরুক্ষেত্র যাবার অনুমতি চাইল ভরদ্বাজের কাছে।

৫১

ভগবান বললেন, প্রথম মৎসরূপ মান হ্রদে অবস্থিত। যার চিন্তা করলেই সকল পাপক্ষয় হয়। কূর্মরূপ কৌশিকী নদীতে, কৃষ্ণার তীরে হয় শীর্ষ, হস্তিনাপুরে গোবিন্দ, ত্রিবিক্রম, কেদার মাধব, বদরিকাশ্রমে নারায়ণ, বরাহে গরুড়ধ্বজ, ভদ্রকর্ণে জয়েশ, বিপাশা তীরে দ্বিজপ্রিয়, কৃতগৌচে নৃসিংহ, প্রাচীনে কামপল, বিতস্তায় কুমারিলা, গয়ায় গোমতি, দক্ষিণাচলে গোপাল পাঞ্চালিতে পাঞ্চতানিষ্ক, মহোদয়ে হয়গ্রীব প্রয়াগে যোগাশরী।

বারাণসীতে কেশব, পদ্মাতীরে পদ্মকিরণ, সমুদ্রে বড়বামুশ, কুমার ধারে, বহনে কার্তিকেয়, ওজসে শম্ভু, নর্মদাতীরে স্ত্রীপত মূর্তি, মাহেশ্মতীরে ত্রিনয়ন, মহাকাশীতে হংসযুক্ত পাপ বিলাপাতে, কস্থার মধুসূদন মূর্তির দেবীকার তীরে ভুধর, শঙ্খদ্বারে শঙ্খী, হস্তি প্রদেশে বিশ্বামিত্র, কৈলাসে বৃষধ্বজ মাহেশ, মহিলা, সশিষ্য কামরূপ, সিংহাসনে উপেন্দ্র, সুতলে অচল কূর্ম, দ্বিতলে পক্ক পঙ্কজানন মহাতলে বৃষলেশ্বর, পাতালে যোগী অধিশ্বর, ধরাতলে কোকনদ, মেদিনীতে চক্রপানি, ভূলোকে গরুড়, জনলোকে কপিল, ব্রহ্মলোকে ব্রহ্মা, সেবে সনাতন, কুপাদ্বীপ কুসোসয়, প্লক্ষদ্বীপে গরুড় বাহনে ঐন্বেত্ত পদ্মলাভ, সাস্মলে বৃষভজ, সাকে সহস্র পুস্করে বামন মূর্তি বিরাজমান, তিনি বিরাজিত ফালি গ্রামে, জলে, স্থলে, পর্বতে তার মূর্তি স্মরণ ও দর্শন করলে পাপ প্রশমিত হয় ও মোক্ষলাভ করে। বিষ্ণু ভরদ্বাজকে এসব বলে কুরুজঙ্গনোর উদ্দেশ্যে যাত্রা করল।

৫২

পুলস্ত্য বললেন, সমগ্র পৃথিবী কেঁপে উঠল, বলির যজ্ঞ ব্যাকুল হয়ে উঠল। বামনকৃতি বাসুদেব গমনোদ্যত হলে দানবরাজ বলি এই ভয়ানক কাণ্ড দেখে শুক্রাচার্যকে জিজ্ঞেস করলেন, কি কারণবশত সমগ্র পৃথিবী এভাবে দুলে উঠেছে? সাগর কেন ক্ষুব্ধ হয়েছে? নক্ষত্ররাজি কেন আকাশে শোভা পাচ্ছে না? তখন শুক্র বললেন, অগ্নি মহাসুরদের কাছ থেকে যজ্ঞ ভাগ গ্রহণ করছেন না। বাসুদেবের পদবিক্ষেপে এরূপ ঘটনা ঘটছে।

দিকসমুহে অন্ধকারে আবৃত হয়ে পড়েছে। সাগর উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। তখন তার কি করণীয়-বলি, শুক্রর কাছে জানতে চাইল। তাকে কি সে মণিরত্ন দান করবেন? নাকি নিজের ও তার কল্যাণের কথা বলবেন? শুক্র তখন বললেন, যে বলি মহাসুরদের যজ্ঞভাগ গ্রহণ করেছেন কিন্তু বিধান অনুযায়ী তার ভাগীদার দেবগণ, তাই বাসুদেব এখানে আসছেন।

এবার শুক্রাচার্য বলির করণীয় কর্তব্যের কথা বললেন। তিনি বললেন, বলি যেন মনের ভুলেও কিছু দান না করেন এবং যেন তাকে সন্তুষ্ট করবার জন্য বলেন, যে সমগ্র পৃথিবী ধারণ করে আছেন তাকে কিছু দান করার ক্ষমতা কার আছে? তখন বলি বললেন–যে, তিনি পথিককে প্রত্যাখ্যান করতে পারবেন না। তার ওপর তিনি স্বয়ং বাসুদেব। তখন শুক্রাচার্য বলিকে বোঝাবার জন্য প্রাচীনকালের মলয় প্রদেশের কোশাকার তনয়ের পৌরাণিক কাহিনি বলতে লাগলেন।

শুক্রাচার্য তখন কাহিনি শোনানোর জন্য কৌতূহল প্রকাশ করলেন। বলি বলল, তার পূর্বাভ্যাস বশে এই কাহিনি জানা। পূর্বে সমস্ত মহার্য মুদগলের বিখ্যাত পুত্র ছিল। সে জ্ঞান বিজ্ঞানে পারদর্শী ছিলেন। তার পত্নী ব্যাৎসায়ন কন্যা ধর্মিষ্ঠা তার গর্ভে জড়বুদ্ধিসম্পন্ন পুত্র ধর্মিষ্ঠা এই পুত্রকে সূতিকা গৃহের। দ্বার প্রান্ত ফেলে রাখলেন।

৫৩

সু-পক্ষী রাক্ষসীও তার রুগ্ন সন্তানকে সেখানে রেখে ব্রাহ্মণের পুত্রকে খাবার জন্য নিয়ে গেল, রাক্ষসীর অন্ধস্বামী ঘটোদর জানতে চাইল সে কি এনেছে? রাক্ষসী সব বললে ঘটোদর বলল, তার একাজ ঠিক হয়নি, কারণ বিজেন্দ্র কোশক ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেবেন। সে রাক্ষসীকে বলল এই পুত্রকে ফেরত দিয়ে অন্য কারো পুত্র নিয়ে আসতে। রাক্ষসী তৎক্ষণাৎ প্রস্থান করল।

এদিকে রাক্ষস কিন্তু সুতিকা গৃহের বাইরে কেঁদে উঠলে ধর্মিষ্ঠা স্বামীকে তা জানালেন এবং দ্বার প্রান্তে এসে শিশুকে দেখলেন গাত্রবর্ণে সে তার সন্তানের মতই দেখতে ছিল। তখন কোশাকার হাসতে হাসতে বললেন–যে শিশুটিকে ভূতে ধরেছে, কেউ ছলনা করার জন্য শিশুর রূপ ধরেছে। তখন কোশাকার রাক্ষস শিশুকে সেখানে বেঁধে রাখলেন। রাক্ষসী তখন ব্রাহ্মণ শিশুকে সবে ঘরে রাখলে কোশাকার তাকেও বেঁধে ফেলল। রাক্ষসী তার পুত্রকে নিতে পারল না। রাক্ষসী চলে গেলে কোশাকার পত্নী দুই শিশুকেই দুধ, দই, আমের রস খাইয়ে বড়ো করতে লাগল। ক্রমে তাদের বয়স সাত বছরের হলে পিতা নাম রাখলেন দিবাকর ও নিলাকর। রাক্ষস পূত্রের নাম দিবাকর। নিজ পুত্রের নাম নিলাকর।

দিবাকর বেদ পাঠ করতে লাগল। কিন্তু নিলাকর পারুল না, এর ফলে সকলে তার নিন্দা করতে লাগল। পিতা কোশাকার ক্রুদ্ধ হলেন, এবং তাকে এক জনশূন্য কূপে ফেলে তার ওপর পাথর চাপা দিলেন। সেখানে এলে কূপের মধ্যে এক আমলকী গাছের ফল খেয়ে সে বহু বছর কাটিয়ে দিল। এভাবে দশ বছর পর একদিন ধর্মিষ্ঠা পুত্র সেই কুয়ো থেকে চিৎকার করে বলতে লাগল, কে পাথর চাপা দিয়েছে। মায়ের গলা শুনে নিলাকর চিৎকার করে পিতার কথা বলতে ধর্মিষ্ঠা ভয়ে জানতে চাইল সে কে? সে নিজের পরিচয় দিলে ধর্মিষ্ঠা বলে তার একটি পুত্র নিলাকর। তখন সব ধর্মিষ্টা তা শুনে পাথর সরিয়ে দিলেন ও নিলাকর ভক্তিভরে মাকে প্রণাম করল। এরপর কোশাকারের কাছে সে এলে কোশাকার তার মূক, অজ্ঞ ও জড় হয়ে জন্মাবার কারণ জানতে চাইলেন। তখন নিলাকর বলল পূর্বে সে বৃন্দাকর নামক ব্রাহ্মণ ঘরে জন্মেছিল। পিতা দৃশকপি ও মা মালা, সে সর্বশাস্ত্রে পারদর্শী ও মাহাজ্ঞানী ছিল কিন্তু সে নানা দুষ্কর্মে লিপ্ত ছিল। তাকে লোভ ও মোহ গ্রাস করল। ক্রমে সে পরস্ত্রীও হরণে মগ্ন হল এবং পাপের ফলে গলায় দড়ি দিয়ে মরল এবং মরার পর রৌরব নরকে পতিত হয়ে হাজার বছর পরে মুক্তি লাভ করে গভীর অরণ্যে বাঘ হয়ে জন্ম লাভ করল।

একদিন এক পরাক্রমশালী রাজা তাকে খাঁচায় পুরল। বাঘ হলেও তার শাস্ত্রজ্ঞান জাগ্রত ছিল। রাজা একদিন একটি কাপড় পড়ে বাইরে গেলে তার স্ত্রী চিতা বাঘের কাছে গেলে পূর্ব স্বভাববশত তার কাম উদ্বেগ হল। তখন জিতা বলল যে, কিভাবে সে বাঘের সাথে রতি মিলন করবে? জিজি তখন বাঘকে রাতে খাঁচা মুক্ত করবে বলল, কিন্তু বাঘের আর ধৈৰ্য্য ছিল না। ফলে রাজপত্নী খাঁচা খুলে দিলেন এবং রতি কামনার বাঘ জিতাকে গ্রহণ করল। কিন্তু রাজ পুরুষরা তাকে দেখতে পেয়ে মুগুরের আঘাত করে ও দড়ি শেকলে বেঁধে ফেলল এবং ভয়ংকর ভাবে মারলে তার মৃত্যু ঘটল এবং নরকে পতিত হল।

হাজার বছর পর সাদা গাধা হয়ে অগ্নিবস্য ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মাল। তখনও তার অন্তরে শাস্ত্র জ্ঞান জাগ্রত ছিল। ব্রাহ্মণ পত্নীরা তাকে বাহন করে নিলেন। একদিন তার বিমতি পত্নী পিতৃগৃহে যেতে চাইলে অগ্নিবস্য তাকে গাধার পিঠে যেতে বললেন– সেই তন্বী গাধার পিঠে চেপে যাত্রা করল। মাঝে এক নদীর জলে স্নান করতে গেল। স্নান শেষে সে ভিজা কাপড়ে উঠে আসলে গাধা কামবশত তার দিকে ছুটে গিয়ে তাকে মাটিতে ফেলে দিল। তার অনুচররা লাঠি হাতে তাকে তাড়া করলে সে দক্ষিণে পালাল এবং দুরাত্মা গাধা শেষপর্যন্ত ফঁদে বাধা পড়ে মারা গেল।

দীর্ঘকাল নরক যন্ত্রণার পর শুকপাখি হয়ে জন্মাল। এক দুরাত্মা ব্যাধ তাকে বণিক পুত্রের কাছে বেচে দিল। বণিক তাকে যুবতীদের কাছে রেখে দিল। বণিক পত্নীরা তাকে ভাত ও পাকা ডালিম দিত। চন্দ্রাবতী নামক এক বণিক পত্নী খাঁচাখুলে শুককে একদিন বার করে তার সুপুষ্ট স্তনের উপর চেপে ধরল। তখন পাখির মনে কামভাব জাগল, কিন্তু বণিক পত্নী গলার হার পেঁচিয়ে শ্বাস রোধ হয়ে মারা গেল এবং শুক পুনরায় ঘোর নরকে নিমগ্ন হয়ে এক চণ্ডালের ঘরে ষাঁড় হয়ে জন্মাল।

একদিন চণ্ডাল তাকে গাড়িতে জুড়ে পত্নী সহ বনের দিকে চলল। চণ্ডাল পত্নী কিছুদূর যাবার পর গান গাইতে লাগল, ফলে ষাঁড় ভাবাবেগবশত পা পিছলে মাটিতে পড়ল এবং মারা গেল। এবার সে হাজার বছর নরক যন্ত্রণা ভোগ করল। তারপর সে ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মাল এবং শাস্ত্রের পূর্বাভ্যাস বশে তার বা শক্তি ফিরে এসেছে। ফলে সে কথা দিল আর পাপ কাজ করবে না। এখন শাস্ত্র পাঠই তার জীবিকা। তাই সে পাপকাজ থেকে পুণ্য লাভের জন্য তপস্যা করে।

নিশাকর তখন পবিত্র মুরারি সদনবদরি আশ্রমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করল। সে পূর্ব জন্মের অভ্যাস ত্যাগ করতে প্রস্তুত হল। তাই দান না করলে অগ্নিদাহের মতো পাপ ঘটে। বলি নারায়ণের ধ্যানে শুক্রাচার্যকে একথা বলে ছিলেন।

৫৪

পুলস্ত্য বললেন, বামনাকৃতি বিষ্ণু বলির যজ্ঞস্থানে এসে উচ্চস্বরে বললেন–এই যজ্ঞের ঋত্বিকগণ ওঁকার যুক্ত বেদের প্রতিমূর্তি। অশ্বমেধ যজ্ঞ সব যজ্ঞের সেরা, তাই যা উচিত মনে করেন করুন। বলি তখন অর্ঘ্য পাত্র নিয়ে দেবের সামনে এসে দেবকে বললেন,আপনাকে কি দেব অনুগ্রহ করে বলুন। মধুসূদন ভরদ্বাজের দিকে তাকিয়ে বলিকে বললেন, যে তার পুরুর পুত্র যজ্ঞ করতে চান কিন্তু অবস্থান নেই তাই বলিও যেন তাকে ত্রিপদভূমি দান করে। এরপর স্ত্রী ও পুত্রের দিকে তাকিয়ে রাজা বলি বলল যে এ শুধু আকারে বামন নয়, এর প্রার্থনাও ছোট, তাই মাত্র ত্রিপদ ভূমি চাইছে। বলি আবার হরিকে বললেন, আমার হাতি, ঘোড়া, ভূমি, দাসী, সোনা প্রচুর পরিমাণ আছে, আপনি যা চান বলুন।

বলি তাকে বলল, রসাতল, পৃথিবী বা স্বর্গের মধ্যে যে কোন একটি চাইতে। কিন্তু বিষ্ণু তাকে কেবল তিন পা জমি দিতে বলল। বলি তখন জলপাত্র হাতে নিয়ে বিষ্ণুকে যেই তিন পা ভূমি দান করল সাথে সাথে বিষ্ণুর করতলে দান করা জল পড়ল এবং তিনি জগন্ময় মূর্তি ধারণ করলেন। এবং তার পায়ে ভূমি, অন্তরীক্ষ, জানুতে তপোলোক, উরুতে মেরু, কোমরে কিছু দেবগণ, বস্তি প্রদেশে ও মাথায় মরুৎগণ পিতৌ কামদেব, আস্তকোয়ে প্রজাপতি উদরে বামে সাত সমুদ্র, উঠবে সমগ্র লোক বুক থেকে নাভি মূল পর্যন্ত গোমে নদী, কাঁধে রুদ্র, বাহুতে দিক। হাতে অষ্টবসু, হৃদয়ে ব্রহ্মা, অস্থিতে বজ্র, ঘাসে দেবমতো অদিতি। মুখমণ্ডলে সাগ্নিক ব্রাহ্মণ নিচের ঠোঁটে সকল সংস্কার ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ সহ যাবতীয়। কপালে লক্ষ্মী, দুই কান অশ্বিন কুমারের চোখের পাতায় কৃত্তিকা ও রোম রজিতে মহর্ষিগণ বিরাজ করতে লাগলেন। বিষ্ণু একটি মাত্র পা-তে সমগ্র জগত দখল করে নিলেন।

দ্বিতীয় পদক্ষেপে দেশের দক্ষিণে ও সূর্য বারে বিরাজ করত তৃতীয় পায়ের অর্ধেকে স্বর্গলোকে মহালোক, জনলোক ও তপোলোকে অধিকার করে। বাকি অর্ধেকে নভঃস্তল আবৃত করে ফেললেন বিষ্ণু বিশাল আকার ধারণ করে ব্রহ্মাণ্ড ভেদ করে নিরালোকে চলে এলেন। তার পদদেশ থেকে এক ভয়ংকর নদীতিপন্ন হয়। অপ্সরা তাকে বিষ্ণুপদী নামে স্তব করতে লাগলেন।

তৃতীয় পা সম্পূর্ণ না ফেলে সে বলিকে বাঁধবে বলল। তখন বলি পুত্র, বাণ তাকে বলল, আমার সৃষ্টি অনুযায়ী পিতা আপনাকে দান করেছে। তবে কেন আপনি পিতাকে বাকচাতুরিতে আবদ্ধ করতে উদ্যত হয়েছেন। আমার পিতাকে আবদ্ধ করবেন না। কারণ আপনিই বলেছেন যোগ্য পাত্রে দান করলে কল্যাণ হয়। বিষ্ণুকে দান করলে তো অশেষ ফল লাভ অবশ্যাম্ভাবী। প্রথমে আপনি বামচরণে ত্রিপাদ ভূমি প্রার্থনা করে এখন কেন বিশাল আকৃতি ধারণ করেছেন।

বলির পুত্রের কথা শুনে তার উত্তর দিলেন জনার্দন। প্রথমে তিনি তার সরীয় অনুসারে ত্রিপদ ভূমি দান করতে বলেছিলেন ও বলিও তাই করেছিলেন। কিন্তু বলি তো আমার দেহের পরিমাণ জানে তবে কেন অসংকোচে দেহপ্রমাণ ভুমি দান করে বসল? তবে তোমার পিতার কল্যাণে সে অবশিষ্ট পদদ্বয় দেবার ফলে সে কল্পকাল অবধি জীবিত থাকবেন। বিষ্ণু বানকে বললেন, সুতল নামক পাতালে গিয়ে নিরাময় দেহে বাস করতে। বলি বলল, সুতলে বাস করলে কোথা হতে ভোগরাশি আসবে। তখন বিষ্ণু তাকে ভোগ দ্রব্যের কথা বললেন– অবৈধ দান বেদান্ত রহিত, শ্রাদ্ধ ও ব্রত বিহীন অধ্যায়ন অনুষ্ঠান করলে, ফললাভ ঘটবে তাছাড়া ইন্দোৎসবে অনুষ্ঠানে তোমার উদ্দেশ্যে আচারকষ্টি মহোৎসব প্রবর্তিত হবে। এই উৎসব দীনদান নামে বিখ্যাত হবে। জনগণ দ্বীপ জ্বেলে পুস্পার্ঘ্য দিয়ে সযত্নে অর্চনা করবে। তোমার রাজ্যের উৎসব স্বনামে খ্যাত হবে।

বিষ্ণু এরপর প্রস্থান করলেন ও ইন্দ্রকে স্বর্গরাজ্য দান করলেন। দেবতারা যজ্ঞভাগ ভোজী হলেন। তিনি স্বর্গলোকে হাজির হলে সাশ্ব মহাসুরদের সঙ্গে অন্তরীক্ষে সৌৎ নামক প্রসিদ্ধ পুরী নির্মাণ করে যথেচ্ছ বিচরণ করতে লাগলেন। ময়দানব ধাতুনির্মিত ত্রিপুর নামে নগরে তারক প্রভৃতি অসুর ও আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে যথেচ্ছভাবে বিরাজ করতে লাগল। বাসুদেব স্বর্গে গেলেন, বলি রসাতলে বন্দি হল। বান এক সুদৃঢ় শোণিত নামক নগর নির্মাণ করে অসুরসহ বাস করতে লাগল। বিষ্ণু এভাবে বলিকে বন্দি করেছিলেন। এই কাহিনি শুনলে পাপক্ষয় হয় এবং পুণ্য লাভ হয়।

৫৫

নারদ বললেন, তিনি জানতে চান বিষ্ণু ইন্দ্রকে স্বর্গরাজ্য দান করে কোথায় গেলেন? পুলস্ত্য বললেন। বিষ্ণু ব্রহ্মার কাছে গেলেন এবং ব্রহ্মা তাঁর দেরির কারণ জানতে চাইলেন। বিষ্ণু বললেন–তিনি বলিকে বন্দি করেছেন। ব্রহ্মা তখন তার অ্যুত যোজন বিস্তৃত আকৃতি দেখে নিজেও দীর্ঘ আকার ধারণ করে তাকে ভক্তিভরে প্রণাম করে স্তব করতে লাগলেন- হে দেবাদিদেব, বৃষবলি, তালধ্বজ, মহাসেন, গুরুকেন, নীলা, স্থল, পীত, শ্বেত, প্রীতি বাস, কুশোয়, গোবিন্দ ওঁকার, বিশ্বদেবেন, বিস্বভূত, বিশ্বরূপ তোমা হতে উৎপন্ন, ব্রাহ্মণরা তোমার মুখ, ক্ষত্রিয় বাহু, বৈশ্য উরুযুগল এবং শুদ্র তোমার চরণ কমল থেকে উৎপন্ন হয়েছে। তোমার নাভিতে অন্তরীক্ষ, তোমার ক্রোধ থেকে শিব, মাথা থেকে স্বর্গ, দুই কান থেকে দিকসমূহ সমুৎপন্ন, তুমি নক্ষত্র, হুতাসন, পবিত্রা, ত্রাতা, অরণিধ্যের, যজ্ঞ, গাহ্য, ধ্যাতা, মাধব, কালি, মিত্রবরণ, ভূতাদি মহাভূত, অন্তর্কতা তোমায় প্রণাম।

ব্রহ্মার স্তবে তুষ্ট হয়ে বিষ্ণু তাকে বর চাইতে বললেন। তখন ব্রহ্মা বললেন, যে স্বয়ং বিষ্ণু যেন বামনরূপে চির দিন তাঁর ভবনে বিরাজ করেন। বিষ্ণুও তাই করলেন, এবং সকলে তার পূজা করলেন, –অপ্সরা নৃত্য ও দেবরমনীগণ গান করতে লাগলেন। বিষ্ণু স্বর্গে বামনরূপে সহস্ৰযোজন স্থান জুড়ে অবস্থান করলেন।

পুলস্ত্য বললেন, বলি রসাতলে গিয়ে নির্মাণ করলেন এমন একটি পুরী, বা নানা মণি-মাণিক্য খচিত ও বিশুদ্ধ স্ফটিকে নির্মিত। এর দ্বারদেশ মুক্তাজালে আবৃত। বলি এখানে পত্নীসহ সুখ ভোগ করতে লাগল। এই সময়ে বিষ্ণুর দৈত্যদেহ হরণকারী চক্র সেখানে এসে উপস্থিত হল এবং দৈত্যরা ভীত হল। তখন এক ঘোর কোলাহল শব্দ শোনা গেল এবং তা শুনে বলি তাড়াতাড়ি খঙ্গ তুলে নিতে বিন্ধ্যাকারি তাকে খঙ্গ কোষবদ্ধ করতে অনুরোধ করলেন। তখন তিনি চক্রের কথা বলিকে বললেন–এবং এই চক্রের পূজা করতে বললেন।

বলি তখন করজোড়ে চক্রের স্তব করতে লাগলেন। হরিচক্র স্তব করে বললেন– হরিচক্র সুদর্শন, সহস্রাংসু ও সহস্রাভ, যার তুঙ্গে শূলপানি, আর মূলে হিমালয়, আর সমূহে ইন্দ্র, সূর্য অগ্নি, জীব, বায়ু, জল, বাতাস ও আকাশ, যার নেমির বহিভাগে বালমিল্যাদি মুনিগণ বিরাজিত সেই সুদর্শনকে প্রণাম করি। পিতৃ ও মাতৃকুলের পাপ হরণ করে নাও। তোমার নাম সংকীর্তনে আমার আপদ দূর হয়ে যাক। ব্যাধি বিনষ্ট হোক। বলির হাতে পূজা নিয়ে চক্র অসুর হরণ করে নিয়ে পাতালে চলে গেলেন। এবং বলি বিপদগ্রস্ত হয়ে প্রহ্লাদকে স্মরণ করলেন। প্রহ্লাদ এলে তাকে অর্চনা করে বলি বলল যে, ভয়ানক বিপদে পড়েছি, উদ্ধার করুন।

প্রহ্লাদ পৌত্রের সুমতিতে তাকে ধন্যবাদ দিলেন। তিনি তখন বিধানের কথা বললেন। যারা ভব সাগরে পতিত, সংসার জ্বালরূপ, বায়ুবেগে দিশেহারা, বিষম বিষয় সলিলে মগ্ন, তাদের পথে বিষ্ণুরূপ ভালোই আশ্রয়স্থল, যম তার দূতদের কাছে বলে যে মাধব যার প্রতি প্রসন্ন তাকে ত্যাগ কর। প্রতি ইক্ষবাবু ভক্তিভরে বলেছিলেন, বিষ্ণু ভক্তরা যমের অধিকার বহির্ভূত। শ্রীহরির চরণ কমল পূজা করার শক্তি যাদের নেই তাদের হাত হাত নয়।

যে রসনা হরির সংকীর্তনে বিমুখ তার রসনাই নয়। যারা ত্রিবিক্রমের মূর্তির পূজা করে তাদের পক্ষে দেবতাগণসহ সর্বলোকের পূজা করা হয়। চক্রপাণির গুণরাশি আসে। যাঁরা মহাত্মা ব্যক্তি, তারাই স্বর্গগামী, সূক্ষ্ম ও অব্যক্ত বাসুদেবের দর্শন লাভ করে। বাসুদেবকে যথারীতি ধ্যান ও প্রণাম করলে পুণর্জন্ম হয় না, যে তার পূজা করে সে সংসার আবর্তে পতিত হয় না। যারা যথা সময়ে শয্যা ত্যাগ করে, তারা অতি বড় সঙ্কটে থেকেও পরিত্রাণ লাভ করে।

