বাদামী – 1
নামটা বাদামী হলেও,সেই মেয়ের রঙটা কিন্তু ঝকঝকে তামার মতো। তাই আরও বেশি টানে ঐ মেয়ে। একে খাসা রঙ তায় নজর কাড়া চিবুকের ঢল।কপোলে লালের আভা। মোতির মতো দাঁতের সারি,কথায় কথায় চমক ফেলে। সুবোধ সিং এর ঐ এক মাত্র মেয়ে। মায়ের পায়ে পায়ে বেড়ে ওঠা বাদামী। ছোট থেকেই মায়ের চোখের জল দেখেছে। সেই জল মুছিয়ে দিয়েছে।মায়ের কষ্ট ভোলাতে মাকে জড়িয়ে ধরেছে।সেই ছোট্ট বেলায় মায়ের চোখের জলের কারণ না বুঝলেও বড় হয়ে সব বুঝেছে। বাদামীর বাবা ,সুবোধ সিং এর রাতের আসরে রস পানের অভ্যাস। ঘরে ফিরেই সেই সেই রসের ফল স্বরুপ খোলতাই বুলি বর্ষণ। তার সঙ্গে আসুরিক শক্তির প্রয়োগ বাদামীর মা অর্থাৎ শশীর উপর। রেলওয়ে কলোনী,নাম বি.আর.আই.কলোনী। সুবোধ সিং রেলওয়ে ব্রিজ মিস্ত্রি। রেল কলোনীতেই
তার বাস। সংসার খারাপ চলার কথা না,তবে ঐ রাতের আসরটাই সব মাটি করেছে।
প্রথম থেকেই সুবোধ সিং রাতের বেলা বেড়িয়ে গেলে ঘর খানা যেন শশীকে খেতে আসত।মেয়ে হবার পর শশীর সেই একাকীত্ব ঘুঁচেছে। রাতের খাওয়া সেরে, মেয়েকে জড়িয়ে শশী রাত পার করে দিত।
আতরের গন্ধে শশীর চিন্তা ছুটে যায়। সুবোধ সিং এর সাজের বহর দেখেই বোঝা গেল যে আজ সে তাড়াতাড়ি বারমুখো হবে। এখন মেয়ে কথা বলতে শিখেছে তাই অনেক কথার জবাব মেয়েকে দিতে হয়। মেয়ে বড়ো না হলেও মেয়ের চোখে চোখ ফেলতে লজ্জ্বা করল শশীর। যে স্ত্রী তার মরদকে বাগ মানাতে পারে না তার মরণ ও ভালো। কিন্তু শশীর মরণের ও উপায় নেই। অমন এক রত্তি মেয়েকে এ রকম একটা মরদের কাছে রেখে মরেও সুখ নেই শশীর। —–ও মা,বাবুজী বাহার গেলে তুমি রাগ করো কেন?
—,–আমার রাগ দেখছিস।
—না ,তোমার মন খারাপ হয় কেন?বাবুজী বাহার গেলেই তো ভালো। ঘরে থাকলে খালি চেল্লাবে।
——সে তুই বুঝবি না।
মায়ের চোখ উপচানো জল দেখে থেমে গেছে বাদামী। মায়ের কোল ঘেঁষে বসেছে। পড়তে শুরু করেছে, ‘ক’ -সে কোয়েল। ‘খ’ –সে খরগোস। পড়তে পড়তে বলে—-ও মা আমি হিন্দি পড়বো
না।বাংলা পড়ব।
——-বিটিয়া, হিন্দি তোর আপনা ভাষা।কেন পড়বি না?সব পড়বি। বাংলা ভি পড়বি,ইংরাজি ভি পড়বি। বোল বিটিয়া তুই খুব পড়বি?
—-হ্যাঁ মা,আমি খুব পড়বো।
—-তুই বড় হয়ে মাস্টারনি বনবি তো?তাহলে আমার মতো কষ্ট পাবি না। খুব ভালো থাকবি।
——হ্যাঁ মা,আমি খুব পড়বো । মাস্টারনি বনবো। তোমাকে ভালো রাখবো। বলো ,তুমি কাঁদবে না? কাঁদতে কাঁদতে শশী মেয়েকে বুকে টেনে নিয়েছে।
——না না, আর কাঁদবো না।
বাদামী -2
রাতের খাওয়া শেষ হতে রাণী বিটিয়াকে বুকে নিয়ে শুয়ে পড়েছে শশী।মেয়েকে জড়িয়ে স্বামীর অন্যত্র যাবার জ্বালাটা জুড়োয় শশী।মেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে নিজেকে মেয়ের থেকে আলগা করে নিয়েছে। মরদ এলে দরজা খুলতে হবে ভেবেই আলগা করা,পাছে মেয়ে জেগে যায় এই ভয়।
ঘুমিয়ে পড়েছিল শশী।জেগে গেল সুবোধ সিং-এর খিস্তি খেউরে। লোক লজ্জার ভয়েই ছুটে গেল দরজায়। রেলওয়ে কলোনি, একেবারে নিঃঝুম এ সময়টা। রাত দশটার মধ্যে সব কোয়ার্টার এর বাতি নিভে যায়। সুবোধের চিৎকার আরও বেড়ে গেল।
—–কি রে?কোন নাগরকে নিয়ে শুয়ে আছিস?খোল দরজা, রন্ডি কাঁহিকা ।
—-চুপ করো।মেয়ে জেগে যাবে। –চাপা গলায় বলল শশী।
—-কেয়া, হমে শিখাতি হ্যাঁয়?হমে আঁখ দিখাতি হ্যায়?
ঐ হুঙ্কারেই জেগে গেছে বাদামী। শুনলো বাবার গালাগাল। সবই মায়ের উদ্দেশে। বুক হিম করা কষ্ট ঠক্ ঠক্ করে কেঁপেছে। মুখে বালিশ চেপে কান্না চেপেছে।গলা ব্যথা হয়ে গেছে, তবু ও শব্দ করেনি
বাদামী। শশী এসেছে। বুকে জড়িয়ে ধরেছে মেয়ের অবস্থা দেখে।বুঝেছে মেয়ের কান্নার কারণ।
——–মৎ রো বিটিয়া। মেয়ে হুঁ না?শো যা। বাদামী শক্ত হয়ে থেকেছে মায়ের বুকে। ওটা দৈত্য! যে দৈত্য টা ওকে স্বপ্নে ভয় দেখায়। ইয়াঁ বড়া গোঁফ আর হাতির মতো দাঁতওয়ালা দৈত্য টা!কেঁপে উঠেছে
বাদামী। শশী আবার অভয় দিয়েছে।
——ডর মৎ।তুঝে কুছ নহি করেগা। চিৎকার এসেছে ও ঘর থেকে ।
—-শশী—-।বলতে বলতেই এ ঘরে এসেছে সুবোধ সিং।
——শালী,আপনা মরদ ছোড়কে দুসরা মরদ ধরলি? রন্ডি কহিকা!বেশি নখড়াবাজি করবি না। শশীর চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেছে পাশের ঘরে।