Skip to content

Banglasahitya.net

Horizontal Ticker
বাঙালির গ্রন্থাগারে আপনাদের সকলকে জানাই স্বাগত
"আসুন শুরু করি সবাই মিলে একসাথে লেখা, যাতে সবার মনের মাঝে একটা নতুন দাগ কেটে যায় আজকের বাংলা"
কোনো লেখক বা লেখিকা যদি তাদের লেখা কোন গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ বা উপন্যাস আমাদের এই ওয়েবসাইট-এ আপলোড করতে চান তাহলে আমাদের মেইল করুন - banglasahitya10@gmail.com or, contact@banglasahitya.net অথবা সরাসরি আপনার লেখা আপলোড করার জন্য ওয়েবসাইটের "যোগাযোগ" পেজ টি ওপেন করুন।

সেনজিতের শয়নকক্ষ। রাজা পালঙ্কে শুইয়া ঘুমাইতেছেন।

সহসা বাতায়নের বাহিরে বাদ্যযন্ত্র ও সঙ্গীতের কর্ণবিদারী শব্দ উথিত হইল। রাজার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। তিনি বিরক্ত মুখে শয্যায় উঠিয়া বসিয়া ডাকিলেন—

অভিজিৎ।

রাজার সন্নিধাতা অভিজিৎ প্রবেশ করিল। তাহার বেশবাস উৎসবের উপযোগী; কর্ণে কুণ্ডল, বাহুতে অঙ্গদ, গলায় ফুলের মালা, পরিধানে পট্টাম্বর ও উত্তরীয়। সে প্রবেশ করিতেই রাজা রুক্ষস্বরে বলিলেন

এ কি! এত শব্দ কিসের?

সন্নিধাতা বলিল—আয়ুষ্মন্, আজ দোলপূর্ণিমা-মদনোৎসব!

রাজা শয্যা হইতে অবতরণ করিলেন। বলিলেন

মদনোৎসব—তা এত গণ্ডগোল কেন?

সন্নিধাতার মুখে বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়া উঠিল—

মহারাজ, আজ আনন্দের দিন—তাই পুরবাসীরা উৎসব করছে।

সেনজিৎ বাতায়ন খুলিয়া বাহিরে চাহিলেন, আবার তৎক্ষণাৎ বন্ধ করিলেন—

উত্সব। কিসের জন্য উত্সব! যাও, এখনি বন্ধ করে দাও-মদনোৎসব হবে না।

সন্নিধাতা বুদ্ধিভ্রষ্টভাবে বলিল—মদনোৎসব হবে না—মদনোৎসব হবে না। কিন্তু মহারাজ

সেনজিৎ দৃঢ়স্বরে বলিলেন—আমার আদেশ, মদনোৎসব বন্ধ থাকবে। যাও, নগরে ঘোষণা করে দাও—দাঁড়িয়ে দেখছ কি? যাও।

যথা আজ্ঞা মহারাজ-হতভম্ব অভিজিৎ প্রস্থান করিল।

রাজপ্রাসাদের অঙ্গনে পুরীর দাসদাসীরা অভিনব বেশে সজ্জিত হইয়া উৎসবে মাতিয়াছে। যুবতী দাসীরা কোমরে কাপড় জড়াইয়া কাঁখে কলস লইয়া নাচিতেছে, ভৃত্যেরা শিঙা বাঁশী ঢোল বাজাইতেছে। যবনী প্রতিহারীরাও স্বদেশের পোষাক পরিয়া যোগ দিয়াছে। উদ্দাম উৎসব আরম্ভ হইয়া গিয়াছে।

অবরোধের একটি অলিন্দ। উল্কা বাতায়নে দাঁড়াইয়া রাজপ্রাসাদের দিকে চাহিয়া আছে। প্রাসাদ-অঙ্গন হইতে বাদ্যযন্ত্রের নিনাদ আসিতেছে। উদ্ধার চোখেমুখে অসহ্য উৎকণ্ঠা।

বাসবী আসিয়া উল্কার পাশে দাঁড়াইল। কিছুক্ষণ নীরব থাকিয়া বাসবী কুষ্ঠাজড়িত স্বরে বলিল—

প্রিয়সখি, মহারাজ তো আজও এলেন না।

উল্কা অধর দংশন করিয়া বলিল—না।

সহসা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ থামিয়া গেল। উল্কা ও বাসবী বিস্মিতভাবে পরস্পরের পানে চাহিল।

রাজপ্রাসাদের অঙ্গনে দাসদাসীরা নৃত্য-গীত বন্ধ করিয়া অবাক বিস্ময়ে রাজ-সন্নিধাতা অভিজিতের পানে চাহিয়া আছে। অবশেষে এক দাসী স্খলিতস্বরে প্রশ্ন করিল

মদনোৎসব বন্ধ থাকবে!

সন্নিধাতা সক্ষোভে বলিল—মহারাজের আদেশ।

অবরোধের অলিন্দে উল্কা ও বাসবী পূর্ববৎ দাঁড়াইয়া আছে। কঞ্জুকী কুণ্ঠিতমুখে প্রবেশ করিল।

বাসবী বলিল—কঞ্চুকী মহাশয়, গীতবাদ্য বন্ধ হয়ে গেল যে!

কঞ্চুকী হতাশভাবে দুই হস্ত প্রসারিত করিল।

মহারাজ আদেশ দিয়াছেন—মদনোৎসব হবে না।


চারিদিক নিস্তব্ধ, কোথাও গীতবাদ্যের শব্দ নাই। সেনজিৎ আপন বিশ্রামগৃহে একাকী বসিয়া আছেন, তাঁহার ললাট ভূবদ্ধ। তিনি দুই হাতে একটি ফুলের পাপড়ি ছিড়িতেছেন!

বটুক ভট্ট আসিয়া রাজার কাছে বসিলেন—

জয়োস্তু মহারাজ!

সেনজিৎ হাস্যহীন মুখে বটুক ভট্টকে নিরীক্ষণ করিলেন—

স্বস্তি।

শুনলাম, তুমি দোলপূর্ণিমার নৃত্য-গীত আনন্দ-উৎসব বন্ধ করে দিয়েছ! বেশ করেছ, ভাল করেছ, উত্তম কার্য করেছ।

সেনজিতের দৃষ্টি সন্দিগ্ধ হইয়া উঠিল। তিনি বলিলেন—এইসব অর্থহীন উৎসব আমার ভাল লাগে না।

বটুক ভট্ট মুণ্ড নাড়িয়া বলিলেন—বটেই তো, কেন ভাল লাগবে! এবং তোমার যখন ভাল লাগে তখন প্রজাদেরই বা কেন ভাল লাগবে! কোন্ স্পর্ধায় তারা উৎসব করবে!

বটুক ভট্টের ব্যঙ্গ বুঝিতে পারিয়া সেনজিৎ আরও ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন, কিন্তু ক্রোধ সংবরণ করিয়া বলিলেন—

কী বলতে চাও তুমি?

কিছু না বয়স্য। বছরের মধ্যে এই এক উৎসব, যেদিন ধনী-দরিদ্র বালকবৃদ্ধ একসঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে। কিন্তু তুমি যখন নিষেধ করেছ তখন সকলে নীরব থাকবে। কেবল

কেবল?

কেবল তোমার পক্ষীশালার পাখিগুলো অকারণে বড় কিচির-মিচির করছে। যদি অনুমতি দাও এখনি গিয়ে তাদের গলা টিপে নীরব করে দিতে পারি।

সেনজিৎ কিছুক্ষণ নতমুখে রহিলেন, তারপর ব্যথাক্লিষ্ট মুখ তুলিলেন।

বটুক, তোমার কথাই সত্য। কিন্তু বয়স্য, আমার বুকের জ্বালা যদি বুঝতে!

বটুক ভট্ট গাঢ়স্বরে বলিলেন—আমি সব বুঝেছি বয়স্য। কিন্তু তুমি মিছে কষ্ট পাচ্ছ!

যাক।–সন্নিধাতাকে ডাকো।

ডাকিতে হইল না, সন্নিধাতা অভিজিৎ নিজেই প্রবেশ করিল। দেখা গেল, তাহার পশ্চাতে পুরীর দাসদাসী দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে।

সন্নিধাতা করজোড়ে বলিল—আজ্ঞা করুন আর্য।

সেনজিৎ ঈষৎ লজ্জিতভাবে বলিলেন-আমার আদেশ প্রত্যাহার করছি। যাও, সকলে উৎসব কর গিয়ে।

দ্বারের কাছে দাসদাসীরা জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল—

মহারাজের জয়-জয় দেবপ্রিয় মহারাজ!

ভৃত্যেরা আনন্দ কোলাহল করিতে করিতে চলিয়া গেল।

বটুক ভট্ট বলিলেন—বয়স্য, আশীবাদ করি কন্দর্পদেব তোমার প্রতি প্রসন্ন হোন।

সেনজিৎ নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন—বটুক, দ্বার বন্ধ করে দাও, বাতায়ন বন্ধ করে দাও। উৎসবের শব্দ আমি শুনতে চাই না।


অবরোধের একটি কক্ষ। উল্কাকে ঘিরিয়া চারজন সখী বসিয়াছে, তাহারা উল্কাকে ফুলের অলঙ্কার পরাইয়া দিতেছে। কঙ্কণ অবতংস গলায় চন্দ্রহার—সমস্তই ফুলের। উল্কা চোখে-মুখে বিদ্রোহ ভরিয়া বলিতেছে

মহারাজ সেনজিৎ যে আদেশই দিন, আমরা বসন্ত-উৎসব করব। তিনি যদি পারেন, নিজে এসে বাধা দিন।

সখীরা নীরব। সহসা বাহিরে বিপুল বাদ্যোদ্যম শুনা গেল। সকলে হতচকিত হইয়া পরস্পর দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল। এমন সময় কঞ্চুকী মহা-উল্লাসে প্রবেশ করিয়া বলিল—

সুসংবাদ! সুসংবাদ! মহারাজ আদেশ প্রত্যাহার করেছেন। উৎসব হবে—মদনোৎসব হবে—

কঞ্চুকী প্রায় নাচিতে নাচিতে প্রস্থান করিল। উল্কার মুখ উৎফুল্ল হইয়া উঠিল, চোখে আশার আলো ফুটিল।


বেলা দ্বিপ্রহর। নগরের বিভিন্ন স্থানে আবার উৎসব আরম্ভ হইয়াছে। পুষ্করিণীর জলে রঙ গুলিয়া নাগরিক নাগরিকারা জলক্রীড়া করিতেছে। বিলাসী নাগরিকেরা নৌকায় চড়িয়া জলবিহার করিতেছে। বনে বনে প্রেমিক প্রেমিকাদের লুকোচুরি খেলা চলিতেছে, গাছে গাছে হিন্দোল দুলিতেছে।

অপরাহ্ন আসিল। উল্কার শয়নকক্ষে বাতায়নে দাঁড়াইয়া উল্কা প্রতীক্ষা করিতেছে। তাহার পুষ্পভূষা শুকাইয়া গিয়াছে। দূর হইতে উৎসবের মিশ্রিত ধ্বনি ভাসিয়া আসিতেছে। উল্কার চোখে ব্যর্থতার শুষ্ক জ্বালা। মহারাজ আসেন নাই।

সহসা রূঢ় হস্ত সঞ্চালনে উল্কা নিজের গলার মালা ছিড়িয়া দূরে নিক্ষেপ করিল, তারপর নিজ শয্যার পাশে আসিয়া বসিল। তীক্ষ্ণ নীরব কণ্ঠে ডাকিল—

বাসবী।

বাসবী উদ্বিগ্ন মুখে প্রবেশ করিল।

উল্কা প্রশ্ন করিল—বেলা কত?

বাসবী বলিল—অপরাহ্ন। কই প্রিয়সখি, মহারাজ তো এখনও এলেন না।

উল্কা দাঁতে দাঁত চাপিয়া বলিল—আসবেন। তুই লেখনী মসীপত্র নিয়ে আয়, মহারাজকে পত্র লিখব—

বাসবী দ্রুতপদে চলিয়া গেল, উল্কা মুখে বাণ-বিদ্ধ মৃত হাসি লইয়া বসিয়া রহিল।


সায়াহ্ন। সেনজিৎ বিশ্রামগৃহে একাকী জানালার পাশে দাঁড়াইয়া আছেন। দীর্ঘ অন্তযুদ্ধে তাঁহার মুখ ক্ষত-বিক্ষত।

দ্বারের নিকট হইতে মন্ত্রী বলিলেন—

জয়োস্তু মহারাজ।

সেনজিৎ মুখ তুলিলেন-মন্ত্রী! কি প্রয়োজন?

মন্ত্রী প্রবেশ করিলেন, তাঁহার মুখে কুণ্ঠা, হাতে কুণ্ডলীকৃত একটি লিপি।

ক্ষমা করবেন, একটা গুরুতর কথা মহারাজকে জানাবার জন্য এলাম।

কী গুরুতর কথা? কাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা কি চলত না?

না মহারাজ, বিলম্বে ঘোর অনিষ্ট হতে পারে। আমরা জানতে পেরেছি যে গোপনে আপনার প্রাণনাশের চেষ্টা হচ্ছে

সেনজিৎ তাচ্ছিল্যভরে বলিলেন—কে চেষ্টা করছে?

মন্ত্রী কহিলেন—মহারাজ, যাকে আপনি বিশ্বাস করে অবরোধে স্থান দিয়েছেন সেই চেষ্টা করছে।

সেনজিৎ চকিত বিস্ফারিত নেত্রে চাহিলেন। বলিলেন

বটে! প্রমাণ পেয়েছেন?

মন্ত্রী লিপি দেখাইয়া বলিলেন—এই যে প্রমাণ। পড়ে দেখলেই বুঝতে পারবেন। লিচ্ছবি দেশের এক গুপ্তচর এই লিপি নিয়ে আসছিল, পথে আমাদের গুপ্তচর লিপি চুরি করে এনেছে। এতে পরিষ্কার নির্দেশ রয়েছে, সুযোগ পেলেই যেন রাষ্ট্রদূতী আপনাকে হত্যা করে।

লিপি লইয়া সেনজিৎ নীরবে পাঠ করিলেন। তাঁহার মুখ অমার্জিত প্রস্তরখণ্ডের মত কর্কশ হইয়া উঠিল।

মন্ত্রী বলিলেন—মহারাজ, এখন এই বিশ্বাসঘাতিনী রাষ্ট্রদূতীকে—যদি অনুমতি হয়—

সেনজিৎ পত্রের দিকে চাহিয়া থাকিয়া বলিলেন—যা করবার আমি করব, আপনি চিন্তিত হবেন না।

মন্ত্রী উদ্বিগ্নকণ্ঠে বলিলেন-আপনি সাবধানে থাকবেন। সতর্ক থাকবেন।

সেনজিৎ ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন-অবশ্য। আপনি এখন আসুন।

জয়োস্তু মহারাজ।

মন্ত্রী মহারাজের এই ঔদাসীন্য বুঝিতে পারিলেন না, একটু যেন অতৃপ্তভাবে প্রস্থান করিলেন। সেনজিৎ তখন আস্তরণে আসিয়া বসিলেন; আবার লিপি খুলিয়া পড়িলেন। তাঁহার বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া একটি নিশ্বাস পড়িল।

উল্কা—আমাকে হত্যা করতে চায়। কিন্তু কেন? কেন?

দ্বারের দিকে চক্ষু ফিরাইয়া সেনজিৎ দেখিলেন একটি যুবতী আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। প্রশ্ন করিলেন

কে তুমি?

বাসবী সলজ্জভাবে বলিল—আমি উল্কার সখী-বাসবী।

সেনজিৎ কিছুক্ষণ চাহিয়া রহিলেন।

কাছে এস।—তুমি উল্কার সখী! কী নাম তোমার?

বাসবী।

বাসবী। কিছু প্রয়োজন আছে?

বাসবী মহারাজের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল, এখন কঞ্চুলীর মধ্য হইতে একটি পত্র বাহির করিল।

মহারাজ, আমার প্রিয়সখী আপনাকে এই পত্র দিয়েছেন।

পত্র হাতে লইয়া সেনজিৎ কিছুক্ষণ বাসবীর সলজ্জ সরল মুখের পানে চাহিয়া রহিলেন। তারপর জিজ্ঞাসা করিলেন—তোমার সখী তাঁর মনের সব কথা তোমাকে বলেন?

বাসবী আরও লজ্জা পাইয়া নতমুখে বলিল—হাঁ, বলেন।

সেনজিৎ ধীরস্বরে বলিলেন—তিনি আমার প্রতি বিরূপ কেন বলতে পারো?

লজ্জা ভুলিয়া বাসবী সবিস্ময়ে চাহিল।

বিরূপ! মহারাজ, আমার প্রিয়সখী আজ তিন দিন আপনার পথ চেয়ে আছেন।

এবার সেনজিৎ সবিস্ময়ে চাহিলেন; তারপর নীরবে পত্ৰ খুলিয়া পাঠ করিলেন। পত্র পড়িতে পড়িতে তাঁহার মনে হইল তিনি উল্কার স্বর শুনিতে পাইতেছেন—

দেবপ্রিয়, আজ বসন্ত-পূর্ণিমার রাত্রে লজ্জাহীনা উল্কা প্রার্থনা জানাইতেছে—একবার দর্শন দিবেন কি? শুধু একটিবার দেখিব—আর কিছু না।

পত্র পাঠ করিয়া সেনজিৎ কিছুক্ষণ নির্বাক বসিয়া রহিলেন, তারপর ধীরে ধীরে পত্র কুণ্ডলিত করিয়া অন্য পত্রটির পাশে রাখিলেন; তাঁহার মুখ দেখিয়া মনে হয় তিনি গভীর চিন্তায় ড়ুবিয়া গিয়াছেন।

বাসবী সঙ্কোচভরে বলিল—মহারাজ, পত্রের উত্তর দেবেন কি?

সেনজিৎ সচেতন হইয়া বলিলেন—উত্তর! হাঁ—এই উত্তর।

সেনজিৎ অন্য পত্রটি লইয়া বাসবীর হাতে দিলেন। বাসবী ক্ষণেক পত্ৰ-হাতে দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর যুক্তকরে প্রণাম করিয়া চলিয়া গেল। সেনজিৎ একটি দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করিলেন।

দিনের আলো ফুরাইয়া আসিতেছে। বটুক ভট্ট আসিয়া রাজার নিকটে বসিলেন। বলিলেন—

বয়স্য, দিনটা তো উপবাসে কাটল, এবার পারণের ব্যবস্থা হোক।

সেনজিৎ বলিলেন-উপবাস! পারণ! বুঝতে পারলাম না।

বটুক ভট্ট বলিলেন—বুঝতে পারলে না? আচ্ছা, তবে একটা গল্প বলি শোনো। পুরাকালে ঘরট্টঘর্ঘর নামে এক উগ্রতপা মুনি ছিলেন—মুনিবর যখন নিদ্রা যেতেন তখন তাঁর নাক দিয়ে

সেনজিৎ ক্লান্তস্বরে বলিলেন—বটুক, আমার কি ইচ্ছা হচ্ছে জানো?

কী ইচ্ছে হচ্ছে বয়স্য?

তোমাকে শুলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।

বটুক ভট্ট লাফাইয়া উঠিয়া দ্বারের দিকে চলিলেন

বয়স্য, ও ইচ্ছা দমন করো, আমি বিছানায় শুয়ে শুয়ে মরতে চাই

বটুক নিষ্ক্রান্ত হইলেন। সেনজিৎ অবিচলিত মুখে বসিয়া রহিলেন।


গভীর রাত্রি। পূর্ণিমার চাঁদ প্রায় মধ্যাকাশে।

অবরোধের সরোবর-তীরে শুভ্র সোপানশ্রেণীর এক পাশে উল্কা বসিয়া আছে। তাহার পরিধানে শুভ্র বেশ, দেহে অলঙ্কার নাই, একটি মাত্র বেণী অংসের উপর দিয়া বুকের মাঝখানে লম্বিত হইয়া আছে।

উল্কার হাতে বীণা। সে খেদ বিগলিত মৃদু কণ্ঠে গান গাহিতেছে—

ফাগুন রাতি পোহায়—তুমি এলে না!


সেনজিতের বিশ্রাম কক্ষ। চতুষ্কোণে দীপ জ্বলিতেছে, মুক্ত বাতায়নপথে জ্যোৎস্নাপ্লাবিত বহির্দৃশ্য দেখা যাইতেছে। সেনজিৎ বাতায়নের পাশে দাঁড়াইয়া আছেন, উল্কার গান মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধ বাতাসে ভাসিয়া আসিতেছে—

চাঁদ মাথা নোয়ায়—তুমি এলে না।

সহসা সেনজিৎ বাতায়ন হইতে ফিরিলেন। প্রাচীরগাত্রে একটি কোষবব্ধ ক্ষুদ্র ছুরিকা ঝুলিতেছিল, তাহা লইয়া নিজের কটিবন্ধে বাঁধিলেন। তারপর ঘর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। তাঁহার অন্তর্দ্বন্দ্ব শেষ হইয়াছে।

সরোবরের ঘাটে উল্কা গান গাহিতেছে। তাহার দেহ মন যেন ভাঙিয়া পড়িতেছে—তুমি এলে না! তুমি এলে না!

হঠাৎ সেনজিতের স্বর শুনিয়া উল্কা চমকিয়া উঠিল—

উল্কা!

দীর্ঘ পদক্ষেপে সেনজিৎ আসিতেছেন। উল্কার কোল হইতে বীণা পড়িয়া গেল, সে উদ্ভাসিত মুখে উঠিয়া দাঁড়াইল

দেবপ্রিয়!

সেনজিৎ আসিয়া উল্কার হাত ধরিলেন, আবেগ রুদ্ধ স্বরে বলিলেন—

উল্কা, আমি এসেছি। আর পারলাম না। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে পারলাম না—

উল্কার কণ্ঠে গুঞ্জরণ উঠিল—প্রিয় প্রিয়তম

সেনজিৎ গাঢ়স্বরে বলিলেন—উল্কা! মায়াবিনি! এ তুমি আমায় কী করেছ? আমার রক্তের সঙ্গে তুমি মিশে গেছ—আমার বুকের স্পন্দনে তোমার নাম ধ্বনিত হচ্ছে। তুমি শুনতে পাচ্ছ না? এই শোনো।

সেনজিৎ উল্কার মস্তক নিজ বক্ষে চাপিয়া ধরিলেন। কিছুক্ষণ উভয়ে এইভাবে জগৎ সংসার ভুলিয়া রহিলেন। উল্কার চক্ষু আপনি মুদিয়া গিয়াছিল, সে ধীরে ধীরে চক্ষু মেলিল। তাহার একটি হাত সেনজিতের কটির উপর ন্যস্ত হইয়াছিল, সেখানে কোষবদ্ধ ছুরিকার অস্তিত্ব সে অনুভব করিল। সে মাথা তুলিয়া অস্ফুটস্বরে বলিল—

এ কি?

সেনজিৎ আত্মস্থ হইলেন, কটি হইতে নিষ্কোষিত ছুরিকা বাহির করিয়া উল্কার হাতে দিলেন—

হাঁ, ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি নাকি আমাকে হত্যা করতেই মগধে এসেছ? এই নাও, তোমার কাজ শেষ কর।

উল্কা ছুরিকা লইয়া দূরে নিক্ষেপ করিল— প্রিয়তম, এ উল্কা আর সে উল্কা নেই—সে উল্কা মরে গিয়েছে (স্বপ্নাবিষ্টমুখে হাসিল) আমি কে তা নিজেই জানি না। প্রিয়তম, তুমি বলে দাও

সেনজিৎ উল্কাকে আবার বাহুবদ্ধ করিলেন

উল্কা, তুমি মগধের পট্ট মহাদেবী।

সহসা মাথার উপর একটি পেচক কর্কশ চিৎকার করিয়া উড়িয়া গেল। চমকিয়া উল্কা ঊর্ধ্বে চাহিল, তাহার স্বপ্নাচ্ছন্নতা কাটিয়া গেল; বজ্রনির্ঘোষের মত তাহার কর্ণে ধ্বনিত হইল—তুমি। বিষকন্যা! সে যন্ত্রবৎ উচ্চারণ করিল

পট্ট মহাদেবী—মগধের পট্ট মহাদেবী

সেনজিতের মুখের পানে চক্ষু তুলিয়া উল্কা দেখিল, তিনি মৃদু মৃদু হাসিতেছেন। উল্কার চোখে ধীরে ধীরে ভয়ের ব্যঞ্জনা পরিস্ফুট হইয়া উঠিল। তারপর সে সেনজিতের বুকের উপর দুই হাত রাখিয়া সত্ৰাসে পিছু হটিয়া গেল।

না না না

সেনজিৎ ঈষৎ বিস্ময়ে উল্কার দিকে অগ্রসর হইলেন, উল্কা আবার পিছাইয়া গেল; আৰ্তস্বরে বলিল—

না না, রাজাধিরাজ, তুমি আমার কাছে এস না—

সেনজিৎ দুই বাহু প্রসারিত করিয়া ভর্ৎসনার কণ্ঠে বলিলেন—

ছি উল্কা, এই কি ছলনার সময়।

উল্কা এবার দেহ ও মুখের ভাব কঠিন করিয়া বলিল

মহারাজ, আপনি ভুল বুঝেছেন, আমি আপনাকে ভালবাসি না।

সেনজিৎ বলিলেন—আর মিথ্যে কথায় ভোলাতে পারবে না। এস–কাছে এস

উল্কা ব্যাকুলস্বরে বলিয়া উঠিল—না না, প্রিয়তম, তুমি জানো না—তুমি জানো না

কাঁদিতে কাঁদিতে উল্কা বাড়ির দিকে ছুটিয়া চলিয়া গেল। সেনজিৎ ক্ষণেক বিমুঢ় হইয়া রহিলেন, তারপর উল্কার অনুসরণ করিলেন।


অন্তঃপুর গৃহের দ্বার। উল্কা ছুটিতে ছুটিতে দ্বারপথে প্রবেশ করিয়া অদৃশ্য হইয়া গেল।

অল্পক্ষণ পরে সেনজিৎ দৌড়িতে দৌড়িতে সেই পথে অন্তঃপুরে প্রবেশ করিলেন—

উল্কা!

উল্কার শয়নকক্ষের দ্বার। উল্কা প্রবেশ করিয়া সশব্দে দ্বার বন্ধ করিয়া দিল। তাহার মুখ অশ্রুসিক্ত।

সেনজিৎ আসিয়া দ্বার ঠেলিলেন, দ্বার খুলিল না।

উল্কা!

কক্ষের ভিতর উল্কা কবাটে গণ্ড রাখিয়া দাঁড়াইয়া আছে; তাহার চক্ষু দিয়া অনর্গল অশ্রু ঝরিতেছে। সে বলিল—

রাজাধিরাজ, বিস্তীর্ণ পৃথিবীতে আপনার যোগ্য নারীর অভাব নেই, আপনি উল্কাকে ভুলে যান।

দ্বারের অপর দিক হইতে সেনজিৎ তিক্তস্বরে বলিলেন

হৃদয়হীনা, তবে কেন আমাকে প্রলুব্ধ করেছিলে?

আর্য, বুদ্ধিহীনা নারীর প্রগভতা ক্ষমা করুন। আপনি ফিরে যান, দয়া করুন। আমাদের মিলন অসম্ভব।

কিন্তু কেন—কেন? কিসের বাধা?

উল্কা ভগ্নস্বরে বলিল—সে কথা বলবার নয়।

সেনজিৎ বলিলেন—কেন বলবার নয়? তোমাকে বলতে হবে। আমি শুনতে চাই।

উল্কা ক্ষণেক নীরব হইয়া রহিল। তারপর বলিল—

আচ্ছা, কাল সকালে বলব।

সেনজিৎ দ্বারের কাছে অধর আনিয়া স্নেহ-ক্ষরিত স্বরে বলিলেন—

উল্কা, আজ এই বসন্ত-পূর্ণিমার রাত্রি

উল্কা আর্তস্বরে কাঁদিয়া উঠিল—না না না

সেনজিৎ ক্লান্তকণ্ঠে বলিলেন—ভাল– কাল সকালে বলবে?

বলব।

আশাহত দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া সেনজিৎ চলিয়া গেলেন। উল্কা দ্বারের কাছে নতজানু হইয়া হৃদয়বিদারক কান্না কাঁদিতে লাগিল।


পরদিন প্রভাত। উল্কা শয়নঘরের বাতায়নে দাঁড়াইয়া আছে। মনের আগুনে পুড়িয়া পুড়িয়া রাত্রি কাটিয়াছে; উল্কার চোখের কোলে নীলাভ ছায়া তাহার মুখখানিকে আরও সুন্দর করিয়া তুলিয়াছে। তাহার কেশ-বেশ শিথিল, কবরীর অর্ধ-শুষ্ক মালা অংসে লুটাইতেছে।

সহসা বাহির হইতে একটি তীর আসিয়া বাতায়নের কাষ্ঠে বিদ্ধ হইল। উল্কা চকিতে তীর বাতায়ন হইতে টানিয়া মুক্ত করিল। দেখা গেল তীরের কাণ্ডে একটি লিপি জড়ানো রহিয়াছে। উল্কা সযত্নে লিপি উন্মোচন করিয়া পড়িল। শিবামিশ্রের লিপি, তাহাতে লেখা আছে

কন্যা, স্মরণ রাখিও, শিশুনাগ বংশকে নির্মূল করা চাই!

পত্র হাতে লইয়া উল্কার মুখে একটি তিক্ত হাসির আভাস ফুটিয়া উঠিল—সে পত্রখানি ছিড়িয়া দুই খণ্ড করিল, তারপর চারিখণ্ড করিল। এই সময় বাসবী প্রবেশ করিল।

ওকি প্রিয়সখি, কার চিঠি ছিড়ছ? উল্কা বলিল-বৈশালী থেকে পিতা লিখেছেন—

সে পত্রের ছিন্নাংশগুলি বাতায়নের বাহিরে ফেলিয়া দিল।

জানিস বাসবী, পিতা একটি ভুল করেছেন। আমার শরীরেও যে শিশুনাগ বংশের রক্ত আছে তা তাঁর মনে নেই।

বাসবী হতবুদ্ধি হইয়া বলিল—তোমার শরীরে শিশুনাগ বংশের রক্ত!

উল্কা চমকিয়া আত্মসংবরণ করিল—ও–না না! আজ আমি কী সব বলছি তার ঠিক নেই।

ঘরের যে-প্রাচীরে অস্ত্রশস্ত্র টাঙানো ছিল উল্কা সেখানে গিয়া দুই হাতে দুইটি তরবারি তুলিয়া লইল। উল্কার হাতে ঋজু শাণিত তরবারি দুটি ঝকমক করিয়া উঠিল। সে দুই হাতে তরবারি ঘুরাইতে লাগিল।

এ কি করছ প্রিয়সখি!

দেখছি অসি-বিদ্যা ভুলে গেছি কিনা। আজ মহারাজের অস্ত্র-কৌশল পরীক্ষা করব। বাসবী, তাঁকে অসি-যুদ্ধে কি হারাতে পারব না?

বাসবী উন্মুক্ত অধরে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিল

তুমি কি বলছ আমি বুঝতে পারছি না!

উল্কা বলিল—তুই এখন বুঝতে পারবি না। আমি উদ্যানে যাচ্ছি, মহারাজ যদি আসেন তাঁকে বলবি, আমি মাধবীকুঞ্জে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করছি।

উল্কা দুইটি তরবারি লইয়া কক্ষ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইল।


উদ্যানের এক প্রান্তে মাধবীকুঞ্জ। পুষ্পিতা মাধবীলতা মাথার উপর বিতান রচনা করিয়াছে। বিতানতলে উল্কা এক পাশে দাঁড়াইয়া। তাহার দুই হাতে দুই তরবারির প্রান্তভাগ ভূমি স্পর্শ করিয়া আছে। মুখে চোখে দৃঢ় যুযুৎসা। বিতানের অপর প্রান্তে সেনজিৎ আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন, তাঁহার বক্ষ বাহুবদ্ধ, চোখে কোমল ভর্ৎসনা।

আজ আবার এ কি নতুন ছলনা?

উল্কা চকিতে ফিরিয়া সেনজিৎকে দেখিল। তাহার মুখ কোমল হইল, আবার দৃঢ় হইল। সে বলিল—ছলনা নয়। আমাদের দুজনের মধ্যে এই তরবারির ব্যবধান।

সেনজিৎ ভ্রূ তুলিয়া বলিলেন—অর্থাৎ?

অর্থাৎ অসি-যুদ্ধে পরাজিত করতে না পারলে আমাকে পাবেন না।

সেনজিতের বিস্মিতমুখে ঈষৎ কৌতুকের ছায়া পড়িল—

সে কী!

এই আমার বংশের প্রথা।

কিন্তু তুমি নারী, নারীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরব কি করে।

উল্কা ভ্রূভঙ্গি করিয়া বলিল—মহারাজ কি আমাকে অস্ত্র-বিদ্যায় তাঁর সমকক্ষ মনে করেন না?

সেনজিৎ হাসিয়া বলিলেন—তা নয়। তোমার অস্ত্র-বিদ্যার পরিচয় আগেই পেয়েছি, এখনও বুক তোমার অস্ত্রাঘাতে জর্জরিত কিন্তু উল্কা, আমি যদি যুদ্ধ না করি?

তাহলে আমাকে পাবেন না।

যদি জোর করে গ্রহণ করি?

তাও পারবেন না—এই তরবারি বাধা দেবে।

উল্কা ডান হাতের তরবারি তুলিল। সেনজিৎ দুই বাহু প্রসারিত করিয়া তাহার দিকে অগ্রসর হইলেন

বেশ, তোমার তরবারি আমাকে বাধা দিক।

সেনজিৎ যতই কাছে আসিতে লাগিলেন, উল্কার মুখ ততই বিবর্ণ হইতে লাগিল। শেষে উল্কার অসির অগ্র যখন সেনজিতের বক্ষ স্পর্শ করিবার উপক্রম করিয়াছে তখন উল্কা কম্পিতস্বরে বলিয়া উঠিল—

মহারাজ, আর কাছে আসবেন না

মহারাজ কিন্তু অগ্রসর হইতে লাগিলেন, উল্কা তখন নিজেই তরবারি টানিয়া লইল। সেনজিৎ উচ্চকণ্ঠে হাসিয়া উঠিলেন। উল্কা বাধ্য হইয়া অসি নামাইল। সেনজিৎ তাহার দুই স্কন্ধে হাত রাখিয়া কপট ক্রোধে বলিলেন—

আজ তোমাকে কঠিন শাস্তি দেব।

উল্কা কাঁদিয়া ফেলিল

নিষ্ঠুর নির্দয়! তোমার কি কলঙ্কের ভয় নেই? অসহায়া নারীর ওপর অত্যাচার করতে তোমার লজ্জা হয় না?

সেনজিৎ বলিলেন—না—হয় না। এস, এবার যুদ্ধ করি। (উল্কা চকিতে সজল চক্ষু তুলিল) পাছে তুমি মনে কর নারীর সঙ্গে যুদ্ধ করতেও আমি ভয় পাই, তাই অসি ধরলাম। এস।

উল্কা বলিল—প্রতিজ্ঞা করুন, যদি পরাজিত হন আমাকে স্পর্শ করবেন না।

সেনজিৎ গর্বিতস্বরে বলিলেন—প্রতিজ্ঞা করছি যদি পরাজিত হই, কখনও স্ত্রীজাতির মুখ দেখব না।

উল্কার হাত হইতে একটি তরবারি লইয়া সেনজিৎ কয়েক পদ পিছু হটিয়া অসিক্রীড়ার জন্য প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইলেন। যুদ্ধ আরম্ভ হইল। কিন্তু উল্কা বেশীক্ষণ যুদ্ধ করিতে পারিল না, তাহার তরবারি করচ্যুত হইয়া দূরে ছিটকাইয়া পড়িল।

সেনজিৎ নিজের তরবারি ফেলিয়া দিয়া উল্কার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

এবার হয়েছে?

উল্কা ব্যাকুল চক্ষে সেনজিতের মুখের পানে চাহিয়া রহিল। সেনজিৎ তখন তাহাকে নিজের দিকে আকর্ষণ করিয়া কোমলস্বরে বলিলেন—

উল্কা, আর তো বাধা নেই।

উল্কা নিষ্প্রাণকণ্ঠে বলিল-না, আর বাধা নেই।…আজ মধ্যরাত্রে তুমি এস, তোমার গলায় মালা দেব…আর…রক্তকমল দিয়ে তোমার পূজা করব।


রাত্রি। অন্তঃপুরের বৃহৎ একটি কক্ষে অসংখ্য দীপ জ্বলিতেছে, চারিদিক পুষ্পমালা পুষ্পস্তবকে সমাকীর্ণ। কক্ষের মধ্যস্থলে একটি বেদীর মত আসন, তাহাতে বধূ-বেশিনী উল্কা বসিয়া আছে। তাহার হাতে এক গুচ্ছ রক্তকমল। চারিজন সখী তাহাকে ঘিরিয়া ঘিরিয়া নৃত্য করিতেছে ও গান গাহিতেছে। উল্কার মুখে স্বপ্নাতুর বেদনা-বিধুর হাসি।

সখীরা গান গাহিল

আজি উজল মন-মন্দির
সুন্দর এলো
তারে বরণ করিয়া নে লো।
নয়ন সলিল ধারে
ভুজ বন্ধন হারে
মন-মন্দির দ্বারে
বরণ করিয়া নে লো।
সৌর-মুকুট শিরে—শোভে শিরে
কনক-পীত চীরে– ধীরে ধীরে
সুন্দর এলো
তারে হৃদয়ে বরিয়া নে লো—

নৃত্যগীত শেষ হইলে দেখা গেল, মহারাজ সেনজিৎ দ্বারের কাছে আসিয়া দাঁড়াইয়াছেন। তাঁহার অঙ্গে বর-বেশ, মুখে আনন্দের উদ্ভাস। সখীরা তাঁহাকে দেখিয়া হাসিতে হাসিতে অন্য দ্বার দিয়া অদৃশ্য হইল।

উল্কা উঠিয়া দাঁড়াইয়া স্থির আয়ত নয়নে রাজার পানে চাহিল; রক্তকমলগুচ্ছ তাহার বুকের কাছে রহিল। সেনজিৎ আসিয়া তাহার কাছে দাঁড়াইলেন। চোখে চোখে অনির্বচনীয় প্রীতির বিনিময় হইল।

উল্কা!

সেনজিৎ উল্কার দুই স্কন্ধে হাত রাখিয়া তাহাকে নিকটে আকর্ষণ করিলেন, তারপর বিপুল আবেগভরে বুকে চাপিয়া ধরিলেন। বক্ষে বক্ষ নিষ্পেষিত হইল। উল্কার মাথা সেনজিতের বুকের উপর এলাইয়া পড়িল।

উল্কা!

ঈষৎ উদ্বেগে সেনজিৎ উল্কার মুখের পানে চাহিলেন, উল্কা অর্ধনিমীলিত নেত্রে স্রিয়মাণ হাসিল। সেনজিৎ তাহাকে দুই বাহু দ্বারা বক্ষ হইতে দূরে সরাইয়া দেখিলেন। রক্তকমলগুলি বুকের মাঝখান হইতে ঝরিয়া পড়িল। সেনজিৎ সভয়ে দেখিলেন, শলাকার ন্যায় সূক্ষ্ম ছুরিকা উষ্কার বুকে আমূল বিদ্ধ হইয়া আছে। তিনি চিৎকার করিয়া উঠিলেন

উল্কা! সর্বনাশী! এ কী!

উল্কা অস্ফুটস্বরে বলিল—এখন অন্য কথা নয়, শুধু ভালবাসা—প্রিয়তম, আরও কাছে এস…তোমাকে ভাল দেখতে পাচ্ছি না

সেনজিৎ উল্কাকে দুই বাহু দিয়া বক্ষে তুলিয়া লইলেন। উন্মত্তের ন্যায় বলিলেন—

কিন্তু কেন উল্কা—কেন এ কাজ করলে?

উল্কার চোখের কোণ হইতে দুই বিন্দু অশ্রু গলিয়া পড়িল। সে নির্বাপিত স্বরে বলিল—

প্রিয়তম, আমি বিষকন্যা–

উল্কা আরও কিছু বলিবার চেষ্টা করিল কিন্তু বলিতে পারিল না; তাহার প্রাণবায়ু নির্গত হইল। সেনজিৎ তাহার মুখের উপর মুখ রাখিয়া হৃদয়বিদারক স্বরে ডাকিলেন—

উল্কা—উল্কা—উল্কা

Pages: 1 2 3 4 5 6
Pages ( 6 of 6 ): « পূর্ববর্তী1 ... 45 6

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Powered by WordPress