যারা কর্ণরূপ পত্রে হরিনাম রূপ সুধা পান করে তারা যাবতীয় সংকট থেকে মুক্তি লাভ করে ‘নমো নারায়ণায়’ সর্বার্থ সাধকমন্ত্র। বিষ্ণুর আশ্রয় প্রার্থীর পরাজয় নেই। বিষ্ণুর নামে গানে সকল বিঘ্ন দূর হয়। সকল তীর্থ দর্শন হয় তার নাম করলে। ত্রিসন্ধ্যা তার নাম করলে উপবাসের ফল লাভ হয়। শাস্ত্রনির্দিষ্ট নিয়মে হরির অর্চনা করলে পরম সিদ্ধিলাভ হবে। যারা নারায়ণকে সর্বদা স্মরণ করে তারা সংসার-সমুদ্রে অতিক্রম করে, যারা জনার্দনের ধ্যান করে তাদের চিত্ত পাপমুক্ত হয়। তার নামকারীরা বিষ্ণুলোকে স্থান পায়। যারা জন্মবধি নানা পাপ কাজ করেছে তারা হরির নাম ভক্তিভরে করলে পাপমুক্ত হয়ে অমৃত পানে তৃপ্ত হয়, শ্রদ্ধাশীল জনগণ সর্বদা তার ধ্যান ও নাম সংকীর্তন করবেন।

বলি বললেন, জনার্দনের আরাধনায় যে মোক্ষ লাভ হয় তা শুনলাম কিন্তু তার আরাধনা কিরূপে করবেন, কোন দান বিষ্ণুর পক্ষে প্রীতিকর ও কোন তিথিতে উপবাস করলে তিন সন্তুষ্ট হন। প্রহ্লাদ বললেন, জনার্দনকে ভক্তিভরে যা দান করা যায়। তাই তিনি সন্তুষ্ট চিত্তে, গ্রহণ করেন। ব্রাহ্মণদের পূজা করলেও জনার্দনের পূজা করা হয়। ব্রাহ্মণ শাস্ত্রজ্ঞ হোক বা না হোক তাকে অবমাননা করা উচিত নয়। ব্রাহ্মণই বিষ্ণু দিব্যসারীর তাই শ্রদ্ধাভরে তার অর্চনা করা উচিত।

তিথি বিষয়ে বিষ্ণু যাতে প্রীত হন– জাতী, কুন্দবান, চাপা, অশোক, করবী, যুথিকা, বকুল, পারিজাত, তিল, জবা, টগর ফুলের মধ্যে কেয়া ছাড়া অন্য সকল ফুল বিষ্ণুর পূজায় ব্যবহৃত হয়। নানা লতাপাতা, সাদা লাল পদ্ম, প্রবাল, দুর্বা, পত্রকোরক প্রভৃতি উপকরণ দিয়ে বিষ্ণু পূজা করতে হয়। এছাড়া কুমকুম, চন্দন, ধুনো, নাগকেশার, জাতীয়ফল, প্রিয়, ঘি, যব, গম, তিল, মুগ, শাল, মাষ–ধান হরির প্রিয় বস্তু, পবিত্র গোদান ভূমিদান এবং বস্ত্র ও অন্নদানে প্রীত হন। ফাল্গুনে ধান, কাপড়, কৃষ্ণতিল, মাঘে তিল ও ধেনু, চৈত্রে বস্ত্র, শয্যা ও আসন, বৈশাখে, জলপূর্ণ কলস, ধেনু, চন্দন ও তালবৃন্ত দান করতে হয়। যারা বিষ্ণু ভক্ত তারা স্ত্রীপুত্র নিয়ে সুখে বাস করে। যে বিধি মতো বিষ্ণুপুজা করে তার পাপ দূর হয়, সে অশ্বমেধের ফল লাভ করে।

যে পুরুষ বা নারী বামন পুরাণের কথা শোনে সে পৃথিবীতে পুণ্যতম। তার স্বর্ণ, ভূমি, গো, ঘোড়া, হাতি, লাভ হয়, রাজসূয় যজ্ঞের ফল লাভ হয়। বামন পুরাণ শুনলে সূর্য ও চন্দ্র গ্রহণে রত্নদান, বুভুক্ষু ব্রাহ্মণকে আত্মদান, পিতা, মাতাদের, জৈষ্ঠ্য ভ্রাতাকে গ্রহণ করলে যে ফল লাভ হয়, তা বামন পুরাণ পাঠের সমগোত্রীয়। আষাঢ়ে পাদুকা, ছাতা, লবণ, আমলকী ভাদ্রে পায়েস মধু, ঘি, লবণ ও গুড় মেশানেনা ভাত, আশ্বিনে উৎকৃষ্ট অশ্ব, বৃষ, দই তামা, লোহা, কার্তিকে রূপা, সোনা, দীপমণি ও মুক্তামালা। অগ্রহায়ণে খচ্চর, সাপ, দান ও চমর। পৌষে প্রাসাদ, নগর প্রভৃতি দান করবে, যে কেশবের জন্য মন্দির নির্মাণ করে সে সনাতন পবিত্র লোকে স্থান পায়, তার উদ্দেশ্যে ফুল ও ফল দান করলে ভোগরাশি উপভোগ হয়।

যে বিষ্ণু মন্দিরের যত্ন নেয় সে পাতকী, উপপতকী, মহা পাতকী হলেও পাপমুক্ত হবে এক বিষ্ণু মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। পরে বাসুদেবের মন্দিরে সোনার তৈরি দীপ, পাত্র, রূপার পতাকা ও বহু সুসজ্জিত নির্মাণ করেন। এখানে চারপাশে ফুল, ফল, লতা, পাতায় যে ভরা দেবদারু গাছের রমণীয় বাগান তৈরি করলেন। ফুল বাগান সহ সরিষার তেলের দীপ দান করলে নরক উদ্ধার হয়। আশ্রয় বলি বললেন। হরি মন্দির তৈরি করে সযত্নে ব্রাহ্মণদের অর্চনা করতে, সদাচার পবিত্র চিত্তদের বস্ত্র, অলংকার, রত্ন, ভূমি দান করে। ভগবান জগৎপতিকে আশ্রয় করলে তোমার কল্যাণ হবে ও অবসাদ মুক্ত হবে।

পুলস্ত্য নারদকে বললেন–প্রহ্লাদ বলিকে উপদেশ দিয়ে নিজ নগরে ফিরে গেলেন। তারপর বলি দেবশিল্পীকে দিয়ে কেশব মন্দির নির্মাণ করলেন। তিনি ও তার স্ত্রী সেই মন্দির প্রত্যহ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করতেন। প্রত্যহ নিজে দ্বীপে জ্বালিয়ে দিতেন এবং ধর্মীয় গান করতে লাগলেন। বলির ভক্তিকে জনার্দন সন্তুষ্ট হয়ে তাকে রক্ষার জন্য সচেষ্ট হলেন। তিনি দীপ্তমান মুষল নিয়ে বলির দ্বাররক্ষক হলেন। ফলে কোনো শত্রু প্রবেশ করতে পেল না। বলি নারায়ণের দ্বারদেশ দেখে তাঁকে প্রাসাদের অভ্যন্তরে পূজা করতে লাগলেন। প্রতিদিন হরির পাদপদ্ম পূজা ও নামগান করে তার কাল কাটতে লাগল।

তার স্মৃতিপথ জাগরূক হল পিতামহ প্রহ্লাদের উপদেশে। এই উপদেশ ইহলোক ও পরলোকের পথ্য স্বরূপ, বয়োজ্যেষ্ঠদের উপদেশ আপাত মধুর না হলেও সুফল দান করে পরিণাম সুখে ও নির্বিঘ্নে তার কাল কাটে। যে ব্যক্তি বৃদ্ধ ব্যক্তির উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে তা সর্ববিশেষ মুক্তির সমযুক্তি দেয় সোমরসের তৃপ্তির চেয়ে বৃদ্ধব্যক্তির উপদেশাবলি বেশি তৃপ্তিকর। যারা গুরুজনের উপদেশ অবহেলা করে তারা মরার মত বেঁচে থাকে। তারা স্বজনের করুণার পাত্র হয়, যে ব্যক্তি কায়মনোবাক্যে গুরুজনের উপদেশ মানে তার সিদ্ধি লাভ ঘটে। এই বামন পুরাণ সবিস্তারে বললেন–পুলস্ত্য–যা শুনলে ব্যাধি, পাপদূর হয়। যে বিষ্ণুর প্রতি ভক্তিবান হয়ে বামন পুরাণ শোনে তাকে গো, ভূমি ও সোনা দান করতে হয়। এব্যাপারে অন্যথা হলে পুরাণ শ্রবণ নিফল। যে ব্রাহ্মণ ত্রিসন্ধ্যা এই পুরাণ শুনবে বা পাঠ করবে তার যাবতীয় সম্পদ লাভ হবে।

Pages: 1 2 3 4 5
Pages ( 5 of 5 ): « পূর্ববর্তী1 ... 34 5

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *