Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বাঁচা মরা || Syed Mustafa Siraj

বাঁচা মরা || Syed Mustafa Siraj

বাঁচা-মরা

অনেক বছর পরে গ্রামে যাচ্ছি। ট্রেন লেট করেছিল। স্টেশনে নেমে দেখি শেষ

বাস চলে গেছে রাত নটায়। এখন বাজছে প্রায় দশটা। গ্রাম ছয় মাইল দূরে। কী করব ভেবে পেলুম না।

কয়েকটা সাইকেল রিকশো দাঁড়িয়েছিল। তাদের সাধাসাধি করলুম। এত রাতে কেউ অত দূরে যেতে রাজি হল না। তখন হতাশ হয়ে একটা চায়ের দোকানে গেলুম চা খেতে।

এমনসময় রোগা হাড়গিলে চেহারার হাফপেন্টুল আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরা লোক এসে হঠাৎ বলল, স্যার কি রিকশো খুঁজছিলেন? কোথায় যাবেন?

–হ্যাঁ। যাব দোমোহানী।

–আসুন তবে। লিয়ে যাই। চন্ডীতলার একজন পেসেঞ্জার পেয়েছি। পথে আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাব। ওই দেখুন আমার রিকশো। আনন্দে লাফিয়ে উঠলুম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলুম, একটু তফাতে গাছতলায় একটা রিকশো দাঁড়িয়ে আছে। তাতে একজন লোক গুটিসুটি বসে আছে। গাছের পাতার ফাঁকে কুচিকুচি আলো পড়েছে মাছের আঁশের মতো। পাঞ্জাবিধুতিপরা লোকটাকে প্রৌঢ় বলে মনে হল। কোলে একটা ব্যাগও আছে। চুপচাপ বসে আছে।

শিগগির চা খেয়ে আসুন।–বলে রিকশোওলা চলে গেল। ভাড়ার কথা তোলার ইচ্ছে হল না। যা চায় দেব। এমন বিশ্রি অবস্থায় কখনও পড়িনি। আর স্টেশনটা এমন অখাদ্য জায়গায়, বাজার বা বসতি মাইলটাক দূরে। সেখানে গিয়েও যে রাতের আশ্রয় পাব, ভরসা নেই।

চা-ওলা আমার মুখের দিকে তাকিয়েছিল। এতক্ষণে বলল,–স্যার, ওহিদের রিকশোয় যাবেন না। বরং ওই সিংহবাহিনীর মন্দিরে যান। ধর্মশালা আছে।

আমি জানি, হিন্দু মন্দিরে অথবা ধর্মশালায় আমাকে থাকতে হলে জাত উঁড়িয়ে থাকতে হবে। সে মিথ্যাচারিতা সম্ভব নয়। তাই বললুম–থাক। কিন্তু ওর রিকশোয় গেলে ক্ষতি কী বলুন তো?

চা-ওলা চাপা গলায় বলল, আপনি নতুন লোক বলেই বলছি। ওহিদ ওর রিকশায় মড়া বয়।

হেসে বললুম,–মড়া বয়? আমি ভাবলাম বুঝি চোর-ডাকাত!

–না না। লোক খুব ভালো। তবে দোষের মধ্যে ব্যাটা রিকশোয় মড়া বয়। তাই চেনা-জানা কেউ ওর রিকশোয় চাপে না। চাওলা ফের ষড়যন্ত্রসংকুল গলায় বলল,-রাত বিরেতে মড়াবওয়া রিকশোয় চাপতে নেই। আমি একবার ভারি বিপদে পড়েছিলুম জানেন? আসছিলুম মেয়ের শ্বশুরবাড়ি সেই হরেকেষ্টপুর থেকে। বেয়ানের সঙ্গে একটুখানি কথা কাটাকাটি হয়েছিল! তাই…

ওহিদ রিকশাওলা এসে তাড়া লাগাল, আসুন স্যার। রাত বেড়ে যাচ্ছে। তক্ষুনি উঠে পড়লুম। চা-ওলা খুব জমিয়ে নিশ্চয় ভূতের গল্প বলতে চাইছিল। বাধা পেয়ে গোমড়ামুখে বসে রইল।

আমার সঙ্গী ভদ্রলোক চোখ বুজে বসে আছে। মনে হল, ঘুমোচ্ছেন। অনেকের এ অভ্যাস থাকে। তাছাড়া যেচে পড়ে কারও সঙ্গে আলাপ করার স্বভাব আমার নেই। রিকশো ধীরেসুস্থে চলেছে। ওহিদ রিকশাওলা তেমন শক্তসমর্থ জোয়ান নয়, তা ওর গঠন দেখেই টের পেয়েছিলুম।

কিছুক্ষণ পরে কৃষ্ণপক্ষের ভাঙা উঁদ উঠল। হালকা জ্যোৎস্না ছড়াল পৃথিবীতে। এসব সময়ে এই নির্জন রাতের পথে স্বভাবত ঘুম-ঘুম আচ্ছন্নতা এসে যায়। কিন্তু ইন্দ্রিয় সজাগ রাখা দরকার। না, ভূতের ভয় দেখিয়েছে বলে নয়, নেহাত চোর-ডাকাতের ভয়েই। ভাবলুম, রিকশোওলার সঙ্গে গল্প করা যাক। তাই বললুম–ওহে, তোমার নাম বুঝি ওহিদ?

রিকশাওলা জবাব দিল,–হ্যাঁ, স্যার।

–তুমি থাকো কোথায়?

–আজ্ঞে, হরিণমারা-গোপপাড়ায়। ইস্টিশনের ওপাশেই আমাদের গাঁ বলে সে আকাশের দিকে মুখ তুলে হাঁ করে দম নিল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে চাঁদ দেখে ফিরে বলল,-বড় গাঁ, স্যার। ইস্কুল-পোস্টাপিস-থানা-হাসপাতাল সবই আছে।

এরপর সে তার গ্রাম সম্পর্কে মোটামুটি একটা ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক বিবরণ দিতে থাকল। লোকটির প্রতি আমার আকর্ষণ বেড়ে গেল।

এই করে প্রায় মাইলটাক আসা গেল। তারপর বেমক্কা হাসতে-হাসতে বলে বসলুম, হ্যাঁ, তুমি নাকি এই রিকশোয় মড়া বও?

ওহিদ প্যাডেল থামিয়ে আমার দিকে ঘুরে ফাঁচ করে অদ্ভুত হেসে বলল– নেতদা বলল বুঝি? নেত্যদাটা ভারি দুষ্টু। আমার প্যাসেঞ্জারকে ভাঙচি দেয় খালি। কী আর বলব বলুন? এক জায়গায় আড্ডা দিই। তাসটা-আরটা খেলি। বলতে গেলে বন্ধু মানুষ। তা স্যার, ইচ্ছে হলে চলুন আমার গাড়িতে। না ইচ্ছে হলে নেমে যান। ভেবে দেখুন এখনও।

সর্বনাশ! বলে কী? ব্যস্তভাবে বললুমনা, না। মড়া বও তাতে কী হয়েছে?

ওহিদ প্যাডেলে আস্তে চাপ দিয়ে বলল ইস্টিশনের পেছনে মা গঙ্গা। নানা জায়গার মড়া যায় সেখানে। আমি মড়া বই। দোষ কী বলুন? তিনগুণ ভাড়া পাই। বইব না কেন? জ্যান্ত প্যাসেঞ্জার কি আমায় স্বগগে নিয়ে যাবে?

–ঠিকই তো। বরং মড়া বইলে অনেক পুণ্যি! মড়ারা তো স্বর্গের পথেই পাড়ি জমায়। আগে থেকে চেনা-জানা থাকা ভালো। নেহাং পাপ করে থাকলে তাদের কেউ কেউ স্বর্গে ঢুকতে পায় না। নরকে বেঁধে নিয়ে যায়!

ওহিদ আমার কথায় খুশি হল!–তাহলেই দেখুন! তবে আসল কথা কী জানেন স্যার? মড়া বওয়া সহজ কাজ নয়। সবাই এটা পারে না। ইস্টিশনের যত রিকশাওলা আছে, কারুর কি এ সাধ্যি হতো? হ্যাঁ, পারলে তো সবাই বইত। তিনগুণ বেশি পয়সা পেত। কিন্তু মুরোদে কুলোয় না বলেই হিংসে করে আমায়।

–তাই বুঝি?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। মড়া পেসেঞ্জার নিয়ে রিকশোর প্যাডেল ঘোরানো সোজা নয়। শালারা কি ভেতরে-ভেতরে চেষ্টা করেনি কেউ? সব জানি বাবা। পারেই নি। একবার গোবর্ধন রেতের বেলায় চুপি-চুপি মড়া চাপিয়েছিল। পরদিন সকালে দেখি, রিকশো নয়নজুলির জলে উলটে পড়ে আছে মড়া সুদ্ধ। সে এক কেলেঙ্কারি।

ওহিদ খুব হাসতে লাগল। আমি বললুম,–গোবর্ধনের কী হল?

–গোবর্ধন বেগতিক বুঝে রিকশোর সিট থেকে লাফ দিয়ে পালিয়েছিল। তাই রক্ষে। তো সেই থেকে সে মড়া দেখলে সরে যায় তফাতে।

–তা ওহে ওহিদ, তুমি কীসের জোরে মড়া বইতে পারো বলো তো শুনি?

–ওহিদ হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। একটু পরে বলল, আমি নিজেই এক মড়া।

–তার মানে?

–মড়া বইকী। কারণ, আমাকে একবার জানঘরে দিয়েছিল।

–জানঘর! সে আবার কী?

–বলতে গেলে সে বড্ড দুঃখের কথা স্যার। আমার পেটে শুলের ব্যামো হয়েছিল। সদর হাসপাতালে ভর্তি হলাম। দেখে থাকবেন। হাসপাতালের একধারে একটা আলাদা ঘর থাকে। রুগি মারা যাবে টের পেলে কিংবা মারা গেলে সেই ঘরে রেখে আসে। তাকে বলে জানঘর। তো আমাকে সেই জানঘরে রেখে এসেছিল ডাক্তারবাবু।

–বলো কী? তারপর?–ডাক্তারবাবু আমার নাড়ি খুঁজে পায়নি। খাবি খেতে খেতে মারা পড়েছিলুম।

–অ্যাঁ! সর্বনাশ!

–আজ্ঞে খোদার কসম। তো রোজ সকালে বউ খোঁজ নিতে যায় আর আমায় গালমন্দ করে আসে। এভাবে হাসপাতালে পড়ে থাকলে সংসারী লোকের চলে? ছেলেপুলে উপোস করে মরছে যে! বউ ভারি চটে গিয়েছিল। রোজ এসে বলত– মিনসের সব চালাকি! রিকশো টানতে আলস্যি। তাই হাসপাতালে এসে মিছিমিছি পড়ে আছে। টাইমে-টাইমে দিব্যি পেটপুরে খেতে পাচ্ছে। বউ বোজ গিয়ে গালাগালি করত। আমায় জানঘরে দেওয়া শুনে বউ আরও চটে গেল। বাড়ি থেকে একটা মুড়ো ঝটা এনে জানঘরের দরজায় গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ন্যাকামির আর জায়গা পাওনি? ওঠো, ওঠো বলছি। পড়ে আছো আর এখানে আমরা উপোস করে মরছি। না ওঠো তো, পিঠের চামড়া কঁঝরা করে দেব। এই বলে যেই আঁটা তুলেছে, আমি স্যার তড়াক করে উঠে পড়েছি।

–সর্বনাশ!

–সর্বনাশ বলে সর্বনাশ! আমার বউকে তো স্যার দেখেননি।

–তারপর কী হল?

–দেখতেই পাচ্ছেন। রিকশোয় প্যাডেল ঘোরাচ্ছি। সে হাঁ করে দম নিয়ে ফের চাঁদটা দেখার পর বলল, আমি জানঘর থেকে পালিয়ে আসা মড়া, স্যার। আমি কেন মড়ার ভয় পাব বলুন?

সে ফ্যাঁচ করে অদ্ভুত হাসল এবার। এতক্ষণে তার মুখের একটা পাশ, একটা চোখ অব্দি দেখতে পেলুম ফিকে জ্যোৎস্নায়। নীল ঝকঝকে ওই চোখ কি জ্যান্ত মানুষের? আমার গা ছমছম করল।

এই সময় হঠাৎ দেখি, আমার সঙ্গী যাত্রীটিও এতক্ষণে একটু নড়লেন এবং গলার ভেতর খিকখিক করে হেসে উঠলেন। চোখও খুললেন।

ভয়ে ভয়ে বললুম, কী হল মশাই? হাসছেন কেন?

ভদ্রলোক ভারি গলায় বললেন,–কে জ্যান্ত কে মড়া বোঝা ভারি কঠিন। এই আমায় দেখছেন, বলুন তো আমি জ্যান্ত না মড়া?

–মড়ারা কথা বলে না। আপনি তো দিব্যি কথা বলছেন?

–বলে মশাই, বলে। আপনি জানেন না, সে আলাদা কথা। বলে ভদ্রলোক ফের খিকখিক করে হাসতে থাকলেন।

পাগল নাকি? বললুম–নিজেকে বুঝি আপনি মড়া ভাবেন?

–ভাবব কী মশাই? আমি যে সত্যি-সত্যি মড়া!

–বলেন কী?

–হুঁউ! ওই যে ওহিদ বলল, সে জানঘর থেকে পালিয়ে এসেছিল বউয়ের আঁটার ভয়ে। আমিও আজ জানঘর থেকে পালিয়ে এসেছি জানেন?

–আপনিও কি বউয়ের ভয়ে পালিয়ে এসেছেন?

ভদ্রলোক জোরে ঘাড় নেড়ে বললেননাঃ! আমার মশাই বউটউ নেই।

–তাহলে?

–ডাক্তারবাবুর ভয়ে। মশাই সবে মারা গেছি–ডাক্তারবাবু কিনা ইয়াবড় ছুরি বাগিয়ে আমাকে টুকরো-টুকরো করে কাটার ফন্দি এঁটেছেন।

–পোস্টমর্টেম বলুন।

–ঠিক বলেছেন। তো যেই ছুরিটা আমার বুকের দিকে এনেছেন, অমনি একলাফে উঠে ডাক্তারবাবুকে ধাক্কা মেরে হটালুম। কারা চেঁচাল, ধর ধর। পালাচ্ছে, মড়া পালাচ্ছে। আমি ততক্ষণে পগার পার। বাপস, আর ভুলেও হাসপাতালে নয়।

ভদ্রলোক খিকখিক করে ফের হাসলেন। ওহিদ সায় দিয়ে বলল, কখনও নয়। ভাগ্যিস, মারা গিয়েছিলুম বলেই না উচিত শিক্ষেটা হল।

ভদ্রলোক হাসি থামিয়ে আমার দিকে ঘুরে বললেন,–যাকগে। এবার আপনারটা শোনা যাক।

–আমার কী?

–লজ্জা কীসের মশাই? লুকোছাপা করে আর কী লাভ বলুন? এখানে তো কোনও জ্যান্ত মানুষ নেই। প্রাণ খুলে বলে ফেলুন, আপনি কীভাবে…

–কী মুশকিল! আমি হাসপাতালেও যাইনি। আপনাদের সেই জানঘর কিংবা লাসকাটা ঘরেও আমায় ঢোকানো হয়নি। আমি যাচ্ছি অনেক বছর পরে জন্মভূমি দেখতে।

ভদ্রলোক ধমক দিলেন,–চালাকি হচ্ছে? আমরা মড়া চিনি না? কী রে ওহিদ, বল না বাবা!

ওহিদ ফাঁচ করে হাসল। স্যারকে দেখেই চিনেছিলুম। নইলে কেনই বা নিজে গিয়ে সাধব?।

রেগে গিয়ে বললুম, আমি মড়া নই, জ্যান্ত মানুষ। নাড়িটা টিপে দেখুন না।

ভদ্রলোক গম্ভীর গলায় বললেন,-ারে ওহিদ, তাহলে কি ভুল করেছিস বাবা?

ওহিদ জোর গলায় বলল, আমার ভুল হতেই পারে না। এতকাল মড়া ঘাটছি।

ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে বললেন–দেখি, আপনার নাড়ি দেখি। বলে খপ করে আমার হাতের কব্জি ধরে ফেলতেই টের পেলুম, কী ঠান্ডা বরফের মতো ওঁর হাতটা। আর চোখের ওই দৃষ্টিআবছা জ্যোৎস্নায় জুলজলে নীল দুই চোখের দৃষ্টি।

হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চলন্ত রিকশো থেকে লাফ দিলুম। আছাড় খেয়েই উঠে পড়লুম! তারপর দিগ্বিদিক না দেখে দৌড়-দৌড়। পেছনে ওরা চেঁচাতে থাকল– ধর ধর। পালাল পালাল।

স্টেশনের আলো লক্ষ করে দৌড়াচ্ছিলুম। হাঁফাতে-হাঁফাতে যখন সেই চায়ের দোকানে পৌঁছলুম, বিজ্ঞ চা-ওলা হেসে বলল, জানতুম। তখন নিষেধ করলুম, শুনলেন না। সোজা ধর্মশালায় চলে যান। সকালে রওনা হবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress