Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বহ্নি পতঙ্গ – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 14

বহ্নি পতঙ্গ – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

দশ মিনিট পরে ব্যোমকেশ এক্কা থামাইতে বলিল। আমি এক্কা হইতে নামিয়া ধোঁয়াটে আলোয় ঠাহর করিয়া দেখিলাম‌, দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়ির কোণে ডাক-বাক্সের নিকটে উপস্থিত হইয়াছি। ব্যোমকেশ এক্কাওয়ালাকে ভাড়া ও বিকশিস দিল।

‘সালাম বাবুজি।’

অন্ধকার-সমুদ্রে ভাসমান ধোঁয়াটে আলোর একটা বুদ্বুদ ঝুনঝুন শব্দ করিতে করিতে দূরে মিশাইয়া গেল। আমরা যে তিমিরে ছিলাম। সেই তিমিরে নিমজিত হইলাম।

‘এবার কী? দেশলাই জ্বালব?’

ব্যোমকেশ উত্তর দিবার পূর্বেই চোখের উপর তীব্র আলো জ্বলিয়া উঠিল; হাত দিয়া চোখ আড়াল করিলাম। ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘কে-সাব-ইন্সপেক্টর তিওয়ারী?

‘জি।’ তিওয়ারী টর্চের আলো মাটির দিকে নামাইয়া আমাদের কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। মাটি হইতে উত্থিত আলোর ক্ষীণ প্রতিভাস আমাদের তিনজনের মুখে পড়িল। সকলের.গায়ে কালো পোশাক‌, তিওয়ারীর কালো কোটের পিত্তলের বোতামগুলি চিকমিক করিতেছে।

‘আপনার সঙ্গে ক’জন আছে?’

‘দু’জন।’ বলিয়া তিওয়ারী আলো একটু পিছন দিকে ফিরাইল। দুইটি লিকলিকে প্রেত্যকৃতি পুলিস জমাদার তাহার পিছনে দাঁড়াইয়া আছে।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশ‌, দু’জনই যথেষ্ট! কি করতে হবে ওদের বলে দিয়েছেন?’

‘জি।’

‘তাহলে এবার একে একে গাছে ওঠা যাক। অজিত‌, তুমি সামনের গাছটাতে ওঠে। চুপটি করে গাছের ডালে বসে থাকবে‌, সিগারেট খাবে না। বাঁশীর আওয়াজ যতক্ষণ না শুনতে পাও ততক্ষণ গাছ থেকে নামবে না। —তিওয়ারীজি‌, টর্চটা আমাকে দিন।’

টর্চ লইয়া ব্যোমকেশ একটা আম গাছের উপর আলো ফেলিল। ডাক-বাক্স হইতে পাঁচ-ছয় হাত দূরে বেশ বড় আম গাছ‌, গুড়ির স্কন্ধ হইতে মোটা ডাল বাহির হইয়াছে। গাছে পিপড়ের বাসা আছে কিনা জল্পনা করিতে করিতে আমি গাছে উঠিয়া পড়িলাম।

‘ব্যস‌, আর উচুতে উঠে না।’ আমি দুইটা ডালের সন্ধিস্থলে সাবধানে বসিলাম। গাছে চড়িয়া লাফালাফি করার বয়স অনেক দিন চলিয়া গিয়াছে‌, একটু ভয়-ভয় করিতে লাগিল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আচ্ছা। সব কথা মনে আছে তো?’

‘আছে। বাঁশী শুনলেই বিরহিণী রাধার মত ছুটব।’

ব্যোমকেশ তখন অন্য তিনজনকে লইয়া পাঁচিলের সমান্তরালে ভিতর দিকে চলিল। দুই তিনটা গাছ বাদ দিয়া আর একটা গাছে একজন জমাদার উঠিল। তারপর তাহারা আরও দূরে চলিয়া গেল‌, কে কোন গাছে উঠিল।’ দেখিতে পাইলাম না। ঘন পত্রান্তরাল হইতে কেবল সঞ্চরমান বৈদ্যুতিক টর্চের প্রভা চোখের সামনে খেলা করিতে লাগিল।

তারপর বৈদ্যুতিক টর্চও নিভিয়া গেল।

হাতের ঘড়ি চোখের কাছে আনিয়া রেডিয়াম-নির্দেশ লক্ষ্য করিলাম-নাটা বাজিয়া দশ মিনিট। অন্তত এক ঘণ্টার আগে কিছু ঘটিবে বলিয়া মনে হয় না।

বসিয়া আছি। ভাগ্যে বাতাস নাই‌, শীতের দাঁত তাই মমস্তিক কামড় দিতে পারিতেছে না। তবু থাকিয়া থাকিয়া হাড়-পাঁজরা কাঁপিয়া উঠিতেছে‌, দাঁতে দাঁতে ঠোকাঠুকি হইয়া যাইতেছে।

আমবাগান সম্পূর্ণ নিঃশব্দ নয়। গাছের পাতাগুলো যেন উসখুসি করিতেছে‌, ফিসফিস করিয়া কথা বলিতেছে‌, অন্ধকারে শ্রবণ শক্তি তীক্ষ্ণ হইয়াছে তাই শুনিতে পাইতেছি। একবার মাথার উপর একটা পাখি-বোধহয় প্যাঁচা-চ্যাঁ চ্যাঁ শব্দ করিয়া উড়িয়া গেল‌, সম্ভবত গাছের মধ্যে আমাকে দেখিতে পাইয়াছে। চকিতে চোখ তুলিয়া দেখি গাছপালার ফাঁক দিয়া দুই চারিটি তারা দেখা যাইতেছে।

বসিয়া আছি। পৌঁনে দশটা বাজিল। সহসা সমস্ত ইন্দ্ৰিয় সজাগ হইয়া উঠিল। চোখে কিছু দেখিলাম না‌, কানেও কোনও শব্দ আসিল না‌, কেবল অনুভব করিলাম‌, আমার গাছের পাশ দিয়া কে যেন ভিতর দিকে চলিয়া গেল। কে চলিয়া গেল! পাণ্ডেজি! কিম্বা–!

একটা ভিজা-ভজা বাতাস আসিয়া মুখে লাগিল। ঊর্ধ্বে চাহিয়া দেখিলাম‌, তারাগুলি নিষ্প্রভ হইয়া আবার উজ্জ্বল হইল। বোধহয় কাল রাত্রির মত আকাশে কুয়াশা জমিতে আরম্ভ করিয়াছে।

হ্যাঁ‌, কুয়াশাই বটে। তারাগুলিকে আর দেখা যাইতেছে না। গাছের পাতায় কুয়াশা জমিয়া জল হইয়া নীচে টোপাইতেছে—চারিদিক হইতে মৃদু শব্দ উঠিল-টপ টপ টপ টপ!

প্রবল ইচ্ছা হইল। ধূমপান করি। দাঁতে দাঁত চাপিয়া ইচ্ছা দমন করিলাম…

ঘড়িতে সওয়া দশটা। আমি গাছের ডালের উপর খাড়া হইয়া বসিলাম। দীপনারায়ণের হাতার ভিতর যেন একটা গুঞ্জনধ্বনি শোনা গেল। তারপর একটা মোটর হাতা হইতে বাহির হইয়া বিপরীত দিকে চলিয়া গেল। গাড়ির হেডলাইটের ছটা কুয়াশার গায়ে ক্ষণেক তাল পাকাইল‌, তারপর আবার অন্ধকার।

বোধহয় মিস মান্না নিজের বাসায় ফিরিয়া গেলেন।

এইবার! দশ মিনিট স্নায়ু-পেশী শক্ত করিয়া বসিয়া রহিলাম‌, কিছুই ঘটিল না। তারপর হঠাৎ—খিড়কির দরজার দিকে দপ করিয়া আলো জ্বলিয়া উঠিল। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত পরস্পরায় তিন-চারবার পিস্তলের আওয়াজ হইল। পিস্তলের আওয়াজের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না‌, আমি মুহুর্তকাল নিশ্চল নিষ্পন্দ হইয়া গেলাম।

চমক ভাঙিল পুলিস হুইসলের তীব্র শব্দে। আমি গাছের ডাল হইতে নীচে লাফাইয়া পড়িলাম। মাটি কত দূরে তাহা ঠাহর করিতে পারি নাই‌, সারা গায়ে প্রবল ঝাঁকানি লাগিল। উঠিয়া দাঁড়াইয়া দেখিলাম খিড়কির কাছে গোটা ঠিকেই বলিয়া উঠিয়াছে। আমি সেই দিকে ছুটিলাম।

ছুটিতে ছুটিতে আর একবার পিস্তলের আওয়াজ শুনিতে পাইলাম। তারপর পায়ে শিকড় লাগিয়া আছাড় খাইলাম। উঠিয়া আবার ছুটিলাম। হাত-পা অক্ষত আছে কিনা অনুভব করিবার সময় নাই। যেখানে আর সকলেই দাঁড়াইয়াছিল হুড়মুড় করিয়া সেখানে উপস্থিত হইলাম।

খিড়কি দরজার কাছে একটা স্থান ঘিরিয়া পাঁচজন দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। পাণ্ডেজির হাতে রিভলবার‌, তিওয়ারী ও দুইজন জমাদারের হাতে টর্চ, ব্যোমকেশ কোমরে হাত দিয়া দাঁড়াইয়া। তিনটি টর্চের আলো একই স্থানে পড়িয়াছে। পাঁচ জোড়া চক্ষুও সেই স্থানে নিবদ্ধ।

দুইটি মৃতদেহ মাটিতে পড়িয়া রহিয়াছে; একজন স্ত্রীলোক‌, অন্যটি পুরুষ। স্ত্রীলোকটি শকুন্তলা‌, আর পুরুষ–রতিকান্ত।

রতিকান্তের নীল চক্ষু দুটা বিস্ময় বিস্ফারিত; ডান হাতের কাছে একটা পিস্তল পড়িয়া আছে‌, বাঁ হাতের আঙুলগুলা একটা সাদা রঙের খাম আঁকড়াইয়া আছে। শকুন্তলার মুখ ভাল দেখা যাইতেছে না। গায়ে কালো রঙের শাল জড়ানো। বুকের কাছে থোলো থোলো রক্ত-করবীর মত কাঁচা রক্ত।

ব্যোমকেশ নত হইয়া রতিকাস্তের আঙুলের ভিতর হইতে খামটা বাহির করিয়া লইয়া নিজের পকেটে পুরিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *