Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।
Home » বহ্নি পতঙ্গ – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay » Page 13

বহ্নি পতঙ্গ – ব্যোমকেশ বক্সী || Sharadindu Bandyopadhyay

আমরা তিনজনে সামনের ঘরে গিয়া বসিলাম। মিস মান্না উৎসুক চোখে আমাদের পানে চাহিলেন। আমরা আর কী বলিব‌, নিজেরাই কিছু জানি না‌, মুখ ফিরাইয়া যামিনী রায়ের ছবি দেখিতে লাগিলাম।

পঁচিশ মিনিট পরে ব্যোমকেশ আসিল। তাহার মুখে চোখে কঠিন ক্লান্তি‌, যেন বুদ্ধির যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হইয়া অতি কষ্টে জয়ী হইয়াছে। সে মিস মান্নার পাশে বসিয়া নিম্ন কণ্ঠে তাঁহাকে নির্দেশ দিল। নির্দেশের মমর্থি; আজ রাত্রি সওয়া দশটা পর্যন্ত এক লহমার জন্য তিনি শকুন্তলাকে চোখের আড়াল করিবেন না‌, বা অন্য কাহারও সহিত জানাস্তিকে কথা বলিতে দিবেন। না। সওয়া দশটার পর মিস মান্নার ছুটি‌, তিনি তখন নিজের বাসায় ফিরিয়া যাইবেন। মিস মান্না নির্দেশ শুনিয়া পাণ্ডেজির প্রতি সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিক্ষেপ করিলেন‌, প্রত্যুত্তরে পাণ্ডেজি ঘােড় হেলাইয়া সায় দিলেন। মিস মান্না তখন শকুন্তলার ঘরে চলিয়া গেলেন।

ব্যোমকেশ পর্যায়ক্রমে আমার ও পাণ্ডেজির মুখের পানে চাহিয়া শুষ্ক হাসিল‌, ‘চলুন‌, এবার যাওয়া যাক।‘

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, ‘কিন্তু—’

ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল‌, ‘এখানে নয়। বাড়ি যেতে যেতে সব বলব।’

সেদিন সন্ধ্যার প্রাক্কালে বাড়ি হইতে বাহির হইবার পূর্বে জলযোগ করিতে করিতে ব্যোমকেশ আড় চোখে সত্যবতীর পানে চাহিয়া বলিল‌, ‘আজ আমাদের ফিরতে একটু দেরি হবে।’

সত্যবতী মুখ ভার করিয়া বলিল‌, ‘তা তো হবেই। আজ অমাবস্যা‌, তার ওপর আমি বেরুতে মানা করেছি‌, আজ দেরি হবে না তো কবে হবে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আজ অমাবস্যা নাকি! আরে‌, খুব লাগসৈ হয়েছে তো।’

সত্যবতী বলিল‌, ‘হয়েছে বুঝি? ভাল।’ ব্যোমকেশ বলিল ‘অজিত কবি মানুষ‌, ওকে জিগ্যেস কর‌, অভিসার করবার জন্যে অমাবস্যার রাত্রিই প্রশস্ত।’

‘তা সারা রাত্রি ধরেই কি অভিসার চলবে?’

‘আরো না না‌, বারোটা-একটার মধ্যেই ফিরব।’

সত্যবতী চকিত উদ্বেগ ভরে চাহিল‌, ‘বারোটা-একটা?’

ব্যোমকেশ উঠিয়া মুখ মুছিতে মুছিতে লঘুস্বরে বলিল‌, ‘তুমি ভেবো না। ফিরে এসে তোমাকে দুষ্মন্ত-শকুন্তলার উপাখ্যান শোনাব। —চল‌, অজিত।’

সত্যবতী শঙ্কিত মুখে দাঁড়াইয়া রহিল‌, আমরা বাহির হইলাম।

আমরা পাণ্ডেজির বাসায় না গিয়া সটান দীপনারায়ণের বাড়িতে গেলাম; সেই রূপই কথা ছিল। পাণ্ডেজি বাহিরের হল-ঘরে গদি-মোড়া চেয়ারে বসিয়া দুই পা সম্মুখ দিকে প্রসারিত করিয়া দিয়াছিলেন‌, আমাদের দেখিয়া খাড়া হইয়া বসিলেন। ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করিল‌, ‘রতিকান্ত বক্সার থেকে এখনও ফেরেননি?’

পাণ্ডেজি বলিলেন‌, না। থানায় খবর দেওয়া আছে। ফিরেই এখানে আসবে।’

‘অতঃপর আমরা তিনজনে বসিয়া নীরবে সিগারেট টানিতে লাগিলাম। অন্ধকার হইলে পাণ্ডেজি উঠিয়া একটা আলো জ্বালিয়া দিলেন, তাহাতে ঘরের কিয়ংদশ আলোকিত হইল মাত্র। …ম্যানেজার গঙ্গাধর বংশী একবার বাহির হইতে উঁকি মারিয়া নিঃসাড়ে অপসৃত হইলেন। চাঁদনী নীচে নামিয়া আসিয়া আমাদের দেখিয়া চুপি চুপি আবার উপরে উঠিয়া গেল। কিছুক্ষণ পরে একটা চাকর আসিয়া তিন পেয়ালা চা দিয়া গেল। আমরা চা পান করিলাম। …বাড়িটা যেন ভূতুড়ে বাড়ি; শব্দ নাই‌, ঘরের আনাচে কানাচে অস্পষ্ট ছায়ামূর্তি ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। আমরা তিনটি প্রতীক্ষ্ণমান প্ৰেতাত্মার মত বসিয়া আছি; কেন বসিয়া আছি তাহা গভীর রহস্যে আবৃত।

পৌঁনে আটটার সময় রতিকান্ত আসিল। পরিধানে আগাগোড়া পুলিস বেশ‌, চোখে চাপা উত্তেজনা। সে পাণ্ডেজিকে স্যালুট করিয়া তাঁহার পাশের চেয়ারের কিনারায় বসিল‌, পাণ্ডেজির দিকে ঝুকিয়া বলিল‌, ‘প্রমাণ পেয়েছি-ডাক্তার পালিতের কাজ।’

পাণ্ডেজি তীক্ষ্ণ নোত্রে রতিকাস্তের পানে চাহিয়া রহিলেন‌, বলিলেন‌, ‘প্রমাণ পেয়েছ? কি প্রমাণ—‘

রতিকান্ত বলিল‌, কয়েদীটো স্বীকার করেছে। প্রথমে কিছুই বলতে চায় না‌, অনেক জেরা করার পর স্বীকার করল যে‌, পালিত তার কাছে কিউরারি কিনেছে।’

‘তাই নাকি?’ পাণ্ডেজি যেন আত্ম-সমহিত হইয়া পড়িলেন।

রতিকান্ত উৎসুকভাবে বলিল‌, ‘তাহলে এবার বোধহয় পালিতকে অ্যারেস্ট করা যেতে পারে? ‘দাঁড়াও‌, অত তাড়াতাড়ি নয়। একটা ছিচকে চোরের সাক্ষীর ওপর ডাক্তার পালিতের মত লোককে অ্যারেস্ট করা নিরাপদ নয়। এদিকে আমরাও কিছু খবর সংগ্রহ করেছি-? বলিয়া পাণ্ডেজি ব্যোমকেশের পানে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাহিলেন। রতিকান্ত উচ্চকিত হইয়া ব্যোমকেশের পানে চোখে ফিরাইল‌, ‘কি খবর?’

বলছি—ব্যোমকেশ একবার সতর্কভাবে বৃহৎ কক্ষের চারিদিকে দৃষ্টি প্রেরণ করিল‌, তারপর চেয়ার টানিয়া রতিকান্তের কাছে ঘেষিয়া বসিল। আবছায়া আলোয় চারিটি মাথা একত্ৰিত হইল। চুপি চুপি কথা হইতে লাগিল।

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আজ সকালবেলা শকুন্তলা দেবীকে জেরা করেছিলাম। প্রথমটা তিনি চোখে ধুলো দেবার চেষ্টা করেছিলেন; কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভেঙে পড়লেন। তিনি স্বীকার করেছেন যে অপরাধীকে তিনি চেনেন‌, অপরাধী তাঁর—গুপ্ত-প্রণয়ী। …’ ব্যোমকেশ চুপ করিল। রতিকান্ত নিনিমেষ চক্ষে তাহার পানে চাহিয়া রহিল।

ব্যোমকেশ একটা নিশ্বাস ফেলিল‌, ‘কিন্তু মুশকিল হয়েছে‌, কিছুতেই অপরাধীর নাম বলছেন না।’

রতিকান্ত বলিয়া উঠিল‌, ‘নাম বলছেন না।’

ব্যোমকেশ মাথা নাড়িল‌, ‘না। শকুন্তলা স্ত্রীলোক‌, তাঁর লজ্জা সঙ্কোচ আছে‌, কলঙ্কের ভয় আছে‌, তাই তাঁকে বিশেষ দোষ দেওয়া যায় না। অনেক চেষ্টা করেও অপরাধীর নাম তাঁর মুখ থেকে বার করতে পারলাম না।’

রতিকান্ত সোজা হইয়া বসিল‌, ক্ষণেক চিন্তা করিয়া বলিল‌, ‘আমি একবার চেষ্টা করে দেখব? আমি যদি একলা গিয়ে তাঁকে জেরা করি‌, তিনি হয়তো নামটা বলতে পারেন।’

পাণ্ডেজি মাথা নাড়িয়া বলিলেন‌, ‘এখন আর হবে না‌, তিনি মুখ ফুটে কিছু বলবেন না। তবে অন্য একটা উপায় হয়েছে–’

‘কি উপায় হয়েছে? রতিকান্ত পাণ্ডেজির দিক হইতে ব্যোমকেশের দিকে চক্ষু ফিরাইল।

ব্যোমকেশ গলা আরও খাটো করিয়া বলিল‌, ‘অনেক ধ্বস্তাধবস্তির পর শকুন্তলা রাজী হয়েছেন‌, চিঠি লিখে পাণ্ডেজিকে অপরাধীর নাম জানাবেন। ব্যবস্থা হয়েছে‌, এখানে যে-সব পুলিস মোতায়েন আছে তাদের সরিয়ে নেওয়া হবে। শকুন্তলার কাছে থাকবেন শুধু মিস মান্না। আর কাউকে তাঁর কাছে যেতে দেওয়া হবে না। রাত্রি সওয়া দশটার মধ্যে মিস মান্না শকুন্তলাকে একলা রেখে নিজের বাসায় ফিরে যাকেন। তখন শকুন্তলা চিঠি লিখে নিজের হাতে ডাক-বাক্সে ফেলে আসবেন। লোকাল চিঠি‌, কাল বেলা দশটা—এগারোটার সময় আমরা সে চিঠি পাব।’

কিছুক্ষণ কোনও কথা হইল না‌, চারটি মুণ্ড একত্রিত হইয়া রহিল। শেষে রতিকান্ত বলিল‌, ‘তাহলে আপনাদের মতে ডাক্তার পালিত অপরাধী নয়?’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘ডাক্তার পালিতও হতে পারে‌, এখনও কিছু বলা যায় না। আবার নর্মদাশঙ্করও হতে পারে। কাল নিশ্চয় জানা যাবে।’ বলিয়া সকালবেলা নর্মদাশঙ্করের বাড়িতে যাহা যাহা ঘটিয়াছিল তাহা বিবৃত করিল।

শুনিয়া রতিকান্ত চুপ করিয়া রহিল। পাণ্ডেজি হাতের ঘড়ি দেখিয়া বলিলেন‌, ‘আজ তাহলে ওঠা যাক। ব্যোমকেশবাবু্‌, আপনারাও চলুন আমার বাসায়। রতিকান্ত‌, তুমিও চল‌, সবাই মিলে কেসটা আলোচনা করা যাবে। তুমি আজ সারাদিন ছিলে না‌, ইতিমধ্যে অনেক ব্যাপার ঘটেছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘আমরা কিন্তু আজ সকাল সকাল বাড়ি ফিরব। গিয়ী ভীষণ রেগে আছেন।’

আমরা বাহিরে আসিলাম। রতিকান্ত জমাদারকে ডাকিয়া পাহারা তুলিয়া লইতে বলিল।

বহ্নি ও পতঙ্গের কাহিনী শেষ হইয়া আসিতেছে। ভাবিয়া দেখিতে গেলে‌, এ কাহিনীর শেষ নাই‌, সারা সংসার জুড়িয়া আবহমান কাল এই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি চলিতেছে। কখনও পতঙ্গ তিল তিল করিয়া পুড়িয়া মরে‌, কখনও মুহুর্তমধ্যে ভস্মীভূত হইয়া যায়।

বাক্ষ্যমান বহ্নি ও পতঙ্গের খেলা শেষ হইয়া যাইবার পর আমি ব্যোমকেশকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম‌, ‘আচ্ছা ব্যোমকেশ‌, এখানে পতঙ্গ কে? বহিস্থই বা কে?’

ব্যোমকেশ বলিয়াছিল‌, ‘দু’জনেই বহ্নি‌, দু’জনেই পতঙ্গ।’

কিন্তু থাক। পরের কথা আগে বলিয়া রাসভঙ্গ করিব না। সে-রাত্রে আটটা বাজিতেই ব্যোমকেশ ও আমি পাণ্ডেজির বাড়ি হইতে বাহির হইলাম; পাণ্ডেজি ও রতিকান্ত বসিয়া কেস সম্বন্ধে আলোচনা করিতে লাগিলেন। বক্সার হইতে রতিকান্ত কয়েদীর যে জবানবন্দী লিখিয়া আনিয়াছিল। তাহারই আলোচনা।

বাহিরে ঘুটফুটে অন্ধকার। রাস্তার ধারে আলো দু’ একটা আছে বটে। কিন্তু তাহা রাত্রির তিমির হরিবার পক্ষে যথেষ্ট নয়। পাটনার পথঘাট ভাল চিনি না‌, এই অমাবস্যার রাত্রে চেষ্টা করিয়া কোনও নির্দিষ্ট গন্তব্য স্থানে পৌঁছিতে পারিব এ আশা সুদূরপরাহত। আমরা মনে মনে একটা দিক আন্দাজ করিয়া লইয়া হোচট খাইতে খাইতে চলিলাম। মনের এমন অগোছালো অবস্থা যে একটা বৈদ্যুতিক টর্চ আনিবার কাথাও মনে ছিল না। ভাগ্যক্রমে কিছুদূর যাইতে না যাইতে ঠুনঠুন ঝুনঝুন আওয়াজ শুনিতে পাইলাম। একটা ধোঁয়াটে আলো মন্থর গতিতে আমাদের দিকে অগ্রসর হইয়া আসিতেছে। কাছে আসিলে একটি এক্কার আকৃতি অস্পষ্টভাবে রূপ পরিগ্রহ করিল। ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া হাঁকিল-‘দাঁড়া। ভাড়া যাবি?’

এক্কা দাঁড়াইল। আপাদমস্তক কম্বলে মোড়া এক্কাওয়ালার কণ্ঠস্বর শুনিতে পাইলাম‌, না বাবু্‌, আমার ঘোড়া থকে আছে।’

ব্যোমকেশ বলিল‌, ‘বেশি দূর নয়‌, দীপনারায়ণ সিং-এর বাড়ি। যাবি তো চল‌, বকশিস পাবি।’

এক্কাওয়ালা বলিল‌, ‘আসুন বাবু্‌, আমার আস্তাবল ওই দিকেই।’

আমরা একার দুই পাশে পা ঝুলাইয়া বসিলাম। এক্কাওয়ালা চাবুক ঘুরাইয়া মুখে টকাস টকাস শব্দ করিল। ঘোড়া ঝন ঝন শব্দ করিয়া চলিতে আরম্ভ করিল।

Pages: 1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *